শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০

চার্চ থেকে মসজিদ, মিউজিয়াম থেকে মসজিদ -- এর নাম হাজিয়া সোফিয়া


হাইয়া সোফিয়া বা আয়া সোফিয়া বা চার্চ অফ হাজিয়া সোফিয়া (Hagia Sophia) স্থাপত্যটি এই মুহূর্তে সংবাদমাধ্যম তোলপাড়, সোস্যাল মিডিয়া সরগরম। কেন সরগরম ? কারণ তুরস্কের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ইস্তাম্বুলের খ্যাতনামা হায়া সোফিয়ায় নামাজ পড়ার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। রিসেপ তায়েপ এরদোগান বলেছেন, আদালতের রায়ের পর নামাজ পড়ার জন্য হায়া সোফিয়াকে খুলে দেয়া হবে। টুইটারে এক পোস্টে এরদোগান জানান, হায়া সোফিয়ার সম্পত্তি দিয়ামাত বা তুর্কি ধর্মীয় বিষয়ক দফতরের হাতে সোপর্দ করা হবে। এরপরই হাইয়া সোফিয়াতে প্রথমবারের মতো আজান দেওয়া হয়। দেড় হাজার বছরের পুরনো হায়া সোফিয়া একসময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো গির্জা, পরে তা পরিণত হয় মসজিদে, তারও পর একে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা কামাল আতাতুর্কর সিদ্ধান্তকে সসম্মানে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তুরস্কের মুসলিম প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ভাবলেন, তা কেন, ওই স্থাপত্যটি সম্পূর্ণভাবে মুসলিমদের সম্পদ, সকলের সম্পদ হতে পারে না। অতএব ওটা কেবল মসজিদই হবে, আজান হবে, নামাজ পড়বে – অন্য কিছু হবে না। নিশ্চয় স্থাপত্যের অভ্যন্তরের জিশু ও খ্রিস্টীয় চিহ্নগুলি মুছে ফেলে কেবলই আল্লাহ ও মোহম্মদ সম্পূর্ণভাবে ছড়িয়ে পড়বে। কী হবে, সেটা সময় বলবে। আপাতত হাজিয়া সোফিয়ার জন্মবৃত্তান্তটা জেনে নিই।

তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরটি দাঁড়িয়ে আছে এশিয়া ও ইউরোপ দুই মহাদেশে ভাগ হয়ে। মহাদেশ দুটিকে যোগ করা বসফরাস প্রণালী শহরটিকে দু-ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। এই শহরেরই ইউরোপীয় অংশে রয়েছে দৈত্যাকৃতির এক স্থাপত্যবিস্ময়। বাইজেন্টাইন শাসনামলে বানানো এই স্থাপত্যকর্মটির নাম হাজিয়া সোফিয়া। এই স্থাপত্যটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে এসেছে আমেরিকান ঔপন্যাসিক ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’ গ্রন্থে।

 
হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণ করা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১,৫০০ বছর আগে একটি বাইজেন্টাইন খ্রিস্টান ব্যাসিলিকা হিসাবে। কিন্তু বর্তমানে অনেকটা প্যারিসের আইফেল টাওয়ার বা এথেন্সের পার্থেননের মতো এটিও একটি অসাম্প্রদায়িক স্থাপত্যশৈলী হিসেবে পরিগণিত হয়। অবশ্য শুধু স্থাপত্যকৌশলের কারণেই যে এটি বিখ্যাত তা নয়, এ ঐতিহাসিক স্থাপত্যটির আছে নানারকম রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং শৈল্পিক আবেদন।

শনিবার, ১৩ জুন, ২০২০

সিরাজের পতনের প্রকৃত কারণ


বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লাএর আগে বেশ কিছু নবাব এসেছেন আর গিয়েছেন। স্বল্প মেয়াদের নবাবির নবাবেরা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সেইসব অনুল্লিখিত নবাবদের বিরুদ্ধেও হিন্দু-বিদ্বেষ, হিন্দু-নিধন, হিন্দুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ করার মতো কোনো অভিযোগের দলিল পাওয়া যায়নি। তাঁদের তেমন কোনো বিশেষত্ব না-থাকার কারণেই হয়তো ইতিহাস মনে রাখেনি।


বাংলার সিরাজপর্ব কিন্তু ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। সিরাজ-পতনের মধ্য দিয়েই ভারত-শাসনের খাতা খোলে ব্রিটিশরা। যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ইংরেজগণ শতাধিক বছরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধ্যসাধনায় ব্যবসায়ী থেকে শাসকে পরিণত হয়েছিল, ৮০০ বছর ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের মূলোৎপাটন করে এ দেশবাসীকে গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে (১৫৯৯) কতিপয় ব্যবসায়ী সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম হয় রানি এলিজাবেথের অনুমোদনক্রমে তাঁরা ভারত সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যাবসা শুরু করে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে সনদ লাভ করে এই কোম্পানি সর্বপ্রথম সুরাট বন্দরে তাঁদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে প্রথম প্রথম তাঁদেরকে খুব ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে চলতে হয় বলে ব্যাবসাবাণিজ্যে বেশি সুবিধা করতে পারে না ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে তাঁর কন্যা আগুনে দগ্ধিভূত হয় তাঁর চিকিৎসার জন্যে সুরাটের ইংরেজ-কুঠির অধ্যক্ষ কর্তৃক প্রেরিত সুদক্ষ সার্জন ডাঃ গ্যাব্রিল বাউটন তাঁকে নিরাময় করেন তাঁর প্রতি বাদশাহ শাহজাহান অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং বাউটনের অনুরোধে ইংরেজ বণিকগণ বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা যখন বাদশাহর ফরমানসহ বাংলায় উপস্থিত হয়, তখন বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবাদার ছিলেন শাহজাহানের পুত্র যুবরাজ মোহাম্মদ শাহসুজা

বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

দুর্গা দুর্গতিনাশিনী নয়


দুর্গা শব্দের ব্যুৎপত্তি হল দুর্ (দুঃখ) গম্ (গমন করা, জানা) + অ (র্ম্ম) = দুর্গ + আ (স্ত্রীং)। অর্থাৎ যাঁকে দুঃখে জানা যায়। কিংবা যিনি দুর্গ অর্থাৎ সংকট থেকে মুক্তি দেন। শব্দকল্পদ্রুমে আছে, যিনি দুর্গ বা দুর্গম নামে অসুরকে হত্যা করেছিলেন, তিনিই দুর্গা – “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা”। হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে – “দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিত। উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।। রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ। ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।” অর্থাৎ ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। পুরোটা সাজিয়ে নিলে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হল – দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে, যে দেবী “নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ”(সমস্ত দেবতা সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা। শব্দের ব্যুৎপত্তি যাই-ই হোক না-কেন, দেবী দুর্গা কখনো কোনোদিনই মানুষের সংকট মোচন সক্ষম হননি। তিনি সংকটমোচনকারী কেবল পুরাণের কাহিনিগুলিতেই। বাস্তবে তাঁর কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই।

যাই হোক, হিন্দুরা তাঁকে মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করে। দুর্গার অন্য নামগুলি হল – চণ্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুরসংহারিণী বা মহিষাসুরমর্দিনী, নারায়নী, মহামায়া, কাত্যায়নী ইত্যাদি। প্রত্যেক রূপেই আছে পৃথক পৃথক অসুর হত্যার কাহিনি। এঁদের কারোর আঠারোটা হাত, কারোর ষোলোটা হাত, কারোর দশটা হাত, কারোর আটটা হাত, কারোর-বা চারটি হাত। তবে দশ হাতের দুর্গা বা দশভূজাই বেশি জনপ্রিয়।তাঁর বাহন সিংহ এবং মহিষ নামক এক অসুরকে হত্যারত অবস্থায় দেখা যায়। বাংলার দুর্গাপুজোই অন্যত্র নবরাত্রি উৎসব হিসাবে উদযাপিত হয়।

শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৬

ভারতবর্ষে ইসলাম : প্রবেশ এবং প্রস্থান (প্রথম পর্ব)



[মুখবন্ধ : এই প্রবন্ধটির বিষয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অতএব লেখা চলাকালীন  যথাযথ যুক্তি ছাড়া কারোকে আলটপকা মন্তব্য না-করার অনুরোধ রাখছি। লেখা প্রথম থেকে না-পড়ে মাঝখান থেকে কেউ মন্তব্য করবেন না। যদি কারোর মনে হয় তিনি আমার জানার বাইরে আরও বেশি কিছু জানেন, তাহলে লিখিতভাবে বক্তব্য রেখে আপনি যা জানেন সেটা সবাইকে জানান। সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন কোনোরকম কটুক্তি ডিলিট করে দেওয়া হবে, বারবার একই আচরণ করলে সোজা ‘নোটিশ’। বিতর্ক অনাবশ্যক, আলোচনা চলতেই পারে।এটি একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ, গবেষণা করতে গিয়ে যেসব গ্রন্থাদির সহায়তা নেব, সেগুলি শেষ পর্বে উল্লেখ করা হবে। যেহেতু প্রবন্ধটি ইতিহাস নয়, ইতিহাসের ইতিহাস – সে কারণে আমার জানার সঙ্গে আপনার জানা সবসময় নাও মিলতে পারে।প্রতিটি ধর্মব্যবস্থায় যেমন ভালোর দিক আছে, তেমনি মন্দের দিকও আছে -- আমার লেখায় দুটি দিকই আলোচিত হবে, কোনোরকম ফিল্টার ছাড়াই।]

“কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে/কত মানুষের ধারা/দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে/ সমুদ্রে হল হারা।/হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/হেথায় দ্রাবিড়, চীন--/শক-হুন-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন।/পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,/সেথা হতে সবে আনে উপহার,/দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে,/এই ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে।/……………..এসো হে আর্য, এসো অনার্য,/হিন্দু মুসলমান।/এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,/ এসো এসো খৃস্টান।/এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন/ধরো হাত সবাকার,/এসো হে পতিত করো অপনীত/সব অপমানভার।/মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা/মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,/সবারে-পরশে-পবিত্র-করা/তীর্থনীরে।/ আজি ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে।”

ভারতে ইসলাম তথা মুসলমানদের ইতিহাস নিয়ে লিখতে বসে মহামানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি উল্লেখ না-করে শুরু করতে পারছিলাম না। প্রায় ৭০০ বছরের ইতিহাস তো সোজা কথা নয়। ভারতবর্ষের পরতে পরতে মুসলিমদের সুকীর্তিতে যেমন উজ্জ্বল হয়ে আছে, কুকীর্তিতেও তেমন কালিমালিপ্ত হয়ে আছে।আর্য-অনার্য-হিন্দু-মুসলমান-ইংরাজ-খ্রিস্টান যখন এক দেহে লীন হয়, তখন সেই দেশে একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের ইতিহাস লেখা সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে সেই ধর্মাবলম্বীদের শাসনকাল যদি ৭০০ বছরের হয়। না, ঠিক ইতিহাস নয় হয়তো – ইতিহাসের ইতিহাস।
সেই ইতিহাসের সন্ধান তো করবই, তার আগে জানা প্রয়োজন ইসলাম ধর্মের ইতিহাস। ইসলাম একটি একেশ্বরবাদী এবং আব্রাহামিক ধর্ম । কোরান দ্বারা পরিচালিত --  যা  এমন এক কিতাব যা  হবহু আল্লাহর বাণী এবং ইসলামের প্রধান নবি মোহাম্মদের প্রদত্ত শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনাদর্শও এর ভিত্তি । বলা হয় সুন্নাহ এবং হাদিস নামে লিপিবদ্ধ রয়েছে । ইসলামের অনুসারীরা মোহাম্মদকে শেষ নবি বলে মনে করেন।অনেকের ধারণা যে মোহাম্মদ হলেন এই ধর্মের প্রবর্তক। তবে মুসলিমদের মতে, তিনি এই ধর্মের প্রবর্তক নন। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রসুল বা পয়গম্বর। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে তিনি এই ধর্ম পুনঃপ্রচার করেন। পবিত্র কোরান ইসলাম ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের মুসলমান বা মুসলিম বলা হয়। পবিত্র কোরান আল্লাহর বাণী এবং এটি তার কর্তৃক মোহাম্মদের নিকট প্রেরিত বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন। তাদের বিশ্বাস অনুসারে মোহাম্মদ শেষ নবি। হাদিসে প্রাপ্ত তাঁর নির্দেশিত কাজ ও শিক্ষার ভিত্তিতে কোরানকে ব্যাখ্যা করা হয়। তবে কোনো হাদিসের মর্মার্থ কোরানের বিরুদ্ধে গেলে তা বাতিল বলে গণ্য হয়।

বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান (চতুর্থ/শেষ পর্ব)



গ্রহশান্তির জন্য জ্যোতিষবাবুরা রত্ন-পাথর ছাড়াও গাছের মূল বা শিকড় ও ধাতু বা মেটাল ব্যবহারের নিদান দেন। নাকের বদলে নরুন আর কী ! কী আছে শিকড়-বাকড়ে ? শরীরে শিকড়-বাকড় বাঁধলে দুষ্ট গ্রহরা পালিয়ে যায় ? শিকড়-বাকড়ের দোকানে লোকজন দেখি ভিড় করে থাকে, বিশেষ করে শনি-মঙ্গলবারে। মূল-বিক্রেতারা মূল-ক্রেতাদের একটা কার্যকরী আপ্ত্যবাক্য শুনিয়ে থাকে, তা হল – গাছ কথা বলে। গাছ তো কথা বলেই। কিন্তু জ্যোতিষবাবু, গাছকে কথা বলানোরক্ ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানে গাছদের কথা বলিয়ে গ্রহদের খেদাতে পারবেন না। ওটা চিকিৎসকদের কাজ, চিকিৎসকরাই পারেন। চিকিৎসকরাই পারেন চিকিৎসা পদ্ধতিতে। দেখুন কীভাবে পারে -- জ্যোতিষবাবুদের মতে সূর্য বা রবি গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে বিল্বমূল অর্থাৎ বেলের শিকড় হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন--(১) বেলের শিকড়ের ছাল ৩/৪ গ্রাম মাত্রায় গরম জলে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে ছেঁকে তার সঙ্গে একটু বার্লি বা খইয়ের মণ্ড ও অল্প চিনি মিশিয়ে খাওয়ালে শিশুদের বমি ও অতিসার বন্ধ হয়ে যায়। (২) বেলের মূলের ছালচূর্ণ ৬ থেকে ১২ মাত্রায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হৃদ্দৌর্বল্য দূর হয়। এছাড়া অনিদ্রা ও ঔদাসীন্যভাবও কেটে যায়।(৩) বিল্বমূলের ছাল ১২ থেকে ১৪ গ্রেনের সঙ্গে ৬ গ্রেন জিরে বেটে গাওয়া ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ধাতুতারল্যে বা শুক্রতারল্যে উপকার পাওয়া যায়।জ্যোতিষবাবুরা বলেন রবির প্রকোপে হৃদরোগ, শিরঃপীড়া হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে বিল্বমূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?

জ্যোতিষবাবুদের মতে চন্দ্র বা চাঁদ গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ক্ষীরিকা বা ক্ষীরা বা শশার মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন--(১) সৌন্দর্য পিপাসু নারী-পুরুষেরা শশা ত্বকের যত্নে ব্যবহার করতে পারেন। (২) পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখতে এবং শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে শশার বিকল্প নেই। (৩) জলশূন্যতা দূর করে সারাদিন কাজের ব্যস্ততার কারণে পর্যাপ্ত জল পান করা হয় না অনেকেরই। এই জল ঘাটতি দূর করতে শশার তুলনা হয় না। শশায় ৯০ ভাগ জল থাকায় শরীরের প্রয়োজনীয় জলের অভাব দূর করে শরীর সুস্থ রাখে। (৪) শশা আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বাইরে রোদে ঘুরা-ফেরা করার কারণে সূর্যের তাপে শরীরের চামড়ায় যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা থেকে শশা আমাদেরকে অনেকটাই স্বস্তি দিতে পারে। এজন্য শশা চাক চাক করে কেটে শরীরের রোদে পোড়া অংশে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।(৫) শশার ভিতরের জলীয় অংশ শরীরের অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দিতে সক্ষম। নিয়মিত শশা খেলে কিডনিতে পাথর হওয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়।(৬) সুস্থ থাকার জন্য আমাদের শরীরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন দরকার হয় তার অধিকাংশের অভাব পূরণ করে থাকে শশা। ভিটামিন এ, বি ও সি--যেগুলি শরীরে শক্তি উৎপাদন ও শরীরের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে, তার অধিকাংশই পূরণ করে থাকে শশা।(৭) শশায় রয়েছে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সলিকন। তাই শরীরে এসবের অভাবজনিত সমস্যার মূল সমাধান হলো শশা।(৮) শশায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জল এবং অত্যন্ত কম পরিমাণে ক্যালরি। তাই আমার যারা শরীরের ওজন কমানোর ব্যাপারে সচেতন তাদের জন্য শশা বা ক্ষীরিকার একটি প্রধান উপাদান। আয়ুর্বেদশাস্ত্র তন্নতন্ন করে তালাশ করেও শিকড় বা মূলের সন্ধান পেলাম না।জ্যোতিষবাবুরা বলেন চন্দ্রের প্রকোপে অতি আবেগপ্রবণতা, মানসিক অসুস্থতা, বাত, শ্লেষ্মা হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে ক্ষীরিকা মূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?

মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১৬

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান (তৃতীয় পর্ব)



আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ আত্মনিবেদন করতে শেখে। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গর্ব অনুভব করে, দুঃখ-যন্ত্রণা-বঞ্চনাকে ভুলে থাকতে শেখে। এরা লড়াই জানে না, লড়াই দেখলে ভীত হয়।এমতাবস্থায় অদৃষ্ট বা নিয়তির শরণাপন্ন হয়।জেগে ওঠে জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষীবাবুরা। হাত বড়িয়ে দেয় – একপক্ষে জ্যোতিষীবাবুর হাত, অপরপক্ষে জাতকের হাত।কী আছে হাতে ? রেখা ? রেখায় কী আছে ? আছে স্বল্প রেখাযুক্ত পরিষ্কার হাত এবং বহু সূক্ষ্ম রেখাযুক্ত হাত।লালচে হাত, গোলাপি হাত, সাদাটে হাত, হলদেটে হাত। আছে চওড়া তালু, বেঁটে ও মোটা আঙুল, কুশ্রী নখ।আছে চৌকো হাত, চৌকো হাতে লম্বা আঙুল, দার্শনিক হাত, শিল্পী হাত, আধ্যাত্মিক হাত। আছে নমনীয় বুড়ো আঙুল, অনমনীয় বুড়ো আঙুল।খুব লম্বা নখ, খুব লম্বা ও সরু নখ, খুব লম্বা নীলচে অথবা মলিন বর্ণের চোখ, ছোটো নীলচে নখ, ছোটো গোলাকার নখ, ছোটো অথচ নখের তলার দিকটা চ্যাপটা, ছোটো অথটচ নখের তলার দিকে সাদা চাঁদ, শরীরের ভিতর গভীরভাবে চেপে বসা চ্যাপটা নখ, নখে সাদা দাগ ইত্যাদি।
এমন কোনো মানুষ নেই যাঁর হাতে ভাঁজ বা কোঁচকানো দাগ বা রেখা নেই। কারোর ঘন দাগ, কারোর-বা অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা।এইসব দাগগুলি আবার বিভিন্ন নামে পরিচয় আছে। যেমন—আয়ুরেখা, হৃদয়রেখা, ভাগ্যরেখা, রবিরেখা, বিবাহরেখা ইত্যাদি।এছাড়া হাতের উঁচুনীচু অংশগুলিতে আছে গ্রহস্থল – মানে কোথায় রবি অবস্থান করছে, কোথায় মঙ্গল অবস্থান করছে, কোথায় রাহু অবস্থান করছে ইত্যাদি।হাতের রং দেখেও জ্যোতিষবাবুরা ভাগ্যগণনা করে থাকেন। আছে তারা চিহ্ন, ক্রশ চিহ্ন, চতুষ্কোণ, যব বা দ্বীপ চিহ্ন, বৃত্ত বা চক্র চিহ্ন, ত্রিশূল, জাল চিহ্ন ইত্যাদি – এইসব চিহ্নগুলিও অনেক ভবিষ্যৎবার্তা দেয় বলে জ্যোতিষবাবুরা নিদান দেন।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান (দ্বিতীয় পর্ব)



জ্যোতিষীবাবুদের গ্রহ, নক্ষত্র, রাশি, লগ্নের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
(১) ১৮ ডিগ্রির এক টুকরো আকাশে যদি ১২ টি রাশি থাকে, তাহলে ৩৬০ ডিগ্রি আকাশে ডিগ্রির আকাশে কত লক্ষ রাশি থাকতে পারে ভাবুন। তবে তো খুব ভয়ানক ব্যাপার, এত লক্ষ লক্ষ রাশির প্রভাব হিসাবে উচিত নয় ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(২) জন্মকালে চন্দ্র যে রাশিতে থাকে সেটিই জাতকের রাশি বলা হয়। শুধু চন্দ্র কেন, সৌরজগতে তো আরও অসংখ্য গ্রহ আছে উপগ্রহ আছে – সেগুলি বিচার্য নয় কেন ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৩) জাতকের জন্মসময় কোনটি ? এটা বড্ড গোলমেলে ব্যাপার ! কেউ মনে মনে করেন মাতৃজঠরে ভ্রূণের প্রথম দিন, কেউ মনে করেন মাতৃজঠরে থাকাকালীন যেদিন শরীরে প্রাণসঞ্চার হয়, কেউ মনে করেন যেদিন শিশু মাতৃগর্ভ ত্যাগ বেরিয়ে আসে, আবার কেউ মনে করেন শিশুর নাড়ি কাটার সময়, কেউ আবার এত ঝামেলায় না-গিয়ে চিকিৎসকের দেওয়া সার্টিফিকেটের জন্মসময় গ্রাহ্য করে – এক্ষেত্রে আবার সংশয়, চিকিৎসক বা চিকিৎসা-কর্মীরা যে সময় নথিভুক্ত করেছেন সেটা কতটা অথেনটিক ! যাই হোক, জ্যোতিষীবাবুরা কোন জন্মসময় বিচার করে জাতকের কোষ্ঠী বিশ্লেষণ করবেন ? ভিন্ন ভিন্ন সময়কে জন্মসময় ধরলে ভিন্ন কোষ্ঠী বিচার হবে না ? হবেই তো। রাশির অবস্থান পালটালে নির্ণয়ও পালটাতে বাধ্য।এক্ষেত্রে অবশ্য জ্যোতিষীবাবুরা বলেন, লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকাল ব্যতীত লগ্ন-মধ্যবর্তী সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের সন্নিবেশের এমন কিছু তারতম্য হয় না, ফলে রাশি পালটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ও মা, সে কি কথা ! যদি জমজ সন্তান হয় ? তাদের কোষ্ঠীবিচার তো একই হবে। মানে তারা একই সময়ে পটি করতে যাবে, একই শিক্ষকের কাছে পড়বে, একইরকম বিদ্বান হবেন, একই ক্লাসে পড়া শেষ করবে, একই জায়গায় একই চাকরি করবে, একই মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করবে, একই দিনে একই সময়ে একই কারণে মরবে – তাই-ই হবে, জ্যোতিষ বিজ্ঞান হলে।হয় কী ? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মানোর পরপরই একটি সন্তান মারা যায়। তাহলে একই লগ্ন, একই গ্রহস্থান, একই রাশিচক্র হওয়া সত্ত্বেও দুইজন জাতকের আয়ুষ্কাল দুই রকমের হবে কেন ? তাহলে কী পৃথিবীর সকল জমজ জাতকই লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকালে জন্ম নেয় ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? অবশ্যই নিরুত্তর থাকেন।
(৪) পুব আকাশে রাশি উদয় হয়—এই বিষয়টি এক্কেবারেই আপেক্ষিক। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সূর্যোদয়কাল বিভিন্ন হওয়ার ফলে পুবদিকে উদিত রাশিটি ভিন্ন হবে। ফলে একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো জাতকের লগ্ন বিভিন্ন রকমই হবে, কোষ্ঠীও হবে বিভিন্ন।অতএব একই সময়ে জন্মানো সত্ত্বেও আলাদা আলাদা জাতকের আলাদা লগ্নফল এবং কোষ্ঠীচক্র হবে না, তাই তো ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৫) জ্যোতিষীদের যে শাস্ত্র, তা ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে মেনে চলে। অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য সহ সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্ররা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তত্ত্ব তো অচল তত্ত্ব, আস্তাকুড়ে তার ঠিকানা। এই ধরনের তত্ত্ব কে. সি. পালের মতো বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে পারেন, যারা ভাঙা রেকর্ডের মতো এখনও চলেছেন ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’।এই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলতে অসুবিধা আছে। ভুল হবে রাশি-গ্রহের অবস্থান। সঠিক হবে না রাশিচক্র, কোষ্ঠী-ঠিকুজি।এ তত্ত্ব সঠিক হলে গ্রহ-উপগ্রহগুলিতে মহাকাশযান কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো সম্ভব হত না।ওই তত্ত্ব ভুল, তাই জ্যোতিষ ভুল।জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৬) কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীবাবুরা যোটক বিচার করে। অর্থাৎ পাত্রপাত্রীদের রাজযোটক হলে দাম্পত্যজীবন বড়োই সুখময় হয় !!! যোটক বিচার কাকে বলে ? এককথায় – “বিবাহের পূর্বে পাত্র এবং পাত্রীর পরস্পরের জন্মরাশ্যাদি থেকে যে শুভাশুভ বিচার করা হয়, তাকে রাজযোটক বলে”।এই বিচার আট প্রকার, অর্থাৎ আট প্রকারের কূট। ‘কূট’ কথাটির অর্থ জটিল। জ্যোতিষীবাবুরা প্রবল কূট বলে দু-হাতেই আট প্রকারের ‘কূট’ সামাল দিতে পারেন। এই কূটগুলি হল – বর্ণকূট, বশ্যকূট, তারাকূট, যোনিকূট, গ্রহমৈত্রীকূট, গণমৈত্রীকূট, রাশিকূট এবং ত্রিনাড়িকূট। এদের আবার ‘গুণ’ আছে। ‘বর্ণকূট’ থেকে ‘ত্রিনাড়িকূট’ পর্যন্ত গুণ হবে ১,২,৩ ইত্যাদি। মোট নম্বর ৩৬-এর মধ্যে ১৮ নম্বর পেতেই হবে, আর তা না-হলে ডাহা ফেল।যদি ৩০-এর উপর নম্বর হয় তাহলে লেটার মার্কস হবে। একটু ‘যোনিকূট’ নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক – যোনি চোদ্দ প্রকার। দুটি করে নক্ষত্র নিয়ে এক-একটি যোনি। অভিজিৎ নক্ষত্রকে ধরে নক্ষত্রের সংখ্যা ২৮।অবশ্য সবকটি যোনিই ইতর-যোনি, অর্থাৎ ঘোড়াযোনি, মোষযোনি, বাঘযোনি, সিংহযোনি, হাতিযোনি, কুকুরযোনি, বেড়ালযোনি, ইঁদুরযোনি, বানরযোনি ইত্যাদি। না, মানুষের জন্য মনুষ্যযোনি নেই। তামাম মনুষ্যকুল ইতর-যোনির অংশ।ছাগল, কুমির, হাঙ্গর, গোরিলা, গোসাপ, শিম্পাঞ্জি, টিকটিকিদের কি যোনি নেই !
আমার বিয়ের সময় আমার শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিস পাত্রের কোষ্ঠী দেখাতে হবে। বড়োই বিপদে পড়ে গেল আমার অভিভাবক। কারণ আমার কোনো কোষ্ঠী-ঠিকুজি ছিল না। অতএব জ্যোতিষে শরণাপন্ন। জ্যোতিষীকে বলে আমার একটা ‘রাজযোটক’-এ মিল হয়েছে এমন একটা কিছু করিয়ে আনা হল। কেল্লা ফতে, বিয়ে পাক্কা।আদতে আমার রাশি, লগ্ন, কোষ্ঠী কিছুই নেই – তার আবার রাজযোটক ! আমার ১২ বছরের সংসার দিব্য চলছে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়ো মেয়ের বিয়ে ছিল রাজযোটক। ভাটপাড়ার জনৈক জ্যোতিষী মেয়ে আর হবু জামাইয়ের কোষ্ঠীবিচার করে সেটাই বলেছিলেন। রাজযোটকের বিয়ে, তা সত্ত্বেও বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের বড়ো মেয়ে বিধবা হয়ে যান। এরকম হাজার হাজার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা যায়, যেখানে রাজযোটক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে অকালে নষ্ট হয়ে গেছে। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন। (৭) একদা, মানে দেড়শো বছর আগে পর্যন্ত জ্যোতিষীবাবুরা বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকলে বাল্যবিবাহের নিদান দিতেন। তাই ওই সময় প্রায় সকল মেয়েদেরই বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকার ফলে বাল্যবিবাহ হত। ১৯৯৯ সালে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন,১৯৯৯’ চালু হওয়ার পর থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে গেল। বলবান সপ্তমপতি গেল কোথায় ? কেন্দ্রের কোণে আর থাকেন না ? গেছে।ভুল।জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকবেন।

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সব চরিত্রই কাল্পনিক !!!

ধর্ম কর্কটরোগের চাইতেও মারাত্মক। হাইড্রোজেন বোমার চাইতে ভয়ংকর। আদিযুগ থেকে শোষকশ্রেণির শ্রেষ্ঠতম এবং উৎকৃষ্ট হাতিয়ার -- ধর্ম। শাসকের প্রয়োজনেই ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের সৃষ্টি করা হয়েছে নিরাকার ঈশ্বরের নামে। প্রাচীনযুগে ধর্মগ্রন্থগুলিই ছিল সংবিধান, অনুশাসন-যন্ত্র, আইন-কিতাব। মানবসমাজের প্রগতির দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের এক ভয়ংকর দিক হল ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। ফলে শোষিত মানুষগুলি আর একজোট হতে পারল না শোষণের বিরুদ্ধে।এই ভাগ-বিভাজনের ফায়দা লুটে ভোগ করেন দুর্বৃত্ত রাজনীতিকরা। এইসব শঠ রাজনীতিকরা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থেই ধর্মান্ধতার অবসান চায় না। যে-কোনো ধর্মের যে-কোনো জাতপাতের দরিদ্র শ্রমিক-কৃষকদের একটিই পরিচয় – সে দরিদ্র। দরিদ্র মানুষদের বিরুদ্ধে দরিদ্রদের লড়িয়ে দেওয়াই হল এখনকার শোষকশ্রেণির হাতিয়ার, গবেষণার বিষয়। এরা উলটে ধর্মনিরপেক্ষতার ভান করে। কে ধর্মনিরপেক্ষ? কোন্ রাজনৈতিক দল ধর্মনিরপেক্ষ ? ভারতবর্ষে একটিও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল নেই। এরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ জাহির করে অন্যকে সাম্প্রদায়িক সাব্যস্ত করে। মানুষ জেনেছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানে ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’। তাই কি ? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি দেশের মন্ত্রীসান্ত্রীদের মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেড়ানো ? মসজিদে গিয়ে মুসলমানি কায়দায় হিজাব বা রুমাল জড়িয়ে দোয়া করা ? গির্জায় ঢুকে শ্রদ্ধা জানানো ? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি পুজোয় ফিতে কাটা? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি রোজার শেষে ইফতার পার্টিতে উপস্থিত থেকে দোয়া করা ? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বড়োদিনে বেলাল্লপনা করা নয়।ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলার রাষ্ট্রে ধর্ম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হতে পারে, মাইক লাগিয়ে ক্যাওয়াজ করা নয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে তোমার ধর্মকথা শুনব কেন ? আমি বাধ্য নই, বাধ্য করতে পারো না কোনো অজুহাতেই। তাই রাষ্ট্রীয় জীবনে বা রাষ্ট্রীয় নীতিতে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস প্রকাশ্যে আচরণ করাটা স্বাস্থ্যকর নয় মোটেই। এ ব্যাপারে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অতি সতর্ক থাকা উচিত ছিল।ভারতবর্ষের সংবিধানে এটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, সেটা আর রক্ষা করা গেল কোথায় ! ভারতের মন্ত্রী-নেতারাই প্রকাশ্যে বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মাচার পালন করে থাকে। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কোনো পক্ষে নয়। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ মানে কোনো ধর্মের পক্ষে নয়। সোজা কথায় – সমস্ত ধর্মের সম্পর্ক বর্জন। ‘Secularism’ মানে ধর্মনিরপেক্ষতা কি না তাই নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, তবে অভিধানিক অর্থ হল -- এমন একটি যা মনে করে রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা প্রভৃতি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকা।কেউ কোনো ধর্মীয় মতবাদ প্রকাশ্যে প্রচার করবে না, অন্য ধর্মকে গালিগালাজ করবে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে আস্তিকদের যতটুকু স্পেস থাকবে, নাস্তিকদের জন্যও ততটুকুই স্পেস থাকবে।ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হিন্দুরা যেমন রাস্তা বন্ধ করে দুর্গাপুজো-কালীপুজো করতে পারে না, ঠিক মুসলমানরা রাস্তা বন্ধ করে ইদের নামাজ পড়তে পারে না, অনুরূপ বড়োদিনের উৎসবের নামে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রাতভর হুল্লোড় করা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হিন্দুরা মুসলিমদের ‘মোল্লা’ বা ‘কাটা’ বলে গালি দিতে পারে না, তেমনই মুসলমানরাও হিন্দুদের ‘মালাউন’ বা ‘মালু’ বলে গালি দিতে পারে না।অন্যথায় এদের সকলকেই, অর্থাৎ এই সংবিধান অবমাননাকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ সাব্যস্ত করা উচিত। ব্রিটিশমুক্তির ৭০ বছর পরও আমরা কেউই ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারলাম না – আমরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ শিখ। আর এখানেই আক্ষেপ। সোসাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া – সর্বত্র চলছে উসকানিমূলক কথাবার্তা, প্ররোচণামূলক বিবৃতি। এরা কি ‘দেশপ্রেমী’ ?

সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান (প্রথম পর্ব)



প্ল্যাটফর্মে ধাতুর আংটি বিক্রেতা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে আংটিটি আঙুলে ঢোকানোর। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ হবেন নাই-বা কেন ! আঙুলগুলিতে তো আর আংটি ঢোকানোর জায়গাই নেই।দশ আঙুলে কুড়িটা রত্নখোচিত আংটির উপর ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি কোথায় ঢুকবে ? পোখরাজ, গোমেদ, পান্না, চুনি, প্রবাল -- কী নেই সেই দশ আঙুলে ! ডাবল ডাবলও আছে। ‘রহিস আদমি’ পেয়ে জ্যোতিষীরা ওর দশ আঙুলে বিশটা আংটি ভজিয়ে দিয়েছে। ওই বিশটা আংটিতেও যে কাজ হয়নি, তা ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি পরার ব্যাকুলতাতেই আন্দাজ করা যায়।

আর-একটা ঘটনা বলি : বছর কুড়ি আগে আকাশবাণীর ‘বিজ্ঞানরসিকের দরবারে’ শিরোনামে অনুষ্ঠান হত।কোনো একদিনের অনুষ্ঠানে কলকাতার স্বনামখ্যাত পাঁচজন জ্যোতিষীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট কোষ্ঠী বিচারের জন্য।পাঁচ জ্যোতিষীই জানতেন এই কাজটি করতে শুধুমাত্র তাঁকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যদিও ট্যবলেট বিক্রেতা এক স্বনামধন্য লাল-জ্যোতিষী ছাড়া বাকি চারজন জ্যোতিষী আকাশবাণীতে গিয়েছিলেন নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রমাণ করতে। চারজন জ্যোতিষীকে চারটি ভিন্ন ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছিল একই ব্যক্তির কোষ্ঠী দিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে চারজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে একই ব্যক্তির চারটি কোষ্ঠী জমা নেওয়ার পর দেখা গেল  চার ধরনের বিচার। কারোর সঙ্গে কারোর মিল নেই।এখানেই শেষ নয় বিস্ময়ের। সেই কোষ্ঠীর জাতক ছিলেন একজন মৃত শিশুর। সেই মৃত শিশুর কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীরা বলেছিলেন যে জাতকের বিয়ে হবে, চাকরি হবে, ফাঁড়া ইত্যাদি ইত্যাদি হাস্যকর কথাবার্তা।
এরকম ঘটনার ঝুড়ি ঝুড়ি উল্লেখ করা যায়। তাতে লাভ কিছু নেই। মানুষ যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে, জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষী যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি জ্যোতিষ আসলে কী ? জ্যোতিষ কি শাস্ত্র ? নাকি বিজ্ঞান ? প্রচুর বিতর্ক, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এ বিষয়ে। তবুও আমি আমার মতো চেষ্টা করি। বোঝার এবং বোঝাবার।

মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৬

বরফ

এ আঠা এমনই, বাতাসে এলে শুকিয়ে কংক্রিট। এতটাই যে সেবার ছেলের ভাঙা খেলনা জুড়তে গিয়ে বে-খেয়ালে তর্জনী-মধ্যমা জুড়ে গিয়েছিল ভয়ানকভাবে। বছর পাঁচেক আগে। বুক ঠেলে লম্বা নিশ্বাস বেরিয়ে এল সমিধের।
পাঁচ বছর আগে, আজকের দিনেই স্বর্ণালীর সঙ্গে সমিধের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়। আদালতের সেই রায় এখনো যেন কানের ভিতর গরম সিসা ঢেলে দেয় কেউ।
বিয়ের এক বছর যেতে না-যেতেই সমিধ বুঝতে পারল স্বর্ণালী কেমন যেন যৌনতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। শরীরের জন্য কাছে গেলে স্বর্ণালী খুবই বিরক্ত হয়। নামি দামি ডাক্তার দেখিয়েও কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। সন্তান গর্ভে আসার পরপরই এই অনীহা। ভেবেছিলাম সন্তান জন্মানোর পরই সব ঠিক হয়ে যাবে। চিকিৎসকরা বলে দিলেন, এটা ফ্রিজিটি। পারমানেন্ট ফ্রিজিটি। বারো বছর অপেক্ষার পর অবশেষে বিচ্ছেদের মামলা উঠল আদালতে।

শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

অস্পৃশ্যনামা : না-মানুষের পদাবলি(তৃতীয়/শেষ পর্ব)


জাতপাত ব্যবস্থা বর্ণগত মই বাহিত হয়ে নিচে নেমে যায় এবং কখনোই পুরোপুরি অদৃশ্য না-হওয়ায় আম্বেদকরের বর্ণিত অনুকরণের সংক্রমণপ্রতিটি বর্ণেরই ক্রমপরম্পরায় নিম্নতর বর্ণের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা হয়।তেজস্ক্রিয় অণুর অর্ধেক জীবনের মতো অনুকরণের সংক্রমণগাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নষ্ট করে দেয়। এর ফলে এমন এক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে যেটাকে আম্বেদকর বলেছেন ক্রমবিন্যস্থ বৈষম্যএতে আরও নিচুর তুলনায় নিচু বর্ণও বিশেষ অধিকার ভোগের অবস্থানে থাকে। প্রতিটি বর্ণই বিশেষ অধিকার ভোগ করে, প্রতিটি শ্রেণিই ব্যবস্থাটি বজায় রাখার ব্যাপারে আগ্রহী।আমাদের সমাজে পচনের মূলেই আছে এই জাতপাত প্রথা। অধস্তন জাতের প্রতি যা কিছু করা হয়েছে, তা তো আছেই, সেইসঙ্গে এটা বিশেষ অধিকারভোগকারী বর্ণের নৈতিকতার মূলে পচন ধরিয়েছে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর মতে, প্রতি ১৬ মিনিটে একজন দলিতের সঙ্গে আর-একজন অদলিত অপরাধ করে, প্রতিদিন ৪ জনেরও বেশি অস্পৃশ্য নারী স্পৃশ্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। প্রতি সপ্তাহে ১১ জন দলিত খুন হয় এবং ৬ জন দলিত অপহৃত হয়। শুধুমাত্র ২০১২ সালেই ২৩ বছর বয়েসের ১ জন নারী দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার হয়, ১৫৭৪ জন দলিত নারী ধর্ষিত হয় (বৃদ্ধাঙ্গুলির শাসানির জোরে দলিতদের সঙ্গে ঘটা ধর্ষণ বা অন্যান্য অপরাধের মাত্র ১০ ভাগ প্রকাশিত হয়) এবং ৬৫১ জন দলিতকে হত্যা করা হয়। এগুলি ছিল ধর্ষণ ও বর্বরতা, যা লুণ্ঠন আর নগ্ন হতে বাধ্য করাই নয়, জোরপূর্বক মানুষের মল খাওয়ানো, জমি দখল,সমাজচ্যুত করা, খাওয়ার জল আনতে বাঁধা দেওয়া। এ পরিসংখ্যানে পাঞ্জাবের বান্ত সিংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি, যিনি ছিলেন একজন মাজহাবি দলিত শিখ। ২০০৫ সালে যার দুই হাত এবং একটি পা কেটে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ সে তার মেয়েকে গণধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। তিনটি অঙ্গ ছেদ হওয়া ব্যক্তির জন্য আলাদা কোনো পরিসংখ্যান নেই।কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে --

ঘটনা ১ : ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর। মধ্যপ্রদেশ। তার খেতে ঢুকে ফসল খেয়ে নিচ্ছিল গরুর দল। গোরুর মালিককে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে গিয়ে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হল এক দলিত নারীকে। তাকে নগ্ন করে মারধরের পর প্রস্রাব খেতেও বাধ্য করা হয়। ছত্তরপুর জেলায় এই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় স্থানীয় থানার নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসেছিল। ওই মহিলাকে নিয়ে দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজন জেলার সহকারী পুলিশ সুপার নিরজ পান্ডের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় নওগং থানা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।নিগৃহীতার অভিযোগ, বিজয় যাদবের বাড়িতে গিয়ে তার খেতে গওরু ঢোকার বিষয়টি জানান। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বিজয় ও তার স্ত্রী বিমলা তাকে মারধর করেন। এমনকি জামাকাপড় খুলে তাকে প্রস্রাব খেতেও বাধ্য করা হয়।

মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫

অস্পৃশ্যনামা : না-মানুষের পদাবলি(দ্বিতীয় পর্ব)


কেউ কেউ বলেন জাতপাতের এই বিড়ম্বনা নাকি হিন্দুধর্মের নয়। হিন্দুধর্মে নাকি জাত-বিভাজনের বালাই নেই এসব নাকি ব্রাহ্মণ্যধর্মের হিন্দুদের ঘাড়ের চাপিয়ে দেওয়া নিষ্পেষণ-চাক্কি। তাহলে কি ব্রাহ্মণ্যধর্ম আর হিন্দুধর্ম সমার্থক নয় ! এ ভাবনার যুক্তি কী ? তাঁরা বলছেন – (১) তাঁদের প্রত্যেকের ধর্মপালনের নীতি-নিয়ম একই হবে।(২) তারা একই পদ্ধতিতে ধর্মাচরণ বা উপাসনা করবে।(৩) তাদের মধ্যে অবাধ বিবাহ সম্পর্ক চালু থাকবে।(৪) ধর্মের দৃষ্টিতে তারা সবাই অভিন্ন বলে বিবেচিত হবে।(৫) তাদের মধ্যে কোন উঁচু-নীচু ভেদ থাকবে না।(৬) তারা সবাই সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে।(৭) একই ধর্মের অনুগামী বলে তারা পরস্পরের প্রতি একাত্মবোধ করবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর ক্ষেত্রে এক নয়, আলাদা। এ পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে বোঝা যায় ব্রাহ্মণ ও হিন্দু এক ধর্মভুক্ত নয়, তাদের ধর্ম আলাদা।তা ছাড়া দুটি আলাদা ধর্মের মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যে বৈসাদৃশ্যগুলি থাকে ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যেও তা লক্ষ করা যায়।বৈসাদৃশ্যগুলি মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে, যেমন -- (১) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক হয় না।যদিও কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়,তবে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই।(২) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব দেখা যায় না,বরং ঘৃণার সম্পর্ক দেখা যায়।(৩) একজন ব্রাহ্মণ ধর্মাচরণের হ্মেত্রে যে অধিকার পায়,একজন হিন্দু তা পায় না।(৪) ব্রাহ্মণ ও হিন্দু পরস্পরের সাথে একাত্ম মনে করে না।(৫) ব্রাহ্মণ হিন্দুকে তার সাথে সমমর্যাদার ভাবে না,তার থেকে নীচু ভাবে। (৬) ব্রাহ্মণদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য শূদ্রদের সম্পদ হাতানো।হিন্দুদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।(৭) ব্রাহ্মণ্যধর্মে অব্রাহ্মণ আছে এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই অব্রাহ্মণরা হল পথভ্রান্ত, নিজের অজান্তে বিপথে চালিত ধর্মচ্যূত হিন্দু, ব্রাহ্মণরা যাদের উপর অপমানজনক, ঘৃণ্য শূদ্রনামের ছাপ্পা মেরে দিয়েছে।কিন্তু হিন্দুধর্মে কোনো অহিন্দু নেই। (৮) ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুযায়ী ব্রাক্ষ্মণ সবার শ্রেষ্ঠ, সবার প্রভু।আর ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুগামী অব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট, এমনকি কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণদের নিকট ঘৃণার বস্তু,অস্পৃশ্য। কিন্তু হিন্দু ধর্মে কোন উচ্চনীচ ভেদাভেদ নেই,সবাই সমান।(৯) বর্ণভেদ, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথা, গুরুপ্রসাদী প্রথা ইত্যাদি অমানবিক, অশালীন প্রথাগুলি ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই অবদান।কিন্তু অপরদিকে হিন্দুধর্ম একটি সুসভ্য, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী ধর্ম। (১০) ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামীরা সবাই ব্রাহ্মণ নয়, কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ শূদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি।কিন্তু হিন্দুধর্মের অনুগামী মাত্রেই সবাই হিন্দু এবং কেবলমাত্র হিন্দু। হিন্দুদের একমাত্র পরিচয় -- তারা হিন্দু।(১১) ব্রাহ্মণদের উপনয়ন হয়, হিন্দুদের হয় না। (১২) ব্রাহ্মণ্যধর্মে জাতপাত, বর্ণভেদ, অস্পৃশ্যতা আছে, কিন্তু হিন্দুধর্মে ওইসব কদর্য জিনিস নেই।ওগুলো সম্পুর্ণতই ব্রাহ্মণ্যধর্মের ব্যাপার, হিন্দুধর্মের নয়।(১৩) ব্রাহ্মণরা পৈতে পরে, কিন্তু হিন্দুরা তা পরে না। তাই পৈতে পরা দেখে ব্রাহ্মণকে সহজেই স্বতন্ত্র ধর্মের অনুগামী হিসাবে সনাক্ত করা যায় -- যেমন টুপি (ফেজ) পরা দেখে মুসলমানদের সনাক্ত করা যায়, বুকে ক্রুশ দেখে খ্রিস্টান সনাক্ত।

এইসব তথ্য বিচার ও বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমিত হয় যে, ব্রাহ্মণ্য ও হিন্দু দুটি স্বতন্ত্র ধর্ম, কখনোই এক ধর্ম নয়।অতএব ব্রাহ্মণ্যবাদের সব রকম অন্যায়-অবিচার হিন্দুধর্মের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা সুবিচার হয় না।এ ব্যাপারে শিবরাম চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুধাবনযোগ্য -- এই হিন্দু সভ্যতায় ব্রাহ্মণের দান অতি সামান্যই, বলতে গেলে ব্রাহ্মণের থেকে যতটা এ নিয়েছে তাই এর কলঙ্ক……ব্রাহ্মণের দ্বারা প্রভাবিত না হলে এ সভ্যতা আরও প্রাণবান, আরও বেগবান, আরও বীর্যবান হতে পারত…… ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার চেয়ে ঢের বড়ো এই হিন্দু সভ্যতা। ব্রাহ্মণ না জন্মালেও এ হত এবং ব্রাহ্মণ লোপ পেলেও হিন্দু সভ্যতা থাকবে…… ব্রাহ্মণরা সমাজের মাথা নয়, বরং টিকি। সমাজের মাথা থেকে ওটাকে কেটে বাদ দিলে সমাজটার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং তাকে আরও বেশি আধুনিক দেখাবে

সেই কারণেই বোধহয় অন্ত্যজ বা দলিতদের সন্মানের জন্য যাঁরা লড়াই করেছেন এবং করছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় উচ্চবর্ণের হিন্দু।রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি প্রমুখ উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তিগণ দলিতদের পক্ষে জোরদার আন্দোলন করেছেন। অবশ্য ড: ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের আন্দোলনও দলিত সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও বাবা আহম্মেদকর উচ্চবংশীয় ছিলেন না, বরং দলিত শ্রেণির।স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বর্তমান ভারতগ্রন্থে লিখেছেন – “ভারতবাসীর কেবল ভারবাহী পশুত্ব, কেবল শূদ্রত্ব।বিবেকানন্দের সমকালীন ভারতে ব্রাহ্মণত্ব, ক্ষত্রিয়ত্ব, বৈশ্যত্বের অধিকারী হলেন ইংরেজ এবং তাদের শাসন-শোষণের ভার পশুর মতো বহন করে চলেছে শূদ্ররূপ ভারতবাসী।বিবেকানন্দ মনে করতেন, “শূদ্রজাতি মাত্রেই এজন্য নৈসর্গিক নিয়মে পরাধীন।

অস্পৃশ্যনামা : না-মানুষের পদাবলি (প্রথম পর্ব)


লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহুরুপাদতঃ।

ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশং শূদ্রঞ্চনিরবর্তয়ৎ।।”(মনুসংহিতা ১ : ৩১)

---লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সৃষ্টি করলেন।এখানে পরিষ্কার। শূদ্রদের জন্মই হয়েছে পদ বা পা থেকে। নির্দেশ যাদের পা থেকে তারা মাথায় উঠবে কীভাবে ! তাই এদের স্থান তো পায়ের নিচেই হতে হবে ! অতএব জন্মও পায়ের নিচে, কর্মও পায়ের নিচে।

গীতায় শ্রী ভগবানের উক্তি মতে বলা হয়েছে—‘আমি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চার বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) সৃষ্টি করেছিপুরুষ সুক্তের মন্ত্র ব্যাখ্যা করে নির্মল কুমার বসু যে মত ব্যক্ত করেন তা হল চারটি বিশেষ গুণসম্পন্ন এবং বিভিন্ন মাত্রার সংযাগের ফলে চার বর্ণের মধ্যে গুণের তারতম্য দেখা যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতের গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সে জাতির কর্ম উল্লিখিত চার বর্ণের কর্মের সঙ্গে মিল না থাকলে সে জাতি মিশ্র গুণসম্পন্ন ধরে নেওয়া হত। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় তাদের বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, গৌতম প্রভৃতি স্মৃতিকার এ নিয়ে যে মতামত দেন তা প্রণিধানযোগ্য। মনু সংহিতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল এবং স্মৃতিকাররা বৃত্তির ভিত্তিতে সে জাতির বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করে দিতেন। এর থেকে প্রমাণিত হয়, প্রাচীনকালে কিছু গুণকে উত্তম এবং কিছু গুণকে অধম বলে গণ্য করা হত। একইভাবে কিছু বৃত্তিকে শুদ্ধ এবং কিছু বৃত্তিকে অশুদ্ধ বলে বিবেচনা করা হত। এভাবে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রএ চার বর্ণের সৃষ্টি হয়।

ব্রাহ্মণদের প্রভূত্বকামী শাসনব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান অস্ত্রই হল চতুর্বর্ণ প্রথাঅর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের উপস্থিতি -- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই প্রথার মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠিকে এক অদ্ভুত বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বিভাজিত করে যে ভাগ করো, শাসন করোনীতি কায়েম করা হয়েছে, সেখানে স্বঘোষিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রশ্নহীন করে রাখা হয়েছে। বর্ণ-মর্যাদার দিক থেকে এর পরই রাজদণ্ডধারী ক্ষত্রিয়ের অবস্থান। তার নিচে বৈশ্য এবং সর্বনিকৃষ্ট বর্ণ শূদ্র। মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আগ্রাসনবাদী বৈদিক সমাজের সর্বগ্রাসী বর্ণ-বিভেদের ছায়ায়। গোটা মনুসংহিতার কোথাও কোন ভাবে মানুষ নামের কোনো স্বতন্ত্র সত্ত্বার বা মানব জাতির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- চারটি বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ জাতি, ক্ষত্রিয় জাতি, বৈশ্য জাতি ও শূদ্র জাতি। মনুসংহিতায় ভগবান মনু যে চারটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন, তা হল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, নারী এবং শূদ্র। এই চারটি ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দিয়েছেন। তবে চতুর্বর্ণের বাইরে আর-একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আছে, তা হল -- অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ যাকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না।

বর্ণ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করেন তার বাইরে অবস্থান গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। জন্মের দ্বারাই নির্ধারিত হয় যে, সে কোন্ বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। অজানা সময় কাল থেকে একটি বংশধারা এই মর্যাদা ভোগ করে আসছে। অনন্তকাল পর্যন্ত বংশধারার মাধ্যমে এটা অব্যাহত থাকবে। ব্যক্তির মর্যাদা জন্ম দ্বারা নির্ধারিত। একজন ব্রাহ্মণ হিসাবে জন্মগ্রহণ করলে যে-কোনো অবস্থাতেই সে ব্রাহ্মণের জন্য নির্ধারিত মর্যাদা ও পুরস্কার ভোগ করবে। কোনো ব্যক্তি এক বর্ণে জন্মগ্রহণ করে অন্য বর্ণে বিয়ে করতে পারে না। কারণ বর্ণের বাইরে বিয়ে করলে তার বংশগত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু যে বংশগত পবিত্রতাই মূল কথা তাই নয়, এর সঙ্গে আরও বহু আচার ব্যবস্থা জড়িত, যার মাধ্যমে বর্ণ শুদ্ধতা রক্ষিত হয়। মূল বর্ণগুলির মধ্যেও আছে হাজারও উপবর্ণ। এই উপবর্ণগুলি আবার নিজেদের গোত্রগত বিশুদ্ধতা রক্ষার রীতিনীতি মেনে চলে। এই উপগোত্রগুলি আবার নিজেদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য নানারূপ বিধিনিষেধ মেনে চলে যেমন সপিণ্ড, সগোত্র ইত্যাদি সংক্রান্ত আচার বিধি। এই নিয়ম কঠোরভাবে মানতে হয়, তা না হলে উঁচু জাতের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণের মধ্যে এটা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এজন্য পণ্ডিতরা বলে থাকেন, ভারতে বর্ণপ্রথার ইমারতটি গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের উপর। একজন ব্রাহ্মণ একজন নিচু জাতের লোকের সঙ্গে একত্রে বা হাতের রান্না খাবে না, ছোঁয়া খাবার খাবে না। তার খাওয়া পাত্রে খাবে না, তার স্পর্শ করা খাবার খাবে না। বর্ণ পঞ্চায়েত এবং আচরণরীতি ব্যাপারটার কেন্দ্রে রয়েছে ব্রাহ্মণ সমাজ এবং তাদের কৌলীন্য ও মর্যাদার ধারণার গুণগত উৎকর্ষের কারণে সমাজে মানুষ উচ্চতর মর্যাদা এবং পুরস্কারগুলি ভোগ করবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম, এটাই দস্তুর। একটি বিশেষ পুরস্কার বা সুবিধা বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত থাকে। এর ফলে সমাজের নিম্ন শ্রেণিগুলির মধ্যে উচ্চতর অর্জন প্রেষণা কাজ করে না। সমাজ হয়ে পড়ে বদ্ধ জলাভূমি। এখানে সর্বস্তরের মানুষের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয় না। মানুষের উচ্চ অর্জন প্রেরণা হচ্ছে সমাজ উন্নয়নের চাবিকাঠি। যেহেতু বর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির মর্যাদা এবং পুরস্কার শ্রম ও মেধার সাহায্যে অর্জন করা যায় না তাই সার্বিকভাবে সামাজিক সচলতার উপস্থিতি এখানে লক্ষ করা যায় না।

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫

দেবতার তত্ত্বতালাশ (দ্বিতীয়/শেষ পর্ব)



মিশরীয়দের মনেও প্রশ্ন জাগল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, মৃত্যু এবং জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। এভাবে তাঁদের মধ্যেও জন্ম নেয় ধর্মীয় বিশ্বাস। অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় দেবদেবতা। সমাজের বিবর্তন আর সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক গভীর। প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের চিহ্ন রেখে গেছেন পাথরে গায়ে, সমাধি ক্ষেত্রে, গড়েছিলেন দেবতাদের মূর্তি আর মন্দির। প্রাচীন মিশরে ২০০০ এরও বেশি দেবদেবী ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। স্থান ও কালের পার্থক্যে দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল ভিন্ন। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মিশরীয় রাজা বা ফারাও যারা পরবর্তীতে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। দেবতাদের কেউ কেউ ছিলেন ক্ষতিকরউল্লেখযোগ্য দেবতারা ছিলেন রা, তাহ, ওসিরিস, আইসি্স‌, হোরাস, সেথ, হাথর, আনুবিস, থথ, আটেন, আমুন, বাস্তেত। রা ছিলেন সূর্যের দেবতা রা দেবতা আবির্ভূত হতেন বিভিন্ন রূপে সকালে খেপরি, বিকালে আটুম কিংবা হোরাক্তি রূপে। রা-এর ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন ন্যায়বিচারের দেবী মাত। রা-এর দিবাকালীন আকাশভ্রমণ সব সময় নিরাপদ ছিল না আপেপ নামের এক সাপের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হত। আপেপের নিঃশ্বাসে মেঘের কালো কুণ্ডলী রা-কে ঘিরে ফেলত। কিন্তু শক্তিমান রা-কে এসব আটকাতে পারত না। সে সব কিছুকে পরাজিত করে ঠিকই তার পথ অতিক্রম করত। মাঝে মাঝে ক্ষতিকর দেবতারা এসে গিলে ফেলত রা-কে। তখন সূর্যগ্রহণ হত। কিন্তু রা ঠিক ঠিক শত্রুর পেটে কেটে বেরিয়ে আসত। আইসিস, মিশরীয় মাতৃদেবী। উর্বরতার দেবতা আমুন। ফারাওরা নিজেদের রা-এর সন্তান বলে দাবি করত।

মায়াদেরও দেবতাদের কথা আমরা জানতে পারছি। অর্থাৎ মায়াদেরও দেবতা-ধারণা আছে। হুনাহপু এবং এক্সবালেংখুয় হল মায়াদের দেবতা। এই যমজ দেবতার কাহিনি মায়া পুরাণের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়। এই কাহিনি যে কয়টি এপর্যন্ত জীবিত মায়া পুরাণ টিকে আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এরা সম্পর্কে দুই ভাই। মায়ার নরকের দেবতা হলেন এক্সিবালবা। এক্সিবালবা অত্যন্ত বদরাগী এবং নিষ্ঠুর চরিত্রের দেবতা ছিলেন। মায়ারা বিশ্বাস করতেন এক্সিবালেংখুয়ে এবং হুনাহপু ছিলেন যথাক্রমে পৃথিবীর শাসক এবং আকাশের দেবতা। পরে অবশ্য দুজনেই চন্দ্রদেব এবং সূর্যদেবে রূপান্তরিত হন। মায়ারা বিশ্বাস করত মায়া-সম্রাট আসলে হয় এক্সিবালেংখুয়ে, নয় হুনাহপু দেবের পুত্র।

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫

দেবতার তত্ত্বতালাশ (প্রথম পর্ব)



ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ সৃষ্টিকর্তাকে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই একই পংক্তিতে ফেলে ভেবে থাকেন। মুসলিমগণ তাদের ঈশ্বরকে 'আল্লাহ' এবং খ্রিস্টানগণ 'গড' বলে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কাছে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই এক। সবই কিন্তু এক নয়। দেবতা বা ঠাকুরের মধ্যে ঈশ্বর বা ভগবানের বিস্তর তফাত। কখনোই এক নয়। ঈশ্বর বা ভগবান নিরাকার, দেবতা বা ঠাকুর সাকার। ঈশ্বর বা ভগবান বিমূর্ত। দেবতা বা ঠাকুর মূর্তিমান। হিন্দু, গ্রিক, মিশরীয় এবং রোমানদের ছাড়া আর কোনো ধর্মেই দেবতা বা ঠাকুর নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদেরও ঈশ্বর বা ভগবান আছে। ভাষাভেদে ভিন্ন নামে। আল্লাহ, গড -- সব ঈশ্বরেরই প্রতিশব্দ। ঈশ্বর হল জাগতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থানকারী কোনো অস্তিত্ব | অনেকের মতে, এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক আছে মনে করা হয় --- যাকে গড, ঈশ্বর সহ বিভিন্ন ভাষা ও সংষ্কৃতিতে বিভিন্ন নাম এবং উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়। এই অস্তিত্বে বিশ্বাসীগণ ঈশ্বরের বা উপাসনা করেন। তাদেরকে আস্তিক বলা হয়| আর অনেকে ধারণাকে অস্বীকার করেন| এদেরকে বলা হয় নাস্তিক| আস্তিক সমাজে, ঈশ্বরের ধারণা ধর্ম ও ভাষা ভেদে ভিন্ন। ভাষাভেদে একে ইংরেজি ভাষায় গড, আরবি ভাষায় ইলাহ এবং বাংলা ও সংষ্কৃত ভাষায় ঈশ্বর ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। একজন সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারণাকে বলা হয় একেশ্বরবাদ| ভগবান এবং দেবতার মধ্যে পার্থক্য কী ? এককথায় হিন্দুরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভগবান নামে ডাকেন, তবে তারা বিশ্বাস করে ভগবান সরাসরি নিজে সবকিছু করেন না। তিনি একই সঙ্গে, একই সময়ে, নানান রূপে একাধিক কাজ সম্পন্ন করেন। ভিন্ন ভিন্ন কাজ করার সময় তার যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রকাশিত হয় সেটাকেই হিন্দুরা বলে দেবতা। যেমন ভাবা হয় ভগবান বিশ্বকর্মাদেবতা নাম নিয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। হিন্দুরা বিশ্বকর্মাকে দেবতা মনে করেন। একইভাবে বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ইত্যাদি। অপৌরুষেয় গ্রন্থগুলিতে বলা হয়েছে --- দেবতারা ঈশ্বরনন, দেবতারা ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ মানুষ!
গ্রিকদেবী অ্যাফ্রোদিতি
ঈশ্বর হলেন সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর কোনো শুরুও নেই এবং তাঁর কোনো শেষও নেই। আস্তিকগণ মনে করেন কোনো মানুষই কখনো ঈশ্বরকে দেখেনি। বামাক্ষ্যপা, রামপ্রসাদ, মোহম্মদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ, জিশু, ইব্রাহিম কেউ নয়। ঈশ্বরের ধারণা দিয়েছেন মাত্র। কারণ তিনি হলেন আত্মিক ব্যক্তি। আর এর অর্থ হল -- পৃথিবীতে বসবাসরত মাংসিক প্রাণী থেকে তাঁর জীবন আরও উন্নত প্রকৃতির। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে তা যেমন প্রমাণ করা যায় না, আবার তিনি যে নাই তাও প্রমাণ করা যায় না। বাইবেল বলে, বিশ্বাসেই এই সত্য আমাদের অবশ্য মেনে নিতে হবে যে, ঈশ্বর সত্যিই আছেন --বিশ্বাস ছাড়া ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা অসম্ভব, কারণ ঈশ্বরের কাছে যে যায়, তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ঈশ্বর আছেন এবং যারা তাঁর ইচ্ছামত চলে তারা তাঁর হাত থেকে তাদের পাওনা পায়” (ইব্রীয় ১১:৬)। যদি ঈশ্বর চান তাহলে খুব সহজে তিনি তো উপস্থিত হয়ে সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দিতে পারেন যে, তিনি আছেন। কিন্তু যদি তিনি তা করেন, তাহলে বিশ্বাসের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। সেইজন্য জিশু থোমাকে বলেছিলেন -- থোমা, তুমি কি আমাকে দেখেছ বলে বিশ্বাস করছ ? যারা না দেখে বিশ্বাস করে তারা ধন্য” (জোহন ২০:২৯)। তবে, তার মানে এই নয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। বাইবেল বর্ণনা করেছে --মহাকাশ ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করছে, আর আকাশ তুলে ধরছে তাঁর হাতের কাজ। দিনের পর দিন তাদের ভিতর থেকে বাণী বেরিয়ে আসে, আর রাতের পর রাত তারা ঘোষণা করে জ্ঞান। কিন্তু তাতে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভাষা নেই, তাদের স্বরও কানে শোনা যায় না। তবু তাদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে জগতের শেষ সীমা পর্যন্ত।”(গীতসংহিতা ১৯:১-৪)।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রথম যুক্তি : ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা দিয়েই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। ঈশ্বর সম্বন্ধে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে --তিনি এমন এক সত্ত্বা, তাঁর চেয়ে মহত্তর আর কিছু ভাবা যায় না।এভাবেও যুক্তি দেওয়া হয়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকার চেয়ে বরং তাঁর অস্তিত্ব থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো। তার মানে ধারণা করার মতো সবচেয়ে বড়ো সত্ত্বার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকে, তাহলে ঈশ্বর সম্পর্কে সবচেয়ে বড়ো কোনো ধারণা করা যায় না। করা না-গেলে ঈশ্বর সম্পর্কে এই সংজ্ঞার গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না।