শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়

চৈত্রমাস থেকে আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। চারদিক কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আসে কালবৈশাখী থেকে সারা বর্ষাকাল হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিতে এক মুহূর্তের জন্য চারদিক আলোকিত হয়ে যায়প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা! এটাকেই বজ্রপাত বা বাজ-পড়া বলে বজ্রপাত কীকীভাবে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয় ? সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার প্রায় সমান মাত্রার স্ফুলিঙ্গ আর ভয়াবহ গুরুগর্জন বহুকাল ধরেই মানুষের পিলে চমকানোর কাজটি দায়িত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে। বজ্রপাত হল বিদ্যুতের বিস্ফোরণ, যা প্রভূত শক্তিশালী। ঝড়বৃষ্টির সময় চোখের পলকে বজ্রপাত হতে পারে। যদিও মনে হয় আকাশে বিজলী চমকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বজ্রের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়, প্রকৃতপক্ষে এটি ঠিক নয়। আলোর গতিবেগ শব্দের গতিবেগের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার জন্য দূরবর্তী আলোকবর্তিকা দেখার অনেক পরে বজ্রের আওয়াজ শোনা যায়। ভূপৃষ্ঠের স্থানিক অবস্থান, উচ্চতা, বিদ্যমান বায়ুপ্রবাহ, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ, উষ্ণ ও শীতল জলাধারের অবস্থান ইত্যাদি ফ্যাক্টরের উপর বিদ্যুৎ চমকের পৌনঃপুনিকতা, ব্যাপ্তি ও তীব্রতা অনেকটাই নির্ভর করে।  শীতকালে শৈত্য প্রবাহকালেও থান্ডার-স্নো ঘটতে পারে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলিতে বায়ুমণ্ডলে অস্থিরতা বেশি থাকার কারণে প্রায় ৭০% বিদ্যুৎ চমকের ঘটনা ঘটে থাকে। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পার্থক্যের কারণে এটি হতে পারে এবং সাধারণত দুই রকম বাতাসের বর্ডার লাইনেই এটি সংঘটিত হয়।

জলচক্রের নিয়মে জলাধারের জল বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ আকারে আকাশে আশ্রয় নেয়। এই মেঘই হল বজ্রপাতের ব্যাটারি। বজ্রপাতের জন্য দায়ী মেঘ বৈদ্যুতিক চার্জের আধারের মতো আচরণ করে, যার উপরের অংশ পজিটিভ এবং নীচের অংশ নেগেটিভ চার্জে সক্রিয় থাকে। মেঘ কীভাবে সক্রিয় হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ মতভেদ থাকলেও সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হচ্ছে,জলচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নীচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষারকণার সঙ্গে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্পকণা বেশ কিছু ইলেকট্রন হারিয়ে ফেলেএই মুক্ত ইলেকট্রনগুলি মেঘের তলদেশে জমা হয় এবং ইলেকট্রন হারানো পজিটিভ চার্জিত বাষ্পকণা মেঘের একেবারে উপর পৃষ্ঠে চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে মেঘগুলি শক্তিশালী ধারক বা ক্যাপাসিটরের বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মেঘের দুই স্তরে চার্জ তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিদ্যুৎক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত চার্জের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।এভাবে বাষ্পকণা ও মেঘে সংঘর্ষ চলতে চলতে মেঘের উপরে এবং নীচে যথাক্রমে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে এতটা শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে যে তার বিকর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থানরত ইলেকট্রনগুলি ভূপৃষ্ঠের আরও গভীরে চলে যায়। ফলস্বরূপ, ওই নির্দিষ্ট এলাকার ভূপৃষ্ঠ শক্তিশালী পজিটিভ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখন বজ্রপাতের জন্য শুধু যা প্রয়োজন তা হল বিদ্যুৎপ্রবাহের জন্য সামান্য একটু বাহক (কন্ডাক্টর)বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী, তাই মেঘের বিপুল শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্র তার চারপাশের বাতাসের অপরিবাহী ধর্মকে নষ্ট করে দেয়, যাকে বলে Dielectric Breakdownমেঘে অবস্থিত বিদ্যুৎক্ষেত্র যখন যথেষ্ট শক্তিশালী হয় (প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০,০০০ ভোল্ট), তখন তার আশেপাশের বাতাস পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জে বিভক্ত হয়ে যায়। এই আয়োনিত বাতাস প্লাজমা নামেও পরিচিত। বাতাস আয়োনিত হয়ে মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচলের পথ বা শর্ট সার্কিট তৈরি করে দেয় এবং বজ্রপাত ঘটায়। কোনো ধাতুর সঙ্গে অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন নিষ্কাশনের প্রক্রিয়াই হল জারণআয়োনিত বাতাস বা প্লাজমা পরিবাহী হওয়ার কারণে এতে ধাতব বৈশিষ্ট্য প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে প্লাজমার বিক্রিয়ায় বজ্রপাতের স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়। বজ্রপাত মেঘের ভিতরেও হতে পারে, একাধিক মেঘের মধ্যেও হতে পারে, এমনকি মেঘ থেকে মাটিতেও হতে পারে। যত বজ্রপাত হয়, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশই হয় মেঘ থেকে মাটিতে। আশপাশের সবচেয়ে কাছে যেখানে পায় সেদিকেই ছুটে যায় বিজলি ! সেটা অনেকসময় একটি গাছের উপর পড়ে, কখনো-বা লম্বা-উঁচু কোনো ভবনের উপর, আর ভাগ্য খারাপ হলে সরাসরি কোনো মানুষের উপর পড়েবিজলির গড় তাপমাত্রা প্রায় ২০০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৬০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। যেসব মেঘ অনেক ঘন আর লম্বা, সেগুলিতেই সাধারণত বজ্রপাত হয়। অনেকেই বলেন সাম্প্রতিককালে নাকি বজ্রপাত বেড়ে গেছে। তাহলে দেখা যাক বজ্রপাতের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ কী ? বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিকে বড়ো বড়ো গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, অন্যদিকে মোবাইল ফোনসহ যান্ত্রিক ব্যবহার বৃদ্ধি মানুষকে বজ্রপাতের নিশানা করে তুলছে। একই সঙ্গে বায়ুদূষণের হার বেড়ে যাওয়াও দায়ী হতে পারে। কারণ এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, বায়ুমণ্ডলে ধাতব উপাদান বেড়ে গেলে তা বজ্রপাতের অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতের ঘটনা খোলা প্রান্তরে বেশি দেখা যায়। বর্তমানে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। এটিও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার একটা কারণ হতে পারে। এ ছাড়া আগে কৃষিতে ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। কৃষকের কাছে বড়জোর কাস্তে থাকত। কিন্তু এখন ট্রাক্টরসহ নানা কৃষি যন্ত্রাংশ বা মোবাইলের মতো ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে গেছে। এসব ধাতব বস্তুর ব্যবহার বজ্রপাতে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করছে। ২০১৩ সালে বজ্রপাতের কারণে জার্মান বিমান সংস্থাগুলির ২৮০ মিলিয়ন ইউরোর মতো গুনতে হয়েছে৷

বজ্রপাতের আঘাতে মানুষের মৃত্যু থেকে শুরু করে দাবানল পর্যন্ত হতে পারে। জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাতের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী গত বৃহস্পতিবার এমনটিই দাবি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, চলতি শতকের শেষ নাগাদ বজ্রপাতের হার ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। নেচার সাময়িকীতে এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং মেঘের প্লবতা পরিমাপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ২১০০ সালে পৃথিবী কতটা উষ্ণ হতে পারে, তা অনুমানের জন্য বিজ্ঞানীরা ১১টি ভিন্ন ভিন্ন নমুনা জলবায়ুর সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখেন। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলিতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ ডেভিড রম্পস বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতগুলি আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হবে। উষ্ণায়নের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প বাড়বে। আর আশপাশে যদি বেশি বেশি জ্বালানি ছড়িয়ে থাকে, কোনো ধরনের প্রজ্বলন ঘটলেই তা বেশি সময় স্থায়ী হবে।
বজ্রপাত কী আরও ভয়ানক আরও বিধ্বংসী হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে ? বজ্রপাতের ধরনে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, সে সম্পর্কে জানার প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীদের পূর্ববর্তী অনুমানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের বিষয়টি কম গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় জ্বালানি বা শক্তির পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলে বাতাসের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের হার সমন্বিতভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। গবেষকেরা আরও জানান, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাতের হার প্রায় ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। আর চলতি শতকের শেষে তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে তখন বজ্রপাত প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারেবিশ্বজুড়ে বছরে এখন প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ বার বজ্রপাত হয়। এ অবস্থায় বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পেলে মানুষের হতাহত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এ ছাড়া বনভূমি এবং প্রাণীবৈচিত্র্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুষ্ক বনাঞ্চলে দাবানলের আশঙ্কা আরও বাড়বে এবং সেখানকার পাখিসহ বিলুপ্ত-প্রায় নানা রকমের প্রাণীর প্রজাতি ধ্বংস হবে। বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ যত দ্রুত হয়, বজ্রপাত তত বেশি হয়। আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলেও বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে চলতি শতকের শেষ নাগাদ বজ্রপাতের হার প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
কোথায় বেশি বাজ পড়ে ? একই জায়গায় বাজ দু-বার পড়ে ?  -- এ নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা। এ সমীক্ষায় দেখা গেছে, একই জায়গায় বাজ দু-বার পড়ে না -- এমন ধারণা মোটেই সঠিক নয়। অর্থাৎ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৯৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কোনো কারণ ছাড়াই এক জায়গায় তিনবার পর পরও বাজ পড়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ নাসার ট্রপিক্যাল রেইনফল মেজারিং মিশন ও অরবভিউ ওয়ান/মাইক্রোল্যাব স্যাটেলাইট বিভিন্ন জায়গার বজ্রপাতের তথ্য সংগ্রহ করে। এ তথ্যে দেখা গেছে, বিষুবরেখার কাছাকাছি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। সমুদ্র থেকে স্থলভাগেই বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এর কারণ হিসাবে নাসার আর্থ অবজার্ভেটরি ওয়েবসাইটে জানানো হয়, সাধারণত মাটি জলের থেকে বেশি সূর্যরশ্মি শোষণ করে। ফলে জলতলের তুলনায় কয়েকশো গুণ বেশি উত্তপ্ত হয় ভূত্বক। বিশাল এলাকা জুড়ে ঝড়ের সৃষ্টি হলে ফাঁকা জায়গা বা উঁচু পার্বত্য জায়গায় বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় ভেনেজুয়েলার লেক মারাকেবিওতে। বছরে ৩০০ দিন সেখানে বাজ পড়ে। প্রতি এক কিলোমিটারে বছরে ২৫০ বার বজ্রপাত হয়ে থাকে। নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীতে সবথেকে বেশি বজ্রপাত হয় ভেনিজুয়েলার লেক মারাকেবিওতে। বছরে তিনশো দিন সেখানে বাজ পড়ে। প্রতি এক কিলোমিটারে বছরে ২৫০ বার বজ্রপাত হয়ে থাকে ।
মানুষের গায়ে বজ্রপাত হলে নাকি সেই শরীর ম্যাগনেট হয়ে যায় -- এটা কি আসলেই সত্যি, নাকি কুসংস্কার ? এ কথা মোটেও সত্যি নয়। তবে তার শরীর মারাত্মকভাবে ইলেকট্রনগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আসলে আমরা জানি যে, কোনো ইলেকট্রিক চার্জের মুভমেন্টের ফলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। তা হলে বজ্রপাতের এই বিশাল ইলেকট্রিক ডিসচার্জের সময় চার্জের মুভমেন্টের দরুন একটা বিশাল ম্যাগনেটিক ফিল্ড অবশ্যই তৈরি হওয়ার কথা অতএব বজ্রপাতের সময় ইলেকট্রিক ডিসচার্জ চ্যানেলে অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। বজ্রপাতের কারেন্ট যখন কোনো পাথর, কোনো ধাতব পদার্থ কিংবা মাটি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যায়, তখন এই অতি শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডের দরুন ওই পদার্থসমূহ পার্মানান্টলি ম্যাগন্যাটাইজড হয়ে যায় সেই কারণে বজ্রপাতের ফলে কোনো মানুষ মারা গেলে তার হাড়সমূহও পার্মানান্টলি ম্যাগন্যাটাইজড হয়ে যায়। প্রতি মিনিটে পুরো ৬০০ বার বিশ্বে বজ্রপাত হয় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ বজ্রপাত পৃথিবীতে হয়ে থাকে পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে ৪০/৫০ বার বিদ্যুৎ চমকায়, বছরের হিসাবে যেটা প্রায় ১৪০ কোটি বার ! একটা বজ্রপাতের স্থায়িত্ব মাত্র ৩০ মাইক্রোসেকেন্ড, মানে থিওরিটিক্যলি  ক্যামেরা শাটার মারার এক সেকেন্ডের মাঝেই আমার আশেপাশে একটির পর একটি করে ৩৩,৩৩৩ টি বজ্রপাত হয়ে যেতে পারে।
বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অতএব বজ্রপাত চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব বজ্রপাত বা তড়িতাদহ থেকে বাঁচা। উপায়গুলি জেনে রাখা ভালো --- (১) জানালা থেকে দূরে থাকুনবজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভিতর থাকুন। (২) উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকুন, বজ্রপাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই এসব জায়গায় যাবেন না বা কাছাকাছি থাকবেন না। ফাঁকা জায়গায় কোনো যাত্রী ছাউনি বা বড়ো গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি থাকে। (৩) পাকা বাড়ির নীচে আশ্রয় নিন, ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু জায়গায় না-থাকাই ভালো। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো দালানের নীচে আশ্রয় নিতে পারেন। (৪) টিভি-ফ্রিজ থেকে সাবধান, বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। টিভি-ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও ধরবেন না। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলির প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করুন। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্লাগ আগেই খুলে রাখুন।(৫) বজ্রপাতের সময় রাস্তায় চলাচলের সময় আশেপাশে খেয়াল রাখুন। যে দিকে বাজ পড়ার প্রবণতা বেশি সে দিক বর্জন করুন। কেউ আহত হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। (৬) ঝড়-বৃষ্টির সময় রাস্তায় জল জমাটা আশ্চর্য নয়। তবে বাজ-পড়া অব্যাহত থাকলে সে সময় রাস্তায় বের না-হওয়াই মঙ্গল। একে তো বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে, উপরন্তু কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়লে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।(৭) খালি পায়ে বা পা খোলা জুতো নয়, বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতো বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি একান্ত বেরোতেই হয় তবে পা ঢাকা জুতো পড়ে বের হোন। রবারের গাম্বুট এ ক্ষেত্রে সব থেকে ভালো কাজ করবে। (৮) গাড়ির ভিতর থাকলে বজ্রপাতের সময় রাস্তায় গাড়িতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করুন। যদি প্রচণ্ড বজ্রপাত ও বৃষ্টির সম্মুখীন হন তবে গাড়ি কোনো গাড়িবারান্দা বা পাকা ছাউনির নীচে নিয়ে যান। এ সময় গাড়ির কাঁচে হাত দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। (৯) ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলুনবজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলির সংস্পর্শ এসে অনেকে আহত হন। (১০) বিদ্যুৎ চমকানি বা বাজ-পড়ার সময় খোলা মাঠে দৌড়োবেন না। খোলা মাঠে দৌড়োলে তার মাথায় বাজ পড়তে পারে। (১১) বসতঘরটি দালান না-হলে তার একেবারে কাছে কোনো গাছ রাখা ঠিক নয়। (১২) গৃহস্থাপনায় বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা রাখুন। অর্থাৎ, বজ্র প্রতিরোধের জন্য দালানের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় অবশ্যই ভাল গ্রাউন্ডিং থাকতে হবে এবং তা আলাদা গ্রাউন্ড সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যেমন--  কম্পিউটার, ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য একটি সার্জ এরেস্টার স্থাপন করতে হবে, দালানের ছাদে দৈর্ঘ্য বরাবর ২৫ ফুট পর পর লাইটনিং রড স্থাপন করতে হবেলাইটনিং রডের ব্যাস সাধারণত ৫/৮" এবং উচ্চতা ১/২ ফুট পর্যন্ত হয়। দালানের প্রত্যেক কর্নারে আর্থিং সিস্টেমের সংযোগ থাকা আবশ্যক। বড়ো দালানের ক্ষেত্রে (পরিধি ২৫০ ফুট এর বেশি) অতিরিক্ত গ্রাউন্ডিং সিস্টেম থাকলে ভালো হয়। মাটিতে ১০০ ফুট উপর একটি গ্রাউন্ডিং সিস্টেম থাকা দরকার। প্রধান তার একটি আর্থিং থেকে শুরু করে প্রত্যেক লাইটনিং রডের সঙ্গে সংযোগ শেষে অন্য কর্নারের আর্থিংয়ে গিয়ে শেষ হবে। বৈদ্যুতিক গ্রাউন্ড সিস্টেম ও লাইটনিং গ্রাউন্ড সিস্টেম পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা প্রয়োজন। দালানের ভূগর্ভস্থ ধাতব পাইপ লাইন থাকলে গ্রাউন্ড সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। গ্রাউন্ডের সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার জন্য গ্রাউন্ড রড ব্যবহার করা হলে গ্রাউন্ড রডগুলি পুরোপুরি মাটির ভিতর ঢুকিয়ে উপযুক্ত ক্লাম্প দিয়ে তারের সংযোগ দিতে হবে।
গ্রিক পুরাণে জিউস ছিলেন আকাশ ও বজ্রের দেবতা। তাঁর প্রতীক হল বজ্র, ঈগল, ষাঁড় ও ওক। দেবরাজ জিউসের বজ্রের আঘাতে নিহত হয় দেবতা অ্যাপোলোর ছেলে এসক্লেপিয়াস। দেবতা অ্যাপলো ক্ষেপে গিয়ে জিউসের বজ্র নির্মাণ করত যে দৈত্য তাকে মেরে ফেলল। এই অপরাধে অ্যাপোলোকে পৃথিবীতে নির্বাসন দেওয়া হল। শুধু নির্বাসনই নয়, পৃথিবীর এক রাজার দাস হিসাবে থাকতে হবে একবছর। অপরদিকে নরওয়ের পুরাণে বজ্রের দেবতা হচ্ছেন থর, দেবরাজ ওডিনের পুত্র। বীর যোদ্ধা। মেজাজটাও একটু চড়া। ভারতে বা আর্যদের দেবতাদের মধ্যে বজ্রের দেবতা ইন্দ্র। ঋগবেদের ঋষি বলছেন, “হে ইন্দ্র! তুমি শক্তিমান, বীর ও শত্রু নিহন্তা বলে আমরা তোমার স্তব করি” (৬/৩৫/৫)। হে পূজনীয় উগ্র ইন্দ্র! ....... তুমি সমস্ত ভুবনের একমাত্র রাজা, তুমি শত্রুদের প্রহার করো ও সাধু ব্যক্তিদের স্বস্থানে স্থাপিত করো” (৩/৪৬/২)। ইন্দ্রের বজ্র অয়োনির্মিত এবং তাঁর হস্তে সম্বন্ধ, তাঁর হস্তে বহুতর বল আছে। বেদে পাওয়া যায় যে বৃত্র, নমুচি, শম্বর প্রভৃতি অসুররা ইন্দ্রের শত্রু ছিল। ইন্দ্র তাদের বজ্র দ্বারা বধ করলে জল ছুটতে থকে। এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা এই যে এই সব অসুররা বৃষ্টি হবার প্রাকৃতিক বাধা মাত্র। তাই সবই প্রাকৃতিক শক্তির বিকাশ ও গুণ যা বেদে দেবতা বলে পূজিত। দধীচির অস্থি দেবরাজ নিয়ে দিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কাছে। সেই অস্থিনির্মিত অস্ত্রই হল বজ্র। এই বজ্রাস্ত্রে বৃত্রকে বধ করে দেবতারা অসুরদের তাড়িয়ে স্বর্গরাজ্য অধিকার করেন দেবতারা। দধীচির আত্মত্যাগে ত্রিভুবন বিস্মিত হল। কত যুগ-যুগান্ত চলে গেছে, কিন্তু আজও বজ্র আকাশ বাতাসে কড়কড় শব্দে সেই আত্মত্যাগী দধীচির বিরাট ত্যাগের কথা জানিয়ে যায় !

পুনশ্চ : () বজ্রপাত যতই শমন ডেকে আনুক না-কেন বজ্রপাত নিয়ে যে পড়াশোনা করারও ক্ষেত্র আছে, সেই বিদ্যাকে বলে “Fulminology”() আপনি  যদি বজ্রপাতে ভয়ও পান তাহলে আপনার ভয়ের একটা নাম আছেতা হল “Astraphobia”

কোন মন্তব্য নেই: