মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আপনকথা-যাপনকথা : ৩



গ্রামের নাম দেবগড় কিংবা শক্তিগড় হবে ঠিক মনে পড়ছে না আজকের কথা তো নয় ১৯৭৮ কিংবা তারও আগের কথা হবেতবে ১৯৬৪ সালের আগে নয়এই গ্রামে আমাদের খুব ছোট্ট একটা বাড়ি ছিল বাড়ি বলতে টালির দোচালায় দর্মার বেড়া দিয়ে তৈরি আমার বাবার প্রথম বাড়িছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতিগুলি জুড়ে জুড়ে মালা গাঁথার চেষ্টা করছিবাড়ির পশ্চিমদিকটায় একটা সরু গলি, অনতিদীর্ঘ এই গলি বনগাঁ-রানাঘাট লোকাল চলাচলের রেললাইনে এসে শেষ হয়েছে এ সময় এখান দিয়ে স্ট্রিম ইঞ্জিনচালিত ট্রেন চলত রেললাইন টপকালেই সোজা আমার স্কুল যাওয়ার পথ স্কুলপথে ডানদিকে ঘন লম্বা লম্বা অড়হর ডালের ক্ষেত পড়ত একটু হাঁটলেই একটা নিঃসঙ্গ বাবলাগাছ দেখতে পাওয়া যেত এই গাছের সাদা সাদা বড়ো বড়ো কাটা সবসময় যেন জেগে থাকতআর কিছুক্ষণ হাঁটলেই আমাদের স্কুল ছিল প্রাইমারি স্কুল পড়াশোনায় অ্যাডভান্স থাকায় এই হেডমাস্টারমশাই ক্লাস টুতেই ভরতি করে নেন আমার পিতৃদত্ত নামস্বপনবদলে দিয়ে হেডমাস্টারমশাইবিপ্লবনাম করে দিলেন যদিও আমাদের ভাইবোনেদের পিতা রাখেননি, মাতাই রেখেছেন যেহেতু বাবার নামের আদ্যাক্ষর উচ্চারণমানে সন্তোষ ছিল, তাই ভালোবাসার চিহ্ন হিসাবে আমার নাম স্বপন, বোনের নাম সিপ্রা, ছোটো ভাইয়ের নাম সমীর রেখেছিলেন আমার মা প্রাইমারি স্কুলের ওপাশে কী ছিল মনে করতে পারছি না

আমাদের বাড়ির পূর্বদিকটায়, আমাদের বাড়ির পিছনে ছিল একটা ছোটো জলা জলার ওপারে সারি সারি কলাগাছ কী কলাগাছ ছিল জানি না সম্ভবত বিচিকলা বা দয়াকলার গাছ ছিল কলাগাছের পরেই অনেক বিস্তৃত সবুজ ঘাসের গালিচা পাতানো জমি ছিল যেন ওই জমির বাঁদিকে বিশাল বড়ো একটা ঝাঁকড়া আমগাছ ছিল মনে পড়ছে এই গাছটায় প্রচুর আম ফলত খুব নীচেও আম ফলে থাকত জমিতে ঘাসের গালিচায় আমগাছের ডালগুলি এমনভাবে চুমু খেত যে পাঁচ-সাত বছরের বাচ্চাও ছুঁয়ে ফেলতে পারত জমির ওপাশে কী ছিল মনে করতে পারছি  না
 
আমাদের বাড়ির দক্ষিণদিকে প্রথমে মীরা-মাসির বাড়ি মীরা-মাসির বাড়ির পরেই কল্পনা-মাসির বাড়ি কল্পনা মাসি আমার মায়ের খুব ভালো বান্ধবী ছিল আমি মাসি বললেও কল্পনা-মাসি মাকে বউদি বলত কেন জানি না কল্পনা-মাসি প্রতিদিন আমার মায়ের কাছে আসত বাংলা আধুনিক গানেরঅনুরোধের আসরশোনার জন্যতখন আকাশবাণীর খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল এটি আড়াইটে কিংবা তিনটে থেকে শুরু হত আধ ঘণ্টা কিংবা এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান ছিল মনে হয় ঠিক মনে পড়ছে না তখন  রেডিয়োই ছিল মানুষের কাছে একমাত্র বিনোদন-যন্ত্র লাইসেন্স ছাড়া রেডিয়ো কেনা বা বাজানো যেত না বছরে একবার পোস্ট অফিসে গিয়ে লাইসেন্স ইস্যু করে আসতে হত কোনো একদিন অনুরোধের আসর শুরু হল, শেষও হয়ে গেল কিন্তু কল্পনা-মাসি এল না চিন্তা হচ্ছিল মায়ের মা পায়চারি করছিল কে যেন মাকে ডাকছে, “বকুলদি বকুলদিমা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে উদভ্রান্ত মীরা-মাসি, আর কল্পনা-মাসির বাড়ির লোকজন কল্পনা-মাসির মা আমার মাকে জিজ্ঞাসা করল, “বকুল, কল্পনা কোথায় গেছে বলতে পারিস ?”

মা বলে, “আজ কল্পনা আমাদের বাড়ি আসেনি তো !” সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে, কল্পনা-মাসির বাড়ির লোকজন বোধহয় বুঝতে পারছিল
 
মা জিজ্ঞাসা করল, “রাগারাগি হয়েছে নাকি ?”

হঠাৎ সবাই পশ্চিমদিকের রেললাইনের দিকে ছুটে গেল বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সকলে রেললাইনে পড়ে আছে কল্পনা-মাসির নিথর দেহ কোমর থেকে দু-ভাগ হয়ে গেছে শরীরটা অনেকদিন পর মার কাছ থেকে শুনে ছিলাম, সুন্দরি হলেও কল্পনা-মাসির গায়ের রং খুব কালো ছিল এই কালো রঙের জন্য কল্পনা-মাসির বিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না বয়সও বেড়ে গিয়েছিল অনেক পাত্রপক্ষ দেখতে আসে, খায়-দায়, আবার মুখ মুছে ফিরে যায় কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মা হতাশ হয়ে পড়ে কল্পনা-মাসিকে এই কারণে প্রচুর গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছিল এমন অপদার্থ মেয়ের লাইনে গলা দিয়ে মরা উচিতবলে  কল্পনা-মাসির মা নিদান দিয়ে দেন সেদিন মা-মেয়ের ঝগড়া-মনোমালিন্য এইভাবেই চরমে পৌঁছেছিল

আমাদের বাড়ির উত্তরদিকে একটা মাটির দীর্ঘ রাস্তা ছিল রাস্তার ওপারে কী ছিল মনে পড়ছে না রাস্তার পূর্বদিক গিয়ে মিশেছে একটা জনপদ ছাড়িয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে, রাস্তার অপরদিক, পশ্চিমদিকে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে মনে পড়ছে নাতবে পশ্চিমদিকের একটা বাড়িতে পূর্ণিমা-মাসিরা থাকত তাঁর মায়ের সঙ্গে পূর্ণিমা-মাসির স্বামী বিহারে থাকে বিহার থেকে বছরে এক-আধবার এসে মাসির সঙ্গে রাত কাটিয়ে ভোর হলেই চম্পট দিত এই মাসিকে ঘিরে আমাদের মায়ের সঙ্গে বাবার তুমূল ঝগড়া হত সে গল্প অন্য আর-একদিন বলা যাবে

একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি মা ঘরে নেই বাবা খুব গম্ভীর মুখে চৌকির উপর বসে আছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বাবা, মা কোথায় গেছে ?” বাবা বললেন, “তোর মা মরতে গেছে রেললাইনে পারলে বাঁচা গিয়ে আমার চোখের সামনে তখন শুধুই অন্ধকার অঝরে ঝরছিল জল ছুট্টে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে আমি দিশেহারা পূর্ণিমা-মাসির বাড়ির পিছনেই চাষের জমিচাষের জমি পেরলেই রেললাইন উত্তরদিকের রাস্তা ধরে ছুটতে থাকলাম বাঁদিকের চাষের জমিতে নেমে পড়লাম সদ্য লাঙল দেওয়া হয়েছে চারদিকে বড়ো বড়ো মাটির ডেলা ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে মা হেঁটে যাচ্ছে রেললাইনের দিকে আমি ছোটো ছোটো নরম নরম পায়ে  বড়ো বড়ো মাটির ডেলার উপর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে লাগলাম,  মাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকলাম অনেকক্ষণ পর মা আমার ডাক শুনতে পেল এরপর বড়ো বড়ো মাটির ডেলা তুলে তুলে আমার দিকে ছুঁড়ছিল একের পর এক আমি মাটির ডেলার আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে ডানে-বাঁয়ে করতে করতে মায়ের দিকেই ক্রমশ এগোচ্ছিলাম মা হেরে গেলেন, স্নেহের কাছে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন আমি বললাম, “মা তোমার কী হয়েছে ? তুমি কোথায় যাচ্ছিলে ? আমার খুব কান্না পাচ্ছে মার চোখে জল, টলটল করতে করতে ঝরে পড়ল আমার বুকে মা বললেন, “এই দেখ, তোর বাবা আমার ডান পায় ব্লেড টেনে ফালাফালা করে দিয়েছেমা ডান পায়ের রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ খুলে দেখালেন কাটা অংশ, হাঁ হয়ে আছে মা বললেন, “প্রচণ্ড ঝগড়া হচ্ছিল তখন তোর বাবা দাড়ি সেভ করছিল -কথায় সে-কথায় বলল, “দেখবি কেটে দেব তোকে!” আমি বললাম, “পারবে কাটতে”? তোর বাবাদেখ, পারি কি নাবলে ব্লেড টেনে দিল পায়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম। 

পা বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছিল রক্তরক্তে ভিজছিল মাটি, আমি ভিজছিলাম মায়ের চোখের জলে

কোন মন্তব্য নেই: