বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

জীবনের শেষ স্টেশন এবং তারপর.........


"মরণ রে,/তুঁহুঁ মম শ্যামসমান/মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট,/তাপবিমোচন করুণ কোর তব/মৃত্যু-অমৃত করে দান।/তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।।/মরণ রে,/শ্যাম তোঁহারই নাম।........" -- রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত এই মৃত্যু বিষয়ক কবিতা দিয়েই শুরু করি মৃত্যু, মৃত্যুকালীন ব্যবচ্ছেদ এবং আমরা মানুষ নাম প্রাণীকুলপ্রবন্ধটি।
মৃত্যু ! ছোট্ট একটি শব্দ। এই সেই শব্দ, যা আমাদের নিয়ে যায় অজানা কোনো রাজ্যে, যার সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে কত না কষ্ট! যখন মৃত্যুর ডাক এসে যায়, প্রিয়তমা স্ত্রী, আদরের সন্তানেরা, বাবা-মা কেউ তাদের বন্ধন দিয়ে ধরে রাখতে পারে না আমাদের। ক্ষণিকের জীবন, তা সত্ত্বেও কত সুন্দর করে আমরা সাজাতে চেয়েছি আমাদের জীবন, কত পরিকল্পনা ছিল -- সব মিলিয়ে যায় মাত্র দুটি অক্ষরের এই শব্দের দ্বারা। আমরা প্রতিদিন এই মৃত্যুকে কত আপনভাবে নিজের সঙ্গে বয়ে বেড়াই আমরা নিজেরাও জানি না।জীবদ্দশায় মৃত্যু কী আমাদের যারপরনাই বিব্রত করে না ! আমরা এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব মৃত্যু কী ? মৃত্যু কীভাবে ? মৃত্যু কেন ? মৃত্যুর পরে কী? মৃত্যুর পরে কী কিছু আছে ? নাকি মৃত্যুই শেষ ? আবার শুধু মৃত্যুতেই শেষ নয়, মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, জাতিস্মর ইত্যাদি বিষয়। স্মতর্ব্য, মানুষ ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য মানবেতর প্রাণীরা জন্ম-মৃত্যু নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়। মৃত্যু যেভাবে মানুষকে বিব্রত করে তেমন অন্য প্রাণীর হয় না। কারণ মানবেতর প্রাণীরা মানুষের মতো বিচক্ষণ নয়।তাই মৃত্যুকে ঘিরে মানুষের সমাজে অনেক মিথ এবং সংস্কার প্রচলিত আছে, যা সমগ্র মানবজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

মৃত্যু কী ? মৃত্যু (Death) বলতে জীবনের সমাপ্তি বোঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোনো জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। অন্য কথায়, মৃত্যু হচ্ছে এমন একটি অবস্থা  যখন সকল শারিরীক কর্মকাণ্ড যেমন শ্বসন, খাদ্যগ্রহণ, পরিচলন, ইত্যাদি থেমে যায়। কোনো জীবের মৃত্যু হলে তাকে মৃত বলা হয়। মৃত্যু বিভিন্ন স্তরে ঘটে থাকে। সোমাটিক মৃত্যু হল সামগ্রিকভাবে কোনো জীবের মৃত্যু। নির্দিষ্ট অঙ্গ, কোশ বা কোশাংশের মৃত্যুর আগেই এটি ঘটে। এতে হৃৎস্পন্দন, শ্বসন, চলন, নড়াচড়া, প্রতিবর্ত ক্রিয়া ও মস্তিষ্কের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। সোমাটিক মৃত্যু ঠিক কখন ঘটে তা নির্ণয় করা দুরূহ, কেন-না কোমা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, এবং ঘোর বা ট্রান্সের মধ্যে থাকা ব্যক্তিও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে থাকেন। সোমাটিক মৃত্যুর পর অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটে যা থেকে মৃত্যুর সময় ও কারণ নির্ণয় করা যায়। মারা যাওয়ার পরপরই পার্শ্ববর্তী পরিবেশের প্রভাবে দেহ ঠান্ডা হয়ে যায়, যাকে বলে Algor mortisমারা যাওয়ার পাঁচ থেকে দশ ঘণ্টা পরে কংকালের পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়, যাকে বলে Rigor mortis এবং এটি তিন-চার দিন পরে শেষ হয়ে যায়। রেখে দেওয়া দেহের নীচের অংশে যে লাল-নীল রং দেখা যায়, তাকে বলে Livor mortis; রক্ত জমা হওয়ার কারণে এমন হয়। মৃত্যুর খানিক বাদেই রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। আর তারপরে দেহের যে পচন শুরু হয়, তার জন্য দায়ী এনজাইম ও ব্যাক্টেরিয়া। দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্ন হারে মারা যায়। সোমাটিক মৃত্যুর ৫ মিনিটের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোশগুলির মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে হৃৎপিণ্ডের কোশগুলি ১৫ মিনিট এবং বৃক্কেরগুলি প্রায় ৩০ মিনিট বেঁচে থাকতে পারে। এই কারণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদ্যমৃত দেহ থেকে সরিয়ে নিয়ে জীবিত ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।

এতদিন মৃত্যু বলতে হৃৎক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যাওয়াকেই বোঝাত। কিন্তু অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ১৯৯৪কার্যকর হওয়ায় বদলে গেছে মৃত্যুর ধারণা। “Brain Death” বা মস্তিষ্কের মৃত্যু”-তেই এখন কেবল কোনো মানুষকে মৃত বলা যাবে। কোনো মানুষের ব্রেন ডেথ হয়েছে কী হয়নি, তা ঠিক করতে দুজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের লিখিত অভিমত বাঞ্ছনীয়। এরপর যন্ত্রাদি দ্বারা পরীক্ষিত নথিভুক্ত ফলাফলও যদি ওই অভিমতের পক্ষে যায়, তাহলেই কেবলমাত্র ব্রেন ডেথহয়েছে বলে ধরা হবে। তবে ওই দুই চিকিৎসক কোনোভাবেই সংস্থাপক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। মস্তিষ্ক মৃত্যুঘোষণা করার আগে দেখে নিতে হবে রোগী যেন কোনোরকম নিস্তেজক বা ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী না হন।
ব্রেন ডেথবা মস্তিষ্ক মৃত্যুবলতে আসলে ব্রেনস্টেমের মৃত্যুকে বোঝায়। প্রকৃত মৃত্যুমস্তিষ্ক মৃত্যুর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। প্রকৃত মৃতদেহে ধমনীপ্রবাহ থাকে না। শ্বাস-প্রশ্বাসের লক্ষণ থাকবে না, হৃদস্পন্দনের আওয়াজ থাকবে না এবং বাইরের উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া থাকবে না। এই ধরনের মৃত্যুকে বলা হয় কার্ডিওরেসপিরেটরি ডেথমস্তিষ্ক মৃত্যুএর থেকে আলাদা। আমাদের চেতনা, শ্বাস-প্রশ্বাস ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কার্যের কেন্দ্রবিন্দু হল মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের যে বিশেষ অংশ দ্বারা এই জরুরি কাজগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় তাকেই বলে ব্রেন স্টেমবা মস্তিষ্ক কাণ্ডএই অংশের মৃত্যু হলে মানুষকে আর বাঁচানো যায় না। অনেক রোগী দেখা গেছে, যাঁরা অজ্ঞান হয়ে আছেন, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু তাঁদের হৃৎপিণ্ড কাজ করে যাচ্ছে। এই অবস্থায় যদি কৃত্রিমভাবে শ্বাসকার্য ও হৃৎপিণ্ডকে সচল রাখা যায় তাহলে একসময় দেখা যাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর যন্ত্র ছাড়া হাজার চেষ্টা করলেও শ্বাস-প্রশ্বাস আর ফিরবে না এবং মস্তিষ্কের কেন্দ্রবিন্দু আর সজাগ হবে না। হৃৎপিণ্ডের নিজস্ব সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা থাকার ফলে এমন ক্ষেত্রেও হৃৎপিণ্ড তার কাজ চালিয়ে যেতে পারে এবং ধমনীপ্রবাহ সচল থাকতে পারে। এই অবস্থাকেই আমেরিকায় ব্রেন ডেথএবং ইংল্যান্ডে ব্রেনস্টেম ডেথবলে।

মৃত্যুর পরে শরীরে ধীরে ধীরে পচন ধরতে শুরু করে-- এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকে পচন ধরা পর্যন্ত কী কী শারীরিক পরিবর্তন হয় বা কোন্ কোন্ পথ ধরে শরীর পচতে শুরু করে, তা কি জানা আছে? চিকিৎসাশাস্ত্র মতে মৃত ঘোষণার অর্থ এই নয় যে, শরীরের প্রতিটি কোশের মৃত্যু হয়েছে। হৃদযন্ত্র পাম্প করা বন্ধ করলে, কোশগুলি অক্সিজেন পায় না। মস্তিষ্কে শেষ মুহূর্তে সক্রিয়তার ঢেউ খেলে যায়, এর পরই 'সবকিছু অন্ধকার'অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ হলে পেশিগুলি শিথিল হতে শুরু করে। পাশাপাশি অন্ত্র এবং মূত্রস্থলী খালি হতে শুরু হয়। শরীরের মৃত্যু ঘটলেও, অন্ত্র, ত্বক বা অন্য কোনো অংশে বসবাসকারী ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়া তখনও জীবিত থাকে। মৃত্যুর পর শরীরের অভ্যন্তরে যা ঘটে, সে সবের পিছনেই এই ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়ার যোগদান থাকে। মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম শরীরে কোনো পরিবর্তন আসে? প্রথমেই হয় অ্যালগর মরসিট ঘরের তাপমাত্রায় না-আসা পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট কমতে থাকে। লিভোর মরটিস বা লিভিডিটির ক্ষেত্রে শরীরের নিম্নাংশে রক্ত এবং তরল পদার্থ জমা হয়। ব্যক্তির ত্বকের আসল রঙের ভিত্তিতে তা ধীরে ধীরে গাঢ় বেগুনি-নীল রঙে পরিবর্তিত হতে শুরু করে।রিগর মরটিস- শেষে শরীরে রিগর মরটিস হয়, এ ক্ষেত্রে অত্যধিক ক্যালসিয়াম ক্ষরণের ফলে পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়। ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই অবস্থা থাকে। রিগর মরটিসের সময় চোখ খোলা থাকলে, বেশ কিছু ক্ষণের জন্য মৃতের চোখ খোলাই থাকে। এর পর শরীরে পচন ধরতে শুরু করে। রক্ত চলাচল বন্ধ হলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের গঠন শুরু হয়, অম্লের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর ফলে কোশগুলিতে ভাঙন ধরে। ২-৩ দিনে শরীর পচতে থাকে। পরিপাক নালিতে থাকা ব্যাক্টেরিয়া এবং আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তলপেট সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং তাতে গ্যাস তৈরি হয়। তার চাপে শরীরের মল-মূত্র নিষ্কাশিত হয়। পিউট্রেসিন এবং ক্যাডাভেরিনের মতো জৈবিক যৌগ শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়লে, দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করে। এই গন্ধই মৃতদেহের অন্যতম বৈশিষ্ট। নেক্রোসিস পদ্ধতিতে এরপর শরীরের রং সবজেটে থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। মৃতদেহের দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমায় উচ্ছিষ্টভোগী পোকামাকড়। মৃত শরীরকে খাদ্যভাণ্ডার হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়াও, এই সমস্ত পরজীবী কীট সেখানে ডিমও পাড়ে। ডিম ফুটে বেরোনো শূককীট মাত্র এক সপ্তাহে শরীরের ৬০ শতাংশ নিকেশ করতে পারে।
এ তো গেল শুধু প্রথম সাতদিনের বৃত্তান্ত। এর পর ধীরে ধীরে প্রাণহীন মানবদেহ ক্রমে মাংস-চামড়ার খোলস ত্যাগ করে পরিণত হয় হাড় সর্বস্ব কঙ্কালে।
মৃত্যু, কিন্তু মৃত্যু নয়। এক অনন্তকালের ফিরে আসার অপেক্ষা। দু-একজন ফিরলেও, অনেকেই ফেরে না। এমন দুর্বিষহ এবং ব্যয়বহুল অপেক্ষার অবসান হয় একদিন। সেই অবস্থার নাম কোমা, কোমাচ্ছন্ন এবং কোমাচ্ছন্নতা।

কোমা কী ? কোমা মৃত্যুর কোন্ অবস্থাকে বোঝায় ? Wikipedia বলছে, “In medicine, a coma is a state of unconsciousness lasting more than six hours in which a person: cannot be awakened; fails to respond normally to painful stimuli, light, or sound; lacks a normal sleep-wake cycle; and, does not initiate voluntary actions. A person in a state of coma is described as being comatose.
A comatose person exhibits a complete absence of wakefulness and is unable to consciously feel, speak, hear, or move. For a patient to maintain consciousness, two important neurological components must function. The first is the cerebral cortex—the gray matter that covers the outer layer of the brain. The other is a structure located in the brainstem, called reticular activating system (RAS). Injury to either or both of these components is sufficient to cause a patient to experience a coma. The cerebral cortex is a group of tight, dense, "gray matter" composed of the nuclei of the neurons whose axons then form the "white matter", and is responsible for perception, relay of the sensory input (sensation) via the thalamic pathway, and many other neurological functions, including complex thinking. RAS, on the other hand, is a more primitive structure in the brainstem that is tightly in connection with reticular formation (RF). The RAS area of the brain has two tracts, the ascending and descending tract. Made up of a system of acetylcholine-producing neurons, the ascending track, or ascending reticular activating system (ARAS), works to arouse and wake up the brain, from the RF, through the thalamus, and then finally to the cerebral cortex. A failure in ARAS functioning may then lead to a coma.”
যুক্তরাষ্ট্রের সান্তাক্রুজ শহরের ৩৯ বছর বয়স্ক এক মহিলা কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। মহিলাটি প্রায় ৭০ দিন যাবৎ কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন।সেই অবস্থাতেই সিজার করে শিশুটিকে প্রসব করানো হয়। মেলিসা স্কারলেট নামের এই ৩৯ বছর বয়সি মহিলাটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেমিকোমাটেজ অবস্থায় আছেন।
কোমা থেকে ফিরে এসে বিদেশি ভাষায় অনর্গল কথা বলে যাওয়া ! বাস্তবে সম্ভব ?
বাস্তব ঘটনাগুলি নিরীক্ষণ করা যাক -- তার নাম বেন মেকমাহন। বয়স যখন ২২ তখন সে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কোমায় চলে যায়। অন্তত এক সপ্তাহ লেগেছিল তার ওই স্থবির অচলায়তন পরিধি থেকে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার জন্য। আর যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন নিবাসী এই তরুণ পুরোপুরি ভুলে গেছে নিজের মাতৃভাষা ইংরেজি। সবাই অবাক হয়ে শুনতে থাকল তার মুখে ইংরেজির পরিবর্তে চৈনিক ভাষা। জানা গেছে, বেন কেবল তার স্কুলেই অল্পবিস্তর চিনের মান্দারিন ভাষা শিখেছিল। কিন্তু সেটা বলা কিংবা লেখার জন্য যথেষ্ট নয়। অথচ কোমা থেকে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর বেন চিনা ভাষায় স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে শুরু করে। তার চিকিৎসকরা জানান, সে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল সেখান থেকে তার বেঁচে ফিরে আসাটা অনেক বড়ো ব্যাপার।বেন তার কোমা থেকে জেগে উঠার মুহূর্তটি স্মরণ করতে পারে। সে সময় সে দেখেছিল এশীয়দের মতো একজন সেবিকা (নার্স) তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে নার্সকে ডেকে চিনা ভাষায় জানালো, ক্ষমা করবেন, আমি এখানে সুস্থবোধ করছি না।এরপর সে নার্সকে একটা কলম এবং কাগজ আনতে বলে। নার্স এনে দিলে বেন তাতে মান্দারিন হরফে লিখে, ‘আমি মাকে ভালোবাসি, বাবাকে ভালোবাসি, আমি সুস্থ হয়ে উঠব।বেনের বাবা-মা তখন ছেলে বেঁচে গেছে তাতেই খুশি। মজার ব্যাপার হল পরবর্তী সে চিনের সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগে পড়ছে।
এ ধরনের ঘটনা কেবল তার ক্ষেত্রেই ঘটেনি। রয়েছে আরও নজির। ২০১০ সালের কথা। সে বছর এ রকম কোমায় থাকার পর ১৩ বছরের ক্রোশিয়ান এক বালিকা যখন জেগে উঠল তখন সে পুরোপুরি জার্মানি ভুলে গিয়ে নিজের গ্রামীণ ভাষা বলা শুরু করল। আবার খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, গেল বছর ২০১৩ সালে এক আমেরিকান নেভিকে তার মোটেল রুম থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সাময়িক কোমা বা চেতন ফেরত পাওয়ার পর দেখা গেল সে আর নিজেকে চিনতে পারছে না। এমনকি সে সুইডিশ ভাষায় কথা বলা শুরু করেছে।
বিদেশি জার্মান ভাষাশিক্ষায় সবে হাতেখড়ি। থেমে থেমে পড়া, কিছু কিছু লেখা আর আধো আধো বুলি পর্যন্তই দৌড়। এরই মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে যাওয়া। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই কোমাই যেন তাকে রাতারাতি জার্মান ভাষা শিখিয়ে দিয়েছে। এখন সে জার্মান ভাষা এতটাই অনর্গল বলা শুরু করেছে যে নিজের ভাষাই ভুলে গেছে সে। ক্রোয়েশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় কেনিন শহরের ১৩ বছর বয়সি এক মেয়ের জীবনে ঘটে গেছে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা। শিশুটির অভিভাবকেরা জানান, শিশুটি সবে একটি বিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে। তবে অনর্গল কথা বলা দূরে থাক, ভাষাটি এখনও খুব একটা শেখা হয়ে ওঠেনি তার। শিশুটির পরিবার জানায়, সম্প্রতি আকস্মিক অসুস্থ হয়ে সে কোমায় চলে যায়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা সে কোমায় ছিল। তবে কোমা থেকে ফেরার পর সে মাতৃভাষা ভুলে যায়। আর শুদ্ধ জার্মানিতে কথা বলা শুরু করে। কেবি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা দাবি করেন, ঘটনাটি একেবারেই ব্যতিক্রম। বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছেন। হাসপাতালের পরিচালক দুজোমির মারাসোভিক বলেন, “এভাবে স্নায়ুরোগ (ট্রমা) থেকে সেরে উঠে মস্তিষ্ক কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, আপনি কখনোই তা জানবেন না। তবে ওই ঘটনায় অবশ্যই আমাদের কিছু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছেমনস্তত্ত্ববিশেষজ্ঞ মিজো মিলাস বলেন, “আগে এ ধরনের ঘটনাকে অলৌকিক আখ্যা দেওয়া হত। তবে আমরা মনে করি, এর অবশ্যই যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। যদিও আমরা এখনও তা খুঁজে পাইনি
কোন ধর্মের মানুষ কেমনভাবে মৃতদেহের সৎকারে বিশ্বাস করেন, সেটা দেখা যাক। মিশরীয়রা : প্রাচীনকালে মিশরীয়রা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত, মৃত্যুর পরও তাদের আত্মা বেঁচে থাকে। কাজেই পরবর্তী জীবনে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, জীবনটাকে যাতে উপভোগ করা যায়, সে চিন্তায় মিশরীয়রা অস্থির থাকত। ব্যক্তির গুরুত্বের উপর নির্ভর করে গুরুত্ব আরোপ করা হত এ ব্যাপারে। ব্যক্তি যত গুরুত্বপূর্ণ হত এ কাজে গুরুত্ব তত বেশি বেড়ে যেত। পরবর্তী জীবনের আরাম-আয়েশের জন্য স্বভাবতই ফারাওদের ব্যাপারেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। ক্ষমতায় আসা নতুন ফারাওয়ের প্রথম কাজ সম্পন্ন করা। প্রত্যেকেই চাইতেন বিশাল আয়তনের হোক তার সমাধিক্ষেত্র। অনেকেই মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যেত। এসব সমাধিক্ষেত্র আসলে মৃতের আত্মার ঘর। মিশরীয়রা মনে করত, লাশ বা মৃতদেহ টিকে থাকার উপরই নির্ভর করে আত্মার বেঁচে থাকা বা ফিরে আসা। এ কারণেই মৃতদেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মমি করত তারা। আত্মার বেঁচে থাকার জন্য চাই প্রয়োজনীয় নানা জিনিস। তাই নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিশেষ করে খাবার-দাবার মৃতদেহের সঙ্গে দিয়ে দিত তারা। সমাধি-স্তম্ভ প্রধানের দায়িত্ব ছিল দস্যুদের হাত থেকে মৃতদেহ আর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষা করার। কিন্তু কবরে সমাধিত ব্যক্তিটি কত বিপুল পরিমাণ বিত্ত আর ক্ষমতাবান ছিল তা জাহিরের উদ্দেশ্যেও নির্মাণ করা হত পিরামিড। তাই ফারাওদের মৃতদেহের সঙ্গে কবরস্থ করা হত বিপুল ধন-সম্পদ। সমাজের বিত্তশালীদের কবরেও মূল্যবানসামগ্রী দেয়া হত। এমনকি, নিন্মশ্রেণীর মানুষদের কবরেও সামান্য পরিমাণ হলেও কিছু খাবার রেখে দেয়া হত।
খ্রিস্টান ধর্মে সৎকার : খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা মৃতদেহকে কবর দিয়ে থাকেন। এটাই রীতি। প্রাচীন যুগে পোপগণ মৃতের সুখের জন্য স্বর্গের জায়গা বিক্রি করতেন। জমি কিনলে যেমন দলিল থাকে, তেমনই পোপগণও একটা দলিল লিখে দিতেন যাকে Indulgence বা পাপক্ষয়পত্র বলা হত।যখন কোনো ধনী ব্যক্তি স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে পোপকে প্রচুর ধনদৌলত দিত। এবং পোপ জিশুর ও মেরির মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে একপ্রকারের হুন্ডি লিখতেন। কী লেখা থাকত তাতে ? –- “হে ঈশ্বরের বান্দা জিশুখ্রিস্ট ! অমুক ব্যক্তি স্বর্গে যাওয়ার জন্য তোমার নামে আমার কাছে লক্ষ মুদ্রা জমা করে দিয়েছে। সে স্বর্গে উপস্থিত হলে তুমি তোমার পিতার স্বর্গরাজ্যে পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা মূল্যের ভোজ্য পানীয় ও বস্ত্রাদি, পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা মূল্যের বাগানবাড়ি, পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা মূল্যের যান-বাহন-ভৃত্য এবং পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা আত্মীয়স্বজন-ভাই-বন্ধু প্রভৃতির নিমন্ত্রণের জন্য প্রদান করা হবে যাঁরা যত বেশি টাকা পুরোহিত বা পোপদের কাছে জমা দিতে পারবেন তাঁদের পিতা-মাতা-আত্মীয়স্বজন ততবেশি স্বর্গে জমি বা জায়গা পাবেন। তবে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানরা এমন ব্যবস্থাপত্রে রাখেন না, বিশ্বাস রাখেন ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা।
ইসলাম ধর্মে সৎকার : মৃতদেহকে কবর দেওয়া হয় এবং আত্মীয়রা জামাজার নমাজ পাঠ করেন।আত্মীয়-পরিজনদের মৃত্যুর খবর পেলেই মুসলিমগণ মৃতের উদ্দেশ্যে ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নালিল্লাহে রাজেউন বলে থাকেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নালিল্লাহে রাজেউন”, অর্থাৎ -- নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁরই দিকে ফিরে যাব। এরপর সম্মিলিতভাবে মৃতদেহটিকে মাটি (কবর) দেওয়ার পর ৪০ (চল্লিশ) দিনের মিলাদ দেওয়া হয়। এবং লা ইলাহা ইল্লাহ মহম্মদু রসুলাল্লাহ”(আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, মোহম্মদ তাঁর প্রেরিত পুরুষ)-- আয়াতটি বারে বারে পাঠ করা হয়। পুরোহিত নিয়োগে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই মৌলভি বা মাওলানা বা যে-কোনো মুসলিম ব্যক্তি যিনি আয়াতটি জানেন তিনিই পাঠ করতে পারেন। যে ব্যক্তির পিতা বা মাতা বা আত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে তিনি স্বাভাবিক পোশাকই পরবেন, স্বাভাবিক খাদ্যদ্রব্যই গ্রহণ করবেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন আর পাঁচজনের মতো।মুসলিম সম্প্রদায়গণের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে। যেমন – (১) মোহম্মদী এবং (২) হানাফি। পিতা-মাতার মৃত্যু হলে মোহম্মদী সম্প্রদায়গণ লোকজন নেমন্তন্ন করে ভোজ দেন না। এঁদের মত মৃত মানুষের জন্যে আবার ভাত রান্না কেন ? এটা তাঁর কোন্ কাজে লাগবে ? অপরদিকে হানাফি সম্প্রদায়গণ আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব ডেকে ভোজের ব্যবস্থা করবেন।
ইহুদি ধর্মে সৎকার : ইহুদিরা আত্মায় বিশ্বাস করেন না বলে আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে কোনো যাগযজ্ঞ-অনুষ্ঠানাদিও নেই।এঁদের পরলোকবাদেও কোনো বিশ্বাস নেই। মোট কথা, ইহুদিরা ঈশ্বর, অবতার, পুনর্জন্ম, বর্ণভেদ ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে না মৃত্যু এবং মৃতদেহকে কেন্দ্র করে যাগযজ্ঞাদিও করে না।
বৌদ্ধধর্মে সৎকার : বৌদ্ধধর্মে মৃতের সৎকারাদি বৌদ্ধভিক্ষুই করে থাকেন(যে-কোনো বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত হলে তাকে ভিক্ষু পদে উন্নীত করা হয়)। বৌদ্ধরা আত্মাকে নিত্য স্বীকার করে না এবং ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন না।তবে বৌদ্ধরা মনে করেন, মানুষ মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই ব্যক্তির চিত্তপ্রবাহের সংস্কাররাশি যা চুম্বকের মতো গুণসম্পন্ন তা নিকটতম গর্ভের সন্তানের মধ্যে চলে যায়। এইভাবেই তাঁর পুনর্জন্ম হয়। সে কারণে তাঁরা মৃতের কল্যাণে উদ্দেশ্যে কিছু করেন না।
বৈষ্ণবধর্মে সৎকার : বৈষ্ণব মতে মৃতদেহকে সমাধি (কবর) দেওয়াই নিয়ম। একটা গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মৃতব্যক্তিকে যোগাসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মৃতদেহের মাথায় এক মালসা লবণ বা নুন ঢেলে দেওয়া হয়। বৈষ্ণব সম্প্রদায়গণ সাধারণত ১১ দিনের দিন মৃতের আত্মাকে মন্ত্রপুত করে বিষ্ণুলোকে পাঠান।
সাঁওতালি সৎকার : সাঁওতালদের সৎকারে তাদের কেউ মারা গেলে মৃতদেহকে দাহ করে বাড়িতে ফেরার সময় একখণ্ড অস্থি নিয়ে এসে কোনো এক রাস্তার মোড়ে পুঁতে রাখে।এরপর তিন দিনের দিন নির্দিষ্ট অস্থিখণ্ডটি তুলে কেন্দুগাছের তিনটি ডালের মাথায় সরা বসিয়ে সেটার উপর রাখে।গ্রামের মোড়ল বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির নির্দেশমতো মৃতের পুত্র ওই খুঁটির গোড়ায় ফুল, জল প্রভৃতি দিয়ে মৃতককে শ্রদ্ধা জানায়। ওই দিনেই ওখান থেকে অস্থি তুলে নিয়ে যে-কোনো নদীতে দিয়ে দিলেই মৃতের সৎকার শেষ হয়ে যায়। এরপর যে-কোনোদিন সুবিধামতো আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে ভোজের ব্যবস্থা করা।
বৈদিক মতে সনাতন সৎকার : প্রাচীনকালে সমস্ত সনাতনপন্থীরা বেদের নিয়মেই মৃতের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেন। এখনও অনেকে বৈদিক নিয়মেই মৃতকের শেষকৃত্য করে থাকেন। বৈদিক ক্রিয়া মতে শ্রাদ্ধহল শ্রদ্ধা সহকারে যেটা করা হয়(সেই শ্রাদ্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যে মৃত হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, কোনো ব্যক্তির জীবদ্দশাতেই তা করা হয়।জীবিত পিতামাতার সেবা-শুশ্রূষা করার নামই শ্রাদ্ধ।)।বৈদিক নিয়মানুসারে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগে।কী সেই নিয়ম ? কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তাঁকে দাহ করার সময়ে মন্ত্রের মাধ্যমে অগ্নির এবং মৃতদেহের গুণগান করা হয়। মৃতদেহকে শ্মশানে চন্দন, ঘি, অগুরু, তগর, কস্তুরী, মাসা ইত্যাদি সহযোগে কাষ্ঠ দ্বারা দাহ করা হয়। তৃতীয় দিনে মৃতকের কোনো আত্মীয় শ্মশানে গিয়ে চিতা থেকে অস্থি উঠিয়ে সেই শ্মশানের ভূমির কোথাও সেগুলি আলাদাভাবে রেখে দেয়। মৃতকের জন্য আর কোনো কর্ম করা কর্তব্য নয়। কেন-না ভস্মান্তম্ শরীরম্এই যজুর্বেদ মন্ত্রের প্রমাণে স্পষ্ট হয় যে দাহ ও অস্থি সঞ্চয়ণ ব্যতীত মৃতকের জন্য কোনো কর্ম করা কর্তব্য নয়।
অন্ত্যেষ্টিশব্দটি শব্দটি স্বয়ং ঘোষণা করছে মৃতদেহ দাহ করাই পুণ্যকর্ম। অন্ত্যা অর্থে অন্তিম, চরম বা সর্বশেষ এবং ইষ্টি অর্থে যজ্ঞ, শুভকর্ম বা সংস্কার বোঝায়। মৃত্যুর পর বিধিপূর্বক শবদাহ করাই অন্ত্যেষ্টি কর্ম।
পৌরাণিক মতে হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকার : পৌরাণিক শাস্ত্রমতে (আসলে গরুড়পুরাণ মতে) হিন্দু সম্প্রদায়গণ শবদাহ এবং শবদাহান্তে অস্থি গঙ্গায় অস্থি প্রদান। তদুপরি বর্ণ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মেয়াদ যেমন ১০, ১১, ১৫ বা ৩০ দিন পর পুরোহিত ডেকে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করে শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।এরপর মৃতদেহটি যাতে স্বর্গে যান তার জন্য যথাসম্ভব উপায় প্রয়োগ করা হয়। মৃতব্যক্তিকে স্বর্গে যেভাবে পাঠানো যায় তার কয়েকটা বন্দোবস্ত এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।যেমন – (১) মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির কানের সামনে জোরে জোরে গীতা পাঠ করা, (২) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু সম্পন্ন হলে বুকের উপর নামাবলি অথবা গীতা অথবা উভয়ই রাখা হয়, (৩) মৃতদেহ শ্মশান নিয়ে যাওয়ার পথে হরি বলোধ্বনি তোলা, (৪) মৃতদেহ ভস্মীভূত হওয়ার পর অস্থি তুলে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা, (৫) ব্রাহ্মণকে সবৎসা গোরু দান, (৬) মৃতের দোষ কাটানো, (৭) নানাবিধ কারণে প্রায়শ্চিত্ত করা, (৮) যোড়শ দান (শ্রাদ্ধের সময় ব্রাহ্মণকে ১৬টি দ্রব্য দান করলে মৃতব্যক্তি ৯৬০ হাজার বছর স্বর্গে সুখে কাল কাটাতে পারবেন। যতগুলি পুত্র এই অনুষ্ঠান করবেন মৃতব্যক্তি ততগুণ স্বর্গলাভ করবেন। একজন পুত্র হলে ৯৬০ হাজার বছর, ১০ জন পুত্র হলে অবশ্যই ৯৬০০ হাজার বছর), (৯) হেম গর্ভ তিল দান।        (১০) বিলক্ষণা শয্যা দান, (১১) মৃত ব্যক্তির নামে ষাঁড় ছেড়ে দেওয়া, (১২) অতিথি ভোজন, (১৩) ব্রাহ্মনভোজন, (১৪) বাড়িতে কীর্তন বা রামগানের আয়োজন করা, (১৫) গয়ায় পিণ্ডদান, (১৬) সাংবাৎসরিক শ্রাদ্ধ, (১৭) পিতৃতর্পণ ইত্যাদি।
পিণ্ডদানও হিন্দুদের মৃতদেহের একটি সৎকার বিষয়ক ব্যবস্হা। পিণ্ডদানের মাধ্যমে প্রেতলোক থেকে অমৃতলোকে যাত্রা। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস, মৃত আত্মা ঘুরে বেড়ায় মানুষের হাত থেকে জল চেয়ে। অর্থাৎ, বংশের জীবিত কারোর হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করে তবেই আত্মার মুক্তিএ ক্ষেত্রে বংশের কেউ জীবিত না-থাকলেও অন্য কেউ মৃত আত্মার জন্য জল দান করতে পারেন। নিজের আত্মীয়ের পিণ্ডদানের সূচনাপর্বে জীবিতের হাত থেকে জীবজগতের সকল মৃত প্রাণীর (তা সে কীটপতঙ্গ, জন্তুজানোয়ার, এমনকী মৃত বৃক্ষাদি পর্যন্ত) জন্য জলদানের আচার বড়ো বিস্ময়কর। পিণ্ডদানের ধর্মীয় আচারস্থল হিসাবে নদীসঙ্গম, সমুদ্রস্থল, অভাবে বড়ো দিঘি বা পুষ্করিণী বেছে নেওয়া হয়। গয়ায় পিণ্ডদান বিশ্বাসীদের কাছে বিরাট ব্যাপার।এর কারণ হিন্দুপুরাণ । দেবতা বনাম অসুরের দ্বন্দ্ব। মহাদেব হত্যা (বধ ?) করলেন ত্রিপুরাসুরকে।ত্রিপুরাসুরের পুত্র গয়াসুর পুরোনো হিসাব বুঝে নিতে নারায়ণের সঙ্গে শতাব্দীকাল যুদ্ধ করে। কোনো পক্ষই হারছে না, কোনো পক্ষই জিতছে না। এমতাবস্থায় নারায়ণের ইচ্ছেমতো গয়াসুর পাষাণে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এরপর নারায়ণ গয়াসুরের মাথায় পা রাখলেন। তখন থেকেই সেই পদচিহ্নে পিণ্ডদান হয়। আচার-বির্বতনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে এরকম চল্লিশটি বেদিতে পিণ্ডদানের প্রথা চালু আছে।
রামায়ণের নায়িকা সীতাদেবী স্বামী রাম এবং দেবর লক্ষ্মণের অনুপস্থিতিতে ফল্গুনদীর তীরে মৃত শ্বশুরের উদ্দেশে বালির পিণ্ডদান করেন।রাম ও লক্ষ্মণ ফিরে এসে সীতার কাছে পিণ্ডদানের ঘটনায় অবগত হলেন। কিন্তু সীতার বিবৃতি ওরা কেউ বিশ্বাস করলেন না। অবশেষে সীতাদেবী সাক্ষী মানলেন ফল্গু ও বটবৃক্ষদের। এক অজ্ঞাতকারণে ফল্গু নদী ঠিক সাক্ষ্য দিল না। সীতা অভিশাপ দিলেন ফল্গুনদীকে। বললেন, “অন্তঃসলিলা হওসেই থেকেই ফল্গুনদী নাকি মাটির নীচ দিয়ে বয়ে যায়। অপরদিকে বটবৃক্ষ যথাযথ সাক্ষ্য দেওয়াতে সীতার আশীর্বাদে অমরত্ব পায়। সে কারণেই অক্ষয় বটের পাদদেশে পিণ্ডদান কর্মসূচি হয়। যাঁরা দুর্ঘটনা বা আত্মঘাতী বা অপঘাতে মারা যান তাদের জন্য প্রেতশিলায় পিণ্ডদান প্রচলিত। আগ্রহী পাঠকগণ যদি আরও জানতে কৌতূহলী হন, তাহলে গরুড়পুরাণের উত্তরখণ্ডের ষষ্ঠ, ষোড়শ এবং চতুস্ত্রিংশ অধ্যায় পাঠ করতে পারেন।
শব সমাধিস্থকরণ ও শবদাহ এবং একটি অপ্রিয় সত্যভাষণ : প্র্রাচীন ভারতে লোকসংখ্যা ছিল অনেক কম, কিন্তু সেই তুলনায় গাছপালা তথা জ্বালানি ছিল অনেক বেশিকিন্তু বর্তমানে লোকসংখ্যা যেমন অনেক বেশি তেমনই আবার দিন দিন গাছপালা ও জ্বালানিও হ্রাস পাচ্ছে। এখানে যৌক্তিক, মানবিক, ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে শব সমাধিস্থকরণ ও শবদাহের      সুবিধা-অসুবিধাগুলি এখানে উল্লেখ করা যাক – (১) ব্যতিক্রম ছাড়া খুব অল্প খরচে একটি মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খরচ লাগে না বললেই চলে। অন্যদিকে একটি মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে ছাইভস্ম করতে প্রচুর জ্বালানির দরকার হয়। (২) মাটিতে যে জৈবিক উপাদান আছে সেগুলি মানুষের দেহেও থাকে। ফলে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করলে মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে ফেললে জৈবিক উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। (৩) মৃতদেহকে সমাধিস্থ করলে পরিবেশের কোনো ক্ষতিসাধন হয় না। অন্যদিকে মৃতদেহকে আগুনে পোড়ালে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। (৪) মৃতদেহকে সমাধিস্থকরণ একটি মানবিক প্রক্রিয়া। অন্যদিকে মৃতদেহকে আগুনে পোড়ানো একটি অমানবিক ও ভয়ংকর প্রক্রিয়া। শিশু ও দুর্বল হার্টের লোকজনের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এই কারণেই অনেকেই শ্মশানে যেতে চায় না, নানা কারণে যেতে হলেও শবদাহ প্রত্যক্ষ করেন না। এই কারণেই আজকের প্রজন্মের ছেলেরা মুখাগ্নিতে আপত্তি জানাচ্ছেন। (৫) বৃষ্টি-বাদলের দিনেও মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা যায়। কিন্তু বৃষ্টি-বাদলের দিনে মৃতদেহকে আগুনে পোড়ানো খুবই কঠিন কাজ। আর মৃতদেহকে ঠিকমতো পোড়াতে না পারলে সেটি পরিবেশের জন্য আরও ক্ষতিকর। (৬) সর্বোপরি, মৃতদেহকে সমাধিস্থকরণের ক্ষতিকর কোনো দিক নেই। সমাধিস্থকরণের জন্য জায়গা লাগলেও পরবর্তীতে সেই জায়গাকে আবার রি-সায়ক্লিং করা যায়। তা ছাড়া কবরস্থান ছাড়াও তো অনেক পতিত জায়গা-জমি পড়ে আছে। ফলে এটি মোটেও কোনো সমস্যা নয়। অন্যদিকে মৃতদেহকে পোড়ানোর সবগুলো দিকই ক্ষতিকর এবং অযৌক্তিক বা অমানবিক বা অবৈজ্ঞানিক।

মৃতের সৎকার তো হল, সৎকারের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তিকে স্বর্গে পাঠিয়েই কী সব শেষ ! মৃত্যুর পরে কী কিছুই নেই ? মৃত্যুতেই কী একটা জীবনের সব শেষ ? আত্মা বলে কী কিছু আছে ? তবে আত্মা কী ? আত্মার স্বরূপ কী ? আত্মাই পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে ? পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা খুঁজতে চেষ্টা করব মৃতব্যক্তির পরিণতি এবং আত্মার ব্যাখ্যার উত্তর।
অবশেষে মানুষ একদিন মৃত্যুকে স্পর্শ করে কিংবা মৃত্যু মানুষকে স্পর্শ করে। জীবনের প্রথমবার এবং শেষবারের মতো চরম সত্যের মুখোমুখি হয় মানুষ।নানাভাবে মানুষের মৃত্যু আসতে পারে। যদিও সব মৃত্যুই মৃত্যু হলেও, সব মৃত্যু একরকম হয় না। মৃত্যু যেরূপে মানুষকে আলিঙ্গন করে – (১) বার্ধক্যজনিত মৃত্যু, (২) প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু (বন্যা, সাইক্লোন, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি), (৩) দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, (৪) অসুখে-বিসুখে মৃত্যু, (৫) যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু, (৬) রাজনৈতিক কারণে মৃত্যু, (৭) আত্মহত্যায় মৃত্যু, (৮) অনুমতি সাপেক্ষে মৃত্যু (ইচ্ছামৃত্যু), (৯) রাষ্ট্র দ্বারা মৃত্যু (আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড), (১০) ধর্মীয় কারণে মৃত্যু (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা), (১১) শত্রুতার কারণে মৃত্যু, (১২) আততায়ীর হাতে মৃত্যু (ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধি, মুজিবর রহমান, জন কেনেডি প্রমুখ), (১৩) সামাজিক অশিক্ষার কারণে মৃত্যু (ডাইনি হত্যা ইত্যাদি), (১৪) না খেতে পেয়ে বা অনাহারে মৃত্যু, (১৫) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনশনে মৃত্যু (চেট্টি) (১৬) পুলিশী হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি। মানুষ ছাড়া এত প্রকারের মৃত্যু পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর হয় না। তা মৃত্যু যেভাবেই হোক -- মৃত্যুর পর কী, তা নিয়ে আমাদের অপার কৌতূহল। নানা জনের নানা মত।সত্যটা কী ? সবটাই ধোঁয়াশা !
জীবের মৃত্যুর কথা জানার আগে জীবনকী সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। যদিও বিজ্ঞানীরা আজও জীবন বা প্রাণের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেননি, তবু বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ভাষায় জীবন হল – (১) জীবন বা প্রাণ এমন এক সত্তা যার থেকে অনুরূপ সত্তার জন্ম হতে পারে। পরিবেশের প্রভাবে যার আকস্মিক পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটলে তার থেকে উন্নততর জীবন-সৃষ্টির পথ সুগম হতে পারে। (২) প্রতিনিয়ত পরিবর্তনোন্মুখ পরিবেশে মানিয়ে নিতে ইচ্ছুক জটিল সুসংবদ্ধ প্রোটোপ্লাজমের সুনির্দিষ্ট শক্তির বহিঃপ্রকাশই হল জীবন। (৩) বৃদ্ধি, জনন, পরিব্যক্তি ও বিবর্তন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সজীব, জটিল, কোষীয় জৈব যৌগকে জীবন বা প্রাণ বলে। (৪) পরিবেশ ও সজীব বস্তুর আন্তঃবিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশই হল জীবন।
জীবের মৃত্যু অনেকাংশেই প্রোটোপ্লাজমের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে। প্রোটোপ্লাজম বিশেষ এক প্রকার জটিল যৌগ।উদ্ভিদ বা প্রাণী যে-কোনো জীবদেহ এক বা একাধিক কোশের সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণত কোশের প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থেকে এই প্রোটোপ্লাজম সবরকম শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করে। সে জন্য প্রোটোপ্লাজমকে প্রাণের ভৌত ভিত্তিবা “Physical basis of life” বলা হয়। প্রতিটি জীবদেহে প্রোটোপ্লাজম বর্তমান, অর্থাৎ যেখানেই প্রাণ সেখানেই জীবন্ত প্রোটোপ্লাজম। প্রোটোপ্লাজম গঠনের ৭৫% জল। তাই জীবদেহের জলের অভাব হলে প্রোটোপ্লাজমের ক্রিয়া ব্যাহত হয়।ফলে জীব বাঁচতে পারে না। তাই জীবকোশে প্রোটোপ্লাজমের মৃত্যু হলে জীব জড়বস্তুতে পরিণত হয়।জন্মের পর অধিকাংশ জীবদেহ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বাল্য, কৈশোর, যৌবন এবং পৌঢ়ত্বের পর প্রাকৃতিক নিয়মে জীবদেহে বার্ধক্যের লক্ষণ ফুটে ওঠে। দেহের কর্মক্ষমতা কমে আসে এবং জরার লক্ষণ প্রকাশ পায়৳ কর্মক্ষমতা কমে আসার ফলে দেহের বিভিন্ন বিপাকীয় কাজে কোশ আর ঠিকমতো অংশগ্রহণ করতে পারে না। ফলে কোশস্থিত অঙ্গাণুগুলি ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং জীব একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, নশ্বর শরীর নিথর হয়।বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহের হৃৎপিণ্ডের ছন্দোবদ্ধতা স্তব্ধ হওয়া মানেই মৃত্যু নয়, যতক্ষণ-না মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটছে ততক্ষণ মানুষের মৃত্যু বিলম্বিত হয়। অতএব মৃত্যু জীবের অবধারিত এবং স্বাভাবিক পরিণতি।মৃত্যুর কোনো দিনক্ষণ হয় নাকি ? হয় না। কারণ রোগীর মৃত্যুর সঠিকসময় নির্ধারণ করাটাও অনেকক্ষেত্রে অসুবিধাজনক, কারণ দেখা গেছে বিভিন্ন অংগপ্রত্যংগ দেহের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে, যেমন মস্তিষ্ক ৫ মিনিট, হৃৎপিণ্ড ১৫ মিনিট, কিডনি ৩০ মিনিট, কঙ্কাল পেশি ৬ ঘণ্টা। অঙ্গ বেঁচে থাকার অর্থ হল তার কোশগুলি বেঁচে থাকা। কোশ বেঁচে থাকে ততক্ষণই যতক্ষণ এর মধ্যে শক্তির জোগান থাকে। শক্তি উৎপন্ন হয় কোশের অভ্যন্তরস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ হলে কোশেরও মৃত্যু হয়। কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে, মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি প্রক্রিয়া। দেহের মৃত্যু দিয়ে এর প্রক্রিয়া শুরু হয়, শরীরের শেষ কোশটির মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
মৃত্যু তো হল, কিন্তু মৃত্যুর ওপারে কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই উপনিষদের কথা মনে পড়ে গেল। কঠ উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে যম ও নচিকেতার উপাখ্যানে আমরা জানতে পারছি, বাজশ্রবস নামক মুনি যজ্ঞফল কামনা করে পুরাকালে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ সম্পাদন করে সেই যজ্ঞে তাঁর সর্বস্ব দান করেছিলেন।বাজশ্রবসের পুত্র নচিকেতা পিতাকে বারবার আপনি আমাকে কোন্ ঋত্বিকের উদ্দেশ্যে দান করিবেন ?” বলে বিরক্ত করলে পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে পুত্রকে বললেন, “তোমাকে যমের উদ্দেশ্যে দান করিলামঅতঃপর নচিকেতা যমের গৃহে উপস্থিত হলেন এবং তিন রাত্রি অনাহারে থাকলেন। গৃহস্থের বাড়িতে সমাগত ব্রাহ্মণ-অতিথি অনাদৃত হয়ে অনাহারে থাকলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়, সেই কারণে যম নচিকেতাকে বললেন, “হে ব্রাহ্মণ, তুমি আমার অতিথি এবং ব্রাহ্মণ, কাজেই আমার নমস্কারের যোগ্য।যেহেতু তুমি আমার গৃহে তিন রাত্রি অনাহারে যাপন করিয়াছ, সেই কারণে প্রতি রাত্রির জন্য একটি করিয়া মোট তিনটি বর প্রার্থনা করযমের শুনে নচিকেতা বললেন, “হে যম, আমাকে যমালয়ে পাঠাইয়া পিতার যে দুশ্চিন্তা হইয়াছে তাহা প্রশমিত হউক।তোমার দ্বারা প্রেরিত হইয়া আমি গৃহে প্রত্যাগমন করিলে তাঁহার পূর্বস্মৃতি যেন জাগিয়া ওঠে এবং আমাকে চিনিতে পারিয়া যেন সাদর সম্ভাষণ করেন। বরত্রয়ের মধ্যে ইহাই প্রথম বর প্রার্থনা করিতেছি
প্রথম বরপ্রাপ্তির পর দ্বিতীয় বর প্রার্থনার উদ্দেশ্যে নচিকেতা বললেন, “হে মৃত্যু, স্বর্গলোকে কিছুমাত্র ভয় নাই, আপনারও সেখানে কোনো অধিকার নাই, বার্ধক্যজনিত জরার ভয়ও সেখানে নাই। সেখানে যাঁহারা গমন করেন, তাঁহারা ক্ষুধা-তৃষ্ণার কোনো কষ্ট পান না, সমস্ত শোক ও মানসিক দুঃখ অতিক্রম করিয়া তাঁহারা আনন্দ ভোগ করেন। হে মৃত্যু, যে অগ্নির চয়ন দ্বারা মানুষ স্বর্গে করে, সেই অগ্নির বিষয় আপনি সম্যক্ অবগত আছেন। শ্রদ্ধাবান আমাকে তাহা সবিস্তারে বলুন। যাঁহারা মৃত্যুর পরে স্বর্গলোকে গমন করেন তাঁহাদের অমৃতত্ত্ব লাভ হয়, এই কারণে স্বর্গলাভের অভিলাষী হইয়া আমি দ্বিতীয় বরে স্বর্গলাভের সাধনভূত অগ্নিবিদ্যা আপনার নিকট প্রার্থনা করিতেছিযম বললেন, “তুমি তৃতীয় বর প্রার্থনা করোযমরাজের কথা শুনে নচিকেতা বললেন, “কেহ কেহ বলেন মৃত্যুর পর আত্মা থাকে, কেহ কেহ বলেন আত্মা থাকে না। পরলোক সম্বন্ধে মানুষের মনে এই যে সন্দেহ বিদ্যমান আপনার উপদেশে সেই আত্মার তত্ত্ব আমি সম্যক্ জানিতে ইচ্ছা করি। বরসমূহের মধ্যে ইহাই আমার প্রার্থনীয় তৃতীয় বর।যম বললেন, “নচিকেতা, তুমি যে বিষয়ে বর প্রার্থনা করিয়াছ সে বিষয়ে দেবতারাও পূর্বে সংশয় প্রকাশ করেছেন।প্রাকৃত লোকে সহজে ইহা জানিতে পারে না, কারণ এ আত্মতত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম।তুমি অন্য বর প্রার্থনা করো। আমাকে এ বিষয়ে আর উপরোধ করিয়ো না, আমার নিকটে এই বর প্রার্থনা ত্যাগ করো।যে বিষয়ে দেবতারাও পূর্বে সংশয় প্রকাশ করেছেন, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ জানবে কীভাবে ! তবে কঠ উপনিষদ বলছে, “ন প্রাণেন নাপানেন মর্ত্যো জীবতি কশ্চন।/ইতরেণ তু জীবন্তি যস্মিন্নেতাবুপাশ্রিতৌ।।অর্থাৎ কোনো মরণশীল মানুষই প্রাণবায়ু, অপানবায়ু বা অন্য কোনো বায়ু দ্বারাই জীবন ধারণ করে না, পরন্তু এই প্রাণ ও অপান যাকে আশ্রয় করে আছে দেহ থেকে পৃথক সেই আত্মা দ্বারাই জীবন ধারণ করে
মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত মহাভারত”-এর অষ্টাদশ পর্ব স্বর্গারোহণপর্বে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, “এ জগতে আশ্চর্য কী ?” ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির উত্তরে বলেছিলেন, “মৃত্যু অবধারিত জেনেও মানুষ বেঁচে থাকে এটাই আশ্চর্য।
আসলে এই বেঁচে থাকা এবং ক্রিয়মান জীবনের পরিসমাপ্তি-রেখা -- যার অপর নাম মৃত্যু আশ্চর্য দুই-ই। জন্মলাভের মধ্য দিয়ে যে জীবনের শুরু এবং ক্রম-অভিব্যক্তি যার প্রকৃতি এ যেমন নিশ্চিত, তেমন নিশ্চিত মৃত্যুতে তার শেষ পরিণতি।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি।/তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যান্যানি সংযাতি নবানি দেহী।। -- অর্থাৎ মানুষ যেমন জীর্ণ পোশাক ত্যাগ করে নতুন পোশাক গ্রহণ করে, তেমনই আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর গ্রহণ করেজীর্ণ পোশাককী, কখন, কীভাবে তা তো আমরা সবাই বিলক্ষণ জানি। কিন্তু জীর্ণ শরীরবলতে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা কিন্তু বক্তা কোথাও দেননি। অতএব জীর্ণ শরীরবলতে আমি বার্ধক্য বয়সকেই বুঝব, তাই নয় কি ? বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন এই শরীরটির নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার সক্ষমতা লোপ পায় এবং বার্ধক্যজনিত রোগগুলি শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে তখনই ধরে নিতে হবে আমরা বার্ধক্যে পৌছে গেছি। তাই বার্ধক্যে পৌছোনোর বয়স ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হতেই পারে। প্রতিটি মানবকোশে অজস্র (নির্দিষ্ট সংখ্যক) ডিএনএ (DNA) আছে, আর তারই একটা ছোট্ট অংশকে বলা হয় জিন (Gene)এই জিনগুলিই আমাদের বংশগতির ধারক ও বাহক। আর এই জিনজনিত কারণকেই এখনও বৃদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেওয়া হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে তৈরি হয় প্রচুর বিষাক্ত উপাদান, যাদের বলা হয় রি-অ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিশিস (Reactive oxygen species), যার সংক্ষিপ্ত ভিন্ন একটি নাম ফ্রি র্যা ডিকেল’ (Free radical)তবে আনন্দের বিষয় এই যে, আমাদের শরীরে এন্টি-অক্সিডেন্ট (antioxidant) নামক এমন কিছু উপাদান আছে যা সহজেই এইসব ফ্রি র্যা্ডিকেলকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আর যখন এদের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং ফ্রি র্যামডিকেল প্রাধান্য বিস্তার করে তখন এরা আমাদের বিভিন্ন জিন তথা ডিএনএকে ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। আরো মজার একটি ব্যপার হল আমাদের শরীরে এমন কিছু জিন আছে যারা সেই ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএগুলিকে সারিয়ে তুলতে পারে। ফ্রি র্যা ডিকেল যখন সেইসব সারিয়ে তোলার মতো জিনকেও ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন কিন্ত সত্যি সত্যিই আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গগুলি ব্যাপকভাবে তাদের কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করে। মস্তিস্ক, হৃদপিন্ড, ফুসফুস, বৃক্ক, অগ্নাশয়, পেশি, ত্বকসহ সকল অঙ্গগুলি এমনিভাবে প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই করার শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং সহজেই বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। এভাবেই একটি মানুষ একসময় বার্ধক্যে উপনীত হয়। অর্থাৎ শরীর জীর্ণ হয়। গীতার বয়ান অনুসারে এই শরীর যদি জীর্ণই, তবে সেই জীর্ণ শরীর ছেড়ে আত্মা নতুন শরীরের খোঁজে ত্যাগ করতেই পারে। কিন্তু শূন্য (zero) বয়স থেকে যুবক বয়সে যাদের হঠাৎ মৃত্যু হয় তাদের শরীর তো জীর্ণ নয়, তাহলে শরীর থেকে আত্মা বেরিয়ে কোন্ শরীরের সন্ধানে ? সে কথা গীতার বক্তা বলেননি। শুধু গীতার বক্তা শ্রীকৃষ্ণ কেন, কোনো ধর্মবেত্তাই এর জবাব দেয়নি।
প্রশ্ন হল, মৃত্যুই কী শেষ ? অনেকে মনে করেন মৃত্যুই শেষ নয়। আছে আত্মা, আছে জন্মান্তর, আছে বিচার বিচারে কারোর স্বর্গে (বেহেস্ত বা জন্নত), কারোর-বা নরকে (জাহান্নাম বা দোজখ) গমন ইত্যাদি। আবাল্য যাকে পাশে নিয়ে বেড়ে উঠলেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিতে যার আন্তরিক সাহচর্য, কিংবা স্নেহ-ভালোবাসা লাভ করে তৃপ্ত হয়েছেন, প্রেরণা পেয়েছেন, কিংবা জীবনের পথে চলতে গিয়ে যাদের পাশাপাশি দেখেছেন-পেয়েছেন তারপর একদিন হঠাৎ করে স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখতে হল মৃত্যু তাদের ছিনিয়ে নিয়ে গেল বিনা কৈফিয়তে। চিরতরে হারিয়ে গেল পরম প্রিয়জন। কোনোদিন আর সে ফিরবে না। জন্মমুহূর্তে যেমন একা এসেছিলাম, তেমনই একাই যেতে হয়। মর-জগতের কোনো বস্তুই সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া চলে না, নিয়ম নেই যে ! নিয়ে যাওয়া যায় না কারোকেই। যে যায় সে একা শূন্য হাতেই যায়। যায় কি ? কোথায় যায়? কেন যায় ? কে যায় ? আত্মা ?
আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ে বিশ্বাস থাক বা না-থাক আগ্রহ সকলের মধ্যেই কমবেশি বর্তমান। পণ্ডিতপ্রবর কোচ গ্রুনবার্গ মনে করেন, কতকগুলি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পদ্ধতি দেখে মনে হয় হাড়গোড়ই জীবাত্মার শেষ আশ্রয়স্থল। দেহের মৃত্যু হলে এই কঙ্কালের মধ্যেই জীবাত্মা থাকে। ঠিকই তো ! আজ পর্যন্ত ভূতপ্রেতের রূপকল্পনা করতে কঙ্কালের কল্পনাই আগে করে নিই। টিউটনরা মনে করেন, মৃত্যুর জগৎ ছায়া জাতীয়। দেবী হেল এই মৃত্যুর জগৎ শাসন করেন। সূক্ষ্ম কোনো সত্তা স্থূলদেহীর মৃত্যুর পর ভিন্নলোকে গেলেও চিরকাল সেখানে থাকতে পারে। আবার শ্লাভজাতিরা মনে করত, স্থূলদেহের মৃত্যু হলেই সব শেষ হয়ে যায় না। তাই তাঁরা মৃতের সঙ্গে কবরে পার্থিব জীবনে ভোগের সব কিছুই দিয়ে দিত। অন্যদিকে তিব্বতীয়রা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পরও জীবাত্মা বেঁচে থাকে। তাঁরা বিশ্বাস করে, মৃত্যু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জীবাত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায় না, চারদিন পর্যন্ত আত্মা দেহের সঙ্গে লেগে থাকে।
মধ্য প্রাচ্যের আন্নামাইটদের মধ্যে রীতি ছিল গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করা। এক্ষেত্র অবশ্য তিনপুরুষ পর্যন্ত পূর্বপুরুষদেরই নাম স্মরণ করা যেত (হিন্দুরা যেমন তর্পণে সাতপুরুষের বা কোনো কোনো হিন্দু চোদ্দোপুরুষের নাম স্মরণ করে থাকে)। তবে আন্নামাইটরা পূর্বপুরুষদের সকলেই একত্রে যুক্ত করে পারিবারিক এক আত্মারূপে কল্পনা করেও পুজো দিত। এমন অনেক নরগোষ্ঠী আছে যাঁরা মৃতের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত করে না। দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের অনেকেই পিতৃপুরুষদের ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। মৃতের আত্মা দুষ্ট আত্মাতে পরিণত হয় বলে তারা মনে করে। সেইজন্য নামরূপ জীবাত্মাকে স্মরণ করে তাকে ডেকে আনতে চায় না। ফলে মৃত ব্যক্তির নাম মুখেও আনে না। কোথাও কোথাও মৃত ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করলে শাস্তিদানের ব্যবস্থাও আছে। গুয়াজিরো জাতিদের মধ্যে কেউ মৃতের নাম উচ্চারণ করলে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হত। গায়ানার প্রাচীন অধিবাসীরা দেহের নানা অংশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আত্মার কল্পনা করত। যেমন হৃৎপিণ্ডের আত্মা, মস্তিষ্কের আত্মা, রক্তের আত্মা, থুতুর আত্মা ইত্যাদি। চিনের পিকিং মানবজাতিরা মৃতের মাথা ভেঙে ঘিলু খেয়ে নিত। ভক্ষিত মস্তিষ্ক-ঘিলু সেই ব্যক্তির শক্তি ও সাহস ভক্ষকের শরীরের ভিতর নিয়ে আসবে। হয়তো পিকিং মানুষেরা এরকম তত্ত্বেই বিশ্বাস করত। কোনো কোনো জনগোষ্ঠীদের মধ্যে শুধুমাত্র মুণ্ড কবর দেওয়ার নিয়ম ছিল। যেমন নিয়ানডার্থাল যুগের মানুষদের মধ্যে এ রীতি ছিল। মুণ্ডের মধ্যেই জীবাত্মা থাকে এরকম কবর দেওয়ার পিছনে কাজ করেছে। জানা যায়, নব্যপ্রস্তর যুগের প্রথমদিকে কোথাও কোথাও নাকি মৃতদেহ থেকে মস্তিষ্ককে বিচ্ছিন্ন করে কবর দেওয়া হত। মস্তিষ্ক জীবাত্মার বসবাস এরকম ধারণা যে নব্যপ্রস্তর যুগেও ছিল এ থেকে তা প্রমাণিত হয়। এমনকি,, নিউজিল্যান্ডের মাওরিরাও জীবাত্মার মস্তিষ্কে বাস করে এ রকম ধারণাই পোষণ করে।
একটি নয়, একটি মানুষের কমপক্ষে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন আত্মা আছে এমনটা মনে করে মেলানেশিয়ান জনগোষ্ঠীরা। তবে বগোবো জনগোষ্ঠীরা বিশ্বাস করে, প্রত্যেক মানুষেরই দুটি আত্মা আছে একটি ভালো, অপরটি মন্দ। মৃত্যুর পর ভালো আত্মাটি স্বর্গে যায় এবং খারাপ আত্মাটি যায় নরকে। বহু আফ্রিকান এবং পলিনেশিয়ান জনগোষ্ঠীর একটা অংশ এক অদ্ভুত তত্ত্বে বিশ্বাস করত। বিশ্বাস করত -- মহিলা ও নীচুজাতের লোকেদের আত্মা থাকে না। তাদের কাছে পুরুষের আত্মিক শক্তির পরিচয় ছিল কয়টি বিয়ে তিনি করেছেন তার উপর। অর্থাৎ, যে যত বিয়ে করে তার আত্মিক সত্তা তত বেশি। নেফেসবলতে জীবাত্মা বোঝালেও একে দেহযুক্ত আত্মার বাইরে খুব বোধহয় ইহুদিরা ভাবতে পারত না। তবে গ্রিক চিন্তার প্রভাবে ইহুদিরা আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে ভাবতে শুরু করে। এই অমরত্ব তাদের মতে জীবাত্মিক সত্তাতেই হত। অর্থাৎ, কোনো জীবাত্মা চিরকালের জন্য নরক ভোগ করবে, কোনো আত্মা চিরকালের জন্য স্বর্গ ভোগ করবে। ভারতের আদিবাসীরা আত্মা-ভাবনায় বারবার তাদের ধারণা বদলেছে। তার কারণ, ভারত স্মরণাতীত কাল থেকেই হাজারো জাতি দ্বারা অধ্যুষিত। পরিবেশ, জলবায়ু, খাদ্য, পোশাক প্রভৃতি যেমন মুহুর্মুহু বদলেছে ঠিক তেমনই আত্মার ধারণাও বদলেছে। আজও ভারতের নানা স্থানের জাতিদের নানা রকমের আত্মার ধারণা বিদ্যমান। ভিন্ন ভিন্ন নরগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন দর্শন। জীবাত্মা বলতে নির্ভেজাল এক ভারতীয় বিশ্বাস বলতে যা বোঝায়, তা নেই। ভারতে প্রাগার্য নরগোষ্ঠীর জীবাত্মা সম্পর্কে নানা বিশ্বাস যেমন আছে, ঠিক তেমনই আর্যদেরও যুগে যুগে বিভিন্ন দর্শনে বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাসের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আবার প্রাগার্য এবং আর্য বিশ্বাস পরস্পর মিশে গিয়েও নতুন ধারণার জন্ম নিয়েছে। ভারতে সাধারণ বিশ্বাস হল, একটি দেহে একটিমাত্র আত্মা থাকে। আদি বৈদিক সাহিত্যে জীবাত্মার চিন্তা তেমন করে প্রতিফলিত হয়নি। কারণ আর্যরা প্রথমদিকে জীবনেরই উপাসক ছিলেন, মৃত্যুর নয়। ঋগ্বৈদিক আর্যরা মৃত্যুর চিন্তা তেমন করে করেননি। তার কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করতেন মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না। তবে ঋগ্বৈদিক আর্যরা মৃত্যুলোকের একটা কল্পনা করেছিলেন। ভাবতেন মৃত্যুলোক একটা বহুদূর ধূসর দেশ, যেখানে সূর্য তার জ্যোতি হারিয়ে অন্ধকার সৃষ্টি করে। সেই ধূসর জগতেরও একজন দেবতা আছেন বলে তাঁরা মনে করতেন। সেই দেবতার নামই যম, যম মৃত্যুরই সমার্থক মাত্র। অথচ পরবর্তীকালে এই যমই ভয়াবহ রূপে কল্পনা করা হল। ঋগ্বৈদিক যম মোটেই ভয়াবহ নয়। বলা হয়েছে যম ও যমী হলেন প্রথম মানব ও মানবী, যাঁরা মৃত্যুর পর অস্তাচলের জগতে গিয়ে তাঁর অধীশ্বর ও অধীশ্বরী হয়েছিলেন। প্রথম মানব-মানবীর লোকহিসাবে সেই মৃত্যুলোক ঋগ্বৈদিক আর্যদের কাছে পিতৃলোক নামে পরিচিত হয়েছিল। ফলে পিতৃলোকে পরলোক ভীতির স্থান তো নয়ই, বরং সুখকর লোক হিসাবে তাঁদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল। তবে মৃত্যুর পর যে এই স্থূলদেহ থাকে না এটা ঋগ্বৈদিক ঋষিরা জানতেন। সেইজন্য মৃত্যুর পর রূপান্তর ঘটে এরকম ধারণা হয়েছিল। মৃত্যুর পর মানুষ অমর হয়, এরকম একটা ধারণাও ছিল। মৃত্যু তাদের কাছে ছিল স্থূলদেহের নাশ মাত্র, আর কিছুই নয়। কিন্তু স্থূলদেহ নাশ হওয়ার পর জীবনের সত্তা কী থাকে, এ সম্পর্কে তাঁরা কিছু বলেননি। জীবাত্মার স্বরূপ কী সেটা তাঁরা স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি।
ঋগ্বেদের ধারণা, মৃত্যুর পর পাপীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, পুণ্যবান অমরজীবন লাভ করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বলা হয়েছে পাপী এবং পুণ্যবান উভয়ই মৃত্যুর পর কর্মফল ভোগের জন্য পুনর্জন্ম লাভ করবে। কর্মফলের জন্যই মানুষ জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে চিরকাল ঘূর্ণায়মান, এমনই ধারণা ছিল। উপনিষদে বলা হয়েছে, কামনা-বাসনা থাকলে স্থূলদেহের মৃত্যু হলে জীবাত্মা পুনরায় জন্মগ্রহণ করে জন্মান্তরের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় এমন চিন্তাভাবনাও শুরু হল। বলা হল, জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হল নিষ্কাম কর্ম।
বেদান্ত মতে -- আত্মা কখনো চলে যায় না, আসেও না, জন্মগ্রহণ করে না, মৃত্যুও হয় না। আত্মা যেসব কাজ করেছে, যেসব চিন্তা করেছে, সেগুলিই একে কোনো বিশেষ দিকে পরিচালিত করবে। ওই আত্মা নিজের মধ্যে ওইসব সংস্কার নিয়ে গন্তব্য পথে এগিয়ে যাবে। যদি সমবেত কর্মফল এমন হয় যে, পুনর্বার ভোগের জন্য তাকে একটা নতুন শরীর গড়তে হবে, তবে তা এমন পিতামাতার কাছে যাবে, যাদের থেকে সেই শরীর গঠনের উপযোগী উপাদান পাওয়া যেতে পারে। আর সেইসব উপাদান নিয়ে আত্মা একটি নতুন শরীর গ্রহণ করবে। এইভাবে ওই আত্মা দেহ থেকে দেহান্তরে যাবে, কখনো স্বর্গে যাবে, আবার পৃথিবীতে এসে মানবদেহ পরিগ্রহ করবে; অথবা অন্য কোনো উচ্চতর বা নিম্নতর জীবশরীর পরিগ্রহ করবে। এভাবে আত্মা ততদিন অগ্রসর হবে, যতদিন-না তার অভিজ্ঞতা অর্জন শেষ হয় এবং পূর্বস্থানে প্রত্যাবৃত্ত হয়।
ভারতীয় দর্শনে জড়বাদী চার্বাক দার্শনিকরা দেহাতিরিক্ত কোনো আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। চার্বাকদের মতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা। আত্মার অমরতা, কর্ম ফলভোগ, জন্মান্তর, বন্ধন, মুক্তি সবই অর্থহীন প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ এবং প্রত্যক্ষের মাধ্যমে কোনো অজড় নিত্য চৈতন্যবিশিষ্ট আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে না। অভিজ্ঞতাবাদী বৌদ্ধ দার্শনিকগণও কোনো শাশ্বত বা চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, কোনো এক মুহূর্তে আমাদের মধ্যে আমরা যেসব মানসিক প্রক্রিয়াগুলি দেখি, সেইসব মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বা প্রবাহই আত্মা। ভগবান বুদ্ধের মতে, জন্মান্তর অর্থে কোনো চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ পরিগ্রহণ নয়। জন্মান্তর অর্থে বর্তমান জীবন থেকে পরবর্তী জীবনের উদ্ভব। জৈন দার্শনিকরা অবশ্য আত্মার সত্তা স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, চৈতন্যধর্মবিশিষ্ট এবং চৈতন্য আত্মার স্বরূপ লক্ষণ। আত্মা নিত্য এবং দেহাতিরিক্ত সত্তা। আত্মার জন্ম বা মৃত্যু নেই। কর্মফল ভোগের জন্য আত্মা যখন যে দেহ ধারণ করে, তখন সেই দেহের অবস্থা লাভ করে।
চৈনিক তাওবাদীরা মনে করতেন, প্রত্যেকটি লোকের দুটি করে আত্মা আছে – “কিএবং লিঙকিহল প্রাণ এবং লিঙহল যথার্থ জীবাত্মা বা দেহের সূক্ষ্ম সত্তা। কিদেহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে। লিঙদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অপরদিকে মুসলিম সম্প্রদায়গণের একটা অংশের বিশ্বাস, আত্মা মৃত্যুকালে মুখ দিয়ে নির্গত হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মস্তিষ্কের পিছন দিয়ে আত্মা নির্গত হয়। মৃত্যুর পর ফেরেস্তা বা দেবদূতেরা আত্মাকে বেহেস্তে নিয়ে গেলেও সেখান থেকে আল্লাহতালা আবার তাদের নীচে পাঠিয়ে দেন। স্বর্গ থেকে ফিরে এসে এইসব আত্মারা কেউ বেশিদিন, আবার কেউ কমদিন কবরে বাস করে। তাদের বিশ্বাস, রোজাকেয়ামতের দিন পর্যন্ত আত্মা পাখির আকারে জীবিত থাকে। বিশ্বাসী ব্যক্তি যে পাখিটিকে আশ্রয় নেয় তার রং সবুজ, পাপীদের আত্মা যে পাখিটিতে আশ্রয় নেয় তার রং কালো। কোরানের মতে, প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবে। শেষের দিনে পরমপিতার তুর্যনাদে যাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁরা মারা যাবেন। উচ্চস্তরীয় কিছু দেবদূতই কেবল বেঁচে থাকবেন। কে, কবে মারা যাবেন তা পূর্বনির্দেশিত। মৃত্যুকালে যার মুখ থেকে আল্লা ছাড়া দ্বিতীয় ঈশ্বর নেইকালিমাটি উচ্চারিত হবে তিনি নিশ্চয় বেহেস্তে যাবেন। জীবাত্মা আছে এ বিশ্বাস ইসলামে দৃঢ়। মুসলমানরা মনে করেন, যাঁরা ইসলামে বিশ্বাস করেন মৃত্যুর পর দয়ার্দ্র কোনো দূত সাদা পোশাক পরে তাঁর আত্মার কাছে আসেন এবং পরমপিতার শান্তিতে স্থান লাভ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আত্মাকে এক দেবদূতের কাছ থেকে অন্য এক দেবদূতের কাছে দেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত তাঁকে ইসলাম বিশ্বাসীরা যেখানে আছেন সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ইসলামীরা মনে করেন, ইসলামে অবিশ্বাসী আত্মা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দেহত্যাগ করে। ঈশ্বরের দূতেরা বিরক্ত হয়ে তাকে অবিশ্বাসীদের আত্মা যেখানে আছে সেখানে নিয়ে যান।
মৃত্যুর পর আত্মার পুনরুত্থানের ধারণা সর্বপ্রথম পারস্যেই সৃষ্টি হলেও পরে নিউ টেস্টামেন্টের পাতায় ওই ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তখন থেকেই পাশ্চাত্য জগতের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা পরিমাণে ওই ধারণা গ্রহণ বা স্বীকার করে আসছিল। মথি, লুক মার্ক লিখিত সুসমাচারের মধ্যে আত্মার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে মৃত্যুর পর একটি সূক্ষ্ম সত্তার অস্তিত্ব আছে এই রকমের ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। নিউ টেস্টামেন্টে যে প্রেতাত্মার কথা পাওয়া যায় তা শেষপর্যন্ত Holy Ghost-এ পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টানগণ মনে করেন, আত্মা হল অধ্যাত্ম সত্তা।
আত্মা বিষয়ে দার্শনিকগণ কী বলেছেন সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক। দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, দেহের সঙ্গে আত্মার কোনো সম্পর্ক নেই। জন্মের সময় আত্মা দেহের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং মৃত্যুর পর আত্মা নিজের রাজ্যে চলে যায়। দার্শনিক ডেকার্তের মতে আত্মা এবং জড় পরস্পর-বিরুদ্ধ ধর্মবিশিষ্ট। চেতনার মাধ্যমে আমরা আত্মাকে জানতে পারি। আত্মাকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। আমরা অনুভবের মাধ্যমে আত্মাকে জানতে পারি। বার্কলের মতে -- ধারণা নিষ্ক্রিয়, আত্মা সক্রিয়। আত্মা আশ্রয়, ধারণা বিষয়। আত্মা জ্ঞাতা, ধারণা জ্ঞেয়।
এবার আত্মা বিষয়ে বিজ্ঞানীরা কী বলেন সেটাও দেখে নিতে পারি। তবে তার আগে স্বামী নিগূঢ়ানন্দের বিজ্ঞানীরা কী বলেছেন সেটা আগে দেখব। নিগূঢ়ানন্দের মৃত্যুর পরেগ্রন্থটিতে বলছেন, রুশ বিজ্ঞানীরা মৃতদেহ থেকে চার গজ দূরে সারগেয়েভ ডিটেকটর বসিয়ে দেখেছেন যে, মৃতদেহে কোনো সাড়া না থাকলেও সেই দেহের চার গজ দূরত্বে শক্তির সাড়া পাওয়া যায়। এই দূরত্বে দেহের ফোর্সফিল্ড থাকে বলে বিশ্বাস। আমেরিকার নিউ জার্সির টমসন ডঃ জ্যাক ওয়ার্ডের সাহায্যে আবিষ্কার করেন যে, একটি মানুষের এই ফোর্সফিল্ড আর-একটি মানুষের ফোর্সফিল্ডের স্পন্দন দূর থেকেই অনুভব করতে পারে। মানুষের এই ফোর্সফিল্ড বা দ্বিতীয় সত্তাই বিপদ-আপদ এবং ভালোমন্দের কথা আগে থেকেই বুঝতে পারে। তদানীন্তন চেকোশ্লোভাকিয়ার বিজ্ঞানীরাও দেহের একটা আত্মিক ক্ষেত্র বা Psi-field রূপী আবরণ আবিষ্কার করেছেন। এই সত্তা নিয়ে তারা Psychotronics নামে এক বিজ্ঞানের সৃষ্টি করেছেন। এই বিজ্ঞান জীবের এই দ্বিতীয় সত্তা নিয়ে কাজ করে। চেকরা দেখিয়েছেন যে, সকল জৈবসত্তার চারদিকেই এই তেজাবরণ থাকে। এই তেজাবরণ বা সাইকোট্রনিক-এনার্জিই হল আত্মা যা স্থূলদেহ থেকে মৃত্যুকালে বেরিয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা স্থূলদেহ থাকাকালীন সূক্ষ্মদেহ বা বায়ো-প্লাজমিক বডির একটা অনুমান করতে পেরেছেন মাত্র। মৃত্যুর পর স্থূলদেহ থেকে এই তেজকায়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এটাও বুঝতে পেরেছেন। স্থূলদেহের উপর এই তেজকায়ার বিরাট একটা প্রভাব আছে তাও তাঁরা অনুমান করতে পেরেছেন। কিন্তু স্থূলদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শেষপর্যন্ত তা কোথায় যায়, কীভাবে থাকে তা অনুমান করতে পারেনি। -- মন্তব্য নিগূঢ়ানন্দের।
আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে আরও অনেক মতামত এখানে হাজির করা সম্ভবযদি হাজির করি শুধু এই প্রবন্ধটিই নয়, একটা মোটকা একটা বই লিখে ফেলা সম্ভব। যুগ যুগ ধরে আত্মা বিষয়ে হাজার মানুষের হাজার মত প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্যই সেগুলি স্ববিরোধিতায় বিভ্রান্ত। আসলে সবই অনুমাননির্ভর, প্রত্যক্ষ নয়। প্রত্যক্ষ নয় বলেই ধারণারও শেষ নেই। সৃষ্টির আদি থেকেই যে যার মতো ভেবেছেন এবং প্রকাশ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীর ভণিতায়।
বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে আমিও একজন ব্যক্তিমানুষ। তাই আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ে আমারও মত থাকা অনুচিত হবে না। আমি মনে করি পৃথিবীর সব জায়গাতেই কোনো একটি নির্দিষ্ট বস্তুর সংজ্ঞা নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু আত্মার বিভিন্ন প্রকার অসংলগ্ন অসামঞ্জস্য ধারণাই প্রমাণ করে দেয় আত্মা বলে আদৌ কিছু নেই। আত্মা যদি থাকে এবং সেটি যদি জন্মহীন, মৃত্যুহীন হয় তাহলে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাবের পূর্বে আত্মারা কোথায় ছিল ? আত্মার ক্ষয় নেই, মৃত্যুও নেই তাহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণই-বা কী ? আত্মা বিশেষজ্ঞদের কাছে যথার্থ উত্তর উত্তর মেলে না। সুতরাং আমি বলবই আত্মা নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আত্মা আমার কাছে হাঁসজারু, বকচ্ছপ, ঘোড়ার ডিম, পক্ষ্মীরাজের সমান মনে হয় -- তার বেশি কিছু নয়। আত্মা একটি কাল্পনিক বস্তু, ম্যানমেইড যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এর একমাত্র অস্তিত্ব অন্ধবিশ্বাসী, যুক্তিহীন প্রশ্নহীন, গতানুগতিকার আনুগত্যতায় বিবশ, ধর্মভীরু মানুষের তমসাচ্ছন্ন মানসিকতায় ।
মোহমুগ্ধতার চশমা খুললেই পাঠ করতে পারবেন, কর্মফলকে কেন্দ্র করেই এসেছে শোষক ও শোষণের নতুন দিক। দাস সম্প্রদায়কে কর্মফলের আফিম খাইয়ে প্রতিবাদহীন করা হল নানা চতুরতায়। এইভাবে সৃষ্টি হয়েছিল আত্মার অবিনশ্বরতার ধারণা, যার সঙ্গে যুক্তিবাদী বিজ্ঞানচিন্তার কোনো সম্পর্ক নেই। পুরুষদেহজাত শুক্রাণু নারীর দেহনিঃসৃত ডিম্বাণুর মিলনেই নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়। সেখানে আত্মার কোনো সম্পর্ক বা ভূমিকা নেই। যদি থাকত, তাহলে যৌনমিলন ছাড়াই নারী এবং পুরুষ যথাক্রমে গর্ভবতী এবং গর্ভবান হত। যৌনতারও প্রয়োজন হত না, যৌনতাড়নাকে কেন্দ্র করে ব্যভিচারিতাও থাকত না।
আত্মা যদি মন, চেতনা, হৃদয় বা মস্তিষ্ক ছাড়া যদি আত্মা হিসাবে অন্য কিছু কল্পনা করা হয়, তবে সেটা স্রেফ ভাঁওতাবাজি। এ রকম আত্মার অস্তিত্ব কোনোদিনও ছিল না, আজও নেই। জীবজগতের মস্তিষ্ক, হৃদয়, রক্ত, পেশি, হাড়, স্নায়ু সবকিছুই নশ্বর। মন বা আত্মা বলে দেহের ভিতর কিছু বসবাস করে না, ঘরবদলও করে না। এটা ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ধারণা, যা ভিত্তিহীন। কেউই প্রত্যক্ষ করেননি। তাই কারোরই আত্মাজ্ঞান গ্রহণযোগ্য নয়।
এইসব জ্ঞানী-পণ্ডিতগণ শুধু আত্মাতেই ক্ষান্ত হননি। আত্মার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম দিয়েছেন জন্মান্তরবাদের, আছে স্বর্গ-নরক। আমরা খুঁজতে চেষ্টা করব জন্মান্তরবাদ বা পুনর্জন্মবাদ কী তার উত্তর।
আদি মানুষ প্রথম যে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে চরম বিস্ময়াভুত হয়েছিলেন, সেই ঘটনাটি অবশ্যই মৃত্যুআর সেই প্রাচীনকাল থেকেই মৃত্যুকে ঘিরে হাজারো অনুসঙ্গ, জল্পনা-কল্পনা, নানা ফন্দি-ফিকির, তত্ত্ব-তালাশ। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আত্মা, পরমাত্মা, মোক্ষ, পাপ, পুণ্য, স্বর্গ, নরক, ভুত-পেতনি-ব্রহ্মদত্যি, কর্মফল, জন্মান্তর, জাতিস্মর এরকম হাজারো বিমূর্ত ধারণা।বাস্তবে যাঁরা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তাঁরাই জন্মান্তর বা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন। ভারতীয়রা প্রাচীনকাল থেকেই জন্মান্তরে বিশ্বাসী। আর্যধর্মে এই জন্মান্তর সম্পর্কিত বিশ্বাস আর্য-পূর্ব ভারতীয়দের কাছ থেকে এসেছিল বলে পণ্ডিতজনেরা মনে করেন। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাসও নাকি জন্মান্তরে বিশ্বাস করতেন। অবশ্য খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা জীবাত্মায় বিশ্বাস রাখলেও জন্মান্তরে বিশ্বাস নেই। যাঁরা পুনর্জন্মবাদ মানেন না তাঁরা একজন্মবাদেই আস্থাবান।তাঁদের বিশ্বাস, ব্যষ্টি-আত্মা সর্বপ্রথম শূন্য থেকেই সৃষ্ট।
হিন্দুধর্মে জন্মান্তরবাদ : হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস করে, জীবের মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় জীবদেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্মান্তরকথাটির মূল অর্থ হল, জীবাত্মা একদেহ পরিত্যাগ করলে কর্মফল ভোগ করার জন্য অন্য দেহ ধারণ করে এ জগতেই পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। বেদ, উপনিষদ এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে, জীবাত্মা স্বরূপ ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্তিবশতই আত্মাকে দেহ ধারণ করতে হয়। জীবাত্মার একাধিক জন্মগ্রহণের কারণ হল তার ভোগের আকাঙ্ক্ষা। আর এরূপ পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণকেই বলা হয় জন্মান্তরবাদ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য --"বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মনি তব চার্জুন।/তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেথু পরন্তপ ।।" অর্থাৎ যে অর্জুন তোমার আমার বহুবার জন্ম হয়েছে। সে কথা তোমার মনে নেই, সবই আমার মনে আছে। এই বক্তব্যর মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ যে অর্জুনের সখা এবং তাঁর রথের সারথি এই সত্য অতিক্রম করে আর একটি পরম সত্য প্রকাশিত হয়েছে -- তা হল তিনি সর্বজ্ঞ, পরমেশ্বর। তিনি শাশ্বত. অব্যয়, পরমাত্মার প্রতীক। আবার যখন বলা হয় অর্জুনের বহুবার জন্ম হয়েছে, তখন এ থেকে বোঝা যায় অর্জুনের মধ্যেও পরমাত্মার মতো কোনো শাশ্বত বস্তু আছে যা বহুবার জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েও নষ্ট হয়ে যায়নি। শাস্ত্রের ভাষায় জীবদেহের ওই শাশ্বত বস্তুটি হল জীবাত্মা, জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ বিশেষ। অংশের মধ্যেও মূলবস্তুর গুণাগুণ বিদ্যমান। তাই পরমাত্মার মতো জীবাত্মাও অব্যয়, জন্ম-মৃত্যুহীন, শাশ্বত বস্তু। তবে কোনো অনাদি অতীতে পরমাত্মা থেকে বিযুক্ত হয়ে জীবাত্মা ওই পরমাত্মার পুনরায় মিলিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা বলা কঠিন। তবে যতদিন পরমাত্মা বা ঈশ্বরপ্রাপ্তি না ঘটে ততদিন জীবাত্মাকে বারবার নতুন দেহ ধারণ করে মোক্ষলাভ বা ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে, মানুষ প্রকৃতির সংসর্গবশত প্রকৃতির, গুণ অর্থাৎ সত্ত্ব, তমো এবং রজ গুণের প্রভাবে সুখ-দুঃখ, মোহাদিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি কর্তা, আমার কর্ম ইত্যাদি আমিত্ব প্রকাশ করে কর্মনাশে প্রবৃত্ত হয়। এই সব কর্মফল ভোগের জন্য তাকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। আর একাধিকবার জন্মগ্রহণ করাকেই বলা হয় জন্মান্তরবাদ। দেহ ও আত্মার মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। দেহহীন আত্মা নিষ্ক্রিয়, আত্মাহীন দেহ জড়। দেহকে আশ্রয় করে আত্মার অভিযাত্রা, আবার আত্মাকে লাভ করে দেহ সজীব। তবে দেহের মধ্যে যে আত্মার অবস্থান এটা উপলব্ধি করা সহজ কাজ নয়। আত্মা যে দেহকে আশ্রয় করে সেটি কিন্তু নশ্বর। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম -- এই পঞ্চভূতে গড়া দেহ। যিনি জীবদেহ ধারণ করে এসেছেন তারই দেহনাশ নিশ্চিত হয়ে রয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, -- "জাতস্য হি ধ্রবো মৃত্যুঃ”-- জাত ব্যক্তির মৃত্যু অবধারিত । তবে ওই যে দেহে জীবাত্মা ছিল তার কিন্তু বিনাশ নেই। এই জীবাত্মা এক দেহ ত্যাগ করে অন্য নতুন দেহে চলে যায়।জীবাত্মার পক্ষে মৃত্যুর অর্থ হল দেহত্যাগ। জীবাত্মা কেমন করে এবং কেনই-বা দেহ ত্যাগ করে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, দেহত্যাগ ব্যাপারটি একটি সহজ কাজ, যেমন একই দেহে বাল্য, কৈশোর, যৌবন বার্ধক্য আসে, তেমনই আত্মাও স্বাভাবিকভাবেই জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে চলে যায়। যেমন একই লোকে পুরাতন ছিন্ন বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে. সেইরূপ জীবাত্মাও জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। এইভাবে পুরোনো দেহ ত্যাগ করে জীবাত্মা যে নতুন দেহ ধারণ করছে অর্থাৎ দেহের সঙ্গে তার যে সংযোগ বিয়োগ ঘটেছে এটাই জন্মান্তরবাদ। এবার নিশ্চয় প্রশ্ন আসতে পারে, এখানে আবার কর্মবাদ কেন? জন্মান্তরবাদের সঙ্গে কর্মবাদ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যোগ আছে। আত্মার অবিনাশত্ব ও জন্মান্তরবাদের মতো কর্মবাদও হিন্দুধর্মের ভিত্তিপ্রস্তর স্বরূপ। কর্মবাদের মূল কথা হচ্ছে বিশ্বজগৎ স্রষ্টার বিশাল কর্মক্ষেত্র। এখানে জীব ভাবনা, বাসনা ও চেষ্টার দ্বারা নানারকম কর্ম করে যাচ্ছে। আর প্রত্যেকটা কর্মের আছে আলাদা আলাদা কর্মফল। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা মনে করেন কর্ম করলেই তার ফল উৎপন্ন হবে, আর কর্মকর্তাকে তা অবশ্যই ভোগ করতে হবে। আর এই কর্মফল ভোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মোক্ষপ্রাপ্তি বা জন্ম মৃত্যুরূপ সংসারচক্র থেকে মুক্তি হবে না। নিষ্কাম কর্মের মধ্যেই জীবের মুক্তির উপায়। একমাত্র নিষ্কামভাবে কর্ম করলে, সে কর্মের যে ফল উৎপন্ন হবে তা কর্মকর্তাকে ভোগ করতে হবে না। সুতরাং, নিষ্কাম কর্মের অনুশীলন করাই যথাযথ কাজ। নিষ্কাম কর্ম করে জীব মুক্তি লাভ করতে পারে। হিন্দুধর্ম যতগুলি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে জন্মান্তরবাদ অন্যতম।
ইসলামে জন্মান্তরবাদ : ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মতে, একজন মানুষ আদৌ নির্বাণ লাভ করল কি না তারই-বা প্রমাণ কী ! দেখা যাচ্ছে যে জন্মান্তরবাদ একটি পুরোপুরি অন্ধ ও অযৌক্তিক বিশ্বাস এবং সেই সঙ্গে অমানবিকও বটে। কারণ এই বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো প্রমাণ ছাড়াই একজনের অপরাধের শাস্তি অন্য কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে জন্মান্তরবাদকে অবাধে অপরাধ করার একটি লাইসেন্সও বলা যেতে পারে। অধিকন্তু, এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে হাজার হাজার বছর ধরে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে কিছু সুবিধাবাদী মানুষের জন্মসূত্রে দাস বানিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি এই দর্শন অনুযায়ী প্রত্যেক নিরীহ জীবজন্তু কোনো-না-কোনোভাবে ইভিল মানুষের পাপ বা অপরাধের বোঝা বহন করছে! এই ধরনের বিশ্বাসকে নিরীহ জীবজন্তুদের প্রতি চরম অপমান ছাড়া আর কীই-বা বলা যেতে পারে। কোরান অনুযায়ী এই পৃথিবীতে একবারই মানুষের জন্ম হবে (২:২৮, ২৯:২০, ৪০:১১, ৪৪:৫৬)। একজনের অপরাধের শাস্তি অন্য কারও উপর চাপিয়েও দেওয়া হবে না (১৭:১৫, ৬:১৬৪)। ফলে জন্মান্তরবাদের নামে অজ্ঞ ও সাধারণ মানুষকে ঠকানোর কোনো পথই খোলা নেই। তবে অনেকে মনে করেন, কোরানে পুনর্জন্ম বা পুনরুত্থান আছে, এর স্বপক্ষে কোরানে মহান আল্লাহ্ একুশটি আয়াত নাজিল করেছেন। আসলে পুনর্জন্ম বা পুনরুত্থান বা জন্মান্তরবাদ বা পুনর্জন্মবাদ বা কর্মফলবাদ একই ঘটনা।
বৌদ্ধধর্মে জন্মান্তরবাদ : বুদ্ধ পরকাল সম্বন্ধেও অনেক কিছুই বলে গেছেন। পরকাল নির্ভর করে মানুষের ইহজন্মের কর্মের উপর। মৃত্যুর পর মানুষ একত্রিশ লোকভূমিতে গমন করে। এই একত্রিশ লোকভূমি হছে চারপ্রকার অপায় : তীর্যক, প্রেতলোক, অসুর, নরক। সাত প্রকার স্বর্গ : মনুষ্যলোক, চতুর্মহারাজিক স্বর্গ, তাবতিংশ স্বর্গ, যাম স্বর্গ, তুষিত স্বর্গ, নির্মাণরতি স্বর্গ, পরনির্মিত বসবতি স্বর্গষোলো প্রকার রূপব্রহ্মভূমি। চার প্রকার অরূপব্রহ্মভূমি -- এই একত্রিশ প্রকার লোকভূমির উপরে সর্বশেষ স্তর হচ্ছে নির্বাণ (পরম মুক্তি)। যেমন : ইহজন্মে মানুষ যদি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, গুরুজনের রক্তপাত ঘটায় তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ চার উপায়ে (তীর্যক, প্রেতলোক, অসুর, নরক) জন্মগ্রহণ করে, আর ইহজন্মে মানুষ যদি ভালো কাজ করে তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ বাকি আঠাশ লোকভূমিতে গমন করে।বৌদ্ধধর্মে এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার কোনো ধারণা নেই। বলা হয়ে থাকে বুদ্ধও নাকি স্রষ্টার প্রশ্নে নীরব ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ধর্মগ্রন্থকে স্রষ্টার বাণী হিসাবে বিশ্বাস করা হয় না। বৌদ্ধরা জন্মান্তরবাদ তথা কর্মের উপর ভিত্তি করে জন্ম-মৃত্যু'র চক্রে বিশ্বাস করে। তাদের এও বিশ্বাস যে, গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছেন।
অলৌকিক নয়, লৌকিকসিরিজের চতুর্থ খণ্ডে প্রবীর ঘোষ বলছেন – “প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ছান্দোগ্যতে আমরা প্রথম পেলাম পুনর্জন্ম কল্পনার কথা। সে কথা এল কল্পনার হাত ধরে, অজ্ঞতার পিঠে সওয়ার হয়ে, সেই কল্পনাকে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে প্রবলভাবে প্রথম কাজে লাগাল ভারতের ক্ষত্রিয় ও পুরোহিত সম্প্রদায়। পুনর্জন্মের গর্ভে জন্ম নিল কর্মফল’-এর কল্পনা। কর্মফল তত্ত্ব হতদরিদ্র, বঞ্চিত মানুষদের শোনাল হে বৈশ্য, হে শূদ্র, এই যে প্রতিটি বঞ্চনা, এর কারণ হিসাবে তুমি যদি কোনো ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ বা উচ্চকুলের মানুষকে দায়ী করো, তবে তুমি ভুল করবে। এইসব উচ্চকুলের মানুষরা তো তোমার বঞ্চনার উপলক্ষ্য মাত্র। তোমার বঞ্চনার মূল কারণ পূর্বজন্মের কর্মফল। ভারতে দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে জন্মান্তর ও কর্মফলে বিশ্বাসের ফলস্বরূপ এ দেশের বঞ্চিত মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের বিদ্রোহ করেনি, বিপ্লবে শামিল হয়নি
মানুষদের জন্মান্তর হয় কী হয় না সে জন্মান্তরবাদীরাই বলতে পারবেন। কিন্তু মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে যে আরও কোটি কোটি প্রজাতির কোটি কোটি মানবেতর প্রাণীদের বসবাস আছে, তাদেরও মৃত্যু হয় তাদেরও পুনর্জন্ম হয় কি না সে কথা কোনো ধর্মের কোনো ধর্মবেত্তাই বলেননি।সে না বলুক, মানুষের কিছু এসে গেলেও মানবেতর প্রাণীদের কিছু এসে যায় না ।
জন্মান্তর হোক বা না-হোক, মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায় ? -- এই প্রশ্নটাই তামাম মানুষকে অস্থির করে তোলে। তবে মৃত্যুর পর মানুষের যাওয়ার জায়গা দুটি স্বর্গ ও নরক। কোথায় স্বর্গ ? কোথায় নরক ? কারা যাবে স্বর্গে ? কারাই-বা নরকে যায় ?
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর ? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!কবির প্রশ্নে কবিই উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্ন তো আমাদের সবারও। বর্তমান বিশ্বের বিখ্যাত তাত্ত্বিক, পদার্থ বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদ স্টিফেন হকিং সম্প্রতি মৃত্যুর পরে স্বর্গের অস্তিত্ব আছে এমন ধারণা উড়িয়ে দিয়েছেন । তিনি মত প্রকাশ করেন যে, অন্ধকার দেখে ভীত হয় এবং মৃতুভীতিতে আক্রান্ত মানুষের বানানো কাল্পনিক এক গল্পই হচ্ছে স্বর্গ। স্টিফেন হকিং বলেছেন, স্বর্গ-নরকের ধারণা অলীক কল্পনামাত্র। মানুষের মস্তিষ্ক পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে মৃত্যু তাকে গ্রাস করে। এরপর আর কোনো কিছুই উপলব্ধি করার সামর্থ্য থাকে না মানবসত্তার। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনার দশম খণ্ডে লিখলেন, “মৃত্যুর পর মানুষ স্বর্গে যায় এটা কল্পনামাত্র। সজ্জন ব্যক্তি মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়া অনন্ত সুখময় জীবনযাপন করে এই ধারণা স্বপ্নমাত্র। স্বর্গ ও নরক এসব আদিম ধারণাজন্নতের অর্থ: বাগ-বাগিচা, জাহান্নাম অর্থ : অগ্নিকুণ্ড। পার্শি ভাষায় বেহেস্ত-দোজখ -- বাংলায় স্বর্গ-নরক বলা হয়। সপ্তস্বর্গ বা সাত বেহেশত হচ্ছে প্রধান প্রধান ধর্মসমূহে বর্ণিত মৃত্যু-পরবর্তী আবাসস্থল যেখানে শুধু পৃথিবীতে সৎকর্মসম্পাদনকারী এবং বিশ্বাসীগণ স্থান পাবেন। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মে সাত স্বর্গের কথা বলা হয়েছে। ইব্রাহিমীয় ধর্মসমূহে বলা হয় এই সাত স্বর্গের ঠিক উপরেই সৃষ্টিকর্তার সিংহাসন অবস্থিত। জন্নত বা বেহেশত হচ্ছে ইসলামের পরিভাষায় স্বর্গ। মুসলমানগণ বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরে ইমানদার এবং পরহেজগার ব্যক্তিগণ জান্নাতে অনন্তকাল ধরে বাস করবে। আরবি জন্নত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাগান বা উদ্যান। কোরান শরিফে একাধিকবার সপ্তস্বর্গের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক সময় সাত বেহেশত বা জন্নতকে সাত আসমান বলা হয়।কোরান বর্ণিত সাত আসমানগুলি হল – (১) ফিরদাউস, (২) দারুস সালাম, (৩) জান্নাতুল মাওয়া, (৪) দারুল খুলদ, (৫) জান্নাতুল আদন, (৬) জান্নাতুল আখিরাহ, (৭) জান্নাতুন নাঈম।ইসলাম মতে মূলত জন্নত-জাহান্নাম বলতে স্থুল-সূক্ষ্ম জগতের দৈহিক-মানসিক শান্তি-অশান্তির অবস্থা বোঝায়। জীবন-মৃত্যু যেমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তেমনই জন্নত-জাহান্নামও। যে যেখানেই থাকুক শান্তিই স্বর্গ, অশান্তিই নরক। ইব্রাহিমের অগ্নিকুণ্ডই ছিল তার জন্য জন্নত।
হিন্দুধর্মে স্বর্গকে স্বর্গলোক বলা হয় যা সাতটি লোক বা তলের সমন্বয়ে গঠিত। পর্যায়ক্রমে এই লোকগুলো হচ্ছে -- ভূলোক (পৃথ্বী লোক বা পৃথিবী), ভূভার লোক, স্বর্গ লোক, মাহার লোক, জন লোক, তপো লোক এবং সব থেকে উপরে সত্যলোক (ব্রহ্মলোক)। হিন্দু পুরাণ এবং অথর্ববেদে ১৪ টি লোকের কথা বলা হয়েছে। এর সাতটি স্বর্গলোক, বাকি সাতটি নরক বা পাতাল। সপ্তস্বর্গের ঠিক নিচেই সপ্ত নরক অবস্থিত। স্বর্গের রাজধানী হল অমরাবতী এবং ঐরাবত স্বর্গের প্রবেশদ্বার পাহারা দিচ্ছে। বৈদিক বা হিন্দু ধর্ম অনুসারে স্বর্গ শুধু দেবদেবীদের বাসস্থান ৷ তাই স্বর্গে কোনো রোগ, শোক, তাপ, মৃত্যু কিছুই নেই৷ স্বর্গে চিরবসন্ত বিরাজমান থাকবে ৷ আর স্বর্গবাসীদের মনের আনন্দের জন্যে সেখানে থাকবে -- নন্দনকানন, পারিজাত বৃক্ষ, সুরভী গাভী কামধেনু, ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব ইত্যাদি ৷ এখানেই শেষ নয়, আছে স্বর্গবাসীদের কামনা-বাসনা পূরনের জন্যে অপ্সরা, মেনকা, রম্ভা, কিন্নরী, গন্ধর্ব ইত্যাদি সুন্দরী নারীগণ। হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রানুসারে স্বর্গের অবস্থান এক দুর্গম ও দূরারোহী এবং অতি উচ্চে অবস্থিত এক স্থানে ৷ আকাশ নয়, যার অবস্থান সুমেরু পর্বতের উপরে ৷ ভৌগোলিকদের মতে, স্থানটি ছিল বর্তমান হিমালয় পর্বতের অংশ বিশেষ ৷ বর্তমানে হিমালয়ে যেভাবে সহজে আরোহণ করা যায়, তখনকার দিনে অসাধারণ শারীরিক ও মানসিক শক্তি সম্পন্ন না-হলে কেউ সেখানে পৌঁছোতে পারত না ৷ এইজন্যই বোধহয় মহাভারত”-এর স্বর্গারোহণপর্বে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ছাড়া দ্রৌপদী সহ বাকি চার পাণ্ডবের পতন ও মৃত্যু হয়। দেবদেবীরা নাকি ওখানেই থাকতেন, উহাই নাকি স্বর্গলোক। ওই উঁচু জায়গা থেকে নীচু সমতল ভূমিকে বলা হত মর্ত্যলোক, মর্ত্যলোকে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীরা থাকে ৷ কারণ দেবদেবী ছাড়া কাউকে স্বর্গে যেতে দেয়া হত না। সুর-অসুরের দ্বন্দ্বের কাহিনির এখান থেকেই শুরু। স্বর্গের অধিকারের প্রশ্নে বারবার দেবতা-অসুরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। শাসক-দেবতাদের বিরুদ্ধে শোষিত-অসুরদের স্বাভাবিক পরাজয়।এই দ্বন্দ্বই আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব হিসাবে বিশ্লেষিত হয়। যুধিষ্ঠিরের স্বর্গগমনের পথ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই জায়গাটি কৈলাস হিসাবে পরিচিত ছিল, যা বর্তমানে হিমালয় পর্বতের চিন-ভারত অংশে অবস্থিত ৷ বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণম্”-এ লঙ্কেশ্বর রাবণ মর্ত্য থেকে স্বর্গে আরোহণ করে দেবগণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। আর সাধারণ মানুষ পুণ্যের তারতম্য অনুসারে ক্রমান্নয়ে ঊর্ধ্ব হতে ঊর্ধ্বতম স্বর্গের অধিকারী হতে পারে, আবার পাপ অনুসারে নিম্ন থাকে নিম্নতর নরকে নিপতিত হতে হয়৷ অবশ্য এর আগে একটি বৈতরণী নদী (পৌরাণিক এই নদী ওড়িশা রাজ্যে বহমান) পার হতে হয় তাকে। নিরাপদে ওই বৈতরণী অতিক্রমকারীরা স্বর্গ লাভ করে এবং অতিক্রম করতে পতিত হয় পচা রক্তমাংসে পরিপূর্ণ দুর্গন্ধযুক্ত ও তপ্ত নদীর জলেহ্যাঁ, পাপীদের সেখানেই থাকতে হবে অনন্তকাল৷ হিন্দুশাস্ত্রে বৈদিক ও পৌরাণিক ঋষি মুনিগণ প্রথমেই প্রচার করে সবাইকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন পাপপূণ্য তুলাদণ্ডে ওজন করে পরিমাপের বিধানসহ পাপপূণ্যের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করেন ভগবান।
প্রাচীনকালে মানুষ ভাবত নরক হল পৃথিবীর পেটের ভিতর, মানে মাঝখানে। গ্রিক কাব্যকথায় বার বার উঠে আসে নরকদেবতা হেইডিসের আবাস পাতালে। খুব ছোট্টবেলায়, মানে সত্তর/আশির দশকে এক ধরনের ক্যালেন্ডার পাওয়া যেত। বেশ বড়ো মাপের। পাপ করলে যমরাজ কীভাবে তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকেন, তারই গোটা কুড়িক হাতে আঁকা স্ন্যাপ। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, শাস্তি যারা পাচ্ছেন তারা সকলেই উলঙ্গ। এখন আর ওই ক্যালেন্ডার দেখি না। তাহলে কী এখন আর কেউ পাপ করে নরকে যাচ্ছেন না ! প্রসঙ্গ বলে রাখি, পুণ্যবানদের যমরাজ কোথায় রাখেন কী খাওয়ান কী করান কত সুখে রাখেন সে বিষয়ে কোনো ক্যালেন্ডার দেখিনি। যাই হোক, এবার আমরা দেখে নিতে চেষ্টা করব আরও কিছু ধর্মাবলম্বীদের পাপপুণ্যের বিভিন্নতা।
(১) ইরানীয় ধর্মের স্বর্গ-নরক : প্রাচীন ইরানীয় পুরাণ মতে, ধর্মগুরু জরাথ্রুস্টের জেন্দ আবেস্তানামক গ্রন্থটি থেকে জানা যায় ইরানীয় দেবতা অহুর মাজদা। ইরানীয় দেবতা অহুর মাজদা একেবারে নিরাকার ব্রহ্ম ছিলেন না, তাকে ব্যক্তিসত্তার অধিকারী এক স্বর্গবাসী দেবতা মনে করা হত৷ এই মত অনুসারে মৃত্যুর পর জীবিতকালের পাপ ও পুণ্যের শাস্তি এবং পুরস্কারের বিধান ছিল৷ অবশ্য তার আগে প্রথমে মৃতের দেহকে এক দানব অধিকার করে নেবে এবং আত্মাকে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক পর্যায়ে এসে আত্মার মাঝে জ্ঞানের সঞ্চার হবে, তখন আত্মাকে চিন্দভাদনামক এক ব্রিজ বা সেতু পার হতে হবে৷ পুণ্যবানরা অনায়াসে সেতু পার হতে পারবে এবং দেবতার সঙ্গে মিলিত হবে। দেবতা অহুর মাজদা ওই পুণ্যবানদের বসার জন্য স্বর্ণসিংহাসনের ব্যবস্থা করেন। সেই সঙ্গে হুরান-ই-বেহেস্তনামক সুন্দরী পরিদের সঙ্গে অনন্তকালের যৌনমিলনের ব্যবস্থা করে দেবেন৷ অপরদিকে জীবিতকালে পাপ কার্য করেছে বলে যে আত্মাগণ সেতু পার হতে সফল হলেন না, তারা নরকে নিক্ষেপ করে যন্ত্রণা ভোগ করবে৷
(২) ইহুদি ধর্মের স্বর্গ-নরক : ইহুদিদের ধর্মকে জুডাইজম বলে। জুডাইজম ধর্মমতে মানুষের মৃত্যুর পর বিচারের একটি শেষদিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে৷ সেইদিনই মৃতদের আত্মার পুনরুত্থান ঘটবে এবং পুনরুত্থানের পর আত্মাদের জীবিতকালের পাপপুণ্যের বিচার হয়৷ ইহুদিদের আত্মাকেও সেতু পার হতে হয় এবং পাপপুণ্যের বিচার হয়৷ সেতু অতিক্রমে অসফল আত্মাগণ নিীচের নরক-নদীতে নিক্ষেপিত হয়ে শাস্তি ভোগ করে। ইহুদিদের মতে মানুষের পাপপুণ্যের পরিমাণ দুটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে এবং তুলাদণ্ডের দু-দিকে স্থাপন করে প্রতিজনের পাপপুণ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে যেদিকে পাল্লা ভারি হবে, সে অনুসারে ব্যবস্থা হবে। অর্থাৎ, পুণ্যের ভাগ ভারী হলে স্বর্গলাভ এবং পাপের ভাগ ভারী হলে নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে অনন্তকাল।
ইহুদিদের স্বর্গের নাম এদন বা ইডেন। ইডেন বহু মূল্যবান পাথরখচিত। তিনটি দ্বার বিশিষ্ট ও চারটি প্রবাহমান নদী থাকবে ইডেনে (প্রথম প্রবাহিত নদীর নাম পিশোন, যা সমস্ত হবিলাদেশ বেষ্টন করে প্রবাহিত ছিল। দ্বিতীয় নদীর নাম ছিল গিহোন, যা সমস্ত কুশদেশ বেষ্টন করে প্রবাহিত ছিল৷ তৃতীয় নদীর নাম হিদ্দেকল, এটা অশুরিয়া দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং চতুর্থ নদীর নাম ছিল ফরাৎ৷ ঐতিহাসিকদের মতে পিশো, গিহো, হিদ্দেকল ও ফরাৎ -- এই চারটি নদীর উৎপত্তি এলাকার মধ্যে ওই সময়ে ইডেন নামে একটা জায়গা ছিল৷ আন্দাজ করা হয়ে থাকে যে, ইডেন জায়গাটি বর্তমান তুরস্ক দেশের পূর্বভাগের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত একটি অঞ্চল৷ তাওরাতে উল্লিখিত নদী চারটি ওই অঞ্চল থেকেই উৎপন্ন হয়ে পিশোন ও গিহোন কৃঞ্চসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে এবং হিদ্দেকল ফরাৎ নদীদ্বয় একত্রিত হয়ে পারস্য উপসাগরে পতিত হয়েছে৷)। নদীগুলির প্রথমটিতে দুধ থাকবে, দ্বিতীয়টিতে মধু থাকবে, তৃতীয়টিতে সুরা থাকবে এবং চতুর্থটিতে সুগন্ধিযুক্ত নির্যাস প্রবাহিত হতে থাকবে৷ এ ছাড়া একটি উৎকৃষ্ট উদ্যানও থাকবে। সেখানে প্রচুর সুমিষ্ট ফল এবং সুগন্ধ-সৌন্দর্যময় ফুলে পরিপূর্ণ থাকবে৷
(৩) খ্রিস্টান ধর্মের স্বর্গ-নরক : বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের উল্লেখ আছে, মানুষ আপন পাপকর্ম দ্বারাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। উপরন্তু মৃত্যুর পর আত্মা দেহ থেকে বিকারপ্রাপ্ত এবং ধুলোয় পরিণত হয়৷ মৃত্যু ব্যক্তিদের মধ্যে যারা পূণ্যবান তারা দেহত্যাগের পরে তাদের আত্মা স্বর্গে গমন করে। অপরদিকে মৃত্যু ব্যক্তিদের মধ্যে যারা পাপী তাদের আত্মা শেষ বিচারের শাস্তির জন্য প্রস্তুত হয়৷ বিচারের দিন পবিত্র আত্মা জিশুখ্রিস্ট স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন এবং বিচারাসনে উপবিষ্ট হবেন৷ সেদিন মৃতগণ কবর থেকে উত্থিত হবে বিচারের সম্মুখীন হতে৷ বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত পাপীগণ চিরপ্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। অপরদিকে পুণ্যবানরা অত্যুজ্জ্বল আলোকমালায় শোভিত প্রসাদে পাঠানো হবে। সেখানে পুণ্যবানদের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষগণ, দেবদূতগণ, স্বয়ং প্রভু জিশুখ্রিস্টও তাদের সঙ্গে আনন্দোৎসবে যোগদান করবেন। খ্রিস্টমতে বিচারকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর নয়, জিশুই শেষ বিচারের বিচারক।
(৪) প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে স্বর্গ-নরক : প্রাচীন মিশরীয় ফারাও ধর্ম মতে, যুগ বিবর্তনান্তে তিন থেকে দশ হাজার বছর পরে মৃত ব্যক্তির আত্মা পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবে৷ আর এই বিশ্বাস থেকেই বোধহয় মিশরে মৃতদেহ রক্ষার প্রথা প্রবর্তিত হয়েছিল৷ প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাস বা সমাধিগাত্রে মৃত ব্যক্তিদের জীবন সংক্রান্ত বিভিন্ন কথা লিখে রাখার প্রচলন ছিল৷ মৃতের বর্ণনায় দেখা যায় যে, প্রত্যেক মৃতকে পরমেশ্বরের কাছে একটা শপথ বা এফিডেভিট দিয়ে জীবিতকালে তার পাপপূণ্য কাজের হিসাব দিতে হবে৷ পরে ওই সত্যপাঠের সত্যমিথ্যা যাচাই করবেন জ্ঞানের দেবতা থৎএবং হোরাস৷ দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হবে মৃতের হৃৎপিণ্ড৷ বিচারের পর দুইটি দ্বার দিয়ে স্বর্গ অথবা নরককুণ্ডে প্রবেশ করতে হবে৷ পুণ্যাত্মাগণ আলুনামক স্বর্গধামে প্রবেশ করে মনের আনন্দে শস্যক্ষেত্র চাষ করবে এবং পাপাত্মাদের নরককুণ্ডে পাঠিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে জ্বলন্ত আগুনে পোড়ানো অথবা গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে৷

(৫) চিনা ধর্মের স্বর্গ-নরক : চিন দেশের প্রাচীন ধর্মমত অনুসারে পাপপুণ্যের বিচারে স্বর্গ ও নরক লাভের বিধান প্রচলিত ছিল৷ ওই গ্রন্থে ন্যায়-অন্যায় ও পাপপুণ্যের বিচার, পুরস্কারের ও দণ্ডের বিবরণসহ অনেক বিষয় উল্লেখ ছিল, যা দ্বারা মানুষ ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ বুঝে চলতে পারে৷ অবশ্য সুকিংনামক গ্রন্থটি চিনদেশের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাচীন গ্রন্থ বলে পরিচিত , যা কনফুসিয়াস সংকলন করেন বলে কথিত আছে৷ যেখানে মৃত্যুর পরে স্বর্গ-নরকের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট তেমন কিছুর উল্লেখ নেই। তবে কনফুসিয়াস দর্শন অনুসারে দেহাংশ পঞ্চভূতে মিশে যাবে এবং অশরীরী আত্মা সংসারে অদৃশ্য আকারে উপস্থিত থেকে আপন সংসার ও জগতের মঙ্গল সাধন করতে থাকবে। মানে মানুষের শারীরিক মৃত্যু হবে নিশ্চয়, তবে আত্মার মৃত্যু নেই -- তাই কনফুসিয়াস প্রলয় শেষে পুনরায় সৃষ্টি বা পরলোক বিষয়ে কোনো বক্তব্য স্পষ্ট করেননি ৷
(৬) বৌদ্ধধর্মের স্বর্গ-নরক : বৌদ্ধধর্ম মতে এই পৃথিবীর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই৷ তাঁরা মনে করেন জগত অনন্তকাল থেকে বিদ্যমান আছে এবং অনন্তকাল ব্যাপি এভাবেই থাকবে৷ বৌদ্ধধর্ম অনুসারে বিশ্বের আকৃতি চিরকালই একরূপ আছে এবং আগামীতেও ওই একরূপই থাকবে৷ কর্মানুসারে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীগণ সংসারে ঘুরে বেড়ায় মাত্র ৷ বৌদ্ধধর্মে স্বর্গ-নরক, দেবদূত বা ফেরেস্তা, পয়গম্বর বা নবি এবং শেষ বিচার ও শয়তান সহ অন্যান্য বিষয়াদির উল্লেখ নেই।
স্বর্গের লোভ আর নরকের ভয়ে দুটি বিষয়ই মানুষকে ধর্মের প্রতি অতি অনুরাগী করে তুলেছে।এ ছাড়া মানুষের ধর্মবিশ্বাসী হওয়ার অন্য কোনো কারণ নেই।মানুষ বড়ো স্বার্থপর। আত্মা বলে যদি কিছু না থাকে তাহলে স্বর্গে বা নরকে যাবে কে ? তাই আত্মার স্বর্গে বা নরকে পাড়ি দেওয়ার চিন্তা অবান্তর কল্পনামাত্র।তাই স্বর্গ ও নরকও অবান্তর কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।তাই স্বর্গে যাওয়ার জন্য ধর্ম পালন করাও ভূতের ব্যাগার খাটা বৈকি।তাই কল্পিত স্বর্গে পাড়ি দেওয়ার আকাশকুসুম স্বপ্ন না দেখে আমরা যদি আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটাকেই আরও সুন্দর করে তুলতে পারি তাহলে সেটাই হবে প্রকৃত সুখের।আসলে স্বর্গ আর নরক বলে আলাদা কোনো জায়গা নেই। আকারেও নেই, নিরাকারেও নেই। অস্তিত্বে নেই, অনস্তিত্বেও নেই। আকাশেও নেই, পাতালেও নেই। তাহলে কি স্বর্গ-নরক ব্যাপারটা পুরোপুরিই ভাঁওয়া ? না, একদমই ভাঁওতা নয়। স্বর্গ-নরক আছে এই পৃথিবীর বুকেই। চোখ-কান খোলা রাখলেই আপনি স্বর্গদর্শন এবং নরকদর্শন করতে পারেন। উপভোগ করতে পারেন স্বর্গসুখ, অথবা হাড়ে-হাড়ে ভোগ করতে পারেন নরকযন্ত্রণা।স্বর্গবাস বা স্বর্গসুখ তাঁরাই ভোগ করেন, যাঁরা সৎকর্ম, সৎ জীবনযাপন, সৎ চিন্তা, যে অন্যের অনিষ্ট করেন না (ভাবেনও না), যে পরস্ত্রী এবং পরশ্রীতে কাতর নয়, যিনি কখনো কোনো অন্যায় কাজ করেন না, যিনি পরোপকারী ইত্যাদি। অপরদিকে তাঁরাই নরকযন্ত্রণা ভোগ করেন, যাঁরা অসৎ কর্ম, অসৎ জীবনযাপন, অসৎ চিন্তা, যে অন্যের অনিষ্ট করেন (ভাবেন), যে পরস্ত্রী এবং পরশ্রীতে কাতর, যিনি অন্যায় কাজকর্মে লিপ্ত থাকেন ইত্যাদি। এমন কি ধর্ম বা ঈশ্বরের নামেও যাঁরা বিভিন্ন অন্যায় সম্পাদন করেন, তবুও তাঁরা নরকযন্ত্রণা ভোগ করবেন (চন্দ্রস্বামী, আশারাম, আফজল, মাসুদ, সাদ্দাম হোসেইন, লাদেনদের কথা মনে করুন) কথা মনে করুন। প্রথম পক্ষ অমরত্বের ভাগীদার হতে পারেন, দ্বিতীয় পক্ষের অমরত্বে সম্ভাবনা একেবারেই থাকে না। অমরত্ব সম্ভব? কেন নয় ? আলবৎ অমরত্ব লাভ করা সম্ভব। কীভাবে ?
জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে ?” মধুকবির রচিত এই পংক্তির পর সব প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ হয়ে যায়। তবুও আমি সামান্য কিছু না-লিখে থাকতে পারছি না। মানুষ মরণশীল। শুধু মানুষ কেন, সব প্রাণীই মরণশীল। জন্ম হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। উদ্ভিদ থেকে প্রাণী সকলেরই মৃত্যু হয়। এ যেন জন্মের ঋণশোধ মৃত্যু দিয়েমৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। সকলকে যে মরতেই হবে এ-কথা আমরা পূর্বজ্ঞাত। মায়াময় পৃথিবী। চিরতরে বিলীন হতে মন চায় না কারোর। মনে হয় রয়ে যাই অনন্তকাল। তাই চাই অমরত্ব। ধর্মশাস্ত্রগুলিতে অমরত্বের লেনদেনে ছড়াছড়ি। অসুরগণ দেবতাদের কাছে অমর বর চেয়ে চরমতম কৃচ্ছ্রসাধন করছেন। অপরদিকে দেবতারাও মুড়ি-মুড়কির মতো অমরত্ব দিচ্ছেন। দু-হাত তুলে অসুরদের অমর বর প্রদান করছেন এবং হত্যা করেছেন। অসুররা অমর নন, এমন কী সুর বা দেবতারাও অমর নন হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবতা, এর মধ্যে কটা দেবতা বেঁচে আছেন যাঁদের স্মরণ করা হয় ! তাহলে অমরত্ব কী ? সংক্ষেপে অমরত্ব হল মৃত্যুহীন জীবন।
পৃথিবীতে যত লোক আছে তার মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্গত জর্জিয়ার অধিবাসীগণের পরমায়ু পৃথিবীর আর সব রাষ্ট্রের অধিবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের গড় আয়ু ৯০ বছর। সে দেশের বেশির ভাগ লোক মারা যায় একশত বছরেরও ঊর্ধ্বে গিয়ে। এমনকি ১৫০ বছর বয়সি বৃদ্ধের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এত দীর্ঘজীবী হয়েও কেউ অমরত্ব লাভ করতে পারেনি। আমরা বস্তুত পুরাণ এবং রামায়ণ-মহাভারত-উপনিষদে অমরত্বের বিষয়টা জানতে পারি। এখানে দেবতারা সকলেই অমর এবং অসুররাও অমর, কিন্তু তাঁদের নানা ছিদ্রান্বেষণ করে মৃত্যুদান করেছেন দেবতাগণ।
হিন্দুশাস্ত্র মতে, পুরাকালে রম্ভা অসুর নামে এক অসুর ছিল। তার পুত্র মহিষাসুর ছিলেন অসুরদের রাজা। মহিষাসুর ব্রহ্মার ভক্ত ছিলেন। অমরত্ব বর লাভের আশায় ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করতেন। তপস্যারত অবস্থায় একদিন ব্রহ্মা এসে মহিষাসুরের কাছে হাজির হলেন এবং বললেন, “মহিষাসুর তুমি কি চাও?” মহিষাসুর উত্তরে  বললেন, “আমি অমরত্ব চাইব্রহ্মা বললেন, “না না মহিষাসুর, এই বর তুমি প্রার্থনা করো না; এই বর শুধু দেবতারা লাভ করতে পারে, কোনো অসুর নয়, অন্য বর প্রার্থনা করোএইভাবে অমরত্ব লাভে কয়েক বার ব্যর্থ হয়ে শেষে মহিষাসুর কঠিন থেকে কঠিনতর তপস্যায় লিপ্ত হলেন। ব্রহ্মা তার তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে বলেন, “তোমার কঠিন তপস্যায় আমি মুগ্ধ হয়েছি, বলো তোমার প্রার্থনা কী ?” মহিষাসুর বললেন, “হে দেবকর্তা, আপনি আমাকে এমন বর দিন যাতে আমি ত্রিভূবন জয় করতে পারিব্রহ্মা বললেন, “তথাস্তু, সর্বত্র অপরাজেয় থাকবে; শুধু নারী ছাড়াউত্তরে মহিষাসুর বললেন, “হে দেবকর্তা, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি নারীর ভয়ে ভীত নই
বরলাভের পর অসুরদের রাজা মহিষাসুর ঘোর অত্যাচারী  হয়ে উঠলেন। স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। দীর্ঘ দিন ধরে যুদ্ধ চলতে থাকল। অবশেষে দেবতারা হেরে গেলেন। অসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে দেবতাদের  সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন এবং সর্বত্র অন্যায়-অত্যাচারের রাজ্য কায়েম করলেন। তার অত্যাচার-অনাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাজ্যহারা দেবতারা একদিন এক সভায় সমবেত হলেন। তারা ব্রহ্মাকে অগ্রদূত করে মহাদেব ও বিষ্ণুর কাছে  অসুরের নানাবিধ অত্যাচার-অনাচারের কাহিনি  বর্ণনা করলেন। সেই গণ-অভ্যুত্থানের কাহিনি শুনে মহাদেব ও বিষ্ণু ক্রোধে গর্জে উঠলেন। ব্রহ্মাও ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। ক্রোধের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, ক্রোধে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজ বের হতে লাগল। সকলের তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল আলোকপুঞ্জে পরিণত হল। এই আলোকপুঞ্জ থেকেই আবির্ভূত হলেন এক নারী দেবীর মুর্তি -- দেবী দুর্গা। নির্মাণ হল শিবের তেজে দেবীর মুখ। বিষ্ণুর তেজে তার বাহুসমূহ, যমের তেজে কেশপাশ, ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, ব্রহ্মার তেজে তার ত্রিনেত্রর উৎপন্ন হয়। দেবতারা নিজ নিজ অস্ত্র থেকে একটি করে নতুন অস্ত্র সৃষ্টি করে মহামায়া দুর্গাদেবীর দশ হাতের সাজিয়ে দিলেন ।শিব তার কালান্তক ত্রিশূল, বিষ্ণু তার অমোঘচক্র, বরুণ তার ভীমনাদ শঙ্খ, অগ্নি তার অব্যর্থ শক্তি, বায়ু তার ত্রিদিক বিজয়ী  ধন এবং বাণপূর্ণ দুইটি অক্ষয় তূণীর, ইন্দ্র তার দুর্নিবার  বজ্র, বিশ্বকর্মা তার খরশান কুঠার ও অভেদ্য বর্ম এবং হিমালয় বাহন রূপ সিংহ দিলেন। দশহাতে দেবী মহাশক্তি নিয়ে অসুর বধে বেরিয়ে পড়লেন। যুদ্ধ আরম্ভ হল। মহিষাসুর ক্ষণেক্ষণেই নিজের রূপ পবির্বতন করে  দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। একসময় দেবীর এক খড়গের আঘাতে অসুরের মস্তক ধর থেকে আলাদা হয়ে গেল।
সব অসুরই অমর বর পেয়েছিলেন এবং সব অসুরদেরই বরদাতাদের ষড়যন্ত্রে মরতেও হয়েছে। অসুরদের অমরত্বের অধিকার নেই, মানুষ সহ পৃথিবীর কোটি কোটি প্রাণীদেরও সেই অধিকার নেই।
আমরা গ্রিক পুরাণেও  অমরত্বের খোঁজ পাই। দেখি, কী সেই কাহিনি --  রিক পর্বত অলিম্পিয়াসে দেবরাজ জিউস এবং দেবী হেরার ঘরে জন্ম নেয় হারকিউলিস। ছোটোবেলা থেকেই হারকিউলিস ছিল বেশ শক্তিশালী, তার বাল্যকালের একমাত্র বন্ধু ছিল পাখাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাস।সমস্ত দেবতা হারকিউলিসকে খুব পছন্দ করত, শুধু ব্যতিক্রম ছিল জিউসের ভাই হেডস । হেডস জিউসকে ঘৃণা করত । হেডস জিউসের মতো অলিম্পিয়াসের রাজা হতে চেয়েছিল, অলিম্পিয়াসের রাজা হওয়ার জন্য হেডস তিন ভাগ্যদেবীর (ক্লোতো, ল্যাচেসিস, অ্যাট্রোপোস) সাহায্য চায়, সেই তিন ভাগ্যদেবী যারা কিনা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জানতেন। কিন্তু ভাগ্যদেবীরা তাকে জানায় ১৮ বছর পরে টাইটান নামক এক দৈত্য দ্বারা জিউসকে হত্যা করা গেলেও হারকিউলিস সেই দৈত্যকে হত্যা করবে । এরপর হেডস বিকল্প ভাবতে লাগলেন। হেডস হারকিউলিসকে হত্যার জন্য এক ধরনের বিষ তৈরি করেন, কিন্তু তিনি হারকিউলিসকে সেই বিষ সম্পূর্ণরূপে পান করাতে ব্যর্থ হন । পরবর্তীতে হারকিউলিস তার পালিত পিতা-মাতার (আনফিট্রাইয়ন ও আলকেমিন) কাছে বড়ো হন।
ছোটোবেলা থেকে হারকিউলিস মোটামুটি নিঃসঙ্গ ছিল এবং তার শক্তি ছিল তার অন্যতম সমস্যা --  সে যা কিছুই ছুঁয়ে দেখার চেস্টা করত সেটাই ভেঙে যেত। হারকিউলেস একাকীত্ব এবং অন্যান্য সমস্যা তার পালিত মা-বাবা বুঝতে পারে। তারপর হারকিউলিসকে বোঝানো হয় সে দেবতার ঘরে জন্ম নেওয়া এজন্যই সে অন্যদের থেকে ভিন্ন রকম ।
হারকিউলিস তার জন্মের রহস্য উন্মোচনের জন্য সে জিউসের মন্দিরে যায় এবং সেখানে গিয়ে সে অবাক হয় যখন সে দেখতে পায় জিউসের এবং হেরার মূর্তি জীবিত হয়ে গেছে । এবং জিউস এবং হেরা স্বীকার করে যে তারাই তার আসল পিতামাতা। হারকিউলিস তার আসল পিতামাতার কাছে থেকে যেতে চায় , কিন্তু জিউস তাকে বলে এখানে শুধু দেবতারাই থাকতে পারবে , তুমি যদি কোনোদিন নিজেকে এই পৃথিবীর সত্যিকারের বীরে পরিণত করতে পার, তবেই তুমি এখানে থাকতে পারবেহারকিউলিস নিজেকে সত্যিকারের বীরে পরিণত করার জন্য তার বাবার কথা অনুযায়ী বীর তৈরির শিক্ষক ফিলোকটেসের কাছে যায় এবং তার কাছে দীক্ষিত হওয়ার পর জীবনের প্রথম পরীক্ষার জন্য থেবসের দিকে রওনা হয় ।
মাঝপথে  সে দেখতে পায় অর্ধমানব এবং অর্ধ ঘোড়ার সংমিশ্রণে এক দৈত্য একটি সুন্দরী মেয়েকে আক্রমণ করেছে । হারকিউলিস ওই দৈত্যটা বধ করে মেয়েটিকে উদ্ধার করে । মেয়েটির নাম ছিল মেগার । হারকিউলিস মেয়েটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে যায় ।এদিকে হেডস (জিউসের ভাই ), হারকিউলিসকে হত্যা করার জন্য একের পর এক দানব পাঠাতে থাকে । হারকিউলিস সবাইকেই পরাজিত করে এবং পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী বীরে পরিণত হয় ।কিন্তু তারপরও সমস্যা থেকে যায়, হারকিউলিস অমরত্ব পায় না। পারে না অলিম্পিয়াসে গিয়ে তার পিতা-মাতার সঙ্গে থাকতে । হারকিউলিস তার পিতাকে জিজ্ঞেস করে, সে এত দৈত্য বধ করার পরেও কেন অমরত্ব পাচ্ছে না। জিউস তাকে বলে তুমি যত সাহসী হও না-কেন, যতদিন তোমার হৃদয়ে কোনো দুর্বলতা থাকবে, ততদিন তুমি অমরত্ব পাবে না । হারকিউলিস খুঁজতে থাকে তার আসল দুর্বলতা কোথায় ! অবশেষে হারকিউলিস বুঝতে পারে তার একমাত্র দুর্বলতা মেগারা ।হেডস এই কথা জেনে যায় এবং বুদ্ধি করে মেগারাকে বন্দি করে । অবশেষে মেগারাকে মুক্ত করার জন্য হারকিউলিস একদিনের জন্য তার শক্তি সমর্পণ করতে রাজি হয়। এইসময় হেডস সাইক্লোপস নামক এক তেজি দৈত্যকে পাঠায় হারকিউলিসকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু হারকিউলিস ফিলোকটেসের সাহায্যে সাইক্লোপসকে হত্যা করে। সেই সাইক্লোপ্সের যুদ্ধের সময় মেগারা আহত হয় । ফলে হেডসের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী হারকিউলিস তার শক্তি ফিরে পায় । কারণ শর্ত ছিল মেগারাকে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ফেরত দিতে হবে।
এদিকে হেডস টাইটান নামক এক দৈত্যকে অলিম্পিয়াসে পাঠায় দেবতা জিউসকে হত্যা করার জন্য। হারকিউলিস আহত মেগারাকে ফিলোকটেসের কাছে রেখে  জিউসকে রক্ষা করতে চায় । হারকিউলিস কোনো অস্ত্র ছাড়াই টাইটানকে হত্যা করে তার পিতাকে রক্ষা করে।  হেডস যখন দেখল তার কোনো পরিকল্পনা কাজে আসছে না, তখন সে হারকিউলিসকে বলল, “মেগারা মারা গেছেএই কথা শুনে হারকিউলিস ভেঙে পড়ে এবং সেই সঙ্গে মেগারার সঙ্গে সহমরণের ইচ্ছা জানায় এবং একই সঙ্গে মেগারার আত্মা যেখানে থাকবে সেখানে যেন তার আত্মা রাখা হয় সেই দাবিও জানায়। অবশেষে ভালোবাসার জন্য এই আত্মাহুতির ইচ্ছা হারকিউলিসকে দেবতাদের কাছে সত্যিকারের বীরের মর্যাদা দেয়।কথিত আছে হারকিউলিস এবং মেগারা অমর হয়ে দুজনে একসঙ্গে পৃথিবীতে বসবাস করতে লাগল ।
হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে -- যখন ব্রহ্মকে প্রত্যেক বিষয় প্রতীতির মধ্যে জানা যায়, তখনই সম্যগ্জ্ঞান হয় এই জ্ঞান থেকেই ব্যক্তি অমৃতত্ব লাভ করেন আত্মার জ্ঞান থেকেই পুরুষ বীর্য লাভ করেন, বিষয়ের জ্ঞান থেকে নয় বিদ্যা অর্থাৎ একত্বের জ্ঞান দ্বারা তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন, জ্ঞানী ব্যক্তি প্রত্যেক বোধ বা প্রতীতির সঙ্গে তার প্রকাশক এবং দ্রষ্টারূপে আত্মার বিদ্যমানতাও উপলব্ধি করেন তিনি বুঝতে পারেন যে, বোধগুলি বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন হলেও এদের বোধ প্রকাশক এবং দ্রষ্টা আত্মা এক, অখণ্ড, ধ্বংসহীন এবং নিত্যজ্ঞান স্বরূপ এক আত্মাই সমস্ত বোধকে ধারণ করে আছে এভাবে প্রত্যেক বোধ বা প্রতীতির সঙ্গে আত্মার যে উপলব্ধি -- এটাই হল যথার্থ জ্ঞান বা সম্যগ্দর্শন জাগতিক প্রত্যেক বস্তুর জ্ঞানের সঙ্গে যিনি ব্রহ্মকে অনুভব করেন তাঁর জীবন ব্রহ্মময় হয়ে যায় এবং তিনি বিশ্বময় ব্রহ্মকেই দর্শন করেন এ জন্যও একে সম্যগ্দর্শন বলা হয়েছে এই দর্শন থেকেই অমৃতত্ব লাভ হয় এবং সম্যগ্দর্শনপ্রাপ্ত ব্যক্তিই শোক, দুঃখ- অজ্ঞান মোহময় পার্থিব জীবনের ঊর্ধে উঠে অমৃতময় আনন্দময় জীবন লাভ করেন
আত্মার জ্ঞান থেকে বীর্য লাভ হয় বলা হয়েছে এখানে বীর্যের অর্থ অমৃতত্ব লাভের সামর্থ্য বিষয়ের জ্ঞান যে বীর্য দেয় তাতে অমৃতত্ব লাভ হয় না, আমাদের শোকদুঃখের অতীত করতে পারে না, মৃত্যুভয় নিবারণ করতে পারে না একমাত্র আত্মার জ্ঞান থেকেই এই সামর্থ্য লাভ হয় কারণ তখনই মানুষ বুঝতে পারে-- 'আমি ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি বিশিষ্ট দেহ নই, আমি আত্মা, আমি জন্মমৃত্যুহীন, আমি চৈতন্যস্বরূপ, আমি দেহাদির মত ধ্বংসশীল জড় পদার্থ নই|' এই জ্ঞান থেকেই বীর্য লাভ হয় যার দ্বারা শোক- দুঃখ জয় করা যায়, মৃত্যুভয় নিবারিত হয়।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য  মৈত্রেয়ীকে বলছেন, “মৈত্রেয়ী, আমি এই স্থান (আশ্রম) হইতে চলিয়া যাইতেছি। এই কাত্যায়নীর সহিত তোমার ভাগ-ব্যবস্থা করিয়া দিতেছিমৈত্রেয়ী বলেন, “ভগবান, সমস্ত পৃথিবী যদি বিত্ত দ্বারা পূর্ণ হয়, আমি কি তাতে অমর হইতে পারিব ?” যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, “না, সম্পদশালী ব্যক্তিদের জীবন যেমন তোমার জীবনও সেইরকম হইবে। বিত্তের দ্বারা অমরত্বের আশা নাইমৈত্রেয়ী বললেন, “যাহা দ্বারা আমি অমরত্ব লাভ করিতে পারিব না, তাহা দ্বারা কী করিব ? – “যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাৎসেই অমরত্বের প্রশ্ন  !
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, মানুষের আয়ু ক্ষণস্থায়ী। অতীতকালে মানুষের আয়ু ছিল অনেক। কিন্তু পরবর্তীকালে আল্লাহ মানুষের আয়ু কমিয়ে দেন। ধর্মগ্রন্থগুলিতে বর্ণনায় আছে, প্রথম মানুষ হজরত আদম ৯৩০ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। অবশ্য আদমের চেয়েও বেশি বেঁচেছিলেন নুহ। নুহ ৯৫০ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। এছাড়া ইয়ারুদ ৯৬২, মুতাশালেহ ৯৬৯, শিশ ৯১২, কিনান ৯১০, আনুশ ৯০৫, মাহলাইল ৮৯৫, লামাক ৭৭৭, ইব্রাহিম ১৭৫, ইসমাইল ১৩৭, ইসহাক ১৮০, ইয়াকুব ১৪৭, ইউসুফ ১১০, লুত ১৩৭, কহাত ১৩৩, ইমরান ১৩৭, জিহোয়াদা ১৩০, ইউসা ১১০, সারা ১২৭ বৎসর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ইনোক ৩৬৫ বছর পৃথিবীতে ছিলেন। এরপর তাকে আর দেখা যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে কি তিনি মারা যাননি ? কিতাব মতে, ইনোক মারা যাননি। তাকে আল্লাহ তুলে নিয়েছেন। কিন্তু কেউই দৈহিক অমরত্ব লাভ করেনি। আল্লাহ যে আয়ু নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তা তিনি বদলে দিতে পারেন। যেমন তিনি হিস্কিয়ের আয়ু ১৫ বছর বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই আধুনিক যুগে মানুষ কত বছর পর্যন্ত বাঁচে ? এক এক দেশে এক এক রকম গড় আয়ু আছে। হজরত মোহাম্মদ ৬৫ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তার আগের নবি হজরত ঈসা মাত্র ৩৩ বৎসর বেঁচে ছিলেন।
মরণশীল মানুষ পাবে অমরত্ব, চিরযৌবন -- এমনটি ভাবতে কার-না ভালো লাগে ? অমরত্ব লাভের চেষ্টা তো আর আজ-কালকের ব্যাপার নয়। হাজার হাজার বছর ধরে সেই চেষ্টা চালাচ্ছে মানুষ। পুরাণেও এমন চেষ্টা নিয়ে আছে হাজার কাহিনি। শ্রীমদ্ভাগবত, মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ, কূর্মপুরাণ, মৎসপুরাণ, বরাহপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, গরুড়পুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি  গ্রন্থসমূহে উল্লেখ্য যে, অমৃতের সন্ধানে সমুদ্রমন্থন করা করা হয়েছিলো। অমৃত সন্ধানের উদ্দেশ্য ছিল অমরত্ব লাভ করা। কথিত আছে যে, অসুরদের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করে দেবতারা তাঁদের শক্তি হারিয়ে ফেললে, সেইজন্য তাঁরা বিষ্ণু কাছে শক্তি ও অমরত্ব লাভ প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু দেবতাদের উপদেশ দেন যে, সমুদ্রমন্থন করে অমৃত উঠে এলে তা পান করে অমরত্ব লাভ করা যাবে। সমুদ্রমন্থনের জন্য বিশালাকার মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড ও বাসুকি সর্পকে মন্থন রজ্জুরূপে ব্যবহার করে সমুদ্রগর্ভে মন্থন-কার্য শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিশালাকার মন্দার পর্বতের ভারে সমুদ্রের তলদেশ পাতালে প্রবেশ করে এবং মন্থন-কার্যে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। অতঃপর বিষ্ণু কুর্মাবতার রূপে নিজের পিঠে মন্দার পর্বত ধারণ করে মন্থন কার্য সুসম্পন্ন করেন। পুরাণে অমৃত সম্বন্ধে উল্লেখ আছে -- পৃথুরাজার উপদেশ অনুসারে ধরিত্রীকে গাভীরূপা ও ইন্দ্রকে বৎস করে দেবতাদের দ্বারা হিরন্ময় পাত্রে দুগ্ধ দোহন করা হলে তা হতে অমৃত উৎপন্ন হয়। কিন্তু দুর্বাসার অভিশাপে এই অমৃত সমুদ্র গর্ভে পতিত হয়। পরে ইন্দ্র দুর্বাসার দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে বিষ্ণুর কাছে যান। তখন বিষ্ণু নিজে কুর্মরূপ ধারণ করেন এবং মন্দার পর্বতকে নিজের পিঠে ধারণ করে  বাসুকিকে মন্থন-রজ্জুতে রূপান্তরিত করে সমুদ্র মন্থন-কার্য শুরু হলে অমৃত উৎপন্ন হয়। সুর-অসুরের সম্মিলিত প্রয়াসে সমুদ্র মন্থন হয়েছিলে। শর্ত অনুসারে অমৃতের অর্ধেক অসুরদের প্রাপ্য ছিল । কিন্তু পূর্ব প্রতিশ্রুতি তথা শর্ত ভঙ্গ করে দেবতারা ছলনার আশ্রয় নেয়। বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করে অমৃত বিভিন্নস্থানে গোপন স্থানে সংরক্ষণ করে রাখেন। পরে তা দেবতাদের মধ্যে বিতরণ করেন। বিষ্ণু যে যে স্থানে অমৃত সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন সেই সেই স্থানেই কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে জনশ্রুতি। 
কাশীদাসী মহাভারতে অন্য এক অমরত্ব অর্থাৎ অমৃতলাভের কাহিনি পাচ্ছি : নারায়ণ বলেন, “এই ক্ষীরসিন্ধুর মধ্যেই আমার অবস্থান। আমার নাম মোহিনী। আমি অযোনিসম্ভূতা। তোমাদের কলহ আমি সহ্য করতে না-পেরে এখানে উপস্থিত হয়েছি। কী কারণে তোমরা কলহ করছ ?” মোহিনীরূপী নারায়ণের এই কথা শুনে সবাই বলল, “অমৃতের কারণে সুর এবং অসুরের এই দ্বন্দ্ব। দেবীর আগমনে ভালই হল। এবার তিনিই সুধা ভাগ করে দিনমোহিনী বললেন, “সকলে আমার বিধান না-ও মানতে পারে । এর ফলে তারা আমার উপর ক্রুদ্ধ হবেনতখন দেবাসুর সবাই সমবেত হয়ে একযোগে বলেন, “যে তারা দেবীর সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন
মোহিনীরূপী হরি তখন অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে একদিকে দেবতাদের ও অপরদিকে অসুরদের দুই সারিতে বসালেন এবং অমৃত বন্টন শুরু করলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দেবতারা  বলেন, “যেন মোহিনী এবং দেবতাদের আগে সুধা বিতরণ করেনদৈত্যেরা সেই দাবি মেনে নেন। মোহিনী এইভাবে তেত্রিশ কোটি দেবতাদের অমৃত পান করিয়ে বাকি শেষাংশ তিনি নিজে পান করেন। এমন সময়ে সদাজাগ্রত চন্দ্র ও সূর্য মোহিনীকে ডেকে বলেন যে, “দৈত্য রাহু দেবতার রূপ ধারণ করে অমৃত পান করে ফেলেছেন।এই কথা শুনে নারায়ণ যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে তাঁর সুদর্শনচক্রের সাহায্যে রাহুর মুণ্ড  দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। তা সত্ত্বেও অমৃতের প্রভাবে রাহুর মৃত্যু হল না। তার মুণ্ডই হল রাহু ও দেহ হল কেতু। -- চক্রেতে অসুর-মুণ্ড করিল ছেদন।।/তথাপি না মরিলেক সুধাপান হেতু।/মুখ হৈল রাহু, কলেবর হৈল কেতু।।দৈত্যরা ক্রোধে জ্বলে উঠল। দৈত্যরা দেবতাদের মারতে স্বর্গে রওনা দিল। শুরু হল দেবতা ও দৈত্যের যুদ্ধ। অমৃত পান করে দেবতারা শক্তিশালী হয়েছিল, দৈত্যরা তাদের পরাজিত করতে পারল না। তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে নিজেদের স্থানে ফিরে গেল। দেবতারাও স্বর্গে ফিরে গেলেন।
সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ রাহুগ্রাসের ফলেই হয় একথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করেন। যেহেতু রাহু দেবতার ছদ্মবেশে অমৃত পান করা সূর্য ও চন্দ্র দেখে ফেলে এবং মোহিনীরূপী নারায়ণকে সেকথা জানিয়ে দেয় এবং ফলে নারায়ণের ক্রোধে তাঁর মুণ্ডকর্তন হয়, সেইহেতু নিয়ম করে সূর্য-চন্দ্রকে ভক্ষণ করে। রাহু স্কন্দ-কাটা বলে মুখ দিয়ে ভক্ষণ করলে কাটা গলা দিয়ে সূর্য-চন্দ্র বেরিয়ে আকাশে বিরাজ করে।
অমরত্ব লাভের আরও একটি জনপ্রিয় পুরাণ-কাহিনি শোনাই : কশ্যপের দুই স্ত্রী বিনতা এবং কদ্রু। বিনতা এবং কদ্রু সহোদরা। গরুড় কশ্যপ ও বিনতার পুত্র এবং কদ্রুর পুত্রেরা হল সর্প। কদ্রু একবার কশ্যপের কাছে বর প্রার্থনা করেন যে, ওর যেন এক হাজার নাগ-সন্তান হয়। বিনতা সেই কথা শুনে কশ্যপের কাছে বর চান যে, ওঁর মাত্র দুটি সন্তান হলেই চলবে।শর্ত একটাই, তারা যেন কদ্রুর সন্তানের থেকে বেশি বলশালী হয়। বিনতার সেই দুই সন্তানের এক হলেন সর্পভুক গরুড়। ঘটনা চক্রে বিনতা কদ্রুর দাসীত্বে পরিণত হয়েছিলেন। কদ্রুর সর্প-সন্তানরা গরুড়কে বলেছিলেন যে, তিনি যদি তাদের জন্য অমৃত নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে বিনতার দাসীত্ব মোচন হবে। গরুড় তাঁর অমিত বাহুবলে ইন্দ্রাদি দেবতাদের পরাস্ত করে অমৃত নিয়ে যখন ফিরছেন তখন বিষ্ণু গরুড়কে অমৃতলোভী  নয় বুঝে বর দিতে চাইলেন। গরুর বর চাইলেন যে, অমৃত পান না-করেও তিনি অজেয় ও অমর হতে পারেন। বিষ্ণু গরুড়কে বরদান করে তাঁকে নিজের বাহন হিসাবে চাইলেন। গরুড় রাজি হলেন। ফেরার পথে ইন্দ্রের সঙ্গে গরুড়ের আবার যুদ্ধ হল। ইন্দ্র তাঁর বজ্র দিয়ে আঘাত করেও গরুড়ের ক্ষতি করতে পারলেন না। অবশ্য গরুড় ইন্দ্র ও তাঁর বজ্রের সন্মানার্থে একটিমাত্র পালক-পতন ঘটালেন। সেই সুন্দর পালক দেখে সকলে আনন্দিত হয়ে ওঁর নাম দিলেন সুপর্ণ। গরুড় অজেয় জেনে ইন্দ্র গরুড়ের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করে অমৃত ফেরত চাইলেন। গরুড় বললেন যে, বিশেষ উদ্দেশ্যে তিনি অমৃত নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যেখানে তিনি অমৃতভাণ্ডটি রাখবেন, সেখান থেকে ইন্দ্র সেটি হরণ করতে পারেন। ইন্দ্র তাতেই খুশি। খুশি হয়ে গরুড়কে বর দিতে চাইলেন। গরুড় বর চাইলেন, মহাবল সর্পরা যেন গরুড়ের ভক্ষ্য হয়। গরুর অমৃত এনে কুশের উপর রাখতেই সর্পরা বিনতাকে দাসীত্ব থেকে মুক্ত করে দিল।  কিন্তু সর্পদের অমৃত ভক্ষণের আগেই ইন্দ্র হরণ করে পগারপার। ভাগ্যিস !
মানুষকে সেই বিশ্বাস দিতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা জানিয়েছেন, মানুষকে চিরযৌবন দিতে তাঁরা শিগগিরই নিয়ে আসছেন এক মহৌষধ। এ ওষুধ মানুষের অকালবার্ধক্যকেই ঠেকাবে। সেই সঙ্গে আয়ুও বাড়িয়ে দেবে ১০ বছরের বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী বলছেন -- অমরত্ব বলতে যদি আপনি মনে করেন আপনার শরীরটিকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখা, তাহলে তা হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না, কারণ আপনি নানাভাবে আপনার মৃত্যু প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করলেও একটি দুর্ঘটনায় আপনার মৃত্যু হতেই পারে। যাই হোক, মানুষ সত্যিকারের অমরত্ব লাভ করবে তখনই, যখন মানুষ তার স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে পারবে। এই যে আপনি আপনাকে অনুভব করছেন এ সবকিছুই আপনার স্মৃতিতে সংরক্ষিত ডাটার কারণেই।  ধরুন, আপনার ব্রেইনে সংরক্ষিত সব স্মৃতি একটি কম্পিঊটারে সংরক্ষণ করে রাখা গেল, এখন এই স্মৃতি যদি অন্য একটি দেহে প্রতিস্থাপন করা হয় তাহলে ওই দেহকেই আপনি আপনার নিজের দেহ বলে মনে করবেন। জীববিজ্ঞান যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে করে একটি কৃত্রিম মানবদেহ তৈরি করা হয়তো আনুমানিক ৫০ বছরের মধ্যে সম্ভব হতে পারে। তবে মানুষের ব্রেইনের জটিল বিন্যাস বুঝে তা থেকে ডাটা এক্সট্রাক্ট করে সংরক্ষণ করা এবং পরবর্তীতে তা আবার জৈব মস্তিস্কে স্থাপন করার প্রযুক্তি অর্জন করতে এখনও বেশ খানিকটা সময় লাগবে হয়তো। তবে কাজ চলছে, একদিন হয়ত সমাধানও আসবে। ২০৪৫ সালের মধ্যে হয়তো অমরত্ব লাভ হবে না, তবে মানবজাতি আরও দু-একটি শতাব্দী টিকে থাকলে অমরত্ব লাভ হবে বলে আশা করি।

অমরত্ব লাভের উপায় : তাহলে কী অমরত্ব লাভের কোনো উপায় নেই ? আলবাৎ আছে। আমি মনে করি দুটি উপায় আছে। দুটি উপায়ে মানুষের অমরত্ব লাভ সম্ভব। দেখুন পছন্দ হয় কি না --
(১) কীর্তিযস্য স জীবতি”:  সেটা হল সময়ের মূল্য বুঝে যে কাজ করেছে, মরেও অমর তারা পৃথিবীতে। যে ব্যক্তি মহৎ কোনো কিছু করে জগতে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করতে পারলেন, তিনিই অমর হলেন। তাজমহল নির্মাণ করে সম্রাট শাহজাহান অমরত্ব লাভ করেছেন। মিশরের ফ্যারাওরা পিরামিড তৈরি করেও অমর হয়ে আছেন। অমর যদি হতে চান তবে একটা কীর্তি স্থাপন করুন। মার্কনি সাহেব রেডিয়ো আবিষ্কার করে অমর হয়েছেন। স্টিভেনসন রেলগাড়ি তৈরি করে অমর হয়ে আছেন। হোমার ইলিয়াডঅডিসিকাব্য রচনা করে  অমর হয়ে আছেন। কালিদাস, কৃত্তিবাস ওঝা, কাশীরাম দাস প্রমুখগণ মহাকাব্য রচনা করে অমর হয়ে আছেন। মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে অমর হয়ে আছেন। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করে অমর হয়ে আছেন। জগদীসচন্দ্র বসু গাছের প্রাণ আছে এটা প্রমাণ করে ফ্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করে অমর হয়েছেন। রাজকাপুর, রাজেশ খান্না, সুনীল দত্ত, নার্গিস, সুরাইয়া, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, দেবানন্দ প্রমুখেরা স্মরণীয় অভিনয় করে অমর হয়ে আছেন। মুকেশ, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মোহম্মদ রফি, কিশোরকুমার গান গেয়ে অমর হয়েছেন। পরিতোষ সেন, ভ্যান ঘগ, পাবলো পিকাসো, লিওনার্দো-দ্য-ভিঞ্চি প্রমুখগণ চিত্রকলায় অবদান রেখে অমরত্ব পেয়েছেন। বৈবস্বত মনু, হজরত মোহম্মদ, জরাথ্রুস্ট, কনফুসিয়াস, শংকরাচার্যরাও অমর হয়েছেন। সক্রেটিস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখরাও অমরত্ব লাভ করেছেন। ভবিষ্যতে এমনই আরও হাজার হাজার মানুষ অমরত্ব পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁরাও। মানুষ অমর হতে পারে তার সৃষ্ট মহৎ কাজের মাধ্যমে।
(২) মরণোত্তর দেহদান : পুরাণ ও মহাকাব্যে দেহদানের কাহিনি পাওয়া যায়। অথর্ব মুনির সন্তান ছিল দধীচি। দধীচি মুনি ছিলেন শিবভক্ত। বৃত্রাসুর একবার স্বর্গ আক্রমণ করে এবং সেখান থেকে দেবতাদের তাড়িয়ে দেয়। দেবতারা বৃত্রাসুরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করার সময় জানতে পারেন দধীচি মুনির অস্থিনির্মিত অস্ত্র ছাড়া অন্য অস্ত্রে তাঁকে হত্যা করা যাবে না। তখন দেবরাজ ইন্দ্র দধীচি মুনির কাছে এসে প্রার্থনা জানান। অকুণ্ঠিতচিত্তে দধীচি পরের উপকারের জন্য নিজের জীবনদানে সম্মত হন। দধীচি বলেন, নশ্বর অস্থিপঞ্জর লোকের উপকারে লাগানো অপেক্ষা জীবের পক্ষে অধিকতর সৌভাগ্যর বিষয় আর কী হতে পারে ! এরপর দধীচি যোগবলে দেহত্যাগ করলে তাঁর অস্থি বা হাড় দিয়ে বজ্রাস্ত্র তৈরি করা হয়। সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র, বজ্রাস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হল বৃত্রাসুরকে। এইভাবেই পুরাণে বজ্রাস্ত্র নির্মাণে দেহদানের মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন মহান দধীচি।
মৃতদেহ এখন আর শুধু অ্যানাটমি শিক্ষার কাজেই ব্যবহৃত হয় না, এর প্রায়োগিক ক্ষেত্র আজ বহুদূর বিস্তৃত। শব-ব্যবচ্ছেদের সহায়তায় মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয়, রোগের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ, চিকিৎসা চলাকালীন ঘটে-যাওয়া ত্রুটিবিচ্যুতি অনুসন্ধান এবং জীবিত রোগীর দেহে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় দেহকলা সংগ্রহের জন্যও মৃতদেহ প্রয়োজন। তার জন্য অতি দ্রুত ধর্মীয় সংস্কার তথা আত্মা-পরলোক-জন্মান্তরবাদের ভ্রান্ত ধারণা কাটিয়ে উঠতে হবে।না হলে খুব দেরি হয়ে যাবে ।
আমাদের দেশে (ভারত) জনসংখ্যা ১২১ কোটি ছুঁই ছুঁই। বিজ্ঞান আন্দোলনকারী সংগঠনের প্রভাবে ও সরকারি প্রচার মাধ্যমের উৎসাহদানে এই বিরাট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশও দেহদানে অঙ্গীকার করলে এবং তা সংগৃহীত হওয়ার কাঠামো তৈরি হলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত কারণে মানুষ মারা যাবে না। মরদেহের অভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাশাস্ত্রের স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্যক্রম থেকে শব-ব্যবচ্ছেদবিষয়টি তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে।গত প্রায় ৪০ বছর যাবৎ ছাত্রছাত্রীরা শব-ব্যবচ্ছেদ না-করেই প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের ব্যাবহারিক নোট খাতা থেকে টুকে নিজেদের নোট খাতা জমা দিয়ে যাচ্ছেন। এটা ওপেন-সিক্রেট ! ফলে স্নাতক ডাক্তারদের অনেকেরই শব-ব্যবচ্ছেদের হাতেখড়ি হচ্ছে না এবং নিদানিক শব-ব্যবচ্ছেদ না-করায় চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক প্রাথমিক বিষয় না জেনেই তাদের চিকিৎসা-জীবন শুরু করতে হচ্ছে। এ রাজ্যের সবকটি মেডিক্যাল কলেজে প্রতি বছর প্রায় ৭৫২ জন ছাত্রছাত্রী ভরতি হয়। তাদের পর্যাপ্তভাবে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য বছরে অন্ততপক্ষে ১৫০টি মৃতদেহের প্রয়োজন। সেই জায়গায় বছরে মাত্র ২০/২৫টি দেহ পাওয়া যায়। ফলে শব-ব্যবচ্ছেদের বিষয়টি উঠে যাওয়ার কারণ বুঝতে দেরি হয় না। সেই সঙ্গে এটাও বোঝা যায় বাস্তব জ্ঞানের অভাবে চিকিৎসকদের ভুল অপারেশন করার রহস্য।
এমতাবস্থায় এই সমস্যার সমাধানে একটা পথই খোলা আছে। সেটা হল মরণোত্তর দেহদান। মরণোত্তর দেহদান জারি থাকলে প্রয়োজন অনুযায়ী কিডনি, লিভার, অগ্ন্যাশয়, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কর্নিয়া, মজ্জা, চামড়া বা ত্বক ইত্যাদি রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। কে বলতে পারে কবে, কখন, কার দরকার হতে পারে একটি শরীর-যন্ত্র ! কোথায় পাবেন ? কীভাবে পাবেন ? কেবলমাত্র অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অঙ্গের অভাবে আমাদের মৃত্যু হবে ?!
আসুন, সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে ধর্মের গন্ধ-মাখানো পরিচিতি মুছে ফেলতে এবং বিজ্ঞানের তথা মানুষের উন্নতির জন্য। সর্বোপরি, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরও বেশি মানুষ মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হই এবং অন্যকে অনুপ্রাণিত করি। একের মরণোত্তর অঙ্গ ভিনশরীরে অবস্থান করে নতুন প্রাণের মধ্য দিয়ে নশ্বর দেহ অমরত্ব প্রাপ্ত হয়। আমারই যকৃৎ অথবা কিডনি অথবা ফুসফুস অথবা হৃদপিণ্ডের সাহায্যে যখন অন্যের শরীরের রক্তধারা প্রবাহিত হবে তখন এ অমরত্ব কার !
মৃত্যু তো একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই বলে আত্মহত্যা !  মৃত্যু, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে মৃত্যু নয় ; এমন মৃত্যু দু-রকম হয় – (১) আত্মহত্যা এবং (২) ইচ্ছামৃত্যু। আত্মহত্যা এবং ইচ্ছামৃত্যু এক ব্যাপার নয়। সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করব।
আত্মহত্যা : প্রথমেই আসি আত্মহত্যা প্রসঙ্গে। আত্মহত্যা বা আত্মহনন (Suicide) হচ্ছে একজন নর কিংবা নারী কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। লাতিন ভাষায় সুই সেইডেয়ারথেকেই এসেছে “Suicide” (যা বাংলা তর্জমায় আত্মহত্যা”) শব্দটি, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ নিজেকে নিজে হত্যা করেন, তখন এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলা হয়। ডাক্তার বা চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতিমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যিনি নিজেই নিজের জীবন বা প্রাণ বিনাশ করেন, তিনিই আত্মঘাতক বা আত্মঘাতী বা আত্মঘাতিকা বা আত্মঘাতিনীরূপে সমাজে পরিচিত হন।
প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নীচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি, প্রায় তিন থেকে চার গুণ।
হিন্দুধর্ম মতে আত্মহত্যা : হিন্দুধর্ম মতে আত্মহত্যা মহাপাপ। হিন্দুধর্ম আত্মহত্যাকে গর্হিত বলে আখ্যা দিয়েছে। মৃত্যুর পরে আত্মহত্যাকারীর অবস্থান কোথায় হয়? ঈশ উপনিষদে আত্মহত্যার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। সাবধান করে বলা হয়েছে যে আত্মহত্যাকারী মৃত্যুর পর আনন্দহীন লোকে গমন করে।''অনন্দা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবতাঃ।/তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ।।'' (ঈশ উপনিষদ,৩) অর্থাৎ, অন্ধের ন্যায় অন্ধকারে আবৃত একটি লোক আছে। তার নাম আনন্দলোক। যারা আত্মহত্যা করে তারা মৃত্যুর পর সেই লোকে যায়।
তবে Section 306 in The Indian Penal Code বলছে, “Abetment of suicide.—If any person commits suicide, whoever abets the commission of such suicide, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine.”
Section 309 ধারায় বলা হয়েছে, “Whoever attempts to commit suicide and does any act towards the commission of such offence, shall be punished with simple imprisonment for term which may extend to one year 1[ or with fine, or with both]”.
তবে এবার আর আত্মহত্যা করা চেষ্টা অপরাধ নয় । এতদিন পর্যন্ত ভারতীয় পিনাল কোডের ৩০৯ ধারা অনুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টা অপরাধ হিসাবে গণ্য হত। বুধবার কেন্দ্রীয় সরকার এই ধারাটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এতদিন পর্যন্ত আত্মহত্যার চেষ্টা করে ধরা পড়লে এক বছর পর্যন্ত কারাবাস ও জরিমানা হত। নিজেকে মেরে ফেলতে সফল না-হলে জেলের চার দেয়ালে ভিতর সময় কাটাতে হত। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজিজু লোকসভায় জানিয়েছেন, আইন কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ৩০৯ ধারাটিকে ভারতীয় পিনাল কোড থেকে বাদ দিতে চলেছে। আইন কমিশন তাদের ২১০তম রিপোর্টে জানিয়েছিল এই ধারা অমানবিক। তাই সংবিধানিক হোক বা অসংবিধানিক আইপিসি-র ৩০৯ ধারাকে বাতিল করা উচিত।এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মানসিক অবসাদের ফলে যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এই আইন বাতিল হলে সেই ব্যক্তিদের কষ্ট হয়তো কিছুটা কমবে।আইন কমিশনের মতে, আত্মহত্যার চেষ্টা আসলে অসুস্থ মানসিক অবস্থারই বহিঃপ্রকাশ। শাস্তির বদলে প্রয়োজন চিকিৎসা ও পর্যাপ্ত সহানুভূতি।বহুদিন ধরেই এই আইন নিয়ে সমালোচনা চলছিল। সমালোচকরা দাবি করেছিলেন এই আইন অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অযৌক্তিক। একজন মানুষ সাধারণত সাঙ্ঘাতিক কষ্ট থেকে নিজের জীবন শেষ করতে উদ্যোগী হন। তার উপর আইনি শাস্তি পেলে সেই ব্যক্তির কষ্ট, উদবেগ কয়েকগুণ বাড়ে বই কমে না।
অবশ্য অনেকের মতে, একজন ব্যক্তির জীবন তাঁর কাছে যতখানি মূল্যবান ঠিক ততখানিই মূল্যবান তার দেশের কাছেও। কেউ যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে দেশ, প্রশাসন তাঁর প্রতি চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না।
ইসলাম মতে আত্মহত্যা : ইসলাম মতে, আত্মহত্যা মহাপাপ। এ কাজ থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ  বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিণামের কথা ভাবার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহাপবিত্র আল কোরানে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। মহান আল্লাহ রাববুল আলামিন বলেন, “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে উহা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করব, আল্লাহর পক্ষে উহা সহজসাধ্য।” (সুরা-নিসা-২৯-৩০) আরও  কিছু সতর্কবাণী -- (ক) সাহাবা আবু হোরায়রা  হতে বর্ণিত রাসুল  বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের উপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে।(খ) যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে।(গ) যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।(ঘ) রাসুল  বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে সেও দোজখেও  সেইভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে।(ঙ) হজরত জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ  বলেন যে, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড়ো তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।
খ্রিস্টধর্ম মতে আত্মহত্যা : পবিত্র বাইবেলে ছয়জন লোকের কথা বলা হয়েছে যারা আত্মহত্যা করেছিল, তারা হলেন --  অবিমেলক (বিচারকর্তৃগণ ৯:৫৪), শৌল (১ স্যামুয়েল ৩১:৪), শৌলের অস্ত্রবহনকারী (১ স্যামুয়েল ৩১:৪-৬), অহিথোফল     (২ স্যামুয়েল ১৭:২৩), সিম্রি (১ রাজাবলি ১৬:১৮) এবং জিহুদা (মথি ২৭:৫)। এদের পাঁচজনই ছিল দুষ্ট, পাপী লোক (কিন্তু শৌলের অস্ত্রবাহকের চরিত্র সম্বন্ধে তেমন করে বিচার করা যায় না)। আবার কেউ কেউ শিমশোনের ঘটনাও আত্মহত্যা বলে থাকে (বিচারকর্তৃগণ ১৬:২৬-৩১)। কিন্তু আসলে শিমশোনের উদ্দেশ্য ছিল পলেস্টীয়দের মেরে ফেলা, নিজেকে মেরে ফেলা নয়। বাইবেলে আত্মহত্যাকে খুন সমতুল্য বলা হয়, যার মানে নিজেকে খুন করা। একমাত্র ঈশ্বর ঠিক করে দেবেন কে কখন কীভাবে মারা যাবে। বাইবেল অনুসারে, একজন লোক স্বর্গে যেতে পারবে কি না তা তার আত্মহত্যা করার উপরে নির্ভর করে না। যদি উদ্ধারপ্রাপ্ত নয় এমন একজন আত্মহত্যা করে, তবে সে নরকের পথে দ্রুতএগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করল না। যাই হোক, যে আত্মহত্যা করেছে সে খ্রিস্টের মাধ্যমে পরিত্রাণ বা উদ্ধার অস্বীকার করার ফলে চুড়ান্তভাবে নরকে যাবে, আত্মহত্যা করার জন্য নয়। তাহলে, একজন খ্রিস্টীয়ান আত্মহত্যা করলে বাইবেল তার সম্বন্ধে কি বলে ? বাইবেল বলে, যে মুহূর্তে আমরা সত্যিকারভাবে খ্রিস্টকে বিশ্বাস করেছি, আমরা অনন্ত জীবনের নিশ্চয়তা পেয়েছি (জোহন ৩:১৬)। বাইবেল অনুসারে, সকল সন্দেহের ঊর্ধে একজন খ্রিস্টীয়ান জানে যে, সে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়েছে (১ জোহন ৫:১৩)। ঈশ্বরের ভালোবাসা থেকে একজন খ্রিস্টীয়ানকে কোনো কিছুই আলাদা করতে পারে না (রোমীয় ৮:৩৮-৩৯)। যদি কোনো সৃষ্ট বস্তুএকজন খ্রিস্টীয়ানকে ঈশ্বরের ভালোবাসা থেকে আলাদা না করতে পারে, তাহলে আত্মহত্যার মতো সৃষ্ট বস্তুও একজন খ্রিস্টীয়ানকে ঈশ্বরের ভালোবাসা থেকে আলাদা করতে পারে না। তবে আত্মহত্যা অবশ্যই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে একটা মারাত্মক পাপ। বাইবেল অনুসারে আত্মহত্যা মানে খুন, তাই তা সবসময়ই ভুল। কারণ ঈশ্বরের জন্য খ্রিস্টীয়ানদের বেঁচে থাকতেই ডাকা হয়েছে এবং কখন তারা মারা যাবে তা সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের, শুধুমাত্র ঈশ্বরেরই সিদ্ধান্ত।
সহায়তা : আমাদের নিজেদের জীবন শেষ করার ক্ষমতা রয়েছে ৷ প্রতিবছর এক মিলিয়ন মানুষ এই পথ বেছে নেয়৷ এমনকি যেসব সমাজে আত্মহত্যা বেআইনি বা নিষিদ্ধ সেখানেও মানুষ আত্মহত্যা করে৷ যাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয় তাদের মনে হয় আর কোনো পথ নেই ৷ সেই মুহুর্তে মৃত্যুই তাদের জগতের শ্রেষ্ঠ উপায় হয়ে ওঠে এবং এদের আত্মহননের এই সুতীব্র ইচ্ছাশক্তিকে কখনোই অগ্রাহ্য করা উচিত না -- এই অনুভূতি সত্যিকার, শক্তিশালী ও তাত্ক্ষণিক৷ জাদুবলে এটা সরিয়ে তোলা যায় না৷ তবে একথাও সত্যি যে – () প্রায়ই সাময়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধান আত্মহত্যা হয়। (২) আমরা যখন বিষণ্ণ বোধ করি, তখন বর্তমান মুহুর্তের খুব সংকীর্ণ প্রেক্ষাপটে আমরা জীবনটাকে দেখি৷ এক সপ্তাহ বা এক মাস পর হয়তো সবকিছু সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাবে। (৩) যারা একসময় আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল তাদের মধ্যে বেশির ভাগ আজও বেঁচে আছে বলে খুশি ৷ তারা বলে তারা জীবন শেষ করে দিতে চায়নি -- শুধু যন্ত্রণাটা দূর করতে চেয়েছিল৷
সবচেয়ে জরুরি কাজ, কারোর সঙ্গে কথা বলা৷ যাদের আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা হয় তাদের একা সব সামলানোর চেষ্টা করা উচিত নয় ৷ তাদের এখনই সাহায্য চাওয়া উচিত৷ (১) বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কথা বলুন ৷ শুধুমাত্র পরিবারের সদস্য বা বন্ধু কিংবা সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে অনেকটা আশ্বস্ত হওয়া যায়। (২) একজন বিফ্রেন্ডারের সঙ্গে কথা বলুন৷ কয়েকজন পরিবার বা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারে না ৷ কয়েকজনের অচেনা লোকের সঙ্গ কথা বলা সহজ মনে হয়৷ সারা পৃথিবীতে বিফ্রেন্ডারদের কেন্দ্র আছে, এদের স্বেচ্ছাসেবীদের কথা শোনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ ফোনে কথা বলা কষ্টকর মনে হলে ইমেল পাঠানো যায়৷ (৩) ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন৷ যদি কেউ দীর্ঘসময় যাবৎ বিষণ্নবোধ করে বা আত্মহত্যার ইচ্ছা থাকে সে হয়তো সাংঘাতিক বিষণ্নতাবোধে ভুগছে ৷ এটা এক চিকিত্সাগত পরিস্থিতি, রাসায়নিক ভারসাম্য হারানোর ফলে এমন হয় এবং ওষুধের প্রেসক্রিপশন এবং থেরাপির সুপারিশ করে ডাক্তার এর চিকিত্সা করতে পারেন৷
জীবনের পথে অগ্রসর হওয়ায়, সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে তবে ওই সময়ে কী ঘটছে তাও গুরুত্বপূর্ণ৷ কারোর আত্মহননের ইচ্ছা হলে তক্ষুনি ওই অনুভূতির ব্যাপারে কথা বলা উচিত৷ সহায়তার জন্য একটি ওয়েব সাইটের লিংক দিলাম : http://www.befrienders.org/need-to-talk
স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইচ্ছামৃত্যু : এবার আসব স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইচ্ছামৃত্যু প্রসঙ্গে। নন্দিনীকে চুরি করার শাস্তি ভোগ করতে হল প্রভাসকে। শাস্তি হল মর্ত্যে মানে এই পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে মরণশীল মানুষ হয়ে। যখন দেবব্রত নামে জন্ম হল, তখন মনে হয় পূর্বের স্মৃতি সান্ত্বনার কাজে আসেনি।ভীষণ প্রতিজ্ঞায় বর লাভ হল, বরটি "ইচ্ছামৃত্যু"। নচেৎ রাজ্যহীন, স্ত্রী-সন্তানবিহীন হয়ে এই ভীষণ পৃথিবীতে বাস করার মতো প্রতিজ্ঞা হয়ত কুরুক্ষেত্রে ধর্মনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াত।চিরকৌমার্য ব্রত নিয়ে ভীষ্মনামে পরিচিত হন। ভীষ্মের অপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসাবে আজও তার মৃত্যুতিথিতে হিন্দুরা তাঁকে পিতার প্রাপ্য জলদান করে থাকে। তার সৎ ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ের জন্য কাশিরাজের তিন কন্যাকে হরণ করেন তিনি। ভাইয়ের অকালমৃত্যুতে তার নির্দেশে অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে ব্যাসদেবের পুত্র ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম হয়। ভীষ্ম গান্ধারী ও কুন্তীর সঙ্গে তাদের বিয়ে দেন। রাজসূয় যজ্ঞে কৃষ্ণকে অর্ঘ্যদানের পরামর্শ ভীষ্মই দিয়েছিলেন। পাণ্ডবদের পক্ষপাতী হয়েও চিরদিন তিনি দুর্যোধনকেই আশ্রয় করেছিলেন এবং দূতসভায় দ্রৌপদীর চুল আকর্ষণ করাসহ দুর্যোধনের যাবতীয় অধর্মাচরণের প্রতিবাদ তিনি আদৌ করেননি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তিনি প্রধান সেনাপতিরূপে প্রতিদিন দশ হাজার পাণ্ডব সৈন্য বধ করে প্রথম দশ দিন যুদ্ধ করেছিলেন। এরপর পাণ্ডবদের সমূহ বিপদ আন্দাজ করে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে নপুংসক শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন তাকে রথ থেকে ফেলে দেন। ইচ্ছামৃত্যু বরপ্রভাবে তিনি শরশয্যায় শয়ন করেও আটান্ন রাত জীবিত ছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মাঘ মাসের অষ্টম তিথিতে তার মৃত্যু ঘটে।
আবার গ্রিক পুরাণে দেখি সিসিফাস। দেবতাদের গোপন সত্য চুরি করায় সেও অভিশপ্ত। তার জন্যও পাতালপুরীর শাস্তি। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হল মৃত্যুর। সিসিফাস মৃত্যুকে বন্দি করেছিল, আর ভীষ্মের কাছে ছিল মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক, তবু দুজনের কাছেই জীবনজগত বিমূর্ততা বা অ্যাবসার্ডের নামান্তর। সিসিফাসের পাথর গড়িয়ে যায়, আর ভীষ্মকে সইতে হয় ভোগহীন জীবনজ্বালা, শিখন্ডী স্ত্রীহস্তের প্রহার এবং ধনঞ্জয়ের তীব্র বাণ।স্ত্রীর ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে গিয়ে সিসিফাস বিপথে, নন্দিনীর জন্য প্রভাস।
ইউথ্যানাশিয়া বা ইচ্ছামৃত্যু : পুরাণ-মহাভারতে যতই ইচ্ছামৃত্যুর গপ্পো থাক-না কেন, বাস্তবে ইচ্ছামৃত্যুমামার হাতের মোয়া নয়।তাহলে ইউথ্যানাশিয়া (euthanasia) ব্যাপারটা ঠিক কী ? এর মানে কি মানবাধিকারের স্বীকৃতি ? ইউথ্যানাশিয়া কি স্বেচ্ছাচারের জন্ম হতে পারে ? “ইউথ্যানাশিয়াশব্দটি গ্রিক। ইউঅর্থ ভালো, এবং থ্যনাটোসঅর্থ হল মৃত্যু । শারীরিক ব্যথা-যন্ত্রণার উপশম যখন আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তখন সেই যন্ত্রণার মুক্তি ঘটাতে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণই হলই ইউথ্যানাশিয়া । এই ইউথ্যানাশিয়া নিয়ে চলছে  যুক্তি-পালটা যুক্তি গোটা বিশ্ব জুড়ে, দীর্ঘ দিন। সক্রেটিস স্বয়ং হেমলকের মাধ্যমে ইউথ্যানাশিয়ার প্রচলন করেন এথেন্সে। আবার সক্রেটিস, প্লেটো বা সেনেকার মতো গ্রিক দার্শনিকরা জীবনাবসান ঘটাতে ইউথ্যানাশিয়ার পক্ষপাতী হলেও হিপোক্রেটিস কিন্তু এর ঘোর বিরোধী ছিলেন ।
ইউথ্যানাশিয়ার পক্ষে যেমন যুক্তি আছে তেমনই বিপক্ষেও যুক্তি কম নয়। আমরা সকলেই চাই সে মৃত্যু যেন যন্ত্রণাদীর্ণ না হয়। আমরা কেউই তিলে তিলে মরতে চাই না, একদিন টুপ করে মরে যেতে চাই। যে মানুষ নিরাময়হীন রোগে জর্জর, যে রোগভোগে বোধশক্তিহীন, কিংবা যার অস্তিত্ব শুধু জড় বস্তুর মতো, তাতে মানুষের শরীর আর মন -- দুইয়েরই বড়ো কষ্ট হয়, বড়ো অমর্যাদাকর হয় । আসলে জীবন যখন কারও কাজে লাগে না, এমন কী নিজের কাজেও লাগে না ; উলটে নিজেকে প্রতিদিনের জীবনে পরমুখাপেক্ষী হয়ে অসহায় যাপন করতে হয়, তখন রোগীর ইচ্ছায়, তাকে সসম্মানে পৃথিবী থেকে বিদায় জানানোর ব্যবস্থাই হল ইউথ্যানাশিয়া । এতে যেমন যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষটিকে সসম্মানে বিদায় জানানো গেল --  তেমনই তাঁর আত্মীয়-পরিজন-পরিবারও ওই নিদারুণ যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করা থেকে বেঁচে গেলেন। 
অনেকসময়ই মানুষটি হয়তো এমন শারীরিক অবস্থায় চলে গেছেন যেখান থেকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা আর সম্ভব নয়। বোধহীন শরীর জীবিত আছে শুধু যন্ত্রের মাধ্যমে। পরিবার প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছে । তখনই প্রয়োজন অনুভূত হয় তাঁর জীবনের অবসান ঘটিয়ে পরিবারটিকে বাঁচানো ? এইরকম লস্ট কজ’-এর জন্যে একটা জীবন বাঁচাতে গিয়ে তো পরিবারের বাকি জীবিত সদস্যদের শান্তি, সুস্থিতি, ধৈর্য, আর্থিক নিরাপত্তা সব বিঘ্নিত হতে পারে ! কিন্তু সেই অসুস্থ, বোধহীন মানুষটির জীবনাবসানের অনুমতি কে দেবেন ? পরিবারের নিকটতম আত্মীয় ? নাকি ডাক্তার ? নাকি আইনজ্ঞ ? নাকি তাঁর উত্তরসূরী ? এটা আর-এক বিতর্কিত বিষয়। অর্থই অনর্থের মূল। তাই অর্থ লোভে বা সম্পত্তির লোভে অসুস্থ মানুষটির উত্তরসূরীরা ইউথ্যানাশিয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার । আসলে স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইউথ্যানাশিয়া নিয়ে এসব বিতর্ক আজকের নয়। প্রাচীন গ্রিস বা রোমে এর অনেক আগে থেকেই স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রচলন ছিল ।
ইউথ্যানাশিয়া সাধারণত তিন ধরনের । (১) ভল্যান্টারি,(২) নন-ভল্যান্টারি এবং (৩) ইনভল্যান্টারি । অসুস্থ ব্যক্তির সম্মতিতে স্বেচ্ছামৃত্যু হল ভল্যান্টারি ইউথ্যানাশিয়ারোগীর সম্মতি ছাড়া ইউথ্যানাশিয়া হল নন-ভল্যান্টারিস্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দিতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির সম্মতি না-নিয়ে বা তার অসম্মতিতে ঘটানো ইউথ্যানাশিয়া হল ইনভল্যান্টারিএই তিন ধরনের ইউথ্যানাশিয়াকে আবার দু-ভাগে ভাগ করা যায় – (১) অ্যাক্টিভ ইউথ্যানাশিয়া এবং (২) প্যাসিভ ইউথ্যানাশিয়া।অ্যাক্টিভ ইউথ্যানাশিয়াতে কোনো প্রাণঘাতী ওষুধ বা ইঞ্জেকশন সরাসরি প্রয়োগ করা হয় । প্যাসিভ ইউথ্যানাশিয়াতে জীবনদায়ী ওষুধ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা লাইফ সাপোর্ট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ।
ইচ্ছামৃত্যুর অধিকার চাই : ১৯২৮ সালে গুজরাতি সংবাদপত্র 'নবজীবন' গান্ধীজির দুটি চিঠি প্রকাশ করে। সে সময় সবরমতী আশ্রমে একটি বাছুরের মৃত্যু ঘিরে তীব্র আক্রমণের শিকার হন মহাত্মা। আশ্রম প্রতিষ্ঠাতা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে ধেয়ে আসে একের পর এক সমালোচনার তির। তারই প্রেক্ষিতে পরিস্থিতির বিশদ ব্যাখ্যা করে চিঠি লেখেন 'জাতির জনক'গান্ধীজি লিখেছিলেন, “অঙ্গহানী হওয়ার ফলে আশ্রমের একটি বাছুর তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। চিকিৎসকদের সবরকম চেষ্টার পরও তার কষ্ট দূর করা সম্ভব হয়নি। তাঁরা জানান, বাছুরটির সেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। বোঝা যাচ্ছিল প্রাণীটির অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়, মানবিকতার স্বার্থে এই তীব্র যন্ত্রণার একমাত্র উপশম হতে পারে শুধুমাত্র মৃত্যু। বিষয়টি সম্পর্কে গোটা আশ্রমের মতামত জানতে চাওয়া হয়। শেষে গভীর অনুতাপ কিন্তু প্রবল যৌক্তিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিই। আমি নিজে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে এক চিকিৎসককে প্রাণীটির দেহে বিষাক্ত ইনজেকশন দেওয়ার নির্দেশ দিই। মাত্র দুই মিনিটে গোটা প্রক্রিয়া শেষ হয়এরপর মহাত্মা গান্ধী লিখেছেন, “বাছুরটির মতো কোনো মানুষের ক্ষেত্রেও কি একই নীতি গ্রহণ করা সম্ভব ? আমার নিজের জন্যও কি এমন সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হতে পারে ? আমার উত্তর হল হ্যাঁ। একজন শল্য চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করতে রোগীর দেহে ছুরি বসালে যেমন হিংসা বলা চলে না, তেমনই পরিস্থিতির বিচারে আরও এক কদম এগিয়ে কাউকে অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে তার প্রাণসংহার করায় কোনও অন্যায় নেই
ইউথ্যানাশিয়া কার্যকরের আইন : বিভিন্ন দেশে ইউথ্যানাশিয়া কার্যকর করার আইনও বিভিন্ন রকম ।  নেদারল্যান্ডের আইন অনুযায়ী ইউথ্যানাশিয়া হল রোগীর অনুরোধ অনুসারে ডাক্তারের মাধ্যমে তার জীবনাবসান ঘটানো। ব্রিটেনের হাউস অফ লর্ডসে মেডিক্যাল এথিকস সিলেক্ট কমিটির মতে ইউথ্যানাশিয়া হল অপরিসীম রোগ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য ডেলিবারেট ইন্টারভেনশনএই মুহূর্তে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লাক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, এস্তোনিয়া, আমেরিকার ওয়াশিংটন, ওরিগন এবং মন্টানা রাজ্যগুলোতে ভল্যান্টারি ইউথ্যানাশিয়া আইনানুগভাবে স্বীকৃত। ২০১৫ থেকে কানাডার কিউবেকেও ভল্যান্টারি ইউথ্যানাশিয়া আইনি স্বীকৃতি পাবে। নন-ভল্যান্টারি ইউথ্যানাশিয়া কোনো দেশেই আইনি স্বীকৃতি পায়নি এবং ইনভল্যান্টারি ইউথ্যানাশিয়া তো খুন করার সামিল ।
ভারতে প্যাসিভ ইউথ্যানাশিয়া সম্প্রতি আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১১ সালের ৭ মার্চ সুপ্রিমকোর্ট জানান যে পার্মানেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট’-এ দীর্ঘদিন থাকা ব্যক্তির ক্ষেত্রে লাইফ সাপোর্টপ্রত্যাহার করে পরোক্ষে স্বেচ্ছামৃত্যুকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে একঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রথমবার ভারতে প্যাসিভ ইউথ্যানাশিয়ায় সম্মতি দেন । বলা হয়, কোনো রোগী যদি দীর্ঘদিন কোমায় থাকেন, তবে তাঁকে খাবার খেতে না দিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য পরোক্ষে ইন্ধন দেওয়া যেতে পারে ; কিন্তু অবশ্যই পরিবারের লোক আর আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে। খাবার খেতে না দিয়েস্বেচ্ছামৃত্যুর এই ধারণা হিন্দুধর্ম ও জৈনধর্ম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে । এই দুটি ধর্মেই না-খেয়ে মৃত্যুর অধিকার স্বীকৃত । সুপ্রিমকোর্ট বলেছেন, “omission of support to life” কখনোই “act of killing” নয় ; তাই এভাবে পরোক্ষে মৃত্যুর ইন্ধন দেওয়া কখনোই ভুল সিদ্ধান্ত নয় ।
জীবন যখন এমন দুর্বিষহ আর পরমুখাপেক্ষী, তখন ইউথ্যানাশিয়ার মাধ্যমে তাঁর শেষ সীমাটুকু নির্ধারণ করে নেওয়ার অধিকার চাওয়া তো ভুল হতে পারে না ! মানুষের জীবনে বার্ধক্য, জরা, অসুস্থতা খুবই স্বাভাবিক । তার থেকে ছুটি চাওয়ার প্রশ্নই নেই, কারণ তা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ । কিন্তু দেহ আর মন যদি মানুষের মতো অবস্থায় আর না থাকে, বোধহীন আর যন্ত্রচালিত হয় ; তখনও সে জীবনকে প্রলম্বিত করাতে অর্থ , মর্যাদা , উত্তরসূরীদের ধৈর্য - সবেরই ক্ষতি । সেখানে ইউথ্যানাশিয়ার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণভাবে জীবনকে শেষ করা ভুল নয় মোটেই ।
একজিট : স্বেচ্ছামৃত্যুর ব্যাপারে আর-একটা মাইলস্টোন হল মরণ পর্যটনমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অন্য লোকে বেড়াতে যাওয়ার যে পৌরাণিক ধারণা, ভাষার সামান্য পরিবর্তন করে সেটাই হয়ে দাঁড়ালো মৃত্যুর জন্যে বেড়াতে যাওয়া, যাকে বলে মরণপর্যটনএ ব্যাপারে অবশ্যই পথিকৃৎ সুইজারল্যান্ড, জীবনযন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে যারা স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইউথ্যানাশিয়ার অধিকারকে ইতিমধ্যেই বৈধ করেছে । নিজেদের দেশে অধিকার না পেলে স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে আবেদন করতে পারেন । অনুমতি পেলে পরবর্তী দায়িত্ব নেবে সেখানকার পর্যটন সংস্থাগুলি একেবারে শেষ নিশ্বাস পরিত্যাগ করা পর্যন্ত । অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা বাস্তব ২০১৩ সালের যে হিসাব পাচ্ছি, তাতে ইউরোপের নানা দেশ থেকে মরণ পর্যটনে শামিল হয়েছেন প্রায় ৯০০-র কাছাকাছি ইচ্ছুক মানুষ ।এর ফলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে এমন খবর তো আমি শুনিনি !
ভয়ংকর অসুখে-ধরা অধিকাংশ মানুষ, আবার চারপাশের দশটা-পাঁচটা ঘষটানো অধিকাংশ মানুষও বেঁচে থাকেন স্রেফ পটাং করে মরে যাওয়ার খ্যামতাটা নেই বলে, ‘এর পরেও বাঁচতে ইচ্ছে করছেবলে আদৌ নয়। মৃত্যুর প্যাটার্নটা নিজে ঠিক করতে পারব না ? কেন ? আমি কবে মরব এবং কখন, সেটা ঠিক করাও কি আমার জীবনযাপনের সিদ্ধান্তের একটা গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অঙ্গ নয় ? শরীর অথবা মনের রোগে ভুগে-হেগে হেজেমজে গিয়ে নির্ধারিত শেষ নিশ্বাসটা নেব। আমি সত্যি সত্যি স্বাধীন, না দণ্ডিত ? সঙ্গীহীন-বাক্যহীন বন্ধ্যা বাঁচাটাকে মারতে মরতেই তো চাই। উইথ ডিগনিটি।
বেশকিছু দেশে ইতিমধ্যেই আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যু। একনজরে দেখে নেওয়া যাক কোন্ কোন্ দেশে ইচ্ছামৃত্যু স্বীকৃতনেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, আলবেনিয়া, কলম্বিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, নিউ মেক্সিকো, মন্টানায়। পূর্বেই ইচ্ছামৃত্যুর স্বীকৃতি ছিল প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে।

কিছু অপ্রত্যাশিত মৃত্যু : এমন অনেক মৃত্যু হয়ে গেছে এ পৃথিবীতে, যে প্রত্যাশিত নয়। শুধুমাত্র অজ্ঞানতার কারণেই সেইসব মহান ব্যক্তিদের মেরে ফেলেছেন রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপোষিত ধর্মযাজকেরা। সে সময়ে ধর্মবেত্তাদের এতটাই দাপট ছিল যে তাঁরা যা বুঝতেন তার বাইরে কথা বললেই নির্মম হত্যা। এ প্রসঙ্গে এমন কয়েকজনের মৃত্যুর বর্ণনা না করলে লেখাট অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
(১) সক্রেটিস : সক্রেটিস প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক।তিনি এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারা জন্ম দিয়েছেন, যা দীর্ঘ ২০০০ বছর ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতি, দর্শন ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। সক্রেটিস ছিলেন এক মহান সাধারণ শিক্ষক, যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। জেনোফোন রচিত সিম্পোজিয়ামে সক্রেটিসকে বলতে শোনা যায়, তিনি কখনো কোনো পেশা অবলম্বন করবেন না। কারণ তিনি ঠিক তা-ই করবেন, যাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, আর তা হচ্ছে দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা।
এথেনীয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার যুগ থেকে পেলোপনেশীয় যুদ্ধে স্পার্টা ও তার মিত্রবাহিনীর কাছে হেরে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই সক্রেটিস বেঁচেছিলেন। পরাজয়ের গ্লানি ভুলে এথেন্স যখন পুনরায় স্থিত হওয়ার চেষ্টা করছিল তখনই সেখানকার জনগণ একটি কর্মক্ষম সরকার পদ্ধতি হিসেকে গণতন্ত্রের সঠিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছিল। সক্রেটিসও গণতন্ত্রের একজন সমালোচক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এথেনীয় সরকার সক্রেটিসকে এমন দোষে দোষী বলে সাব্যস্ত করেছিল যাতে তার মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হতে পারেসক্রেটিস সরাসরি বা অন্য কোনোভাবে বিভিন্ন সময়ে স্পার্টার অনেক নীতির প্রশংসা করেছে যে, স্পার্টা ছিল এথেন্সের ঘোর শত্রু। এসব সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে সমাজের চোখে তার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রসমূহ নিয়ে তীব্র সমালোচনা। এথেনীয়দের সুবিচারের প্রতি নিষ্ঠা বাড়ানোর চেষ্টাকেই তার শাস্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
প্লেটোর অ্যাপোলজি গ্রন্থের ভাষ্যমতে, সক্রেটিসের বন্ধু চেরিফোন একদিন ডেলফির ওরাকলের কাছে গিয়ে প্রশ্নে করা হয় -- সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ আছে কি না। উত্তরে ডেলফির ওরাকল জানান, সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ নেই। এরপর থেকেই সক্রেটিসকে সমাজের চোখে একজন রাষ্ট্রীয় অপরাধী হিসাবে দেখা হতে থাকে। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন ওরাকলের কথাটি ছিল নিছক হেঁয়ালি। কারণ ওরাকল কখনও কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে জ্ঞান অর্জনের কারণে প্রশংসা করেন না। এটি আদৌ হেঁয়ালি ছিল কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য সক্রেটিস সাধারণ এথেনীয়রা যে লোকদের জ্ঞানী বিবেচনা করত তাদের কাছে গিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। তিনি এথেন্সের মানুষদেরকে উত্তম, সৌন্দর্য এবং গুণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে তিনি বুঝতে পারেন এদের কেউই এই প্রশ্নগুলির উত্তর জানেন না। কিন্তু মনে করে যে তারা সব জানে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সক্রেটিস সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী যে, সে যা জানে না তা জানে বলে কখনও মনে করেন না। তার এ ধরনের  প্রজ্ঞা ও জ্ঞান তখনকার স্বনামধন্য এথেনীয়দের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়। সক্রেটিসের সামনে গেলে তাদের মুখ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। কারণ তারা কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারতেন না। ফলে এখান  থেকেই সকলে সক্রেটিসের বিরোধিতা শুরু করে দেন।
এখানেই শেষ নয়, তাঁর বিরুদ্ধে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করানোর অভিযোগও আনা হয়েছে।সব অভিযোগ বিবেচনায় এনে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। হেমলক বিষ পানের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যু নির্দিষ্ট হয়। বিষপানের পর সক্রেটিসকে হাঁটতে আদেশ করা হয় যতক্ষণ-না তাঁর পদযুগল ভারী মনে হয়। অতঃপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর যিনি সক্রেটিসের হাতে বিষপাত্র তুলে দিয়েছিলেন তিনি তাঁর পায়ে পাতায় চিমটি কাটেন। সক্রেটিস সেই চিমটি স্বাভাবিক কারণেই অনুভব করতে পারেননি।
(২) জর্দানো ব্রুনো : জর্দানো ব্রুনো একজন ইতালীয় দার্শনিক, ধর্মযাজক, বিশ্বতত্ত্ব বিশারদ এবং ওকাল্টিস্ট। জিওর্দানো ব্রুনোর আসল নাম ফিলিপ্পো ব্রুনো। প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতা করার অপরাধে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়। এজন্য অনেকে তাকে চিন্তার মুক্তির জন্য নিবেদিত একজন শহিদ হিসাবে গণ্য করে থাকেন। তার জন্মের সময়টা এমন ছিল যে, মধ্যযুগের ধর্মীয় ও দার্শনিক প্রতিক্রিয়াশীলতাও শেষ হয়নিআবার যুক্তিভিত্তিক আধুনিক যুগের সূচনাও ঘটেনি। সে হিসাবে তার জন্ম এক মহাসন্ধিক্ষণে।এ কারণে দর্শনচ্যুত বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানচ্যুত দর্শনের অন্ধকার যুগ বিরাজ করছিল। এমন সময়েই বিপ্লবী মতবাদ নিয়ে উপস্থিত হন জর্দানো ব্রুনো। সে সময় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের উত্থান ঘটছিল এবং ক্যাথলিক চার্চ সমাজে নিজেদের প্রভাব রক্ষার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।ব্রুনো বিজ্ঞান, দর্শন এবং যুক্তিবাদ নিয়ে এমন সব চিন্তা করেছিলেন যা বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্যই বলা হয়, ব্রুনো অসময়ে জন্ম নিয়েছিলেন, তার জন্ম আরও অনেক পরে হওয়া উচিত ছিল।ব্রুনো সরাসরি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন না, যতটা তিনি দার্শনিক ছিলেন। কিন্তু তার জোরালো বক্তব্য বিজ্ঞানের বিকাশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর কাজ-কারবার তখনকার অনেক বিজ্ঞানী দার্শনিককে মুক্তচিন্তা করতে এক রকমের বাধ্য করেছে। আখেরে এতে লাভ হয়েছে বিজ্ঞানের। বদ্ধ চিন্তাভাবনার গণ্ডি পেরিয়ে বিদ্রোহ করে শিখিয়েছে মুক্তচিন্তা করতে।তার বক্তব্য ছিল, “মহাবিশ্ব সীমাহীন। এখানে অসীম সংখ্যক পৃথিবীর মতো বিশ্ব আছে অসংখ্য নক্ষত্র ঘিরে। এবং যেহেতু অসীম সংখ্যক পৃথিবী রয়েছে তাই এই অসীম সংখ্যক বিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে
কোপার্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের প্রথম প্রস্তাবকারী হলেও তাকে এর রেশ ভোগ করতে হয়নি।ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে নিকোলাস কোপার্নিকাস পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে সেইস্থানে সূর্যকে বসান। তিনি তাঁর মতবাদে বলেন, “সকল গোলক সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে এবং এজন্য সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র ১৫৪৩ সালে তাঁর বই “De Revolutionibus Orbium Coelestium” প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তিনি মারা যান। এ যেন মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়া। কিন্তু তাঁর মতবাদ সমর্থনের অভিযোগে ব্রুনোকে মরতে হয়।
জুয়ান মোসেনিগো নামক একজন অভিজাত ভেনেশিয়ান তাঁকে ভেনিসের ধর্মবিচার সভার হাতে তুলে দেন। তাকে ১৫৯২ সালের ২৩ মে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাঁকে রোমের ধর্মবিচার সভার কাছে পাঠানো হয়, সেখান থেকে তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তারপর সাত বছরের বিচারকার্য শেষে ১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়, তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার। রায় ঘোষণার পর তাঁকে ৮ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল অনুশোচনার জন্য। যদিও তিনি তা করেননি।
১৬০০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রোমের ক্যাম্প ডেল ফিওরিতে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়।
(৩) গ্যালিলিও গ্যালিলি : গ্যালিলিও গ্যালিলি একজন ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক যিনি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সঙ্গে বেশ নিগূঢ়ভাবে সম্পৃক্ত।কোপারনিকাসের মতবাদের বিরোধী মতবাদ প্রচারিত হয় এবং গ্যালিলিও তা সমর্থন করেন। ফাদার টমাসো কাচ্চিনি ব্যাখ্যা সহকারে পৃথিবীর গতি সম্পর্কে গ্যালিলিওর মতবাদ বর্ণনা করেন। এরপর সেই মতবাদের ভিত্তিতে তার বিচার করেন এবং ঘোষণা করেন যে, এগুলো ভয়ংকর এবং ধর্মদ্রোহিতার শামিল। এধরনের অভিযোগ থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টায় তিনি রোমে যান। কিন্তু ১৬১৬ সালে কার্ডিনাল রবার্ট বেলারমাইন ব্যক্তিগতভাবে তার মামলাটি হাতে নেন এবং তাকে হেনস্তা করতে শুরু করেন। ধর্মীয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ধর্মীয় আইন হিসাবে কোপার্নিকান জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়তে বা পড়াতে বাধ্য করা হয়।
১৬৩০ সালে তিনি রোমে ফিরে যান তার রচিত ডায়ালগ কনসারনিং দ্য টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেম্সবইটি প্রকাশের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য। এটি বইটি ১৬৩২ সালে ফ্লোরেন্স থেকে প্রকাশিত হয়। এ বছরেরই অক্টোবর মাসে তাকে রোমের পবিত্র দপ্তরের (Holy Office) সম্মুখীন হতে হয়। কারণ ছিল "Congregation for the Doctrine of the Faith" (বিশ্বাসের উপদেশাবলির জন্য সমাবেশ)। আদালত থেকে তাকে একটি দণ্ডাদেশ দেওয়া হয় যার মাধ্যমে তাকে পূর্ববর্তী ধ্যান-ধারণা শপথের মাধ্যমে পরিত্যাগের জন্য বলা হয়। এই দণ্ডাদেশের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্যই তাকে সিয়েনায় একঘরে জীবন কাটাতে হয়। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে বাইবেল বিরোধী এই সত্য কথা বলার কারণে চার্চ গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করেছিল ধর্মদ্রোহিতারঅভিযোগে। ১৬৩৩ সালে, গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, হাঁটু মুড়ে সবার সামনে জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হয় এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই সঠিক, পৃথিবী স্থির অনড় এবং সৌরজগতের কেন্দ্রে। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। শোনা যায়, এর মধ্যেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ-জ্যোতির্বিদ স্বগতোক্তি করেছিলেন : তারপরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে
ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, অন্তরীণ অবস্থায় নিজ গৃহে।
ঠিক চারশ বছর পরে গত ১৯৯২ সালের ৩১ অক্টোবর ভ্যাটিকান সিটির পোপ দ্বিতীয় জন পল (খ্রিস্টান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেন যে গ্যালিলিওকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি দেওয়াটা তাদের জন্য ভুল ছিল, তিনি এই ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও তাঁর উপর থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার করেন।

রহস্যজনক মৃত্যু : এমন অনেক মৃত্যু আছে, এমন অনেক অন্তর্ধান আছে, এমন কোনো হারিয়ে আছে --- যা অধরাই রয়ে গেছে নানা কূট-কারণে। এমনই কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করব ---
(১) নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু : মৃত্যু নয়, অথচ মৃত্যুর মতো। অবশ্য এই একটি ক্ষেত্রেই মৃত্যুশব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। সেটা গর্হিত অপরাধ ! বলতে হয় অন্তর্ধান। আমি শুধু ঘটনাটি বলব : সুভাষচন্দ্র বসু  ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তি নেতা। তিনি নেতাজিনামে সমধিক পরিচিত। উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাঁকে সমর্থন করেন। শেষপর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংহের ফাঁসি ও তাঁর জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র গান্ধী-আরউইন চুক্তি বিরোধী একটি আন্দোলন শুরু করেন। তাঁকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়।
মনে করা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট (যদিও এই মত বিতর্কিত) তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। একটি মতে নেতাজি সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বন্দি অবস্থায়, সাইবেরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন।আর-একটি মতে, বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজির চিতাভস্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে, ওই চিতাভস্ম নেতাজির নয়। আসলে ভারতবর্ষে নেতাজির তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একদল উঁচুতলার ভারতীয় নেতা এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে নেতাজিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়।তাই ভারতীয় সরকার কখনো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ জনসমক্ষে আনেননি। অনেকের মতে ফৈজাবাদের ভগবান গুনমানি বাবা হলেন নেতাজি।পঞ্চাশের দশকের শাহনওয়াজ কমিশন থেকে মুখার্জি কমিশন পর্যন্ত একাধিক কমিশন বসিয়েও রহস্যের কোনো সুরাহা হয়নি।রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্য সুখেন্দুশেখর রায় এক বিবৃতিতে বলেন, “যদি বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজি মারা গিয়ে থাকবেন, তাহলে সেই তথ্য প্রকাশ পেলে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কেন খারাপ হবে ? দুর্ঘটনায় তো যে কেউই মারা যেতে পারেন ! তাহলে কি আমরা ধরে নেব কোনো কোনো রাষ্ট্র নেতাজির অন্তর্ধানের জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল ? সরকার যে যুক্তি দিচ্ছে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এই রহস্যজনক নীরবতা পালন করার পিছনে রাজনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিতভাবে জড়িত আছে।সেইসময়ের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা –- যাঁদের দেশের মানুষ দারুণ সম্মান দিয়ে থাকেন, গোটা ঘটনায় তাদের জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে, সেইজন্যই এই নীরবতা পালন করা হচ্ছে, তথ্য গোপন করা হচ্ছে
(২) লাল বাহাদুর শাস্ত্রী : লাল বাহাদুর শাস্ত্রী একজন বিশিষ্ট ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শাস্ত্রী সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক থেকে রাশিয়ার তাসখন্দে মারা যান। তার এহেন আকস্মিক মৃত্যু রহস্যের জন্ম দেয়। কিন্তু পোস্ট মর্টেম করে সেই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য রাশিয়া বা ভারত সরকার উভয়ই কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে শুনিনি। পরে তাঁর মৃত্যুর পিছনে সঠিক কারণ চিহ্নিত করা হয় যে বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়। তার সমস্ত জিনিসপত্র ভারতে ফেরত এলেও শুধুমাত্র যে ফ্ল্যাক্সে করে শেষবার তিনি জল পান করেন, তা ফেরত দেয়া হয়নি। ২০০৯ সালে জনপ্রিয় লেখক অনুজ ধর লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত নথি প্রকাশ করার জন্য তথ্য অধিকারের অজুহাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয় যে, তাতে দেশের শান্তি ব্যাহত হতে পারে এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে। তাই তা প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং সংসদীয় বিশেষাধিকার ভঙ্গ হতে পারে বলেও জানানো হয়।
(৩) সুব্রত মুখার্জি : এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জি ওবিই, ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রথম চিফ অব দ্য এয়ার স্টাফ বা বিমান বাহিনী প্রধান।তাকে বলা হয় "ভারতীয় বিমান বাহিনীর জনক"।সুব্রত মুখার্জী ছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার ১৯৬০ সালের নভেম্বরে প্রথম টোকিওগামী ফ্লাইটের যাত্রীদের একজন। ১৯৬০ সালের ৮ নভেম্বর সুব্রত ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন বন্ধুর সঙ্গে টোকিয়োর একটি রেস্তোরায় আহার করছিলেন। এ সময় খাবারের একটি টুকরো (মতান্তরে কাঁটা ফুটে) তার গলায় আটকে যায় এবং তিনি শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে যথেষ্ট রহস্যের দানা বাঁধে। এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জির মৃত্যুর কারণ অন্য কোনোভাবে হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।আজও কোনো কিনারা হয়নি। কিনারা তো হয়ই-নি, উলটে এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জির নাম বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে।
(৪) শ্রীশ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু : শ্রীচৈতন্যদেবের মৃত্যু ঠিক কীভাবে হয়েছিল, এই বিষয়টি নিয়ে নানা মত আছে৷ মতান্তরের মাঝখানে কিছু অনুমানভিত্তিক প্রচারও ঢুকে পড়েছে৷ সবটা মিলিয়ে, চৈতন্যদেবের অন্তিম পর্ব সম্পর্কে যৌক্তিক বিদ্যায়তনিক সংশয় অপেক্ষা, অযৌক্তিক অপপ্রচারই বড়ো হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়৷ সন্দেহ কেন দুটি স্পষ্ট কারণ :               (১) চৈতন্যদেবের মৃত্যু ঠিক কীভাবে হল সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই৷ এবং (২)  শ্রীচৈতন্য জগন্নাথে মানে নীলাচলে লীন হয়ে গেলেন, এই প্রচার অনেকেই তাঁকে হত্যারই করার সন্দেহ করছেন৷  তাহলে ? সংস্কৃত, বাংলা এবং ওড়িয়া ভাষায় চৈতন্যদেবের যে জীবনকথা লিখিত হয়েছে, সেখানে দুটি তথ্যই প্রধান৷ জয়ানন্দ মনে করেন, রথাগ্রে নৃত্যরত অবস্থায় পায়ে ইট লেগে ক্ষত হয়, সেই কারণে তাঁর দেহান্ত হয়৷ জয়ানন্দ চৈতন্যমঙ্গল”-এ তিনি চৈতন্যদেবের স্পর্শ লাভ করেছিলেন আনুমানিক দুই বছর বয়সে৷ চৈতন্যদেবকে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর মনে থাকার কথা নয়৷ যদি-বা তাঁর মনে থাকেও, তবে চৈতন্যদেবের অন্তিম পর্ব তাঁর দেখার কথা নয়৷ জয়ানন্দের সিদ্ধান্ত বাস্তবে সম্ভব৷ কিন্তু তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে লেখা, এমন কিছু প্রমাণ হয় না৷ ওড়িয়া কবি ঈশ্বর দাসের সিদ্ধান্ত, তিনি জগন্নাথের দেহে লীন হয়ে গিয়েছিলেন ৷ কোন্ মতটা ঠিক ? চৈতন্যদেবের সহপাঠী মুরারী গুপ্তই প্রথম সংস্কৃত ভাষায় তাঁর জীবনকথা লেখেন, যেটি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতনামে পরিচিত৷ তাঁর রচনা সর্বাধিক প্রামাণ্য৷  তিনি চৈতন্যদেবের অন্তিম পর্ব বিষয়ে কিছু লেখেননি৷ শিবানন্দ সেনের পুত্র কবি কর্ণপূর পরমানন্দ সেন, পিতার কাছ থেকে শুনে চৈতন্যচন্দ্রোদয়লিখেছিলেন৷ তিনিও প্রত্যক্ষদর্শী নন৷ ফলে শ্রীচৈতন্যের মৃত্যু স্বাভাবিক, না হত্যা ? -- এমন কোনো সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করা কীভাবে সম্ভব ?
জয়ানন্দের পায়ে ইট লেগে মৃত্যু”-র তত্ত্ব বাস্তবে এক্কেবারেই অসম্ভব নয়৷ কিন্তু অন্যান্য কাব্যগুলি এই ভাবনাকে সমর্থন করে না বলে এ নিয়ে মানুষের সন্দেহ আছে৷ চৈতন্যদেবের জগন্নাথে লীনহয়ে যাওয়ার বর্ণনা এই সন্দেহকে আরও জোরদার করেছে৷ অনেকের ধারণা পাণ্ডারা তাকে হত্যা করে এই প্রচার করেছে মহাপ্রভু জগন্নাথে লীন হয়ে গেছেন! নিরঞ্জন ধর তাঁর অবতার শ্রীচৈতন্য ও মানুষ নিমাইশিরোনামে একটি প্রবন্ধে যেকথা লিখেছেন, সেটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক : রাজরোষ”-এ পড়ে চৈতন্য নীলাচলবাসী হন এবং প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত নিযুক্ত হন। রাজরোষথেকে নিজেকে রক্ষা করতেই নিমাই গৃহত্যাগী হন। মহানিষ্ক্রমণের রাতে নিমাই দুই বলবান মায় বিশ্বস্ত সহচর গদাধর ও হরিদাসকে নিজের দু-পাশে নিয়ে শুয়েছিলেন। এ ঘটনায় বোঝা যায়, নিমাই ওই রাতের অন্ধকারে সুলতানের লোকেরা তাঁকে ধরতে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। ইতিমধ্যেই যে সুলতান তাঁর বিশ্বস্ত হিন্দু কর্মচারী কেশবছত্রীর উপর চৈতন্যকে ধরে আনার ভার দিয়েছেন। একথা শোনামাত্র সেদিনই রাতের অন্ধকারে তিনি ওই স্থান ত্যাগ করেন।
রাজশক্তির সঙ্গে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন নিমাই। নিমাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন।স্বীয় হস্তে দণ্ড রাখতে শুরু করেন। চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিমাই নবদ্বীপ ছেড়ে পুরীতে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে মনস্থ করেন। কারণ একাধিক। প্রথমত ওড়িশা তখন পূর্ব ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দুরাজ্য, তদুপরি বৈষ্ণব-প্রভাবিত ছিল।দ্বিতীয়ত পুরী বৈষ্ণবদের এক সর্বভারতীয় প্রধান তীর্থক্ষেত্র বটে এবং পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্ররা স্বয়ং ছিলেন বৈষ্ণবভাবাপন্ন। সর্বোপরি, নবদ্বীপবাসী যাঁরা মুসলিম শাসকদের অত্যাচারে ও নানা ফতোয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই পুরীতে এসে জমায়েত হয়েছিল। বাংলা-ওড়িশার সীমান্তের পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল থাকলেও চৈতন্য কোনো ঝুঁকি নেননি।তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর রামচন্দ্র খাঁনের সঙ্গে তিনি আগে থেকেই আগাম বন্দোবস্ত করেছিলেন, যাতে তিনি নির্বিঘ্নে বাংলা-ওড়িশা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেন। তিনি বাংলার রাজরোষ অতিক্রম করে সীমান্ত পেরিয়ে ওড়িশায় প্রবেশ করলে এতটাই নিরাপদ বোধ করছিলেন যে, সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর হস্তস্থিত দণ্ড সপাটে ভেঙে ফেলেন।কিন্তু শেষরক্ষা হল কোথায় ! ওড়িশায় গিয়েও তিনি নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। হ্যাঁ, চৈতন্য ওড়িশার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন।বস্তুত ওড়িশার সেদিনকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পরিষ্কার দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে প্রতাপরুদ্র ও চৈতন্যসম্প্রদায়, অপরদিকে বিদ্যাধর ও মন্দিরের পুরোহিতকুল।
উৎকলবাসীরা শ্রীচৈতন্যকে যখন সচল জগন্নাথভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, ঠিক সেই সময়কালে ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষমতা দখলের চরম পর্যায়ের প্রস্তুতি হিসাবে গোবিন্দ বিদ্যাধর চৈতন্যশিবিরকে ছত্রখান করতে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতকুলের সাহায্যপ্রার্থী হলেন। তাঁদের চৈতন্যবিরোধিতা তো ছিলই, উপরন্তু তাঁদেরকে আর্থিক টোপ দেওয়া হল। বলা হল তীর্থযাত্রী, ভক্তদের কাছ থেকে পূজা-দান-প্রণামী ইত্যাদি বাবদ মন্দিরের যে বিরাট আয় হত তার সবটুকুই পুরোহিতদের প্রাপ্য।
চৈতন্য যে এইসব ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেননি তা নয়। তা বুঝেই কাশীশ্বর নামে এক ভীমদেহী ব্যক্তি অঙ্গরক্ষক রূপে সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন, যখন চৈতন্য মন্দির প্রদর্শনে আসতেন।যে দণ্ড তিনি সীমান্তে ভেঙে ফেলেছিলেন, তা আবার ধারণ করতে শুরু করলেন।
তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। সেদিন ছিল জগন্নাথের চন্দন উৎসব। চন্দন সরোবরের চারপাশে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ছে।মন্দির প্রায় পরিত্যক্ত বলা যায়। কয়েকজন প্রহরী ও দু-একজন পুরোহিত মন্দির-প্রাঙ্গনে টুকটাক কাজে ব্যস্ত। এমন সময় সতর্ক পাহারা এড়িয়ে চৈতন্য একাকী মন্দিরে এসে উপস্থিত।তিনি মন্দিরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশপথগুলি বন্ধ করে দেওয়া হল। চৈতন্য অনুচরেরা দরজা খোলার জন্য দরজার বাইরে হইচই করতে থাকলেন, ভিতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে দরজা খুলে মন্দিরের প্রহরী জানিয়ে দিল যে  -- চৈতন্য জগন্নাথের অংশ, জগন্নাথের দেহে মিশে গেছেন এবং তাঁর মৃতদেহ জগন্নাথের আদেশে ক্ষেত্রপাল আকাশ দিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছেন।
জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতদের এহেন দুর্বল চিত্রনাট্য সরল ও শান্তিপ্রিয় বৈষ্ণবরা মাথা পেতে মেনে নিল বিনাবাক্যব্যয়ে। বৈষ্ণব তথা চৈতন্যভক্তগণরাও মনে করেন, পাণ্ডারা চৈতন্যদেবের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না৷ তদুপরি চৈতন্যদেবকে একা একা মন্দিরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল৷ রাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেবকে লিখিতভাবেই কড়া নিরাপত্তা দিয়েছিলেন৷ তাঁর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, তাঁর মরদেহ কোথায় গেল এসব প্রশ্নের উত্তর আজ আর নেই৷ আজকের দিনে যেমনভাবে কোনো হত্যার পুলিশি তদন্ত হয়, তেমনভাবে চৈতন্যের মৃত্যুর কিনারা করা যাবে না৷ চৈতন্যভক্তগণরা আরও মনে করেন, চৈতন্যদেব খুন হলে সেই খবর চাপা থাকত না৷ কোনো-না-কোনোভাবে মৌখিক সাহিত্য, মৌখিক ইতিহাসে তা ধরা পড়ত৷ তেমন কোনো প্রমাণ লোকসংস্কৃতিতে পাওয়া যায় না৷ পাণ্ডাদের ভয়ে না হয় পুরীর লোক চুপ করে থাকতে পারে৷ কিন্তু চৈতন্যজীবনীকাররা তো সবাই পুরীতে বসে লেখেননি৷ খুন হলে তাদের লিখতে তো কোনো বাধা ছিল না৷ তাই কি !!!
(৫) হিটলার : অ্যাডলফ হিটলার গানশুটে আত্মহত্যা করে মারা যান। তার আত্মহত্যার দিনটি ছিল ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। আর আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটে বার্লিনের ফুয়েরার বাংকারে। ফুয়েরার বাংকারটি প্রথম দিকে গড়ে তোলা হয়েছিল সাময়িকভাবে, বিমান হামলার সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য।পরে যখন বার্লিনে বিমান হামলা বেড়ে গেল, তখন এর সম্প্রসারণ ঘটিয়ে একে হিটলারের স্থায়ী আশ্রয়স্থলে রূপ দেয়া হয়।অ্যাডলফ হিটলার এই বাংকারে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি থেকে। তখন থেকেই এই বাংকারটি হয়ে ওঠে জার্মান নাৎসি সরকারের মূল কেন্দ্র। হিটলার সেখানেই ছিলেন আত্মহত্যার আগে পর্যন্ত। এ বাংকারেই আত্মহত্যার ৪০ ঘণ্টা আগে হিটলার বিয়ে করেন ইভা ব্রাউনকে। বলা যায় বিয়ের পরপরই এরা দুজনই আত্মহত্যা করেন। ইভা ব্রাউন পলা হিটলারের জন্ম ১৯১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। হিটলারের সঙ্গে আত্মহত্যা করে মৃত্যু ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। ছিলেন হিটলারের দীর্ঘ দিনের সঙ্গীও মাত্র ৪০ ঘণ্টারও কম সময়ের জন্য হিটলারের স্ত্রী। বাংকারটি ছিল রাইখ চ্যান্সেলারির নীচের ভূগর্ভে। ১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল যখন রেড আর্মি আশপাশে যুদ্ধরত, তখন ইভা সংক্ষিপ্ত আয়োজনে বিয়ে করেন হিটলারকে। তখন তার বয়স ২৯। আর হিটলারের ৫৬। এর ৪০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে তিনিও আত্মহত্যা করেন হিটলারের সঙ্গে।তার আত্মহত্যা কীভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তা নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মত। কেউ বলছেন তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। কেউ বলেছেন তিনি নিজের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। কেউ বলেছেন হিটলার সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে অনেক কষ্ট করে মারা যান। সমসাময়িক ইতিহাসবিদেরা অবশ্য তার মৃত্যুর এ বিবরণ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন --  হয় এটি নিছক একটি সোভিয়েত অপপ্রচার, নয়তো এটি বিভিন্ন মতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের একটি প্রয়াস মাত্র। প্রত্যক্ষদর্শীর একটি সাক্ষ্যও রয়েছে। এ সাক্ষ্য মতে, হিটলারের মুখে গুলির আঘাত লাগে। তবে এর কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া মাথার যে খুলি ও চোয়াল সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে তাও সত্যি-সত্যি হিটলারের কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এর বাইরে হিটলারের দেহভষ্ম কোথায় কোথায় ছড়ানো হয়েছে, সে ব্যাপারেও বিভিন্ন ইতিহাস উৎস বিশ্লেষণে একমত হওয়া যায় না। প্রচার করা হয় -- হিটলার বললেন, তিনি শেষ পর্যন্ত বার্লিনেই থাকবেন এবং এরপর নিজের গুলিতেই আত্মহত্যা করবেন।পরদিন তিনি এসএস চিকিৎসক ড. ওয়র্নার হ্যাসির কাছে জানতে চান আত্মহত্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি কোনটি। ড. ওয়ার্নার তাকে জানান পিস্তল অ্যান্ড পয়েজন মেথডহচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আত্মহত্যা পদ্ধতি। এ পদ্ধতির সারকথা হচ্ছে, এক ডোজ সায়ানাইড সেবন আর সেই সঙ্গে মাথায় গুলি করা।
১৯৬৯ সালে সোভিয়েত সাংবাদিক লেভ বেজিমেনস্কির SMERSH-এর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সম্পর্কিত একটি বই প্রকাশিত হয় পাশ্চাত্যে। কিন্তু পূর্ববর্তী ভুল তথ্য দেওয়ার চেষ্টার ফলে ইতিহাসবিদেরা এ বইয়ের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করেননি। ১৯৭০ সালে কেজিবি নিয়ন্ত্রিত স্মার্শ ফ্যাসিলিটি পূর্ব জার্মানি সরকারের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি নির্ধারিত হয়। কেজিবি তখন আশঙ্কা করে ১৯৪৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে হিটলারের লাশ পুঁতে রাখার স্থানটি চিহ্নিত হয়ে পড়লে সে স্থানটি জার্মানদের তীর্থস্থানে রূপ নিতে পারে। সে আশঙ্কায় কেজিবি ডিরেকটর ইউরি আদ্রেঁপভ হিটলার ও ইভার দেহাবশেষ চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার অপারেশন অনুমোদন করেন। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল গোপনে মাটি খুঁড়ে বের করে আনা হল পাঁচটি কাঠের বাক্স। এগুলির মধ্যে ছিল ১০ কিংবা ১১টি লাশের অবশেষ। এগুলির বেশিরভাগই ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। দেহাবশেষগুলো ব্যাপকভাবে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হল। এরপর এর ছাইভস্ম জার্মানির এলবি নদীর উপনদী বিটারিটজ্ নদীর জলে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। আর এভাবেই শেষ হয় হিটলারের রহস্যময় মৃত্যু উপাখ্যান।
(৬) নেপোলিয়ন : নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ফ্রান্স সম্রাট নেপোলিয়নের মৃত্যু হয়েছে, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু বিতর্ক আছে  তিনি কীভাবে মারা গেলেন ? কখন মারা গেলেন ? তার মতো একজন শক্তিধর মানুষ  দক্ষিণ আটলান্টিকের এক পরিত্যক্ত দ্বীপে পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা গেছেন, এমনটি কি ভাবা যায়। বরং ওয়াটারলুর যুদ্ধেই তার মৃত্যু হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। কিংবা তিনি খুন হতে পারতেন কোনো ঈর্ষাপরায়ণ বিদ্রোহীর হাতে। শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণের চেয়ে শত্রুর তলোয়ারের নীচে জীবন দেওয়াই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক।কার্যত দেড় দশকের মতো সময় বীরদর্পে ইউরোপ শাসন করে যাওয়া নেপোলিয়ন একটি পুরোপুরি সিক্ত আধ-সেঁকা অন্ধকার এক ঘরে নির্বাসিত অবস্থায় ধীরে ধীরে নিস্তেজ বিবর্ণ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন। এরপর একসময় মারা গেছেন। অন্তত নেপোলিয়নের বেলায় এমনটি অভাবনীয়, সেই সঙ্গে অকল্পনীয়।১৮১৫ সালের জুনে ওয়াটারলোর যুদ্ধে পরাজিত হন। ব্রিটিশরা সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে তাকে আটকে রাখে। সেখানে তিনি জীবনের শেষ ছয়টি বছর কাটিয়ে মারা যান। ময়না তদন্তের রিপোর্ট মতে, তিনি পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা যান। তবে সুইডেনের দাঁতের চিকিৎসক ও বিষ বিশেষজ্ঞ স্টেন ফরশুফভুদ ও অন্যান্য বিজ্ঞানী বরাবর বলে আসছেন, নেপোলিয়নকে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয় বস্তুত তিনি সারা ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বৈপ্লবিক ধারণা। সুসংহত করেছেন ফরাসি বিপ্লবের চেতনা। সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাজুড়ে। আবার এর আট লাখ বর্গমাইল এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন থমাস জেফারসনের কাছে, মাত্র একরপ্রতি ৬ সেন্টের বিনিময়ে। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল যার পেইন্টিং আর মূর্তি, সেই মানুষটির সাধারণ মৃত্যু কল্পনা করা যায় কি ! সেজন্যই তার মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা অগ্রহণযোগ্য ইতিহাস ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। সালটা ১৮২০। নেপোলিয়নের স্বাস্থ্য ভলো যাচ্ছে না। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। শরীর দুর্বল, সঙ্গে বমি বমি ভাব। মনে হল, তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। নেপোলিয়নের চিকিৎসকেরা যখন হাডসন লাউইয়ের কাছে একথা জানান তখন হাডসন তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, এসব ইংরেজদের অপপ্রচার। দুজন চিকিৎক অবশ্য বলেছিলেন, নেপোলিয়ন হেপাটাইটিসে আক্রান্ত, সেই সঙ্গে আছে আমাশয়।১৮১৯ সালে নেপোলিয়নের বিশ্বস্ত অনুসারী চিপরিয়ানি কর্সিকান অসুস্থ হয়ে মারা যান। একইভাবে মারা যান লংউড হাউসের আরও দুই ভৃত্য। পরিস্থিতি ছিল রহস্যজনক। দ্রুত এই তিনজনের অসুস্থ হয়ে পড়া ও মারা যাওয়ায় মনে করা হয় তাদের ওপরও বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। নেপোলিয়ন আভাস দিয়েছিলেন, তিনিও এমনটি সন্দেহ করছেন। এবং তিনি আশঙ্কা করছেন, তিনি হতে পারেন এদের টার্গেট। ১৮২১ সালে নেপোলিয়নের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটে। এবং মাসজুড়ে প্রচণ্ড পেট ব্যথায় ভুগে ৫ এপ্রিল মারা যান। লাশের ময়নাতদন্ত করেন ডাক্তার অ্যান্টোমার্কি ও আরও পাঁচ ইংরেজ ডাক্তার। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তার মৃত্যু পাকস্থলীর ক্যান্সারে।একজন ইংরেজ ডাক্তার বললেন, তার মৃত্যু হেপাটাইটিস সহ পেটের অসুখে।কিছু কর্তৃপক্ষ এটি মেনে নিয়েছে যে, নেপোলিয়ন ক্যান্সারে মারা গেছেন।কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের মেডিক্যাল রিপোর্ট এতটা খতিয়ে দেখা হয়নি। বলা হয়, নেপোলিয়ন নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে তিনি শিকার হয়েছিলেন হেমোরয়েডসের। পাঁচড়া ছাড়াও তার ছিল দীর্ঘমেয়াদি চর্মরোগ নিউরোডারমিটিটিস, রেগে যাওয়ার রোগ, মাইগ্রেন ও প্রস্রাবের জ্বালা সৃষ্টিকারী রোগ ডাইসুরিয়া। ১৯৬৬ সালে একটি মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এক লেখায় উল্লেখ করা হয়, এসব রোগের জের হিসাবে তিনি প্যারাসাইটিক রোগ সিসটোসোমিয়াসিসে ভুগছিলেন।অনেক সম্ভাবনা। রহস্যের কুয়াশা আজও কাটল না।
(৭) শেলি : পুরো নাম পার্সে বিশি শেলি তিনি ১৭৯২ সালে ইংল্যান্ডের হরশাম নগরীতে জন্ম নেন।শেলি পৃথিবীর অন্যতম সেরা রোম্যান্টিক কবি। তাঁর কবিতা বারবার মানুষের মন ছুঁয়ে যায়।১৮২২ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে জলে ডুবে শেলির মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যু রহস্যাবৃত, তাই এখনও অজানা। অনেকে বলে হতাশার কারণে তিনি আত্মহত্যা করেন। আবার অনেকে বলেন লর্ড বায়রনের সঙ্গে শত্রুতার কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়।

অসামান্য ব্যক্তিদের অতি সামান্য মৃত্যু : আবার এমন অনেক মৃত্যুও দেখা যায় যাঁরা দোর্দণ্ডপ্রতাপ তথা অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি, বাঘে-গোরুতে এক ঘাটেতে জল খায় যাঁদের অঙ্গুলীহেলনে, তাঁদের মৃত্যুই অত্যন্ত সামান্য কারণে। কিছু মৃত্যু বলা যাক–-
(১) কৃষ্ণ : যদুবংশ ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার পর কৃষ্ণ-বলরাম সংসার ছেড়ে বনে চলে যান। যাবার সময় অর্জুনের কাছে তিনি তাঁর সারথি দারুককে পাঠিয়ে সকল বিষয় অবগত করান। বনে গিয়ে ইনি যোগাবলম্বনপূর্বক একস্থানে শয়ন করে থাকলেন। ইতোমধ্যে বলরাম দেহত্যাগ করেন। এই সময় জরা নামক এক শিকারী হরিণ মনে করে- কৃষ্ণের পায়ে শরবিদ্ধ করে। এর ফলে কৃষ্ণের মৃত্যু হয়। এই সেই কৃষ্ণ, যিনি কৌরব ও পাণ্ডববংশ নির্বংশ করার মূল নিয়ন্ত্রক, যিনি পুতনা হত্যা-তৃণাবর্ত হত্যা-বত্সাসুর ও বকাসুর হত্যা-কেশী হত্যা-অঘাসুর হত্যা-কালিয়দমন-গোবর্ধন পর্বত উত্তোলন-কৃষ্ণ ও বলরাম কর্তৃক কংসবধ-শঙ্খাসুর হত্যা-নরকাসুর হত্যা-শতধন্বাকে হত্যা-জরাসন্ধ হত্যা-শিশুপাল ও শাম্ব হত্যা ইত্যাদি নানাবিধ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, সেই কৃষ্ণের কী তুচ্ছ পরিণতি !
(২) গৌতম বুদ্ধ  : ভক্তরা যাতে খুশি হন, সেই কারণে বুদ্ধ নানা স্থানে উৎসব ও ভোজের আয়োজনে যোগদান করতেন। পেটরোগা গৌতম বুদ্ধ বৈশালী নগরে গণিকা অম্বপালী বা আম্রপালীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন।অম্বপালী বুদ্ধদেব ও তাঁর অনুচরদের প্রচুর ভোজে আপ্যায়িত করে। অম্বপালীর প্রদত্ত ভোজ ভক্ষণ করে বুদ্ধদেবের পক্ষে খুব ক্ষতিকর হয়েছিল। তিনি বৈশালীর নিকটবর্তী এক গ্রামে এসে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর কুশীনগরের পথে বুদ্ধদেবকে পাবা গ্রামে চুন্দ নামক একজন কর্মকারের আতিথ্য গ্রহণ করেন। চুন্দ বুদ্ধ ও তাঁর অনুচর ভিক্ষুদের জন্য পোলাও, শূকরমাদ্দব ইত্যাদি মুখরোচক খাদ্যের আয়োজন করেছে। শূকরমাদ্দব শূকরমাংস দিয়ে প্রস্তুত রন্ধনদ্রব্য। খাদ্য ভক্ষণের পরপরই বুদ্ধের শরীরে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। চুন্দকে তিনি আদেশ করলেন শূকরমাদ্দব যা এখনও বাকি আছে তা মাটির নীচে পুঁতে ফেলতে। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই বুদ্ধদেব পেটে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছিলেন।শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। আরম্ভ হল রক্তপাত। স্পষ্টভাবে না জানা গেলেও সম্ভবত রক্তক্ষরণটা পেট থেকেই হয়েছিল। পাছে চুন্দ কষ্ট পায়, সেই কারণে বুদ্ধদেব চুপিসারে অতি দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।কিন্তু বেশি দূর অবসন্ন শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। গাছের নীচে উত্তরীয় পেতে বুদ্ধদেব শুয়ে পড়লেন। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে তাঁর। জল খেয়ে একটু সুস্থ মনে হতেই পুনরায় কুশীনগরের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। আবারও অবসন্নতা শরীরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে থাকল। পুনরায় তিনি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়লেন।বুদ্ধকে ঘিরে গ্রামবাসীদের ভিড় বাড়ল। তখন বুদ্ধদেব গ্রামবাসীদের উদ্দেশে নান উপদেশ দিতে থাকলেন। উপদেশ দিতে দিতে বুদ্ধদেব  শান্ত পরিবেশে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
বুদ্ধদেবের মৃত্যুর কারণ হিসাবে তিনটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়—(১) গুরুভোজনের পর আকস্মিক অসুস্থতা, (২) প্রবল রক্তপাত, প্রবল তৃষ্ণা ইত্যাদি। আজীবক এ সময় কথায় ছিলেন কে জানে !
(৩) হজরত  মোহাম্মদ : পুরো নাম হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।ইসলামের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় বিশ্বাসমতে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ নবি তথা বার্তাবাহক, যাঁর উপর আল কোরান অবতীর্ণ হয়েছে। কেউ কেউ বলেনতিনি ইসলামি জীবন-ব্যবস্থার প্রবর্তক। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে মোহাম্মদ ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসাবে তিনি অগ্রগণ্য। বিবদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সফলতা।
এহেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তির  বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরি ১১ সালের সফর মাসে মোহাম্মদ মামুলি জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচণ্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির উপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশার কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল, মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলিও দান করে দেন। বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে। অবশেষে ১১ হিজরি সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সন্ধ্যায় ৬৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আয়েশার ঘরের যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, জানা যায় পর সেখানেই তাঁকে দাফনকরা হয়।
(৪) কান্ট : দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের স্বাস্থ্য বরাবরই খারাপ ছিল।স্বাস্থ্যহীনতার কারণে তিনি বিয়ে পর্যন্ত করেননি। স্বাস্থ্য যাতে ভালো থাকে তার জন্য কান্টের যত্নের খামতি ছিল না কোনো।মোজা আটকানোর জন্য বন্ধনী ব্যবহার করলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে সেই আশঙ্কায় তিনি অনেক ভেবেচিন্তে এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। এত সাবধানে থেকেও অনেক কষ্ট পেয়ে তাঁকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।
(৫) মোৎসার্ট : পুরো নাম ভলফগাংগ আমাদেউস মোৎসার্ট । তিনি ১৭৫৬ সালে অস্ট্রিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন ।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা সঙ্গীতজ্ঞ মোৎসার্ট জীবনে ৬০০ টির উপর কম্পোজিশন রচনা করেছেন, যেগুলি এখনও মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা সঙ্গীত প্রতিভা রিউমেটিক ফিভারে আক্রান্ত হয়ে ১৭৯১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
(৬) শ্রীনিবাস রামানুজন : রামানুজনকে গণিতবিদ না বলে গণিতের রাজপুত্র বলাই শ্রেয়। আধুনিক বীজগণিতের অন্যতম কর্ণধার শ্রীনিবাস রামানুজন। সারাজীবন পড়ালেখায় তেমন সুবিধা করতে পারেননি, কিন্তু গণিতের প্রতি অদম্য আগ্রহ তাঁকে আসীন করে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের আসনে। খুব ধার্মিক ছিলেন তিনি।যখন তিনি অধ্যাপক হার্ডির সঙ্গে গবেষণার জন্য ক্যাম্ব্রিজে গমন করেন তখন ধর্মরক্ষার জন্য তিনি অতিরিক্ত শীতের মধ্যে পশমি ও চামড়ার পোশাক বর্জন করেন। ফলে ধীরে ধীরে তিনি যক্ষায় আক্রান্ত হন এবং দেশে ফিরে আসেন। ১৯২০ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে গণিতের এই বরপুত্রের মৃত্যু ঘটে।

শেষ বাণী : জীবন-মৃত্যুর মাহেন্দ্রক্ষণে কী বলে যান মানুষ ? তাঁর জীবনের শেষ কথাটি কেমন ? সাধারণ মানুষরা তো অনেক কথাই বলেন। কে মনে রেখেছে সে কথা হাতে-গোনা কয়েকটি কাছের মানষ ছাড়া ! আর তাছাড়া সাধারণ মানুষের তো সাধারণ কথা ! অসাধারণের কথা অমৃত-সমান, তাই না ? মৃত্যুকালীন কথাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কেউ জীবন ও সংসার, কেউ ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। কেউ কোনো  বিষয় সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। কেউ-বা নিজের রোগ-যন্ত্রণা নিয়ে হা-হুতাশ করেন। মৃত্যুর আকস্মিক আগমনে কেউ ভীত হয়ে পড়েন, অর্ধসমাপ্ত কাজ ও পরিজন ফেলে যাচ্ছে বলে অনেকে আক্ষেপ করেন।মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পারলে আমাদের দেশের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তুলসীতলা কিংবা গঙ্গার ঘাট কাশী যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
(১) ভগবান বুদ্ধ : বযধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথাতিঅর্থাৎ সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল, অপ্রমাদের সাথে সর্বকার্য সম্পাদন করো। তথাগত বুদ্ধের এই অন্তিম বাক্য সমগ্র বিশ্বের জন্য অতীব সাবধানমূলক বাণী। তাঁর অন্তিম বাণীর বযধম্মা সঙ্খারাঅর্থাৎ সংস্কারসমূহ ব্যয়শীল বা ক্ষয়শীল এই বাক্যাংশের দ্বারা পরিষ্ফুটিত হয়েছে ক্ষয়শীলতা বা ব্যয়শীলতা যেখানে বিদ্যমান তা নিশ্চয়ভাবে অনিত্য। অনিত্যতা দুঃখদায়ক। সুতরাং অনিত্যতা দুঃখ, আর যা দুঃখ দেয় তা আত্ম বা আমার এই সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
(২) কাজী নজরুল ইসলাম : “..বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম...
(৩) স্টিভ জবস : “Oh wow. Oh wow. Oh wow.”
(৪) হজরত মোহম্মদ : নামাজ এবং যাঁরা তোমাদের অধীন তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর
(৫) মাস্টারদা সূর্য সেন : চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসির ৫ ঘণ্টা পূর্বে লেখা মাস্টারদা সূর্যসেনের শেষ বাণী : আমার শেষ বাণী আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এইতো সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করার এই তো সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা বন্ধুরা এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো, কখনও পিছিয়ে যেয়ো না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনও হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনও দিনই ভুলে যেয়ো না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদিমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে
(৬) ভ্যান গগ্ : আমি এখন বাড়ি যেতে চাই
(৭) গ্যেটে : আলো ! আরও আলো !
(৮) মাইকেল এঞ্জেলো : জীবনের পথে চলতে গিয়ে দুঃখ পেলে জিশু বেদনার কথা মনে কোরো
(৯) স্যর আইজাক পিটম্যান : কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে আমার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে তাহলে বোলো, আমি যেন নতুন কাজের সন্ধানে এক ঘর থেকে আর-এক ঘরে গিয়েছি মাত্র
(১০) জিশু : ঈশ্বর, হে ঈশ্বর, কেন আমাকে ত্যাগ করেছ ?”
(১১) সক্রেটিস : অমুকের কাছ থেকে একটা মোরগ ধার করেছিলাম, মনে করে সেই ঋণটা শোধ করে দিয়ো
(১২) ঔরঙ্গজেব : আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি, জানি না তার জন্য কী শাস্তি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে
(১৩) চতুর্দশ লুই : ভৃত্যদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন : তোরা কাঁদিস কেন ? তোরা কি ভেবেছিলি যে আমি অমর?”

আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা নেই। আমিই প্রথম মৃত্যুকে বিষয় হিসাবে নিয়ে প্রবন্ধ লিখছি না। আমার আগে অনেক মানুষ মৃত্যু বিষয়ে বইপত্র লিখেছেন। আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। বইগুলির বিষয়বস্তু আলোচনা করে আর কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না। আপনারা যাঁরা পড়তে আগ্রহী তাঁদের জন্য শিরোনামগুলি উল্লেখ করলাম। যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, তা হল কিছু অত্যধিক জনপ্রিয় বই --- এমব্রেসড বাই দ্য লাইট”, “হাউ উই ডাই”, “দ্য টিবেটান বুক অফ লিভিং অ্যান্ড ডাই”, “এ নেসেসারি এন্ড”, “সেভড্ বাই দ্য লাইট”, “ফাইন্যাল গিফট”, “ফাইন্যাল একজিট”, “লাইফ আফটার লাইফ”, “রি-ইউনিয়নস : ভিশনারি এনকাউন্টারস উইথ ডিপার্টেড লাভড ওয়ানস্”, “মেলোনি ডাইজ”, “নাথিং টু বি ফ্রাইটেন্ড অফইত্যাদি।
এবার উপসংহার টানার সময় হয়েছে। সহায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : কত অসংখ্য কত বিচিত্র জগৎ আছে, তাহা একবার মনোযোগপূর্বক ভাবিয়া দেখা হউক দেখি ! আমার কথা হয়তো অনেকে ভুল বুঝিতেছেন। অনেকে হয়ত চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র একটি একটি গণনা করিয়া জগতের সংখ্যা নিরূপণ করিতেছেন। কিন্তু আমি আর এক দিক হইতে গণনা করিতেছি। জগৎ একটি বই নয়। কিন্তু প্রতি লোকের এক একটি যে পৃথক জগৎ আছে, তাহাই গণনা করিয়া দেখ দেখি! কত সহস্র জগৎ! আমি যখন রোগযন্ত্রণায় কাতর হইয়া ছট্ফট্ করিতেছি তখন কেন জ্যোৎস্নার মুখ ম্লান হইয়া যায়, উষার মুখেও শ্রান্তি প্রকাশ পায়, সন্ধ্যার হৃদয়েও অশান্তি বিরাজ করিতে থাকে ? অথচ সেই মুহূর্তে কত শত লোকের কত শত জগৎ আনন্দে হাসিতেছে! কত শত ভাবে তরঙ্গিত হইতেছে ! না হইবে কেন ? আমার জগৎ যতই প্রকাণ্ড, যতই মহান হউক না কেন, “আমিবলিয়া একটি ক্ষুদ্র বালুকণার উপর তাহার সমস্তটা গঠিত। আমার সহিত সে জন্মিয়াছে, আমার সহিত সে লয় পাইবে। সুতরাং আমি কাঁদিলেই সে কাঁদে, আমি হাসিলেই সে হাসে। তাহার আর কাহাকেও দেখিবার নাই, আর কাহারও জন্য ভাবিবার নাই। তাহার লক্ষ তারা আছে, কেবল আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিবার জন্য। এক জন লোক যখন মরিয়া গেল,তখন আমরা ভাবি না যে একটি জগৎ নিভিয়া গেল। একটি নীলাকাশ গেল, একটি সৌর-পরিবার গেল, একটি তরুলতাপশুপক্ষী-শোভিত পৃথিবী গেল
                                    ################# সমাপ্ত ###################

কোন মন্তব্য নেই: