শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

সংস্কৃত সাহিত্য : সনাতন ধর্মের প্রাণভোমরা (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)



এতক্ষণ আমরা যে যে বিষয়গুলি আলোচনা করলাম তার সবকটিই লিখিত নয়, লোকের মুখে মুখে শুনে বংশপরম্পরায় প্রচারিত ও মান্য করা হত। পরে এগুলি লিখিত আকারে সংরক্ষিত করা হয়। সেই লিখিত আকারই ছাপার অক্ষরে আমাদের কাছে সুলভ হয়েছে আরও পরে। এবার আমি এমন কিছু গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করব যেগুলি প্রায় গোড়া থেকেই লিখিত রূপ ছিল, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে আসছে। আসলে প্রাচীন যুগে সব সাহিত্যই হত রাজকাহিনি এবং এই রাজকাহিনি হৃষ্টপুষ্ট হত ঈশ্বরের উপস্থিতিতে। কারণ যতসব অবাস্তব অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে রাজাকেই সর্বোচ্চে রাখতেন প্রাচীন যুগের কবিরা। এইসব কবিরা রাজার তত্ত্বাবধানে থেকে রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজার গুণকীর্তন করতেন এবং ঈশ্বরপুষ্ট হয়ে রাজকাহিনি লিখতেন। সেই কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে যেখানেই অন্যায় অবিচার অবমাননার প্রয়োজন সেখানেই ঈশ্বরের অনুষঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। ঈশ্বর ছাড়া অবাস্তব কাহিনি উপস্থাপন করার সুযোগ কোথায় যেমন রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদভগবদগীতা ইত্যাদি। শাসকের অন্যায় কাজকর্মগুলিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হত নিজেদের মানদণ্ডে যুক্তি খাড়া করে। বস্তুত আর্য ভার্সেস অনার্যের ন্যায়-অন্যায়ের কাহিনি। মোগলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিল না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠী এবং তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও রোলার চালিয়েছিল, চালিয়েছিল ব্যাপক আক্রমণ, হত্যাকাণ্ড। আর এই আক্রমণই আর্য-অনার্যের যুদ্ধ, সুরাসুরের জমি দখলের লড়াই। আর্যরা সেইসব দেবদেবতা -- অনার্যরাই দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ষস, অসুর সাব্যস্ত হল। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারত উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীরা আর্যদের পক্ষেই থেকে গেলেন। অথচ তারা ভুলে যায় একদিন আর্যদের আক্রমণের ফলেই ধ্বংস হয়ে যায় আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সিন্ধুসভ্যতা। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীকে দাসে পরিণত করার লক্ষ্যে যে চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, শেষপর্যন্ত এতে সফলও হয় তারা। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক, দেবতা বা দেবতাতূল্য। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসাবেই স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠল 'মনুসংহিতাযেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে বিদ্রোহী করতে থাকল, তারাই অছ্যুৎ, দস্যু, অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। এইসব অস্পৃশ্যদের যখন খুশি ন্যাংটো করে দেওয়া যায়, ন্যাংটো করে দৌড় করানোও যায়।




আশির দশকের মাঝামাঝি বছরে রামানন্দ সাগরের রামায়ণভারতের দূরদর্শনে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। হয়েছিল তুমূল বিতর্ক। বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শকরা অভিযোগ করতে থাকলেন যে তাঁদের রামায়ণে যা আছে রামানন্দ সাগরের রামায়ণে তা মিলছে না। সেই বিতর্ক মেটাতে রামানন্দ সাগর টাইটেলে বিস্তারিত জানিয়ে দিলেন কোন্ রামায়ণের কোন্ কাহিনি।

সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫

সংস্কৃত সাহিত্য : সনাতন ধর্মের প্রাণভোমরা (প্রথম পর্ব)



ইসলাম ধর্ম যেমন কোরান কেন্দ্রিক, খ্রিস্টধর্ম যেমন বাইবেল কেন্দ্রিক, বৌদ্ধধর্ম যেমন ত্রিপিটক কেন্দ্রিক হিন্দুধর্ম কিন্তু তেমনভাবে বেদ কেন্দ্রিক নয়। যদিও বলা হয় হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। তা সত্ত্বেও বলা যায় হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র বেদাশ্রিত নয়। হিন্দুধর্ম সমৃদ্ধ হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডারের আনুকূল্যে। সেই কারণে হিন্দুধর্ম না-বলে সনাতন ধর্ম বলাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। হিন্দুধর্ম কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থকে ঘিরে গড়ে ওঠেনি।হিন্দুধর্ম একটি সংকলিত ধারণামাত্র, যা কেউ বুঝি, অনেকেই বুঝি না।যে অঞ্চলের মানুষের কাছে যে নির্দেশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে সেটা গ্রহণ করেছে, যার যেটা খারাপ লেগেছে সেটা বর্জন করেছে। সেই কারণে কাশ্মীরের হিন্দুধর্ম আর বাংলার হিন্দুধর্ম এক নয়, গুজরাটের হিন্দুধর্মের সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের হিন্দুধর্মে অনেক অমিল, কেরলের হিন্দধর্ম আরা মহারাষ্ট্রের হিন্দুধর্মের বৈসাদৃশ্য প্রচুর। অনেক হিন্দু গো-মাংস ভক্ষণ করেন, অনেক হিন্দু গো-মাংস ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু গো-মাংস মুখে উচ্চারণ করলেই প্রায়শ্চিত্ত (কারণ গোরুর শরীর জুড়ে সব দেবতার অবস্থান) করেন। অনেক হিন্দু শূকর ভক্ষণ, অনেক হিন্দু শূকর ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু শূকরের নাম উচ্চারণ করলে প্রায়শ্চিত্ত (কারণ শূকর বা বরাহ বিষ্ণুর অবতার) করেনঅনেক হিন্দু কচ্ছপ ভক্ষণ করেন, অনেক হিন্দু কচ্ছপ ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু কচ্ছপের নাম উচ্চারণ করলেই প্রায়শ্চিত্ত (কারণ কচ্ছপ বা কূর্ম বিষ্ণুর অবতারকরেন। এত ভিন্নতার কারণ হিন্দুধর্মের কোনো প্রবক্তা নেই, হিন্দুধর্মের কোনো স্রষ্টা নেই, একক প্রচারক নেই। ব্যাপক পরিসরে বলা যায় হিন্দুধর্মের কোনো বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থই নেই। সংকীর্ণ পরিসরে অনেকেই বলতে ভালোবাসেন হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থ বেদ, বৃহত্তর তথা সামগ্রিক পরিসরে যদি ভাবা যায় হিন্দুধর্মের একত্রে ধর্মগ্রন্থগুলি হল ঋগবে, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, মনুসংহিতা, অসংখ্য উপনিষদ, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ সমগ্র, রামায়ণ, মহাভারত  ইত্যাদি।


বস্তুত বিপুল সংস্কৃত ভাণ্ডারের সমস্ত নির্দেশাবলি-গল্প-কাহিনিই সনাতন ধর্মের নিয়ন্ত্রক, এগুলিকে আমি ধর্মসাহিত্য বলতে পছন্দ করি। বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। বেদ থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ বেদই সনাতন ধর্মের প্রধান ও প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ। ঐতিহাসিকরা বৈদিক সাহিত্য কখনও লিখিত রূপের উপর জোর দেয়নি। বেদ মানেই শ্রুতি। তার লিখিত রূপ অনেক পরের সময়ের কথা। ফলে কাশ্মীরে এক রকম, বাংলায় আর-এক, তামিলনাড়ুতে অন্য রকম রামায়ণ-মহাভারত পাওয়া গেলেও বেদ নিয়ে সেই সমস্যা হয়নি। তার লিখিত রূপভেদ নেই, তাই দরকার হয়নি কোনও ক্রিটিকাল এডিশনএই কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে উনিশ শতকে উইলসন তাই অনুবাদ করেন ঋগবেদ। কোনো পাঠান্তর বা পাঠভেদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না তাঁকে। আজও পুনের ভাণ্ডারকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ঋগবেদের সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটি গাছের ছালের উপর ১৪৬৪ সালে লেখা। এটি ইউনেস্কোর মেমরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের বোখাজকই শিলালিপির সঙ্গে ঋগবেদের ইন্দো-ইরানীয় ভাষার মিলের কথাও বলা হয়েছে বারবার। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান রমেশ ভরদ্বাজের মতে, ‘‘বাল গঙ্গাধর তিলক, জার্মান পণ্ডিত ফেলিক্স জ্যাকোবি মনে করতেন, ঋগবেদ খ্রিস্টের জন্মের আট হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল।’’ কিন্তু ঋগবেদকে যিনি বিশ্বের দরবারে প্রথম পরিচিত করেন, সেই ম্যাক্সমুলারও তিলকের মতো এত দূর পিছিয়ে যাননি। তিনি খ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছর আগের কথা ভেবেছিলেন। আর আর্যভাষাটি যে শুধুই ভারতীয় ভাষা নয়, সে কথাও ইতিহাসের দরবারে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। শেল্ডন পোলক পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন, সংস্কৃত নামক কসমোপলিটান ভাষাটি আফগানিস্তান থেকে জাভা সর্বত্র চলত। রোমিলা থাপারও ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে ঋগবেদের মিত্রাবরুণগোছের দেবতার অনেক মিল পেয়েছেন। সংস্কৃত ভাষা সমীহের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা সনাতন ধর্মের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা ব্রাহ্মণের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা মন্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা শাস্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা অভিসম্পাতের ভাষা এবং সংস্কৃত ভাষা আশীর্বাদেরও ভাষা।


সংস্কৃত ভাষা কীভাবে সনাতন ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে আমি তারই ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করব -- বেদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা ঠিক, বেদ ছাড়া ভারতীয় মনের ঐতিহাসিক বিকাশের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে বেদ পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। হাজার হাজার সাহিত্য লেখা হয়েছে, যা ধর্মসাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে অনেক ক্ষেত্রে এবং সেইসব সাহিত্যের উপাদানের বীজ সবই বেদে প্রতীয়মান। ঋগবেদের কাল থেকে বেদাঙ্গ রচনার অন্তিম পর্ব পর্যন্ত যে সুবিশাল সাহিত্য কেবল ভারতীয় সংস্কৃতির নয়, বিশ্বসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা করেছিল বৈদিক সাহিত্য। যাজ্ঞবল্ক্যের মতে প্রত্যক্ষ বা অনুমানাদির সাহায্যে যে জ্ঞান লাভ করা যায় না, সেই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান যার দ্বারা লাভ করা যায়, তাইই বেদ।
স্বয়ং বেদ বলেছে -- বেদ স্বয়ং উদ্ভূত। এসম্পর্কে বেদের পুরুষসূক্তে বলা হয়েছেতস্নাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুত ঋচ সামানি জজ্ঞিরে।/ ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত (ঋগ্বেদ, ১০/৯০/) অর্থাৎ, সে সর্ব হোম সম্বলিত যজ্ঞ হতে ঋক ও সামসমূহ উৎপন্ন হল, ছন্দ সকল তথা হতে আবির্ভূত হল, যজু তা হতে জন্মগ্রহণ করল, বেদ স্বয়ং উদ্ভূত- বেদ অপৌরুষেয়।