দেবতা
কে ? দেবতা কী ?
হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদে যে দেবতাদের উল্লেখ আছে,
সেগুলি হিন্দুসমাজে বহুল প্রচলিত এবং প্রচারিত দেবদেবীদের মতো নয়।
অবশ্য বেদের সূত্রেই ভারতীয় হিন্দু বা সনাতন ধর্মের দেবদেবীদের আবির্ভাব। আদিবেদ
হিসাবে স্বীকৃত ঋগবেদে কতগুলি দেবদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।ঋগবেদে “দেবতা” শব্দ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অল্প
কয়েকটি সূক্ত ছাড়া প্রায় ৯০ ভাগ মন্ত্রে দেবতা বিষয়ক ভাবনাই মুখ্য। এই
মন্ত্রগুলিকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। (১) স্তুতি এবং (২) প্রার্থনা। স্তুতি
বিষয়ক মন্ত্রে দেবতার নাম, রূপ ও কর্মের উল্লেখ করে দেবতার
স্তব করা হয়েছে। অপরদিকে প্রার্থনা বিষয়ক মন্ত্রে দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে
ধন, আয়ু, শক্তি, পুত্র
প্রভৃতি।
যাস্কাচার্য
তাঁর “নিরুক্ত” গ্রন্থে ‘দেব’ এবং ‘দেবতা’ দুটি শব্দের একই অর্থ করেছেন। তিনি ‘দেব’ শব্দের তিনটি তিনটি অর্থ এবং চারটি ব্যুৎপত্তি
দেখিয়েছেন – (১) ‘দা’ ধাতু থেকে। (২) ণিজন্ত ‘দীপ’ ধাতু থেকে।(৩) ণিজন্ত ‘দ্যুৎ’ ধাতু থেকে। (৪) ‘দিব’ শব্দ থেকে। অর্থাৎ দেব বা দেবতা তাঁরাই যাঁরা (ক)
ঐশ্বর্য দান করেন এবং আমাদের ঈপ্সিত বস্তুগুলি দান করেন। (খ) তেজোময় বলে যাঁরা পদার্থগুলিকে প্রকাশিত করে। (গ) যাঁরা সাধারণত দ্যুলোকে অবস্থান করেন। বস্তুত
শৌনকাচার্যের ‘বৃহদ্দেবতা’ এবং
যাস্কাচার্যের ‘নিরুক্ত’ গ্রন্থের
দেবতাকাণ্ডে দেবতাতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে। ঋগবেদের সূক্তগুলিতে ধর্মীয়
চিন্তাধারায় অনুসরণ করলে দেবতাতত্ত্বের সম্বন্ধে এক বিবর্তন লক্ষ করা যায়।
বহুদেবতাবাদ থেকে অতিদেবতাবাদের মধ্য দিয়ে একদেবতাবাদ বা একেশ্বরবাদে উত্তরণ ঘটেছে
বৈদিক দেবতাতত্ত্বে। বেদের দেবতাতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি দেবতাই বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি থেকে কল্পিত হয়েছেন।প্রাকৃতিক রূপেরই প্রতিরূপ।
অনেক
ক্ষেত্রে দেবতা হিসাবে বিষয়বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এই অর্থে প্রস্তরখণ্ড, ধনুক, ব্যাঙ
ইত্যাদি দেবতা প্রতিপন্ন হয়। বস্তুত
ঋকবেদের দেবতা অর্থে বুঝি পৃথিবী বা অন্তরিক্ষ বা দ্যুলোকের এমন সব প্রাকৃতিক বিষয়, যাঁদের মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখে
ঋষিরা তাঁদের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। সেই কারণে নানা মুনির নানা মতও আছে। যেমন –
কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে ইন্দ্র হল ঝড়ের দেবতা। কেউ বলেছেন প্রাচীন
সূর্যদেবতা। কারও মতে বরুণ স্বর্গের দেবতা, কেউ বলছেন
চন্দ্রদেবতা, কেউ-বা বলেন জলের দেবতা
ইত্যাদি। ঋকবেদে কতকগুলি আদিত্যের নাম আছে, রুদ্র ও বসু শব্দ
দুটি বহুবচনে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু ১২ জন আদিত্য, ১১ জন রুদ্র,
৮ জন বসু এমন উল্লেখও নেই। ঋকবেদে নীচে উল্লিখিত দেবতাদের নাম পাওয়া
যায় – (১) মিত্র, বরুণ, অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড, সূর্য, সবিতা এবং ইন্দ্র । এঁদের ঋকবেদে কোথাও না-কোথাও
আদিত্য বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আবার অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড --
এঁদের কোনো প্রাধান্য নেই।(২) মিত্র, সূর্য, বরুণ,
সবিতা, ইন্দ্রের খুব প্রাধান্য। এ
ছাড়া অগ্নি, বায়ু,
মরুৎগণ, বিষ্ণু,পর্জন্য,
পূষা, ত্বষ্ঠা, অশ্বিনী
২ জন, সোম -- এরাও প্রাধান্য পেয়েছেন।
(৩) বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি ও যমেরও কিছু গৌরব
আছে। (৪) কোনো কোনো অংশে ত্রিত, আপ্তা,
অধিব্রধ ও অজএকপাদেরও নাম পাওয়া যায় । (৫)
বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ, স্কম্ভ,
প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্মা
-- এই কয়টি নাম দ্বারা সৃষ্টিকর্তাকে বোঝায়। (৬) ক-জন দেবীও আছেন। অদিতি ও ঊষা প্রধানা। (৭) সরস্বতী, ইলা, ভারতী,
মহী, হোত্রা, বরুত্রী,
ধীষণা, অরণ্যানী, অগ্নায়ী,
বরুণানী, অশ্বিনী, রোদসী,
রাকা, সিনিবালী, গুঙ্গু,
শ্রদ্ধা ও শ্রী -- এঁরা দেবী পদভিষিক্তা। তা
ছাড়া পরিচিত সব নদীরাও দেবীর মর্যাদা পেয়েছেন ।
এখন
প্রশ্ন হল দেবতারা সৃষ্টি হল কীভাবে ? পুরাণে আছে, পরমেশ্বরের
ইচ্ছায় ও তার লীলা প্রকাশের বাসনায়
দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছে। পরমেশ্বর মহাবিষ্ণুই
লীলার জন্য তিন ভাগে ভাগ
হয়েছেন -- ব্রহ্মা , বিষ্ণু এবং মহেশ্বর । বিষ্ণু পূরাণে আছে – পরব্রহ্মের প্রথম অংশ ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা রূপে সকল কিছু সৃষ্টি করে তৃতীয় বারে দেবতাদের সৃষ্টি করলেন । দেবতারা
জ্যোতিষ্মান,
দীপ্তিমন্ত । দেবতাদের প্রধানত স্বর্গবাসী হিসাবেই দেখানো হয়েছে, অবশ্য পৃথিবীতেও তাদের অবস্থান আছে। দেবতারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। মানুষ
যা করতে পারে না দেবতারা তা করতে পারেন,
অথবা দেবতারা যা করতে পারেন মানুষ তা পারে না – এরকম গোছের কিছু একটা। সাধারণভাবে
মরুৎ ঝড়ের দেবতা বাদে দেবতাদের সংখ্যা হল তেত্রিশ । কিন্তু যাস্ক প্রভৃতি
নিরুক্তকারদের মতে বৈদিক দেবতা মাত্র তিনজন -- অগ্নি , ইন্দ্র
এবং সূর্য। তবে পুরাণে তেত্রিশ
কোটি দেবদেবীর কথা বলা হয়েছে। বোঝাই যায়, বেদে উল্লেখিত ৩৩ টি দেবতায় কাজ
মিটছিল না। পুরাণের যুগে এসে তৎকালীন শাসকদের তত্ত্বাবধানে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ৩৬ টি
পুরাণে ৩৩ কোটি দেবতাদের গল্প-কাহিনি বর্ণিত হল, যা উপকথা এবং রূপকথার মতোই মনোরঞ্জন করে। পুরাণের পাতায় পাতায় বর্ণিত
হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তার পরিণতি কী হয় ! বেদের দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্ধ আছে । এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার জন্ম আছে। অনেক
বিষয়ে মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মিল দেখা যায়,
তাই হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া যায় । সেই কারণে পুরাণের দেবতারা মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম,
ক্রোধ, লোভ, মোহ,
মদ ও মাৎসর্য ) গড়ে উঠেছে।
আবার অনেক দেবতা মানুষ
থেকেও জন্মেছেন । তাই আহার-বিহার, যানবাহন বসন-ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের
কাছাকাছি । মহাভারতের ক্ষেত্রেও যে বাস্তবতা কিছু রয়েছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু
ঘটনা, চরিত্র ও সময় সম্ভবত ঋগবেদের পরবর্তী কোনো সময়ে।
ঋগবেদের অনেক দেবতার নামই এখানে দেখা যায়। তবে কৃষ্ণসহ বেশ কিছু নতুন চরিত্র বা
ভগবানের উদ্ভব হয়, যেগুলি আসলে ঋগবেদের কিছু দেবতার
ভিন্নরূপ বই কিছু নয়। কুন্তিপুত্র পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই হলেও তাদের জন্ম পাঁচজন অন্য
পুরুষের (যাঁদের দেবতা বলা হয়েছে) ঔরসে। যুধিষ্ঠির ধর্মের
পুত্র, ভীম
বায়ুর, অর্জুন ইন্দ্রের এবং নকুল ও সহদেব যমজ দেবতা
অশ্বীনিকুমারদ্বয়ের পুত্র। সমস্যা হল ধর্ম নামে কোনো দেবতাকে আমরা ঋগবেদে পাই না।
বাকিদের অবশ্য পাওয়া যায়। এখানে এই “ধর্ম” সম্ভবত বরুণ। ঋগবেদে আমরা দেখতে পাই ধর্মসংস্কারের ফলে ইন্দ্র যখন
প্রধান দেবতা হিসেবে প্রাধান্য পেতে শুরু করে তখন বরুণকে হেয় করা হয়। কিন্তু
প্রথমদিককার ঋকগুলিতে বরুণ প্রধান দেবতা থেকেই যায়। কারণ সেগুলির পরিবর্তন সম্ভব ছিল না হয়তো। সম্ভবত ধর্মসংস্কারের জন্য প্রাচীন দেবতাকে যেহেতু
“বরুণ” রূপে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি, তাই তাকে নতুন
নামে নতুন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ধর্মদেবতাকে সকল দেবতার ঊর্ধ্বে স্থান
দেওয়া হয়েছে। ঋগবেদে বরুণের সঙ্গে আরও একজন দেবতাকে আমরা দেখতে পাই -- সে হল মিত্র। ইন্দ্রের পূর্বে বরুণ এবং মিত্র এই দুই দেবতাকে ঋগবেদে
বেশ উঁচু স্থান দেওয়া হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণের অবস্থান নিরপেক্ষ মনে হলেও
মোটেই তা নিরপেক্ষ ছিল না। সে পাণ্ডবদের “মিত্র” হিসাবেই অবস্থান নিয়েছিলেন। নিজের পক্ষকে জয় এনে দিতে ন্যায়ের নামে যা যা ‘নোংরামি’ করা যায়, তার সব তিনিই সম্পাদন করেছেন। ভালো
মানুষের ভেক ধরে আর লম্বা লম্বা ডায়লগ মেরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাকে প্রহসনে পরিণত
করেছেন কৃষ্ণ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কৃষ্ণ অনার্যের প্রতিনিধি ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।
অনেকে মনে করেন কৃষ্ণ মহাভারতের রচয়িতা “কৃষ্ণদ্বৈপায়ন”ও হতে পারেন। বেদব্যাসের অপর নামই তো কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।
২টি মন্তব্য:
শেষের কৃষ্ণবিষয়ক বক্তব্যটুকু শান্তিপ্রাপ্য কৃষ্ণকে যারা সৃজক হিসেবে পূজে তাদের মনোবৈকল্যজাত গালগল্পাদিকে দেয়াই যায় কিন্তু কল্পগাথামুক্ত কৃষ্ণই যে ছয় ছয়টি সহস্র পেড়িয়ে আসা বৈদিক সনাতনীদের প্রধানতম একজন বাণীবাহক তা ঐতিহাসিক এক তথ্য ।
তাই সৎজীবনকাঙ্খী প্রতিটি মানুষকেই তার তার স্রষ্টাসমর্পিত ধর্মকে মনোবৈকল্যের অধর্ম থেকে দূরে রাখার অনবরত এক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকতেই হয় ।
ঋগ্বেদীয় ঋষি ও তাদের প্রার্থনাবিষয়ক সুসমঞ্জস্যভাষে যে যৌক্তিকতাকে লেখাটিতে পেলাম তা ধারাবহিক থাকুক এই আশে এবং
''বৃহদ্দেবতা'' গ্রন্থটি পড়া বা সংগ্রহের কোন সংযোগ জানার আগ্রহে ।
শয়তানের সাথে ছলনায় যদি নোংরামি হয়ে থাকে তবে সে নোংরামি যুগে যুগে হোক এই প্রার্থনা। তথ্য পূর্ণ অন্দর লেখাটি। ধন্যবাদ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন