বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বিবাহ কি অবাধ যৌনাচারের বৈধ ছাড়পত্র ?



আমার জীবনের সবচেয়ে ইনসিগনিফিকেন্ট ঘটনা হল আমার বিয়ে। সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী, সবচেয়ে ফালতু, ফেক, বাজে,  বেহুদা, বোকামো, বুদ্ধুমি, বালের ঘটনা হল আমার বিয়ে। সবচেয়ে অদরকারি, সবচেয়ে শিটি, ফাকিং ঘটনা এই বিয়ে।“ -- বলেছেন তসলিমা নাসরিন।
বিবাহ, অর্থাৎ বিয়ে সম্পর্কে শ্রীমতী তসলিমার এহেন মন্তব্য পাঠ করে চমকে গেলেন নাকি ! তসলিমার বক্তব্য যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে প্রশ্ন হল হাজার হাজার ধরে বিবাহ নামক ব্যবস্থা টিঁকে আছে কী করে ? সারা পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই বিবাহ-ব্যবস্থায় আস্থা রাখে। কারণ বিবাহ ছাড়া মানুষের অন্য কোনো পথ খোলা নেই। মানুষ ছাড়াও পৃথিবীর বুকে আরও কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণী আছে। এই কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণীরা কেউই বিয়ে করে না। কেবলমাত্র মানুষই বিয়ে করে। কেন ? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের এক্কেবারে শিকড়ে চলে যেতে হবে।

বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেই জেনেটিক বিবর্তন ঘটে সেটার সফল পরিসমাপ্তি হল একটা ভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি। এই ধারাবাহিক বিবর্তনের ধাপে ধাপে এইসব প্রজাতির ভেতরে আন্তঃনিষেক ঘটে, যখন যৌনজনন পদ্ধতিতে একটা অন্যটার সঙ্গে বংশবিস্তার করতে পারে না, তখনই সেটাকে আমরা পৃথক প্রজাতি বলি।
আজ থেকে প্রায় ৩৫ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম জীবনের সঞ্চার হয়েছিল। দিনে দিনে সেই প্রাণ উন্নত হয়ে আসে এককোশী অ্যামিবা। তারপর বিবর্তিত হতে হতে প্রথমে মধ্যবর্তী জীব এবং ধীরে ধীরে উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী ও সবশেষে মানুষের আবির্ভাব ঘটে আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীতে।
নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ও বিবর্তনের এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সকল জীব প্রজননকে বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে যৌন এবং অযৌন দুই উপায়ে তাদের বংশবিস্তার করতে থাকে। বর্তমান ইউক্যারিয়টদের প্রায় ৯৯.৯% জীব যৌন প্রজননকেই বেছে নিয়েছে। কেউ কেউ বলেন জীব যৌন প্রজনন হয়তো বেছে নিয়েছে, কারণ এটি আনন্দদায়ক। কিন্তু বিবর্তনবাদের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে এটি সম্ভব নয়। প্রথম ইউক্যারিয়ট যারা যৌন প্রজননে অংশ নেয় তাদের আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২০ কোটি বছর পূর্বে, যেখানে প্রথম প্রাণী যারা আনন্দ বা কষ্ট এরকম অনুভূতি বুঝতে পারে তারা এই পৃথিবীতে জন্ম নেয় প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে। তাই আনন্দ নিশ্চয় তাদের মূল লক্ষ্য ছিল না।  গবেষণা থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় তাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বাহকের যৌন প্রবৃত্তি বৃদ্ধি ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই স্বার্থপর জিন প্রভাব রাখে। অন্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য যত উৎসাহী হব আমরা, ততই এই জিনের সুবিধে। তাই যৌন মিলনে আনন্দের প্রক্রিয়া সম্ভবত এসব জিনের প্রভাবেই এসেছে।
যৌনমিলনের ফল হল সন্তানের জন্ম, অনিবার্য। এবং তার উত্তরাধিকার থেকে পরিবার বংশ, গোত্র, সমাজ, জাতি এবং সম্ভবত রাষ্ট্রেরও উৎপত্তি হয়েছে। আমাদের পুর্বপুরুষেরা যখন পরিবার প্রথা চালু করেছিল। তার আগে নর-নারীর যৌন সম্পর্ক ছিল নির্বিচার। প্রথমে আপন ভাই-বোনেদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হয়, পরে অন্যান্য রক্তের সম্পর্কের মধ্যেও বিয়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অন্তর্প্রজনন তখনই শেষ হয়ে যায়, গোত্র প্রথার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে।  একসময় দেখা গেল সন্তান উৎপাদনে পুরুষেরও ভূমিকা আছে। আর তখনই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে, সন্তানের পরিচয় নিশ্চিন্ত করতে, নারীদের আরও বিশেষভাবে বন্দিনী করার প্রয়োজনের তাগিদে, নিখুঁত এক-বিবাহের প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু সেটা একমাত্র নারীর ক্ষেত্রে, পুরুষের ক্ষেত্রে নয়। কারণ সন্তানের চিহ্নিতকরণ তখনই সম্ভব, যখন নারী একজন মাত্র পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক রাখবে। স্বাধীন অরণ্যচারিণী নারীকে খাদ্য ও নিরাপত্তা দিয়ে বশ করেছিল আদিম পুরুষ। বিনিময়ে পেয়েছিল আপন পিতৃত্বের নিশ্চয়তা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শৃঙ্খল আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয় এবং ধর্মের নিয়ম-নিগড়ের সহায়তায় নারীকে প্রায় পণ্যে পরিণত করে পুরুষ, নানা অছিলায়।
Proceedings of the Royal Society B জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশ হয় নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ অকল্যান্ড এর বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা এবং এখানেই তারা মত প্রকাশ করেন যে স্বার্থপর জিনগুলি প্রাণীদেরকে মিলনে উৎসাহিত করে, যাতে এরা অন্য জিনকে প্রভাবিত করতে পারে। মোদ্দা কথা, পিতামাতা উভয়ের শরীর থেকে জিন সন্তানের শরীরে আসার সময় দুই ভাগ হয়ে যায় এবং এই দুই অর্ধাংশ একত্র হয়ে সন্তানের জেনেটিক গঠন তৈরি করে। এই ভাগ হওয়ার সময় কিছু জিন বাদ পড়ে যায়। কিন্তু স্বার্থপরজিনগুলি এভাবে ভাগ হয় না। পিতা-মাতার শরীরে এই জিন থাকা মানে সন্তানের শরীরে এটা থাকবেই থাকবে। আর তাছাড়া এই জিনগুলি মানুষের শরীরে কোনও উপকারও করে না। এ কারণেই এদেরকে বলা হয় স্বার্থপর। নিউজিল্যান্ডের এই গবেষকরা ধারণা করেন যে, স্বার্থপর জিনগুলি শুধুমাত্র যৌন প্রজননের মাধ্যমেই ছড়াতে পারে। মানুষের শরীরে এই জিন থাকে তবে যত বেশি মানুষের সঙ্গে তিনি মিলিত হবেন তত বেশি পরিমাণে এই জিন ছড়ানোর সুযোগ পাবে। আর মানুষ যদি মিলনে আনন্দ পায় তবে তিনি অবশ্যই বেশি পরিমাণে এবং বেশি মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে চাইবেন। এ থেকেই ধারণা করা যায়, মানুষের যৌন প্রজননে যে আনন্দ লাভের প্রক্রিয়া তার পিছনে এই স্বার্থপর জিনের হাত আছে।
প্রাণীর বিবর্তনের ধারা : প্রায় ১৩৭৫ কোটি বছর আগে বিগব্যাং-এর সূত্রে বর্তমান বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী ১০০০ কোটি বছরের মধ্যে গ্যালাক্সিগুলোর বিন্যাস হয়েছিল বটে, কিন্তু সুবিন্যস্ত ছিল না। ১৩৬০ বছরের দিকে আমাদের ছায়াপথ তৈরি হয়েছিল। ৪৬০ কোটি বছরের দিকে আমাদের সৌরজগত দিকে তৈরি হয়েছিল, তখন মহাকাশেও তেমনি প্রক্রিয়া চলছিল। ৩৮০ কোটি বছর সময়কে অজীবীয় কাল বা Azoic হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। কারণ এই সময় প্রাণের বিকাশ ঘটেনি।  ৩৫০ কোটি বছর আগে প্রাণকোশের উপকরণসমূহের এই সমন্বয় হয়েছিল প্রায়  । এই আদি জীবকোশেরই একটি প্রজাতি হল আর্কেব্যাক্টেরিয়া বা Archaebacteria নামক জীবকণিকা।  ২৫০ থেকে ১৬০ কোটি বছরের ভিতরে সাগরের জলে একটি নতুন ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হল। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন সায়ানোব্যাক্টেরিয়া বা Cyanobacteriaএর অন্য নাম নীল-সবুজ শৈবাল (blue-green algae)এই সময়কে প্রোটেরোজোইক কালের প্রথমাংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই কালের শেষ সমাপ্তি সময় ধরা হয় ৫৪৪০ লক্ষ বছর আগে। ৫৪/৫৩ কোটি বছর থেকে ৫০ কোটি বছর পূর্বকাল পর্যন্ত ক্যাম্ব্রিয়ান অধিযুগ স্থায়ী ছিল। এই সময় পৃথিবীর অধিকাংশ স্থান জলে ঢাকা ছিল। এই অধিযুগে ক্রমান্বয়ে বাতাসে অক্সিজেন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে অক্সিজেন গ্রহণকারী প্রাণীকুলেরও বিকাশ হতে থাকে। এই সময়ই বহুকোশীয় প্রাণীজগতের (এনিমেলিয়া Animalia) সূচনা ঘটে।  তখন সাগরের জলে বিকশিত হয়েছিল অমেরুদণ্ডী প্রাণীকুল। বিশেষ করে স্পঞ্জ, ওয়ার্ম, ব্রায়োজয়ান, হাইড্রোজোয়ান, ব্র্যাকিওপোড, মোলাস্কা জাতীয় প্রাণীকূল। ৫২ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে মেরুদণ্ডী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল। ৪১ কোটি ৮০ লক্ষ বৎসর আগে  Sarcopterygians মাছের উদ্ভব ঘটে। ৪১ কোটি থেকে ৩৯ কোটি বছরের ভিতর এই মাছ দুটি ভাগে হয়ে যায়। এই ভাগ দুটি হল -- Coelacanths এবং Rhipidistians৩৯-৩৭ কোটি বছরের ভিতর  Rhipidistians বিভাজিত হয়ে সৃষ্টি হয় -- Lungfish এবং  Tetrapodomorphs৩৯ কোটি ৭০ লক্ষ বছর থেকে ৩৫ কোটি ৯০ লক্ষ বছরের ভিতরে Tetrapods উদ্ভব হয়েছিল। ৩২-৩১ কোটি বছর আগে কার্বোনিফেরাস অধিযুগে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল। ২৪ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে ইক্‌থায়োসর বা Ichthyosaur নামক সামুদ্রিক প্রাণীর বর্গের প্রাণীকুলের আবির্ভাব ঘটেছিল। ২২কোটি ৫০ লক্ষ বছরের দিকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। এই সময়ে কিছু উড়ন্ত সৃরীসৃপের আবির্ভাবও ঘটে। এই সময় কিছু কিছু স্থল সরীসৃপ পুনরায় জলচর হয়ে উঠে। ১৮ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে থেরাপ্সিডদের আবির্ভাব ঘটে। ১৬ কোটি বছর আগে জুরাসিক অধিযুগে ট্রেটাপড ডাইনোসর থেকে পাখির উৎপত্তি ঘটে। ক্রেটাসিয়াস অধিযুগের শেষে অর্থাৎ ৭ কোটি বছর আগে স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনের ধারায় প্রাইমেট বর্গের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তী ৬ কোটি ৫০ লক্ষ বছরের দিকে এসে প্রাইমেটদের আদর্শরূপ বিকশিত হয়েছিল। ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বৎসর পূর্বে এই বর্গের প্রাণীরা দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠলো। বিজ্ঞানীরা এই ভাগ দুটিকে উপবর্গ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এই উপবর্গ দুটি হল – (১) Strepsirrhin এবং (২) Haplorrhini
৫ কোটি ৮০ লক্ষ বছর আগে Haplorrhini উপবর্গটির প্রাণীকুল দুটি ভাগে বিভাজিত হয়ে যায় যায়। এই ভাগ দুটি হল -- Infraorder : Simiiformes এবং : Tarsiers৪ কোটি বছর আগে, সিমিফোর্মস ক্ষুদ্রবর্গের প্রাণীগুলো 'নব্য পৃথিবীর বানর' হিসাবে মূল ধারা থেকে পৃথক হয়ে যায়।  অবশিষ্ট থেকে যায় প্রাচীন পৃথিবীর বানর এবং এপসমূহ। সিমিফোর্মস ক্ষুদ্রবর্গের এই অবশিষ্ট প্রাণীগুলোকে বিজ্ঞানীরা নাম দেন ক্যাটারহৃনি বা Catarrhini৩ কোটি ৫০ লক্ষ বছর থেকে ২ কোটি ৯০ লক্ষ বছরের ভিতরে ক্যাটারহৃনি নামক উপক্ষুদ্রবর্গ (Parvorder) থেকে প্রাচীন পৃথিবীর বানর পৃথক হয়ে যায়। মূল ধারায় থেকে যায় Hominoidea নামক অধিগোত্রের (Superfamily) প্রাণীসমূহ। Hominoidea নামক অধিগোত্র গিবোন (Hylobatidae গোত্রের প্রাণীকূল) পৃথক হয়ে যায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ বছর পূর্বে। মানুষের বিবর্তনের মূলধারার রয়ে যায়  Hominidae গোত্রের (family) প্রাণীসমূহ। এই গোত্রের প্রাণীগুলির ভিতরে থাকল ওরাং ওটাং, গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও মানুষ (Homo sapiens)Hominidae গোত্রের প্রাণীকুলের ভিতরে প্রথম ১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে বিভাজিত হয়ে যায় গণের (Pongo) প্রাণীকূল। এই গণের প্রাণীদের সাধারণ নাম ওরাং ওটাং। এরপর দ্বিতীয় গণ গরিলা (Gorilla) পৃথক হয়ে যায় ৭০ লক্ষ বছর আগে। শেষপর্যন্ত রয়ে যায় মানুষের নিকটতম প্রজাতি শিম্পাঞ্জি। উল্লেখ্য শিম্পাঞ্জি প্যান (Pan) গণের প্রাণী।  প্যানগণের গণটি পৃথক হয়ে যায় ৬০ লক্ষ বছর আগে। ফলে Hominidae গোত্রের প্রাণিকুলের মূল ধারায় থেকে যায় মনুষ্য জাতি।

হোমোনিডি গোত্র থেকে মানুষ : প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমোনিডি গোত্রের একটি গণ (Genus) অস্ট্রেলোপিথেকাসের বিকাশ ঘটেছিল প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায়। এই গণের একটি প্রজাতি অস্ট্রেলোপিথেকাস ঘারি  এই প্রজাতিটি ৩০ থেকে ২৫ লক্ষ বছর আগে এই প্রজাতিগুলো আফ্রিকা মহাদেশে বসবাস করত। প্রায় ২৪,০০,০০০ থেকে ২৩,০০,০০০ বছর আগে একটি পৃথক গণের প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। এই গণকে বিজ্ঞানীরা নামক দিয়েছেন হোমো (Homo)এই গণের প্রজাতিগুলির আদি প্রজাতিটি হোমো হ্যাবিলিস। এই প্রজাতিটি বুদ্ধিমত্তার বিচারে অস্ট্রেলোপিথেকাস থেকে একটু উন্নত ছিল২৩ লক্ষ বছর আগে এরা পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে বিকাশ প্রাপ্ত হয়েছিল। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতিটিকে যথার্থ আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ মনে করেন না। ২০১০ সাল পর্যন্ত   হোমো হ্যাবিলিসকেই আদি মানব হিসাবে বিবেচনা করা হত।  ২০১০ সালে  হোমো গোটেনজেনসিস নামক একটি প্রজাতির জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এই প্রজাতিটিকে আদি মানুষের যথার্থ পূর্ব পুরুষ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এরও ২০ লক্ষ বছর আগে পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে বসবাস করত। এইসময়ে একই স্থানে অস্ট্রেলোপিথেকাস গণের অস্ট্রেলোপিথেকাস সেডিবা নামক প্রজাতিও বসবাস করত। ১৯ লক্ষ বছর আগে হোমো এরগাস্টার নামক একটি প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে। এর পাশপাশি আরও একটি হোমো রুডোলফেন্সিস নামক প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল।  হোমো রুডোলফেন্সিস নামক এই প্রজাতিটি প্রায় ১৯/১৮ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার কেনিয়া অঞ্চলের বসবাস করত। পৃথকভাবে বিকশিত এই দুটি প্রজাতি দুটি মানুষের পূর্বপুরুষ নয়। হোমোগণের আদি প্রজাতি হোমো হ্যাবিলিস বিবর্তনের ধারায় ১৮ লক্ষ বৎসর আগে হোমো জর্জিকাস নামক প্রজাতিতে পরিণত হয়েছিল। এই প্রজাতিটি আফ্রিকা ছেড়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল। ১৮ লক্ষ ৫০ বছর আগে আরও একটি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়, এর নাম হোমো অ্যারেক্টাস। এই প্রজাতিটিই আফ্রিকা ছেড়ে ব্যাপকভাবে এশিয়া এবং ইউরোপের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরা আফ্রিকা থেকে প্রথমে ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করে। এর আর একটি শাখা ইউরোপের ককেশাশ অঞ্চলে থেকে যায়। অবশিষ্ট অংশ চিন, ভারত, জাভা অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। এছাড়া মস্তিষ্ক ও দেহের কাঠামোগত পরিবর্তনের দিক দিয়ে এরা আধুনিক মানুষের মতো হয়ে উঠেছিল। এই প্রজাতিটিই স্থানের বিচারে বলা হয় জাভা মানব, পিকিং মানব।  প্রায় ১২ লক্ষ বছর থেকে ৮ লক্ষ বছর আগে এরা ইউরোপে বসবাস করত। ইউরোপে যে কয়েকটি মনুষ্য প্রজাতি বসবাস করত হোমো অ্যান্টেসেসর ছিল তার মধ্যে একটি।
মনে করা হয়, এরা ছিল হোমো এরগাস্টার এবং হোমো হাইডেলবার্গেনসিসের মধ্যবর্তী একটি প্রজাতি। কিন্তু Richard Klein সহ আরও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন হোমো এরগাস্টার থেকে বিবর্তিত হয়ে এই প্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছিল। বৈশিষ্ট্যে বিচারে এরা হোমো হাইডেলবার্গেনসিসের কাছাকাছি ছিল। অপরদিকে অনেকে মনে করেন হোমো অ্যান্টেসেসর আর হোমো হাইডেলবার্গেনসিস একই প্রজাতি।  ৬ লক্ষ বছর আগে আমরা পাই  হোমো হাইডেলবার্গেনসিস নামক প্রজাতিটিকে। মনে করা হয়, প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব ঘটে।  ১ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে মূল প্রজাতি থেকে একটি উপ-প্রজাতি পৃথকভাবে বিকশিত হয়। এই প্রজাতিটি হল Homo sapiens idaltu

১৮৬৫ সালে জার্মানির নেয়ানডার্থাল নামক স্থানে মাটি খনন করে পাওয়া গিয়েছিল একটি মাথার খুলি । বিজ্ঞানীদের মতে এই খুলিটি ছিল মানুষের পূর্বপুরুষের । মাটির যে স্তর থেকে এতি আবিষ্কৃত হয়, এর প্রাচীনত্বের হিসাব অনুযায়ী খুলিটির বয়স ছিল ৭৫ হাজার বছর । এটি ছিল নেয়ানডার্থাল মানুষ । ১৯০৮ সালে ফ্রান্সের শাপেন ওস্যা নামক গ্রামের কাছে একটি গুহা থেকে পাওয়া গিয়েছিল একটি আস্ত কঙ্কাল। এটি ছিল একটি মানুষের কঙ্কাল এবং তা নেয়ানডার্থাল মানুষের সমবয়সি এবং সমগোত্রীয় । ১৮৬৮ সালে ফ্রান্সের দোর্দোঞন অঞ্চল থেকে মানুষের ৫টি পূর্ণাবয়ব কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় । এগুলির উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট ১ ইঞ্চির মধ্যে । এদের মাথা ছিল লম্বা, মুখ থ্যাবড়া, পেশিবহুল প্রত্যঙ্গ ও চোয়াল ছিল উঁচু । চেহারার দিক দিয়ে পুরাপুরি আধুনিক মানুষ । কঙ্কালগুলোর বয়স ছিল মাত্র ৩০ হাজার বছর । এগুলোকে বলা হয় ক্রোমাঙ্গ মানুষ । বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে ১৫০ কোটি বছর পূর্বেকিন্তু মানুষের আধুনিক রূপ গঠিত হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার বছর আগে ।
৩০ হাজার বছর আগে সেই মানুষ ছিল উলঙ্গ, বন্য, পশুর মতো হিংস্র। কাজ : খাদ্য সংগ্রহ, খাদ্য গ্রহণ, যৌনমিলন, আত্মরক্ষার লড়াই, আক্রমণের প্যাঁচ-পয়জার এবং মৃত্যু। তখন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। যৌনক্রিয়া চলত অবাধে, যখন যার সঙ্গে খুশি। পেটের ক্ষুধার পরই জীবজগতে মানুষের যৌনাকাঙ্খার প্রবল চাহিদা। আর পাঁচটা বন্যপশুদের মতোই ছিল মানুষের অরণ্য-জীবন। বন্যপশুদের মতোই ছিল মানুষের যৌনজীবন।পুরুষরা ইচ্ছা করলেই যে-কোনো নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে পারত না। নারীরাই নির্বাচন করে নিত যৌনসঙ্গী। নারীকে কেন্দ্র করে বাধত লড়াই, রক্তপাত। জয়ী পুরুষই ঈপ্সিত নারীকে লাভ করত। নারীকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছিল দুই পুরুষের শত্রুতা। শত্রুতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হল গোষ্ঠী। গোষ্ঠী থেকে রাষ্ট্র।
যৌন-আবেগ ও আকর্ষণ প্রায় অদম্য। যার ওরপ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। প্রাণীজগতে মানুষই বোধ হয় একমাত্র জীব, যার যৌনক্ষুধা সীমিত নয়। অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সন্তান উৎপাদনের জন্য যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং স্ত্রী-পুরুষ একত্রে যৌনমিলনের মধ্য দিয়ে সন্তান উৎপাদনের প্রবৃত্ত হয়। অপরদিকে মানুষের ক্ষেত্রেই এরূপ কোনো নির্দিষ্ট ঋতু নেই। মানুষের মধ্যে যৌনমিলনের বাসনা সকল ঋতুতেই জাগ্রত থাকে। তাই যৌন আবেগ বা চাহিদাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বা সভ্য করতে নর-নারীর মিলন একদিন রূপ নেয় বিয়েতে। জগৎ সৃষ্টির বিবর্তনে আজকের বিয়ে বা পরিবার এভাবেই হয়তো এ সভ্যতা তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া আদিম মানুষের খাবার সংগ্রহ ছিল অতি দুরূহ ব্যাপার। মনে রাখবে হবে, মানুষ তখন পর্যন্ত কোনোরূপ উৎপাদন করতে শেখেনি। কৃষিকাজ জানত না। পশুমাংসই ছিল তাদের প্রধান আহার। ফলমূলও খেতে শিখেছিলযাই হোক, এই পশুশিকারের জন্য আদিম মানুষকে মাঝেমধ্যেই নিজের আশ্রয় ছেড়ে অনেক দূরে যেতে হত। এভাবে পুরুষেরা যখন দূরে থাকত,  তখন নারী সম্পূর্ণ অসহায় ও রক্ষকহীন অবস্থায় থাকত। অপর কোনো পুরুষ বলপূর্বক তুলে নিয়ে গেলে যুদ্ধ ও রক্তপাতের সৃষ্টি হত। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ল মালিকানানারীর স্থায়ী দখলদার। অতএব এহেন রক্তপাত এড়াতেই মনুষ্যসমাজে বিবাহ দ্বারা স্ত্রী-পুরুষের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়ছিল। জঙ্গল-জীবনে বিশেষত পুরুষকে নারীর সঙ্গে যৌনমিলনের জন্য কোনো বিনিময়-মূল্য দিতে হত না। শুধুমাত্র যৌন-চাহিদা মেটাতেই পুরুষকে বিয়ে নামক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হল। প্রকারান্তরে নারী-পুরুষ উভয়ই বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হল।
যৌনমিলনেই কাজ শেষ হয়ে যায় না পুরুষ মানুষের। পুরুষ মানুষকে একটি নারীর সারা জীবনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হল। শুধু নারীর দায়িত্বই নয়, দায়িত্ব নিতে হয় অসংখ্য সন্তানেরও। মহাভারতের শ্বেতকেতু উপাখ্যান থেকে পাওয়া যায়, শ্বেতকেতুই ভারতবর্ষে প্রথম বিবাহপ্রথার প্রবর্তন করেন। শ্বেতকেতুর উপাখ্যানটি এরকম- গৌতম বংশীয় উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু। শ্বেতকেতু একদিন দেখে তাঁর নিজের মাকে অপর একজন ব্রাহ্মণ সম্ভোগের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর পিতা উদ্দালকও তখন উপস্থিত ছিল। শ্বেতকেতু ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। কিন্তু পিতা পিতা উদ্দালক পুত্রকে শান্ত করেন, বলেন- এটি  চিরাচরিত ধর্ম। এ সময় শ্বেতকেতু অভিশাপ দেন যে, স্বামীকে অতিক্রম করে অন্যচারিণী হলে ভ্রূণ হত্যার পাপ হবে। অনুরূপ কারণে স্বামীরও একই পাপ হবে। এবং স্বামীর নির্দেশে সন্তান ধারণ করতে সম্মত না হলে সেই নারী একই রকম পাতকী হবে। অবশ্য বিবৃত কাহিনি থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তার আগেই শ্বেতকেতু পিতা-মাতার সঙ্গে পরিবারে বাস করতেন।
যৌনমিলনকে প্রাতিষ্ঠানিক বা সভ্যরূপে রূপ দান করতে সমাজকে অনেক ক্ষতিও স্বীকার করতে হয়েছে। এমনকি মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। যার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল বৈরাগ্যবাদ। বৈরাগ্যবাদীরা মনে করতেন যৌন-আবেগকে অবদমিত করতে পারলেই শান্তি পাওয়া যাবে,  আসবে মানবতার মুক্তি দূর হবে সমস্ত অশান্তি। সেজন্য মিসর, গ্রিস, ভারতবর্ষ, চিন, ইউরোপ এবং আরও বহু জায়গায় বৈরাগ্যবাদ সথেষ্ট প্রসারও লাভ করেছিল। এ ব্যাপারে বেশি জল ঢেলেছে খ্রিস্টবাদ। কারণ জিশু নিজেই বিয়ে করেননি, তিনি কখনোই মিলিত হননি কোনো নারীর সঙ্গে। তাই খ্রিস্ট পাদরিরা নারী থেকে এমনভাবে দুরে থাকতে আরম্ভ করে যে, তাঁরা মনে করতে নারী বা যৌনতা মানেই কোনো নোংরা ক্লেদময় অবস্থা।
যৌন-আবেদনের আর-একটি জটিল ব্যাপার হল, মানুষ যখন যৌনতাকে অবদমন করে তখন মেজাজ ও স্বভাব-প্রকৃতি ওই চেষ্টা সাধনাকে গ্রহণ করতে পারে না। কারণ মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি এমন যে, তার মধ্যে যৌন-আবেগ ও চাহিদা প্রচণ্ডভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার যৌন-চাহিদা পূরণ না-হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত যে স্বাভাবিক হতে পারে না। ১৯৫৭ সালের মার্চে ব্রিটেনের একদল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এগারো হাজার মানসিক রোগীর কেস হিস্ট্রি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দেন যে, “মনের শান্তি ও নানাবিধ মানসিক রোগ থেকে রক্ষা পেতে বিয়ের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।
প্রাচীন কাল থেকে বৈরাগ্যবাদের পাশাপাশি অবাধ যৌনাচারের ধারণটিও বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। অবাধ যৌনাচারের যুক্তি হল,  যেহেতু যৌনাকাঙ্খা প্রাকৃতিক তাই তাতে বাধ সাধার কোনো অবকাশ নেইঅন্যান্য প্রকৃতিগত আকাঙ্খার মতো তারও (যৌনাকাঙ্খা) পরিতৃপ্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে সঠিক ও বেঠিক এবং বৈধ অবৈধতার বাধ্যবাধকতা আরোপ নিরর্থক।
বাৎস্যায়ন বলেছেন -- শতায়ুব পুরুষঃ”; অর্থাৎ পুরুষের আয়ু (আনুমানিক) একশো বছর। এই একশো বছরকে তিন ভাগে ভাগ করে বাল্য, যৌবন, বার্ধক্যে ত্রিবর্গের (ধর্ম, অর্থ, কাম) সেবা করা বিধেয় বলা হয়েছে। বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষা ও সেই সঙ্গে অর্থোপার্জনের উপায় শিক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যা লাভ হওয়া পর্যন্ত ব্রহ্মচর্যের সেবাই কর্তব্য। তারপর বিবাহ করে গৃহস্ত জীবন যাপন ও কামের সেবা করা এবং বার্ধক্যে ধর্ম ও মোক্ষ অর্থাৎ ধর্ম চর্চা করে মোক্ষলাভের উপায় চিন্তা করা কর্তব্য। বয়সের বিভাগ সম্পর্কে বলা হয়েছে – “আ ষোড় ষাদ ভবেদ বালো যাবৎ ক্ষীরানুবর্তকঃ। মধ্যম সম্প্রতি যাবৎ পরত বৃদ্ধ উচ্যতেঅর্থাৎ ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত বালক বলা হয়, সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত মধ্যম এবং তারপর বৃদ্ধ। এই মধ্যম শব্দে এখানে যৌবনকাল ও প্রৌঢ়ত্বকে একসঙ্গে ধরা হয়েছে। তার কারণ পুরুষ সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত কাম সেবা ও সন্তান উৎপাদনে সমর্থ। কৌটিল্য বলেছেন – “দ্বাদশবর্ষা স্ত্রী প্রাপ্তব্যবহারা ভবতি। ষোড়শবর্ষঃ পুমানঅর্থাৎ যে স্ত্রীর বয়স বারো বছর পার হয়েছে সে প্রাপ্তব্যবহারা অর্থাৎ সাবালিকা এবং ষোলো বছর বয়সি পুরুষ সাবালক।
বস্তুত বিবাহ বা বিয়ে হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দুজন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মে সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার হেরফের থাকলেও সাধারণভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দুজন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে আচার- অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। বহু সংস্কৃতিতেই বিবাহ দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কিছু সংস্কৃতিতে বহুগামী বিয়ে ও কিছু সংস্কৃতিতে সমকামী বিয়েও স্বীকৃত। বিয়ের মাধ্যমে পরিবারের সূত্রপাত হয়। এছাড়া বিয়ের মাধ্যমে বংশবিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিয়ের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কিত পুরুষকে স্বামী এবং নারীকে স্ত্রী  হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। স্বামী ও স্ত্রীর বিবাহিত জীবনকে "দাম্পত্য জীবন" হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত, অঞ্চলভিত্তিক অনেক বৈসাদৃশ্যও লক্ষ করা যায়। একইভাবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিবাহ মূলত একটি ধর্মীয় রীতির পাশাপাশি একবিংশ শতাব্দীতে বিবাহ রেজিস্ট্রি করতে হয়, এটি একটি আইনী প্রথাও বটে। ধর্মীয়ভাবে বিবাহ-বহির্ভুত যৌনসঙ্গম অবৈধ বলে স্বীকৃত এবং ব্যাভিচার হিসাবে অভিহিত একটি পাপ ও অপরাধ, কোথাও কোথাও আইনের চোখেও অপরাধ। তা সত্ত্বেও ব্যাপকভাবে বিবাহ-বহির্ভুত যৌনসঙ্গম অবলীলায় হচ্ছে।
সারা পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার ধর্ম বর্তমান। হাজার হাজার ধর্মের হাজার হাজার বিবাহরীতি। সব আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয়। অতএব মোটামুটি প্রধান প্রধান ধর্মগুলির বিবাহরীতি আলোকপাত করা যাক।
হিন্দু বিবাহরীতি : হিন্দুশাস্ত্রে আট প্রকারের বিবাহরীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন –- (১) ব্রাহ্ম বিবাহ, (২) দৈব বিবাহ, (৩) আর্য বিবাহ, (৪) প্রাজাপত্য বিবাহ, (৫) অসুর বিবাহ, (৬) গান্ধর্ব বিবাহ, (৭) পিশাচ বিবাহ এবং (৮) রাক্ষস বিবাহ। হিন্দু বিবাহে যৌতুকের কোন স্থান নেই এবং বহির্ভূতএবং বিবাহর্পূর্ব অনৈতক সম্পর্ক করা নিষিদ্ধ।
(১) ব্রাহ্ম বিবাহ : ব্রাহ্ম বিবাহ ছিল ব্রাহ্মণ্য আচার সম্পৃক্ত বিবাহ। ব্রাহ্ম বিবাহ  রীতি অনুসারে কোনো বেদজ্ঞ সৎ চরিত্র ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে এনে যৌতুকাদি সহ কন্যা সম্প্রদান করা হত। এই বিবাহে মন্ত্র উচ্চারণ সহ যজ্ঞানুষ্ঠান করে স্ববস্ত্রা ও সুসজ্জিতা কন্যাকে বরের হাতে সম্প্রদান করা হত। বিবাহ যজ্ঞাগ্নির সামনে বর-কনে উভয়েই তিনবার যজ্ঞাগ্নি প্রদক্ষিণ করতে করতে বলত -- তুমি আমি, আমি তুমি। তুমি স্বর্গ, আমি পৃথিবী। আমি সাম, তুমি ঋক। এসো আমরা বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করি।মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “আচ্ছাদ্য চার্চয়িত্বা চ শ্রুতিশীলবতে স্বয়ম্।/আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্তিতঃ।। (৩/২৭)।
(২) দৈব বিবাহ : জ্যোতিষ্টোমাদি বিস্তৃত যজ্ঞ আরম্ভ হলে সেই যজ্ঞে পুরোহিতরূপে যজ্ঞকার্যনিষ্পাদনকারী ঋত্বিককে যদি সালঙ্কারা কন্যা দান করা হয়, তাহলে এইরকম বিবাহকে মুনিগণ দৈব নামক শাস্ত্রবিহিত বিবাহ বলে থাকেন। (ব্রাহ্মবিবাহে নিঃশর্তভাবে কন্যাদান করা হয়। দৈববিবাহে কন্যাদান করা হয় বটে, কিন্তু যজ্ঞকর্মে নিযুক্ত ঋত্বিকের কাছ থেকে পূণ্যফল লাভের সম্ভাবনা থাকায় এই কন্যাদানটিকে একেবারে শুদ্ধদানের পর্যায়ে ফেলা যায় না)। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “যজ্ঞে তু বিততে সম্যগৃত্বিজে কর্ম কুর্বতে।/অলংকৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্মং প্রচক্ষতে।।  (৩/২৮)।
(৩) আর্য বিবাহ : আর্য বিবাহ প্রাচীন ঋষিদের মধ্যে যে বিবাহ প্রচলিত ছিল তার নাম ছিল আর্য বিবাহ। এই বিবাহে যৌতুকের পরিবর্তে নামমাত্র কন্যামূল্য হিসাবে একটি গোরু এবং একটি ষাঁড় দেওয়া হত। আর্য বিবাহে ধর্মীয় কাজে ব্যবহার হওয়ার জন্য পাত্র কন্যার পিতাকে এক জোড়া গোরু অথবা মহিষ প্রদান পূর্বক তাহার কন্যাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করত। যা পণপ্রথা নামে প্রচলিত ছিল। কন্যার পিতাকে টাকা, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি প্রদান করতে হত। এমনকি কন্যাপণএকটি আভিজাত্যের প্রতীকও ছিল। অনেক ধনাঢ্য ব্যাক্তি পণ প্রদানের মাধ্যমে উচ্চবংশীয় কন্যাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতেন। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “একং গোমিথুনং দ্বে বা বরাদাদায় ধর্মতঃ।/কন্যাপ্রদানং বিধিবদার্ষো ধর্মঃ স উচ্যতে।। (৩/২৯)।
(৪) প্রাজাপাত্য বিবাহ : প্রাজাপাত্য বিবাহ রীতি অনুসারে পাত্র নিজে অথবা তাহার অবিভাবক কন্যার পিতার নিকট নিজে প্রার্থনা করে অনুমতি লাভ করলে পরে কন্যার পিতার আমন্ত্রেণের মাধ্যমে তার কন্যাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করত। এই নিয়মেই এখন সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিবাহ করেন। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “সহোভৌ চরতাং ধর্মমিতি বাচানুভাষ্য চ।/কন্যাপ্রদানমভ্যর্চ্য প্রাজাপত্যো বিধিঃ স্মৃতঃ।। (৩/৩০)।

উপরে বর্ণিত চার প্রকারের বিবাহ ধর্মশাস্ত্রে অনুমোদিত বিবাহরূপে স্বীকৃত হয়।
(৫) আসুর বিবাহ : আসুর বিবাহ  কন্যার পিতা পাত্রপক্ষের কাছে কন্যার মূল্য বা পণ দাবি করত, যে সবচেয়ে বেশি পণ বা মূল্য প্রদান করত তার কাছে কন্যা সম্প্রদান করা হত। এইরূপ বিয়েতে পয়সা দিয়ে কন্যা ক্রয় করা হত। অর্থাৎ বিয়েতে মেয়ের বাবাকে কিংবা তার অভিভাবককে পণ বা মূল্য দিতে হত। মাদ্রির সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহ এবং দশরথের সাথে কৈকেয়ীর বিবাহ-দুটি এই বিবাহের দৃষ্টান্ত হতে পারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “জ্ঞাতিভ্যো দ্রবিণং দত্ত্বা কন্যায়ৈ চৈব শক্তিতঃ।/কন্যাপ্রদানং স্বাচ্ছন্দ্যাদাসুরো ধর্ম উচ্যতে।। (৩/৩১)।
(৬) গান্ধর্ব বিবাহ : গান্ধর্ব বিবাহ পাত্রপাত্রীর স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে। এই ধরনের বিয়ে প্রেমঘটিত বিয়েরই  প্রাচীন রূপ। ছেলে-মেয়ে তাদের স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোনো দেবতার সামনে মালাবদল বা অন্য রূপে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে। এই রূপ বিবাহকে সামাজিক রূপদান বা অনুষ্ঠানাদি পালনে কোনো প্রথাগত বাধা নেই। পাত্রপাত্রীর ইচ্ছায় এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হত। অর্থাৎ পাত্রপাত্রী স্বেচ্ছায় একে অপরকে মাল্যদানের মাধ্যমে যে বিবাহ করত, তাকে বলা হত গান্ধর্ব বিবাহ । মহাভারতের নায়কদের মধ্যে অনেকেই গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেছিলেন, যেমন -- অর্জুনের সঙ্গে উলুপি, চিত্রাঙ্গদার বিবাহ, দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার বিবাহ প্রভৃতি। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “ইচ্ছয়ান্যোন্যসংযোগঃ কন্যায়াশ্চ বরস্য চ।/গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুন্যঃ কামসম্ভবঃ।। (৩/৩২)।
(৭) রাক্ষস বিবাহ : হিন্দু ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা বর্ণের লোকদের মধ্যে রাক্ষস বিবাহ অধিক প্রচলিত ছিল। বলপূর্বক কন্যা ছিনিয়ে নিয়ে রাক্ষস বিবাহ সম্পন্ন হত। যদি কোনো রূপসি নারীকে লাভ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে, তখন তাকে কোনো বাগান বা পথ থেকে লোকজনের সাহায্যে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে পরে ব্রাহ্মণ ডেকে হোম করে বিয়ে করার নাম রাক্ষস বিবাহ। পুরাকালে ক্ষত্রিয় রাজারা এইভাবে বাহুবলে বহু নারীকে ধরে এনে বিয়ে করত। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “হত্বা চ্ছিত্ত্বা চ ভিত্ত্বা চ ক্রোশন্তীং রুদতীং গৃহাৎ।/প্রসহ্য কন্যাহরণং রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে।। বাধাপ্রদানকারী কন্যাপক্ষীয়গণকে (আহত) নিহত করে, (অঙ্গ) প্রত্যঙ্গ ছেদন করে এবং গৃহ প্রাচীর প্রভৃতি ভেদ করে যদি কেউ চিৎকারপরায়ণা ও ক্রন্দনরতা কন্যাকে গৃহ থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে, তবে একে রাক্ষস বিবাহ বলা হয়। (৩/৩৩)।
(৮) পৈশাচ বিবাহ : যদি কোনো তরুণ-তরুণীর মধ্যে গান্ধর্ব বিয়ে করার উপায় না থাকে, তাহলে আর-এক যে উপায় প্রচলিত ছিল তা হল পৈশাচ বিবাহ। পৈশাচ বিবাহ বাৎস্যায়নের যুগেও ছিল। দুজনে আগে প্রেম করবে, তারপর সুযোগ বুঝে গোপনে নারীকে কোনো মাদকদ্রব্য খাইয়ে উত্তেজিত করে যৌনমিলন করবে। এরপর পুরোহিত ডেকে সেই নারীকে বিয়ে করবে। কোনো কুমারী কন্যাকে মাদকদ্রব্য সেবনে নিদ্রিত অবস্থায় বা মাতাল করে কেউ যদি তাকে ধর্ষণ করত, তবে সেই ব্যক্তি সেই নারীর স্বামী হতে পারত। তবে এই বিয়ে শুধু অননুমোদিতই নয়, অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিল। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “সুপ্তাং মত্তাং প্রমত্তাং বা রহো যত্রোপগচ্ছতি।/স পাপিষ্ঠো বিবাহানাং পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।। (৩/৩৪)। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কৃষ্ণচরিত্রগ্রন্থে চতুর্থ  খণ্ডে লিখেছেন, “অষ্টপ্রকার বিবাহে সকল বর্ণের অধিকার নাই। ক্ষত্রিয়ের কোন্ কোন্ বিবাহে অধিকার, দেখা যাউক। তৃতীয় অধ্যায়ের ২৩ শ্লোকে কথিত হইয়াছে, “ষড়ানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোহ বরান্ইহার টীকায় কুল্লূটভট্ট লেখেন, “ক্ষত্রিয়স্য অবরানুপরিতনানাসুরাদীংশ্চতুরঃ।তবে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে কেবল আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ –- এই চার প্রকার বিয়ে বৈধ। বাকি সবকটিই অবৈধ।
কিন্তু ২৫ শ্লোকে আছে — “পৈশাচশ্চাসুরশ্চৈব ন কর্তব্যৌ কদাচন।। পৈশাচ ও আসুর বিয়ে সকলেরই অকর্তব্য। অতএব ক্ষত্রিয় পক্ষে কেবল গান্ধর্ব ও রাক্ষস -- এই দ্বিবিধ বিবাহই বিহিত রহিল।  তন্মধ্যে, বরকন্যার উভয়ে পরস্পর অনুরাগ সহকারে যে বিবাহ হয়, তাহাই গান্ধর্ব বিবাহ। এখানে সুভদ্রার অনুরাগ অভাবে সে বিবাহ অসম্ভব, এবং সেই বিবাহ কামসম্ভব”, সুতরাং পরম নীতিজ্ঞ কৃষ্ণার্জুনের তাহা কখনও অনুমোদিত হইতে পারে না। অতএব রাক্ষস বিবাহ ভিন্ন অন্য কোন প্রকার বিবাহ শাস্ত্রানুসারে ধর্ম্য নহে ও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রশস্ত নহে; অন্য প্রকার বিবাহেরও সম্ভাবনা এখানে ছিল না। বলপূর্বক কন্যাকে হরণ করিয়া বিবাহ করাকে রাক্ষস বিবাহ বলে। বস্তুতঃ শাস্ত্রানুসারে এই রাক্ষস বিবাহই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে একমাত্র প্রশস্ত বিবাহ। মনুর ২৪ শ্লোকে আছে— “চতুরো ব্রাহ্মণস্যাদ্যান্ প্রশস্তান্ কবয়ো বিদুঃ।/ রাক্ষসং ক্ষত্রিয়স্যৈকমাসুরং বৈশ্যশূদ্রয়োঃ।।  যে বিবাহ ধর্ম্য ও প্রশস্ত, আপনার ভগিনীর ও ভগিনীপতির গৌরবার্থ নিজকুলের গৌরবার্থ, কৃষ্ণ সেই বিবাহের পরামর্শ দিতে বাধ্য ছিলেন। অতএব কৃষ্ণ অর্জুনকে যে পরামর্শ দিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার পরম শাস্ত্রজ্ঞতা, নীতিজ্ঞতা, অভ্রান্তবুদ্ধি এবং সর্বপক্ষের মানসম্ভ্রম রক্ষার অভিপ্রায় ও হিতেচ্ছাই দেখা যায়।
বাৎসায়ন তাঁরকামশাস্ত্রম্”-এ চেহারা ও গণাগুণ অনুযায়ী নারীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন--
(
) উত্তমা কুমারী, () মধ্যমা কুমারী, () অধমা কুমারী।
উত্তমা কুমারীর লক্ষণ : যে কন্যা শ্যামাঙ্গী, যার কেশ মনোহর, দেহে অল্প অল্প লোম বিরাজমান সে কন্যা মনোহারিনীমনোহর ভ্রূযুক্তা, সুশীলা, মৃদু গতিশালিনী। সুদন্তা, পঙ্কজ নয়না। যার কটি ক্ষীণ, যার কথা অতি উত্তম ও মিষ্টভাষী বলে মনে করবে। যে কন্যা কুলের কল্যাণকারিণী। যার দেহ নাতিদীর্ঘ, নাতিহ্রাস। যার বর্ণ শ্যাম, দেহ ক্ষীণ, গতি হংসিনীর মতোকরতল রক্তপদ্মের মতো, স্তন নাতিউচ্চ, নাতি ক্ষুদ্র, যোনিপৃষ্ঠ কচ্ছপাকৃতি, ধর্মপরায়ণ, পতিব্রতা, তাকেই উত্তমা রমনী বলে মনে করা চলে।
মধ্যমা কুমারীর লক্ষণ : যার শরীর মধ্যবিত্ত, কেশ দীর্ঘ। যে রমণী সর্বদা আলস্য পরিত্যাগ করে। কী সুখ কী দুঃখ উভয় যার সমজ্ঞান। যে সর্বদা হাসি মুখে কথা বলে, যার নাভিদেশ গভীর, যে রমণী সকলের প্রতি মিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করে, যে সদাচারপরায়ণ, যার মতি সর্বদা ধর্মে প্রতিষ্ঠিত। অল্পমাত্র আহারেই যার তৃপ্তিবোধ হয়, সর্বজীবে যার আত্মজ্ঞান, যে রমণী গুরুভক্তিপরায়ণ, দেবপূজায় নিযুক্ত ও দ্বিজ সেবায় রত এবং যে রমণী সাধ্বী, তাকেই মধ্যমা রমণী বলে।
অধমা কুমারীর লক্ষণ : অধমা কুমারী হস্ত ও পদ ক্ষীণ, চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ, দন্ত সুদীর্ঘ ও বিরল (ফাঁকা ফাঁকা) এবং উদর বৃহৎ হয়ে থাকে। এর শরীর অধিক লোমে পরিপূর্ণ। এই রমণী অতি উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করে এবং বেশি কথা বলে। এই রমণী অতি নির্লজ্জ, সদা ক্রোধপূর্ণ এবং চিত্ত সদা বিকল। অধমা কুমারীর হস্ত ও পদে দীর্ঘ এবং কেশ খর্ব হয়ে থাকে। এদের সমস্তই কুলক্ষণে পরিপূর্ণ। অধমা রমণী কদাচ স্বধর্মবিহিত সদাচারের অনুষ্ঠান করে না। সুতরাং রমণীকে পরিত্যাগ করা কর্তব্য।

যে নারী বিবাহের উপযুক্ত নয় : যেখানে অধমা রমণী বাস করে, লক্ষ্মী কখনও সেখানে বিরাজ করেন না। যে-লোক এহেন কন্যাকে বিবাহ করে, তাকে আজীবন মহাদুঃখ ভোজ করতে হয় এতে সন্দেহ নাই। অতএব সব সময় এরূপ নারীর সংসর্গ ত্যাগ করা উচিত। যার সর্বাঙ্গ লোমে পরিপূর্ণ সেরূপ কন্যা কুলে উঁচু হলেও বিবাহযোগ্যা নহে। সে কন্যা কুলক্ষণাযুক্তা।
যে কন্যা শুভ্রবর্ণা, অধিকাঙ্গী, রোগিণী, লোমশূন্য অধিক রোমান্বিত, বাচাল, পিঙ্গলবর্ণা, নক্ষত্র নাসিকা, বৃক্ষনাসিকা, নদীনাম্নী, পক্ষীনাম্নী, সর্পনাম্মী, ভীষণনাম্মী, সেরূপ কন্যাকে বিবাহ করা কর্তব্য নহে। সেরূপ লক্ষণযুক্ত কন্যা শাস্ত্রে কুলক্ষণা বলে কথিত হয়ে থাকে। নদীনাম্নী, বৃক্ষনাম্নী ও নক্ষত্রনাম্নী কন্যাকে বিয়ে করা উচিত নয় পূর্বে একথা বলা হয়েছে বটে-- কিন্তু গঙ্গা, যমুনা, গোমতী, স্বরস্বতী এই সব নদীর নাম। তুলসী ও মালতী এই দুই বৃক্ষের নাম এবং রেবতী, অশ্বিনী ও রোহিনী এই তিন নক্ষত্রের বেলায় কোনো দোষ নয়। যে কন্যার চক্ষুদ্বয় ট্যারা ও চপল, যে কন্যা দুঃশীলা ও পিঙ্গলবর্ণ এবং হাস্যকালে যার গণ্ডস্থলে কূপাকার চিহ্ন দৃষ্ট হয় তাকে কামুকী বলে জানবে।
বাৎসায়ন তাঁর শাস্ত্রে শুভাশুভ বিচার করতে গিয়ে বলেছেন : যখন বরপক্ষরা কন্যা দেখতে যাবেন, তখন নিম্নলিখিত চিহ্নগুলি তাদের অবশ্য দেখা উচিত -- () কন্যাটি এই সময় ঘুমোচ্ছে বা কাঁদছে কি না, কিংবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে কি না। () কন্যার নাম সহজে এবং প্রকৃতপক্ষে উচ্চরণ করা যায় কি না, তার নাম অকল্যাণ সূচক কি না () খবর নেওয়া উচিত, ঐ কন্যার আগে অপর কারও সাথে বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল কি না। () কন্যার গায়ের রং পিঙ্গলবর্ণ কি না। তার মুখে সাদা সাদা দাগ আছে কি না। () কন্যার মুখ দেখতে পুরুষের মত যেন না হয়। () তার মুখে চুল আছে কি না। () তাঁর কাঁধ নিচে ঝুলে পড়া কি না। () পা দুটি বাঁকা কি না। () কপাল বাইরে ঠেলে বের হয়েছে কি না, অথবা খুব উঁচু কি না। (১০) তার স্তন দুটি অনুদ্ভিন্ন কি না। (১১) যদি কন্যা তার পিতার শবদাহ করে থাকে। (১২) যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে আগে যৌন মিলন করে থাকে এবং তা জানা যায়। (১৩) যদি তার বিয়ের বয়স পার হয়ে গিয়ে থাকে। (১৪) যদি কন্যা রুগ্না বা বোবা হয়। (১৫) কন্যার সঙ্গে যদি কোনও সম্পর্ক যেমন খুড়তুতো কী মামাতুতো বোন ইত্যাদি থাকে। (১৬) যদি কন্যা বয়সে বরের চেয়ে খুব ছোটো বা বড়ো হয় কন্যার এইসব লক্ষণ থাকলে বিবাহ করা কখনও উচিত নয়।
আসলে আমরা কেউ ‘Perfect’ নই, তাই Mr. Right অথবা Miss Right’ সারা জীবন ধরে খুঁজে বেড়ালেও পাওয়া যাবে না। কারণ একটা imperfect মানুষ আর-একটা perfect মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই।
মনুসংহিতায় কোন্ বিয়ে শুদ্ধ কোন্ বিয়ে অশুদ্ধ সে ব্যাপারে উল্লেখ আছে। কয়েকটি শ্লোক অনুবাদসহ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। --- (১) হীনক্রিয়ং নিষ্পুরুষং নিশ্ছন্দো রোমশার্শসম্। ক্ষয্যাময়াব্যপস্মারিশ্চিত্রিকুষ্ঠিকুলানি চ।। যে বংশ ক্রিয়াহীন (অর্থাৎ যে বংশের লোকেরা জাতকর্মাদি সংস্কার এবং পঞ্চমহাযজ্ঞাদি নিত্যক্রিয়াসমূহের অনুষ্ঠান করে না), যে বংশে পুরুষ সন্তান জন্মায় না (অর্থাৎ কেবল স্ত্রীসন্তানই প্রসূত হয়), যে বংশ নিশ্ছন্দ অর্থাৎ বেদাধ্যয়নরহিত, যে বংশের লোকেরা লোমশ (অর্থাৎ যাদের হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গে বড়ো বড়ো লোম দেখা যায়), যে বংশের লোকেরা অর্শ অর্থাৎ মলদ্বারাশ্রিত রোগ বিশেষের দ্বারা আক্রান্ত, যে বংশের লোকেরা ক্ষয়রোগগ্রস্ত, যে বংশের লোকেরা আময়াবী (আমাশয় রোগাক্রান্ত বা মন্দাগ্নি অর্থাৎ ভুক্ত দ্রব্য যাদের ঠিকমতো পরিপাক হয় না), যে বংশের লোকেদের অপস্মার রোগ (যে রোগ স্মৃতিভ্রংশ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বৈকল্য ঘটায়) আছে, যে বংশের লোকদের শ্বেতরোগ আছে এবং যারা কুষ্ঠরোগ দ্বারা আক্রান্ত। এইসব বংশের কন্যাকে বিয়ে করা চলবে না। (৩/৭)। (২) অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।/সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।। যে নারী মাতার সপিণ্ড না হয় (অর্থাৎ সাতপুরুষ পর্যন্ত মাতামহ বংশজাত না হয় এবং মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয়) এবং পিতার সগোত্রা বা সপিণ্ডা না হয় (অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয়) এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য) পক্ষে ভার্যাত্ব-সম্পাদক বিয়ে ব্যাপারে এবং মৈথুন বা জনন কাজে বিধেয়। (৩/৫)।(৩) নোদ্বহেৎ কপিলাং কন্যাং নাধিকাঙ্গীং ন রোগিণীম্।/নালোমিকাং নাতিলোমাং ন বাচাটাং ন পিঙ্গলাম্।। কপিলা কন্যাকে (যার কেশসমূহ তামাটে, কিংবা কনকবর্ণ) বিয়ে করবে না; যে কন্যার অঙ্গুলি প্রভৃতি অধিক অঙ্গ আছে (যেমন, হাতে বা পায়ে ছয়টি আঙ্গুল আছে), যে নারী নানা রোগগ্রস্তা বা চিররোগিণী বা দুষ্প্রতিকার্য ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত, যে কেশশূন্যা (অথবা যে নারীর বাহুমূলে ও জঙ্ঘামূলে মোটেই লোম নেই, সে অলোমিকা), যার শরীরে লোমের আধিক্য দেখা যায়, যে নারী বাচাল (অর্থাৎ অতিপ্রগলভা) এবং যে নারীর চোখ পিঙ্গলবর্ণের -- এই সমস্ত নারীকে বিয়ে করবে না। (৩/৮)। (৪) নর্ক্ষবৃক্ষনদীনাম্নীং নান্ত্যপর্বতনামিকাম্।/ই পক্ষ্যহিপ্রেষ্যনাম্নীং না চ ভীষণনামিকাম্।। নক্ষত্রবাচক নামযুক্তা (যেমন, আর্দ্রা, জ্যেষ্ঠা প্রভৃতি), বৃক্ষবাচক নামযুক্তা (যেমন, শিংশপা, আমলকী প্রভৃতি), নদীবাচক শব্দ যার নাম (যেমন, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি), অন্ত্যনামিকা অর্থাৎ অন্ত্যজজাতিবোধক নামযুক্তা (যেমন, বর্বরী, শর্বরী প্রভৃতি), পর্বতবাচক নামযুক্তা (যেমন, বিন্ধ্যা, মলয়া প্রভৃতি), পক্ষিবাচক নামযুক্তা (যেমন, শুকী, সারিকা প্রভৃতি), সাপবোধক নামযুক্তা (যেমন, ব্যালী, ভুজঙ্গী প্রভৃতি), ভৃত্যবাচক নামযুক্তা (যেমন, দাসী, চেটী প্রভৃতি) কন্যাকে এবং (ডাকিনী, রাক্ষসী প্রভৃতি) ভয়বোধক যাদের নাম এমন কন্যাকে বিবাহ করবে না। (৩/৯)। (৫) মহান্ত্যপি সমৃদ্ধানি গোহজাবিধনধান্যতঃ।/স্ত্রীসম্বন্ধে দশৈতানি কুলানি পরিবর্জয়েৎ।। বক্ষ্যমান দশটি কুল (বংশ বা পরিবার) গরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি পশু এবং ধন ও ধান্যে বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হলেও স্ত্রীসম্বন্ধ ব্যাপারে সেগুলি বর্জনীয়। (৩/৬)। (৬) সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।/কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য -- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে (অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্য স্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে) দ্বিজাতির পক্ষে বক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (৩/১২)। (৭) অব্যঙ্গাঙ্গীং সৌম্যনাম্নীং হংসবারণগামিনীম্।/তনুলোমকেশদশনাং মৃদ্বঙ্গীমুদ্বহেৎ স্ত্রিয়ম্।। যে নারীর কোনও অঙ্গ বৈকল্য নেই (অর্থাৎ অবয়বসংস্থানের পরিপূর্ণতা বর্তমান), যার নামটি সৌম্য অর্থাৎ মধুর, যার গতি-ভঙ্গি হংস বা হস্তীর মতো (অর্থাৎ বিলাসযুক্ত ও মন্থরগমনযুক্তা), যার লোম, কেশ ও দন্ত নাতিদীর্ঘ, এবং যার অঙ্গসমূহ মৃদু অর্থাৎ সুখস্পর্শ (অর্থাৎ যে নারী কোমলাঙ্গী), এইরকম নারীকেই বিবাহ করবে। (৩/১০)(৮) যস্যাস্তু ন ভবেদ্ভ্রাতা ন বিজ্ঞায়েত বা (বৈ) পিতা।/নোপযচ্ছেত তাং প্রাজ্ঞঃ পুত্রিকাধর্মশঙ্কয়া।। যে কন্যার কোনও ভ্রাতা নেই, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সেই কন্যাকে পুত্রিকাহওয়ার আশঙ্কায় (ভ্রাতৃহীনা কন্যাকে পিতা ইচ্ছা করলে পুত্রের মত বিবেচনা করতে পারতেন, এইরকম কন্যাকে পুত্রিকা বলা হতআবার ভ্রাতৃহীনা কন্যার কোনও পুত্র হলে সে নিজে পুত্রস্থানীয় হয়ে সপিণ্ডনাদি কাজ সম্পন্ন করবে -- অপুত্রক পিতার এইরকম অভিসন্ধি থাকলে সেই কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত।) অথবা যে কন্যার পিতা সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না তাকে জারজ বা মদ্যপ ব্যক্তির দ্বারা জাত সম্ভাবনায় অধর্ম হওয়ার ভয়ে বিয়ে করবে না। (অতএব, পুত্রিকাশঙ্কায় ভ্রাতৃহীনা কন্যা অবিবাহ্যা এবং যার পিতৃসম্বন্ধ অজ্ঞাত-জারজত্ব সম্ভাবনায় এইরকম কন্যা অধর্মাশঙ্কায় অবিহাহ্যা)। (৩/১১)(৯) শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।/তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ।। একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিয়ে করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে। (এটা অনুলোমবিবাহের প্রসঙ্গ। উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নীচবর্ণের কন্যার বিয়েকে অনুলোম বিবাহ বলে। এর বিপরীত বিয়ে অর্থাৎ তুলনামূলক উচ্চবর্ণের কন্যাকে নিম্নবর্ণের পুরুষ কর্তৃক বিয়ের নাম প্রতিলোম বিবাহ। প্রতিলোম বিয়ে সকল স্মৃতিকারদের দ্বারাই নিন্দিত। মনু মনে করেন, প্রথমে সজাতীয়া কন্যার সঙ্গে বিয়েই প্রশস্ত। পুনর্বিবাহের ইচ্ছা হলে অনুলোম-বিবাহের সমর্থন দেওয়া হয়েছে)। (৩/১৩)। (১০) শূদ্রাবেদী পতত্যত্রেরুতথ্যতনয়স্য চ/শৌনকস্য সুতোৎপত্ত্যা তদপত্যতয়া ভৃগোঃ।। শূদ্রা স্ত্রী বিয়ে করলেই ব্রাহ্মণাদি পতিত হন --- এটি অত্রি এবং উতথ্য-তনয় গৌতম মুনির মতো শৌনকের মতে, শূদ্রা নারীকে বিবাহ করে তাতে সন্তান উৎপাদন করলে ব্রাহ্মণাদি পতিত হয়। ভৃগু বলেন, শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের সন্তান হলে ব্রাহ্মণাদি দ্বিজাতি পতিত হয়। (মেধাতিথি ও গোবিন্দরাজের মতে, কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের শূদ্রা স্ত্রীর ক্ষেত্রেই এই পাতিত্য বুঝতে হবে। কুল্লুক ভট্টের মতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য -- এই তিনজাতির শূদ্রা স্ত্রী সম্বন্ধেই এই পাতিত্য হবে)। (৩/১৬)(১১) হীনজাতিস্ত্রিয়ং মোহাদুদ্বহন্তো দ্বিজাতয়ঃ।/কুলান্যেব নয়ন্ত্যাশু সসন্তানানি শূদ্রতাম্।। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দ্বিজাতিরা যদি মোহবশত (ধনলাভজনিত অবিবেকবশতই হোক অথবা কামপ্রেরিত হয়েই হোক) হীনজাতীয়া স্ত্রী বিয়ে করেন, তাহলে তাদের সেই স্ত্রীতে সমুৎপন্ন পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে নিজ নিজ বংশ শীঘ্রই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। (৩/১৫)। (১২) শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্।/জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।। সবর্ণা স্ত্রী বিয়ে না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিয়ে করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তান উৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন [অতএব সমানজাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়]। (৩/১৭)। (১৩) ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্যঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ।/গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট (নিন্দিত) পৈশাচ- বিবাহ এই আটরকমের। (৩/২১)। (১৪) ষড়ানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোহবরান্।/ বিটশূদ্রয়োস্তু তানেব বিদ্যাদ্ধর্ম্যানরাক্ষসান্।। (প্রথম থেকে) ক্রমানুসারে ছয় প্রকার বিবাহ (ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব) ব্রাহ্মণের পক্ষে ধর্মজনক (অতএব বিহিত); শেষ দিকের চারটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ) ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বিহিত; এবং রাক্ষস ভিন্ন শেষের বাকি তিনটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব ও পৈশাচ) বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষে বিহিত বলে জানবে। (৩/২৩)। (১৫) দৈবপিত্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।/নাশ্লন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি।। শূদ্রা ভার্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (যথা, দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞ প্রভৃতি এবং দেবতার উদ্দেশ্যে যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্র্যকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম, যথা, শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন, অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ওই কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ওই সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়)। (৩/১৮)(১৬) যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ/যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।। যে বংশে স্ত্রীলোকেরা বস্ত্রালঙ্কারাদির দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন (আর প্রসন্ন হয়ে তাঁরা পরিবারের সকলকে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন), আর যে বংশে স্ত্রীলোকদের সমাদর নেই, সেখানে (যাগ, হোম, দেবতার আরাধনা প্রভৃতি) সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়। (৩/৫৬)।
প্রত্যেক ধর্মের মতো হিন্দু আইনে বিয়ের উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হল স্বামী-স্ত্রী রূপে দুই জন নর-নারীর একত্রে বসবাস করা বা পবিত্রভাবে জীবনযাপন করা। প্রাচীনকালের বিবাহের নিয়ম ছিল গোত্র যেন এক না হয় এবং পিতৃকুলে সাতপুরুষ এবং মাতৃকুলে পাঁচ পুরুষ বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ে বিয়ে করতে পারত। মনুর মতে, “অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।/সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।।অর্থাৎ, যে নারী মাতার সপিণ্ড না হয় (অর্থাৎ সাতপুরুষ পর্যন্ত মাতামহ বংশজাত না-হয় এবং মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না-হয়) এবং পিতার সগোত্রা বা সপিণ্ডা না হয় (অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয়) এমন স্ত্রী-ই  দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য) পক্ষে ভার্যাত্বসম্পাদক বিবাহব্যাপারে এবং মৈথুন বা জনন কাজে বিধেয়। (৩/৫)।। প্রাচীনকালের হিন্দু পুরাণে সতীত্বের আদর্শ বর্তমানকালের মতো ছিল না। অনেক সময় একের স্ত্রী অন্যে হরণ করত। যেমন, চন্দ্র বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করেছিল। চন্দ্রের ঔরসে তারার বুধ নামের পুত্র জন্মে। পরে চন্দ্র তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেয়। বৃহস্পতি তারাকে ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করেনি। নারী স্বেচ্ছায় পরকীয়ায় লিপ্ত হলে অসতী বলে গণ্য হত, কিন্তু জোরপূর্বক বলাৎকৃত বা ধর্ষিত হলে অসতীবলে গণ্য হত না।
অসবর্ণ বিবাহ : ভারতে ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইন অনুযায়ী অসবর্ণ বিবাহের বিধান আছে। এই ধরনের বিয়ে উভয় পক্ষকে প্রাপ্তবয়ষ্ক হতে হবে। এই আইন ১৯২৩ সালে সংশোধিত হয়। ১৯২৯ সালের হিন্দু বিবাহ নিরোধ আইন দ্বারা কনের বয়স ১৬ এবং বরের বয়স ১৮ ধার্য করা হয়েছিলপরে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৫৫ সালে কনের বয়স ন্যূনতম ১৮ এবং বরের বয়স ২১ করা হয়েছে।এর কম বয়সি পাত্রপাত্রীর বিবাহ আইনসিদ্ধ হবে না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অসবর্ণ বিবাহের কথা আছে এবং এর ফলে যে সব সংকর বা মিশ্র জাতির উদ্ভব হয়েছিল, তা উল্লিখিত হয়েছে, যেমন -- অন্বষ্ঠ (পিতা ব্রাহ্মণ এবং মাতা বৈশ্য), নিষাদ বা পরশর (পিতা ব্রাহ্মণ এবং মাতা শূদ্র), উগ্র (পিতা ক্ষত্রিয় এবং মাতা শূদ্র), চণ্ডাল (পিতা শূদ্র এবং মাতা ব্রাহ্মণ), সূত (পিতা ক্ষত্রিয় এবং মাতা ব্রাহ্মণ) ইত্যাদিচণ্ডালসহ সমস্ত মিশ্র জাতিকে শূদ্রের পর্যায়ভুক্ত বলে মনে করা হত চিত্তরঞ্জন দাশ যে অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে ছিলেন তার প্রমাণ মিলে তাঁর নিজ কন্যাদের ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারে বিবাহ দানের ঘটনায়। ১৭ বছর বয়সে সরোজিনী ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তাঁর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। উল্লেখ্য, সেই যুগে অসবর্ণ বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। সরোজিনী ব্রাহ্মণ হলেও গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে ১৮৭২ সালের আইন অনুযায়ী তাঁদের বিবাহ হয়। ১৯ শতকের ৬০ ও ৭০ দশকে কেশবচন্দ্র সেন স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে ব্রাহ্মসমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। লেখিকা সাবিত্রী রায় ১৯৩৮ সালে বিএ ও পরে বিটি পাশ করার পর ১৯৪০ সালে অধ্যাপক শান্তিময় রায়ের সাথে অসবর্ণ বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন স্মৃতির বিবরণ অনুযায়ী সাত প্রজন্ম ধরে এরকম অসবর্ণ বিবাহ দিলে কোনো শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে পারত। মহাভারত মতে, কচের অভিশাপে (কখনো ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেবযানীর বিয়ে হবে না), ততদিনে দেবযানী সত্যি সত্যি কচের প্রেম থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। আর তাই ক্ষত্রিয়রাজ সুপুরুষ সাহসী যোদ্ধা যযাতির প্রেমে পড়ে যেতে সময় লাগে না দেবযানীর। যযাতি প্রথমে রাজি না হলেও পরে সম্মতি দেন। এর কিছুকাল পরে যখন শুক্র দেবযানীর সঙ্গে যযাতির অসবর্ণ বিয়ে দেন, তখন তিনি যযাতিকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, দাসী শর্মিষ্ঠাকে যযাতি যেন কখনো বিয়ে না করেন। যযাতি সেই সাবধানবাণী না মেনে গোপনে শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে করেন। কানাডায় অসবর্ণ বিয়ের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সর্বশেষ হিসেবে হিসেবে দেখা যায় ২০০৬ সালে দেশটিতে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা ছিল ২৮৯,৪০০ জন। ২০০১ সালে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা যা ছিল তার তুলনায় এই সংখ্যা শতকরা ৩৩ ভাগ বেশিহিসেবে আরও দেখা যায় এই সব অসবর্ণ দম্পত্তিদের পরিবারে ৩ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি সন্তান রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে অসবর্ণ এই দম্পত্তিদের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ অন্যজন অশ্বেতাঙ্গ বা এথনিক গ্রুপের। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুইজনই দুই এথনিক গ্রুপের। হিন্দুদের নাগরিক সমাজে অসবর্ণ বিবাহ বর্তমানে প্রচলন আছে BBC NEWS জানিয়েছে, “The government in Uttar Pradesh, northern India, is offering newlyweds 50,000 rupees ($810; £530) and throwing in a medal and certificate too, the Times of India reports. There's only one condition - either the bride or groom must belong to one of India's "scheduled castes". The term refers to those on the lowest rung of the Hindu caste system, who are officially considered socially disadvantaged. Inter-caste marriages are still considered taboo in India, and there have been cases of couples being murdered by their own families - so-called honour killings - as a result of mixed relationships.”
বিধবা-বিবাহ : এককালে স্বামীর মৃত্যুর পর কমবয়সি বিধবাদের সহমরণে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হতকিংবা তাঁদের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত । সিঁথির সিঁদুর মুছে, দেহের সমস্ত অলংকার খুলে ফেলে, চুল কেটে, সাদা থান পরে, একবেলা নিরামিষ খেয়ে অনশনক্লিষ্ট অবস্থায় তাঁদের বৈধব্য পালন করতে হত। পাছে বিধবা নারীর যৌবন, দীর্ঘ কেশ ও রঙিন শাড়ি-গয়নায় পুরুষরা আকৃষ্ট হয়, সেই কারণেই এই ব্যবস্থা। বিধবা মহিলার নিজের মধ্যেও যেন কামনার উদ্রেক না হয় সেজন্য শুধু আমিষ বর্জনশুধু আমিষ বর্জনই নয়, অনেক জায়গাতে মুসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারেও বাধানিষেধ ছিলকারণ আমিষকে মনে করা হয় কামোত্তেজক খাদ্য এছাড়া বিধবার পুনরায় বিয়ে হলে মৃত স্বামীর অর্থাৎ পূর্ব স্বামীর অবাঞ্ছিত স্ত্রীরূপে জীবনসত্বরূপে তার সম্পতির দখল করবার অধিকার লোপ পাবে। কিন্তু পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত পুত্র সন্তানের মাতারূপে পুত্রের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার হতে বঞ্চিত হবে না। কারণ বিধবার পুনরায় বিবাহ হলেও পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের সঙ্গে পুত্র সম্পর্ক থেকে যায়বাটোয়ারার মাধ্যমে সম্পত্তির প্রকৃত বণ্টন না-হওয়া পর্যন্ত অবিবাহিত কন্যার বিবাহের ব্যয় যৌথ পরিবারের সম্পত্তি থেকে নির্বাহ করতে হয়।
বিধবা নারীদের ধর্মের নামে সমাজের চরম পীড়ন-অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনটি হল ১৮২৭ সালের সতীদাহ নিবারণ আইন। এই আইনে সতীদাহকে বে-আইনি বলে ঘোষণা করা হল এই আইন হিন্দুদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অবমাননা করছে বলে সেযুগের নামিদামি অনেকেই ঘোরতর আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু রামমোহন রায় ও অন্যান্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির প্রচেষ্টায় তাঁদের আপত্তি টেঁকেনি।
১৮৫৬ সালে গৃহীত বিধবা-বিবাহ আইনটি বিধবাদের স্বার্থরক্ষার জন্য আর-একটি মহত্তম পদক্ষেপ। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। বিধবা-বিবাহ অবশ্য এই আইনের আগেও হয়েছে। ইংলিশম্যান পত্রিকায় ১৮৫৪ সালে কৃষ্ণনগরে একটি পনেরো বছর বয়স্কা বিধবার পুনর্বিবাহের খবর প্রকাশিত হয়। ওই সময়ের কিছু আগের থেকেই সমাজের কিছু প্রগতিশীল লোক পণ্ডিতদের সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন যে, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসন্মত। তবে বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন, এটি শুধু শাস্ত্রসন্মত প্রমাণ করলেই সমাজ তা মানবে না, এটির জন্য আইনের সমর্থন প্রয়োজন। বিদ্যাসাগর, বর্ধমানের মহারাজা, কৃষ্ণনগরের মহারাজা ও আরও কিছু ব্যক্তির বিশেষ প্রচেষ্টায় বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের বিধবা-বিবাহ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। বিধবা-বিবাহ আইন গৃহীত হয় ২৬ জুলাই, তার চার মাস বাদে ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর ঘটা করে একটি বিধবার বিবাহ দেন। কিন্তু সাধারণভাবে সেই সময়কার হিন্দুসমাজ বিধবা-বিবাহকে স্বীকৃতি দেয়নি। উদবেগের বিষয়, আজ ১৬০ বছর বাদেও বিধবা-বিবাহকে হিন্দুসমাজ সুনজরে দেখে না। বিধবাদের পুনর্বিবাহ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সংখ্যায় সেগুলি অত্যন্ত নগণ্য। ভারতবর্ষের কোনো কোনো অঞ্চলে বিধবার সঙ্গে মৃত স্বামীর ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রথা আছে। এই পুনর্বিবাহে সদ্য-বিধবার নিজস্ব কতটা সায় থাকে জানা মুশকিলতবে বাসস্থান ও ভরণপোষণের সমস্যাটা দূর হয় বটে
বহু বিবাহ : হিন্দুধর্মে বা সনাতন ধর্মে বহু বিবাহ নিষিদ্ধঅনেক অহিন্দুরা দাবি করে যে হিন্দুধর্মে বহু বিবাহ অনুমোদিতপ্রকৃত সত্যটা কী ? প্রকৃত সত্যটা দেখে নেওয়া যাক-- ঋগবেদের তিনটি মন্ত্র যথাক্রমে ১.২৪.৭, ৪.৩.২ ও ১০.৭১.৪ -এ বলা হয়েছে,যায়েব পত্য উষতে সুভাসহ অর্থাৎ যেভাবে জ্ঞানীগণ জ্ঞানপ্রাপ্ত হন ঠিক সেভাবে একক পতি-পত্নীযুক্ত সংসার আনন্দ ও সুখ লাভ করে। ঋগবেদ ১০.৮৫.২৩-এ বলা হয়েছে স্বামী ও স্ত্রীর সবসময় উচিত পুনরায় বিয়ে না-করার ব্যপারে সংযমী হওয়া। অথর্ববেদ ৭.৩৮.৪ বলেছে "স্বামীর উচিত শুধু একমাত্র স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত থাকা। দ্বিতীয় কোনো নারীর প্রতি অনুরাগ তো দুরে থাক, অন্য কোনো নারী সম্বন্ধে তার আলোচনাও করা উচিত নয়।" ঋগবেদ ১০.১০৫.৮ বলেছে যে, একাধিক স্ত্রীর অস্তিত্ব মানেই জাগতিক সকল দুঃখের আনয়ন। ঋগবেদ ১০.১০১.১১ বলেছে দুই স্ত্রীযুক্ত ব্যক্তিকে সেভাবেই কাঁদতে হয় ঠিক যেভাবে চলমান রথের ঘোড়া উভয় দিক থেকে চাবুকের আঘাতে হ্রেষা রব করে ! ঋগবেদ ১০.১০১.১১-এও বলেছে যে একাধিক স্ত্রী জীবনকে লক্ষ্যহীন করে তোলে। অথর্ববেদ ৩.১৮.২ বলেছে একজন নারীর কখনো যেন কোনো সতীন না-হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে আপনারা সকলেই জানেন যে বহু বিবাহের ক্ষতিকর দিকের শেষ নেই। সামাজিক বিশৃঙ্খলা, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, সেক্স ট্রান্সমিটেড ও কমুনিকেবল ডিসিসের প্রাদুর্ভাবসহ অসংখ্য ক্ষতিকর প্রভাব আছে এর। তবে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রচুর ধান্ধাবাজ মানুষ বহু বিবাহ করতেন একথা অস্বীকার করা যায় না ভারত সরকার এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে ১৯৫৪ সালে আইন করে হিন্দুদের বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করে। মনুসংহিতায় মনু স্পষ্ট করে বলেছেন – () “অত্র গাথা বায়ুগীতাঃ কীর্ত্তয়ন্তি পুরাবিদঃ।/যথা বীজং ন বপ্তব্যং পুংসা পরপরিগ্রহে।।
অর্থাৎ, পরস্ত্রীতে বীজ বপন করা পুরুষের যে উচিত নয় সে সম্বন্ধে অতীতকালজ্ঞ পণ্ডিতেরা বায়ুকথিত কতকগুলি গাথা অর্থাৎ ছন্দোবিশেষযুক্ত বাক্য বলে গিয়েছেন। (৯/৪২)। () “অন্যদুপ্তং জাতমন্যদিত্যেতন্নোপপদ্যতে।/উপ্যতে যদ্ধি যদ্বীজং তত্তদেব প্ররোহতি।।অর্থাৎ, একরকম বীজ বপন করা হল আর অন্য রকম শস্য জন্মালো, এরকমটি হতে পারে না; কিন্তু যেমন বীজ বপন করা হয় সেইরকমই ফসল তা থেকে জন্মায়। (৯/৪০)। () “তৎ প্রাজ্ঞেন বিনীতেন জ্ঞানবিজ্ঞানবেদিনা।/আয়ুষ্কামেণ বপ্তব্যং না জাতু পরযোষিতি।।অর্থাৎ, অতএব বীজ যখন ওইরকম প্রভাবসম্পন্ন, তখন প্রাজ্ঞ (যিনি স্বাভাবিক প্রজ্ঞার দ্বারা যুক্ত), বিনীত অর্থাৎ শিক্ষিত, জ্ঞানে (অর্থাৎ বেদাঙ্গশাস্ত্রে) এবং বিজ্ঞানে (অর্থাৎ তর্ককলা প্রভৃতি বিষয়ক শাস্ত্রে) অভিজ্ঞ এবং আয়ুষ্কামী ব্যক্তি নিজশরীরস্থিত ওই বীজ কখনো যেন পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে বপন না-করেন। (৯/৪১)।

বহু বিবাহ যে শাস্ত্রবিরুদ্ধ প্রমাণ করছিলেন বিদ্যাসাগর। বহু বিবাহ নিরোধ নিয়ে সেকালের সামাজিক আন্দোলনে উপযুক্ত ভাইপোস্যগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিদ্যাসাগরের বহু বিবাহ নিরোধ আন্দোলন নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র লিখছিলেন বঙ্গদর্শন”-বঙ্কিম আলোচনায় আনেন -- “যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ, সেই কারণেই বহু বিবাহ হইতে নিবৃত্ত হইতে বলিলে একটি দোষ ঘটে। বহু বিবাহপরায়ণ পক্ষেরা বলিতে পারেন, “যদি আপনি আমাদের শাস্ত্রানুসারে কার্য করিতে বলেন, তবে আমরা সম্মত আছি। কিন্তু যদি শাস্ত্র মানিতে হয়, তবে আপনার ইচ্ছামত, তাহার একটি বিধি গ্রহণ করা, অপরগুলি ত্যাগ করা যাইতে পারে না। আপনি কতকগুলিন বচন উদ্ধৃত করিয়া বলিতেছেন, এই এই বচনানুসারে তোমরা যদৃচ্ছাক্রমে বহু বিবাহ করিতে পারিবে না। ভাল, আমরা করিব না। কিন্তু সেই সেই বিধিতে যে যে অবস্থায় (স্ত্রী বন্ধ্যা, মৃতপ্রজা হইলে, পুত্র জন্ম না হইলে বা স্ত্রী অপ্রিয়বাদিনী হইলেবঙ্কিমের উল্লেখ অনুসারে বর্তমান লেখক) অধিবেদনের অনুমতি আছে, আমরা এই দুই কোটি হিন্দু সকলেই সেই সেই বিধানানুসারে প্রয়োজনমত অধিবেদনে প্রবৃত্ত হইবকেন না, সকলেরই শাস্ত্রানুমত আচরণ করা কর্ত্তব্য।…” নবজাগরণ পর্বের এক জ্যোতিষ্ক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বহু বিবাহ প্রথা নিয়ে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল --  “That marriage is looked upon as traffic by the cool in Brahmins, is an evil, the existence of which can not denied. Many, many poor creatures have suffered keenly from this, and if we but consider the enormity of the crime, we cannot entertain any doubts about the course we, as members of society should pursue with respect to persons that recklessly marry a number of wives without fixing their affections on any.”
জীমূতবাহনের ব্যাখ্যায় এবং প্রাচীন শিলালিপিতে বহুবিবাহের প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্মশাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী ব্রাহ্মণ চার পত্নী, ক্ষত্রিয় তিন পত্নী আর বৈশ্য দুই পত্নী গ্রহণ করতে পারেন। পুরুষের বহুবিবাহ শুধু শাস্ত্রীয় অনুমোদনই লাভ করেনি, কার্যক্ষেত্রেও বহু প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছিলআর দাম্পত্য জীবনে প্রাচীনকাল থেকেই নারীর প্রধান অশান্তির কারণ ছিল গৃহে সপত্নীর বা সতীনের অবস্থানধর্মের বিধানে রাজারা যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারত। শাস্ত্র পুরুষের শত শত বিবাহ সমর্থন করেছে। সেই শাস্ত্রের বিধানেই আবার নারীর একাধিক পতিত্ব কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনু নারীর একপতিত্বের বিধান দিয়েছেন এবং স্বামী দুশ্চরিত্র হলেও স্ত্রীকে সারাজীবন পাতিব্রত্য পালন করতে বলেছেন। পতিপরায়ণতা সাধ্বী স্ত্রীলোকের পরম ধর্ম।
দ্বাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেন প্রবর্তিত কৌলীন্যপ্রথা ধীরে ধীরে তার ধর্মীয় লক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়ে এক ধরনের বিবাহ-ব্যবসায়ে পরিণত হয়। হিন্দুধর্মীয় কুলীন পুরুষের বহু স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় এই প্রথা ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধির আকার ধারণ করে। উনিশ শতকে কুলীন ব্যবসায়ীরা বিবাহের জন্য এককালীন পণ এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন উপলক্ষে অর্থলাভের আশা করতেন। কুলমর্যাদা অর্থাৎ কিঞ্চিৎ অর্থগ্রহণ না করে এঁরা শ্বশুরবাড়িতে গমন করে উপবেশন, স্নান ও আহার কিছুই করতেন না, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে আলাপও করতেন না। দীর্ঘদিন পরে কুলীন জামাতা বেড়াতে এলে শ্বশুর-শাশুড়ি এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন তাই তাকে খুশি করার জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। এমনকি অনেকে রাতে শোওয়ার আগে শুভ সাক্ষাৎ উপলক্ষে জামাই স্ত্রীর নিকট অর্থ দাবি করতেন।
শাস্ত্রে যাই-ই থাকুক না-কেন, বাস্তব ছবিটা ভিন্ন মৌর্য যুগে পুরুষদের মধ্যে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল । প্রাচীন সমাজে পুরুষরা বহু বিবাহ করতেন। বহু পুরুষ একাধিক বিয়ে করত বড়ো বউ, মেজ বউ, ছোটো বউরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল বাংলা সাহিত্যে এমন বহু পুরুষকে পাওয়া যাবে যারা একাধিক বিয়ে করেছেন রাজা, উচ্চবংশীয় পুরুষ, ঋষিদের বহু স্ত্রী থাকার প্রমাণ ইতিহাসে এবং পুরাণে পাওয়া যায়।  স্বামী অকালে মারা গেলে, সন্ন্যাসী হলে বা দৈহিক মিলনে অক্ষম কিংবা হিজড়া হয়ে পড়লে বা স্বামী সমাজচ্যুত হলে এরকম কিছু বিশেষ কারণে কখনো-কখনো স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ের অধিকার পেত। এ ক্ষেত্রে স্বামীর ভাইকে বা ভাই না-থাকলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারত। কোনো কোনো প্রাচীন হিন্দু জাতি বা সমাজে স্ত্রীলোকেরও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মারিষা নাম্নী কণ্ডু কন্যাকে দশজন নৃপতি একত্রে বিয়ে করেছিলেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর কাহিনিটিও প্রসিদ্ধ। অনেকে মনে করেন স্ত্রীলোকের বহু বিবাহ অনার্য প্রথা। অর্থশাস্ত্রে বহু বিবাহের উসাহ দেওয়া হয়নি এবং সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের কথাও বলা হয়েছেমহিলাদের মধ্যেও বহু বিবাহ একেবারে অজ্ঞাত ছিল না, যদিও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদের পক্ষে তা এক প্রকার অসাধ্য ছিল তবে ভারতের গোয়ায় বসবাসকারী হিন্দুদের জন্য বিশেষ আইনবলে স্ত্রী যদি বিয়ের ২৫ বছরের মধ্যে সন্তান অথবা ৩০ বছরের মধ্যে পুত্র-সন্তান জন্ম না-দিতে পারে তাহলে স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারেতবে বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান ভদ্রশ্রেণি পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে বহুবিবাহের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। কালক্রমে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বহুবিবাহ বিরল হয়ে পড়ে এবং শিক্ষিত শ্রেণিতে এক বিবাহ দাম্পত্য আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মেয়েদের বিয়ের বয়স : মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ঠিক কত ধার্য করা উচিত এবং সেটার যুক্তি ঠিক কী হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা দেশে  প্রচুর আলোচনা হয়েছে। ভারত উপমহাদেশে হিন্দুদের সমাজজীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে প্রধানত মনুর বিধান অনুসারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, মেয়েদেরকে ৮ (আট) বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দিতে হবে। হিন্দুসমাজে আট বছর বয়সি মেয়েকে বলা হত গৌরী। ব্রিটিশ-ভারতে আমলে ১৮৯১ সালে আইন পাশ হয় স্ত্রীর বয়স ১২ (বারো) বছরের কম হলে স্বামী তার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না। কারণ এর চাইতে কম বয়সি মেয়ের সঙ্গে সহবাস করবার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীর মৃত্যু ঘটতে দেখা যায়। এই আইনকে বলা হয় সহবাস সম্মতি আইন (Age of Consent) ব্রিটিশ শাসনামলে এই আইন যখন পাশ হয়, তখন ইংলন্ডে ১২ বছরের কম বয়সি কোনো মেয়ে গণিকার খাতায় নাম লেখাতে পারত না। সহবাস সম্মতি আইন নিয়ে গোঁড়া হিন্দুসমাজে প্রচুর প্রতিবাদ উঠে। মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত হিন্দু নেতা বালগঙ্গাধর তিলক বলেন, “ইংরেজরা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করছে। নষ্ট করছে হিন্দু-সংস্কৃতি। কিন্তু আইনটা থেকেই যায়। ১৯৫২ সালে হিন্দু কোড বিল পাশ হয়। এ সময় ভারতের হিন্দু মেয়েদের ন্যূনতম বিবাহের বয়স ধার্য করা হয় ১৮ (আঠেরো) এবং ছেলেদের ন্যূনতম বিবাহের বয়স ধার্য করা হয় ২১ (একুশ)বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স ধার্য করা হয় ভারতেরই অনুকরণে। কিন্তু ভারতে মুসলমান বিয়েতে এই ন্যূনতম বয়স প্রয়োজ্য নয়। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও হিন্দু ও মুসলমানের ক্ষেত্রে বিবাহ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন এখনও এক হতে পারেনি।
নারীর পক্ষে মনু : বিবাহের বিষয়ে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে -- “কন্যা বিবাহ উপযুক্ত কাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পিতৃগৃহেই অবস্থান করবে সেও ভালো, তবুও গুণহীন বরের (অর্থাৎ বিদ্যা, শৌর্য, সুন্দর চেহারা, উপযুক্ত বয়স, মহত্ত্ব, লোক ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ দ্রব্যাদি বর্জন এবং কন্যার প্রতি অনুরাগ –- এইগুলি নেই যে পাত্রের) হাতে কন্যাকে দান করবে না(মনুসংহিতা ৯/৮৯)কুমারী কন্যা ঋতুমতী হলেও তিন বত্সর পর্যন্ত গুণবান বরের অপেক্ষা করবে; ওই সময়ের পরও যদি পিতা তার বিবাহ না দেন তাহলে এ পরিমাণ কাল অপেক্ষার পর কন্যা নিজ সদৃশ পতি নিজেই বেছে নেবেন(মনুসংহিতা ৯/৯০)ঋতুমতী হওয়ার তিন বছর পরেও যদি ওই কন্যা পাত্রস্থ করা না হয়, তাহলে সে যদি নিজেই পতি বরণ করে নেয়, তার জন্য সে কোনো পাপের ভাগী হবে না। কিংবা সেই পতিরও কোনো পাপ হবে না(মনুসংহিতা ৯/৯১)
বরপণ বা যৌতুক : যৌতুক বা পণপ্রথা একটি সুপ্রাচীন সামাজিক ব্যাধি। এর ফলে প্রবহমান নারীজীবন হয়েছে বিপর্যস্ত, ব্যাহত ও সীমাহীন পশ্চাৎপদ। সনাতন হিন্দু সমাজে স্ত্রী ধনহিসেবে যৌতুক প্রচলিত ছিল। বাঙালি মুসলিম সমাজে এ যৌতুক ব্যাধি উনিশ শতকের পর দেখা যায়। যৌতুকের বিষফল হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজকেই করেছে যুগপৎ অনগ্রসর ও পশ্চাৎমুখী। আজও উনিশ-বিশ শতকের পরও প্রকৃত নারী স্বাধীনতা আসেনি। আজও থেমে যায়নি যৌতুক-প্রথা। পণপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও কোনো-না-কোনো চেহারায় পণের লেনদেন যে চলছেই, সে কথা সকলেরই জানা। অথচ সেটা আইনে প্রমাণ করা যায় না। পণপ্রথা টিকে আছে। পণপ্রথা বিরোধী আইন অনুসারে বিয়েতে পণ দেওয়া-নেওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে ১৯৬১ সাল থেকেই। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কেউই পণ দেওয়া-নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। পাত্রপক্ষ মানে না, তারা পণ নিয়েছে। বিয়ে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পাত্রীপক্ষও বলে না যে, তারা পণ দিয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র সমীক্ষা বলছে, পণের জন্য বধূহত্যার ঘটনা বরং দিনকে দিন বাড়ছে। ২০১১ সালে গোটা দেশে ৮৬১৮টি এই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, ২০১০-এ সংখ্যাটা ছিল ৮৩৯১স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়েই পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জমি কেনাবেচা হয়।
মনুসংহিতায় বরপণ বা যৌতুক নেওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে বলা হয়েছে -- “কন্যার আত্মীয়রা যদি কন্যার স্ত্রীধন (সম্পত্তি, ধনাদি, স্ত্রীযান বা বস্ত্রাদি) অপহরন করে তবে তারা অধোগতি প্রাপ্ত হয়। (মনুসংহিতা ৩/৫২) তাই মনুস্মৃতিতে যে-কোনো যৌতুক নিষিদ্ধ হয়েছে। তাই মেয়েদের সম্পত্তিতে কেউ হাত দিতে পারবে না। পরবর্তী শ্লোকে এই বিষয়টিকে আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যে-কোনো স্পর্শযোগ্য (tangible) সম্পত্তির সামান্যতম আদান-প্রদান মহতী বিবাহের নীতির বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে মনু বলেন যে, যৌতুকযুক্ত কোনো বিবাহ হচ্ছে আসুরী বিবাহ শাস্ত্রে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারতে বরপণ বা যৌতুক হয়েছে এবং আজও হচ্ছে আমাদের সমাজে পণপ্রথা একটি অভিশাপ রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে পণপ্রথাকে কেন্দ্র করে বধুহত্যা, বধু-নির্যাতন বধুদের এহেন অত্যাচার থেকে রেহাই ভারতীয় দণ্ডবিধি ৪৯৮() ধারার প্রবর্তন হয় ১৯৮৩ সাল থেকে
হিন্দু সমাজে পাত্র-পাত্রীর কোষ্ঠী বিচার করে দেখার রীতি আছে। পাত্রী-পাত্রীর অন্য কোন বিষয়ে আপত্তি না থাকলেও কোষ্ঠী বিচারে যোটক না মিললে বিবাহের আর অগ্রগতি হয় না। পারিপার্শ্বিক প্রভাবে মুসলিম সমাজেও পূর্বে কোষ্ঠী বিচার করে ছেলেমেয়ের বিবাহ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বাঙালি হিন্দু বিবাহ বলতে বোঝায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ত্রিপুরা রাজ্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দুদের বিবাহ সংক্রান্ত নিজস্ব প্রথা ও রীতিনীতি। বৈদিক ও লৌকিক -- উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের বিবাহে প্রধানত এই দুইটি আচারগত বিভাগ লক্ষিত হয়লৌকিক প্রথাগুলি মেয়েলি আচার বা স্ত্রী আচারএই কারণে এগুলি স্ত্রী আচারনামে লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক এক প্রকার হয়। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই, বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য লক্ষিত হয়। বাঙালি ব্রাহ্মণ সমাজে পাঁচটি শাখা রয়েছে রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক, সপ্তশতী ও মধ্যশ্রেণী। বাঙালি কায়স্থ সমাজে রয়েছে চারটি শাখা উত্তর রাঢ়ী, দক্ষিণ রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ। বৈদিক আচারে সাম, যজুঃ ও ঋক্ বেদত্রয়ের অনুসরণকারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ প্রথায় আবার সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। হিন্দু বিবাহের বৈদিক আচারগুলির মধ্যে অপরিহার্য হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ, ধৃতিহোম ও চতুর্থী হোম। এছাড়া পালিত হয় অরুন্ধতী নক্ষত্র দর্শন, ধ্রুব নক্ষত্র দর্শন, শিলারোহণ ইত্যাদি কয়েকটি বৈদিক প্রথাও। বৈদিক প্রথাগুলি বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথা ও বিবাহের মূল অঙ্গ। বাঙালি হিন্দু বিবাহের লৌকিক আচার বহুবিধ। এই প্রথাগুলি বর্ণ, শাখা, উপশাখা এবং অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়। এগুলির সঙ্গে বৈদিক প্রথাগুলির কোনো যোগ নেই।
পাটিপত্র : পাটিপত্র বাঙালি হিন্দু বিবাহের প্রথম আচারএই আচার লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ নামেও পরিচিত। ঘটক বা অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্বন্ধ করে বিবাহ স্থির হলে নগদ বা গহনাপত্রে যৌতুক ও অন্যান্য দেনাপাওনা চূড়ান্তভাবে স্থির করার জন্য যে অনুষ্ঠান হয়, তাকেই পাটিপত্র বলে। এই আচারের মাধ্যমেই বিবাহের অন্যান্য আচারের সূচনা ঘটে।
পানখিল : পানখিল বাঙালি হিন্দু বিবাহের দ্বিতীয় আচার। এটি পাটিপত্রের ঠিক পরেই পালিত হয়। পানখিলের অর্থ পান পাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে খিল দেওয়া বা খড়কে বেঁধানো। এই আচারটি প্রথমে বরের বাড়িতে এবং পরে কনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। পানখিল আচারে কোথাও কোথাও বাড়ির মেয়েরা এবং প্রতিবেশিনীরা বিয়ের গান গেয়ে থাকে। এই গানের বিষয়বস্তু হল রাম সীতার বিবাহ। তবে বিয়েতে গান গাওয়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না
দধিমঙ্গল : বিবাহের দিন বর ও কন্যার উপোস বা উপবাস। তবে উপবাস নির্জলা নয়। জল-মিষ্টি খাওয়ার বিধান আছে। তাই সারাদিনের জন্য সূর্যোদয়ের আগে বর ও কন্যাকে চিড়ে ও দই খাওয়ানো হয়।
গায়ে-হলুদ : হিন্দু ধর্মে কয়েকটি জিনিসকে শুভ বলা হয়, তার মধ্যে গায়ে-হলুদ বা গাত্রহরিদ্রা একটি এছাড়া শঙ্খধ্বনি, হলুদ ইত্যাদিও শুভ প্রথমে বরকে ও নিতবরকে সারা গায়ে হলুদ মাখানো হয়। পরে সেই হলুদ কন্যার বাড়ি পাঠানো হয়। কন্যাকে সেই হলুদ মাখানো হয় এবং স্নানপর্ব সমাপ্ত হয়
শঙ্খ-কঙ্কন : কন্যাকে শাঁখা পরানোর অনুষ্ঠান
এরপর বিকালে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়
বর-বরণ : নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে বর বিবাহ করতে আসে কনের বাড়ি এলে তাকে স্বাগত জানান কন্যাপক্ষের সন্মানীয়ারা সাধারণত কন্যার মা তার জামাতাকে একটি থালায় প্রদীপ, ধান-দুর্বা ও অন্যান্য কিছু বরণ সামগ্রী নিয়ে বরণ করেন। তবে মার অবর্তমানে কনের জেঠিমা, কাকিমা, বউদি, মামি তুল্য মহিলারাও বরণ করতে পারেন যাই হোক, এরপর বরকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও দুধ এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয়
সাতপাক : বিবাহের মণ্ন্ডপে প্রথমে বরকে আনা হয়। এরপর কন্যাকে পিঁড়িতে বসিয়ে আনা হয়সাধারণত: কন্যার জামাইবাবুরা পিঁড়ি ধরে থাকেন। কন্যা পান পাতা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখেন। কন্যাকে পিঁড়িতে করে বরের চারপাশে সাতপাক ঘোরানো হয়।
শুভদৃষ্টি : কনে দুটি পানপাতা নিয়ে দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে বিবাহের মন্ডপে আসে এরপর জনসমক্ষে কনে মুখ থেকে পানপাতা সরিয়ে নেয় এবং বর-কনে উভয় উভয়কে দেখে, এরই নাম শুভদৃষ্টি শুভদৃষ্টির অর্থ হল যে পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, বিয়ের আসরে সেই পাত্রী উপস্থিত আছে কি না তা পরীক্ষা করে নেওয়া বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে ছাদনাতলায় এই  স্ত্রী-আচারটি করতে হয় পাত্রী বদলা-বদলা করে দেওয়ার ঘটনা একদা ঘটত তুলনামূলক সুন্দরী মেয়েকে সরিয়ে দিয়ে তুলনামূলক কুৎসিত হাজির করা হত এটা প্রতারণারই নামান্তর তাই মনুসংহিতায় বলা হয়েছে – “অন্যাং চেদ্ দর্শয়িত্বান্যা বোঢ়ুঃ কন্যা প্রদীয়ক্তে।/উভে তে একশুল্কেন বহেদিত্যব্রবীন্মনুঃ।।অর্থাৎ, বরের নিকট থেকে পণ নেওয়ার সময়ে একটি কন্যাকে দেখিয়ে বিবাহের সময়ে যদি তাকে (বরকে) অন্য একটি মেয়েকে দেওয়া হয়, তা হলে সেই বরটি ওই একই শুল্কে দুইটি কন্যাকেই পাবে (/২০৪)
মালাবদল : কন্যা ও বর মালাবদল করেন। এই রীতির অর্থ হচ্ছে দুজন একে অন্যকে জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিলেন। (মুসলমান মতে একইভাবে কন্যাকে বলতে হয় কবুলআবার ঠিক এই রকমই খ্রিস্টান মতে চার্চের ফাদারের সামনে বর ও কন্যা বিবাহে সন্মতি জানান)
সম্প্রদান : কন্যার পিতা কন্যাকে জামাতার হাতে সম্প্রদান করেন বেদমন্ত্রে। পিতার অবর্তমানে জ্যাঠা, কাকা, দাদা সম্পর্কীয় ব্যক্তিরা সম্প্রদান করার অধিকার রাখে বরও জানান যে তিনি কন্যার ভরণপোষণের দ্বায়িত্ব নিলেন। বিবাহের মন্ত্র হল " ওঁ যদেতদ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।" অর্থাৎ, “তোমার হৃদয় আমার হৃদয়ে থাকুক, আমার হৃদয় তোমার মধ্যে থাকুক
লাজাঞ্জলি : কনের পিছনে বর চার হাত এক জায়গা করে কুলোয় খই নিয়ে যজ্ঞের আগুনে দেন। প্রচলিত বাংলায় একে বলে খই পোড়া। বৈদিক যুগে মানুষ নানা ধরনের শক্তির উপাসনা করতেন। অগ্নিও তাদের মধ্যে অন্যতম। যজ্ঞ হচ্ছে পবিত্র আগুনের সামনে পুরোহিত দ্বারা বর এবং কনেকে বেদমন্ত্র পাঠ করানো। মন্ত্র : “ওঁ ইয়ং নার্যুপধ্রূতে লাজানাবপন্তিকা দীর্ঘয়ুরস্তু মে পতিরেধন্তাং জ্ঞাতয়ো মম।। ওঁ ইমাল্লাঁজানাবপাম্যাগ্নৌ সমৃদ্ধকরণং তব মম তুভ্য সংবননং তদগ্নিনুমন্যতামিয়ং স্বাহা।।" অর্থাৎ, “হোমের অনলে লাজাজ্ঞলি দিই আমার পতি ও জ্ঞাতিরা দীর্ঘজীবী হন এই লাজ অগ্নিতে সমর্পণ করে তোমার সমৃদ্ধি চাইছি তোমার আমার মনে জাগুক অনুরাগ অগ্নি ও স্বাহা এই আমাদের মিলন মেনে নিক
সিঁদুর দান : বিবাহের শেষ রীতি হল বর কন্যার কপালে সিঁদুর লেপন করেন। তবে হিন্দুদের মধ্যে সিন্দুর দান নিয়ম সব জায়গায় একরকম নয় বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেই তিনরকম সিন্দুর দানের নিয়ম লক্ষ করেছি () বিয়ের পরদিন অর্থাৎ বাসি বিয়ের দিন বর কনের সিঁথিতে সিন্দুর তুলে দেয়, () বউভাতের দিন বর-কনে ফুলশয্যার জন্য ঘরে ঢোকে এবং বন্ধ-ঘরে বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর তুলে দেয় এবং () বর কনের দিকে না তাকিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরাবে সিন্দুর দানের মধ্য দিয়েই বাঙালি হিন্দুদের বিবাহ সম্পূর্ণতা পায় বাঙালি হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুর পরেন।
সপ্তপদী : সপ্তপদী হচ্ছে পবিত্র আগুনের চারদিকে বর ও কনেকে সাতপাক ঘোরানো। এ সময় পুরোহিতের মাধ্যমে বর-কনেকে মিলিতভাবে দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য বিয়ের অঙ্গীকার করানো হয়। সাতপাক ঘোরা মাত্র বিবাহ আইনত সম্পন্ন হয়ে যায়। মন্ত্র : প্রথম চরণ – “ওঁ ঈশে একপদী ভব, সা মামনুব্রতা অর্থাৎ, প্রথম চরণ ফেলো, তুমি আমার অনুব্রতা হও দ্বিতীয় চরণ – “ওঁ উজে দ্বিপদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব অর্থাৎ, দ্বিতীয় চরণ ফেলো, সমস্ত কর্মে আমার অনুব্রতা হও তৃতীয় চরণ – “ওঁ রায়স্পোষায় ত্রিপদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব অর্থাৎ, তৃতীয় চরণ ফেলো, সম্পদে হও আমার অনুব্রতা চতুর্থ চরণ – “ওঁ মায়োভব্যায় চতুষ্পদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব অর্থাৎ, চতুর্থ পদ ফেলো, সকল আনন্দে আমার অনুব্রতা হও পঞ্চম চরণ – “ওঁ প্রজাভ্যঃ পঞ্চপদী, সা মামনুব্রতা ভব অর্থাৎ, পঞ্চম পদ ফেলো, পুত্রবতী হয়ে হও আমার অনুব্রতা ষষ্ঠ চরণ – “ওঁ ব্রতেভ্যঃ ষট্ পদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব অর্থাৎ, ষষ্ঠপদ ফেলো, সকল ব্রতে হও আমার অনুব্রতা সপ্তম চরণ – “ওঁ সখে সপ্তপদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব অর্থাৎ, সপ্তম ফেলো, সখ্যতায় হও আমার অনুব্রতা
কনকাঞ্জলি : বিয়ে করতে যাওয়ার সময় কোথাও বররূপী পুত্র সোনা বা রূপো সহ সতন্ডুল মায়ের আঁচলে দান করার আঞ্চলিক অনুষ্ঠান। উত্তরবঙ্গে কোন কোন সমাজে বরকে যখন বরণ করা হয় ,তখন বর শাশুড়ীর আঁচলে এক মুষ্ঠি পান সুপারী ও একটি টাকা ফেলে দেয় ,এইপ্রথাটিও কনকাঞ্জলি নামে পরিচিত। কন্যা অবস্থায় পিতার কাছে অন্নঋণ থাকেঋণী ব্যাক্তিকে দান করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ, তাই বিয়ের আগে পিতার হাতে একমুঠো ধুলো দিয়ে বলে সোনামুঠো নিয়েছিলাম,ধুলোমুঠো দিয়ে শোধ করলাম। কোথাও কোথাও মা মেয়ের ঠিক পেছনেই আঁচল পেতে থাকেন, মেয়ে মাথার ওপর দিয়ে চাল পিছনে ফেলে, মায়ের আঁচলে চাল পড়ে। তিন বার ফেলতে হয়। উভয়েই হাপুস ক্রন্দনরত,আশপাশে প্রচুর সান্তনাদাত্রী। তবে অনেক আধুনিকমনস্করা এই কুৎসিত আচারটিকে বাতিল বা বর্জন করেছেন সম্প্রতিমন নিয়ে কাছাকাছিবাংলা ধারাবাহিকের একটি বিয়ের দৃশ্যে কনকাঞ্জলি আচারটি বাতিল করা প্রদর্শন করেছে
এছাড়া আছে অধিবাস, নান্দীমুখ, জল সওয়া, ছাদনাতলা, বাসরঘর, বাসি বিয়ে, বধূবরণ, কালরাত্রি, ভাত-কাপড়, বউভাত, ফুলশয্যা, দ্বিরাগমন ইত্যাদি স্ত্রী-আচার
স্ত্রী-আচারে ভরপুর যৌনতা : হিন্দু বিবাহ জুড়ে যৌনতা এবং যৌনমিলনের প্রস্তুতি বিদ্যমানশুধু নির্ভেজাল অনুষ্ঠান নয়, প্রতিটি স্ত্রী-আচারে অর্থবহ ইঙ্গিতযৌনতারই প্রতীক ছড়িয়ে আছে সর্বত্রযেমনছাউনি নাড়া = আচ্ছাদন নাড়া, অর্থাৎ সতীচ্ছদ নাশপরামাণিক = প্রামাণিক বা নাপিত, অর্থাৎ যিনি কন্যার অক্ষত যোনি প্রমাণ করেপান = সতীচ্ছদ, যোনিকড়ি = যোনিলাজ বা খই = যোনিকুলো = যোনি ঘি = বীর্যআংটি = যোনিমাল্যদান = মৈথুনক্রিয়ামালা = যোনিবরের মুকুট = অণ্ডকোশ সহ পুরুষাঙ্গকনের সিঁথিমৌড় = স্ত্রীযোনি (উলটো করে পড়লে যেমন দেখায়)শমী = গর্ভপাতের প্রতিষেধকশিল বা শিলা = স্ত্রীযোনিনোড়া = পুরুষাঙ্গতত্ত্বের রুইমাছ = পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ ইত্যাদিএছাড়া বিয়ে-অনুষ্ঠান চলাকালীন বিভিন্ন মন্ত্র পড়তে পড়তে পাত্র এবং পাত্রীর একে-অপরের শরীর ছোঁয়াও যৌনতার দিকে ঠেলে দেওয়া স্পষ্ট
অগ্নিসাক্ষী করে বা ধর্মীয় বিবাহই হিন্দুসমাজে সর্বাধিক সমাদৃতএর সঙ্গে আইনের বিবাহও যুক্ত হয়েছেআইনর যুক্ত হলেও ভারতে বহু মানুষ আইনের বিয়ে করেন না নানা কারণেতাঁরা শুধু ধর্মীয় আচরণ মেনেই বিয়ে সাঙ্গ করেনঅনেকে আবার শুধুমাত্র আইনের বিয়ে (Registry Marriage) করেই ঘরসংসার শুরু করে দেনকেউ কেউ অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে এবং আইনের বিয়ে দুটোই করেন
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আইনি বিবাহ : হিন্দু বিবাহ বিধি (হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৯৫৫) আইন জন্মু ও কাশ্মীর ছাড়া ভারতের অন্য সব জায়গাতেই প্রযোজ্য। কোনও হিন্দু যদি এই আইনের আওতায় পরে এমন কোনও স্থানে বসবাস করেন - তাহলে তিনি বাইরে থেকে এলেও এই আইন তাঁর প্রতি প্রযোজ্য হবে। অহিন্দু, অর্থাৎ, খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, পারসিদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য নয়। হিন্দু ও অহিন্দুর মধ্যে বিবাহ একমাত্র সম্ভবপর "সিভিল ম্যারেজ"-এর সাহায্যে। ১৯৫৪ সালের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রদেশ সরকারের নিয়োজিত ম্যারেজ রেজিস্ট্রাররা এই বিয়ে দিতে পারেন।
হিন্দু বিবাহ বিধিতে সামাজিক প্রথা ও নিয়ম অনুযায়ী হিন্দু বিবাহ সম্পন্ন হলে তাকে বৈধ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং সপ্তপদী যেসব বিয়ের একটি অঙ্গ, অগ্নিসাক্ষী করে সপ্তপদী হয়ে যাওয়ার পরেই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ধরা হয়। হিন্দু আইনে কোথাও বলা হয়নি যে, উভয়পক্ষের সন্মতি না-থাকলে বিয়ে অসিদ্ধ হবে। কিন্তু যদি কোনও পক্ষের সন্মতি অসৎ উপায়ে বা জোর করে নেওয়া হয়, তাহলে সেই বিয়ে অবৈধ ঘোষিত হতে পারে।
বৈধ বিবাহের শর্ত: () হিন্দু হতে হবে। () ন্যূনতম বয়স পাত্রের ক্ষেত্রে ২১ ও পাত্রীর ক্ষেত্রে ১৮ বছর হতে হবে (এর থেকে কম বয়সে বিবাহ করা দণ্ডনীয় অপরাধ, যদিও তার জন্য বিবাহটি অবৈধ নাও হতে পারে)। () বিবাহকালে পাত্রীর অন্য স্বামী বা পাত্রের অন্য স্ত্রী জীবিত থাকলে চলবে না। () পাত্র ও পাত্রী পরস্পরের নিকট আত্মীয় (যা আইনত নিষিদ্ধ) হবেন না। (বিভিন্ন লোকাচার অনুয়াযী এগুলি শিথিলযোগ্য। যেমন দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গায় মামা তাঁর ভাগ্নীকে বিবাহ করতে পারেন)। () উভয়ের কেউই সপিণ্ড হবেন না কারোর সপিণ্ড সম্পর্ক বিচার করতে হলে প্রথমে দেখতে হবে সেই সেই ব্যক্তিকে প্রথম প্রজন্ম হিসেবে ধরে তার মায়ের দিক থেকে তিনটি প্রজন্ম (Generation) আগে এবং বাবার দিক থেকে পাঁচটি প্রজন্ম আগে কারা ছিলেন। দুজনকে তখনই সপিণ্ড বলা হবে যদি একজনের সপিণ্ড সম্পর্কের কেউ অন্য জনের সপিণ্ড সম্পর্কের হয় অথবা একজন অন্যজনের সপিণ্ড সম্পর্কের কেউ হয়
নিষিদ্ধ সম্পর্কগুলির বিবরণ : আপন সন্তান। পুত্রবধূ, জামাতা, পিতার স্ত্রী, মাতার স্বামী। সহোদরা ভাই, বোন, মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো, খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো সবাই। মেয়েদের মামা, কাকা, ও জ্যাঠা। ছেলেদের মাসি ও পিসি।
হিন্দু বিবাহ বিধিতে অসিদ্ধ (Void) এবং অসিদ্ধ-সম্ভব (Voidable) বিবাহের কথা বলা হয়েছে। বিবাহ অসিদ্ধ হবে যদি প্রাক্বিবাহ বাধা সত্ত্বেও বিবাহ সংঘটিত হয়এই বাধাগুলিকে আবার দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে -- () নিরঙ্কুশ বাধা : এই বাধা সত্ত্বেও কেউ বিবাহ করলে সেটি প্রথম থেকেই অবৈধ। যে-কোনো পক্ষ আবেদন জানালে এটি অসিদ্ধ বলে জারি করা হবে। () আপেক্ষিক বাধা : এক্ষেত্রে বিবাহ অসিদ্ধ বলে ঘোষিত হতে পারে, যদি কোনও পক্ষ তার জন্য আবেদন করে।
বিবাহকালে পাত্রের অন্য স্ত্রী বা পাত্রীর অন্য স্বামী জীবিত থাকলে চলবে না। পাত্রপাত্রী সপিণ্ড হবে না পাত্রপাত্রী সম্পর্ক নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে পড়বে না এছাড়াও অন্য কারণে বিবাহ অসিদ্ধ হতে পারে, যেমন, বিবাহঅনুষ্ঠানের আবশ্যকীয় অংশগুলি পালন না করা। অসিদ্ধ (void) বিবাহের সঙ্গে অসিদ্ধ-সম্ভব (voidable) বিবাহের তফাত্ হল অসিদ্ধ-সম্ভব বিবাহ বৈধ বলে ধরা হবে যদি না কোনও এক পক্ষ এটি অসিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য আবেদন জানায় এবং সেই আবেদন গৃহীত হয়ে বিবাহ বাতিল করা হয়। সেক্ষেত্রে বিবাহের দিন থেকেই এই বিবাহ অসিদ্ধ বলে ধরা হবে। অসিদ্ধ-সম্ভব বিবাহের মূলে চারটি কারণ থাকতে পারে : () স্বামী যদি পুরুষত্বহীন হয়। () বিবাহের সময়ে কোনও পক্ষ পাগল বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হয়। () বিবাহে সম্মতি আদায় করেছে শঠতার আশ্রয় নিয়ে বা জোর করে -- এক্ষেত্রে (ক) শঠতা ধরা পরার বা বলপ্রয়োগের (যা শারীরিক মানসিক দুই হতে পারে) এক বছরের মধ্যে আবেদন জানাতে হবে এবং (খ) বলপ্রয়োগের বা শঠতা আবিষ্কৃত হওয়ার পর আবেদনকারী স্বেচ্ছায় অন্যপক্ষের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হননি: () বিবাহের পূর্বে পাত্রী যদি অন্য পুরুষের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে থাকে। -- এক্ষেত্রে (ক) বিবাহের সময়ে পাত্রীকে গর্ভবতী থাকতে হবে, (খ) গর্ভধারণ ঘটেছে স্বামী ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের দ্বারা; (গ) আবেদনকারী বিবাহের সময়ে এই গর্ভধারণের কথা জানতেন না; (ঘ) স্ত্রী গর্ভবতী জানার পর স্বামী স্বেচ্ছায়ে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হননি; (৫) গর্ভবতী জানতে পারার এক বছরের মধ্যে স্বামীকে আবেদন করতে হবে।
বিবাহ-বিচ্ছেদ : অর্থশাস্ত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা উল্লিখিত হয়েছে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনের অমিল হলে এবং উভয় পক্ষ রাজি হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যেত । স্বামী দুশ্চরিত্র, চিরপ্রবাসী, রাজদ্রোহী বা ক্লীব হলে স্ত্রী তাকে পরিত্যাগ করতে পারত স্ত্রী যদি পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম হত, তাহলে আট বছর অপেক্ষা করবার পর স্বামী তাকে ত্যাগ করতে পারত । এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী ভরণপোষণ দাবি করতে পারত  হিন্দু বিবাহ বিধিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করা চলতে পারে এবং উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারলে আদালত তা মঞ্জুর করতে পারেকিন্তু বিবাহ হবার পর থেকে তিন বছরের মধ্যে এই আবেদন করা চলবে না। নিম্নলিখিত কারণগুলি উপযুক্ত কারণ হিসেবে গণ্য করা হবে : হিন্দু বিবাহ আইনের ফলে কোনো পুরুষ স্ত্রীর জীবদ্দশায় অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের আগে অন্য বিয়ে করতে পারেন নাতবে এই আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী যে-কোনো হিন্দু বিবাহই এই কারণগুলির জন্য বাতিল করা যেতে পারে – () যেখানে স্বামী হীনবল, পুরুষত্বহীন অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ইম্পোটেন্ট() যেখানে স্ত্রী বিয়ের আগেই অন্য কারোর ঔরসে গর্ভবতী হয়েছেন () যেখানে পাত্র বা পাত্রীর অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয়, অথবা ২১ বছরের নীচে পাত্র এবং ১৮ বছরের নীচে পাত্রীর অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয়ছলনা, প্রতারণা বা প্ররোচনা করে যেখানে বিয়ে হয় () যেখানে বিয়ে হিন্দু বিবাহ আইনের পঞ্চম ধারা অর্থাৎপ্রোহিবিটেড ডিগ্রিজ’-এর বাধা লঙ্ঘন করে হয়প্রোহিবিটেড ডিগ্রিজ’, অর্থাৎ যে বৈবাহিক সম্পর্ক খুব নিকট আত্মীয়, ব্লাড রিলেশনসদের মধ্যে হয়, তা বাতিল করানো সম্ভব
বিয়ে বাতিল যদি করাতে হয় তাহলে তার জন্য দরখাস্ত বা আবেদন করতে হবে ছলনা বা প্রতারণা আবিষ্কৃত হওয়ার এক বছরের মধ্যে, অথবা সেই প্রভাব বর্তমান থাকাকালীন সময়েআদালত এই আবেদন গ্রাহ্য করবেন যদি বিয়ের আগে আবেদনকারী ব্যাপারে ওয়াকিবহাল না হয়ে থাকেন এবং সেই আবেদন বিয়ের এক বছরের মধ্যে উপস্থাপন করা হয় এবং ওই প্রতারণা সম্পর্কে জানার পর যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো যৌন সম্পর্ক না হয়ে থাকেঅপরদিকে হিন্দু বিবাহ আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী যে-কোনো বিয়ে ওই আইন প্রবর্তিত হওয়ার আগে বা পরে যখনই সম্পন্ন হোক না-কেন এই কারণগুলির জন্য বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য আবেদন করা যায় – () বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পরে স্ত্রী বা স্বামী নিজের সঙ্গী বা সঙ্গিনী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে () বিবাহের পর অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করলে() আবেদন পেশ করার আগে আবেদনকারীকে যদি বছর ধরে তাঁর স্বামী বা স্ত্রী ত্যাগ করে থাকেন () স্বামী বা স্ত্রীর মস্তিষ্ক বিকৃতির ফলে তাঁর সঙ্গে আবেদনকারীর জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে উঠলেমস্তিষ্কের বিকারের মধ্যে নানান মানসিক ব্যাধি, অপরিণত বুদ্ধি () মানসিক অসুস্থতা বা অপূর্ণতা বোঝায় () স্বামী বা স্ত্রী কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত হলে () স্বামী বা স্ত্রী সংক্রামক যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হলে () স্বামী বা স্ত্রী সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করলে () বছর তাঁর কোনো সন্ধান না পেলে
উপরের কারণগুলি ছাড়াও যেখানে আইন অনুমোদিত বিচ্ছেদের (জুডিশিয়াল সেপারেশন) ডিক্রি জারি হওয়ার পরই স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় না অথবা সে ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ আবেদন করা সম্ভবআবার স্বামী যদি বিয়ের পর বলাৎকার বা ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন, অথবা অন্য পুরুষের সঙ্গেঅস্বাভাবিকযৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন এবং তা প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রেও স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা রজু করতে পারেন
হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের ২৪ ধারা অনুযায়ী ইন্টেরিম অ্যালিমনি বা অন্তর্বর্তীকালীন খোরপোশের ব্যবস্থা করা হয়েছেঅর্থাৎ যতদিন বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা চলবে, ততদিন স্ত্রীর খোরপোশের জন্য টাকার কী ব্যবস্থা হবে তা আদালত দুই পক্ষের অবস্থা বুঝে নির্ধারণ করবেনবাদী প্রতিবাদীর আর্থিক সংগতির বিবেচনা করে আদালত মামলার খরচের ব্যবস্থা করেনএছাড়া মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় আদালত পাকাপাকি খোরপোশ অর্থাৎ পারমানেন্ট খোরপোশের ব্যবস্থা করে
ইসলামী বিবাহরীতি : ভারতবর্ষে মুসলিম আইন সৃষ্টি হয়েছে মূলত কোরানের নির্দেশ থেকে (তবে নির্দেশগুলি সংশোধিত হয়েছে বিধানসভা ও লোকসভায় গৃহীত বিল এবং কোর্টের বিভিন্ন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে) মুসলিম আইন (শরিয়ত) অনুসারে বিবাহ বা নিকা হল পরস্পরের উপভোগের জন্য এবং বৈধ সন্তান উত্পাদনের জন্য স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া। ইসলামী বিবাহরীতিতে পাত্র-পাত্রী উভয়েরই সম্মতি এবং বিয়ের সময় উভয়পক্ষের বৈধ অভিভাবক বা ওয়ালির উপস্থিতি ও সম্মতির প্রয়োজন ইসলামী বিবাহে দহেজ বা যৌতুকের কোনো স্থান নেই বিয়ের আগে পাত্রের পক্ষ থেকে পাত্রীকে পাত্রীর দাবি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বা অর্থসম্পদ বাধ্যতামূলক ও আবশ্যকভাবে দিতে হয়, একে দেনমোহর বলা হয় এছাড়া বিয়ের পর তা পরিবার পরিজন ও পরিচিত ব্যক্তিবর্গকে জানিয়ে দেওয়াও ইসলামী করণীয়গুলির অন্তর্ভূক্ত ইসলামে বিবাহ-পূর্ব ও বিবাহ-বহির্ভূত যৌনতা নিষিদ্ধ ইসলাম ধর্মে বিয়ের মাধ্যমে শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্কের অনুমতি আছে সমকামিতা ও সমকামী বিয়ে উভয়েই প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও বিকৃত যৌনাচার হিসাবে ইসলামে অবৈধ ও নিষিদ্ধ|
বিবাহের বিধান : ইসলামী বিধান অনুযায়ী, একজন পুরুষ সকল স্ত্রীকে সমান অধিকার প্রদানের তার চাহিদা অনুসারে সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে (এক স্ত্রীর বর্তমানে আর-একটি বা একাধিক বিবাহ করাকে বহু বিবাহ বলে। ইসলামী আইনে বলা হয়েছে, কেউ যখন বস্তুগত দিক দিয়ে এবং স্নেহ ভালবাসার দিক দিয়ে প্রত্যেক স্ত্রীর সঙ্গে সমান আচরণ করতে পারবে কেবলমাত্র তখনই সে চারটি পর্যন্ত বিবাহ করতে পারবে। তবে বাস্তবে এটা কখনও সম্ভব নয়। কারণ যে স্বামী নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসে তার দ্বিতীয় বিবাহ করার ইচ্ছেই হবে না। কাজেই পবিত্র কোরান শরিফে বহু বিবাহকে অনুমতি দেওয়ার চেয়ে একটি বিবাহ করাই উত্তম বলে উল্লেখ করেছে। যদিও মুসলিম সমাজে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের আইনগত অধিকার স্বামীদের থাকলেও নারীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধান নেই। বহুবিবাহের আর্থসামাজিক বাস্তবতা ইসলামে বহুবিবাহের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে ইসলাম আবির্ভাবের প্রথমদিকে একটি ভিন্ন আর্থসামাজিক ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক বাস্তবতায়। মূলত বিধবা, এতিমদের নিরাপত্তা ও রক্ষার জন্য ইসলামে এ ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেই সময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওহুদের যুদ্ধে বহু মুসলিম পুরুষ শাহাদত বরণ করেন, ফলে স্বাভাবিকভাবে অভিভাবক ও স্বামীহীন নারীরা চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। এসব নারীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার জন্য বহুবিবাহ প্রথা চালু হয়।) করতে পারে আর সমান অধিকার দিতে অপারগ হলে শুধু একটি বিয়ে করার অনুমতি পাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে একাধিক বিয়ের অনুমতি নেই একজন মুসলিম পুরুষ মুসলিম নারীর পাশাপাশি ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান নারীকে বিয়ে করতে পারবে কিন্তু মুসলিম নারীরা শুধু মুসলিম পুরুষের সঙ্গেই বিয়েতে আবদ্ধ হতে পারবে ইসলামে বিবাহ বাধ্যতামূলক বা ফরজ নয়, এটি একটি নবির সুন্নত। একজন মুসলমান চাইলে বিয়ে না-করে সে সারাজীবন একা একা থাকতে পারবে তবে প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাবলম্বী মুসলমানকে বিবাহ করায় উৎসাহিত করে ইসলাম।
ইসলাম ধর্মে বিবাহ হল বিবাহযোগ্য দুজন নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রণয়নের বৈধ আইনি চুক্তি ইসলাম ধর্মে পাত্রী তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী বিয়েতে মত বা অমত দিতে পারে একটি আনুষ্ঠানিক এবং দৃঢ় বৈবাহিক চুক্তিকে ইসলামে বিবাহ হিসাবে গণ্য করা হয়, যা পাত্র ও পাত্রীর পারষ্পারিক অধিকার ও কর্তব্যের সীমারেখা নির্ধারণ করে বিয়েতে অবশ্যই দুজন মুসলিম সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে
চুক্তিভিত্তিক বিবাহ : চুক্তিভিত্তিক বিবাহ পদ্ধতিতে কনে বর ও কনের পরিবারের মধ্যে বিয়ে ও বৈবাহিক রীতিনীতির ব্যাপারে বহুবিধ চুক্তি হত যেমন মেয়েরা একই ধর্মের হলেও নিজ গোত্র ব্যতীত বিয়ে করতে পারবে না, সন্তান জন্মের পর কনের পিতৃগৃহে প্রতিপালনের জন্য প্রেরিত হবে প্রভৃতি
যুদ্ধবন্দি বিবাহ : যুদ্ধবন্দি বিবাহ পদ্ধতিতে গোত্রে গোত্রে সংঘটিত লড়াই বা যুদ্ধে এক গোত্র অপর গোত্রের মেয়েদের বন্দি করে নিজেদের বাজারে নিয়ে আসত এবং তাদেরকে স্ত্রী বা দাসী হিসাবে বিক্রি করা হত
যৌতুকের বিবাহ : যৌতুকের বিবাহ পদ্ধতিতে বিয়ের সময় কনেপক্ষ বরপক্ষকে যৌতুক প্রদান করত
উত্তরাধিকার সূত্রে বিবাহ : উত্তরাধিকার সূত্রে বিবাহ পদ্ধতিতে পিতার মৃত্যুর পর পুত্র তার মাকে বিয়ে করতে পারত
ইসলাম আগমনের পর বৈবাহিক প্রক্রিয়ার পূনর্গঠন : ইসলাম আবির্ভাবের পর নবি প্রচলিত বৈবাহিক রীতির পুনর্গঠন করেন তিনি চুক্তিভিত্তিক বিবাহ এবং যৌতুকের বিবাহের পুনর্গঠন করে পাত্রীকে মত প্রকাশের অধিকার দেন এবং যৌতুক বা পণ পাত্রীপক্ষ থেকে পাত্রকে দেওয়ার পরিবর্তে পাত্রপক্ষ বা পাত্র থেকে পাত্রীকে পণ দেওয়ার বিধান চালু করেন যাকে দেনমোহর নামে নামকরণ করা হয় এর পাশাপাশি সম্পত্তি বিবাহ ও বন্দিকরণ বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করেন কোরানের অনেক আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত আয়াত তখন এ বিষয়ে নাজিল হয়
শর্ত : ইসলামী বিবাহে বর, কনে এবং কনের অভিভাবকের(ওয়ালি) সম্মতির(কবুল) প্রয়োজন হয়| বৈবাহিক চুক্তিটি অবশ্যই কনের অভিভাবক (ওয়ালি) এবং বরের দ্বারা সম্পাদিত হতে হবে, বর এবং কনের দ্বারা নয় ওয়ালি সাধারণত কনের পুরুষ অভিভাবক হন, প্রাথমিকভাবে কনের বাবাকেই ওয়ালি হিসাবে গণ্য করা হয় মুসলিম বিয়েতে ওয়ালিকেও অবশ্যই একজন মুসলিম হতে হবে বৈবাহিক চুক্তির সময় চাইলে কনেও সে স্থানে উপস্থিত থাকতে পারে, তবে তা বাধ্যতামূলক নয় বিয়ের পর ঘোষণা করে বা অন্য যে-কোনো পন্থায় সামাজিকভাবে তা জানিয়ে দিতে হবে, যাকে "এলান করা" বলা হয়
রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতে বিবাহে নিষেধাজ্ঞা : পুরুষের জন্য : মা, সৎ মা, বোন, সৎ বোন, দাদি (দিদিমা), বড়োদাদি এবং তাদের মাতৃসম্পর্কের পূর্বসূরী নারীগণ; নানি (ঠাকুরমা), বড়োনানি এবং তাদের মাতৃসম্পর্কের পূর্বসূরীগণ; কন্যা সন্তান, নাতনি, নাতনীর কন্যাসন্তান এবং জন্মসূত্রে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের নারীগুণ (উদাহরণ -- নাতনীর কন্যার কন্যা ও তার কন্যা ইত্যাদি); ফুফু (পিসি), খালা (মাসি), সৎ মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে, দুধ-মা (কোন পুরুষ-সন্তান জন্মের প্রথম দু-বছরের মধ্যে আপন মা ছাড়া রক্ত সম্পর্কের বাইরে যদি কোনো মহিলার স্তন্যদুগ্ধ পান করে থাকে তবে তাকে ওই ছেলে সন্তানের দুধ-মাতা বলা হয় বিবাহের ক্ষেত্রে আপন মায়ের মতো ওই মহিলার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে তাই একজন পুরুষের জন্য তার দুধ-মাতার সঙ্গে এবং দুধ-মাতার বোন ও মেয়ের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ), দুধ-বোন দুধ-মায়ের বোন, আপন পুত্রের স্ত্রী, শাশুড়ি, সমলিঙ্গের সকল ব্যক্তি অর্থাৎ সকল পুরুষ নারীর জন্যেও বিপরীতভাবে লিঙ্গীয় বিবেচনায় উপরোক্ত একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে
মুসলিম বিবাহ বাতিল এবং বিচ্ছেদ : মুসলিম বিবাহ আইনে অনেক অবৈধ বিবাহ বৈধ হয়ে যায় যখন অবৈধতার কারণ লুপ্ত হয়। যেমন, চারটি স্ত্রী বর্তমান থাকলেও কেউ যদি আবার বিবাহ করে, তাহলে সেই বিবাহ অবৈধ (আয়াত-, সুরা- নিসা)কিন্তু সে যদি একজন স্ত্রীকে তালাক দেয় (বা পরিত্যাগ করে), তাহলে তার অবৈধ বিবাহটি বৈধ হয়ে যায়। কোনো নারীর ইদ্দতের সময়কালে তাকে বিবাহ করলে সেই বিবাহ অবৈধ, আবার ইদ্দতের সময়ে পার হয়ে গেলেই সেটি বৈধ বলে গণ্য হবে। [ইদ্দত: স্বামীর মৃত্যুর পর বা বিবাহ-বিচ্ছেদের পর মুসলিম নারী যে সময়ের জন্য (মোটামুটিভাবে তিনমাস বা তার অধিক) একা থাকে] সুন্নি পুরুষ যদি কোনো মুসলিম নারী বা কিতাবিয়াকে [অর্থাৎ, যে ধর্মে ঈশ্বরপ্রদত্ত বাণী পুস্তকাকারে (বাইবেল, কোরান, ইত্যাদি) আছে - সেই ধর্মাবলম্বীকে] বিবাহ করে, তাহলে সুন্নি আইন অনুসারে সেটি বৈধ হবেকিন্তু যে ধর্মে পৌত্তলিকতা আছে (যেমন, হিন্দু ধর্ম), সেই ধর্মাবলম্বী নারীকে বিবাহ করতে পারে না। করলে সেটিকে নিয়ম বহির্ভূত বা অনিয়মিত বলে গণ্য করা হবে। শিয়া আইনে এটি শুধু অনিয়মিত নয়, এটি হবে অবৈধ। সুন্নি ও শিয়া -- কোনো আইনেই মুসলিম নারী কোনো অমুসলিম পুরুষকে (সে কিতাবিয়া হলেও) বৈধভাবে বিবাহ করতে পারে না। সুন্নি আইন অনুসারে সেটি হবে নিয়ম বহির্ভূত বিবাহ। শিয়া আইন অনুসারে সেটি হবে অবৈধ। যদিও কোরান ও হাদিসে এ বিষয়ে সমর্থন নেই, তবুও অন্যান্য চুক্তির মত বিবাহ চুক্তিও যাতে ভঙ্গ করা যায়, তার ব্যবস্থা ভারতবর্ষের মুসলিম আইনে রয়েছে। “The Dissolution of Muslim Marriage Act, 1939” অনুসারে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে নারীর পক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে যাবার কয়েকটি শর্ত আছে – (১) চার বছর যাবৎ স্বামী নিখোঁজ হলে, (২) দুই বছর যাবৎ স্বামী তাকে অবহেলা করছে বা ভরণপোষণ দেয়নি, (৩) স্বামী সাত বছর বা তার চেয়ে বেশি কালের জন্য কারাদণ্ড পেয়েছে, (৪) তিন বছর যাবৎ কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া দাম্পত্য কর্তব্য করেনি, (৫) দুই বছর যাবৎ স্বামীর মাথা খারাপ কিংবা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত বা দুরারোগ্য যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত, (৬) বিবাহের সময় স্বামী অক্ষম ছিল এবং এখনও অক্ষম আছে, (৭) ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগে যে বিবাহ হয়েছিল, ১৮ বছর বয়সের আগেই সে বিবাহকে স্বামী অস্বীকার করেছে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক ঘটেনি, (৮) স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করছে, যেমন-- তাকে প্রহার করছে বা মানসিকভাবে নিপীড়ন করছে, স্ত্রীকে জোর করে অসামাজিক অবৈধ জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে, ধর্মীয় আচরণে হস্তক্ষেপ করছে, স্ত্রীর আইনসংগত অধিকারে বাধা দিচ্ছে, কোরানের অনুশাসন অনুযায়ী সকল স্ত্রীদের সঙ্গে সম-আচরণ করছে না ইত্যাদি।
পুরুষদের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের একক ইচ্ছার আইন আছে যে-কোনো পুরুষ তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারে। যার উদ্দেশে তালাক দেওয়া হল, সে সেখানে না-থাকলেও এই বিচ্ছেদ স্বীকৃতি পাবে। তবে তালাক দেওয়া স্ত্রীকে সেই পুরুষ আবার বিবাহ করতে পারবে না। তালাকপ্রাপ্তা সেই মুসলিম নারী যদি অন্য কোনো পুরুষকে বিবাহ করে এবং সেই বিবাহ ভেঙে যায়, তখনই আবার তাকে বিবাহ করা যাবে। শরিয়ত আইনে স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া হয়েছে দুটি ক্ষেত্রে। এক হল জিহার, অর্থাৎ স্বামী যদি নিষিদ্ধ সম্পর্কের কোনো স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় এবং তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি না হয়। সেক্ষেত্রে স্ত্রী আবেদন করলে আদালত বিবাহ বিচ্ছেদের আদেশ দেবে। স্ত্রী স্বামীকে মুক্তিমূল্য (স্বামীর শর্ত অনুযায়ী খুলা) দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে নিতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সন্মতিতেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, একে বলা হয় মুবারাত
ভারতে মোহম্মদ আহমেদ খান ও শাহবানু  মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, বিবাহ বিচ্ছেদের পরে যদি মুসলিম নারী যদি নিজের ভরণপোষণ চালাতে পারে, তবে পুরুষের দায়িত্ব ইদ্দতের (ইদ্দতকাল হল বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনটি ঋতুকালের পর্যন্ত আর যদি ঋতুর অবস্থা না থাকে তাহলে তিনটি চান্দ্রমাস পর্যন্ত।) পরেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই নারী যদি নিজের ভরণপোষণ চালাতে সক্ষম না-হয়, তাহলে ক্রিমিনাল কোডের ১২৫ ধারা অনুযায়ী তার ভরণপোষণের দায়িত্ব প্রাক্তন স্বামীর থাকবে এরপর মুসলিম স্বামীদের প্রাক্তন স্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে নানান বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়। মুসলিম নারী (বিবাহ বিচ্ছেদের পর অধিকার রক্ষা আইন), ১৯৮৬ পাশ করানো হয় সুপ্রিমকোর্টের এই রায়ের প্রযোজ্যতা সীমিত করার জন্য। সাধারণভাবে ফৌজদারি আইনের ১২৫ ধারা মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, যদি-না সেই নারী ও তার প্রাক্তন স্বামী যৌথভাবে বা আলাদা ভাবে কোর্টে ঘোষণা করে বা স্বীকৃতি দেয় যে তারা ফৌজদারী আইনের ১২৫ থেকে ১২৮ ধারা মেনে চলবে। প্রসঙ্গত ১২৫ ধারার প্রযোজ্যতা সম্পর্কে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। কলকাতা হাইকোর্ট ২০০১ সালে রায় দিয়েছে যে, মুসলিম মেয়েদের ১২৫ ধারায় আবেদনের পথ খোলাই রয়েছে, কারণ ১২৫ ধারা একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আইন। তাঁরা ইচ্ছে করলে এই আইনের সুযোগ নিতে পারবেন। ১২৫ ধারা বেশ কঠোর আইন। এই ধারায় টাকা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলে, সেই টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না দিলে, ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ারেন্ট জারি করতে পারবে। সময়মত টাকা না-দিলে একমাসের বা যতদিন টাকা না-দেওয়া হচ্ছে ততদিন কারাদণ্ডের আদেশ দিতে পারবে।
তালাক : ‘তালাকশব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন’, ‘ত্যাগ করা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক বলা হয়। স্বামী সর্বাবস্থায় তালাক দিতে পারেন। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক দিতে পারবেন, যদি বিয়ের সময় এর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়। মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে -- "কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাহকে মুসলিম আইনে অনুমোদিত যে-কোনো পদ্ধতিতে ঘোষণার পরই তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এ মর্মে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ প্রদান করবেন এবং স্ত্রীকেও সেগুলির নকল দেবেন" অর্থাৎ তালাক প্রদান বা ঘোষণার ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের প্রবর্তিত পদ্ধতিই হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনের পদ্ধতি। তাই শরিয়ত প্রবর্তিত তালাক সংক্রান্ত বিধানাবলি ভালোভাবে জানা ও বোঝা খুবই জরুরিবিশেষ করে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি
তালাকের উদ্দেশ্য : তালাক  দেওয়ার উদ্দেশ্য হল অন্যায়, জুলুম ও নিদারুণ কষ্ট, জ্বালাতন ও উৎপীড়ন ইত্যাদি অশান্তি থেকে মুক্তি লাভ করা। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে তালাক প্রদানের যে উদ্দেশ্য তা হল স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে যে সমস্ত অশান্তি সৃষ্টিকারী কারণগুলি আছে তা  সংশোধনের চেষ্টা করা তালাক শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নবি তালাক সম্পর্কে বলেছেন, তালাক অপেক্ষা ঘৃণার জিনিস আল্লাহ তায়ালা আর সৃষ্টি করেননি হজরত আলি বর্ণিত  বাণী হল : তোমরা বিয়ে করো,  কিন্তু তালাক দিয়ো না কেন-না, তালাক দিলে আল্লাহর আরশ (সিংহাসন) কেঁপে উঠে।
পদ্ধতিগত দিক দিয়ে তালাক তিন প্রকার : (ক) আহসান বা সর্বোত্তম তালাক (তালাকে হাসানা তাকে বলে, যে তুহুরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহবাস, জায়েজ অবস্থা কিংবা গর্ভাবস্থা নেই। উল্লেখিত অবস্থাসমূহ নেই এমন তুহুর অবস্থায় শুধু মাত্র এক তালাক দিয়ে ইদ্দত পূর্ণ হতে দেওয়া। অর্থাৎ তিন তুহুর অতিক্রম করলে তালাকটি কার্যকর হয়ে যায়। এমতাবস্থায় স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্য যে-কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে কিংবা তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী ইচ্ছা করলে এবং স্বামী চাইলে তারা পুনঃবিবাহে আবদ্ধ হতে পারে। এই ধরনের তালককে বলা হয় তালাকে আহসান।) ; (খ) হাসান বা উত্তম তালাক (হাসান তালাক হল প্রত্যেক তুহুরে একটি করে তালাক দেবে। এই নিয়মে তিন তুহুরে তিন তালাক দেওয়ার নিয়মকে তালাকে হাসান বলে। তালাকে হাসান দিলে অর্থাৎ তিন তুহুরে তিন তালাক দিলে সেই স্ত্রী তার স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে। সে তার স্বামীর নিকট রেজাত বা পুনঃবিবাহে আসতে পারবে  না। তবে স্ত্রীর যদি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয় এবং দ্বিতীয় স্বামী যদি কোনো দৈবাৎ কারণে তালাক দেয় অথবা মৃত্যুবরণ করে, তবে ইচ্ছা করলে পূর্বের স্বামীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।) এবং (গ) বিদই বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক (বিদই বা বিদায়াত তালাক হল কোনো ব্যক্তি একসঙ্গে তিন তালাক দিয়ে দেওয়া বা হায়েজ অবস্থায় তিন তালাক দেওয়া অথবা যে তুহুরে সহবাস করেছে সেই তুহুরে তিন তালাক দেওয়া। উল্লেখিত যে-কোনো প্রকারে তালাক দেওয়া হোক না-কেন তালাকদাতা গুনাহগার হবে গর্ভাবস্থা প্রকাশ পাইনি এমন সন্দেহজনক অবস্থায় তিন তালাক প্রদান করাও বিদায়াত বা হারাম। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ তালাক অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন অথবা শরিয়ত প্রবর্তিত পদ্ধতি কোনোটাই অনুসরণ করা হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে চেয়ারম্যান, মেম্বার বা কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি তালাকের নোটিশ সই বা স্বাক্ষর করলেই তালাক হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তারা তালাকের ঘোষণা দেন না, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় তালাকের নোটিশে লেখা হয় এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক ও বাইন তালাক। এমন ধরনের তালাক প্রকাশ্য তালাকে বিদয়ীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যারা এ ধরনের তালাক অনুষ্ঠিত করে থাকেন তারা সবাই গুনাহগার হবেন।)
ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকার : (১) তালাকে সুন্নাত (২) তালাকে বাদী (৩) তালাকে তাফবিজ (৪) তালাকে মোবারত ও (৫) খোলা তালাক। কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকার : (১) তালাকে রেজি ও (২) তালাকে বাইনতালাকে বাইন আবার দুই প্রকার : (১) বাইনে সগির এবং (২) বাইনে কবির। মর্যাদা ও অবস্থানের দিক থেকে তালাক চার প্রকার : (১) হারাম (২) মাকরুহ (৩) মুস্তাহাব এবং (৪) ওয়াজিববিস্তারিত আলোচনা থেকে বিরত থাকলাম কলেবর বৃদ্ধির আতঙ্কে।
তালাকের পর পুনর্বিবাহ : তালাকের পর স্বামী ও স্ত্র্রী পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে তবে তা শর্তসাপেক্ষ। শর্তটি এই যে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কারো সঙ্গে শরিয়া অনুসরণপূর্বক যথাযথভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং নতুন স্বামী তালাক প্রদানের পর আগের স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এই শর্তটি কঠিন, কারণ ইসলাম সামান্য অজুহাতে বা রাগের মাথায় উত্তেজনাবশত তালাক দেওয়ার বিপক্ষে।
কোরানের ৬৬৬৬ টি আয়াতের মধ্যে প্রায় ২০০টি আয়াতে মুসলিম আইনের সাধারণ নীতিমালার বর্ণনা আছেকোরানে উত্তরাধিকার, বিবাহ, তালাক, দেনমোহর, ভরণপোষণ, হিবা, এতিমের মাল রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কিত আইন এবং জুয়াখেলা, সুদ গ্রহণ, নরহত্যা ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত আইন প্রায় ৮০টি আয়াতে লিপিবদ্ধ আছে।
খ্রিস্টান বিবাহ : খ্রিস্টান বিয়ে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং একটি পবিত্র চুক্তি। খ্রিস্টান বিয়ে লিখিত মাধ্যমে সম্পাদিত হয় এবং রেজিষ্ট্রি বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয়। খ্রিস্টান বিয়ের ক্ষেত্রে যিনি বিয়ে সম্পাদন করবেন তিনিই বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করবেন। খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২, বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন ১৮৬৯ এবং উত্তরাধিকার আইন ১৯২৫ সমন্বয়ে সংকলিত আইনবিধান। এ আইন দ্বারা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়। “The law regulating solemnisation of marriages among Indian Christians is laid down in the Indian Christian Marriage Act of 1872. It was the British-Indian administration that enacted the law.The Indian Christian Marriage Act of 1872 extends to the whole of India except the territories which, immediately before the 1st November, 1956, were comprised in the State of Travancore-Cochin, Manipur and Jammu and Kashmir. Therefore this Act does not apply to marriages of Christians solemnised in the territories of the former States of Travancore and Cochin which now form part of Kerala and Tamil Nadu. However, civil marriages among Christians in the former State of Cochin are governed by the provisions of the Cochin Christian Civil Marriage Act (Act V of 1095 M.E = 1920 A.D). There is no statute regulating solemnisation of marriages among Christians in Jammu and Kashmir and Manipur. It is the customary law or personal law that prevails there. It is specifically provided under section 4 of the Act that every marriage in India between persons, one or both of whom is or are a Christian or Christians, shall be solemnised in accordance with the provisions of the Indian Christian Marriage Act and any such marriage solemnised otherwise than in accordance with such provisions shall be void.”( Indian Christian Marriage Act, 1872)
খ্রিস্টান নাগরিকদের বিবাহ খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২-এর বিধান মোতাবেক সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিবাহে পাত্রপাত্রীর একজন বা উভয়ে খ্রিস্টান হলে তাদের বিবাহে এমন এক ব্যক্তি পৌরোহিত্য করেন, যিনি বিশপের দীক্ষা পেয়েছেন কিংবা যিনি স্কটিশ চার্চের একজন যাজক বা এ আইনের আওতায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো ধর্মযাজক। কোনো বিবাহ-নিবন্ধক বা এ আইনের আওতায় নিযুক্ত/লাইসেন্সপ্রাপ্ত অপর কোনো ব্যক্তির উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন হতে হবে। বিবাহে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে কোনো ধর্মযাজকের নিকট উপস্থিত হয়ে এ মর্মে ঘোষণা দিতে হয় যে, এ বিবাহে তার অর্থাৎ পাত্রপাত্রীর কোনো জ্ঞাতিগত, কিংবা অন্য কোনো আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই এবং যুগপৎ তাকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ ধর্মযাজকের কাছে একটি নোটিশও দিতে হয়। ধর্মযাজক এরপর নোটিশ প্রাপ্তি সম্পর্কে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র প্রদানের পর প্রত্যয়নপত্রে উল্লিখিত পাত্রপাত্রীর বিবাহ দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ধর্মযাজক কর্তৃক যথার্থ বিবেচিত রীতি বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে। দেশীয় খ্রিস্টান ব্যতিরেকে ধর্মযাজক কর্তৃক সম্পাদিত অন্য সকলের বিবাহের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। অন্ততপক্ষে দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে নোটিশ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে বিবাহ-নিবন্ধক খ্রিস্টান বিবাহ সম্পন্ন করতে পারেন। বিবাহ-নিবন্ধক নাবালক পাত্রপাত্রীর (দুজনের একজন সাবালক হলেও) তাদের অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া বিবাহ সম্পাদন করতে পারেন না। যাজক বা ধর্মযাজক বা বিবাহ-নিবন্ধক কর্তৃক সম্পন্ন দেশীয় খ্রিস্টানদের বিবাহ আলাদাভাবে নিবন্ধন বহিতে নিবন্ধিত হয়ে থাকে। দেশীয় খ্রিস্টানদের বিবাহের একটি বয়ঃসীমা রয়েছে। অধিকন্তু, কোনো দেশীয় খ্রিস্টানের স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকলে ওই ব্যক্তি অপর কোনো দেশীয় খ্রিস্টানকে বিবাহ করতে পারে না।
বিবাহ-বিচ্ছেদ  আদালতের ডিক্রি ছাড়া বিবাহিত নারী পুরুষের কোনো এক পক্ষের ঘোষণা অথবা উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে খ্রিস্টানদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যায় নাআদালতের ডিক্রিবলে খ্রিস্টান বিবাহ-বিচ্ছেদের বিধান ১৮৬৯ সালের বিবাহ-বিচ্ছেদ আইনের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ আইনের আওতায় স্ত্রী ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী এ কারণ দর্শিয়ে স্বামী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন দাখিল করতে পারে। অনুরূপভাবে, স্ত্রী উল্লিখিত দুই আদালতের যে-কোনো একটির কাছে নিম্নোক্ত যে-কোনো কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন পেশ করতে পারে -- (১) স্বামী আর-এক জনকে বিবাহ করলে ও ব্যভিচারে অপরাধী হলে, (২) স্বামী ব্যভিচারে অপরাধী হলে,  (৩) স্বামী ব্যভিচার সহ দ্বিতীয় বিবাহ করলে, (৪) স্বামী ব্যভিচারসহ নিষ্ঠুরতার অপরাধে অপরাধী হলে, (৫) স্বামী ধর্ষণ, পায়ুকাম বা পাশবিকতার অপরাধে অপরাধী হলে, (৬) স্বামী কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া দু-বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় স্ত্রীকে পরিত্যাগ ও সে সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকলে। (৭) স্বামী বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হলে এবং আর-এক স্ত্রী গ্রহণ করলেযদি আদালত এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে অভিযোগ সম্পর্কে প্রদত্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সঠিক এবং অভিযোগকারীর আবেদন যোগসাজশমূলক নয় অথবা ব্যভিচারের অভিযোগ উপেক্ষাযোগ্য বা মার্জনীয় নয়, তাহলে আদালত বিবাহ-বিচ্ছেদের ডিক্রি মঞ্জুর করেন।
খ্রিস্টীয় বিয়েতে দেশীয় রীতি, কৃষ্টি ও সামাজিক মূল্যবোধ উপলব্ধি করে লোকাচার ও স্ত্রী আচার মিলে একটি নান্দনিক, আনন্দময় ও সুন্দর রূপ দেওয়া হয়েছে
() কনে নির্বাচন : খ্রিস্টান সমাজে সাধারণত প্রথমে পাত্রী দেখা হয়। প্রথমত পাত্রপক্ষই কনে নির্বাচন করে। পাত্রপক্ষ পাত্রী নির্বাচন করে তাঁর চরিত্র, দোষ-গুণ, বংশ পরিচয় জেনে নেয়।
() প্রস্তাব : শুভদিন দেখে পাত্রপক্ষ পাত্রীর বাড়ি যায়। সাধারণত পাশের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে পাত্রীর বাড়ি যায় এবং তাদের উদ্দেশ্যের কথা জানায়।
() বাগদান : পাত্রপক্ষের প্রস্তাবে পাত্রীপক্ষ রাজি হলে বাগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোথাও এ অনুষ্ঠানকেপাকা দেখাও বলে।  এ অনুষ্ঠানকে পানগাছঅনুষ্ঠানও বলে। বাগদান উপলক্ষে  পান, সুপারি, বিজোড় সংখ্যক মাছ নিয়ে যাওয়া হয়।
() বাইয়র : এই অনুষ্ঠানে পাত্রপক্ষের লোকজন পাত্রের বাড়িতে যায়। যা আগেই কথা বলে ঠিক করে রাখা হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত পাত্রপাত্রী সবার আশীর্বাদ গ্রহণ করে।
() নাম লেখা : বিয়ের তিন সপ্তাহ আগে পাত্রী বাড়িতে পুরোহিতের কাছে পাত্রপাত্রী নাম লেখান। অনেকে এ অনুষ্ঠানে আতসবাজি ও বাজনার আয়োজন করে।
() বান প্রকাশ : এই অনুষ্ঠানে পাত্রপাত্রী বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।  মণ্ডলীর বিধি অনুযায়ী এ সময় বিয়ের ক্লাস করতে হয়।  এটি বিবাহ-পূর্ব বাধ্যতামূলক ক্লাস ব্যবস্থা।
() অপদেবতার নজর : নাম লেখা থেকে শুরু করে বিয়ের আগ পর্যন্ত পাত্রপাত্রীকে অতি সংযমী জীবন করতে হয়। অনেকে এ সময় ভূত-প্রেত ও অপশক্তির নজর থেকে রক্ষার জন্য রোজারি মালাবা জপমালাগলায় পরেন।
() কামানি বা গা-ধোয়ানি : বিয়ের আগের রাতের অনুষ্ঠানকে গা-ধোয়ানি বলে। অনেক খ্রিস্টান সমাজে এই দিন গায়ে হলুদ মাখিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠান করা হয়।
() কনে তোলা : বিয়ের দিন ভোরে বাদকদলসহ বরের আত্মীয়-স্বজন কনের বাড়ি গিয়ে পাত্রীকে নিয়ে আসে। পাত্রীকে ঘর থেকে আনার সময় তার হাতে পয়সা দেওয়া হয়। পাত্রী বাড়ি থেকে আসার সময়  সেই পয়সা ঘরের মধ্যে ছুড়ে ফেলে। এর অর্থ হল যদিও সে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে, তারপরও বাড়ির লক্ষ্মী ঘর থেকে চলে যাচ্ছে না।      
(১০) গির্জার অনুষ্ঠান : শুরুতে গির্জার প্রবেশ পথে যাজক বিয়ের পাত্রপাত্রীকে বরণ করে নেয়।
(১১) ঘরে তোলা : এই অনুষ্ঠানে উঠানের দিকে মুখ করে বড়ো পিঁড়ির উপরে বর-কনেকে দাঁড় করানো হয়। এরপর বর-কনে সাদা-লাল পেড়ে শাড়ির উপর দিয়ে হেঁটে ঘরে ওঠে। এ সময় বর ও কনে একে অপরের কনিষ্ঠ আঙুল ধরে থাকে। 
বৌদ্ধ বিবাহ : বৌদ্ধ বিয়ে লোকাচার ও বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী হয়। প্রথমত পাত্রপাত্রী নির্বাচনের পর সামাজিকভাবে সবাইকে জানিয়ে তারিখ ঠিক করে বৌদ্ধ বিহারে পাত্রপাত্রীকে নিয়ে আসা হয়। এখানে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে বুদ্ধের পুজো করা হয়। ত্রিস্বরণ পঞ্চশীল পুজোর মাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুকের আশীর্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়। এরপর একজন গৃহী তাদের সামাজিক অনুশাসন প্রদান করে।
পৃথিবীর সব ধর্মের বিবাহ নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয় এই স্বল্প পরিসরে। প্রধান ধর্মাবলম্বী বিবাহ বিষয়ে মোটামুটি একটা রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র।
বিবাহ এবং যৌনতা : বিয়ে মানেই যৌনজীবন। এক জোড়া নরনারী বিয়ে করেছেন, অথচ যৌনতা বা যৌনক্রিয়া করেননি এমনটা শোনেনি কেউ। যদি তেমন হয় তা হয় অস্বাভাবিক। একদিনের জন্যেও দাম্পত্য জীবন টিকে থাকবে না। কারণ যৌনতাহীন দাম্পত্য জীবন সোনার পাথরবাটি হয়। তাই যৌনতা নিয়ে আছে কঠোরতা। একজন মুসলমানের কাছে কোরান ও হাদিসের আলোকে যৌন সম্পর্ক শুধু মাত্র একজন বিবাহিত স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই পরিসীমাতে সুস্থ্ যৌন সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণসন্তান ধারণ ছাড়াও যৌনসম্পর্ক একটি সুখী বিবাহিত জীবনে প্রধান ভূমিকা রাখে। হাদিস শরিফে রাসুল  মহিলাদের রজঃ থেকে বীর্যস্খলন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারস্পারিক ভালোবাসা ও নৈকট্য বাড়ে। পরবর্তী দুইটি আয়াতে স্বামী/স্ত্রীর যৌনসস্পর্কের ব্যাপারে সরাসরি উল্ল্যেখ আছে।"তোমাদের জন্য রমজানে রাত্রে স্ত্রী-সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে............।" (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭) "লোক রজঃস্রাব সম্পর্কে তোমায় প্রশ্ন করে বল, ‘এটা নাপাকি’, সুতরাং ঋতুমতীর কাছ থেকে দুরে থাক এবং তার সঙ্গে সংগত হোয়ো নাযখন তারা পবিত্র হবে আল্লাহ অনুমোদিত পথে, তখন গমন করিও (সুরা বাকারা : আয়াত ২২২) মহিলাদের রজঃকালীন সময়ে সংগম না-করার কথা বলা হয়েছে, এতে মহিলাদের কষ্ট হয়বিবাহের লক্ষ্য হল দুজন ভিন্ন প্রজাতীর মানুষকে পারস্পারিক সঙ্গ উপভোগ ও মৌলিক মানবিক চাহিদা নিবৃত্তি করার জন্য একত্র করা। "এবং তার চিহ্ন সমূহের মধ্যে একটি হল, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গী তৈরি করেছেন যাতে তোমরা শান্তি পাও এবং তোমাদের মাঝে প্রেম ও ক্ষমা রেখেছেন, যারা চিন্তা করে তাদের জন্য এতে চিহ্ন রয়েছে"। (সুরা রুমঃ আয়াত ২১)
একটি সম্পর্ক বিবাহে রূপ দেওয়ার জন্য স্বাভাবিক কারণেই পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ প্রয়োজন। পরস্পরের সন্মতি অথবা ব্যাতিরেকেই যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা যায়। বিবাহ বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক স্থাপনে মুসলমানদের কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর যেহেতু পারস্পারিক ঘনিষ্ঠতা থেকে বিপরিত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভূত, আর তার থেকে যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়মুসলিমদেরকে এর জন্য তাদের আচার-ব্যবহার পোশাক-আশাকে শালীনতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। অবিবাহিত যুবক-যুবতীদেরকে একত্রে নির্জনে একলা সময় কাটাতে নিষেধ করা হয়েছে, যাতে করে অবাঞ্ছিত সমস্যা এড়ানো যায়।বিবাহ বহির্ভুত যৌনসম্পর্কের কুফলের মধ্যে, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, যৌন রোগ, পরিবার বিভাজন, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও শারিরীক ও মানসিক বিপর্যস্থতা অন্যতম। ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মেও প্রাকবিবাহ ও বিবাহ-পরবর্তী পরকীয়া অনুৎসাহিত করা হয়েছে এবং পাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম অনুসারে কাম (শারীরিক যৌনতার উদ্দেশ্যে কাম) হল ছয়টি ষড়রিপুর একটি, খ্রিস্টধর্মে এটি সাতটি মারাত্মক পাপের মধ্যে একটি পাপ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম ধর্মে অবৈবাহিক (যৌন)কাম নিষিদ্ধ, বৈবাহিক কাম বৈধ এবং বিবাহিত স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে কামদৃষ্টিতে তাকানো নিষিদ্ধ। কাম বা লাস্য হল শরীরে অনুভূত প্রবল চাহিদা, কামনা ও বাসনার একটি আবেগ বা অনূভূতিকাম বিভিন্ন প্রকারের হতে পারেযেমন -- যৌনসঙ্গমের জন্য কাম, জ্ঞানের জন্য কাম, শক্তির জন্য কাম, লক্ষ অর্জনের জন্য কাম ইত্যাদিতবে যৌনসংগমের বাসনা অর্থেই এটি অধিক হারে ব্যবহৃত হয়আশ্রমের প্রথম ধাপ, ব্রহ্মাচার হচ্ছে কোন বালকের শিক্ষার প্রারম্ভকাল। আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহে ব্রহ্মাচার বলতে সংযম বোঝায়। শিশুর চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থায় জীবনের কোন আনন্দ বা ভোগসুখের অবকাশ ছিল না, কারণ এগুলি ছিল কাম (প্রেম ও সৌন্দর্যতত্ত্ব) বৈশিষ্ট্যমূলক, এবং আশ্রমের পরবর্তী ধাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আশ্রমের দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে গার্হস্থ্য, অর্থাৎ সাংসারিক দায়িত্ব পালনের স্তররূপে বিবাহ এবং বৈষয়িক বিষয়াদিও এর অন্তর্ভুক্ত। গার্হস্থ্য পর্যায়ে কামের ভূমিকা ব্যাপক। আশ্রমের তৃতীয় ধাপ বানপ্রস্থ হচ্ছে বৈষয়িক বিষয়াদি হতে অবসর গ্রহণ। এ পর্যায়ে যৌনক্রিয়া কিংবা প্রজনন সংগত বিবেচিত হয় না। বাংলাদেশে পরিণত বয়সে সংযম প্রত্যাশিত, সাবালকত্বের তারুণ্যে যৌনতার প্রাচুর্য গ্রহণযোগ্য, এবং নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে মধ্যবয়সে যৌনক্রিয়া, এমনকি অনাচারও প্রত্যাশিত।
বাইবেলে এমন কোনো হিব্রু বা গ্রিক শব্দ নেই যেখানে নির্দিষ্ট করে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কের কথা বলেছে। বাইবেলে ব্যভিচার ও যৌন অনৈতিকতাকে দৃঢ়তার সঙ্গে অন্যায়বলে থাকে। তাহলে কি বিয়ের আগে যৌনতা অনৈতিক কাজ বলেই ধরা হবে ? ১ করিন্থীয় ৭:২ পদ অনুসারে এর সুস্পষ্ট  উত্তর হচ্ছে -- হ্যাঁ। কিন্তু চারদিকে অনেক ব্যভিচার হচ্ছে, সেইজন্য প্রত্যেক পুরুষের নিজের স্ত্রী থাকুক এবং প্রত্যেক স্ত্রীর নিজের স্বামী থাকুক।এই পদে পৌল বিয়েকে যৌন অনৈতিকতার চিকিৎসা বা রক্ষাকবচবলে উল্লেখ করেছেন। ১ করিন্থীয় ৭:২ পদে মূলত বলা হয়েছে, যেহেতু লোকেরা তাদের যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং তারা বিয়ে ছাড়াই যৌন অনৈতিক কাজ করে বলেই তাদের বিয়ে করা উচিত। তাহলে তারা তো তাদের যৌন উত্তেজনা নৈতিকভাবে প্রশমন করতে পারে। যেহেতু ১ করিন্থীয় ৭:২ পদে সুস্পষ্টভাবে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ককে যৌন অনৈতিকতা বলে উল্লেখ করেছে এবং বাইবেলে বলা অনেক পদে যৌন অনৈতিকতাকে পাপ বলা হয়েছে, সেই অর্থে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কও পাপ বলে ধরা যায়। বাইবেলের সংজ্ঞা অনুসারে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক মূলত যৌন অনৈতিকতার পর্যায়ে পড়ে। বাইবেলে এমন অনেক পদ রয়েছে, যা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ককে পাপ বলে (প্রেরিত ১৫:২০; ১ করিন্থীয় ৫:১; ৬:১৩, ১৮; ১০:৮; ২ করিন্থীয় ১২:২১; গালাতীয় ৫:১৯; ইফিশীয় ৫:৩; কলশীয় ৩:৫; ১ থিশলনীকীয় ৪:৩; জিহুদা ৭ পদ দ্রষ্টব্য)।
অপরদিকে, প্রায়শই আমরা যৌনসম্পর্ক স্থাপন আনন্দেরবিষয় বলে মনে করি কখনও চিন্তা করি না এর ফলে সন্তান জন্ম হওয়ার মতো একটা নেতিবাচক দিক আছে। বিয়ের মধ্য দিয়ে যৌনসম্পর্ক আনন্দের এবং ঈশ্বর এভাবেই তা সাজিয়েছেন। ঈশ্বর চান যেন পুরুষ ও স্ত্রী তাদের বিয়ের গণ্ডির মধ্যে থেকে যৌনানন্দ উপভোগ করে। সলোমনের লেখা পরমগীত এবং বাইবেলের অন্যান্য পদে (হিতোপদেশ ৫:১৯) সুস্পষ্টভাবে যৌনানন্দের কথা বলেছে। যাই হোক, স্বামী-স্ত্রীকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, সন্তান জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ঈশ্বর যৌনতা দিয়েছেন। সেইজন্য, বিয়ের আগে নারী-পুরুষের যৌনমিলন চরমতম ভুল কারণ তারা তো শুধুমাত্র আনন্দের জন্য এটা করছে এবং পারিবারিক কাঠামোর বাইরে সন্তান জন্ম দিতে সুযোগ নিতে যাচ্ছে, যা তাদের প্রত্যেক সন্তানের জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নয়।
যখন বাস্তবভাবে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল -- তা এভাবে নির্ণয় করা যায় না তবু বিয়ের আগে যৌনতা সম্পর্কে বাইবেলের উপদেশ মেনে নিলে যৌনরোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে না, অবৈধ গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকবে না, বিয়ে ছাড়াই মা হওয়ার সম্ভাবনা এবং অনিচ্ছায় গর্ভ হওয়ারও সম্ভাবনা থাকবে না। তা ছাড়াও, পিতা-মাতা উভয়ের সাহচর্য ছাড়া সন্তানের বেড়ে ওঠার সুযোগ তাদের জীবনে থাকবে না। বিয়ের আগে যৌনতা বর্জন বিষয়ে ঈশ্বরের দেওয়া একমাত্র নীতি হচ্ছে সংযম পালন করা। সংযম পালন করলে জীবন রক্ষা পাবে, বাচ্চারা রক্ষা পাবে, যৌন সম্পর্ক সঠিক মূল্য পাবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঈশ্বরকে সম্মান দেওয়া হবে।
খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, যৌনতা অশ্লীল নয়। যৌনতা ঈশ্বর পরিকল্পিত একটি পথ। ঈশ্বর যেদিন বলেছিলেন, মানুষ আপন স্ত্রীতে আসক্ত হবে এবং তাঁরা একাঙ্গ হবে (আদি পুস্তক ২ অধ্যায় ২৪ পদ)সেদিনই ঈশ্বর যৌনতাকে অনুমোদন করেছিলেন। ঈশ্বর যা অনুমোদন করেন, যা ঈশ্বরের ইচ্ছার অনুসঙ্গী তা কখনোই অশ্লীল বা পাপময় হতে পারে না। বাইবেল কখনোই যৌনতাকে অশ্লীল বা নোংরা বলে মনে করেনি। যৌনতা ঈশ্বর প্রদত্ত। তিনটি কারণে ঈশ্বর মানুষের হৃদয়ে এই যৌনতার সৃষ্টি করেছেন। প্রথমত, পুরুষ যেন আপন স্ত্রীতে আসক্ত হয়। আসক্ত হওয়ার অর্থ লেগে থাকা বা সেঁটে থাকা। এদন উদ্যান থেকে বিতাড়নের সময় প্রথম মানবী ইভকে ঈশ্বর অভিশাপরূপে আশীর্বাদ দান করেছিলেন : স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকবে (আদি ৩ : ১৬)এই বাসনাই যৌনতা। বাসনা ব্যতীত সার্থক একাঙ্গতাসম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, স্বামী-স্ত্রী একাঙ্গহবে। যৌনমিলন দ্বারাই এই একাঙ্গতা সম্ভব হয়। নর-নারীর মধ্যে যদি যৌনবোধ না থাকত, তাঁরা যদি পরস্পরের প্রতি আসক্তি অনুভব না করত তবে স্বামী-স্ত্রীর মিলন আদৌ সম্ভব হত না।আসক্তি এবং একাঙ্গতা শুধুমাত্র বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তৃতীয়ত, ঈশ্বর প্রথম মানব-মানবী আদম-ইভকে সৃষ্টি করার পর তাঁদের আশীর্বাদ করেছিলেন, “তোমরা প্রজাবন্ত এবং বহুবংশ হওপরবর্তীকালে ইভকে তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমার গর্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করব, তুমি বেদনাতে সন্তান প্রসব করবে” (আদি ৩ : ১৬)মানব-সৃষ্টি ধারার মধ্য দিয়েই ঈশ্বর সৃষ্টির যে কাজ শুরু করেছিলেন তা অব্যাহত থাকবে।
বিবাহের মাধ্যমে যুবক-যুবতীর কাছে এক অনাস্বাদিত জগতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে আবিষ্কার করে। প্রথম দম্পতি আদম ও ইভ উভয়ে উলঙ্গ থাকত। আর তাঁদের লজ্জাবোধ ছিল না (আদি পুস্তক ২ : ২৫)বিবাহিত জীবনে উলঙ্গতাই বড়ো কথা। স্বামী-স্ত্রীর জীবন হবে স্বচ্ছ কাঁচের মতো। পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে তাঁরা কোনো কিছুই গোপন করবে না। এই উলঙ্গতা প্রাকবিবাহিত জীবন সম্পর্কে প্রযোজ্য। বাইবেলে ঈশ্বর বিবাহের উদ্দেশ্য বিষয়ে বলেছেন, “মানুষ পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে আপন স্ত্রীতে আসক্ত হবে এবং দুজনে একাঙ্গ হবে” (আদি পুস্তক ২ : ২৪)এই একটি বাক্যের মধ্যে বিবাহের উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়েছে – () স্ত্রীর প্রতি আসক্তি এবং () দৈহিক মিলন।
বিবাহে কন্যার বয়স বেশি হবে না কম হবে ? পাশ্চাত্য দেশে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর বয়সের পার্থক্যটা কোনো ব্যাপারই নয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজ্যে স্ত্রীর বয়স স্বামীর বয়সের চেয়ে অনেক বেশিও হয়ে থাকে। অবশ্য বাঙালিদের মধ্যে আত্মীয়স্বজনের যোগাযোগের মাধ্যমে যে বিয়ে সংঘটিত হয় তাতে কন্যার বয়সকে সবসময়ই কম হতে হবে।  যৌনতার দিক দিয়ে বিচার করে কোনো কোনো যৌনবিজ্ঞানী অবশ্য স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর বয়স বেশি হওয়াকেই বাঞ্ছনীয় মনে করেন। তাঁদের মতে নারীর যৌনশক্তির চরম বিকাশ হয় ২৪/২৫ বছর বয়সে এবং পুরুষের ক্ষেত্রে সেই বয়স ১৮/২০। অর্থাৎ ২৫ বছরের একটি যুবতীকে চরম তৃপ্তি দিতে হলে ২০ বছরের যুবকের সঙ্গে মিলিত হওয়া দরকার। ৩০ বছরের পর নারীর এবং ২৫ বছরের পর পুরুষের যৌনশক্তি ক্রমশ কমতে থাকবে। পুরুষের বয়স নারীর চেয়ে বেশি হলে উভয়ের যৌনক্ষমতার সামঞ্জস্য রক্ষা করা কোনোদিনই সম্ভব হয় না। নারী যৌন-অতৃপ্তিতে ভোগে। 
কেউ কেউ মনে করেন, যৌনতার দিক দিয়ে পুরুষের চেয়ে নারীর বয়স কম হওয়া প্রয়োজন। সাধারণত ৪০/৪৫ বছরের পর নারীর ঋতুচক্র বা পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় এবং স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব আসে। নারীর যৌনকামনা তখন থেকে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অথচ পুরুষের জীবনে যৌবন এবং যৌনতাড়না তখনও অটুট থাকে, স্ত্রীর বয়স বেশি হলে মধ্যবয়সে পুরুষরা যৌন-অতৃপ্তিতে ভোগে। স্ত্রীর কাছে যৌনমিলন বিরক্তকর হওয়ায় স্বামীর ডাকে সে সাড়া দিতে রাজি হয় না। যৌনমিলন তখন একটা কর্তব্যহয়ে দেখা দিতে পারে। ফলে দুজনের মনেই বিরক্তি এবং অতৃপ্তি বাসা বাঁধে। পরস্পর পরস্পরকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। অচিরেই সংসারে ভাঙন ধরে।
বিয়ের বয়সের কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা টানা না গেলেও পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সীমা ২৫-৩০ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ২০-২৭ হওয়া বাঞ্ছনীয়। ২৫ বছরের আগে পুরুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা এবং পরিপক্বতা আসে না। ৩০ বছরের বেশি হলে বিবাহিত জীবনে সামঞ্জস্য রক্ষা করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বিবাহের পর সন্তান-সন্ততি হলে তার অবসর গ্রহণের আগেই তাদের স্বাবলম্বী করে যেতে হবে। ২০ বছরের আগে নারীর বিয়ে হলে তার অপরিণত দেহযন্ত্র বহু সন্তানের জন্মদান করে যেমন তার স্বাস্থ্যকে ভগ্ন করবে, তেমনই সংসারের সভ্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে দুঃখ-দারিদ্র্যকে আহ্বান করে আনবে। অপরদিকে ২৭ বছরের পর নারীর দেহযন্ত্রের মধ্যে কাঠিন্য এসে পড়ে। এরপর সন্তান ধারণ করা তার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। বেশি বয়সে বিয়ে করলে নারীর সন্তান ধারণের মধ্যে অনিশ্চয়তাও দেখা দেয়।
পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণী বসবাস করেতারা কেউ বিয়ে করে না। বিয়ে না-করলেও সেইসব প্রাণীদের জন্য যার সঙ্গে খুশি যৌনমিলনে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বিয়ে করে শুধুমাত্র মানুষ। বিয়ে ছাড়া যৌনমিলন মানুষের জন্য অবৈধ, নিষিদ্ধ। তবে প্রাচীন যুগে মানবসমাজে বিয়ের প্রচলন ছিল না। যে-কোনো নারী যে-কোনো পুরুষের ভোগ্যা ছিল। এই ব্যাভিচার বা বহুগামিতাকে রোধ করার জন্য, নিজের সন্তানের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং যৌনতাকে একসঙ্গীতে সীমাবদ্ধ করার জন্য বিয়ে প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বিবাহ ছাড়া মানুষের যৌনমিলনে নিষেধাজ্ঞা জারি হল।
কিছুদিন ফেসবুকে আমি একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম মানুষ বিয়ে করে কেন ?” অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিল। মানুষ কেন বিয়ে করে সে প্রশ্নের উত্তর নানা মানুষ নানাভাবে বলেছে। যে কারণগুলি উঠে এসেছে, তা হল : (১) আমার অর্জিত সম্পত্তি কে পাবে তার জন্য বিয়ে। (২) জীবনটা শেয়ার করার জন্য বিয়ে। (৩) সহবাসের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য বিয়ে। (৪) নিরুপায় হয়ে বিয়ে। (৫) নিজেকে বংশ পরম্পরায় জীবিত রাখার বাসনায় বিয়ে। (৬) একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য বিয়ে। (৭) নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিয়ে। (৮) সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিয়ে। (৯) ভরসা স্থল খুঁজে নেওয়ার জন্য বিয়ে। (১০) মনের কথা বলতে মনের মতো মানুষের সঙ্গে আজীবন যাপন। (১১) পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া ইত্যাদি।
বাৎসায়ন পুরুষার্থ নামক জীবনের চার উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। যেমন --- (১) ধর্ম : ধার্মিক জীবন, (২) অর্থ : আর্থিক সমৃদ্ধি, (৩) কাম : নান্দনিক ও যৌন আনন্দ লাভ ও (৪ ) মোক্ষ : আধ্যাত্মিক মুক্তি। কাম বা যৌনমিলনকে আরও তৃপ্তিদায়ক করতে বাৎসায়ন একটি শাস্ত্রও লিখে ফেললেন, শাস্ত্রটির নামকামশাস্ত্রম্কাম কী ? কাম হল মানবজীবনের অবিরত প্রবাহকে ক্রমবহমান রেখে মানুষের জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি নিবারণের পথ। কামের ভূমিকা মানুষের জীবনে প্রচণ্ড শক্তিশালী। কামের নিবারণ না-হলে মানুষের অবদমিত কাম ক্রোধের সঞ্চার করে। সেই ক্রোধ হতে মানুষের বিবেক নির্বাক হয়। বিবেক নির্বাক হলে মানুষ তার ধর্ম হতে ভ্রষ্ট হয়। আর ধর্ম ভ্রষ্ট মানুষ জীবনের লক্ষ্য পথ হতে সরে আসে। তখন পাপের সঞ্চার ঘটে, যা মানুষটিকে কষ্ট দেয়। কোন্ পথে হাঁটতে গেলে প্রাথমিক ভাবে যেটা জানার প্রয়োজন হয়, তা হল পথ চলা। কামকে আমরা একটি সহজাত প্রবৃত্তি মাত্র ভেবে যদি তাকে অবহেলা করি, বা একটি শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা মাত্র করে থাকি তাহলে আমরা কামের সঠিক নিবৃত্তি করতে পারব না, এর ফলে তৃষ্ণা বাড়ার বদলে কমে যাবে বা কাম বিকৃতি ঘটবে। এর জন্য শাস্ত্রকাররা কামশাস্ত্রের প্রচলন করে গেছেন, যা নারীপুরুষনির্বিশেষ সকল মনুষ্য মাত্রেরই পঠনীয়। গৌতম বুদ্ধও একটি কামসূত্র শিক্ষা দিয়েছেন। এটিঅত্থকবগ্গগ্রন্থের প্রথম সূত্রে পাওয়া যায়। এই কামসূত্র অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে বুদ্ধ ইন্দ্রিয়সুখের অনুসন্ধান কত ভয়ানক হতে পারে তা শিখিয়েছেন।
অর্থাৎ কাম বা যৌনমিলনের বিষয়টা না-থাকলে কে বিয়ে করত ? কামগন্ধহীন কার দাম্প্যজীবন অগ্রসর হয়েছে ? শুধুমাত্র যৌনতার কারণেই কত দাম্পত্যজীবন তছনছ হয়ে গেল তার খবর কে রেখেছে ? কামই মুখ্য, সার্থক যৌনমিলনই প্রথম এবং শেষ মার্গ এটাই বৈবাহিক অধিকার। বাকি সবইকর্তব্য”, যা সমাজ চাপিয়ে দিয়েছে। নিরাপদ, স্বাধীন ও অবাধ যৌনমিলনের শর্ত, যা বাধ্যতামূলক। যৌনমিলনহীন কোনো বিবাহ হয় না, কোনো ধর্মেই হয় না। শুধুমাত্র সন্তানের জন্য কেউ যদি বিয়ে করে থাকেন, তিনি কি সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই যৌনমিলন বন্ধ করে দেন ? ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত বিবাহ মানেই সন্তান দান। বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই সন্তানের জন্ম, একাধিক সন্তানের জন্ম। মহিলারা যেন সন্তান-জন্মের কারখানা। এক-একটা পরিবারে ১০/১৫টা করে সন্তান। অনেক মরত, কিছু বেঁচে থাকত। তখনকার দিনে সন্তানের জন্ম নিয়ন্ত্রণ তেমনভাবে করা যেত না। তাই অনেকের মনে হতেই পারে বিবাহ মানেই সন্তানের জন্ম।
সব বদলে দিল মার্গারেট সেনগার। মার্কিন সংস্কারক মার্গারেট সেনগার ১৯১৪ সালে দ্যা ওমেন রেবেলনামক একটি আট পৃষ্ঠার মাসিক পত্রিকা চালু করেন এবং এর মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রসার শুরু করেন। ইংরেজি 'বার্থ কন্ট্রোল' শব্দটিও তিনিই প্রচলন করেন। ১৯৬০-এর দশকে জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি ও জরাযুস্থ গর্ভ-নিরোধক কলের বাণিজ্যিক উত্পাদন শুরু হলে সাধারণ জনগণের মধ্যে এটি কার্যকর বিস্তার লাভ করে। সোভিয়েত রাশিয়ায়, সামাজিক নারী-সমতা অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জন্ম নিরোধক অত্যন্ত সহজলভ্য করে দেয়া হয়েছিল। আলেক্সেন্দ্রা কলনটাই (Alexandra Kollontai -- ১৮৭২-১৯৫২) নামক একজন মহিলা তত্কালীন জনকল্যাণ অধিদপ্তরে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বয়স্কদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা নেন। অন্যদিকে ফরাসি নারীরা ১৯৬৫ সালে তাদের প্রবল বিরোধিতার মাধ্যমে ফ্রান্সের জন্ম-নিয়ন্ত্রণ নিষেধাজ্ঞা তুলে দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭০ সালে ইতালিতে নারীবাদীরা জন্ম-নিয়ন্ত্রণমূলক তথ্যাদি আরোহণের অধিকার লাভ করে।
যদিও কন্ডোমের ব্যবহার আরও আগে থেকেই প্রচলিত ছিল কিন্তু এটি প্রধানতঃ যৌন রোগ পরিহারের উপায় হিসেবেই ব্যবহৃত হত। অষ্টাদশ শতকে ক্যাসানোভা তার উপপত্নীদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য এক প্রকার প্রতিবন্ধক ব্যবহার করেন যা কন্ডোমের পূর্বরূপ হিসাবে ধারণা করা হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পরিবার পরিকল্পনার একটি অন্যতম বিভাগ। জন্ম বা গর্ভ ব্যাহত করার উপায়গুলিকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন -- শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ব্যাহত করা, ভ্রুণ সঞ্চারণ ব্যাহত করা এবং ঔষধ অথবা অস্ত্রপচারের মাধ্যমে ভ্রুণ অপসারণ করা। ধারণা করা হয় যে, যৌনমিলন ও গর্ভধারণের সরাসরি সংযোগ উপলব্ধির পরই জন্ম নিয়ন্ত্রণের আবিষ্কার হয়। প্রাচীনকালে বিঘ্নিত যৌন মিলন ও বিবিধ প্রকার প্রাকৃতিক ঔষধি (যা গর্ভনিরোধক হিসাবে প্রচলিত ছিল) সেবনের মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করা হত। মিশরীয় সভ্যতায় সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধক ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে গর্ভনিরোধক ব্যবস্থার প্রচলন থাকলেও জনপ্রিয় না-হওয়ার কারণে নর-নারী একাধিক সন্তানের জন্ম দিতে দিতে জেরবার হতেন।
আজ আর সেইদিন নেই। বিবাহ মানেই সন্তান নয়। সন্তানের জন্ম এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। এসে গেছে কন্ডোম। যৌনমিলনে এসেছে বিপ্লব। কন্ডোম এখন সীমাহীন সন্তানের জন্ম থেকে মুক্তি দিয়েছে। রেতঃস্খলনের পর কন্ডোম যৌনসঙ্গীর শরীরে বীর্য প্রবেশে বাধা দেয়। কন্ডোম প্রায় ৪০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে এলেও ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই কন্ডোম ব্যবহার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জন্মনিরোধ পদ্ধতি। আধুনিক সমাজে কন্ডোমের ব্যবহার ব্যাপক মান্যতা লাভ করেছে। এখন বিবাহ মানে যৌনমিলন, যৌনমিলন মানেই আনন্দ, তৃপ্তি।প্রয়োজন হলে সন্তান, না হলে নয়। অবাধ যৌনসুখ। আজকাল বহু দম্পতি সন্তান নেন না। আজকাল বহু দম্পতি জন্ম দিতে অক্ষম হয়। তা সত্ত্বেও কিন্তু বিয়ে টিকে থাকে যদি যৌনতা থাকে। যৌনতা না থাকলে বিয়ে টিকিয়ে রাখা দুষ্কর। যদি টিকেও থাকে তবে সেখানে নিশ্চয় তৃতীয় পক্ষের অস্তিত্ব লক্ষ করা যাবে।
২০১০ সালের মার্চ মাসে সুইজারল্যান্ড সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা ১২ থেকে ১৪ বছরের ছেলেদের জন্য ছোটো আকারের কন্ডোম প্রস্তুত করবে। এই কনডমের নাম রাখা হয়েছে হটশট। সেদেশের সরকারি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বারো থেকে চোদ্দো বছর বয়সি ছেলেরা যৌনসংগমের সময় যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরোধক ব্যবহারের সুযোগ পায় না। একটি প্রমাণ আকারের কন্ডোমের ব্যাস ২ ইঞ্চি (৫.২ সেন্টিমিটার); কিন্তু হটশটের ব্যাস ১.৭ ইঞ্চি (৪.৫ সেন্টিমিটার)। তবে উভয় প্রকার কন্ডোমের দৈর্ঘ্য একই থাকবে ৭.৪ ইঞ্চি (১৯ সেন্টিমিটার)। একটি জার্মান সমীক্ষায় দেখা গেছে ১২,৯৭০ জন ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সিদের দলে এক-চতুর্থাংশেরই বক্তব্য প্রমাণ আকারের কন্ডোম বেশ বড়ো। এ রিপোর্ট থেকে আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না যে, বৈধ বিবাহ পর্যন্তও মানুষ অপেক্ষা করতে পারে না। বিবাহ বহির্ভূত যৌন-সম্পর্ক মানুষ আদি যুগ থেকে আজও করে থাকে, সুযোগ পেলে। শুধু বিয়ের আগেই নয়, বিয়ের পরেও মানুষ বিবাহ বর্হিভূত যৌন-সম্পর্ক করে থাকে। একাধিক নারীসঙ্গ বা পুরুষসঙ্গ লাভ করে। এমন একটা সময় ছিল যখন পরিবারের স্ত্রীদের সতীন নিয়েও ঘর করতে হত।
যৌনতা থেকে মানুষের মুক্তি কবে ছিল ? নিঃঝঞ্ঝাটে যৌনজীবন উপভোগ করার জন্য বিবাহের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। এখানেই শেষ নয়, একটু যৌনসুখের জন্য মানুষ কি না-করে ! এমনকি যথাযথ যৌনসঙ্গীর অভাবে হস্তমৈথুন পর্যন্ত করে থাকে। মানুষের মধ্যে হস্তমৈথুনের হার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন রকমের জরিপ ও গবেষণা হয়েছে। আলফ্রেড কিনসের ১৯৫০-এর দশকের এক গবেষণায় বলা যায়, মার্কিন নাগরিকদের মাঝে ৯২% পুরুষ ও ৬২% নারী তাঁদের জীবনকালে অন্তত একবার হস্তমৈথুন করেছেন। ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের মানুষের মাঝে করার একটি জরিপেও কাছাকাছি ফলাফল পাওয়া যায়। জরিপে দেখা যায় ১৬ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে ৯৫% পুরুষ ও ৭১% নারী তাঁদের জীবনের যে-কোনো সময়ে অন্তত একবার হস্তমৈথুন করেছেন। সাক্ষাৎকারের চার সপ্তাহ আগে হস্তমৈথুন করেছেন এমন পুরুষের হার ৭১% ও নারী ৩৭%। অপর দিকে ৫৩% পুরুষ ও ১৮% নারী জানিয়েছেন যে, তাঁরা এই সাক্ষাৎকারের ১ সপ্তাহ আগে হস্তমৈথুন করেছেন।
২০০৯ সালে নেদারল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যেও বয়সন্ধিকালীন ছেলেমেয়েদের কমপক্ষে প্রতিদিন হস্তমৈথুন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়। অর্গাজম বা রাগমোচনকে শরীরের জন্য উপকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলিতে শিশু গর্ভবতীর ও যৌন সংক্রামক রোগের হারের প্রাপ্ত উপাত্ত লক্ষ করে, তা কমিয়ে আনতে এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়, এবং এটিকে একটি ভালো অভ্যাস হিসাবে উল্লেখ করা হয়। হস্তমৈথুন নতুন কোনো ফ্যাশন নয়, বিশ্বজুড়ে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগের বহু শিলাচিত্রে পুরুষের হস্তমৈথুন করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, অপ্রাকৃতিক যৌন আচরণের সঙ্গে মানুষের পরিচয় প্রাচীন যুগ থেকেই। মাল্টা দ্বীপের এক মন্দির সংলগ্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় চতুর্থ শতকে নির্মিত একটি মাটির ভাস্কর্যে একজন নারীর হস্তমৈথুরত সময়ের চিত্রও পাওয়া গেছে। তদুপরি, প্রাচীন যুগে মূলত পুরুষের হস্তমৈথুনের প্রমাণই বেশি পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা হয় সে সময় এটিই বেশি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন সুমেরীয়দের যৌনতার বিষয়ে শিথিল ধ্যানধারণা পোষণ করত, এবং হস্তমৈথুন সেখানে সক্ষমতা তৈরির একটি উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হত। এটি একাকী বা সঙ্গীর সঙ্গে উভয়ভাবেই সম্পন্ন হত। প্রাচীন মিশরে পুরুষের হস্তমৈথুন আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসাবে বিবেচিত হত। যখন কোনো দেবতার দ্বারা হস্তমৈথুন সংঘটিত হত, তখন তা অনেক বেশি সৃষ্টিশীল ও জাদুকরী কাজ হিসাবে বিবেচিত হত। বিশ্বাস করা হত মিশরীয় দেবতা আতুম হস্তমৈথুনের মাধ্যমে হওয়া বীর্যপাতের দ্বারা এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সঙ্গে নীলনদের জলপ্রবাহও তার বীর্যপাতের হার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর সূত্র ধরেই মিশরীয় ফারাওদেরও আনুষ্ঠানিকভাবে নীলনদে হস্তমৈথুন করতে হত।
তবে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে হস্তমৈথুনের ইচ্ছা এবং প্রবণতা বাড়ছে। যৌনচিন্তা, পর্নোমুভি, চটি কাহিনি, প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে কল্পমৈথুন, বেশি বয়সে বিয়ে, যৌনসঙ্গীর অভাব, সুলভ নগ্নতাই হস্তমৈথুনের কারণ। যত দিন যাচ্ছে ততই এসব সুলভ হয়ে যাচ্ছে। খুব কম বয়সি ছেলেমেয়েরাও হস্তমৈথুনে জড়িয়ে পড়ছে। স্বপ্নদোষেও মানুষ যৌনমিলন করে। হস্তমৈথুনে সন্তান হয় না, পরিবার হয় না, ভরসাস্থল হয় না তবুও মানুষ বিকল্প যৌনতৃপ্তির জন্য হস্তমৈথুন করে এবং করবে।
অতএব মানুষের জীবন যৌনময়। প্রায় সারাজীবনই যৌনতার ফ্যান্ট্যাসিতে মানুষ ভেসে থাকে। একমাত্র মানুষই যৌনতা নানা বৈচিত্রে উপভোগ করে। নানা কায়দার আসন গ্রহণ করে, যা অন্য প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় না। একমাত্র মানুষই কমবেশি অন্যের যৌনমিলন দর্শন করেন, যে আগ্রহ অন্য প্রাণীদের মধ্যে নেই। তা সত্ত্বেও মানুষ ভাবের ঘরে চুরি করতে বেশি পছন্দ করে। ইনিয়ে-বিনিয়ে সত্যকে আড়াল করতেই মানুষ বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তাই মানুষের মেয়েদের পিরিয়ড বা ঋতুচক্র হয় না, হয় শরীর খারাপ।
সাময়িক উত্তেজনা বা শুধুমাত্র রতিবৈচিত্র্র্যের জন্য বহু পুরুষ বা নারীকে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখা যায়। কত বিবাহিত পুরুষকে কুলি-কামিন, ভিখারিনী বা কুমারী কন্যার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলতে দেখা যায়। বিবাহিত নারীদেরও এইরকম যৌনাসক্তি লক্ষ করা যায়। নাগরিক জীবনের ধনী-দরিদ্র, সম্ভ্রান্ত-সাধারণ সকল স্তরেই এই প্রবণতা থাকে। এসব ক্ষেত্রে নারীরা সাধারণত বাবুর্চি, খানসামা, ড্রাইভার, মালি, আর্দালি, চাকর, এমন কী পথের মানুষদের সঙ্গেও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। নারীর এই ব্যভিচারের মনস্তত্ত্ব অনুসন্ধান করতে গিয়ে নন্দগোপাল সেনগুপ্ত তাঁর সমাজ সমীক্ষা : অপরাধ ও অনাচারগ্রন্থে লিখেছেন : নারীরা ভদ্রলোকের কাছে কাছে আপন সম্ভ্রম ক্ষুণ্ণ করতে চান না। কারণ তাতে অসন্মানের ভয় আছে। কিন্তু অন্ত্যজ বরাবর নীচুতে অবস্থিত সে কিন্তু প্রকাশও করতে পারবে না, কোনো অমর্যাদাও ঘটাতে সাহস পাবে না। সুতরাং তাকে আয়ত্ত করলে বদ-খেয়ালও চরিতার্থ হয়, আবার গৌরবও রক্ষা পায়। তা ছাড়া এই শ্রেণির সহযোগী জোগাড় হলে, তাকে দিয়ে কোনো কদাচার অনাচার নেই, যা অনায়াসে না রিয়ে নেওয় যায়। অপরদিকে পুরুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
বিবাহ প্রথাই মূলত সৃষ্টি হয়েছে, নারীকে পুরোপুরি যৌনদাসী হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। নারী যাতে তার তথাকথিত সতীত্বকে টিকিয়ে রাখতে যত্নবান হয়, তার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিবাহের ফর্মূলা তৈরি করেছে। সময়ের সঙ্গেই বিবাহের ফর্মুলা জাদুঘরে চলে যাবে। শুধু নারী কেন ? পুরুষরাও কি যৌনদাস নয় ? মানুষ প্রকৃতিতে বহুগামী। তাকে জোর করে মনোগ্যামিস্ট বানানো এক ধরনের অসভ্যতা বলেই মনে হয়। বিয়ে নিয়ে অনেকই অনেক মহত্ত্বপূর্ণ দার্শনিক কথাবার্তা বলবেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবাই একরকম ভাববেন কেন ? অন্যরকম যাঁরা ভাবেন, তাঁরা বলছেন -- বিয়ে অত্যন্ত ক্লান্তিকর ও ক্ষতিকর একটা নষ্ট প্রথা। সে আপনাকে এই বিশ্বাস দেবে যে একজনকে আপনি সম্পূর্ণ অধিকার করেছেন। কিন্তু সংসার জীবনে পদে পদে দেখবেন, সে আলাদা একটা মানুষ। তখন ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকবেন। আর সঙ্গে যদি সেক্সুয়াল জেলাসির যাতনা যুক্ত হয় তাহলে তো কথাই নেই। হয় নিজে বিধ্বস্ত হবেন, অথবা সঙ্গীকে করবেন। কিংবা দুটোই ঘটবে।
আরও বেশি ধ্বংস হবে আপনার সন্তান। জীবনের প্রতি পদে সে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি অনুভব করবে এবং এভাবেই শেষ হয়ে যাবে। অথচ সন্তান যদি দেখে যে তার জন্মের আগেই তার পিতামাতা আলাদা হয়ে গেছে, তাতেও তার মধ্যে হতাশা আসে না (যতক্ষণ সমাজ নিজে তাকে ডিপ্রেসড্ না করে) যদি কারো শৈশবে/কৈশোরে পিতামাতার বিচ্ছেদ হয়, তখন কী ঘটবে তা নির্ভর করে নানা পরিস্থিতির উপর। কিন্তু বিয়ে কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তির জন্যই নারী আজ যৌনদাসী। তার আগে যতদিন মানুষ নমাডিক বা প্যালিওলিথিক সমাজের অংশ ছিল, সেখানে বিবাহের প্রয়োজন ছিল না। শিশুরা ছিল কমিউনিটির সম্পতি। কে বাবা তাতে কিছু যায় আসত না। কারণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বালাই ছিল না। নারী বা পুরুষের একাধিক সঙ্গী ছিল। তারা একাধিক লিভ-ইন করত। যেমনভাবে মানবেতর অন্য প্রাণীরা জীবন যাপন করে। মানবেতর অন্য প্রাণীরা এইভাবেই জীবন যাপন করে চলেছে আবহমান কাল ধরে। তাতে কোন অসুবিধাটা হয়েছে? বিবাহ অবাধ যৌনাচারের বৈধ ছাড়পত্র বই তো নয় ! সেই যৌনাচার বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে উপভোগ করে। যৌনবোধকে অবদমন করা যায় না। আইন দিয়েও নয়, ধর্ম দিয়েও নয়। বিবাহের মাধ্যমেও নয়, বিবাহ বহির্ভূতও নয়।
বিবাহ নিয়ে নারী এবং পুরুষ একইরকম ভাবে না। বিবাহ নিয়ে নারী ও পুরুষের চিন্তা ও চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আমি না। এ ব্যাপারে এক আলোচনায় রনবীর সরকার কী বলছেন, সেটা দেখে নিতে পারি – (১) অধিকাংশ নারীই পার্টনার পছন্দ করার ক্ষেত্রে লং টার্মের কথা চিন্তা করেই করে। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে ব্যপারটা ভিন্ন, একটা নারীকে দেখে লং টার্ম পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করার থেকে সেক্স করে আনন্দ পাওয়ার কথাই সে বেশি চিন্তা করবে। এখন ধরুন একটা পুরুষ এক নারীকে প্রলুব্ধ করে সেক্স করে চলে গেল, হয় নারীকে গর্ভপাত করতে হবে, অথবা সেই ছেলের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। কী করবে সেই নারীটি? (২) সন্তানের জন্মদানের পর সে যদি বাবার সঙ্গে থাকে, তাহলে মার ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হবে, আর মার সঙ্গে থাকলে বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে, আর অন্য কোথাও থাকলে তো বাবা-মা উভয়ের ভালোবাসা থেক বঞ্চিত হল। উপরন্তু আমাদের মতো অসভ্য সমাজে স্বাভাবিকভাবে বাবা বা মার নতুন পার্টনারের খারাপ ব্যবহার হয়তো-বা তার জীবনকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দেবে। (৩) পুরুষদের এখানে দায় থাকবে না কন্ট্রাসেপশন ব্যবহার করার, কারণ সে সন্তানের দায়-দায়িত্ব নিতে বাধ্য নাও থাকতে পারে। আর যদি এখানে আপনি আইন দিয়ে পুরুষকে বাধ্য করতে চান সন্তানের দায়িত্ব নিতে তাহলে কি আইন দিয়ে বাধ্য করবেন ? আইনগুলো কী ধরনের হবে ? (৪) ধরুন আপনি ২৫ বছর বয়সে সেক্স করার পর আপনার পার্টনারকে ছেড়ে দিলেন। তার একটা মেয়ে হল যে মেয়েকে আপনি দেখেনইনি। ২০ বছর পর আপনার বয়স ৪৫ আর মেয়ের ১৯-২০। (৫) একটি ছেলে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করল। মেয়েটি ছেলেটির বিরুদ্ধে মামলা করল। হ্যাঁ, প্রমাণিত হল যে ছেলেটি মেয়েটির সঙ্গে সেক্স করেছে। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে সে ধর্ষণ করেছে ? হয়তো ধরা পরতে পারে কিছুটা forced sex হয়েছে। ছেলেটি বলতেই পারে তারা ভালোবাসা থেকেই সেক্স করেছে। ছেলেটির বিরুদ্ধে কি এখন আমরা সত্যি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারব ?        (৬) অনেকে ছেলেমেয়েই আছে যারা প্রেম করতে পারে না। তাই বলে কি তাদের কখনো সেক্স করা হবে না ? অ্যারেঞ্জড ম্যারেজই তাদের অনেকক্ষেত্রে ভরসা। মতান্তর আছে বইকি।
বিবাহ বলতে আজকের সমাজ যেটা দেখছে বা জানে, সেই মন্ত্র আর আইনের কাগজপত্র খুবই আধুনিক ব্যাপার-স্যাপার। ঘটা করে বিয়ে প্রাচীনকালে একমাত্র রাজা-উজিরদের মধ্যেই চালু ছিল। নারী-পুরুষ একসঙ্গে থাকলেই সমাজ তাকে স্বীকৃতি দিত। রোমেও সাড়ম্বর বিবাহ বলতে অভিজাত শ্রেণিদের মধ্যে রাজনৈতিক পুনঃবিন্যাস। সাধারণ মানুষের এত ঘটা করে বিয়ে করার কোনো উপায় ছিল নালিভ-ইন করত, আর তাই-ই ছিল বিবাহ। সেটা করত সমাজের উঁচুশ্রেণির ব্যক্তিরা। সে যুগের আম-আদমির জন্য যাই-ই লিভ-ইন, তাই-ই বিবাহ। বিবাহ ব্যতীত যে-কোনো যৌনমিলন হল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে উদ্ধত মানুষ ঔদ্ধত্য প্রকাশের স্বাভাবিক ভঙ্গি’ – একথা সব ধর্মের ধর্মবাদীরা মনে করেন। দুর্বিনীত পুরুষ অতি সহজ শর্তে বিবাহ নামক কঠিন সামাজিক বাধানিষেধের বেড়াজালে নারীকে শৃঙ্খলিত করেছিল। নারীজাতিকে গৃহপালিত পশুরূপে গণ্য করার মধ্যে পুরুষ-হৃদয়ে আনন্দ সঞ্চারিত হতে পারে, ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু নারীদের কাছে এই অবস্থা যন্ত্রণার এক ধারাবাহিক উপাখ্যান মাত্র।
বাইবেল বা টোরায় দেখা যায় ইজরায়েলিরা প্রথম বিয়ের ব্যাপারে কড়াকড়ি শুরু করে। বিবাহ বর্হিভূত সেক্সের জন্য শাস্তির ধারণা একেশ্বরবাদী ধর্মগুলির আমদানি। কনস্টানটাইন, যিনি আদতে খ্রিস্টান ধর্মের আসল প্রতিষ্ঠাতা, তার আমলেই প্যাগান রোমানদের বিবাহেরপবিত্রতারপ্রথম প্রকাশ। এরপরে ইসলাম এসে বিবাহের পবিত্রতার উপর আর-এক প্রস্থ পোঁচ লাগায়। ক্যাথলিক চার্চ বিবাহের পবিত্রতা রক্ষায় এবং নরনারীর ব্যাভিচারিতা আটকাতে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আইন জারি করে মধ্যযুগে। নরনারীর স্বভাবসিদ্ধ আকর্ষণ এবং সেই কারণে আরও স্বাভাবিক লিভ-ইন সম্পর্কের ফল্গুধারা ধ্বংস করে আব্রাহামিক ধর্মগুলি। ফলে চার্চের বন্ধন আলগা হতেই এখন ফ্রান্সের ৩০% লোক ও বিবাহিত নয়, সেখানে লিভ-ইনকেই বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউরোপের বাকি সভ্য দেশগুলিতেও আস্তে আস্তে বিবাহ প্রায় অবলুপ্তির দিকে। বিবাহিত নর-নারীর জীবন এমন কোনো স্বর্গীয় শয্যা নয়, যে লিভ টুগেদারকে বৈধতা দিলে একেবারে অনর্থ ঘটে যাবে সমাজে। আসলে আমরাপরিবর্তনশব্দটাকে খুব ভয় পাই। আমরা চাই সমাজ তেমন থাকুক, যেমনটা দেখে আমরা অভ্যস্ত। আইনি সংস্কার আর তার সমান্তরালে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। বিয়ে কখনোই কোনো কিছুর সমাধান নয়। বিবাহ সংঘঠিত সম্পর্কটি টিকে থাকে অনেকটা জোর করেই। তবে অনেক চেষ্টা ও সাধানার ফলে এটি একটি স্বাভাবিক শিল্পায়িত পরিমার্জিত রূপে আনা সম্ভব। তবে স্বভাবতই মানুষের ভিতরেই বহুগামিতার লক্ষণ থেকে গেছে। এটি স্বীকার করেই সভ্য দেশগুলী তার প্রচলন রেখেছে। সাধারণ মানুষের জন্য যা খুবই গুরুত্বপুর্ণ ও সমাজ ও সুন্দর থাকে।
প্রাবন্ধিক বিপ্লব পাল মনে করেন, “সময়ের নিয়মে যে কোন সভ্য সমাজে বিবাহর অবলুপ্তি দরকার। বিয়ের পেছনে না আছে যুক্তি, না স্ফূর্তি। এক পার্টনারের সাথে সারাজীবন কাটানো যাব্জজীবন কারাদন্ড। প্রেমের সমাধি। যদি ধরে নেওয়া যায় সন্তানের কারনে সেটা দরকার, তাহলেও এটা পরিষ্কার নয় কেন ঘটা করে, এত অপচয় করে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হবে। কেউ যদি সারাজীবন এক পার্টনারের সঙ্গে থেকে খুশি থাকে, থাকুক। কিন্ত কেউ যদি সেটা না চায়, উকিলদের পকেটে পয়সা দিয়ে ডিভোর্স মামলা, খরপোশ মামলা কেন? বিবাহ একটি অসভ্য প্রথা। জোর করে দুই নরনারীকে চিড়িয়াখানার খাঁচায় ভরে সামাজিক তামাশা। এই বৈবাহিক অসাড়তা আমরা যত দ্রুত বুঝব, ততই মঙ্গলযদিও পরিবারের অন্তরালে জৈবিক কারণ বিদ্যমান, কিন্তু সুসভ্য সমাজব্যবস্থায় বিবাহের মধ্য দিয়ে পরিবার হল আইনসিদ্ধ ফলশ্রুতি।
অনেকেই বিপ্লববাবুর চিন্তায় আঁতকে উঠে বলতেই পারেন -- বিবাহ প্রথা উঠে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নারীরা। যেমন আমি ভালোবেসে আমার স্বামীকে বিয়ে করলাম বা লিভ টুগেদার শুরু করলাম। আমি আর আমার স্বামী দুজনেই সমবয়সি। আমরা পরিশ্রম করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলাম। স্বাভাবিকভাবেই একজন ৪০ বছরের নারী আর পুরুষের মধ্যে পুরুষটি অধিক যুবক থাকে। এখন এই চল্লিশে এসে যদি আমার সঙ্গী আমাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে সে খুব সহজেই একটা যুবতী মেয়ে পাবে। কিন্তু আমার সঙ্গী পেতে সমস্যা হবে। আর বাস্তব একটা উদাহরণ লেখক হুমায়ূন আহমেদ। গুলতেকিনের মতো নারীর সংখ্যা বাড়বে, অন্যদিকে শাওনদের অভাব নেই। এছাড়া কেউ যদি অসুস্থ হয়, আর তা হতেই পারে তখন বিবাহ প্রথার কারণে সঙ্গীর দায়িত্ব নেওয়া জরুরি। বাবা মা যদি সারাজীবন প্রেমকেই গুরুত্ব দিয়ে সঙ্গী পালটানোতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে সেই সন্তানও বড়ো হয়ে বাবা-মাকে ওল্ড হোমে পাঠাতে দ্বিধা করে না। সমস্ত ভালোর মন্দ দিক থাকে, আর মন্দেরও ভালো দিক থাকে। তবে ভালো মন্দের উভয়ের বিচারে একটা স্থিতিশীল সমাজ তৈরিতে যেই নিয়ম বেশি কার্যকরী আমরা সেটাই সমর্থন করব।
রাতভোর বৃষ্টি”-তে বুদ্ধদেব বসুর বিয়ে প্রসঙ্গে বলেছেন বিয়ে ! কী জটিল, কঠিন, প্রয়োজনীয়, সাংঘাতিক মজবুত একটা ব্যাপার, আর কী ঠুনকো ! দুজন মানুষ সারজীবন একসঙ্গে থাকবে পাঁচ দশ পনেরো বছর নয় সারাজীবন এর চেয়ে ভয়ংকর জুলুম, এর চেয়ে অমানুষিক আদর্শ আর কী হতে পারে ? সন্তানের সঙ্গেও সারাজীবন একত্রে থাকি না আমরা, বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন বন্ধু বেছে নিই। কিন্তু আশা করা হয় দাবি করা হয় যে একবার যারা স্বামী-স্ত্রী হল, তারা চিরকাল তাই থাকবে। এই অস্বাভাবিক অবস্থাটা সহ্য করা যায় এটাকে ঈশ্বরের বিধান বলে মেনে নিলে, আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখলে। কিংবা যদি বিয়েটাকে শুধু একটা নিয়মমাফিক পোশাকি গোয়াল বলে ধরে নিয়ে, দূরে-কাছে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা থাকে দুজনেরই।
বিয়ে অনেকটা দিল্লির লাড্ডুর মতো, যে খেয়েছে সে পস্তায়, যে না খেয়েছে সেও পস্তায়। ……… বিয়ে কোনও সমাধান নয়। ভালোবাসা সমাধান। ভালোবেসে একত্রবাস করো, অথবা পৃথকবাস করো। প্রথাট্রথা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করো। মানুষকে প্রথার উর্ধ্বে উঠতে হবে, এ ছাড়া আর উপায় নেই। প্রথাকে বিদেয় না করলে প্রথা বিকট হতে হতে মানুষকে একদিন গিলে ফেলে। আসলে গেলা হয়ে গেছে অনেক আগেই। প্রথার পেটের ভেতর মানুষ এখন বাস করছে, মানুষ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। ওই অন্ধকার গহ্বর থেকে মানুষকে বেরোতেই হবে, এ ছাড়া আর উপায় নেই”-– তসলিমা নাসরিন।
পরিশেষে বলব, একমাত্র একজোড়া নর-নারীকেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা তিল তিল করে নির্মাণ করতে হয় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে। বাকি সব সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে মানুষ জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে। যেমন মা, বাবা, ভাই বোন, মাসি, পিসি ইত্যাদি। বিয়ের উদ্দেশ্য যাই-ই হোক, যেমনই হোক বিয়ে ব্যতীত মানুষ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে না, করতে পারে না। বিয়ে নিষিদ্ধ হলে মানুষের নাবালকত্ব ঘুচবে না কোনোদিন। সৃষ্টিশীলতা স্তব্ধ হয়ে যাবে। সম্পর্ক-শৃঙ্খল বাধাপ্রাপ্ত হবে। মানুষ পুনরায় দিশেহারা হয়ে পড়বে। হয় যৌন অবদমনে মানুষ হিংস্র হয়ে যাবে, অথবা সীমাহীন যৌনতা এবং যৌনসঙ্গী ভোগের ফলে ভয়ংকর যৌনরোগে মনুষ্যসমাজে ধস নামবে। বিয়ে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা। এ পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার তিনটি -– (১) ঈশ্বর (২) আগুন এবং         (৩) বিবাহ। বিবাহের আবিষ্কর্তাকে হাজারো সেলাম।
-------------------------------------------
তথ্যসূত্র : (১) বাংলার লোক-সংস্কৃতি -- আশুতোষ ভট্টাচার্য, (২) পবিত্র কোর-আনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর) -- খাদেমুল-হারমাইন বাদশাহ ফাহদ, (৩) জীবনসাথী শচীন দাস, (৪) Marriage and Morals -- Bertrand Russell (৫) ভারতের বিবাহের ইতিহাস অতুল সুর, (৬) কামশাস্ত্রম্ বাৎসায়ন, (৭) মনুসংহিতা সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।




1 টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

আমি এক মত, 😎🙋👍