বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

অবমানবচরিত : এক বেদনার্ত না-মানুষের না-গল্প (প্রথম পর্ব)

“I want to suck your big penis” – চমকাবেন না ফেসবুকের ইনবক্সে এরকম মেসেজ পাওয়ার এরকম নাছোড় অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেকেরই হয়েছে ফেসবুকে এরকম অনেক নারীপুরুষ তাঁদের যৌনসঙ্গী খুঁজতে সরাসরি এইভাবে প্রস্তাব রাখে এঁরা আদতে সমকামী পুরুষ খোঁজে পুরুষকে, নারী খোঁজে নারীকে প্রথম পক্ষগে’, অপরপক্ষলেসবিয়ান। বাজারি নামহিজড়েবাহিজড়া

হিজড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত একটি পরিভাষা -- বিশেষ করে ভারতের ট্রান্সসেক্সুয়াল বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তারাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের অপর অর্থ হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার’, ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বোঝায় যা দৈহিক বা জেনেটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোনো শ্রেণিতে পড়ে না। প্রকৃতিতে কিছু মানুষ নারী এবং পুরুষের যৌথ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বাংলা ভাষায় এই ধরনের মানুষগুলো হিজড়া নামে পরিচিত। সমার্থক শব্দে শিখণ্ডী, বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ, উভলিঙ্গ, নপুংসক, ট্রান্সজেন্ডার (ইংরেজি), ইনুখ (হিব্রু), মুখান্নাতুন (আরবি), মাসি, বৌদি, চাচা, তাউ, ওস্তাদ, মাংলিমুখী, কুলিমাদর, ভিলাইমাদর, মামা, পিসি, অজনিকা ষণ্ড, অজনক, সুবিদ, কঞ্চুকী, মহল্লক, ছিন্নমুষ্ক, আক্তা, পুংস্তহীন ইত্যাদিহরিদ্বারে হিজড়াদের সকলে তাওজি বা পণ্ডিতজি বলে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে হিজড়াদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

ইসলাম ধর্মে হিজড়া : হজরত ইব্রাহিমের বংশধরদের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রচারিত ধর্মগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ইব্রাহিমীয় ধর্ম। ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম, ইহুদি ধর্ম -- এগুলো সবই ইব্রাহিমীয় ধর্ম। প্রতিটি ইব্রাহিমীয় ধর্ম পুরুষ এবং নারী সৃষ্টির ব্যাপারে আদম এবং হাওয়া (ইভ)-এর গল্প বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ প্রথমে মাটি থেকে তৈরি করেন আদমকে। আদমের বুকের পাঁজর দিয়ে তৈরি করেন বিবি হাওয়াকে। তাহলে আল্লাহ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কিভাবে তৈরি করেন ? নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বা হিজড়া কীভাবে সৃষ্টি করা হল, এই বিষয়ে পৃথিবীর কোনো ধর্মেই আলোচনা করা হয়নি।
ইসলামে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের মুখান্নাতুন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবি ভাষায়  মুখান্নাতুন বলতে মেয়েদের মত আচরণকারী পুরুষদেরকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু শুধুমাত্র মেল টু ফিমেল ট্রান্সসেক্সুয়ালদের বোঝানো হয়, তাই আরবি মুখান্নাতুন হিব্রু সারিস বা ইংরেজি ইউনুখ”-এর সমার্থক শব্দ নয়। কোরানে কোথাও মুখান্নাতুন সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। কিন্তু হাদিসে মুখান্নাতুন”-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
আন নবি বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, একজন মুখান্নাতুন হচ্ছে সেই পুরুষ, যার চলাফেরায়, চেহারায় এবং কথাবার্তায় নারী আচরণ বহন করে। তারা দুই প্রকারের : প্রথম প্রকারের হচ্ছে তারাই যারা এই ধরনের আচরণ ইচ্ছাকৃতভাবে করে না এবং তাদের এই ব্যবহারে কোনো দোষ নেই, কোনো অভিযোগ নেই, কোনো লজ্জা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কোনো অবৈধ কাজ না করে এবং পতিতাবৃত্তিতে না জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যক্তি হচ্ছে তারাই যারা অনৈতিক উদ্দেশ্যে মেয়েলি আচরণ করে হজরত ইবনে আব্বাস বলেছেন – হিজড়ারা জিনদের সন্তান। এক ব্যক্তি আব্বাসকে প্রশ্ন করেছিলেন – এটা কেমন করে হতে পারে ? জবাবে তিনি বলেছিলেন – “আল্লাহ ও রসুল (সাঃ) নিষেধ করেছেন যে মানুষ যেন তাঁর স্ত্রীর পিরিয়ড বা মাসিক স্রাব চলাকালে যৌনমিলন না করে”। সুতরাং কোনো মহিলার সঙ্গে তার ঋতুস্রাব হলে শয়তান তার আগে থাকে এবং সেই শয়তান দ্বারা ওই মহিলা গর্ভবতী হয় এবং হিজড়া সন্তান (খুন্নাস) প্রসব করে (সুরা বাণী ইস্রাইল – আর রাহমান-৫৪, ইবনে আবি হাতিম, হাকিম তিরমিজি)। ইসলামী দেশগুলির মধ্যে ইরানে সব থেকে বেশি রুপান্তরকামী অপারেশন করা হয়। তারা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে যে-কোনো এক লিঙ্গে রুপান্তর হওয়ার সুযোগ দেয়।
হিন্দু ধর্মে হিজড়া : দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরকে সাধারত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু অঞ্চলভেদে ভাষাভেদে হিজড়াকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এই অঞ্চলে হিজড়াদেরকে সামাজিক ভাবে মূল্যায়িত করা হয়। তারা সমাজ থেকে দূরে বাস করতে বাধ্য হয়। দূরপাল্লা ট্রেনে বা বাজারে ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তিই তাদের প্রধান পেশা। হিন্দুদর্শনে তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এই শ্রেণিকে তৃতীয় প্রকৃতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে এই ধরনের মানুষকে আলাদাভাবে পুরুষ বা নারী হিসাবে বিবেচনা করা হত না। তাদেরকে জন্মসূত্রে তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে গণ্য করা হত তাদের কাছে সাধারণ নারী-পুরুষের মতো ব্যবহার প্রত্যাশা করা হত না। আরাবানী হিজড়ারা আরাবান দেবতার পুজো করে। অনেক মন্দিরে হিজড়াদের নাচের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন হিজড়াদের আশীর্বাদ করার এবং অভিশাপ দেয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে।
খ্রিস্টান ধর্মে হিজড়া : গ্রি Eunochos থেকে Eunuchs শব্দটি এসেছে। খ্রিস্টধর্মের নিউ টেস্টামেন্টে স্পষ্ট করে তৃতীয় লিঙ্গ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যদিও এখানে Eunuchs বলতে নপুংশক ব্যক্তি বোঝানো হয়েছে। বিবাহ এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় জিশু বলেন, কিছু মানুষ জন্ম থেকেই Eunuchs, আবার কিছু মানুষ অন্যদের দ্বারা Eunuchs -এ পরিণত হয় এবং আর কিছু মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজদেরকে Eunuchs-রূপান্তরিত করে।
২০০০ সালে ক্যাথলিক সম্মেলনের ডকট্রিন অফ ফেইথের উপসংহারে বলা হয়, চার্চের দৃষ্টিতে একজন মানুষ ট্রান্সসেক্সুয়াল সার্জিকাল অপারেশনের মাধ্যমে একজন মানুষকে শুধু বাহ্যিকভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। “the transsexual surgical operation is so superficial and external that it does not change the personality. If the person was a male, he remains male. If she was female, she remains female.” খ্রিস্টান ধর্মে একজন ইথিওপিয়ান ইনুখ সম্পর্কে আলোচনার কথা আছে বিবাহ এবং তালাক নিয়ে উত্তর দেয়ার সময় জিশু এক পর্যায়ে বলেন, “কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম থেকে ইনুখ এবং আর কিছু মানুষ আছে যাদেরকে অন্যেরা ইনুখ বানিয়েছে এবং আর এক প্রকৃতির মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজেদেরকেই ইনুখ বানিয়েছে।"
বৌদ্ধ ধর্মে হিজড়া : অধিকাংশ বৌদ্ধলিপিতে ধর্ম প্রতিপালনে কোনো লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন করা হয়নি। নির্বাণ লাভের জন্য কামনাকে এই শাস্ত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। থাই বৌদ্ধধর্মে কতি বলে একটি শব্দ আছে। মেয়েদের মতো আচরণকারী পুরুষকে কতি বলা হয়। এটা সেখানে পুরুষ সমকামীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। থাইল্যান্ডে কতিদের বিবাহের অনুমতি নেই। তারা কখনোই বিয়ে করতে পারবে না।  থাইল্যান্ডে কতিদের নারীতে রুপান্তরিত হওয়া কি পুরুষ বিয়ে করা এখন আইনত অবৈধ। কিন্তু হিজড়া মহিলারা তাদের ইউরোপীয় সঙ্গীকে বিয়ে করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে তাকে থাইল্যান্ড ত্যাগ করে তাদের সঙ্গীদের দেশে চলে যেতে হবে।
ইহুদি ধর্মে হিজড়া : মোজেস বা হরত মুসা অনুসারীদেরকে বলা হয় ইহুদি। ইহুদি ধর্মে হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডারদের সারিসবলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিব্রুসারিসইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে "Eunuch" অথবা "Chamberlain" নামে।তনখ-এ সারিস শব্দটি ৪৫ বার পাওয়া যায়। সারিস বলতে একজন লিঙ্গ নিরপেক্ষ বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি শক্তিমানের প্রতিনিধিত্ব করেন শ্বর সারিসদের কাছে এই বলে প্রতিজ্ঞা করছেন, “তারা যদি সাবাথ পালন করে এবং রোজা রাখে তাহলে তাদের জন্য স্বর্গে একটি উত্তম মনুমেন্ট তৈরি করবেন।” (ইসাইয়াহ, ৫৬)তোরাহ-তে ক্রস ড্রেসিং (যেমন পুরুষের নারীর মতো পোশাক পরা) এবং জেনিটাল বা শুক্রাশয় ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। সেজন্য অনেক ইহুদি হিজড়াদের ধর্মের বাইরের মানুষ মনে করেন। কারণ হিজড়ারা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরে।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে হিজড়ারা তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী অথবা পুরুষে নিজেদের রূপান্তর করে নিতে পারবেন। ইহুদিধর্মের অনেক শাখা বিজ্ঞানের এই অগ্রগতিকে স্বাগত জানালেও জুদাইজমের সকল ধারা এই রূপান্তরকামিতাকে এখন সমর্থন করেনি
বাহাই ধর্মে হিজড়া : বাহাই ধর্মবিশ্বাসে হিজড়াদেরকে Sex Reassignment Surgery (SRS) এর মাধ্যমে একটি লিঙ্গ বেছে নিতে হবে এবং শল্যচিকিৎসকের মাধ্যমে লিঙ্গ রূপান্তর করতে হবে। এসআরএসের পরে তাদেরকে রূপান্তরিত বলে গণ্য করা হবে এবং তারা উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচন করে বাহাই মতে বিবাহ করতে পারবে।
তবে সমকামীদের ভূগোল দেখার আগে একটু ইতিহাস দেখে নেওয়া যাক প্রাচীন যুগে হেরোডোটাস, প্লেটো, অ্যাথেনেউস, জেনোফোন  এবং অন্যান্য লেখকদের লেখা থেকে প্রাচীন গ্রিসে সমকামিতা প্রসঙ্গে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। জানা যা প্রাচীন গ্রিসে বহুল প্রচলিত ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সমকামী যৌন সম্পর্কটি ছিল  প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও সদ্যকিশোর বা পূর্ণকিশোর বালকদের মধ্যেকার যৌন সম্পর্ক (প্রাচীন গ্রিসের বিবাহপ্রথাও ছিল বয়সভিত্তিক; তিরিশ বছর পার করা পুরুষেরা সদ্যকিশোরীদের বিয়ে করত।)। নারীর সমকামিতার বিষয়টি প্রাচীন গ্রিসে ঠিক কী চোখে দেখা হত, তা স্পষ্ট নয়। তবে নারী সমকামিতাও যে স্যাফোর যুগ থেকে গ্রিসে প্রচলিত ছিল, তা জানা যায়। বিগত শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সমাজে যৌনপ্রবৃত্তিকে যেমন সামাজিক পরিচিতির মাপকাঠি হিসাবে দেখা হলেও, প্রাচীন গ্রিসে তেমনটা হত না। গ্রিক সমাজে যৌন কামনা বা আচরণকে সংগমকারীদের লিঙ্গ অনুযায়ী ভাগ করে দেখা হত না; দেখা হত যৌনক্রিয়ার সময় সংগমকারীরা কে নিজের পুরুষাঙ্গ সঙ্গীর দেহে প্রবেশ করাচ্ছে, বা সঙ্গীর পুরুষাঙ্গ নিজের শরীরে গ্রহণ করছে, তার ভিত্তিতে। এই দাতা/গ্রহীতা বিভেদটি সামাজিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বকারী ও শাসিতের ভূমিকা নিত: অপরের শরীরে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করানো পৌরুষ, উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ও প্রাপ্তবয়স্কতার প্রতীক ছিলঅপরদিকে অন্যের পুরুষাঙ্গ নিজের শরীরে গ্রহণ করা ছিল নারীত্ব, নিম্ন সামাজিক মর্যাদা ও অপ্রাপ্তবয়স্কতার প্রতীক।
প্রাচীন গ্রিসের সংস্কৃতিতে প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে গভীর প্রণয় সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায়ইলিয়াডমহাকাব্যে হোমার অ্যাকিলিস ও প্যাট্রোক্ল্যাসের সম্পর্কটিকে যৌন সম্পর্ক বলেননি চিত্রকলা ও পাত্রচিত্রে প্যাট্রোক্লাসের দাড়ি আঁকা হত অপরদিকে গ্রিক সমাজে অ্যাকিলিসের স্থান দেবতুল্য হলেও তাঁর চিত্র  উলঙ্গই  আঁকা হত এর ফলে কে "এরাস্টেস" এবং কে "এরোমেনোস" ছিলেন, তাই নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায় হোমারীয় ঐতিহ্যে প্যাট্রোক্ল্যাস ছিলেন বয়সে বড়ো; কিন্তু অ্যাকিলিস ছিলেন বেশি শক্তিশালী অন্যান্য প্রাচীন গল্পের মতে, অ্যাকিলিস ও প্যাট্রোক্ল্যাস ছিলেন নিছক বন্ধু ঐতিহাসিক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ প্রণয়ীযুগলের মধ্যে এথেন্সের পাউসানিয়াস ট্র্যাজিক কবি আগাথন বিখ্যাত আগাথনের বয়স ছিল ত্রিশের বেশি মহামতি আলেকজান্ডার ও তাঁর বাল্যবন্ধু হেফাস্টনের সম্পর্কও একই ধরনের ছিল বলে মনে করা হয়
স্যাফো নারী বালিকাদের উদ্দেশ্য করে অনেকগুলি কবিতা রচনা করেছিলেন ইনি লেসবোস দ্বীপের বাসিন্দা স্যাফো সম্ভবত ১২,০০০ লাইনের কবিতা লিখেছিলেন নারীদের জন্য তবে তার মধ্যে মাত্র ৬০০ লাইনরই সন্ধান পেলে তাই স্যাফো প্রাচীনকালের নারী-সমকামী কবি হিসাবে পরিচিত তিনি গ্রিক সমাজে "থিয়াসোস" বা অল্পশিক্ষিতা নারী হিসাবে পরিচিত ছিলেন সেযুগের সমাজে নারীজাতির মধ্যেও সমকামিতার প্রচলন ছিল নগররাষ্ট্রের উদ্ভবের পর বিবাহপ্রথা সমাজ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে এবং মেয়েরা গৃহবন্দী হয়ে পড়ে "থিয়াসোস"-রা হারিয়ে যায় স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে জায়গা পেয়েছে লেসবিয়ান শব্দটি সামাজিকভাবে নারীর সমকামিতার কোনো স্থান হয়নি সাধারণ ভাবে নারীর সমকামিতার ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য বেশি নেই
সমকামী বিষয়বস্তু সম্পর্কে দীর্ঘকাল নীরব থাকার পর ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন এরিক বেথে ১৯০৭ সালে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন পরে কে. জি. ডোভারাও  গবেষণা চালিয়ে যান গবেষণায় জানা গেছে, প্রাচীন গ্রিসে সমকামিতার খোলাখুলি প্রচলন ছিল এমনকি সরকারি অনুমোদনও ছিল খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে রোমান যুগ পর্যন্ত এই অবস্থা চলেছিল কোনো কোনো গবেষকদের মতে সমকামী সম্পর্ক, বিশেষত পেডেরাস্টির প্রচলন ছিল উচ্চবিত্ত সমাজের মধ্যেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রথার প্রচলন খুব একটা ছিল না ব্রুস থর্নটনের মতে, অ্যারিস্টোফেনিসের কৌতুক নাটকগুলিতে গ্রহীতার স্থান গ্রহণকারী সমকামীদের প্রতি উপহাস করার প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, পুরুষ সমকামিতাকে সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখত না ভিক্টোরিয়া ওল প্রমুখ অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, এথেন্সে সমকামী সম্পর্ক ছিল "গণতন্ত্রের যৌন আদর্শ" এটি উচবিত্ত সাধারণ মানুষ -- উভয় সমাজেই সমাজভাবে প্রচলিত ছিল হার্মোডিয়াস অ্যারিস্টোগেইটন নামে দুই হত্যাকারীর ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত হয় এমনকি যাঁরা বলেন যে, পেডেরাস্টি উচ্চবিত্ত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাঁরাও মনে করেন যে এটি ছিল "নগররাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোর অঙ্গ"
আধুনিক গ্রিসে এই বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে ২০০২ সালে মহামতি আলেকজান্ডার সম্পর্কিত এক সম্মেলনে তাঁর সমকামিতা নিয়ে বিতর্ক হয় ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্তআলেকজান্ডারচলচ্চিত্রে আলেকজান্ডারকে উভকামী হিসাবে দেখানোর জন্য ২৫ জন গ্রিক আইনজীবী চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন তবে ছবির এক আগাম প্রদর্শনীর পর তাঁরা আর মামলা করেননি
দীপা মেহতারফায়ারবা মধুর ভাণ্ডারকারেরপেজ থ্রিছাড়াও সমকালে ভারতীয় সিনেমাতে সমলিঙ্গ প্রেমের প্রচুর উদাহরণ আছে সদ্যপ্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রাঙ্গদা’, কিংবা তিনকন্যা’, মৈনাকেরফ্যামিলি অ্যালবাম’, অপর্ণা সেনেরপারমিতার একদিন’ ‘তাসের দেশ’-এর মতো হাল আমলের নানা বাংলা ছবির গল্পও ঘিরেছে সমকামী সম্পর্ক লক্ষ করা গেছে আদিকাল থেকে শিল্প-সাহিত্যেও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ সমকামিতার প্রতিফলন অথচ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালতের রায়ে সহস্রাব্দ প্রাচীন সমকাম আজ বিকৃত সমকামিতা অপরাধ গ্রিক সভ্যতা থেকে প্রাচীন ভারত আধুনিক সাহিত্য-সিনেমাতেও বারবার জায়গা করে নিয়েছে সমকামী মানুষের গল্প প্রাচীন নাগরিক সমাজ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা যেখানে জন্ম নিয়েছিল গ্রিসে সেই গ্রিস, যে কখনও নাগরিকের যৌন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি সমলিঙ্গ যৌন সংসর্গের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না সেখানে হেরোডেটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায়ই পাওয়া যায় সমকামী সম্পর্কের কথা
ইতিহাস বলছে, প্রাচীন পারস্যে সমকামী সম্পর্কের প্রচলন ছিল এই ভারতবর্ষেও সমকামিতা ছিল এবং আছে বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য তো সমকামেরই পরিচয় প্রকট হয়ে আছে খাজুরাহোর শিল্পকীর্তিতে তো রয়েছে গ্রুপ সেক্সের নিদর্শনও মহাভারতে বৃহন্নলা আর শিখণ্ডি, পুরাণে বিষ্ণুর মোহিনী রূপ আর অর্ধনারীশ্বর শিব, পুরাণের পাতায় পাতায় যেন তৃতীয় লিঙ্গের সদর্প উপস্থিতি এমনকী, বাৎসায়নের কামসূত্রও  সমকামিতা নিয়ে আলোচিত হয়েছে, দেখানো হয়েছে যৌন সম্পর্কেরই অন্য এক রূপ এমনকি আধুনিক সাহিত্যেও অনেক লেখক স্বীকৃতি দিয়েছে সমকামিতাকে অস্কার ওয়াইল্ডের জীবনী লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত এই সমকামী সাহিত্যিকের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন রিচার্ড এলম্যান
সমকামীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক ভুলভাল ধারণা আছে যেমন – () সমকামিতা পাশ্চাত্যের সৃষ্টি পাশ্চাত্যের উদার সমাজব্যবস্থা এবং ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমকামিতার জন্য দায়ী () সমকামিতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা () সমকামীদের সুশিক্ষা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব () সমকামিতা একটা রোগ () প্রকৃতিতে অন্য কোনো জীবজন্তু বা গাছপালার মধ্যে সমকামিতা দেখা যায় না () সমকামীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত () জীবজন্তুরা তো অনেক কিছু করে, তাই বলে সেগুলি মানুষেরও করতে হবে নাকি?
উত্তরে বলি --  প্রথমত, সমকামিতা মোটেই পাশ্চাত্যের সৃষ্টি নয় প্রথমত আদিমকাল থেকেই সমকামিতা আছে ইতিহাসের বিভিন্ন অংশে সমকামিতার দৃষ্টান্ত আছে সমকামিতা কোনো ফ্যাশান নয়, এটি একটি যৌন-সংকট প্রাচীন বিভিন্ন মহাকাব্য সমকামিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে মধ্যপ্রাচ্যে সমকামিতার ব্যাপক প্রচলন ছিল এক সময়ে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, সক্রেটিস সমকামী ছিলেন কামসুত্রে সমকামিতার প্রচুর উদাহরণ আছে অতএব সমকাম কোনো পাশ্চাত্যের তৈরি করা বিষয় নয় দ্বিতীয়ত প্রাণীকুলে সমকামিতার ব্যাপক বিস্তার দেখতে পাওয়া যায় প্রাণীকুল পাশ্চাত্যের উদার জীবনব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়েছে এটা যারা ভাবে তাদের সম্পর্কে বলার কিছু নেই
দ্বিতীয়ত, সমকামিতা কোনোভাবেই মানসিক বিকৃতি নয় কিন্তু জীববিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, সমকাম কোনো মানসিক বিকার নয় এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয় প্রত্যেক জীবের মধ্যে কিছু অংশ অবশ্যই সমকামী হয়ে জন্ম নেবে তারা বেড়ে ঊঠবে সমকামী হয়ে, তাদের চালচলনে সমকামী ভাব ফুটে ঊঠবে একটা রক্ষণশীল সমাজে সমকামীরা বেঁচে থাকে গোপনে, তাদের যৌনপ্রবৃত্তি তারা উপভোগ করে গোপনে, অনেক ক্ষেত্রে অপরাদের মাধ্যমে, আর-একটা মুক্তসমাজে সেটা হয় প্রকাশ্যে প্রকাশ্যে হওয়ার কারণে অপরাধের মাত্রা কমে যায় মাদ্রাসার শিক্ষকরা বা ইমামরা যারা সমকামী, তাঁরা তাঁদের যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটায় অপরাধের মাধ্যমে হয়তো তারা একজন নারীর সঙ্গে বিবাহত জীবন পালন করছে, কিন্তু তৃপ্তির অভাবে তারা প্রতিনিয়ত সুযোগ খোঁজে তাদের অবদমিত কামনা পুরণের যার শিকার সব সময় আমাদের দেশের বালক-তরুণরা হয় কিন্তু উন্নত বিশ্বে সমকামীরা প্রকাশ্যে বলে যে তারা সমকামী যার ফলে চিনতে পারা সহজ হয় এবং সমলিঙ্গের Straight মানুষরা সবসময় সতর্ক থাকতে পারে তার উপর সমকামীরা সমকামী সঙ্গী বেছে নিয়ে স্বাভাবিক বিবাহিত এবং যৌন জীবনযাপন করলে তারা অপরাধের মাধ্যমে তাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার প্রয়োজন পড়ে না
তৃতীয়ত, সমকামীদের নিয়ে যেই মামলাগুলি হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছিল যে সমকামীরা বিকৃতির শিকার কিংবা রোগী বা কিংবা অসুস্থ কিন্তু মেডিকেল সায়েন্সে straight-দের সঙ্গে সমকামীদের কোনো পার্থক্য আছে, শারীরিক বা মানসিকভাবে, তার কোনো প্রমাণ নেই তাহলে সমকামীরা অসুস্থ বা মানসিক বিকৃতির শিকার বা বিকলাঙ্গ তাও বলা যাচ্ছে না
চতুর্থত,  প্রকৃতিতে বিভিন্নভাবে কীভাবে সমকামিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রকৃতির সৃষ্ট প্রায় প্রতিটি প্রাণী এবং বৃক্ষরাজিতে সমকামিতা বিদ্যমান বেশিরভাগ জীব এবং গাছপালায় সমকামিতার প্রকাশ আছে
ষষ্ঠত,  সমকামীদের কেন সামাজিকভাবে বয়কট করার কথা বলা হবে ? তারা রক্তমাংসের মানুষ একজন সমকামী পুরুষের নারীর প্রতি প্রাকৃতিকভাবে আকর্ষণ বোধ করে না কোনো নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারী দেখলে তার লিঙ্গ উত্থিত হয় না সেই পুরুষের লিঙ্গ উত্থিত হবে কোনো নগ্ন বা অর্ধ নগ্ন পুরুষ দেখলে একইভাবে নারী সমকামীরও কোনো নগ্ন নারী দেখলে উত্তেজনা আসবে, অপরদিকে পুরুষদের দেখে তাকে যৌনসঙ্গী করার  কোনো ইচ্ছাই জাগবে না এই কারণে নিশ্চয়ই একজন মানুষকে একঘরে করে রাখা বা বয়কট করা কোনোমতেই মানবিক আচরণ হতে পারে না এটা অন্যায্য, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ
সপ্তমত, জীবজন্তুরা এমন অনেক কাজ করে যেটা সভ্য মানুষের করা উচিত নয়, এটা ঠিক যেমন ধর্ষণ প্রবৃত্তি জীবকুলে বিদ্যমান, পিতামাতার সঙ্গে যৌনতা প্রাণীকুলে বিদ্যমান একজন সভ্য মানুষ কখনোই এই ধরনের কাজ করতে বা সমর্থন করতে পারে না কথা হচ্ছে সমকামিতাও কি একই ধরনের ব্যাপার ?
সমকামিতা সমকামীরা নিজে নির্ধারণ করে না প্রকৃতি তাদের ভিতরে সমকামিতার বীজ বপন করে একজন ধর্ষক ধর্ষণ না-করেও সুস্থ্ যৌনতার মাধ্যমে নিজের যৌনাকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে পারে একজন ইনসেস্টার বা অজাচারিতা ইনসেস্ট বা অজাচার সম্পর্ক না-করেও সুস্থ যৌনজ়ীবন যাপন করতে পারে
হিজড়ে এবং সমকামীরা কি একই সমগোত্রীয় ? সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁরঅন্তহীন অন্তরীণ প্রোষিতভর্তৃকাগ্রন্থে বিষয়টা পরিষ্কার করেছেন তিনি হিজরানী শ্যামলী-মায়ের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন – “এতদিনে মানুষের ধারণা ছিল হিজড়ে বুঝি জন্ম থেকেই হয় ছোটোবেলাতেই হিজড়ে সন্তান জন্মালে মা-বাবা তাকে হিজড়ে ডেরায় দিয়ে আসে কেনএমন গল্প শুনিসনি, হিজড়ে বাচ্ছাকে মা-বাবা আটকে রেখেছিল, পাড়ায় হিজড়েরা তালি দিচ্ছিল, আর সেই তালি শুনে ঘর থেকে বাচ্ছা হিজড়ে তালি দিল আর সেই তালি শুনে হিজড়েরা বাচ্ছাটাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল !”
হিজড়া হতে হলে লিকম্ (লিঙ্গ) ছিবড়াতে (কর্তন) হয়অণ্ডকোশ সমেত পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললে তবেইনির্বাণবা প্রকৃত সন্মানিত হিজড়া হওয়া যায়অবশ্য পুরুষাঙ্গ কর্তন করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই পুরুষাঙ্গ নিয়ে যে ধুরানি (বেশ্যা বা যৌনকর্মী) হিজড়া বৃত্তি করবে তাকে হিজড়ারাআকুয়া’ (বিপরীত সাজসজ্জাকামী যৌনপরিবর্তনকামী) বলে
ওরা ঢোল বাজিয়ের দল, ওরা হিজড়া ওরা নবজাতকের খোঁজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, ওরা হিজড়া ওরা এক শ্রেণির অবাঞ্ছিত অপাঙক্তেয় মানবগোষ্ঠী, ওরা হিজড়া ওরা যৌন বিকলাঙ্গএক প্রতিবন্ধী মানুষ, ওরা হিজড়া মনুষ্য সমাজে এক অন্তঃসলিলা প্রবাহযাঁরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে সমাজের উত্থানপতন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, ওরা হিজড়াই প্রাণীজগতে আমরা চার প্রকারের উভলিঙ্গত্ব দেখতে পাই () প্রকৃত হিজড়া (True Hermaphrolite), () পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়া (Male Pseudo Hermaphrodite), () স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়া (Female Pseudo Hermaphrodite) এবং () ফ্রিমার্টিন সিনড্রোম (Freemartin Syndrome)প্রকৃত হিজড়াদের ক্ষেত্রে একই দেহে শুক্রাশয় ডিম্বাশয়ের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়াদের শরীরের আপাত বাহ্যিক গঠন মেয়েলি হলেও শুক্রাশয় বর্তমান স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়াদের দৈহিক গঠনের সঙ্গে সুস্থ পুরুষের আপাত সাদৃশ্য থাকলেও এরকম হিজড়ার দেহে ডিম্বাশয় থাকে
হিজড়াদের মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – () জন্মগত হিজড়ে এবং () ছদ্মবেশী হিজড়া
() জন্মগত হিজড়ে : আমরা আমাদের চারপাশে যেসব হিজড়া দেখি তাদের অনেকেই জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী এদের যৌন  জনন বৈকল্য বা প্রতিবন্ধকতা একরকম নয় কারোর যৌনাঙ্গ অপুষ্ট বা অপূর্ণাঙ্গ কারোর-বা শরীরে নারী পুরুষ অপরিপূর্ণ যৌনাঙ্গের অবস্থান লক্ষ করা যায় এখন প্রশ্ন কেন প্রতিবন্ধকতা ?
নারী-পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারণ হয় দুই ধরনের আলাদা আলাদা ক্রোমোজোমের উপস্থিতিতে সাধারণত প্রতি কোশে এক জোড়া ক্রোমোজোম দেখা যায়, যারা বস্তুত লিঙ্গ নির্ধারক এই ক্রোমোজোমগুলিই হল Sex Chromosome বা যৌন ক্রোমোজোমযৌন ক্রোমোজোম দুটিকে X এবং Y দ্বারা চিহ্নিত করা হয় বাকি ক্রোমোজোমগুলি জীবের অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্যের ধারক এরা Autosome বা অযৌন ক্রোমোজোমস্বাভাবিক ক্ষেত্রে মানুষের দেহকোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৬ বা ২৩ জোড়া এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে এক জোড়া ক্রোমোজোম নির্ধারক অর্থাৎ বাকি ২২ জোড়া অটোজোমY ক্রোমোজোমের আকৃতি আয়তনে X ক্রোমোজোমের তুলনায় ক্ষুদ্র স্ত্রী দেহকোশে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে অপরদিকে, পুরুষ দেহকোশে একটি X এবং একটি Y ক্রোমোজোম থাকে প্রতিটি কন্যা সন্তান মাতাপিতার কাছ থেকে ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে এর ম্যধ্যে মায়ের কাছ থেকে একটি X ক্রমোজোম এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম, অর্থাৎ দুটি XX যৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে অপরদিকে পুত্র সন্তানটি ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোমের সঙ্গে মায়ের কাছ থেকে একটি X এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম লাভ করেএটাই স্বাভাবিক হলেও সবসময় তা হয় না অনেক সময় যৌন ক্রোমোজোমের ত্রুটির ফলে কোনো সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে অর্থাৎ সন্তানটি ছেলে না মেয়ে, সেটা বলা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না তখন সে তৃতীয় সেক্সের দলে পড়ে, অর্থাৎ হিজড়া
ক্রোমোজোম বার্বডির ত্রুটির হিসাবে হিজড়াদের ছয় ভাগে ভাগ করা যায় যেমন-- () ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম, () XXY পুরুষ, () XX পুরুষ, () টার্নার সিনড্রোম, () মিশ্র যৌনগ্রন্থির বিকৃতি
() ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (Klinefelter Syndrome): এদের স্ফীত স্তন দেখা যায় এদের শিশ্ন বা পুংলিঙ্গ থাকে বটে, তবে তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র শুক্রাশয়ও খুব ছোটো হয় বগল (বাহুমূল) চুল বা কেশ থাকে না এদের তলপেটের নীচে, অর্থাৎ যৌনাঙ্গের চারপাশে চুল কম হয় মুখে দাড়ি-গোঁফ কম হয় এরা সাধারণত উচ্চতায় লম্বা ধরনের হয়ে থাকে মানসিক জড়তাও থাকতে পারেএই সমস্ত ব্যক্তিদের দেহকোশে ২২ জোড়া অটোজোম, ২টি X ক্রোমোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম  -- মোট ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে সাধারণ অবস্থায় পুরুষের শরীরে যৌন ক্রোমোজোম থাকে XY এবং মোট ক্রোমোজোমের সংখ্যা হয় ৪৬টি অতিরিক্ত স্ত্রী যৌন ক্রোমোজোম, অর্থাৎ X-এর উপস্থিতির ফলেই ব্যক্তির শরীরে স্ত্রী-বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়
() XXY পুরুষ (XXY Male) : এদের শরীরের গঠন পুরুষদের মতো হলেও এরা পুরোপুরি পুরুষ নয়এরা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা হয় এদের বুদ্ধিবৃত্তি কম এদের মধ্যে অনেক সময়েই হিংসাত্মক সমাজবিরোধী আচরণের প্রকাশ ঘটেপুরুষদের মতো লিঙ্গ থাকেতবে লিঙ্গ থাকলেও মূত্রছিদ্রটি লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানে না এদের অণ্ডকোশও স্বাভাবিক স্থানে না থাকে শরীরের অভ্যন্তরেএদের শরীরে ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৭৪৪ টি অটোজোম এবং টি যৌন ক্রোমোজোম যৌন ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি X এবং দুটি  Y ক্রোমোজোম থাকে
() XX পুরুষ (XX Male Syndrome) : XX-পুরুষদের সঙ্গে ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোমের অনেক মিল আছে এদের অনেকেরই স্তন থাকে তবে তা কখনোই সুডৌল এবং স্ফীত নয়শুক্রাশয় থাকে, তবে তা খুবই ক্ষুদ্র তবে শুক্রাশয় থাকলেও সেখানে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় নাপুরুষাঙ্গ আকৃতিতে স্বাভাবিক, অথবা স্বাভাবিকের তুলনায় ছোটোও হতে পারে লিঙ্গের যে স্থানে মূত্রছিদ্রটি থাকার কথা সেখানে থাকে না XX-পুরুষরা উচ্চতায় বেঁটে প্রকৃতির হয়এই ধরনের XX-পুরুষের শরীরে ক্রোমোজোমের মোট সংখ্যা ৪৮ অটোজোম ৪৬ টি এবং দুটি সেক্স ক্রোমোজোম থাকে XX সেক্স ক্রোমোজোমের উপস্থিতি থাকলেও ক্রোমোজোমের গঠনের অস্বাভাবিকতার জন্য এরা পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতে পারে নাবিভিন্ন রকম পুরুষালি ভাব প্রকট হয়
() টার্নার সিনড্রোম (Turner Syndrome) : এদের ক্রোমোজোমের গঠন ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম XX-পুরুষ হিজড়াদের অনুরূপ নয় আপাতদৃষ্টিতে এদের নারী মনে হলেও এরা কিন্তু পুরোপুরি নারী নন কারণ এদের প্রধান যৌনাঙ্গ এবং অন্যান্য গৌণ যৌনাঙ্গ ত্রুটিযুক্ত এদের যৌনাঙ্গের সঙ্গে নারীর যৌনাঙ্গের আপাত সাদৃশ্য থাকে যোনিকেশ খুবই কম দেখা যায় ডিম্বাশয় থাকে না এবং অপূর্ণাঙ্গ ফেলোপিয়ান টিউব জরায়ুর গঠন এর ফলে রজঃস্বলা বা পিরিয়ড হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই এদের বুকের ছাতি পুরুষদের মতো প্রশস্ত তবে এদের প্রশস্ত ছাতিতে কৈশোর থেকে স্তনগ্রন্থির প্রকাশ ঘটে এরা অস্বাভাবিক খর্বাকৃতি হয় গায়ের চামড়া টানলে অনেকটা ঝুলে পড়ে হাত-পায়ের অত্যন্ত খসখসে হয়এদের বৌদ্ধিক ক্ষমতা সাধারণের চাইতে কমএদের কোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৫ (অটোজোম ৪৪ + X)বার্বোডি থাকে না ক্রোমোজোমের এই অস্বাভাবিকতার জন্যেই এদের যৌনাঙ্গ ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত হয় Y ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি যেমন শরীরে পুরুষালি ভাব প্রকাশের অন্তরায় হয়ে শরীরকে নারীসুলভ করে তোলে, ঠিক তেমনই বার্বোডি না-থাকায় নারী শরীরের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে না দেহের গঠন আংশিক পুরুষের মতো হয়ে থাকে
() মিশ্র যৌনগ্রন্থির বিকৃতি (Mixed Gonadal Dysgenesis) : আপাতদৃষ্টিতে এদের পুরুষ বলেই মনে হয় গোঁফ-দাড়িও হয় শুক্রাশয় থাকে, তবে তা থাকে শরীরের অভ্যন্তরে এই প্রকার হিজড়াদের শুক্রাশয়ের বিভিন্ন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যই পরিণত শুক্রাণুর জন্ম হয় না এদের শিশ্ন বা লিঙ্গ বর্তমান থাকে মূত্রছিদ্র লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানেই থাকেব্যতিক্রম যেটা, সেটা হল লিঙ্গ থাকা সত্ত্বেও এদের শরীরে যোনি অর্থাৎ স্ত্রীযোনি, জরায়ু এবং ফেলোপিয়ান টিউব থাকে কৈশোরের এদের শুক্রাশয় থেকে এন্ড্রোজেন নিঃসৃত হয়, ফলে শরীরে পুরুষালি ভাব বেশ প্রকট হয়ে ওঠেপ্রধানত ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা, অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডের নানারকম ত্রুটি এবং জননকোশের উৎপত্তি স্থানের নানা সূক্ষ্ম জটিলতার ফলেই এমন যৌনবিকলাঙ্গ মানুষের জন্ম হয় এইসব মানুষদের দেহকোশে ক্রোমোজোমের সংখ্যা সাধারণত ৪৬ (৪৫ + X) হয় অবশ্য অনেক সময়েই ৪৭ (৪৫ + XY) দেখা যায়
হিজড়াদের দলে জন্মগত যৌন-প্রতিবন্ধীর সংখ্যা খুবই নগণ্য সামান্য কিছু ব্যতীত প্রায় সকলেই ছদ্মবেশী হিজড়াতবে শারীরিক মানসিক দিক দিয়ে এরা এত বেশি অসুস্থ যে খোশমেজাজে নেচে-গেয়ে হিজড়াদের দলে থেকে এদের জীবন াটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় নানাবিধ শারীরিক পীড়ায় জর্জরিত এরাআর পাঁচটা অসুস্থ-পঙ্গু মানুষের মতো এরা সংসারের বোঝা তাই সম্প্রদায়ভুক্ত হিজড়াদের দলে এদের ঠাঁই হয় না এদের কাছেও এরা ঝঞ্ঝাট অন্যভাবে বললে এরা অপ্রকৃত হিজড়াপ্রসঙ্গত জানাই, যৌন-প্রতিবন্ধী যাঁরা তাঁদেরকেপ্রকৃত হিজড়াবলা হয়প্রকৃত হিজড়াদের সকলকেই পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব না-হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যানে অনেকেই ত্রুটিমু্ক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেযদিও ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা থাকলে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যায় না ঠিকই, কি্তু হাইপোস্পিডিয়াস থাকলে তাকে সার্জারির সাহায্যে ভালো করে তোলা সম্ভব হয় টানার্স সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও অস্ত্রোপচার সম্ভব হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আগামীদিনে জন্মগত হিজড়ে অনেক কমে যাবে
() ছদ্মবেশী হিজড়া : ছদ্মবেশী হিজড়াদের চারভাগে ভাগ করলে আলোচনার সুবিধা হবে যেমন – () আকুয়া, () জেনানা, () ছিবড়ি এবং () ছিন্নি
() আকুয়া : হিজড়া দলে এক ধরনের পুরুষ থাকে যাঁরা মেয়ে সাজতে চায়, মেয়ে হতে চায়মেয়ে হিসাবে নিজেকে জাহির করার মধ্যে এঁরা অসম্ভব রকম মানসিক পরিতৃপ্তি বোধ করেএঁরা পুরুষ হলেও নারী-বেশ ধারণ করতে পছন্দ করে স্রেফ এক বিশেষ মানসিক তাড়নায় এরা মেয়ে সেজে থাকতে চায় সদ্য শৈশব পেরিয়ে আসা কিশোরদের মধ্যে এরকম ভাব লক্ষ করা যায় তবে পরিণত বয়সেও কোনো পুরুষের মধ্যেও ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারেমনোবিজ্ঞানের ভাষায় এদের মানসিকতাকে Transexualism বা লিঙ্গরূপান্তরকামিতা বা যৌন পরিবর্তনকামিতা বলেনিজেকে পুরোপুরি পালটে মহিলা হিসাবে পরিচিত হতে চায়যৌন পরিবর্তনকামী মানুষরা নারীত্বের স্বাদ পেতে চায় পুরুষদের এরা প্রেমিকা ভাবেকৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের সদ্য নিযুক্ত মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগে পর্যন্তওআকুয়াসোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হিসাবে পরিচিত ছিলেন আজ বিজ্ঞানের কল্যানেপুরুষসোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকেনারীহিসাবে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুনর্জন্ম হয়েছে
এই আকুয়ারা সমবয়সিকে স্রেফ বন্ধু হিসাবে পেতে চায়, যৌনসঙ্গী হিসাবে নয়কিন্তু পুরুষ হয়েও মেয়েলি স্বভাব আচরণের জন্য মেয়েরা তাঁদের মেয়ে হিসাবে মেনে নিতে পারে না মেয়েলি ভাবের জন্য এরা যেমন মেয়েদের কাছ থেকে  প্রত্যাখ্যাত হয়, তেমনি পুরুষদের কাছ থেকেও প্রত্যাখ্যাত হয়ফলে এদের ম্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ অন্তর্মুখীনতা দেখা যায় দারিদ্র্য, সাংসারিক আর পারিপার্শ্বিক চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা আকুয়ারা একটা সময় হিজড়াদের দলে এসে ভিড়ে যায় সবার ভাগ্যে তো আর মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঘর বর জোটে না !
() জেনানা : জেনানা হল নারীর সাজে সজ্জিত কোনো পুরুষ তবে এদের আকুয়া বলা যাবে না কারণ জেনানারা কোনো বিশেষ মানসিকতার দ্বারা আক্রান্ত নয় নারী বেশ ধারণের মধ্য দিয়ে এরা কোনো সুখ উপলব্ধি করে না যৌন-প্রতিবন্ধী হিসাবে পরিচিত হয়ে এরা সমাজের কাছ থেকে সর্বপ্রকার বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চায় কম খেটে অসদুপায়ে বেশি রোজগারের আশায় জেনানা হিজড়াদের এই ধরনের নারীবেশ ধারণ হিজড়ার জগতে জেনানাদের দাপটই সবচেয়ে  জেনানারা আবার দু-ধরনের হয় যেমন – () যৌনক্ষমতাহীন জেনানা এবং () যৌনক্ষমতাসম্পন্ন জেনানা
() যৌনক্ষমতাহীন জেনানা : হিজড়া দলের এইসব জেনানারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজের এক্কেবারে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির মানুষ অস্বাস্হ্যকর ঝুপড়ি-বস্তি এলাকা থেকেই এইসব হিজড়ারা সংগৃহীত হয় এদের কেউ কেউ অনাথ এরা স্বেচ্ছায় হিজড়াদের দলে চলে আসে দারিদ্র্য, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং অল্প পরিশ্রমে রোজগারের হাতছানি যৌনক্ষমতাহীন ব্যক্তিদের হিজড়াদের ডেরায় ভিড়ে যায়
() যৌনক্ষমতাসম্পন্ন জেনানা : এরা শরীরিক মানসিক দিক দিয়ে পরিপূর্ণ সুস্থ পুরুষমানুষ এরা ধান্দাবাজ, ধুরন্ধর এদের অনেকেরই স্ত্রী-সন্তান-পরিবার থাকে কোনো জেনানা যদি হিজড়েদের দলের প্রধান হয় তাহলে তার পক্ষে তার পরিবারের সঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না দল পরিচালনার জন্যে তাকে হিজড়া-মহল্লাতেই থাকতে হয় তাই বলে পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয় না সেই কারণেই এদেরকে রোজ ভোর হতে না-হতেই ছুটতে হয় হিজড়েদের দুনিয়াতে
() ছিবড়ি : শুধু পুরুষরাই নয়, হিজড়াদের দলে কিছু মহিলাদেরও দেখা যায় এইসব হিজড়াদের ছিবড়ি বলা হয় এরা যৌনাঙ্গের ত্রুটিযুক্ত মহিলা নয়, সুস্থ-সবল মানুষ এরা নিতান্তই অর্থনৈতিক কারণেই এরা হিজড়ের দলে এসে যোগ দেয় চরমতম আর্থিক সংকটের মধ্যেই দিন গুজরান করে রুটিরুজির ধান্দায় এরা হিজড়াদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় হিজড়াদের সঙ্গে থাকার কারণে এরা হিজড়াদের আদব-কায়দা শিখে নেয় রপ্ত করে নেয় হিজড়া সমাজের রীতিনীতি এরা বেশিরভাই বিবাহিতা এবং স্বামী পরিত্যক্তা হন
() ছিন্নি : যে সমস্ত ব্যক্তি লিঙ্গ কর্তন করেখোজাহয়, তাদেরকেইছিন্নিবলেহিজড়াদের গরিষ্ঠাংশই ছিন্নি আকুয়া থেকে অনেকে হিজরাই স্বেচ্ছায় ছিন্নিতে রূপান্তরিত হয় যৌন পরির্তনকামী হিজড়ারা নিজেদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে শরীর থেকে পুরুষাঙ্গ কর্তন করে পরিপূর্ণ নারী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে আধুনিক বা অগ্রসর দেশগুলিতে অত্যাধুনিক প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে যৌন পরিবর্তনকামীরা তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করার সুযোগ পেতে পারে এই জাতীয় অস্ত্রোপচার অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তাই স্বপ্ন অধুরাই থেকে যায় তবে যারা অসম্ভব রকমের মানসিক টানাপোড়েনকে উপেক্ষা করতে পারেন না, তারা হাতুড়ে চিকিৎসক দিয়ে লিঙ্গ কর্তন করিয়ে নেয় অবশ্য যৌন পরিবর্তনকামী আকুয়ারা ছাড়াও যৌনক্ষমতাহীন জেনানারাও অনেক সময় তাদের লিঙ্গ কর্তন করায় এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দালাল মারফত পুরুষ-শিশু, কিশোর এবং যুবকদের হিজড়াদের গোষ্ঠীপতিরা সংগ্রহ করে এরপর ওদের লিঙ্গ কর্তন বা খোজা করেপাকা হিজড়াবানিয়ে তাদের বিভিন্ন রকম রোজগারের কাজে নামানো হয়
খোজার কথা যখন উঠলই তখন আমরা জেনে নিতে পারি খোজার ইতিহাসকীভাবেখোজা’ (ক্যাসট্রেশন) করা হয় তাও জানব খোজাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় মানুষের হাতে গড়া খোজাদের আবির্ভাব হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়। খোজা  প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজকীয় হারেমে বা জেনানামহলে কর্মী ও কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত খোজাকৃত পুরুষ। বিশেষ উদ্দেশ্যে পুরুষদের খোজা করার প্রথা খ্রিস্টপূর্ব আট শতকের গোড়ার দিকেও প্রচলিত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে খোজারা রাজকীয় হারেমের ভৃত্য বা প্রহরী হিসাবে, খেতাবধারী বা বৃত্তিভোগী রানি এবং সরকারের যোদ্ধা ও মন্ত্রীদের পরামর্শদাতা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এ প্রথা বা ব্যবস্থাটি ভারতে প্রবর্তিত হয় সম্ভবত সুলতানি আমলের গোড়ার দিকে। খোজাদের প্রধানত সুলতানদের প্রাসাদে হারেম প্রহরার জন্য নিযুক্ত করা হলেও চিনা খোজাদের মতো সুলতানি আমলের খোজারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালন করে সুলতান আলাউদ্দিন খলজির (১২৯৬-১৩১৬) অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি ও ওয়াজির মালিক কাফুর  একজন খোজা ছিলেন। দিল্লির খোজাদের মতো বাংলার অভিজাতবর্গের খোজারাও প্রশাসনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। বাংলায় হাবশি শাসনামলে (১৪৮৭-১৪৯৩) বস্তত শাসকদের ক্ষমতার উত্থান-পতনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শাহজাদা ওরফে বারবক নামে এক খোজা ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদ দখল করেন। পণ্ডিতদের বিশ্বাস, হাবসি সুলতান শামসউদ্দিন মুজাফফর শাহ (১৪৯০-১৪৯৩) খোজা ছিলেন। সমসাময়িক বাংলায় পর্তুগিজ পরিব্রাজক দুয়ার্তে বারবোসার বিবরণ অনুসারে বাংলার শাসক ও অভিজাতবর্গের হারেমগুলিতে দেশীয় ও বিদেশি বংশোদ্ভূত খোজারা প্রহরায় নিয়োজিত থাকত। কথিত আছে, নওয়াব শুজাউদ্দিন খানের (১৭১৭-১৭৩৯) হারেম প্রহরায় নিয়োজিত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে সংগৃহীত খোজারা।
ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক নানা গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বহুবিবাহ,  উপপত্নী (বাঁদি) ও হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণে খোজা ব্যবস্থারও উদ্ভব ঘটে। হারেমের নারীদের উপর নজর রাখার জন্য খোজাকৃত পুরুষ প্রহরী নিয়োগ করা হত। সাধারণত রণাঙ্গণে বন্দি তরুণ সৈনিকদের খোজা করা হত। খ্রিস্টপূর্ব ৮১১ থেকে ৮০৮ অব্দের আসিবিয়ার রানিমাতা সামুরামাত নিজ হাতে তার এক ক্রীতদাসকে খোজা করেছিলেন। একটি উপকথায় তাকে সেমিরা মিস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসিবিয়ার রানিমাতা কেন তার ক্রীতদাসকে খোজা করেছিলেন ইতিহাসে তার বিবরণ না-থাকলেও অনেক গবেষক মনে করেন রানির বিকৃত যৌন-লালসা নিবৃত্ত করার জন্য হতভাগ্য ক্রীতদাসকে বিকলাঙ্গ করা হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন দেশে খোজা করা হয়েছে। আর এই নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়েছে শাসক, অভিজাত শ্রেনি এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মহলেও। শুধু যে রাজা-বাদশা বা অভিজাত শ্রেণির মহলে খোজা তৈরি হত তা কিন্তু নয়, ধর্মীয় কারণে অনেকেই খোজাকরণ বরণ করেছে, ইতিহাসে এর প্রমাণও আছেওল্ড টেস্টামেন্টে খোজার উল্লেখ আছে ম্যাথুর প্রবচনে আছে -- ‘একদল পুরুষত্বহীন মানুষ আছে যারা মাতৃগর্ভ থেকেই অসম্পূর্ণ অবস্থাতে ভূমিষ্ট হয়েছে। আর একদল আছে যাদের অন্য মানুষ খোঁজা করেছে। তৃতীয় দলের খোজা যারা তারা স্বর্গের কামনায় স্বেচ্ছায় পুরুষহীন হয়েছে। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক ঘোষণা করেছিলেন -- একমাত্র কামনাশূন্য খোজার কাছেই স্বর্গের দুয়ার খোলা রয়েছে। কামনা-বাসনা শূন্য হওয়ার জন্য অনেক ধর্মপ্রচারক খোজাদের স্বপক্ষে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কামনাশূন্য সাধনা করার জন্য বিগত খ্রিস্টান সাধু ওরিজেন তার পুরুষত্ব বিসর্জন দিয়েছিলেন। ১৭৭২ সালে রাশিয়ায় একটি গোপন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল, যাঁরা স্বেচ্ছায় খোজাকরণ বরণ করে নিতেনএদের বিশ্বাস ছিল মানুষের দেহে আদম এবং ইড থেকে যে নিষিদ্ধ ফল যৌন-তাড়না করে বেড়াচ্ছে, খোজাকরণের মাধ্যমে তার অবসান ঘটানো সম্ভব। মানব এবং মানবীর জনক এবং জননী হওয়ার যোগ্যতা এই নিষিদ্ধ অদৃশ্য ফল থেকেই আসে, আর লিঙ্গ ও যোনির ব্যবহারে আর একটি মাত্র সন্তানের জন্ম হয়। এ কারণেই রাশিয়ার ওই গোপন সংগঠনের পুরুষ সদস্যরা স্বেচ্ছায় খোজা এবং নারীরা তাদের স্তন কেটে কামনাশূন্য হতে চেয়েছিল।
খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বর্গ প্রাপ্তির আশায় শুধু খোজাকরণ বরণ করত, তা কিন্তু নয় গির্জায় প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য খোজাদের কদর করা হত। সিসটান চ্যাপেলে প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য স্বয়ং পোপ তাদের আহ্বান করতেন। খোজাদের আহ্বান করার পিছনে যুক্তি ছিল খোজাদের কণ্ঠস্বর সমান তেজি, সমান গভীর এবং সমান নিখাদ। খ্রিস্ট সম্প্রদায় এই সংগীত আগ্রহভরে শ্রবণ করত, তাদের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরকে মুগ্ধ করার জন্য খোজা কণ্ঠের সংগীত অবশ্যই গীত হওয়া প্রয়োজন। এই ধারণা থেকে ইতালির অনেক বিখ্যাত গায়ক স্বেচ্ছায় খোজা হয়ে গিয়েছিলেন।
এখানেই শেষ নয়, হারেমের প্রহরী হিসাবেও খোজারা নির্ভরযোগ্য ছিল। খোজাদের এই বিশ্বস্ততা প্রথম লক্ষ করেন সাইরাস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ অব্দে ব্যাবিলন দখল করার পর আবিষ্কার করলেন খোজাদের মতো নির্ভরযোগ্য পুরুষ সত্যিই দুর্লভ। তার এই আবিষ্কারের পিছনে যুক্তি ছিল খোজাদের যেহেতু কোনো সংসার নেই, তাই যে তাকে প্রতিপালন করবে খোজারা সুখ-দুঃখে তারই পাশে থাকবে। সাইরাস এও লক্ষ করেছিলেন যে, খোজারা পুরুষত্বহীন বলে কিন্তু তারা হীনবল নয়। সাইরাস এই বিশ্বাস থেকেই রাজ অন্তঃপুরে খোজা প্রহরী নিয়োগ করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন দেশের হারেমে খোজা প্রহরীদের নিয়োগের হিড়িক পড়ে যায়। হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পারস্যের মানুষরা আইনিয়ানদের দলে দলে বন্দি করে তাদের পুরুষত্বের বিনাশ করত এবং এদের সুন্দর পোশাক-আশাক পরিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজাদের কাছে বিক্রি করে দিত। পারসিকরাই মুসলিম শাসিত রাজ্যে প্রথম খোজার আমদানি করেছিল তুর্কিরা তো খোজার খোঁজই রাখতেন না। অবশ্য পঞ্চদশ শতাব্দীতে খোজার সন্ধান পান তুর্কি শাসকরা। এই আশ্চর্য বিশ্বস্ত এবং শক্তিমান না-নারী না-পুরুষ প্রাণীটি পেয়ে তুর্কিদের মধ্যে এই চেতনার উদয় হল যে, ইচ্ছে করলে তা তারা নিজেরাই খোজা তৈরি করতে পারে।
তুর্কি সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে অসংখ্য যুদ্ধবন্দির মাঝখান থেকে রূপবান এবং শক্তিমান পুরুষদের বেছে বেছে খোজা তৈরির মহরত শুরু করেন সুলতান প্রথম মাহমুদ এবং দ্বিতীয় মুরাদ। খোজাদের কাজ প্রথমদিকে বাদশাহ বা সুলতানের মহিষী এবং রক্ষীতাদের পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলেও পরবর্তী সময় সুলতানের হেঁসেল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে তাদের নিয়োগ করা হত।
১৮৩৬ সালে মুর্শিদাবাদের এক প্রাসাদে ৬৩ জন খোজার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। এই খোজারা শুধু আজ্ঞাবাহী ভৃত্য হিসাবে নিয়োজিত ছিল না, তারা সম্রাট এবং নবাবের প্রিয়পাত্র হিসাবে কোনো কোনো সময় শাসনকার্যে প্রভাব বিস্তার করত। ইতিহাসে এ রকম একটি ঘটনার কথা জানা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিল তুর্কি হারেমে। তুর্কিমহলের খোজা প্রধানকে বলা হত কিসলার আগা। কিসলার আগা উপাধিধারী খোজা শুধু মহলের কুমারীদের প্রধান রক্ষী হিসাবে নিয়োজিত হত সে নিজে দাস হলে তার অধীনে থাকত চারশো গোলাম-বাঁদি তার নামে ঘোড়াশালে আলাদা করে রেখে দেয়া হত তিনশো ঘোড়া। পুরুষত্বহীন একজন মানুষের এই বিপুল ক্ষমতা একজন খোজার শুধু অটোমান সাম্রাজ্যেই দেখা যায়নি, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মোগল আমলে অযোধ্যার একজন জনপ্রিয় আঞ্চলিক শাসক ছিল খোজা। স্পষ্টত মুসলিম বিশ্বে প্রেরিত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সব বা অতি উচ্চ অংশকে খোজা করা হয়েছিল, যার কারণে এসব অঞ্চলে তারা উল্লেখযোগ্য বংশধর (ডায়াসপোরা’) রেখে যেতে ব্যর্থ হয়। ইসলামি ক্রীতদাসত্বের নিদারুণ লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়া ইউরোপীয়, ভারতীয়, মধ্য-এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লক্ষ লক্ষ বিধর্মীর ভাগ্যও অনেকটা একইরকম ছিল। ১২৮০-র দশকে মার্কোপোলো ও ১৫০০-র দশকে দুয়ার্ত বার্বোসা স্বচক্ষে ভারতে বিপুল সংখ্যায় খোজাকরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। একই প্রক্রিয়া চলে সম্রাট আকবর (মৃত্যু ১৬০৫), জাহাঙ্গীর (মৃত্যু ১৬২৮) ও আওরঙ্গজেবের (মৃত্যু ১৭০৭) শাসনামলে। সুতরাং, ভারতে গোটা মুসলিম শাসনামলে খোজাকরণ ছিল একটা প্রচলিত নিয়ম। সম্ভবত এটা ইতিপূর্বে উল্লেখিত ভারতের জনসংখ্যা ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় ২০ কোটি থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ কোটিতে হ্রাসকরণে একটা বড়ো অবদান রেখেছিল।
খোজাদের মধ্যে বুদ্ধিমান এবং স্মৃতিশক্তিধর হিসাবে যাদের পাওয়া যেত সুলতান এবং সম্রাটেরা তাদের রাজকার্যে নিয়োজিত করতেন। তবে বুদ্ধিমান খোজার সংখ্যা ছিল খুবই কম। খোজাদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে অধিকাংশ খোজাই বদমেজাজি, বালসুলভ, প্রতিশোধপরায়ণ, নিষ্ঠুর এবং উদ্ধত। অবশ্য এর বিপরীত স্বভাবের খোজাও রয়েছে এরা সরল, নিরীহ, আমোদপ্রিয় উদার। অবশ্য খোজাদের মেজাজ মর্জি এই বৈপরীত্যের কারণ তাদের খোজাকরণের বয়সের উপর নির্ভর করত। কম বয়সে খোজা করার পর ওই খোজা কারও উপর ক্রোধান্বিত হলে এবং সুযোগ পেলে তাকে হত্যা করতেও দ্বিধা করত না।
জে. রিচার্ড লিখিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, সাধারণভাবে খোজা বা পুরোপুরি অক্ষম এই কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকলেও খোজারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যৌন-অক্ষম নয়। রিচার্ড একজন বিবাহিত খোজার স্ত্রীর সংগে আলাপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, স্ত্রীলোকটির কথায় মনে হচ্ছিল ওরা পুরোপুরি তৃপ্ত এবং সুখী। চিয়েন লুঙ-এর আমলে একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, পিকিংয়ের হারেমের এক খোজা পুরোহিতের কাছে ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করে বলেছিল, খোজার উপর পুরোহিতের কোনো এক্তিয়ার নেই। পুরোহিত খোজাকে হেকিমের কাছে নিয়ে গেলেন পরীক্ষা করে দেখা গেল তার পৌরুষত্ব ফিরে এসেছে। আসলে সে ছিল এক নকল খোজা।
খোজা ব্যাপারটা কী ? সাধারণত দু-রকম ব্যবস্থাকেই খোজা বলে একটি হল () Castration (Removal of the testicles), অপরটি () Penectomy (Penis Removal) ক্যাসট্রেশন (Castration) হল আসলে পুরুষের ভাসডিফারেন্স বা শুক্রনালীকে কেটে দেওয়া হয় এই শুক্রনালী শুক্রাণু বহন করে কাজেই শুক্রাণু বীর্যে আসতে পারে নাকাজেই এই পুরুষের পক্ষে নারীর গর্ভসঞ্চার করানো হয় না এটি পুরুষের স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা ভেসেকটমি বলে পরিচিত ভেসেকটমি অপারেশনের পর সেই পুরুষের যৌনইচ্ছা, যৌনক্ষমতা, যৌন-আবেদন কোনোটাই হ্রাস পায় না হারেমের খোজাদের বেশিরভাগেরই এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা হত তবে Penectomy খোজা হল পুরুষের লিঙ্গটাকে কেটে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলা বাৎসায়নের আগেই কৌটিল্য তাঁরঅর্থশাস্ত্রম্”-এ এক বিশেষ ধরনের পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এরানপুংসক পুরুষাঙ্গ ছেদন করে এদের নপুংসক করা হত এরা ছিল রাজ-অন্তঃপুরের পাহারাদার শুধু মহিলারক্ষীদের এই করানো বেশ কঠিন ছিল আবার পুরুষরক্ষীবাহিনীকে বিশ্বাস করা যেত না এদের দ্বারা অতঃপুরবাসিনীর শ্লীলতাহানি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় কিছু পুরুষকে লিঙ্গ কেটে খোজা করে দেওয়া হয় রাজ-অন্তঃপুরের বা হারেমের মহিলারা এইসব খোজাদের দিয়ে বিকৃতভাবে তাঁদের যৌনক্ষুধা মেটাতো রাজা বা বাদশাও ম যাবে কেন ? এদের অনেকেই পুরুষসঙ্গমে তৃপ্ত হতেন লিঙ্গ কেটে ফেললে যৌনমিলন একেবারেই অসম্ভবহিজড়া-মহলে কীভাবে লিঙ্গ কর্তন বা খোজা (Penectomy) করা হয় সেটা জানা যেতে পারে বীভৎস নারকীয় এবং অবৈজ্ঞানিক উপায়ে লিঙ্গ শরীর থেকে কেটে ফেলা হয় হিজড়া বানানোর জন্য নিয়ে আসা ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ঘরে অন্তরীণ অবস্থায় ১১ দিন থাকতে হয় সূর্যের আলো পর্যন্ত দর্শন করতে পারবে না সে প্রথম প্রথম মহল্লার হিজড়ারা এর সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে চলে আদর আর যত্ন লিঙ্গচ্ছেদনের জন্য হবু হিজড়ার সম্পত্তি আদায় করে নেয় যৌন পরিবর্তনকামীরা মত দিলেও অন্যরা মত দিতে রাজি হয় না রাজি না-হলে চলে দৈহিক আর মানসিক নির্যাতন এই সময়ে হবু হিজড়াকে প্রচুর পরিমাণে মাদক সেবন করানো হয় অমানবিক অত্যাচার ও মাদকের প্রভাবে তার স্বাভাবিক চেতনা লুপ্ত হয়ঠিক ১১ দিন পর অনেক রাতে মহল্লার দলপতি তার অনুগত কয়েকজনকে হিজড়াকে নিয়ে ওই ঘরে ঢোকে নেশায় আচ্ছন্ন হবু হিজড়াকে উলঙ্গ করে হাত-পাঁ বেঁধে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরা হয়যাতে চিৎকার করতে না-পারে সেজন্য মুখের ভিতর কাপড় জাতীয় কিছু গুঁজে দেওয়া হয় এরপর কালো ফিতে দিয়ে লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ একসঙ্গে সজোরে বেঁধে দু-দিক থেকে টেনে ধরা হয় মাথা একদিকে হেলিয়ে কয়েকজন হিজড়া তাকে চেপে ধরে রাখে এরপর দলপতি অত্যন্ত ধারালো ছুরি বা ক্ষুর দিয়ে ঘ্যাচাং করে লিঙ্গটি কেটে ফেলে তখন প্রচুর পরিমাণে রক্ত নিঃসরণ হতে থাকে হিজড়াদের ধারণা এই রক্তপাতের মধ্য দিয়ে শরীরের সমস্ত পুরুষ-রক্ত বেরিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে শরীরে নারী-রক্তের জন্ম হয় একে ওরানির্বাণবলে নির্বাণের মধ্য দিয়ে হিজড়ার জন্ম হয় সে যাই হোক, প্রসঙ্গে আসি লিঙ্গচ্ছেদনের পর ওই ব্যক্তিকে চিৎ করে শুইয়ে তার ক্ষতস্থানের নীচে একটি পাত্র রাখা হয় ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ওই পাত্রে রাখা হয় কর্তিত লিঙ্গটিও রাখা হয় ওই পাত্রটিতেইপরদিন সকালে পাত্রটিকে ফুল দিয়ে সাজানো একটি ঝুড়ির মধ্যে নিয়ে হিজড়ারা মিছিল করে চলে কাছেপিঠের কোনো জলাশয়ে সেখানেই ঝুড়িটি ভাসিয়ে দেওয়া হয় ছেদনকার্যের পর নতুন হিজড়াকে ৪৮ ঘণ্টা ঘুমোতে দেওয়া হয় না ক্ষতস্থান রক্ত বন্ধ করার জন্য ঘুটে পোড়া ছাই খয়ের ভিজিয়ে পুরু করে ওই ক্ষতস্থানের ছাইয়ের উপর লাগিয়ে দেওয়া হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটি প্লাস্টারের মতো শক্ত হয়ে যায় নির্মাণ হয় এক লিঙ্গকবন্ধ হিজড়া
লিঙ্গ কর্তনের পর আর-একটি প্রধান কাজ হল স্তন-দুটিকে পুষ্ট করা এটি হিজড়াসমাজের অত্যন্ত গোপনে হয়, যাকে বলে ট্রেড সিক্রেট লিঙ্গ কর্তনের কয়েকদিন পর নতুন হিজড়া একটু সুস্থ হয়ে উঠলে মহল্লার দলপতি তাকে Lyndiol (চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ট্যাবলেট খাওয়া অনুচিত) নামে এক ধরনের জন্ম নিরোধক ট্যাবলেট খাওয়ায়বেশ কয়েক মাস ধরে এই ট্যাবলেট সেবন করানো হয় রোজ, নিয়মিত এই ট্যাবলেটে ইথিলিন অস্ট্রাডাইওলের পরিমাণ একটু বেশি থাকে ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় হরমোনের কু-প্রভাবে স্তনগ্রন্থিতে স্নেহজাতীয় পদার্থ সঞ্চিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে পুরুষ-বক্ষ থেকে নারী-স্তনের মতো স্ফীত পরিপুষ্ট হতে থাকে নারীদের মতোই স্তনবৃন্তও ফুলে ওঠেতবে যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে তারা প্ল্যাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে স্তন প্রতিস্থাপন বা সিলিকন ব্রেস্ট করিয়ে নেয় খুবই ব্যয়সাপেক্ষ এই পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে প্রায় অসম্ভব হলেও ধনতান্ত্রিক দেশগুলির হিজড়ারা সিলিকন ব্রেস্ট বানিয়ে নেয় তবে তারা কিন্তু সকলেই লিঙ্গ কর্তন করে না পর্ন-দুনিয়ায় এদের বেশ কদর আছে এরা “Shemale”বা “Ladyboy” তবে সোমনাথ ওরফে মানবী মনে করেন, “মেয়ে হিজড়ে ছেলে হিজড়ে বলে কিছুই নেই সকলেই সমান হিজড়ে হিজড়ে দলে দু-রকম মানুষআকুয়া আর নির্বাণ আকুয়ারা পেনিস-টেসটিস এখনো কেটে ফেলে দেয়নি, আর নির্বাণ হল তারাই যারা কেটে ফেলে দিয়েছে বহুচেরা মাতার (হিজড়াদের দেবতা) মন্দিরেকমলিয়ানামে এক বিশেষ হিজড়া সম্প্রদায় আছে এরা পুরুষ এরা একই সঙ্গে নিজেদের নারী পুরুষ হিসাবে কল্পনা করে তাই লম্বালম্বিভাবে দেহের এক অংশে পুরুষের পোশাক এবং অপর অংশে নারীর বেশ ধারণ করে এইকমলিয়াধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।(চলবে)

২টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

লিঙ্গস্থানে জন্মগত ত্রুটি যাদের তারাই হিজড়া - এই কথাগুলো ভুল । হিজড়ে শব্দটি লিঙ্গপরিচয়ভিত্তিক নয় , বৃত্তিমূলক । যারা বাচ্চা নাচানোর বৃত্তি অবলম্বন করেন তারাই হিজড়া বা হিজড়ে । আর এরা মূলত শারীরিকভাবে শক্তসমর্থ পুরুষ , মননে নারী বা রূপান্তরকামী । সব হিজড়ে রূপান্তরকামী হলেও সব রূপান্তরকামী হিজড়ে নন । যারা বাচ্চা নাচান তারাই হিজড়ে । আমার‌ও আগে ধারণা ছিলো লিঙ্গস্থানে ত্রুটি থাকলেই হিজড়ে , কিন্তু স্বপ্নময় চক্রবর্ত্তীর গবেষণামূলক উপন‍্যাস হলদে গোলাপ পড়ার পর এই ধারণা ভেঙেচুরে যায় । আসল কথাটা জানতে পারি ।

Unknown বলেছেন...

সোমনাথ / মানবী বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় হিজড়ে নন , রূপান্তরকামী । পেশায় অধ‍্যাপক / অধ‍্যক্ষ ।