মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫

দেবতার তত্ত্বতালাশ (দ্বিতীয়/শেষ পর্ব)



মিশরীয়দের মনেও প্রশ্ন জাগল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, মৃত্যু এবং জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। এভাবে তাঁদের মধ্যেও জন্ম নেয় ধর্মীয় বিশ্বাস। অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় দেবদেবতা। সমাজের বিবর্তন আর সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক গভীর। প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের চিহ্ন রেখে গেছেন পাথরে গায়ে, সমাধি ক্ষেত্রে, গড়েছিলেন দেবতাদের মূর্তি আর মন্দির। প্রাচীন মিশরে ২০০০ এরও বেশি দেবদেবী ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। স্থান ও কালের পার্থক্যে দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল ভিন্ন। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মিশরীয় রাজা বা ফারাও যারা পরবর্তীতে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। দেবতাদের কেউ কেউ ছিলেন ক্ষতিকরউল্লেখযোগ্য দেবতারা ছিলেন রা, তাহ, ওসিরিস, আইসি্স‌, হোরাস, সেথ, হাথর, আনুবিস, থথ, আটেন, আমুন, বাস্তেত। রা ছিলেন সূর্যের দেবতা রা দেবতা আবির্ভূত হতেন বিভিন্ন রূপে সকালে খেপরি, বিকালে আটুম কিংবা হোরাক্তি রূপে। রা-এর ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন ন্যায়বিচারের দেবী মাত। রা-এর দিবাকালীন আকাশভ্রমণ সব সময় নিরাপদ ছিল না আপেপ নামের এক সাপের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হত। আপেপের নিঃশ্বাসে মেঘের কালো কুণ্ডলী রা-কে ঘিরে ফেলত। কিন্তু শক্তিমান রা-কে এসব আটকাতে পারত না। সে সব কিছুকে পরাজিত করে ঠিকই তার পথ অতিক্রম করত। মাঝে মাঝে ক্ষতিকর দেবতারা এসে গিলে ফেলত রা-কে। তখন সূর্যগ্রহণ হত। কিন্তু রা ঠিক ঠিক শত্রুর পেটে কেটে বেরিয়ে আসত। আইসিস, মিশরীয় মাতৃদেবী। উর্বরতার দেবতা আমুন। ফারাওরা নিজেদের রা-এর সন্তান বলে দাবি করত।

মায়াদেরও দেবতাদের কথা আমরা জানতে পারছি। অর্থাৎ মায়াদেরও দেবতা-ধারণা আছে। হুনাহপু এবং এক্সবালেংখুয় হল মায়াদের দেবতা। এই যমজ দেবতার কাহিনি মায়া পুরাণের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়। এই কাহিনি যে কয়টি এপর্যন্ত জীবিত মায়া পুরাণ টিকে আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এরা সম্পর্কে দুই ভাই। মায়ার নরকের দেবতা হলেন এক্সিবালবা। এক্সিবালবা অত্যন্ত বদরাগী এবং নিষ্ঠুর চরিত্রের দেবতা ছিলেন। মায়ারা বিশ্বাস করতেন এক্সিবালেংখুয়ে এবং হুনাহপু ছিলেন যথাক্রমে পৃথিবীর শাসক এবং আকাশের দেবতা। পরে অবশ্য দুজনেই চন্দ্রদেব এবং সূর্যদেবে রূপান্তরিত হন। মায়ারা বিশ্বাস করত মায়া-সম্রাট আসলে হয় এক্সিবালেংখুয়ে, নয় হুনাহপু দেবের পুত্র।

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫

দেবতার তত্ত্বতালাশ (প্রথম পর্ব)



ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ সৃষ্টিকর্তাকে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই একই পংক্তিতে ফেলে ভেবে থাকেন। মুসলিমগণ তাদের ঈশ্বরকে 'আল্লাহ' এবং খ্রিস্টানগণ 'গড' বলে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কাছে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই এক। সবই কিন্তু এক নয়। দেবতা বা ঠাকুরের মধ্যে ঈশ্বর বা ভগবানের বিস্তর তফাত। কখনোই এক নয়। ঈশ্বর বা ভগবান নিরাকার, দেবতা বা ঠাকুর সাকার। ঈশ্বর বা ভগবান বিমূর্ত। দেবতা বা ঠাকুর মূর্তিমান। হিন্দু, গ্রিক, মিশরীয় এবং রোমানদের ছাড়া আর কোনো ধর্মেই দেবতা বা ঠাকুর নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদেরও ঈশ্বর বা ভগবান আছে। ভাষাভেদে ভিন্ন নামে। আল্লাহ, গড -- সব ঈশ্বরেরই প্রতিশব্দ। ঈশ্বর হল জাগতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থানকারী কোনো অস্তিত্ব | অনেকের মতে, এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক আছে মনে করা হয় --- যাকে গড, ঈশ্বর সহ বিভিন্ন ভাষা ও সংষ্কৃতিতে বিভিন্ন নাম এবং উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়। এই অস্তিত্বে বিশ্বাসীগণ ঈশ্বরের বা উপাসনা করেন। তাদেরকে আস্তিক বলা হয়| আর অনেকে ধারণাকে অস্বীকার করেন| এদেরকে বলা হয় নাস্তিক| আস্তিক সমাজে, ঈশ্বরের ধারণা ধর্ম ও ভাষা ভেদে ভিন্ন। ভাষাভেদে একে ইংরেজি ভাষায় গড, আরবি ভাষায় ইলাহ এবং বাংলা ও সংষ্কৃত ভাষায় ঈশ্বর ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। একজন সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারণাকে বলা হয় একেশ্বরবাদ| ভগবান এবং দেবতার মধ্যে পার্থক্য কী ? এককথায় হিন্দুরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভগবান নামে ডাকেন, তবে তারা বিশ্বাস করে ভগবান সরাসরি নিজে সবকিছু করেন না। তিনি একই সঙ্গে, একই সময়ে, নানান রূপে একাধিক কাজ সম্পন্ন করেন। ভিন্ন ভিন্ন কাজ করার সময় তার যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রকাশিত হয় সেটাকেই হিন্দুরা বলে দেবতা। যেমন ভাবা হয় ভগবান বিশ্বকর্মাদেবতা নাম নিয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। হিন্দুরা বিশ্বকর্মাকে দেবতা মনে করেন। একইভাবে বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ইত্যাদি। অপৌরুষেয় গ্রন্থগুলিতে বলা হয়েছে --- দেবতারা ঈশ্বরনন, দেবতারা ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ মানুষ!
গ্রিকদেবী অ্যাফ্রোদিতি
ঈশ্বর হলেন সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর কোনো শুরুও নেই এবং তাঁর কোনো শেষও নেই। আস্তিকগণ মনে করেন কোনো মানুষই কখনো ঈশ্বরকে দেখেনি। বামাক্ষ্যপা, রামপ্রসাদ, মোহম্মদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ, জিশু, ইব্রাহিম কেউ নয়। ঈশ্বরের ধারণা দিয়েছেন মাত্র। কারণ তিনি হলেন আত্মিক ব্যক্তি। আর এর অর্থ হল -- পৃথিবীতে বসবাসরত মাংসিক প্রাণী থেকে তাঁর জীবন আরও উন্নত প্রকৃতির। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে তা যেমন প্রমাণ করা যায় না, আবার তিনি যে নাই তাও প্রমাণ করা যায় না। বাইবেল বলে, বিশ্বাসেই এই সত্য আমাদের অবশ্য মেনে নিতে হবে যে, ঈশ্বর সত্যিই আছেন --বিশ্বাস ছাড়া ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা অসম্ভব, কারণ ঈশ্বরের কাছে যে যায়, তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ঈশ্বর আছেন এবং যারা তাঁর ইচ্ছামত চলে তারা তাঁর হাত থেকে তাদের পাওনা পায়” (ইব্রীয় ১১:৬)। যদি ঈশ্বর চান তাহলে খুব সহজে তিনি তো উপস্থিত হয়ে সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দিতে পারেন যে, তিনি আছেন। কিন্তু যদি তিনি তা করেন, তাহলে বিশ্বাসের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। সেইজন্য জিশু থোমাকে বলেছিলেন -- থোমা, তুমি কি আমাকে দেখেছ বলে বিশ্বাস করছ ? যারা না দেখে বিশ্বাস করে তারা ধন্য” (জোহন ২০:২৯)। তবে, তার মানে এই নয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। বাইবেল বর্ণনা করেছে --মহাকাশ ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করছে, আর আকাশ তুলে ধরছে তাঁর হাতের কাজ। দিনের পর দিন তাদের ভিতর থেকে বাণী বেরিয়ে আসে, আর রাতের পর রাত তারা ঘোষণা করে জ্ঞান। কিন্তু তাতে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভাষা নেই, তাদের স্বরও কানে শোনা যায় না। তবু তাদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে জগতের শেষ সীমা পর্যন্ত।”(গীতসংহিতা ১৯:১-৪)।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রথম যুক্তি : ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা দিয়েই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। ঈশ্বর সম্বন্ধে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে --তিনি এমন এক সত্ত্বা, তাঁর চেয়ে মহত্তর আর কিছু ভাবা যায় না।এভাবেও যুক্তি দেওয়া হয়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকার চেয়ে বরং তাঁর অস্তিত্ব থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো। তার মানে ধারণা করার মতো সবচেয়ে বড়ো সত্ত্বার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকে, তাহলে ঈশ্বর সম্পর্কে সবচেয়ে বড়ো কোনো ধারণা করা যায় না। করা না-গেলে ঈশ্বর সম্পর্কে এই সংজ্ঞার গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না।