শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

অস্পৃশ্যনামা : না-মানুষের পদাবলি(তৃতীয়/শেষ পর্ব)


জাতপাত ব্যবস্থা বর্ণগত মই বাহিত হয়ে নিচে নেমে যায় এবং কখনোই পুরোপুরি অদৃশ্য না-হওয়ায় আম্বেদকরের বর্ণিত অনুকরণের সংক্রমণপ্রতিটি বর্ণেরই ক্রমপরম্পরায় নিম্নতর বর্ণের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা হয়।তেজস্ক্রিয় অণুর অর্ধেক জীবনের মতো অনুকরণের সংক্রমণগাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নষ্ট করে দেয়। এর ফলে এমন এক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে যেটাকে আম্বেদকর বলেছেন ক্রমবিন্যস্থ বৈষম্যএতে আরও নিচুর তুলনায় নিচু বর্ণও বিশেষ অধিকার ভোগের অবস্থানে থাকে। প্রতিটি বর্ণই বিশেষ অধিকার ভোগ করে, প্রতিটি শ্রেণিই ব্যবস্থাটি বজায় রাখার ব্যাপারে আগ্রহী।আমাদের সমাজে পচনের মূলেই আছে এই জাতপাত প্রথা। অধস্তন জাতের প্রতি যা কিছু করা হয়েছে, তা তো আছেই, সেইসঙ্গে এটা বিশেষ অধিকারভোগকারী বর্ণের নৈতিকতার মূলে পচন ধরিয়েছে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর মতে, প্রতি ১৬ মিনিটে একজন দলিতের সঙ্গে আর-একজন অদলিত অপরাধ করে, প্রতিদিন ৪ জনেরও বেশি অস্পৃশ্য নারী স্পৃশ্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। প্রতি সপ্তাহে ১১ জন দলিত খুন হয় এবং ৬ জন দলিত অপহৃত হয়। শুধুমাত্র ২০১২ সালেই ২৩ বছর বয়েসের ১ জন নারী দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার হয়, ১৫৭৪ জন দলিত নারী ধর্ষিত হয় (বৃদ্ধাঙ্গুলির শাসানির জোরে দলিতদের সঙ্গে ঘটা ধর্ষণ বা অন্যান্য অপরাধের মাত্র ১০ ভাগ প্রকাশিত হয়) এবং ৬৫১ জন দলিতকে হত্যা করা হয়। এগুলি ছিল ধর্ষণ ও বর্বরতা, যা লুণ্ঠন আর নগ্ন হতে বাধ্য করাই নয়, জোরপূর্বক মানুষের মল খাওয়ানো, জমি দখল,সমাজচ্যুত করা, খাওয়ার জল আনতে বাঁধা দেওয়া। এ পরিসংখ্যানে পাঞ্জাবের বান্ত সিংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি, যিনি ছিলেন একজন মাজহাবি দলিত শিখ। ২০০৫ সালে যার দুই হাত এবং একটি পা কেটে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ সে তার মেয়েকে গণধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। তিনটি অঙ্গ ছেদ হওয়া ব্যক্তির জন্য আলাদা কোনো পরিসংখ্যান নেই।কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে --

ঘটনা ১ : ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর। মধ্যপ্রদেশ। তার খেতে ঢুকে ফসল খেয়ে নিচ্ছিল গরুর দল। গোরুর মালিককে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে গিয়ে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হল এক দলিত নারীকে। তাকে নগ্ন করে মারধরের পর প্রস্রাব খেতেও বাধ্য করা হয়। ছত্তরপুর জেলায় এই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় স্থানীয় থানার নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসেছিল। ওই মহিলাকে নিয়ে দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজন জেলার সহকারী পুলিশ সুপার নিরজ পান্ডের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় নওগং থানা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।নিগৃহীতার অভিযোগ, বিজয় যাদবের বাড়িতে গিয়ে তার খেতে গওরু ঢোকার বিষয়টি জানান। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বিজয় ও তার স্ত্রী বিমলা তাকে মারধর করেন। এমনকি জামাকাপড় খুলে তাকে প্রস্রাব খেতেও বাধ্য করা হয়।

মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫

অস্পৃশ্যনামা : না-মানুষের পদাবলি(দ্বিতীয় পর্ব)


কেউ কেউ বলেন জাতপাতের এই বিড়ম্বনা নাকি হিন্দুধর্মের নয়। হিন্দুধর্মে নাকি জাত-বিভাজনের বালাই নেই এসব নাকি ব্রাহ্মণ্যধর্মের হিন্দুদের ঘাড়ের চাপিয়ে দেওয়া নিষ্পেষণ-চাক্কি। তাহলে কি ব্রাহ্মণ্যধর্ম আর হিন্দুধর্ম সমার্থক নয় ! এ ভাবনার যুক্তি কী ? তাঁরা বলছেন – (১) তাঁদের প্রত্যেকের ধর্মপালনের নীতি-নিয়ম একই হবে।(২) তারা একই পদ্ধতিতে ধর্মাচরণ বা উপাসনা করবে।(৩) তাদের মধ্যে অবাধ বিবাহ সম্পর্ক চালু থাকবে।(৪) ধর্মের দৃষ্টিতে তারা সবাই অভিন্ন বলে বিবেচিত হবে।(৫) তাদের মধ্যে কোন উঁচু-নীচু ভেদ থাকবে না।(৬) তারা সবাই সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে।(৭) একই ধর্মের অনুগামী বলে তারা পরস্পরের প্রতি একাত্মবোধ করবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর ক্ষেত্রে এক নয়, আলাদা। এ পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে বোঝা যায় ব্রাহ্মণ ও হিন্দু এক ধর্মভুক্ত নয়, তাদের ধর্ম আলাদা।তা ছাড়া দুটি আলাদা ধর্মের মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যে বৈসাদৃশ্যগুলি থাকে ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যেও তা লক্ষ করা যায়।বৈসাদৃশ্যগুলি মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে, যেমন -- (১) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক হয় না।যদিও কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়,তবে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই।(২) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব দেখা যায় না,বরং ঘৃণার সম্পর্ক দেখা যায়।(৩) একজন ব্রাহ্মণ ধর্মাচরণের হ্মেত্রে যে অধিকার পায়,একজন হিন্দু তা পায় না।(৪) ব্রাহ্মণ ও হিন্দু পরস্পরের সাথে একাত্ম মনে করে না।(৫) ব্রাহ্মণ হিন্দুকে তার সাথে সমমর্যাদার ভাবে না,তার থেকে নীচু ভাবে। (৬) ব্রাহ্মণদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য শূদ্রদের সম্পদ হাতানো।হিন্দুদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।(৭) ব্রাহ্মণ্যধর্মে অব্রাহ্মণ আছে এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই অব্রাহ্মণরা হল পথভ্রান্ত, নিজের অজান্তে বিপথে চালিত ধর্মচ্যূত হিন্দু, ব্রাহ্মণরা যাদের উপর অপমানজনক, ঘৃণ্য শূদ্রনামের ছাপ্পা মেরে দিয়েছে।কিন্তু হিন্দুধর্মে কোনো অহিন্দু নেই। (৮) ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুযায়ী ব্রাক্ষ্মণ সবার শ্রেষ্ঠ, সবার প্রভু।আর ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুগামী অব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট, এমনকি কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণদের নিকট ঘৃণার বস্তু,অস্পৃশ্য। কিন্তু হিন্দু ধর্মে কোন উচ্চনীচ ভেদাভেদ নেই,সবাই সমান।(৯) বর্ণভেদ, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথা, গুরুপ্রসাদী প্রথা ইত্যাদি অমানবিক, অশালীন প্রথাগুলি ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই অবদান।কিন্তু অপরদিকে হিন্দুধর্ম একটি সুসভ্য, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী ধর্ম। (১০) ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামীরা সবাই ব্রাহ্মণ নয়, কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ শূদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি।কিন্তু হিন্দুধর্মের অনুগামী মাত্রেই সবাই হিন্দু এবং কেবলমাত্র হিন্দু। হিন্দুদের একমাত্র পরিচয় -- তারা হিন্দু।(১১) ব্রাহ্মণদের উপনয়ন হয়, হিন্দুদের হয় না। (১২) ব্রাহ্মণ্যধর্মে জাতপাত, বর্ণভেদ, অস্পৃশ্যতা আছে, কিন্তু হিন্দুধর্মে ওইসব কদর্য জিনিস নেই।ওগুলো সম্পুর্ণতই ব্রাহ্মণ্যধর্মের ব্যাপার, হিন্দুধর্মের নয়।(১৩) ব্রাহ্মণরা পৈতে পরে, কিন্তু হিন্দুরা তা পরে না। তাই পৈতে পরা দেখে ব্রাহ্মণকে সহজেই স্বতন্ত্র ধর্মের অনুগামী হিসাবে সনাক্ত করা যায় -- যেমন টুপি (ফেজ) পরা দেখে মুসলমানদের সনাক্ত করা যায়, বুকে ক্রুশ দেখে খ্রিস্টান সনাক্ত।

এইসব তথ্য বিচার ও বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমিত হয় যে, ব্রাহ্মণ্য ও হিন্দু দুটি স্বতন্ত্র ধর্ম, কখনোই এক ধর্ম নয়।অতএব ব্রাহ্মণ্যবাদের সব রকম অন্যায়-অবিচার হিন্দুধর্মের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা সুবিচার হয় না।এ ব্যাপারে শিবরাম চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুধাবনযোগ্য -- এই হিন্দু সভ্যতায় ব্রাহ্মণের দান অতি সামান্যই, বলতে গেলে ব্রাহ্মণের থেকে যতটা এ নিয়েছে তাই এর কলঙ্ক……ব্রাহ্মণের দ্বারা প্রভাবিত না হলে এ সভ্যতা আরও প্রাণবান, আরও বেগবান, আরও বীর্যবান হতে পারত…… ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার চেয়ে ঢের বড়ো এই হিন্দু সভ্যতা। ব্রাহ্মণ না জন্মালেও এ হত এবং ব্রাহ্মণ লোপ পেলেও হিন্দু সভ্যতা থাকবে…… ব্রাহ্মণরা সমাজের মাথা নয়, বরং টিকি। সমাজের মাথা থেকে ওটাকে কেটে বাদ দিলে সমাজটার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং তাকে আরও বেশি আধুনিক দেখাবে

সেই কারণেই বোধহয় অন্ত্যজ বা দলিতদের সন্মানের জন্য যাঁরা লড়াই করেছেন এবং করছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় উচ্চবর্ণের হিন্দু।রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি প্রমুখ উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তিগণ দলিতদের পক্ষে জোরদার আন্দোলন করেছেন। অবশ্য ড: ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের আন্দোলনও দলিত সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও বাবা আহম্মেদকর উচ্চবংশীয় ছিলেন না, বরং দলিত শ্রেণির।স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বর্তমান ভারতগ্রন্থে লিখেছেন – “ভারতবাসীর কেবল ভারবাহী পশুত্ব, কেবল শূদ্রত্ব।বিবেকানন্দের সমকালীন ভারতে ব্রাহ্মণত্ব, ক্ষত্রিয়ত্ব, বৈশ্যত্বের অধিকারী হলেন ইংরেজ এবং তাদের শাসন-শোষণের ভার পশুর মতো বহন করে চলেছে শূদ্ররূপ ভারতবাসী।বিবেকানন্দ মনে করতেন, “শূদ্রজাতি মাত্রেই এজন্য নৈসর্গিক নিয়মে পরাধীন।

অস্পৃশ্যনামা : না-মানুষের পদাবলি (প্রথম পর্ব)


লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহুরুপাদতঃ।

ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশং শূদ্রঞ্চনিরবর্তয়ৎ।।”(মনুসংহিতা ১ : ৩১)

---লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সৃষ্টি করলেন।এখানে পরিষ্কার। শূদ্রদের জন্মই হয়েছে পদ বা পা থেকে। নির্দেশ যাদের পা থেকে তারা মাথায় উঠবে কীভাবে ! তাই এদের স্থান তো পায়ের নিচেই হতে হবে ! অতএব জন্মও পায়ের নিচে, কর্মও পায়ের নিচে।

গীতায় শ্রী ভগবানের উক্তি মতে বলা হয়েছে—‘আমি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চার বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) সৃষ্টি করেছিপুরুষ সুক্তের মন্ত্র ব্যাখ্যা করে নির্মল কুমার বসু যে মত ব্যক্ত করেন তা হল চারটি বিশেষ গুণসম্পন্ন এবং বিভিন্ন মাত্রার সংযাগের ফলে চার বর্ণের মধ্যে গুণের তারতম্য দেখা যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতের গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সে জাতির কর্ম উল্লিখিত চার বর্ণের কর্মের সঙ্গে মিল না থাকলে সে জাতি মিশ্র গুণসম্পন্ন ধরে নেওয়া হত। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় তাদের বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, গৌতম প্রভৃতি স্মৃতিকার এ নিয়ে যে মতামত দেন তা প্রণিধানযোগ্য। মনু সংহিতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল এবং স্মৃতিকাররা বৃত্তির ভিত্তিতে সে জাতির বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করে দিতেন। এর থেকে প্রমাণিত হয়, প্রাচীনকালে কিছু গুণকে উত্তম এবং কিছু গুণকে অধম বলে গণ্য করা হত। একইভাবে কিছু বৃত্তিকে শুদ্ধ এবং কিছু বৃত্তিকে অশুদ্ধ বলে বিবেচনা করা হত। এভাবে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রএ চার বর্ণের সৃষ্টি হয়।

ব্রাহ্মণদের প্রভূত্বকামী শাসনব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান অস্ত্রই হল চতুর্বর্ণ প্রথাঅর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের উপস্থিতি -- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই প্রথার মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠিকে এক অদ্ভুত বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বিভাজিত করে যে ভাগ করো, শাসন করোনীতি কায়েম করা হয়েছে, সেখানে স্বঘোষিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রশ্নহীন করে রাখা হয়েছে। বর্ণ-মর্যাদার দিক থেকে এর পরই রাজদণ্ডধারী ক্ষত্রিয়ের অবস্থান। তার নিচে বৈশ্য এবং সর্বনিকৃষ্ট বর্ণ শূদ্র। মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আগ্রাসনবাদী বৈদিক সমাজের সর্বগ্রাসী বর্ণ-বিভেদের ছায়ায়। গোটা মনুসংহিতার কোথাও কোন ভাবে মানুষ নামের কোনো স্বতন্ত্র সত্ত্বার বা মানব জাতির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- চারটি বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ জাতি, ক্ষত্রিয় জাতি, বৈশ্য জাতি ও শূদ্র জাতি। মনুসংহিতায় ভগবান মনু যে চারটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন, তা হল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, নারী এবং শূদ্র। এই চারটি ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দিয়েছেন। তবে চতুর্বর্ণের বাইরে আর-একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আছে, তা হল -- অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ যাকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না।

বর্ণ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করেন তার বাইরে অবস্থান গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। জন্মের দ্বারাই নির্ধারিত হয় যে, সে কোন্ বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। অজানা সময় কাল থেকে একটি বংশধারা এই মর্যাদা ভোগ করে আসছে। অনন্তকাল পর্যন্ত বংশধারার মাধ্যমে এটা অব্যাহত থাকবে। ব্যক্তির মর্যাদা জন্ম দ্বারা নির্ধারিত। একজন ব্রাহ্মণ হিসাবে জন্মগ্রহণ করলে যে-কোনো অবস্থাতেই সে ব্রাহ্মণের জন্য নির্ধারিত মর্যাদা ও পুরস্কার ভোগ করবে। কোনো ব্যক্তি এক বর্ণে জন্মগ্রহণ করে অন্য বর্ণে বিয়ে করতে পারে না। কারণ বর্ণের বাইরে বিয়ে করলে তার বংশগত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু যে বংশগত পবিত্রতাই মূল কথা তাই নয়, এর সঙ্গে আরও বহু আচার ব্যবস্থা জড়িত, যার মাধ্যমে বর্ণ শুদ্ধতা রক্ষিত হয়। মূল বর্ণগুলির মধ্যেও আছে হাজারও উপবর্ণ। এই উপবর্ণগুলি আবার নিজেদের গোত্রগত বিশুদ্ধতা রক্ষার রীতিনীতি মেনে চলে। এই উপগোত্রগুলি আবার নিজেদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য নানারূপ বিধিনিষেধ মেনে চলে যেমন সপিণ্ড, সগোত্র ইত্যাদি সংক্রান্ত আচার বিধি। এই নিয়ম কঠোরভাবে মানতে হয়, তা না হলে উঁচু জাতের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণের মধ্যে এটা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এজন্য পণ্ডিতরা বলে থাকেন, ভারতে বর্ণপ্রথার ইমারতটি গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের উপর। একজন ব্রাহ্মণ একজন নিচু জাতের লোকের সঙ্গে একত্রে বা হাতের রান্না খাবে না, ছোঁয়া খাবার খাবে না। তার খাওয়া পাত্রে খাবে না, তার স্পর্শ করা খাবার খাবে না। বর্ণ পঞ্চায়েত এবং আচরণরীতি ব্যাপারটার কেন্দ্রে রয়েছে ব্রাহ্মণ সমাজ এবং তাদের কৌলীন্য ও মর্যাদার ধারণার গুণগত উৎকর্ষের কারণে সমাজে মানুষ উচ্চতর মর্যাদা এবং পুরস্কারগুলি ভোগ করবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম, এটাই দস্তুর। একটি বিশেষ পুরস্কার বা সুবিধা বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত থাকে। এর ফলে সমাজের নিম্ন শ্রেণিগুলির মধ্যে উচ্চতর অর্জন প্রেষণা কাজ করে না। সমাজ হয়ে পড়ে বদ্ধ জলাভূমি। এখানে সর্বস্তরের মানুষের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয় না। মানুষের উচ্চ অর্জন প্রেরণা হচ্ছে সমাজ উন্নয়নের চাবিকাঠি। যেহেতু বর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির মর্যাদা এবং পুরস্কার শ্রম ও মেধার সাহায্যে অর্জন করা যায় না তাই সার্বিকভাবে সামাজিক সচলতার উপস্থিতি এখানে লক্ষ করা যায় না।

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫

দেবতার তত্ত্বতালাশ (দ্বিতীয়/শেষ পর্ব)



মিশরীয়দের মনেও প্রশ্ন জাগল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, মৃত্যু এবং জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। এভাবে তাঁদের মধ্যেও জন্ম নেয় ধর্মীয় বিশ্বাস। অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় দেবদেবতা। সমাজের বিবর্তন আর সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক গভীর। প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের চিহ্ন রেখে গেছেন পাথরে গায়ে, সমাধি ক্ষেত্রে, গড়েছিলেন দেবতাদের মূর্তি আর মন্দির। প্রাচীন মিশরে ২০০০ এরও বেশি দেবদেবী ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। স্থান ও কালের পার্থক্যে দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল ভিন্ন। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মিশরীয় রাজা বা ফারাও যারা পরবর্তীতে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। দেবতাদের কেউ কেউ ছিলেন ক্ষতিকরউল্লেখযোগ্য দেবতারা ছিলেন রা, তাহ, ওসিরিস, আইসি্স‌, হোরাস, সেথ, হাথর, আনুবিস, থথ, আটেন, আমুন, বাস্তেত। রা ছিলেন সূর্যের দেবতা রা দেবতা আবির্ভূত হতেন বিভিন্ন রূপে সকালে খেপরি, বিকালে আটুম কিংবা হোরাক্তি রূপে। রা-এর ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন ন্যায়বিচারের দেবী মাত। রা-এর দিবাকালীন আকাশভ্রমণ সব সময় নিরাপদ ছিল না আপেপ নামের এক সাপের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হত। আপেপের নিঃশ্বাসে মেঘের কালো কুণ্ডলী রা-কে ঘিরে ফেলত। কিন্তু শক্তিমান রা-কে এসব আটকাতে পারত না। সে সব কিছুকে পরাজিত করে ঠিকই তার পথ অতিক্রম করত। মাঝে মাঝে ক্ষতিকর দেবতারা এসে গিলে ফেলত রা-কে। তখন সূর্যগ্রহণ হত। কিন্তু রা ঠিক ঠিক শত্রুর পেটে কেটে বেরিয়ে আসত। আইসিস, মিশরীয় মাতৃদেবী। উর্বরতার দেবতা আমুন। ফারাওরা নিজেদের রা-এর সন্তান বলে দাবি করত।

মায়াদেরও দেবতাদের কথা আমরা জানতে পারছি। অর্থাৎ মায়াদেরও দেবতা-ধারণা আছে। হুনাহপু এবং এক্সবালেংখুয় হল মায়াদের দেবতা। এই যমজ দেবতার কাহিনি মায়া পুরাণের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়। এই কাহিনি যে কয়টি এপর্যন্ত জীবিত মায়া পুরাণ টিকে আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এরা সম্পর্কে দুই ভাই। মায়ার নরকের দেবতা হলেন এক্সিবালবা। এক্সিবালবা অত্যন্ত বদরাগী এবং নিষ্ঠুর চরিত্রের দেবতা ছিলেন। মায়ারা বিশ্বাস করতেন এক্সিবালেংখুয়ে এবং হুনাহপু ছিলেন যথাক্রমে পৃথিবীর শাসক এবং আকাশের দেবতা। পরে অবশ্য দুজনেই চন্দ্রদেব এবং সূর্যদেবে রূপান্তরিত হন। মায়ারা বিশ্বাস করত মায়া-সম্রাট আসলে হয় এক্সিবালেংখুয়ে, নয় হুনাহপু দেবের পুত্র।

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫

দেবতার তত্ত্বতালাশ (প্রথম পর্ব)



ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ সৃষ্টিকর্তাকে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই একই পংক্তিতে ফেলে ভেবে থাকেন। মুসলিমগণ তাদের ঈশ্বরকে 'আল্লাহ' এবং খ্রিস্টানগণ 'গড' বলে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কাছে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই এক। সবই কিন্তু এক নয়। দেবতা বা ঠাকুরের মধ্যে ঈশ্বর বা ভগবানের বিস্তর তফাত। কখনোই এক নয়। ঈশ্বর বা ভগবান নিরাকার, দেবতা বা ঠাকুর সাকার। ঈশ্বর বা ভগবান বিমূর্ত। দেবতা বা ঠাকুর মূর্তিমান। হিন্দু, গ্রিক, মিশরীয় এবং রোমানদের ছাড়া আর কোনো ধর্মেই দেবতা বা ঠাকুর নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদেরও ঈশ্বর বা ভগবান আছে। ভাষাভেদে ভিন্ন নামে। আল্লাহ, গড -- সব ঈশ্বরেরই প্রতিশব্দ। ঈশ্বর হল জাগতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থানকারী কোনো অস্তিত্ব | অনেকের মতে, এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক আছে মনে করা হয় --- যাকে গড, ঈশ্বর সহ বিভিন্ন ভাষা ও সংষ্কৃতিতে বিভিন্ন নাম এবং উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়। এই অস্তিত্বে বিশ্বাসীগণ ঈশ্বরের বা উপাসনা করেন। তাদেরকে আস্তিক বলা হয়| আর অনেকে ধারণাকে অস্বীকার করেন| এদেরকে বলা হয় নাস্তিক| আস্তিক সমাজে, ঈশ্বরের ধারণা ধর্ম ও ভাষা ভেদে ভিন্ন। ভাষাভেদে একে ইংরেজি ভাষায় গড, আরবি ভাষায় ইলাহ এবং বাংলা ও সংষ্কৃত ভাষায় ঈশ্বর ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। একজন সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারণাকে বলা হয় একেশ্বরবাদ| ভগবান এবং দেবতার মধ্যে পার্থক্য কী ? এককথায় হিন্দুরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভগবান নামে ডাকেন, তবে তারা বিশ্বাস করে ভগবান সরাসরি নিজে সবকিছু করেন না। তিনি একই সঙ্গে, একই সময়ে, নানান রূপে একাধিক কাজ সম্পন্ন করেন। ভিন্ন ভিন্ন কাজ করার সময় তার যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রকাশিত হয় সেটাকেই হিন্দুরা বলে দেবতা। যেমন ভাবা হয় ভগবান বিশ্বকর্মাদেবতা নাম নিয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। হিন্দুরা বিশ্বকর্মাকে দেবতা মনে করেন। একইভাবে বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ইত্যাদি। অপৌরুষেয় গ্রন্থগুলিতে বলা হয়েছে --- দেবতারা ঈশ্বরনন, দেবতারা ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ মানুষ!
গ্রিকদেবী অ্যাফ্রোদিতি
ঈশ্বর হলেন সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর কোনো শুরুও নেই এবং তাঁর কোনো শেষও নেই। আস্তিকগণ মনে করেন কোনো মানুষই কখনো ঈশ্বরকে দেখেনি। বামাক্ষ্যপা, রামপ্রসাদ, মোহম্মদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ, জিশু, ইব্রাহিম কেউ নয়। ঈশ্বরের ধারণা দিয়েছেন মাত্র। কারণ তিনি হলেন আত্মিক ব্যক্তি। আর এর অর্থ হল -- পৃথিবীতে বসবাসরত মাংসিক প্রাণী থেকে তাঁর জীবন আরও উন্নত প্রকৃতির। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে তা যেমন প্রমাণ করা যায় না, আবার তিনি যে নাই তাও প্রমাণ করা যায় না। বাইবেল বলে, বিশ্বাসেই এই সত্য আমাদের অবশ্য মেনে নিতে হবে যে, ঈশ্বর সত্যিই আছেন --বিশ্বাস ছাড়া ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা অসম্ভব, কারণ ঈশ্বরের কাছে যে যায়, তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ঈশ্বর আছেন এবং যারা তাঁর ইচ্ছামত চলে তারা তাঁর হাত থেকে তাদের পাওনা পায়” (ইব্রীয় ১১:৬)। যদি ঈশ্বর চান তাহলে খুব সহজে তিনি তো উপস্থিত হয়ে সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দিতে পারেন যে, তিনি আছেন। কিন্তু যদি তিনি তা করেন, তাহলে বিশ্বাসের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। সেইজন্য জিশু থোমাকে বলেছিলেন -- থোমা, তুমি কি আমাকে দেখেছ বলে বিশ্বাস করছ ? যারা না দেখে বিশ্বাস করে তারা ধন্য” (জোহন ২০:২৯)। তবে, তার মানে এই নয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। বাইবেল বর্ণনা করেছে --মহাকাশ ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করছে, আর আকাশ তুলে ধরছে তাঁর হাতের কাজ। দিনের পর দিন তাদের ভিতর থেকে বাণী বেরিয়ে আসে, আর রাতের পর রাত তারা ঘোষণা করে জ্ঞান। কিন্তু তাতে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভাষা নেই, তাদের স্বরও কানে শোনা যায় না। তবু তাদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে জগতের শেষ সীমা পর্যন্ত।”(গীতসংহিতা ১৯:১-৪)।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রথম যুক্তি : ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা দিয়েই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। ঈশ্বর সম্বন্ধে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে --তিনি এমন এক সত্ত্বা, তাঁর চেয়ে মহত্তর আর কিছু ভাবা যায় না।এভাবেও যুক্তি দেওয়া হয়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকার চেয়ে বরং তাঁর অস্তিত্ব থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো। তার মানে ধারণা করার মতো সবচেয়ে বড়ো সত্ত্বার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকে, তাহলে ঈশ্বর সম্পর্কে সবচেয়ে বড়ো কোনো ধারণা করা যায় না। করা না-গেলে ঈশ্বর সম্পর্কে এই সংজ্ঞার গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না।

শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

সংস্কৃত সাহিত্য : সনাতন ধর্মের প্রাণভোমরা (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)



এতক্ষণ আমরা যে যে বিষয়গুলি আলোচনা করলাম তার সবকটিই লিখিত নয়, লোকের মুখে মুখে শুনে বংশপরম্পরায় প্রচারিত ও মান্য করা হত। পরে এগুলি লিখিত আকারে সংরক্ষিত করা হয়। সেই লিখিত আকারই ছাপার অক্ষরে আমাদের কাছে সুলভ হয়েছে আরও পরে। এবার আমি এমন কিছু গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করব যেগুলি প্রায় গোড়া থেকেই লিখিত রূপ ছিল, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে আসছে। আসলে প্রাচীন যুগে সব সাহিত্যই হত রাজকাহিনি এবং এই রাজকাহিনি হৃষ্টপুষ্ট হত ঈশ্বরের উপস্থিতিতে। কারণ যতসব অবাস্তব অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে রাজাকেই সর্বোচ্চে রাখতেন প্রাচীন যুগের কবিরা। এইসব কবিরা রাজার তত্ত্বাবধানে থেকে রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজার গুণকীর্তন করতেন এবং ঈশ্বরপুষ্ট হয়ে রাজকাহিনি লিখতেন। সেই কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে যেখানেই অন্যায় অবিচার অবমাননার প্রয়োজন সেখানেই ঈশ্বরের অনুষঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। ঈশ্বর ছাড়া অবাস্তব কাহিনি উপস্থাপন করার সুযোগ কোথায় যেমন রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদভগবদগীতা ইত্যাদি। শাসকের অন্যায় কাজকর্মগুলিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হত নিজেদের মানদণ্ডে যুক্তি খাড়া করে। বস্তুত আর্য ভার্সেস অনার্যের ন্যায়-অন্যায়ের কাহিনি। মোগলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিল না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠী এবং তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও রোলার চালিয়েছিল, চালিয়েছিল ব্যাপক আক্রমণ, হত্যাকাণ্ড। আর এই আক্রমণই আর্য-অনার্যের যুদ্ধ, সুরাসুরের জমি দখলের লড়াই। আর্যরা সেইসব দেবদেবতা -- অনার্যরাই দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ষস, অসুর সাব্যস্ত হল। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারত উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীরা আর্যদের পক্ষেই থেকে গেলেন। অথচ তারা ভুলে যায় একদিন আর্যদের আক্রমণের ফলেই ধ্বংস হয়ে যায় আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সিন্ধুসভ্যতা। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীকে দাসে পরিণত করার লক্ষ্যে যে চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, শেষপর্যন্ত এতে সফলও হয় তারা। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক, দেবতা বা দেবতাতূল্য। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসাবেই স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠল 'মনুসংহিতাযেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে বিদ্রোহী করতে থাকল, তারাই অছ্যুৎ, দস্যু, অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। এইসব অস্পৃশ্যদের যখন খুশি ন্যাংটো করে দেওয়া যায়, ন্যাংটো করে দৌড় করানোও যায়।




আশির দশকের মাঝামাঝি বছরে রামানন্দ সাগরের রামায়ণভারতের দূরদর্শনে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। হয়েছিল তুমূল বিতর্ক। বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শকরা অভিযোগ করতে থাকলেন যে তাঁদের রামায়ণে যা আছে রামানন্দ সাগরের রামায়ণে তা মিলছে না। সেই বিতর্ক মেটাতে রামানন্দ সাগর টাইটেলে বিস্তারিত জানিয়ে দিলেন কোন্ রামায়ণের কোন্ কাহিনি।

সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫

সংস্কৃত সাহিত্য : সনাতন ধর্মের প্রাণভোমরা (প্রথম পর্ব)



ইসলাম ধর্ম যেমন কোরান কেন্দ্রিক, খ্রিস্টধর্ম যেমন বাইবেল কেন্দ্রিক, বৌদ্ধধর্ম যেমন ত্রিপিটক কেন্দ্রিক হিন্দুধর্ম কিন্তু তেমনভাবে বেদ কেন্দ্রিক নয়। যদিও বলা হয় হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। তা সত্ত্বেও বলা যায় হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র বেদাশ্রিত নয়। হিন্দুধর্ম সমৃদ্ধ হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডারের আনুকূল্যে। সেই কারণে হিন্দুধর্ম না-বলে সনাতন ধর্ম বলাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। হিন্দুধর্ম কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থকে ঘিরে গড়ে ওঠেনি।হিন্দুধর্ম একটি সংকলিত ধারণামাত্র, যা কেউ বুঝি, অনেকেই বুঝি না।যে অঞ্চলের মানুষের কাছে যে নির্দেশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে সেটা গ্রহণ করেছে, যার যেটা খারাপ লেগেছে সেটা বর্জন করেছে। সেই কারণে কাশ্মীরের হিন্দুধর্ম আর বাংলার হিন্দুধর্ম এক নয়, গুজরাটের হিন্দুধর্মের সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের হিন্দুধর্মে অনেক অমিল, কেরলের হিন্দধর্ম আরা মহারাষ্ট্রের হিন্দুধর্মের বৈসাদৃশ্য প্রচুর। অনেক হিন্দু গো-মাংস ভক্ষণ করেন, অনেক হিন্দু গো-মাংস ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু গো-মাংস মুখে উচ্চারণ করলেই প্রায়শ্চিত্ত (কারণ গোরুর শরীর জুড়ে সব দেবতার অবস্থান) করেন। অনেক হিন্দু শূকর ভক্ষণ, অনেক হিন্দু শূকর ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু শূকরের নাম উচ্চারণ করলে প্রায়শ্চিত্ত (কারণ শূকর বা বরাহ বিষ্ণুর অবতার) করেনঅনেক হিন্দু কচ্ছপ ভক্ষণ করেন, অনেক হিন্দু কচ্ছপ ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু কচ্ছপের নাম উচ্চারণ করলেই প্রায়শ্চিত্ত (কারণ কচ্ছপ বা কূর্ম বিষ্ণুর অবতারকরেন। এত ভিন্নতার কারণ হিন্দুধর্মের কোনো প্রবক্তা নেই, হিন্দুধর্মের কোনো স্রষ্টা নেই, একক প্রচারক নেই। ব্যাপক পরিসরে বলা যায় হিন্দুধর্মের কোনো বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থই নেই। সংকীর্ণ পরিসরে অনেকেই বলতে ভালোবাসেন হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থ বেদ, বৃহত্তর তথা সামগ্রিক পরিসরে যদি ভাবা যায় হিন্দুধর্মের একত্রে ধর্মগ্রন্থগুলি হল ঋগবে, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, মনুসংহিতা, অসংখ্য উপনিষদ, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ সমগ্র, রামায়ণ, মহাভারত  ইত্যাদি।


বস্তুত বিপুল সংস্কৃত ভাণ্ডারের সমস্ত নির্দেশাবলি-গল্প-কাহিনিই সনাতন ধর্মের নিয়ন্ত্রক, এগুলিকে আমি ধর্মসাহিত্য বলতে পছন্দ করি। বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। বেদ থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ বেদই সনাতন ধর্মের প্রধান ও প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ। ঐতিহাসিকরা বৈদিক সাহিত্য কখনও লিখিত রূপের উপর জোর দেয়নি। বেদ মানেই শ্রুতি। তার লিখিত রূপ অনেক পরের সময়ের কথা। ফলে কাশ্মীরে এক রকম, বাংলায় আর-এক, তামিলনাড়ুতে অন্য রকম রামায়ণ-মহাভারত পাওয়া গেলেও বেদ নিয়ে সেই সমস্যা হয়নি। তার লিখিত রূপভেদ নেই, তাই দরকার হয়নি কোনও ক্রিটিকাল এডিশনএই কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে উনিশ শতকে উইলসন তাই অনুবাদ করেন ঋগবেদ। কোনো পাঠান্তর বা পাঠভেদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না তাঁকে। আজও পুনের ভাণ্ডারকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ঋগবেদের সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটি গাছের ছালের উপর ১৪৬৪ সালে লেখা। এটি ইউনেস্কোর মেমরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের বোখাজকই শিলালিপির সঙ্গে ঋগবেদের ইন্দো-ইরানীয় ভাষার মিলের কথাও বলা হয়েছে বারবার। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান রমেশ ভরদ্বাজের মতে, ‘‘বাল গঙ্গাধর তিলক, জার্মান পণ্ডিত ফেলিক্স জ্যাকোবি মনে করতেন, ঋগবেদ খ্রিস্টের জন্মের আট হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল।’’ কিন্তু ঋগবেদকে যিনি বিশ্বের দরবারে প্রথম পরিচিত করেন, সেই ম্যাক্সমুলারও তিলকের মতো এত দূর পিছিয়ে যাননি। তিনি খ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছর আগের কথা ভেবেছিলেন। আর আর্যভাষাটি যে শুধুই ভারতীয় ভাষা নয়, সে কথাও ইতিহাসের দরবারে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। শেল্ডন পোলক পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন, সংস্কৃত নামক কসমোপলিটান ভাষাটি আফগানিস্তান থেকে জাভা সর্বত্র চলত। রোমিলা থাপারও ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে ঋগবেদের মিত্রাবরুণগোছের দেবতার অনেক মিল পেয়েছেন। সংস্কৃত ভাষা সমীহের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা সনাতন ধর্মের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা ব্রাহ্মণের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা মন্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা শাস্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা অভিসম্পাতের ভাষা এবং সংস্কৃত ভাষা আশীর্বাদেরও ভাষা।


সংস্কৃত ভাষা কীভাবে সনাতন ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে আমি তারই ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করব -- বেদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা ঠিক, বেদ ছাড়া ভারতীয় মনের ঐতিহাসিক বিকাশের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে বেদ পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। হাজার হাজার সাহিত্য লেখা হয়েছে, যা ধর্মসাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে অনেক ক্ষেত্রে এবং সেইসব সাহিত্যের উপাদানের বীজ সবই বেদে প্রতীয়মান। ঋগবেদের কাল থেকে বেদাঙ্গ রচনার অন্তিম পর্ব পর্যন্ত যে সুবিশাল সাহিত্য কেবল ভারতীয় সংস্কৃতির নয়, বিশ্বসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা করেছিল বৈদিক সাহিত্য। যাজ্ঞবল্ক্যের মতে প্রত্যক্ষ বা অনুমানাদির সাহায্যে যে জ্ঞান লাভ করা যায় না, সেই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান যার দ্বারা লাভ করা যায়, তাইই বেদ।
স্বয়ং বেদ বলেছে -- বেদ স্বয়ং উদ্ভূত। এসম্পর্কে বেদের পুরুষসূক্তে বলা হয়েছেতস্নাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুত ঋচ সামানি জজ্ঞিরে।/ ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত (ঋগ্বেদ, ১০/৯০/) অর্থাৎ, সে সর্ব হোম সম্বলিত যজ্ঞ হতে ঋক ও সামসমূহ উৎপন্ন হল, ছন্দ সকল তথা হতে আবির্ভূত হল, যজু তা হতে জন্মগ্রহণ করল, বেদ স্বয়ং উদ্ভূত- বেদ অপৌরুষেয়।

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মৃত্যুদণ্ড : শাসনের ছলনায় রাষ্ট্র কর্তৃক নরমেধ যজ্ঞ (দ্বিতীয়/শেষ পর্ব)



পশ্চিমবঙ্গকে সরিয়ে রেখে ভারতের অন্য রাজ্যগুলির দিকে একটু তাকালে একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখতে পারবেন ভারতের বাইরে অন্যান্য তথাকথিত সভ্য দেশগুলিতেও  নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয় সেগুলি কিছু উল্লেখ করতে মন চাইছে বীভৎসতার বিচারে কিছু বাছাই ঘটনা

ঘটনা : আতঙ্কিত করা, যথেচ্ছ প্রহার, যন্ত্রণা দেওয়া, ভয় দেখানো এবং শেষ পর্যায়ে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারায় গেস্টাপো (গেহেইম স্ট্যাটসপোলজে) ছিল সিদ্ধহস্ত গেস্টাপো, জার্মানের একটি সিক্রেট পুলিশ সংস্থা গেস্টাপো ছিল মানুষের তৈরি জঘন্য, নৃশংস, হিংস্র এক সংস্থা জার্মানিতে একটা সময় এসেছিল যখন গেস্টাপোর নাম শুনলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে শিউরে উঠতবন্ধ হয়ে যেত হৃদস্পন্দন নিরপরাধ মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার করত এই সংস্থাফ্রিডম অফ মুভমেন্টফ্রিডম অফ স্পিচযদি কোনো জার্মান নাগরিক, তবে তাদের যৌনাঙ্গে ইলেকট্রোডের শক, মহিলাদের ধর্ষণ, গোড়ালিতে দড়ি বেঁধে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য গাঁইতির হাতল বা রবারের ডাণ্ডা বা বিষাক্ত ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হত অত্যাচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হত
ঘটনা : রাশিয়ার পুলিশ সংস্থা কেজিবি সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের অসামরিক গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনীকমিটেট গাসুদোর্স্তভেন্নই বেজোপোসনোস্তি’, সংক্ষেপে কেজিবি নাম শুনলেই প্যান্টে হিস্যু হয়ে যাবে অসাড়ে সরকার চালাত কমিউনিস্ট পার্টি, আর সেই সরকারের নির্দেশে কেজিবি সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার করত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাশিয়ার সিক্রেট পুলিশ বাহিনী কাজ করছে ১৯১৭ সাল থেকেজারের আমলে রাজ্যপাট চালাতে অন্যান্য সরকারি দপ্তরের চেয়ে সিক্রেট পুলিশকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তোলা হয়েছিল এটা গড়ে ওঠার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই পুলিশ বাহিনী কত লক্ষ রুশ নাগরিককে যে হত্যা করেছে তার হিসাব নেই
ঘটনা : ইরাকের সিক্রেট সিকিউরিটি পুলিশ প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সামরিক সরকারের সঙ্গে কুর্দদের সংঘর্ষ লেগেই থাকত শিশু, মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে সুযোগ পেলেই নিরপরাধ কুর্দদের ঠান্ডা মাথায় খুন করত ইরাকের সিক্রেট পুলিশ সাদ্দামের সামরিক সরকার প্রায় ৩০০০ সাধারণ নিরীহ কুর্দদের হত্যা করেছিল বলে জানা যায়
ঘটনা : জি পি ইউ, অর্থাৎইউনাইটেট স্টেট পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন এই পুলিশ সংস্থাটি রাশিয়ার আর-একটি ঘাতকের দলসামরিক বাহিনীতে কারা প্রশাসন পার্টির সমালোচক, অন্য অর্থে বিপ্লবের প্রতিবন্ধক বা দেশের শত্রু, তাদের খুঁজে বের করার কাজে ওজিপিইউ প্রথমদিকে ব্যস্ত থাকলেও পরে রাশিয়ার বৃহত্তম গণহত্যার জন্য এই সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছিল তিরিশের দশকে যখন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রেরকালেকটিভাইজেশন প্রোগ্রামরূপান্তরিত হয় তখন দেশের কৃষকরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চারে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ওই প্রতিবাদী কৃষকদের কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল এই ওজিপিইউ রাশিয়ার ইতিহাস অনুযায়ী বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই কোটি রুশ নাগরিক জার্মানদের হাতে নিহত হয়েছিল কিন্তু তার আগে তিরিশের দশকে যে প্রায় সমসংখ্যক রুশি কৃষককে সে দেশের সরকার গুলি করে, ফাঁসি দিয়ে, বেয়নেটে বিদ্ধ করে লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে হত্যা করেছিলএই গণহত্যার নায়ক পরবর্তীকালে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেননি, বরং আমজনতার সামনে তা গর্ব করে বলতেন প্রথমদিকে অবশ্য ব্যাপারটা চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানরা যখন সব ফাঁস করে দেয়, তখনই এই নৃশংস কৃষক হত্যার কথা বিশ্ব জানতে পেরেছিল স্তালিনের দ্বিতীয় স্ত্রী নাজেদদা এই গণহত্যার মানসিক চাপ সহ্য করতে না-পেরে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল