শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

রাম-রাজত্ব

আধুনিক ভারতবর্ষে রাম-রাজত্বশব্দযুগল আমরা প্রথম শুনতে পেয়েছিলাম গান্ধিজির মুখে, বোধ হয়। ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতবর্ষে নাকি রাম-রাজত্ব চলবে। কিন্তু কী সেই রাম-রাজত্ব ? কেমন সেই রাম-রাজত্ব ? রাম-রাজত্বে কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে, যা  নেতা-নেত্রীরা বারবার স্বপ্ন দেখায়, সাধারণ মানুষ বারবার স্বপ্ন দেখে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যে হিন্দুর ঘরে বাল্মীকির রামায়ণম্আছে তাঁরা পাতা উলটাতে পারেন। আমিও উলটাচ্ছি আসুন। আমি এখন  বালকাণ্ডমের (অনেকের মতে এই কাণ্ডটি বাল্মীকি রচনা করেননি, এই কাণ্ডটি উত্তরকাণ্ডের মতোই প্রক্ষিপ্ত) প্রথম সর্গে আছি। কী উল্লেখ আছে ? আসুন মহর্ষি নারদের বয়ানটি বাংলা তর্জমায় পড়ি।
ত্রিকালদর্শী নারদের মুখে রামচন্দ্রের শাসিত রাজ্য অযোধ্যার এক মনোরম সুখসমৃদ্ধির ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। দেবর্ষি নারদ বাল্মীকিকে বলছেন, রাম-বিরহে এতকাল প্রজারা দুর্বিষহ মনঃকষ্ট ভোগ করেছিল। এখন রাম অযোধ্যার সিংহাসনে বসেছেন। তাঁর আদর্শ সুশাসনে প্রজাদের সুখসমৃদ্ধির সীমা থাকবে না। প্রথম তাদের মনের কষ্ট দূর হওয়ায় প্রজারা আদিমুক্ত হল। শ্রীরামের রাজত্বে আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক সন্তাপ থেকে মুক্ত হবে অযোধ্যার নগরবাসী। নীরোগ দেহে তারা রামকে রাজা হতে দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট, আনন্দে, রোমাঞ্চে অত্যুচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ হল। কারণ রাম প্রজাপালনে সদা ব্রতী, সর্বজনরক্ষক। তাঁর সুশাসনে সকল প্রজা ধনসম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে ক্ষোভমুক্ত, আনন্দিত, সন্তুষ্টকোনো প্রজাকেই দারিদ্র্যের জ্বালা ভোগ করবে হবে না। রামের সতর্ক দৃষ্টির ফলে প্রজারা সকলে নিজের নিজের কর্মে লিপ্ত থাকবে। তাদের অপুষ্টিজনিত রোগ কোনোদিন থাকবে না। শরীর নীরোগ থাকায় সুস্থদেহে তারা সুন্দরভাবে ধর্মাচরণ করতে পারবে। দুর্ভিক্ষের ভয় না-থাকায় সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ রাম-রাজত্বে আকালের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। পিতৃহৃদয়ের আকুলতা নিয়ে তিনি প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকবেন। ফলে সকল প্রজা শারীরিক ও মানসিক সর্বপ্রকার ব্যাধিমুক্ত, নীরোগ, সুস্থ জীবনযাপন করবে। চারদিকে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হবে।

এখানেই শেষ নয়, রাম-রাজত্বে কখনও অকালমৃত্যু ঘটবে না। কোথাও কোনো স্থানে পিতা তাঁর পুত্রের মৃত্যু দেখে দুঃখকষ্ট পাবেন না। অর্থাৎ রামশাসিত রাজ্যে কোথাও কারও পুত্রশোক থাকবে না। কারণ শ্রীরামচন্দ্র হলেন নিষ্পাপ মহাপুণ্যবান রাজা। সব রমণী স্বামীর প্রতি একান্ত অনুরক্ত থাকবেন। পতিই তাঁদের ধ্যান ও জ্ঞান হবে। তাঁরা ব্যভিচারিণী হয়ে কখনও পরপুরুষে আসক্ত হবেন না। তাঁরা কখনও বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করবে না। সকল নারী রাম-রাজত্বে সতীসাধ্বী পতিব্রতা হয়ে দিনযাপন করবেন। ন পুত্রমরণং কোচিৎ দ্রক্ষ্যন্তি পুরুষা ক্বচিৎ।/নার্যশ্চাবিধবা নিত্যং ভবিষ্যন্তি পতিব্রতাঃতথা”(বালকাণ্ডম প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯১)। রামশাসিত রাজ্য আধিদৈবিক সন্তাপমুক্ত করতে হবে। তাঁর রাজ্য অগ্নি, বায়ু এবং জলে কখনও বিপন্ন হবে না। কোনো প্রাণী বা কোনো ব্যক্তি অগ্ন্যুৎপাত, বন্যার জলোচ্ছ্বাসে অথবা প্রবল ঝঞ্ঝায় কখনও পীড়িত হবে না। ন চাগ্নিজন ভয়ং কিঞ্চিন্নাসু মজ্জন্তি জন্তবঃ।/ন বাতজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপি জ্বরকৃতং তথা”(বালকাণ্ডম প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯২)। রাজা, দস্যু, তস্কর, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যের কোথাও কোনো প্রাণী অনাহারে কষ্ট পাবে না। কারও ক্ষুধা-তৃষ্ণার ভয় থাকবে না। দেশ, জনপদ, নগরগুলি ধনধান্যে এমনই সমৃদ্ধ থাকবে যে লোকে চুরি করার প্রয়োজনই বোধ করবে না। ফলে চোর বা তস্কর, ডাকাতের ভয় থাকবে না। তন চাপি ক্ষুদভয়ং তত্র ন তস্করভয়ং তথা।/নগরাণি রাষ্ট্রাণি ধনধান্যযুতানি চতথা”(বালকাণ্ডম প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৩)। ত্রিতাপমুক্ত সর্বসাধারণ পরিশুদ্ধ সত্যযুগের মতোই ত্রেতাযুগেও রাম-রাজত্বে চূড়ান্ত আনন্দে দিনযাপন করবে --- নিতং প্রমুদিতাঃ সর্বে যথা কৃতযুগে তথা
তারপর কত যুগ কেটে গেল। রামায়ণের যুগ, মহাভারতের যুগ, বৌদ্ধযুগ, দীর্ঘ ৭০০ বছরের মুসলিম যুগ, প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ যুগ সবই তো অতীত হয়ে গেল, রাম-রাজত্ব কোথায় গেল ! বাল্মীকির রামায়ণম্”- এ মহর্ষি নারদ বলছেন -- দশবর্ষসহস্রাণি দশবর্ষশতানি চ।/রামো রাজ্যমুপাসিত্বা ব্রহ্মলোকং গমিষ্যতিতথা”(বালকাণ্ডম প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৭)। অর্থাৎ, ধার্মিক রামচন্দ্র এগারো হাজার বছর ধর্মবোধের সঙ্গে রাজত্ব করে ব্রহ্মলোকে প্রয়াণ করবেন। তাহলে হিসাবমতো  রামচন্দ্র এখনও রাজত্ব চালাচ্ছেন। এ কেমন রাম-রাজত্ব চলছে ? অবশ্য ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পূর্বেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। এরপর ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন ভারতে এ পর্যন্ত ১৮টি  শাসক বা প্রধানমন্ত্রীর [ (১) জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ ১৯৬৪, (২) গুলজারিলাল নন্দ ১৯৬৪, (৩) লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ১৯৬৪ –- ১৯৬৬, (৪) গুলজারিলাল নন্দ ১৯৬৬, (৫) ইন্দিরা গান্ধি ১৯৬৬ ১৯৬৭, (৬) মোরারজি দেশাই ১৯৭৭ –- ১৯৭৯, (৭) চরণ সিং ১৯৭৯ ১৯৮০, (৮) ইন্দিরা গান্ধি ১৯৮০ ১৯৮৪, (৯) রাজীব গান্ধি ১৯৮৪ ১৯৮৯, (১০) ভি পি সিংহ ১৯৮৯ –- ১৯৯০, (১১) চন্দ্রশেখর ১৯৯০ ১৯৯১, (১২) পি ভি নরসিহং রাও ১৯৯১ ১৯৯৬, (১৩) অটলবিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৬ ১৯৯৬, (১৪) এইচ ডি দেবগৌড়া ১৯৯৬ ১৯৯৭, (১৫) আই কে গুজরাল ১৯৯৭ ১৯৯৮, (১৬) অটলবিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৮ ২০০৪, (১৭) মনমোহন সিংহ ২০০৪ ২০১৪, (১৮) নরেন্দ্র মোদি ২০১৪] আবির্ভাব লক্ষ করেছি।
রামরাজ্যশব্দটির মধ্যে বর্তমানে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পেলেও প্রকৃতপক্ষে শান্তিময় পৃথিবীর সমার্থক হিসাবেই ভারাতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র এ শব্দটি বাগধারা হিসাবে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তবে এ শব্দটি সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় এমন কি নির্বাচনী ইশতেহারেও। তারা অনেকেই একবিংশ শতাব্দীতে ভারতকে রামরাজ্যে পরিণত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। সনাতন ধর্মবিশ্বাসমতে কলিযুগের শেষে আরেকবার সত্যযুগের আবির্ভাব হওয়ার কথা। অনেক ভারতীয় জ্যোতিষ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে সে সময় অত্যাসন্ন। সে যাই হোক, মোদ্দা কথা হোচ্ছে ১০ হাজার বছর পরও রামরাজত্বের ন্যায় একটি শান্তিময় রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের কাছে অতি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু।
মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, দেশ স্বাধীন হলে ভারতে রামরাজত্ব ফিরে আসবে। যখনই তিনি তার স্বপ্নের আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতেন, তিনি রামরাজ্যের কথা বলতেন। রামরাজ্যের শ্লোগানের মাধ্যমে গান্ধীজি বোঝাতে চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থাকবে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে, মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না, কেউ কোনো কাজের কৃতিত্ব দাবি করবে না , সর্বত্র আত্মত্যাগের চর্চা হবে। রামরাজ্যের যেন কোনো অপব্যাখ্যা না-করতে পারে বা একে কেবল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শ্লোগান হিসাবে মনে না করা হয় এজন্য গান্ধীজি নিজেই এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন তার লেখায় এবং বক্তব্যে। গান্ধীজি বলেছিলেন, কেউ যেন ভুলবশত মনে না করেন যে রামরাজ্য মানে হিন্দুর শাসন। আমার কাছে রাম হচ্ছে আল্লাহ বা ঈশ্বরের অপর নাম। আমি প্রকৃতপক্ষে চাই খোদার শাসন যা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর রাজত্বেরই সমার্থক।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিটি জনসভায় রাম মন্দিরের কথা সযত্নে এড়িয়ে গেলেও বারাণসীতে রামরাজ্যের কথা শোনা গেল নরেন্দ্র মোদির গলায়৷ উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি 'রামরাজ্য' প্রসঙ্গ তোলেন৷ তাঁর সাফ কথা, মানুষই একদিন এই রাজ্যে 'রামরাজ্য'’ প্রতিষ্ঠা করবে৷ তাঁর বক্তব্যকে তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করছে  রাজনৈতিক মহল। রামরাজ্যবানাতে চান উমা ভারতী। আসুন হিন্দু মৌলবাদ, মুসলিম মৌলবাদ -- সবের বিরুদ্ধে আমাদের সেকুলার গণতান্ত্রিক লড়াই তীব্র হোক।

কেউ কথা রাখেনি। রাম-রাজত্বও আসেনিরাম-রাজত্ব আসলে সোনার পাথরবাটি। অলীক এক কল্পনা।

কোন মন্তব্য নেই: