বুধবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ছিটমহল : না-রাষ্ট্রের না-নাগরিকের কথার কথা !



রেডক্লিফ নাকি ১৯৪৭ সালে ভারত নামক দেশটাকে তরমুজের ফালির মতো কেটে ভাগ করেছিল ! সৃষ্টি হল একদিকে নতুন ভারত, অপর দু-দিক পাকিস্তান (পশ্চিমের পাঞ্জাব ভেঙে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পুবের বাংলা ভেঙে পূর্ব পাকিস্তান, যা ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ নামে বাঙালির দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে)। একই সঙ্গে সৃষ্টি হল পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত-সমস্যা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যা।
ছিটমহল ব্যাপারটি কী ? ছিটমহল একটি দেশের সীমান্তবর্তী সেই এলাকা, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশের নাগরিকদের বসবাস রয়েছে। ছিটমহল মানে ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং বাংলাদেশের ভিতরে ভারতীয় ভূখণ্ড। আবার এমনও আছে, বাংলাদেশের ভিতরে ভারত, তার ভিতরে আবার বাংলাদেশ। যেমন কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল। এইভাবেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহলের সংখ্যা ১৬২। ভারতের পেটের  ভিতর বাংলাদেশ, বাংলাদেশের পেটের ভিতর ভারত। এইরকম অবাস্তব সীমান্ত ভাগাভাগি করা হল কেন ? দু-দেশের তৎকালীন নেতা-মন্ত্রীরা কেন এহেন কুৎসিত ভাগ মেনে নিলেন ! কেন তাঁরা আপত্তি করলেন না ? তার মানে কি দেশ ভাগাভাগিটা জমি দিয়ে হয়নি, মানুষ দিয়ে হয়েছিল ? দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল। সেই ভাগ নিশ্চয় সুব্রত, সেলিম, আনসারি, গোপালকে কেটেছিল। তাদের যার যেখানে জমি আছে সেটাই তাদের দেশের মালিকানায় গেছে বোধহয়। মীমাংসার কথা যে কেউ ভাবেনি সেটা বোঝাই যায়। কারণ দু-দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সদিচ্ছার চূড়ান্ত অভাব।

বারো ভূঁইয়াদের একজনের নাম ছিল হাজো ভূঁইয়া। হাজো ভূঁইয়ার ছিল দুই মেয়ে। জিরা আর হিরা। সংকোশ বা সরলডাঙ্গা নদী আর চম্পাবতী নদীর মাঝখানে চিকনা পর্বতাঞ্চলে তখন ছিল মাঙ্গোলীয়দের আধিপত্য। চিকনা পর্বতের অবস্থান ডুবরি থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে। ডুবরি হল বর্তমান আসামের গোয়ালপাড়া জেলা। চিকনা পর্বতের মঙ্গোলীয় গোত্রের সর্দার ছিলেন হারিয়া। হরিদাস মণ্ডল নামেই ইতিহাসে সবাই যাকে চেনেন। এই হরিদাস মন্ডল ছিলেন মাঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত হৈহৈ বংশের উত্তরাধিকার। চিকনা পর্বতে সংঘর্ষ এড়াতে, জাতিগত দাঙ্গা বন্ধ করতে এবং শান্তি বজায় রাখতে হাজো ভূঁইয়া হরিদাস মণ্ডলের সঙ্গে তার দুই মেয়ে জিরা ও হিরার বিয়ে দিলেন। জিরা ও হিরার বিয়ের পর জিরার গর্ভে জন্ম নিল মদন আর চন্দন। অন্যদিকে হিরার গর্ভে জন্ম নিল বিশ্ব সিংহ ও শিষ্য সিংহ। হরিদাস মণ্ডলের এই চার ছেলের মধ্যে বিশু ওরফে বিশ্ব সিংহ ছিল সবচেয়ে বেশি সাহসী, বুদ্ধিমান, প্রতাপশালী এবং ক্ষমতাপিয়াসু। পরবর্তীকালে বিশ্ব সিংহের হাতেই ১৫১৫ সালে কোচ রাজবংশের গোড়াপত্তন।
ভারতের কোচবিহার বা কুচবিহারের নামটি এসেছে এই কোচ রাজবংশী থেকে। আর বিহারশব্দটি এসেছে সংস্কৃত বিহারথেকে। যার অর্থ হল ভ্রমণ। কোচ রাজবংশীর রাজা বিশ্ব সিংহ চিকনা পর্বতে যতটুকু এরিয়া নিয়ে ভ্রমণ করতেন ততটুকুই হল কোচবিহারের আয়তন। কোচবিহারের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল রাজা বিশ্ব সিংহের পুত্র মহারাজ  নারায়ণের আমলে। তখন কোচবিহারের সীমানা ছিল উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ এলাকা, বর্তমান বাংলাদেশের রংপুরের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা, বিহারের কিষানগঞ্জ জেলা, এবং ভূটানের দক্ষিণপাশের কিছু এলাকা। কোচ রাজবংশীদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে স্বতন্ত্র ও টিকিয়ে রাখার জন্য কোচ রাজা স্বাধীন কমতপুর বা কামতাপুরী রাজ্য গড়ে তোলেন। ইতিহাসে সেটিই কামতা কিংডম। কামতা রাজ্যের দুটি প্রধান নগর বা ব্যাবসাকেন্দ্র ছিল। একটির নাম কোচবিহার। অপরটির নাম কোচ হাজো। পরবর্তীকালে কোচবিহারে ব্যাবসা-বাণিজ্যের অজুহাতে মোগলদের অনুপ্রবেশ ঘটল। আর কোচ হাজো নগরটি আহমদের দখলে চলে যায়। কামতা রাজ্যের তৃতীয় আর-একটি শাখা বা ব্যাবসাকেন্দ্র ছিল। সেটির নাম খাসপুর। খাসপুর পরবর্তীকালে কাচারি অঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
আসামের প্রথম ঐতিহাসিক নগরীর নাম কামরূপ। কামরূপ নগরীর অস্তিত্ব ছিল ৩৫০ সাল থেকে ১১৪০ সাল পর্যন্ত। মোট তিনটি রাজবংশ কামরূপ শাসন করেছিল। বর্মন রাজবংশ, মলেচ্ছা রাজবংশ এবং পাল রাজবংশ। কামরূপের রাজধানী ছিল যথাক্রমে প্রাগজ্যোতিষপুর, হারুপেশ্বরা এবং দুর্জয়া। যা বর্তমানের গুয়াহাটি, যার বিস্তৃতি ছিল গোটা ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকা, উত্তরবঙ্গ এবং বর্তমান বাংলাদেশের কিছু এলাকা। প্রাচীন বাংলার পাল রাজবংশের লোকজন ছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। আর কামরূপার পাল রাজবংশের লোকজন ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। হিন্দুদের প্রভাব বিস্তারের ফলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ধীরে ধীরে দক্ষিণে, পূর্বে এবং উত্তর-পূর্বের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। ছিটমহল সমস্যার শুরু আসলে তখন থেকেই। সীমানা সমস্যা মেটানোর জন্য কোচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজা ১৭১৩ সালে মোগল সম্রাটের নির্দেশে একটি সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ১৭১৩ সালের ওই সীমান্ত চুক্তি অনুসারেই পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলেও কোচবিহার ও রংপুরের সীমানা সেভাবেই ছিল।১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টির সময় রংপুর সেই সীমান্ত সমস্যা নিয়েই পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হল। আর কোচবিহার ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত স্বতন্ত্র ব্রিটিশ কলোনি হিসাবে থেকে পরে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হল।তদুপরি জনশ্রুতি আছে যে, কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে রংপুরের প্রশাসক দাবা খেলতেন। তারা দাবা খেলার বাজি হিসাবে এক একটা গ্রাম বাজি ধরতেন। বাজিতে একেকবার একেকজন হেরে এই জটিল সমস্যাটি নাকি তখনই তৈরি হয়েছে। কোচবিহার রাজ্যের কোচরাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ি ও ভুরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আটখানি থানা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কোচবিহার সংযুক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখণ্ড আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড যায় ভারতে। বস্তুত এই ভূমিগুলিই ছিটমহল নামে পরিচিত।
পূর্বেই বলেছি, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের খাতিরে আসমুদ্রহিমাচল অখণ্ড ভারত বিভক্ত করে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা। হাজির রেডক্লিফওই সময়ই  রেডক্লিফের মানচিত্র বিভাজন থেকেই ছিটমহলের উদ্ভব । এক দেশের ভূখণ্ডে থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। এতে এক অসহনীয় মানবিক সমস্যার উদ্ভব হয় । দুই প্রতিবেশী দেশে মোট ১৬২টি ছিটমহল আছে । এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল আছে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে। এসব ছিটমহলে বসবাসকারী জনসংখ্যা সংখ্যা ৫১ হাজার। সাম্প্রতিক (২০১১) জনগণনা অনুযায়ী ভারতের ছিটমহলে বসবাসরত লোকসংখ্যা ৩৭ হাজার এবং বাংলাদেশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ১৪ হাজার। ২৪২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দুই দেশের ছিটমহল। তার মধ্যে ভারতের ১৭ হাজার ১৫৮ একর। বাংলাদেশের ছিটমহলের জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলির অধিকাংশই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এ সবের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬, কুড়িগ্রামে ১২ ও নীলফামারিতে চারটি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি কোচবিহার ও চারটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন । ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই রেডক্লিফ লন্ডন থেকে ভারতে আসেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা অনুসারে ব্রিটিশ আইনজীবী রেডক্লিফের নেতৃত্বে সে বছরই সীমানা নির্ধারণ কমিশনগঠন করা হয়। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তিনদিন পর ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। দেশের সীমান্ত-এলাকাগুলিতে যাঁরা বসবাস করতেন তাঁরা ১৬ আগস্টের আগে পর্যন্ত জানতেন না কারা কোন দেশে আছেন। পশ্চিমবাংলার বহু এলাকাতে ১৬ আগস্টের পরেও জানতে পেরেছিল তাঁরা ভারতে, না পাকিস্তানে। কারণ কোনোরকম সুবিবেচনা ছাড়াই তড়িঘড়ি  করে এহেন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যথোপযুক্ত হয়নি।
অনেকে মনে করেন কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা এবং জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা বাগানের মালিকেরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণেই দেশভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে। সেই অভিশপ্ত প্রভাব আজও কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। ১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন চক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ির উত্তরদিকের অর্ধাংশ ভারত এবং বাংলাদেশ পাবে দক্ষিণদিকের অর্ধাংশ সহ সংলগ্ন এলাকা। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ির সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অচিরেই তা মুখ থুবড়ে পড়ল। এটা একটা বিষ্ময়কর বিষয় যে, ভারতের দশ কিলোমিটার ভিতরে বাংলাদেশের একটা গ্রাম আবার বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের একটা গ্রাম ! যারা সীমা নির্ধারণ করেছিলেন ১৯৪৭ সালেও তারা এসমস্ত বিষয়গুলির কেন সমাধান করেননি । ফলে বেরুবাড়ির দক্ষিণদিকের অর্ধাংশ এবং এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি। আজ তক।
ভারত স্বাধীন হল, ভাগও হল।  বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তিতেই ছিটমহল বিনিময়ের কথা উল্লেখ করা হয়। তৈরি হয় ছিটমহলের তালিকা। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা দেয় প্রচুর গরমিল। এরপরে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল চূড়ান্ত হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি -- পরিমাণ ১৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ১৩ একর। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আছে -- যার জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর। অর্থাৎ দু-দেশ মিলিয়ে সর্বমোট ছিটমহল হল ১৬২। ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার অধীনে ১৮টি ও লালমনিরহাট জেলার অধীনে ৩৩টি। এগুলো ভারতের কোচবিহার জেলার প্রশাসনিক সীমানার ভেতরে। অপরদিকে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ছিটমহলের ১১১টিই পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার। এগুলির মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি এবং নীলফামারিতে অবস্থিত ৪টি।ভারত বিভক্তের পর এই ৮টি এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কোচবিহার মিশে যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখন্ড আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখন্ড যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই হচ্ছে ছিটমহল। একথায় ছিটমহল মানে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের ভেতর ভারত বোঝায়।
১৯৫৮ সালে স্বাক্ষরিত হওয়া নেহেরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভারতের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার কারণে  বিলম্বিত হয়েছে ছিটমহল বিনিময়। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও আবার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ১৯৯২ সালের ২৬ জুন তিন বিঘা করিডোর দৈনিক দিনের বেলা ১ঘন্টা পরপর মোট ৬ ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে খুলে দেয়া হয়। ২০০১ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে তা দৈনিক সকাল ৭:৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭:৩০ পর্যন্ত ১২ ঘণ্টার জন্য উন্মুক্ত হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ এ স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে এটি ভারত ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেয়। মনমোহনের বাংলাদেশ সফর শেষে তিস্তা ও ট্রানজিট নিয়ে যত হতাশার সৃষ্টি হোক-না-কেন, ছিটমহল নিয়ে যে কাজে অনেক অগ্রগতি হয়েছে তা সরকারের বিভিন্ন মুখপাত্রের কথায় জানা যায়। এটি মনমোহন সিংয়ের সফরের সবচেয়ে সফল দিক।
তা সত্বেও এসব ছিটমহলে চিকিত্সার কোনো ব্যবস্থা কখনো ছিল না, চিকিত্সার জন্য কারোকে দ্বারস্থ হতে হয় বাংলাদেশে, আবার কারোকে ভারতে। কারণ ওরা তো কোনো দেশেরই নাগরিক নয় না ভারতের, না বাংলাদেশের। ওরা নেই-রাষ্ট্রের বাসিন্দা।ছিটমহলে জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি।বাচ্চাদের টিকা দেওয়ার সুযোগ বা  কোনটাই নেই ছিটমহলে, সচেতনতাও নেই। নিরাপদ প্রসবের কোনো ব্যবস্থা না-থাকায় প্রসবকালীন মৃত্যু ও অসুস্থতার হার খুব বেশি। স্বাস্থ্যসম্মত পানীয়জল বা শিক্ষাসহ সবগুলি মৌলিক অধিকারই তাদের নাগালের বাইরে। একদা নিকট-অতীতে ছিটমহলে খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও রাহাজানির স্বর্গরাজ্য ছিল। দু-দেশ থকে অপরাধীরা এসে আশ্রয় নিত এইসব ছিটমহলে। এখন তা অনেক কমে এসেছে। ছিটমহলগুলিতে দীর্ঘ ৬৭ বছরেও কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কোনো কার্যকর সমাধান হয়নি। ছিটমহলের আদিবাসীরা অতসব আইনের প্যাঁচ-পয়জার বোঝে না। তারা চায় নাগরিকত্ব। বেসরকারি সংস্থাগুলি ছিটমহল নিয়ে কোনো কাজ করেছে বলে শুনিনি। হয়তো সুদূরপ্রসারী লাভজনক নয় বলেই !
ভারত প্রথমবারে তিনবিঘা হস্তান্তরে ব্যর্থ হয়েছিলকারণ সুপ্রিম কোর্ট বাধা দিয়েছিল। তিনবিঘা নিয়ে পরের চুক্তি ছিল লিজের -- যাতে সুপ্রিম কোর্ট তা নিয়ে ঝামেলা না করতে পারে। করিডোর এখন দিনে ২৪ ঘণ্টার জন্য লিজ দেওয়া আছে সুতরাং, দহগ্রামের বাসিন্দারা যেমন খুশি যাতায়াত করতে পারেন সেখানে। এই ব্যাপারটা আরও চল্লিশ বছর আগেই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি প্রতিবেশী ভারতীয় গ্রামগুলোর আপত্তিতে। তাদের জন্য বিকল্প রাস্তা না হওয়া অবধি দু-দেশের জন্যই করিডর খোলা থাকবে এখন।ধাপারহাট থেকে মেখলিগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা তিনবিঘার উপর দিয়ে যায়। এই রাস্তার জন্য একটা ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে, যা তিনবিঘার উপর দিয়ে যাবে। তবে বাংলাদেশের নাগরিকদের অনেকে মনে করেন করেন, লিজ নাকি কোনো সমাধান হতে পারে না। লিজ যেমন দেয়া যায়, তেমন তা বাতিলও করা যায়। মনে করেন, আজকে ভারত সরকার তিনবিঘা বাংলাদেশকে লিজ দিলেও, আগামীকাল অভ্যন্তরীণ কোনো চাপে ভারত তা বাতিল করতে বাধ্যও হতে পারে। তিনবিঘা বাংলাদেশকে দিয়ে দিলে ধাপারহাট-কুচলিবাড়ি যে ছিটমহল হয়ে পড়বে বলেও অনেকে মনে করেন। খুশি এই কারণে যে, ফ্লাইওভার তার একটা ভালো সমাধান। কারণ, এর চেয়ে ভালো সমাধান নাকি হয় না। তিস্তার গতিপ্রবাহ বদলে গেলে বা নদী ভাঙন বৃদ্ধি পেলে এই সমাধানটিও টিকবে কি না সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দিহান !
বাংলাদেশ আর ভারতের ছিটমহল বিনিময় হলে সেখানকার অধিবাসীদের সামনে এসে দাঁড়াবে দুটি বিকল্প প্রথমত, নাগরিকত্ব বদলে তারা নিজের পুরোনো ভিটেতেই থেকে যেতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, নাগরিকত্ব অটুট রাখতে চাইলে তারা পুরোনো ভিটে ছেড়ে পুনর্বাসিত হবেন মূল দেশের মূল ভূখণ্ডে। ছিটমহলের বাসিন্দারা চাইছেন যে বিকল্পই হোক-না-কেন, তারা সবার আগে চান ছিটমহল বিনিময়ের কাজটি হোক। কেন-না রাষ্ট্রবিহীন, নাগরিক-সুবিধাহীন জীবন এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা।দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝে বোঝার উপায় নেই, কোন্ পর্যন্ত বাংলাদেশ, আর কোন্ টি ভারতের ছিটমহল। কাঁটাতারের বেড়া বা সীমানা প্রাচীর না-থাকায় মেঠোপথ দিয়ে অবাধ যাতায়াতে দুই জনপদের মানুষ মিলেমিশে একাকার। কাঁটাতারের বেড়া নেই। খুঁটি কিংবা সীমানা পিলার খুঁজেও লাভ নেই। দেখা মিলবে না কোনোটাই। তারপরও মানুষগুলো চারদিক থেকে বন্দি। চাইলেই যখন-তখন যেভাবে খুশি বের হওয়ার উপায় নেই। রাস্তা বলতে কোথাও জমির আইল ধরে চলা। আবার জলাভূমি থাকলে তার উপর তৈরি হয়েছে বাঁশের সাঁকো।কোথাও কোথাও সামান্য সীমানা খুঁটি আছে নামকাওয়াস্তে, তাও ঢাকা পড়ে অদৃশ্য হয়ে আছে প্রায়। মানুষদের দেখেও বোঝার উপায় নেই কে ভারতের, কে বাংলাদেশি।গত ৬৭ বছরে প্রভূত টানাপড়েনে অনেকেই বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছে, আবার কোনো কোনো বাংলাদেশিও এসেছে ভারতে। বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশের তেমন কোনো যোগাযোগ নেই, নেই সম্পর্কও। বাইরে গেলেই লোকজন তাদের ডাকে ছিটের লোক। এই পরিচয় শুনে স্বভাবতই নিজেদের গুটিয়ে নেয় এসব রাষ্ট্রহীন-নাগরিকহীন মানুষগুলো। বাংলাদেশ যেমন এদের নাগরিকত্ব দেয়নি, দেয়নি ভারতও।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার অবস্থা বেশ জটিল। প্রায় এক হাজার একর এলাকার এই ছিটমহলের মধ্যে হঠাৎই মাটি ফুঁড়ে জায়গা করে নিয়েছে ২৫ একরের এক চিলতে বাংলাদেশি ছিটমহল চন্দ্রখানা। উভয়সংকট অবস্থা ! তাদের একমাত্র পরিচয় তারা ছিটের মানুষভূমি থাকার পরও নিজ দেশে তাদের কোনো অধিকার নেই। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মধ্যে ছিটমহল সমস্যাটি প্রকট ও চিহ্নিত সমস্যাগুলোর অন্যতম। ছিটমহলের মালিক বাংলাদেশ না ভারত তা নির্ধারণেই বছরের পর বছর পার হয়ে গেছে। অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এসব ছিটমহলকে ঘিরে। ছিটমহলবাসীর কোনো ভোটাধিকার নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা হয় নিজেদের উদ্যোগেই। ঠিকমতো চিকিৎসা ও শিক্ষা কিছুই মিলছে না তাদের। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বিচার, পানীয় এবং আধুনিক সব ধরনের যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত।শিশুদের জন্য কোনো শিক্ষা এমনকি চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। রাজস্ব আদায় বা প্রশাসনিক কর্তৃত্ব না-থাকায় এলাকায় কোনো উন্নয়নমূলক কাজ হয় না। পাশের ভারতীয় হাটবাজারে উৎপাদিত পণ্যাদি বিক্রি করতে হয় কম মূল্যে। মূল ভূখন্ডের সঙ্গে কোনো ধরনের সরাসরি যোগাযোগ-ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি এবং ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে মায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঝে মধ্যে অনেকেই মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালান। এ চেষ্টার মূল উদ্দেশ্য জীবন ধারণের জন্য পণ্য ও ওষুধ যোগাড় করা। নির্বাচন আসন্ন হলেই ছিটমহলবাসীকে ভোটার করার আশ্বাস দেয়া হয় এবং অবশ্যই তা পরে আর বাস্তবায়ন হয় না। ছিটমহলগুলোতে জমি কেনাবেচা চলে সাদা কাগজে টিপসই দিয়ে। জমি রেজিস্ট্রির জন্য তাদের যেতে হবে বাংলাদেশ বা ভারতের কোনো রেজিস্ট্রি অফিসে, যা কোনোভাবেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাদের দিন-রাত গুজরান হয়। স্থানীয় সন্ত্রাসীরা প্রায়ই ছিটমহলবাসীর ফসল, বাঁশ ও দামি গাছ এবং গবাদিপশু জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ছিটমহলবাসীরা নিজভূমে থেকেও পরবাসী হয়ে আছে প্রায় সাত দশক জুড়ে।
জনপদগুলোর প্রায় লাখখানেক মানুষ রাষ্ট্রহীন নাগরিকহীন এক অবরুদ্ধ-অপমানিত-লাঞ্ছিত জীবনযাপন করছে। ইতিহাসের এই পুরনো জট খুলতে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের ছিটমহলগুলো বিনিময়ের কথা। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চিহ্নিতকরণ চুক্তিতে বলা আছে, ভূমি বিনিময়ের সময় ছিটের মানুষরা যেখানে থাকতে চাইবে, সেখানেই তাদের থাকতে দেওয়া হবে।বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের ছিটমহল হয়ে যাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড, আর বাংলাদেশের দিকেরটা হয়ে যাবে ভারতের ভূখণ্ড। এভাবে ছিটমহল বিনিময় হলে, ভারত থেকে দশ হাজার একর ভূমি বেশি পাবে বাংলাদেশ। প্রটোকলও সই হয়ে গেছে। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই জল ঘোলার কারণ। অতএব চুক্তি বাস্তবায়ন করতে ভারতকে সংধোশন করতে হবে সংবিধান। তাতে আপত্তি ভারতের বিরোধী দলগুলোর, কখনো সরকারে থাকা দল। এ সমস্যার সমাধানে জন্ম থেকেই সংগ্রাম করে আসছে ছিটমহলবাসীরা। ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার কালীরহাট এখন আন্দোলনকারীদের মিলনকেন্দ্র। ছিটমহল বিনিময় কমিটি বাংলাদেশ অংশের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এখানে অবস্থিত।ছিটমহল বিনিময় নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির কথা হয়েছে বলে জানা যায়। সুতরাং এবারে পার্লামেন্টের সংবিধান সংশোধনীর সমস্যা হওয়া উচিত নয়। ছিটমহল অন্য কোনো রাজ্যের সমস্যা নয় -- সমস্যা পশ্চিমবঙ্গের তথা কোচবিহার জেলার ইস্যু বা সমস্যা । পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকেও এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে সঙ্গে নিয়েদীর্ঘ ৬৭ বছর ধরে অনেক কূটনীতি হয়েছে। এবার আশু সমাধান চাইকুটনীতির কাছে মানবিকতা যুগ যুগ ধরে মার খেয়ে আসছে।আরও মার খাবে হয়তো, কোনো সন্দেহ নেই। ছিটমহলের বাসিন্দারা সেই অমানবিকতার মার খেয়ে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। সাম্প্রতিক এক চুক্তির পর পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে কিছুটা। তবে এটাও কোনো স্থায়ী সমাধান নয় বলে মনে করি।
২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মানমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারতের সমস্যা জর্জরিত ১৬২ টি ছিটমহলের সীমানা পুনঃনির্ধারণ, তিস্তা জল চুক্তি, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সুন্দরবন সংরক্ষণ, বাঘ সংরক্ষণ, উভয় দেশের উন্নয়ন ফ্রেমওয়ার্ক, বাংলাদেশ থেকে নেপালে ট্রানজিট সুবিধা, খনিজ সম্পদ আহরণ, মৎস্য সম্পদ আহরণ, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম বিনিময়, ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ফ্যাশ ডিজাইন এবং বাংলাদেশের বিজিএমইএ ইন্সটিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজির মধ্যে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন ভারতের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ঢাকায় না আসায় তিস্তা জল বিনিময় চুক্তি এবং ছিটমহল সংক্রান্ত সীমান্ত সমস্যা সমাধান চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি।
সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা জর্জরিত ১৬২ টি ছিটমহলের সীমানা পুনঃনির্ধারণ, ছিটমহলগুলোর জনগণের নাগরিকত্ব এবং যাতায়াত সুবিধা নির্ধারণে যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সেখানে ৫১ টি ছিটমহল ভারত নেবে যার আয়তন প্রায় ৭,১১০ একর। আর ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পাবে, যার আয়তন প্রায় ১৭,১৪৯ একর। চলতি বছরের (২০১৩ সালের) আগস্ট মাসে ভারতীয় লোকসভায় ছিটমহল সংক্রান্ত নতুন সীমানা নির্ধারণ বিলটি কংগ্রেস নের্তৃত্বাধীন জোট সরকার লোকসভায় পাশের জন্য উত্থাপন করলেও বিরোধীদল বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বাধার মুখে তা পাশ হয়নি। ভারতীয় লোকসভায় এই বিলটি পাশের জন্য কংগ্রেস নের্তৃত্বাধীন জোট সরকারকে দুই তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন। যা কংগ্রেসের নেই। ফলে বিলটি আর পাশ হল না।
১৫ তম লোকসভার মেয়াদ শেষ হল ৩১ মে ২০১৪ সালে।নির্বাচন হল ১৬ তম লোকসভার। ভারতীয় জনতা পার্টি বিপুল এবং নিরঙ্কুশ ভোটপ্রাপ্ত হয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এল। মনমোহন সরকারের আমলে একা মমতাই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে টেক্কা মেরে ছিটমহল সমস্যা এবং তিস্তা জল বিনিময় চুক্তি আটকে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন একথা সংবাদপত্রের দৌলতে সবাই জেনেছেন।কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ মোদি-সরকার এবং রাজ্যে নিরঙ্কুশ তৃণমূল-সরকার। এবার সেটাই দেখার কী হয়। তবে বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন ভারতের কোচবিহারে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় ছিটমহল বিনিময় এবং তিস্তার জলবণ্টন ইস্যুকে সামনে এনেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোচবিহারে এক নির্বাচনী জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ভারতের অভ্যন্তরে ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁর সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে।
তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘আমি ছিটমহলবাসীকে ভালোবাসি। তবে আমি ন্যায়বিচার চাই। আমি তাঁদের কথা চিন্তা না করে একতরফা কিছু করতে পারি না।ফরওয়ার্ড ব্লকের সর্বভারতীয় সাধারন সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস এক সাংবাদিক সম্মেলন করে ছিটমহল বিনিময় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন স্থলসীমান্ত চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুমোদন না দেওয়ার ফলে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করবে। ২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত প্রোটোকল চুক্তির বিষয়ে এদিন মি. বিশ্বাস বলেন, ছিটমহল বিনিময় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে অবস্থান নিয়েছেন তাতে বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তিগুলি উৎসাহ পাবে।
উল্লেখ্য, তৃণমূল কংগ্রেস এবং অসম গণপরিষদের সাংসদদের সঙ্গে প্রবল হাতাহাতির মধ্যেই গত ১৮ ডিসেম্বর ভারতের বিদেশমন্ত্রী সলমান খুরশিদ ছিটমহল বিনিময়ের জন্য স্থলসীমান্ত চুক্তিটির অনুমোদন সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনি বিলটি পেশ করেন। রাজ্যসভা অধিবেশনের শেষদিনে বাংলাদেশ সংক্রান্ত স্থলসীমান্ত চুক্তি বেল পেশের পর ওইদিন রাতেই ফেসবুকে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। ফেসবুকে ওয়াল পোস্ট করে কেন্দ্রীয় সরকারকে তোপ দেগে মমতা বলেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, লোকসভা ভোটের মুখে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে একটি দলের রাজনৈতিক গিমিক। রাজ্যের অনুমতি না নিয়ে এভাবে একতরফা বিল পেশ দমনমূলক প্রবণতা। আমরা এই বিল মানছি না। রাজ্য সরকার এটা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত করবে না। আমাদের রাজ্যের এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা এবং উত্তরপূর্বাঞ্চল এবং দেশের অন্য অংশের জন্য আমরা একযোগে লড়াই করবঅপরদিকে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বাংলাদেশের সঙ্গে  ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধী  নয় । তবে বিজেপি চায় ছিটমহল বিনিময় হোক জনসংখ্যা এবং প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ  করে।
বাংলাদেশ, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সুচারু নেতৃত্বে নিশ্চয় স্থায়ী সুরাহা হবে। চাই সুষ্ঠু এবং চূড়ান্ত ত্রিপাক্ষিক বৈঠক, ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ছাড়া ছিটমহল-সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। একই সঙ্গে সকল পক্ষকেই মনে রাখতে হবে দীর্ঘ ৬৭ বছর যাবৎ তিল তিল করে ছিটমহলেরা বাসিন্দারা নিশ্চয় কেউ বাংলাদেশ কেউ ভারতের প্রতি অনুগত হয়ে থাকবে।  উচিত হবে প্রতিটি মানুষের দেশ পছন্দ করার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া। ছিটমহলের বাসিন্দাদের যে বা যাঁরা যেই দেশের নাগরিক হতে চাইবে তাঁদের সেই দেশের নাগরিকের অধিকারদান প্রয়োজন। তা নাহলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থেকে যাবে, ক্ষোভ-বিক্ষোভ থেকে জন্ম নেবে নতুন সমস্যা। আমি স্বপ্ন দেখি আগামী কিছুদিনের মধ্যে ছিটমহলশব্দটি পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে।
                    @@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@

কোন মন্তব্য নেই: