শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

দোলযাত্রায় রঙের খেলা

দোলযাত্রা বলতে আমরা যেটা বুঝি তা হল রঙের খেলা, একে-অপরকে নানা রঙে রাঙিয়ে দেওয়া। শীতের কনকনে ঠান্ডাকে বিদায় ঘোঘণা করে বসন্তকে আহ্বান। এই বসন্তের আগমন হয় দোলযাত্রার মাধ্যমে, এই বাংলায়। শুধু বাংলাতেই নয়, ভারত জুড়ে চলে রঙের উৎসব হোলি৷ হিন্দুরা তো বটেই, বৌদ্ধদেরও হোলি খেলতে যায়। আমি বহু জায়গায় মুসলিমদেরও রং খেলায় অংশগ্রহণ করতেও দেখেছি। ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলির মধ্যে একটি রঙিন উৎসব হল দোল বা হোলি বা বসন্ত উৎসব৷ দোল কথাটা এসেছে দোলনা থেকে৷ এই উৎসব ভারতের পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চলে উদযাপন করা হয়ে থাকে৷ জানা যায়, আর্যরা এটি পেয়েছিল অনার্য উৎস থেকে। ফাল্গুনের শুক্লা চর্তুদশীতে ও পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হত হোলিহোলাকবা হোলকনাম থেকে এসেছে এ উৎসবের নাম। উত্তম প্রকারের শস্য উৎপাদনের প্রার্থনায় এই উৎসব আরম্ভ করেছিল মানুষ। জ্বালানো হত অজন্মাদৈত্যের খড়। স্কন্দপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুনমাহাত্ম্যগ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান আছে। মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির ছেলে হিরণ্যকশিপুর বোন ছিলেন হোলিকা। হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার বরে  দেব ও মানব বিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করা শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর ছেলে প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর চরম ভক্ত। প্রহ্লাদ বিষ্ণুকে নিজ পিতার উপরে স্থান দেওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়ে হিরণ্যকশিপু নিজের সন্তানকে পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন। দাদার আজ্ঞায় পিসি হোলিকা ভস্ম করার জন্য ভাইপো প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করেন। কিন্তু বিষ্ণুর উপস্থিতিতে প্রহ্লাদ অক্ষতই থাকেন। প্রহ্লাদ নয়, আগুনে পুড়ে ছাই বা ভস্ম হল  হোলিকা। হোলিকার এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনিই দোলের  আগের দিনে অনুষ্ঠিত হোলিকাদহন বা চাঁচর উৎসবের সঙ্গে যুক্ত।

উত্তরভারতে ঘুরিয়ে বলা হয় হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার বিনাশ করেছিল ভক্ত প্রহ্লাদ স্বয়ং। হোলি উৎসবের পেছনে নানান পৌরানিক লোককাহিনি প্রচলিত থাকলেও, এর মধ্যে প্রধান এবং জনপ্রিয় কাহিনি হল হোলিকাদহনএ থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি । বাংলায় আমরা বলি দোলযাত্রাআর পশ্চিমভারত ও মধ্যভারতে হোলি

দোল উৎসব উদযাপন করা হয় ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ মাসের শেষ পূর্ণিমাতে৷ বাঙালির দোলের সঙ্গে মিশে আছে বাবুয়ানি এবং আভিজাত্যও। শোনা যায়, পুরোনো কলকাতার কোনো বনেদি বাড়িতে দোলের জলসায় গান গাইতে আসতেন গহরজান, মালকাজান, শেলি, নুরজাহান প্রমুখ বিখ্যাত সব বাঈজি। আবার কোনো পরিবারে গৃহদেবতা দামোদর জিউর দোল উৎসব প্রায় দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে হয়ে আসছে। জানা যায়, খ্রিস্টজন্মেরও কয়েক শো বছর আগে থেকে হোলি উদযাপন করা হত।  ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আরিয়ান জাতির কাছ থেকে এই উৎসবের জন্ম বলে মনে করা হয়। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্টজন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদই করা একটি ভাস্কর্যে। তা ছাড়া এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরাণেও। ৭০০ শতকে দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটকেও হোলি উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়। পরে খোদাই করা চিত্রকর্মেও হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠেবিভিন্ন মন্দিরের গায়ে।

আমাদের দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই উৎসব বিভিন্নভাবে পালন করে থাকে। বাংলাদেশে পুরোনো ঢাকার তাঁতিবাজার, শাঁখারি বাজার এবং লক্ষ্মীবাজারসহ কিছু হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাতে আজও এই উৎসব পালন করা হয়। দুপুর ১টা পর্যন্ত রং দিয়ে সব এলাকা ভরিয়ে ফেলা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রায় সবাই একে অন্যেকে রং দিয়ে নিজেদের রঙিন মানুষে পরিবর্তন করে ফেলে।
তবে দোলযাত্রা মূলত একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব বলেই বিবেচিত। বহির্বঙ্গে পালিত হোলি উৎসবটির সঙ্গে দোলযাত্রা উৎসবটি সম্পর্কযুক্ত। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সহিত রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমাও বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমানামেও অভিহিত করা হয়।
হোলি বা দোল উৎসব শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার অন্যতম। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত এই জনপ্রিয় বৈষ্ণব উৎসবটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ তথা বঙ্গদেশের অন্যতম প্রধান গণ-উৎসব এবং সর্বপ্রধান বসন্তোৎসব। আদিতে দোল উৎসব এবং হোলি উৎসব ছিল পৃথক, বর্তমানে দুটি উৎসবই একীভূত হয়েছে। দোল উৎসব এবং হোলির চরিত্র আচার-আচরণ, আবেদন, তাৎপর্য অভিন্ন। উৎসবটি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাংলার বাঙালিরা দোলখেলেন, অবাঙালি তথা মাড়োয়ারি গোষ্ঠীরা তার পরের দিন হোলিখেলেন। বাংলাদেশেও অনেক অঞ্চলে এটি দোলযাত্রা বা দোলোৎসব নামে পরিচিত। ভারতের উডিশাবাসীরাও বলেন দোলোৎসব, আবার উত্তর ও মধ্য ভারতের অধিবাসীরা বলেন 'হোলি' কিংবা 'হোরি', গোয়া ও কঙ্কণ অঞ্চলের লোকেরা বলেন 'শিমাগা', দক্ষিণ ভারতীয়রা বলেন 'মদনদহন' বা 'কামায়ন''হোরি' (তৎসম), 'দোল' থেকে এসেছে অপভ্রংশ 'হোলি''হোলি' থেকে 'হোলক', 'হোলকহল 'হোলিকা', মানে ডাইনি। তাকে দহন করলে সারা পৃথিবীর মানুষ ধর্মে-কর্মে-জীবনে সফেদ চরিত্রের হবে ! আবার কৃষিনির্ভর সমাজের প্রজনন সম্পর্কিত উৎসব 'হোলি'কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ”-এর প্রভাবে পরবর্তীকালে 'হোলি' 'দোলযাত্রা' একাত্ম হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দোল উদযাপন উপলক্ষে 'বুড়ির ঘর' বা 'মেড়া' পোড়ানো হয়। এদিন বিষ্ণু বা কৃষ্ণ মন্দির কিংবা ধামে মানুষের কুশপুত্তলিকা সম্মুখে আনা হয়। নানা পূজার্চনার পর এটিতে অগ্নিদান করা হয়। পরদিন কৃষ্ণ বা গোপালের বিগ্রহকে একটি সুসজ্জিত দোলায় স্থাপন করা হয়। এ সময় পুরোহিত বিগ্রহের গায়ে আবির লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে সকলে পরস্পরকে আবির মাখিয়ে দেয়। এরপর নিজেদের মধ্যে আবির লাগানো বা পিচকারি থেকে গোলা তরল রং গায়ে দিয়ে খেলা শুরু হয়। বৃহত্তর দিনাজপুর রংপুর অঞ্চলে দোলের তিনদিন পর একটি হাস্যরসাত্মক আচার পালন করা হত। তাঁদের একজনকে 'সূর্য রাজা' বা 'দোলের রাজা' সাজিয়ে ঘোড়ায় চড়িয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করানো হয়। রাজা যাকে সামনে পান তার কাছ থেকেই খাজনা আদায় করেন এবং সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যে বলে লোকজনদের ঠকান। বর্তমানে অবশ্য দোলের এই অঙ্গটি খুব একটা দেখা যায় না। অন্তত আমি দেখিনি। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানে 'দোল' প্রসঙ্গ এসেছে। এসেছে রাধাকৃষ্ণের রসময় তাৎপর্যও। এছাড়া তাঁর সোনার তরীকাব্যগ্রন্থের 'ঝুলন' এবং কথা ও কাহিনীকাব্যগ্রন্থের 'হোরিখেলা' সহ অনেক কবিতায় দোললীলার প্রসঙ্গ এসেছে। কবি নজরুল ইসলামের হোলিকেন্দ্রিক অনেক গান ও কবিতা লিখেছেন। দোল উৎসবকে ঘিরে এভাবে অনেক গান কবিতা বা পদ বিভিন্ন সময়ে  রচিত হয়েছে। লোকসমাজে হোলিকে নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক শুভাশুভ সংস্কারও। পুরোনো দিনের সকল গ্লানি, অনুতাপ, ব্যর্থতাকে 'বুড়ির ঘর' বা 'মেড়া' পোড়ানোর মাঝে জ্বালিয়ে দিয়ে লোকায়ত সমাজকে নতুন জীবনে উজ্জীবিত করে তোলে। বস্তুত হোলি উৎসব নানা ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষের মিলন ঘটে। উৎসবস্থল হয়ে ওঠে গণমানুষের মিলনক্ষেত্র। এই মিলনক্ষেত্রে মানুষ ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখের চেয়ে সমষ্টিগত আবেগেই মেতে ওঠে। আর এই সামষ্টিক আবেগ যখন নৃত্যগীত, সংলাপ বা অভিনয় কলার মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে, তখনই হোলির গান লোকনাট্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে। হোলিগান লোকনাট্যটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে দেখা যায় না। লোকনাটকের ভৌগোলিক বিস্তার কেবল এই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদহ ও দিনাজপুর জেলাতে হোলিগান নাটকের প্রচলন আছে। এই অঞ্চলে এখনও অনেক আদিবাসী যেমন -- সাঁওতাল, ওরাওঁ, রাজবংশীরা বাস করে। রাজবংশীরা বর্তমানে হিন্দু-মুসমিল সম্প্রদায় একইসঙ্গে একইভূত হয়ে গেছে। এরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অনেক বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছে।  তাই সুপ্রাচীনকাল থেকে শাক্তদেবীর উপাসনাকেন্দ্রিক হোলি উৎসব পালন করে থাকে। বর্তমানে এই উৎসব বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলে সর্বজনীন উৎসব হিসাবে পরিগণিত হয়। দিনাজপুর রংপুরে এই উৎসব তাদের ভাষায় ধাম। ধামের অপভ্রংশ উচ্চারণ করা হয় ধুম রূপে। হোলি উৎসব বা হোলির গানের পালাগুলো এই অঞ্চলে  'হুলির গান' বা 'হুলির ধুম' নামে পরিচিত। ধাম বলতে দেবস্থানকে বোঝায়।  মূলত পালা আকারে ধাম বা দেবালয়ে পরিবেশিত হয় বলে লোকসমাজে পালাটিয়ানামকরণ করা হয়েছে। হোলি বা দোল পূর্ণিমার আসর যে স্থানে বসে সেই স্থানটিই হোলির ধামনামে পরিচিত। এই ধামে পরিবেশিত পালাগুলোকেই 'হোলির ধাম', 'হুলির ধুম' কিংবা 'হোলি গান' বা 'হুলি গান'ও বলা হয়ে থাকে। বর্তমান সমাজ প্রেক্ষিতে উন্নয়ন কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।  নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো সমাজেরই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়কিন্তু নিরক্ষর মানুষ অজ্ঞতার কারণে সহজে এই বিষয়টি বুঝতে পারে না, অক্ষরজ্ঞানী মানুষরাই-বা বোঝে কত ! হোলি গান লোকনাট্যের পালাগুলোতেও এই বিষয়গুলি লক্ষ করা যায়।
দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মত্ত হয়। অতীতে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে বসন্তের আগমন উপলক্ষ্যে একটি ছোটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নাচগান, আবৃত্তি ও নাট্যাভিনয় করা হত। পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠানটি পরিব্যপ্ত হয়ে শান্তিনিকেতনের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব বসন্তোৎসবের আকার নেয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাৎ দোলপূর্ণিমার দিনই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হয়। পূর্বরাত্রে বৈতালিক হয়। দোলের দিন সকালে ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোলগানটির মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সন্ধ্যায় গৌরপ্রাঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের কোনো নাটক অভিনীত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি চলে আসছে। দোলের আগের দিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। দোলের ব্যতিক্রমী কিছু আচার-অনুষ্ঠান আজও পালন করা হয় মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসেও। কলকাতার মল্লিক পরিবারে দোলের সময় রাধাকান্ত, শ্রীমতী এবং গোপিচাঁদ বল্লভের বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। অতীতের কোনো প্রথার পরিবর্তন হয়নি। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক প্রচলিত বৈষ্ণব প্রথা অনুসারে এই সকল আচার-অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর দিন বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়। অঙ্গরাগের কারিগররা নবদ্বীপ থেকে আসেন । তারপর দেবতাদের শোবারঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর দশমি তিথিতে বিগ্রহের শুদ্ধিকরণ, মার্জনা, স্নান, শৃঙ্গার, অলংকরণ, তিলককরণ এবং আবির পরানো অনুষ্ঠান হয়। লালদীঘি এবং লালবাজার দুটোই সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের সম্পত্তি ছিল। লালদীঘির পাশেই ছিল তাঁদের কাছারি বাড়ি। এই কাছারি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই  শ্যামরায়ের মন্দির ছিল। ধুমধাম করে শ্যামরায়ের দোলযাত্রা পালন করা হত, প্রতি বছর। কাছাকাছি একটি বাজারে দোলের সময় কিনতে পাওয়া যেত কুমকুম আবির। সেই থেকেই এই বাজারের নামকরণ হয় লালবাজারতা ছাড়া শ্যামরায়ের মন্দিরে দোলখেলার পর প্রচুর মানুষ পাশের দীঘিতে স্নান করতেন। ফলে সেই জলের রং দোলের রঙে লাল হয়ে উঠত । সেই থেকে দীঘির নাম হয় লালদীঘিপাথুরিয়াঘাটা ঘোষ পরিবারে এক শরিক ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ-মন্মথনাথের বাড়ির দোল-উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে। অপর শরিক খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়ির দোল আরম্ভ হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। এই দুই শরিকের দোলের আচার-অনুষ্ঠান প্রায় একইরকম। দোলের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা বেশ জাঁকজমক করেই হয় মেড়া পোড়ানোর অনুষ্ঠান চাঁচর। খড়ের তৈরি হোলিকা বা মেড়া পোড়ানোর পর বসে গান-বাজনার আসর। কিন্তু শোভাবাজার দেবপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেবের ছেলে রাজকৃষ্ণের পরিবারের গৃহদেবতা গোপীনাথ জিউএবং  দত্তকপুত্র গোপীমোহনের পরিবারের গৃহদেবতা গোবিন্দ জিউ’-কে ঘিরেই এই দুই শরিকের দোল-উৎসব আবর্তিত হয়। তবে দুই পরিবারের দোল একই দিনে হয় না। রাজকৃষ্ণের পরিবারের গোপীনাথ জিউয়ের দোল আগে, আর পরের দিন হয় গোবিন্দ জিউয়ের দোল। দুই বাড়িতেই প্রস্তুতি অবশ্য আরম্ভ হয়ে যায় দোলের বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই। এই সময়ে গৃহদেবতার সিংহাসন সাজানোসহ পুজোর উপাচার সংগ্রহ এবং অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নের জন্য মিষ্টান্ন প্রস্তুতি ইত্যাদি নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন দেবপরিবারের সদস্যেরা। তবে এখন কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলির দোল-উৎসবের জাঁকজমকেও চরমভাবে ভাটা পড়ে গেছে। পুরোনো জমিদারি আমলে যে বৈভব ছিল এখন কারোরই আর প্রায় তা নেই। স্বাভাবিক কারণেই আগেকার মতো উৎসব এখন করা সম্ভব হয় না। আগের মতো লোকজনও আর হয় না। এখন কেবলই নিয়মরক্ষা।
বাংলায় দোলের আগের দিন চাঁচরউদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়। অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সংপৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু উদযাপনের রীতি এক । ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন। দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব । নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ ও জৈমিনী মীমাংসা’-য় রং উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকোৎসবপালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক রত্নাবলী’-তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে।এমনকি আলবিরুনির বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোন্ কোন্ অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হতেন । মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলির অন্যতম প্রধান বিষয় রাধাকৃষ্ণের রং উৎসব। ইংরেজরা প্রথমদিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ল্যুপেরক্যালিয়াহিসাবেই মনে করেছিল। অনেকে আবার একে গ্রিকদের উৎসব ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করত। কিন্তু এ ছিল একেবারেই এক দেশি উৎসব -- প্রাণের উৎসব, আনন্দের উৎসব। বাৎসায়নের কামসূত্র’, যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতেও এই উৎসবের উল্লেখ আছে। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের রত্নাবলীএবং অষ্টম শতকের মালতী-মাধবনাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের কালবিবেকও ষোড়শ শতকের রঘুনন্দনগ্রন্থেও হোলি উৎসবের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
রং-আবির মেখে উচ্ছ্বাস বা উদ্দামতার প্রকাশ এবং এর মধ্যে অল্প বা পরিমিত নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠতা। এই রং খেলার দিনে অনেক নরনারী একে-অপরের শরীর স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতি লাভ করে। এই রং খেলার দিনে অনেক নরনারী একে-অপরে শরীরী-সম্পর্ক সম্পন্ন করে ফেলে জীবনে প্রথমবার। বস্তুত দোল বা হোলির উৎসব যতখানি-না ধর্মীয়, তার থেকে অনেক অনেক বেশি সামাজিক। নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠতা এখানে সমাজ-স্বীকৃত, এবং তা খানিকটা শাস্ত্রসম্মত পথেই। বঙ্গদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারের ফলে রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বসন্তের রাসলীলা ও হোলি সমার্থক হয়ে গেছে। বাঙালির দোল বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত একটি উৎসব হলেও রবীন্দ্রনাথ দোলযাত্রার ধর্মীয় অংশকে বাদ দিয়ে তার সাংস্কৃতিক দিকটিকে নিয়ে দোলযাত্রা’-কে বসন্ত উৎসব’-এ রূপান্তরিত করলেন। খানিকটা সেই সূত্র ধরেই দোল আমাদের কাছে প্রীতির উৎসব, প্রেমের উৎসব।
শোনাই ইতিহাসের কথা। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মাচারের বিরুদ্ধে একটি বিপ্লব ঘটতে দেখা যায় স্বাধীন সুলতানি বাংলায় এসে। সেন আমলে আচারসর্বস্ব শ্রেণিভেদে জর্জরিত এক পাটাতনের উপর নির্মিত হয়েছিল বাংলার ধর্মচর্চার ভিত্তি। মন্দিরের একচ্ছত্র সম্রাট ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম্য এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে এ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। বখতিয়ার খলজির হাতে সেনদের পতনের পাশাপাশি সুফিবাদী ধর্মাচার ধীরে ধীরে গ্রাস করেছিল বাংলার মানুষের চিন্তাজগৎ। সময়ের আবর্তে মুসলিম সমাজের বিস্তৃতিতে একদিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম। কুল-বংশ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সহজিয়া বৈষ্ণববাদ প্রচার করতে শুরু করেন শ্রীচৈতন্য। তখনকার চৈতন্য অনুসারী কর্তৃক দোলকে হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসাবে বিবেচিত হলেও এখানে আলাদা একটা মাহাত্ম্য যোগ করেছেন । এ উৎসবকে হোলি নামেও অভিহিত করা হয়। কিন্তু ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, প্রথমদিকে ধর্মাচারে দোল ও হোলি ছিল দুটি ভিন্ন অনুষঙ্গ। সময়ের পরিবর্তনে দুটি উৎসব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে একই শিরোনামে। এখন দোল আর হোলি যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সনাতন ধর্ম মতে, দোল উৎসবের দেবতা হিসেবে সূর্য, বিষ্ণু, মদনমোহন ও শ্রীকৃষ্ণের পরিচয় মেলে। উৎসবের প্রধান অঙ্গ শত্রু নিধনের প্রতীকরূপে দেবতার গায়ে আবির মাখানো হয়। 'ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে' বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খচূড় বধের কাহিনি সামনে রেখে বহ্ন্যুৎসব হয়। শঙ্খচূড় দৈত্যের নানা রূপের একটি হিসাবে দোল উৎসবে ক্ষীর-পিটুলি দিয়ে মেষাসুর তৈরি করে তা পোড়ানোর অন্যতম দিক। তবে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বহ্ন্যুৎসবে হোলিকা রাক্ষুসীর কুশপুত্তলিকা দাহ করার রীতি প্রচলিত আছে। দোল উৎসবের এ অংশ শ্রীকৃষ্ণের পুতনাবধের স্মৃতি জাগিয়ে দেয়। পুরাণের কাহিনি অবলম্বনে মহারাষ্ট্রের যোদ্ধারা যুদ্ধে নিহত বীরদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য অগ্নিশিখা বেষ্টন করে নাচ-গান করত। তারা বসন্তকালকে যুদ্ধযাত্রার সেরা সময় ভেবে হয়তো প্রথম দিকে এ উৎসবের আয়োজন করেছিল। আর বাংলাদেশে এ অনুষ্ঠান শুরুর ইতিহাসটা বেশি দিনের নয়। যতদূর জানা যায়, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা জমিদারবাড়িতে খুব জাঁকজমকভাবে দোলযাত্রা পালিত হত। এখানকার উৎসবে পূজার্চনার পরে বিকাল হতেই আবির খেলা শুরু হত। একইভাবে দ্বিতীয় দিন সকাল থেকে টানা ২৪ ঘণ্টা আবির খেলা হতো। তৃতীয় দিন সকালে স্নানের আগ পর্যন্ত রং খেলে দোল উৎসব সমাপ্ত হত। ভারতে হোলির আসল রং বোধহয় আছে উত্তরপ্রদেশে। মথুরা, বৃন্দাবন, বরসন, নন্দগাঁও, এলাহাবাদে হোলিতে পৃথিবীর রং এসে মিশে যায়।
বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক মেহেদী হাসান পলাশ   মনে করেন, “সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হোলি উৎসব। ইতিহাস ও উৎপত্তি বিচারে হোলি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। হোলি উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, অবতার শ্রীকৃষ্ণ একদা বৃন্দাবনে রাধা ও তার সখীদের সঙ্গে লীলারত ছিলেন। সে সময় হঠাৎ শ্রী রাধার রজঃস্রাব শুরু হয় এবং তাতে তার বসন রঞ্জিত হয়। এতে করে শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে পড়েন। এ সময় শ্রীকৃষ্ণ রাধার লজ্জা ঢাকতে এবং বিষয়টি তার সখীদের নিকট গোপন করতে শ্রীরাধা ও তার সখীদের সঙ্গে আবির খেলা শুরু করেন এবং তাদের আবির দিয়ে রাঙিয়ে দেন। শ্রীকৃষ্ণ, রাধা ও তার সখীদের এই আবির খেলার স্মরণে হিন্দুসমাজে হোলি উৎসবের প্রচলন হয়েছে। উৎপত্তি যে প্রকারেই হোক, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই উৎসব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পালন নিয়ে কোনো আপত্তি ওঠেনি কোথাও। কিন্তু মুসলিম সমাজে যখন এই উৎসব পালিত হতে শুরু করে তখন তা নিয়ে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ উদ্বিগ্ন না-হয়ে পারে না
হোলি বা দোলকে কেন্দ্র করে একসময় বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্র সহ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় হোলির গান থাকত, থাকত হোলির বর্ণাঢ্য দৃশ্যায়ন। দাদার কীর্তিসিনেমাতে ছ্যারা রা রা ছ্যারা রা রা”,  ‘একান্ত আপনসিনেমাতে খেলব হোলি হোলি রং দেব না তাই কখনো হয়”, ‘শোলেসিনেমার 'হোলি কে রং মে দিল মিল যাতে হ্যায়', ‘সিলসিলাছবিতে 'রং বারসে ভিগে চুনার ওয়ালি রং বারসে' গানগুলি পেয়েছি। অবিস্মরণীয় এই গানগুলো ভারতীয় চলচ্চিত্রের পর্দায় উপমহাদেশে রঙের উৎসব হিসাবে পরিচিত হোলির প্রাণবন্ত রূপ প্রতিষ্ঠা করেছে। হোলির দিন এখনও ভারতের অলিগলিতে, এমনকি এ দেশেও এফএমে এবং দূরদর্শনে সারাদিন ধরে এই গানগুলো শুনতে পাওয়া যায়। হিন্দি চলচ্চিত্র তো বটেই, ভারতীয় চলচ্চিত্রের একেবারে শুরু থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ পর্যন্ত, কারণে-অকারণে ছবিতে একটি হোলি সংগীত থাকত। এখনও হোলির গান বলতে সবাই 'মাদার ইন্ডিয়া' ছবির 'হোলি আয়ি রে', 'নবরং' ছবির সেই বিখ্যাত 'আরে যা রে হাট নাটখাট', 'কাটি পতঙ্গ' ছবির 'আজ না ছোড়েঙ্গে হামজোলি, খেলেঙ্গে হাম হোলি' গানগুলো গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন। কিন্তু হঠাৎই বেশ কিছু বছর ধরে ভারতীয় বিশেষ করে বলিউড ছবিগুলি থেকে হোলির দৃশ্য এবং গান ভ্যানিস হয়ে গেছে। একসময় বলিউড ছবির এই নিয়মিত 'আইটেম'টি সর্বশেষ রূপ দেখা গেছে, ২০০৫ সালের 'ওয়াক্ত_দ্য রেস অ্যাগেইনস্ট টাইম' ছবিতে। 'ডু মি এ ফেভার লেটস প্লে হোলি' গানটিতে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া এবং অক্ষয় কুমার হোলির রঙে সিক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে বলিউড দর্শকরা ছবিতে আগের মতো করে হোলির গান ও দৃশ্য খুঁজে পাননি। কেন-না এখন খুব কম বলিউড ছবিরই শুটিং ভারতে হয়, বিদেশের মাটিতে অকারণে হোলির গান দেখানো একটু জটিল। ফলে হোলি নিয়ে তেমন একটা ভাবছেন না পরিচালকরা। কাহিনিকাররাও তাই হোলি বা অন্যান্য ভারতীয় উৎসব গল্পে আনছেন না। পরিচালক-প্রযোজকরা মনে করেন বর্তমান হিন্দি ছবির কাহিনি দিনকে-দিন আধুনিকতার দিকে যাচ্ছে, এখনকার কাহিনির পটভূমি, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত নয়, মহা উচ্চবিত্তদের ঘিরে তৈরি হচ্ছে। ফলে এ ধরনের কাহিনিতে হোলির গান আসাটা অনেকটাই কঠিন। তিনি বলেন, কাহিনি অতিরিক্ত আধুনিক হওয়াতে এতে কোনো উৎসবই আসছে না। এতদসত্ত্বেও এখন অত্যন্ত বড়ো বাজেটের ছবি তৈরি হচ্ছে। ফলে ছবি নির্মাণে এর ব্যাবসায়িক দিকটা চিন্তা করতে হয়। বাজারজাত করার জন্য সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অতএব কোনো নির্দিষ্ট উৎসবকে চিন্তা করে সে বিষয়ের গান প্রযোজকরা রাখতে চান না।
যাই হোক, শেষ কথা বলে শেষ করব এই নিবন্ধ। যতদিন যাচ্ছে মানুষ তত অসভ্যতামি এবং নোংরামোর দিকে এগিয়ে চলেছে। আবির খেলা কি জিনিষ মানুষ ভুলে গেছে। উলটে তারা এখন রঙের মধ্যে মোবিল, পেট্রোল বা ব্যাটারির কেমিক্যাল মিশিয়ে দিচ্ছে, যা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কখনো-কখনো এগুলি জীবনদায়ীও হয়ে ওঠে। ফলে মানুষ দোল খেলতে গিয়ে হাসপাতালেও অ্যাডমিশন নিতে হয়। মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ছে, কিংবা অঙ্গহানি হচ্ছে। ধর্ষণের মতো ঘটনাও সংঘটিত হয় এই রং খেলার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে। প্রভাত রায়ের প্রতিকারছবিতে এমনই এক দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। এছাড়া আর-একটা জিনিস তো আছেই। বোতল! ওটা না খেলে নাকি সমাজে স্ট্যাটাস থাকে না। অথচ এই বোতল খেয়ে মাতলামি করতে গিয়ে পুলিশের লাঠির ঘা খেয়ে যখন পড়ে তখন স্ট্যাটাস কোথায় যায়? এই ধরনের নোংরামো থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদের যথেষ্ট পরিমাণে সচেতন হতে হবে। কোথাও এইধরনের ঘটনা ঘটলে কড়াভাবে তা দমন করতে হবে। তা না হলে কিন্তু এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুব মুশকিল। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই যখন দেখি রং খেলার দিন সমস্ত লাইসেন্স প্রাপ্ত মদের দোকানগুলি সব সারাদিন বন্ধ থাকে। কেন ? পাবলিক মদ কিনে খেতে পারবে না বলে ! অথচ রং খেলার আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত মদ কেনাবেচা চলে। পরদিন সেগুলি গলাধঃকরণ করে পথেঘাটে পায়তারা। হ্যাঁ, মানুষ এখন একটু হলেও সচেতন হয়েছে। কোথা থেকে যেন মনে হচ্ছে দোলের সেই ফ্লেবারটা আবার ফিরে আসছে আমাদের এই শহর কলকাতায়, জেলায় জেলায়, শহরতলীতে। ফুলের পাপড়ি আর পরাগরেণু দিয়ে আবার আবির বানানো হচ্ছে। মানুষ আবার আবির খেলায় মেতে উঠেছে।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------

তথ্যসুত্র : (১) দোললীলা ও হোরি বা হোলি খেলা, কাননবিহারী গোস্বামী। (২) শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন: সংক্ষিপ্ত পরিচয়, অনাথনাথ দাস  (৩) দোল, গৌতম বসুমল্লিক

কোন মন্তব্য নেই: