শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আর্য-অনার্য সমাচার

কে আর্য ? কে অনার্য ? রামায়ণ ও মহাভারত তো আর্য-অনার্যরই কাহিনি। পুরাণগুলি তো আর্যদের জয়ের এবং অনার্যদের পরাজয়ের কাহিনি। ককেশীয় মহাজাতি গোষ্ঠীর একটি বৃহৎ নৃগোষ্ঠীই আর্যএদের আদি পুরুষ ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগে এরা আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ৭৫ হাজার বছর আগে এদের একটি দল আরব উপদ্বীপে পৌঁছায়। আর ৬০ হাজার বছরের ভিতরে এরা এশিয়া সংলগ্ন ইউরোপে বসতি স্থাপন করে। ৪০ হাজার বছরে ভিতরে ইউরোপের রাইন নদী থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫ হাজার বছরের দিকে এদের একটি  দানিয়ুব নদীর তীরবর্তী বিশাল তৃণাঞ্চলে বসবাস করা শুরু করে। ভারতে যারা প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে বলা হয় আর্য। ছোটো ছোটো দলে এরা এদের ভারতে প্রবেশের প্রক্রিয়াটি প্রায় ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত চলেছিল। আর্য নামে যাযাবর ও হানাদার এই জনগোষ্ঠী এখানে আসার পর উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে। এরা প্রায় একই সময়ে ইরান, মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং সব জায়গায় একইভাবে আর্য সভ্যতা, ভাষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়। এই ছিল ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সৃষ্ট তত্ত্ব, যা এমন এক মিথ বা অতিকথন সৃষ্টি করেছিল। অনেকে মনে করেন এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অবশ্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না-থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তা টিকে ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল আর্য সম্পর্কে এই অতিকথন কীভাবে সৃষ্টি হল ? নানা পণ্ডিতের নানা মতের মধ্যে এই মতটাই জার্মানিতে প্রবল হল যে আর্যরা হল নর্ডিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ (অবশ্য জার্মানরা নিজেরাও নর্ডিক জনগোষ্ঠীর)। পরে বিংশ শতাব্দীতে এসে জার্মানির এই প্রবল মতটি অ্যাডলফ হিটলার গ্রহণ করেন এবং অন্য সকল জাতির উপর জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজঘর সৃষ্টি করেন। তবে তিনি আর্য জাতির শত্রু হিসাবে সেমিটিক জাতিকে চিহ্নিত করেন এবং যুদ্ধের সময় জার্মানি ও অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ইহুদি জনগোষ্ঠীর মানুষের উপর ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে যেসব পণ্ডিত আর্যতত্ত্ব দাঁড় করালেন, তাঁরা সবাই হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঋগবেদ থেকে যাত্রা শুরু করেন। ঋগবেদের রচনাকারীরা যে আর্য, তা ঋগবেদ থেকে জানা যায়। ঋগবেদে আর্য নাম গৌরব বা মর্যাদার দ্যোতক। এমন কী আর্য নামের সঙ্গে সভ্যতার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও বোঝা যায়। প্রাচীন ইরানীয়দের ধর্মগ্রন্থ জেন্দ আবেস্তাতেও আর্য নামের সঙ্গে গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ জড়িয়ে আছে। ইরান নামের উৎপত্তিও আর্য (সংস্কৃত বা বৈদিক ভাষায় আর্য শব্দের উচ্চারণ হচ্ছে আরিয়) নাম থেকে। আর্য জাতি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করতে শুরু করে। তৎকালে বাংলা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বা উপরাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক রাষ্ট্র স্বশাসিত নৃগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। পূর্ববর্তী বৈদিক আর্যগণ উপনিবেশ গড়ার ক্ষেত্রে নানা কারণে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আসার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের কারণে উত্তরভারতে আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের সম্মিলনকে ত্বরান্বিত করেছিল দ্রুত। কালক্রমে উত্তরভারতে আর্যনামক পৃথক জাতিসত্তা বিলীন হয়ে গিয়েছিল। অনেকে মনে করেন, বর্তমানে ভারতবর্ষে আর্য নামে কোনো পৃথক নৃগোষ্ঠী নেই। তাই কি ? কিন্তু ধর্ম, ভাষাসহ সাংস্কৃতিক নানা উপাদান ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যামান রয়েছে। আরও অনেক গবেষণপত্র জমা পড়বে। ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন হবে। শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলিবে।

কোন মন্তব্য নেই: