“পৃথিবীতে প্রতিটি
ধর্মেরই প্রচার ও প্রসার ঘটেছে মানবরক্তসাগর পেরিয়ে। ইতিহাস তার সাক্ষী। ধর্ম
মানেই ধোঁকাবাজি, ভণ্ডামি, হিংস্রতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান
বিমুখতা, লোভ-লালসা ও আতঙ্কবাদের
চূড়ান্ত। আমরা যারা আজ সেই অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছি, তাদের কাছে ধর্মের ইতিহাসগুলি ভয়াবহ রকমের রূপকথা মনে হয়।
ওসব পড়লে ভয়ে আমাদের গা শিউড়ে ওঠে, বিবমিষা লাগে প্রবল
ঘৃণায়। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে –
এই
অপরাধে খ্রিস্টানরা বিজ্ঞানী ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল, চিরবন্দি করে রেখেছিল বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে। ধর্মগুরুরা
নির্বিচারে পুড়িয়ে মেরেছে নিরপরাধ মানুষকে রূপকথার ডাইনি আখ্যা দিয়ে। মুসলিম
বিজেতারা কচুগাছের মতন মানুষ কেটেছে, জনপদ ধ্বংস করেছে, নিশ্চিহ্ন করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প-সংস্কৃতির ভাণ্ডার।
অহিংস বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্যও সম্রাট অশোক হত্যা করেছিল অগণিত
মানুষ। এরকম ইতিহাস রয়েছে প্রায় সকল ধর্মেরই”
--- যুক্তিবাদী
প্রাবন্ধিক তামান্না ঝুমুর উদ্ধৃতি দিয়েই আলোচ্য প্রবন্ধটি শুরু করা যাক।
এই ধরাধামে আমরা ধর্মকে দু-রকম ভাবে পেয়ে থাকি।
একটি ধর্ম ঈশ্বরনির্ভর, অপরটি প্রকৃতি এবং
বৈশিষ্ট্যনির্ভর। প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্যনির্ভর ধর্ম হল গুণ, আকার, স্বাদধর্ম আছে এমন
বস্তু। আমরা বিভিন্ন দ্রব্যের ধর্ম দিয়েই বস্তু চিনি। এই ধর্ম দিয়েই আমরা হিমসাগর
আর ফজলি আমের পার্থক্য বুঝি, আমার স্বাদ ও আকৃতি
দেখে নিমপাতা আর কেশুতি পাতার পার্থক্য করি,
আমরা
আমলকি ফল আর সবেদা ফলের পার্থক্য ধর্ম দিয়ে বুঝি। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়
প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্যনির্ভর ধর্ম নয়,
আমাদের
আলোচ্য বিষয় ঈশ্বরনির্ভর ধর্ম।
ঋগবেদে প্রায় ৬০ স্থানে “ধর্ম” শব্দটির উল্লেখ আছে।
ক্লীবলিঙ্গ “ধর্মন্” রূপে অধিকাংশ স্থলে –
শুধুমাত্র
দুই-তিন স্থানে “ধর্মন্” পাওয়া যায়। অকারান্ত পুংলিঙ্গ “ধর্ম” শব্দ পাওয়া যায়
পরবর্তী ব্রাহ্মণ ও আরণ্যকের যুগ থেকে। “ধর্ম” শব্দের ব্যুৎপত্তি সবখানেই ‘ধৃ’ ধাতু থেকে করা হয়েছে। ঋগবেগে
অধিকাংশ জায়গায় ক্লীবলিঙ্গ ‘ধর্মন্’ শব্দ যজ্ঞ অর্থে ব্যবহৃত। সুতরাং যাস্কের নিরুক্তে (৩.১৩)
বলা হয়েছে, ধর্ম যজ্ঞেরই নাম (“ধর্ম ইতি যজ্ঞস্য”)। যা ধৃত হয় এই অর্থে ‘ধৃ’ ধাতু থেকে কর্মবাচ্যে
‘মন্’ প্রত্যয় যোগে ‘ধর্মন্’ নিষ্পন্ন হয়। এই অর্থ ঋগবেদেরই যে সূক্তে দেখতে পাচ্ছি, তা হল – “যজ্ঞেন যজ্ঞম্
অযজন্তু দেবাস্থানি ধর্মানি প্রথমান্যাসন”। দেবতারা যজ্ঞ করলেন
এবং সেগুলিই হল প্রথম ধর্ম। ক্লীবলিঙ্গ ‘ধর্মন্’ শব্দের আর-এক অর্থে কয়েকটি জায়গায় প্রয়োগ আছে। অনেক জায়গায়
সায়ন তাঁর ঋগবেদের ভাষ্যে “ধর্ম ধারকং কর্ম” (৭.৮৯.৫) অর্থ করেছেন। ধারক অর্থে ক্লীবলিঙ্গ ‘ধর্ম’ শব্দের প্রয়োগ অগ্নির
(৩.১৭.১) এবং সূর্যের (৮.৬.২০) প্রসঙ্গেও পাওয়া যায়। কিন্তু পুংলিঙ্গ ‘ধর্মন্’ শব্দ ঋগবেদে
শুধুমাত্র ধারক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে (“ধর্মা ভুবদ্ বৃজনস্য
রাজা”.-- ৯.৯৭.২৩)। কালক্রমে ন-কারান্ত
এবং ক্লীবলিঙ্গ রূপ লুপ্ত হয়ে অ-কারান্ত পুংলিঙ্গ ‘ধর্ম’ শব্দেরই প্রচলন হল এবং অর্থও
ক্রমশ নির্দিষ্ট ও রূঢ় হতে লাগল।
এ তো ধর্মের ব্যাকরণগত কচকচানি। এসব জেনে আমাদের বিশেষ লাভ নেই। আমাদের আরও ভিতরে
ঢুকতে হবে, আরও গভীরে। আর আমরা এগিয়ে
যেতে চাইব গন্তব্য স্থলে। Babylon
Dictionary মতে, “Collection of beliefs
concerning the origin of man and the universe.”(অর্থাৎ, মানুষের অস্তিত্ব এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলের উপর যে বিশ্বাস – তাই-ই ধর্ম)। Oxford
Dictionary মতে, “Belief in a superhuman
controlling power especially in a personal GOD or LGODS entitled to obedience
and worship.”( অর্থাৎ, কোনো মহাজাগতিক শক্তিতে
বিশ্বাস স্থাপন করে সেই শক্তির আরাধনা করার নামই ধর্ম)। ধর্মের কোনো সামান্যাভিধান
পাওয়া শক্ত। একদিকে ইতিহাস চর্চা এবং অন্যদিকে সমাজসভ্যতার মতো ধর্মের বিচিত্র
রূপ। প্রতিটি ধর্মের শাখাপ্রশাখা প্রচুর এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলের
চাইতে অমিলই বেশি। সমগ্র পৃথিবীতে যেসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আমরা প্রত্যক্ষ করি
সেগুলিকে বৈশিষ্ট্য ও সৃষ্টিগত বৈচিত্র্য অনুসারে ভাগ করা যায়। আমরা সেইভাবেই
আলোচনা করলে সুবিধা হবে। বস্তুত ধর্ম বৈশিষ্ট্য ও সৃষ্টিগত বৈচিত্র্য অনুসারে
প্রধান বা মুখ্যভাবে তিন ভাগ পাওয়া যায়। যেমন – (১) আব্রাহামীয় ধর্মসমূহ ( ইসলাম ধর্ম,
ইহুদি
ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, বাহাই ধর্ম), (২) ভারতীয় ধর্মসমূহ
( জৈন ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শিখ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম), (৩) চৈনিক, কোরীয়, জাপানি ধর্মসমূহ (তাও ধর্ম, শিন্তো ধর্ম, কনফিউশিয়ান ধর্ম)।
(i)
ইসলাম ধর্ম : একেশ্বরবাদী এবং আব্রাহামীয় ধর্ম হল ইসলাম ধর্ম। কোরান
দ্বারা পরিচালিত; যা এমন এক কিতাব বা
গ্রন্থ যাকে এর অনুসারীরা অবিকল আল্লাহর
বাণী বলে মনে করেন। ইসলামের প্রধান নবি মোহাম্মদ (সঃ)-এর প্রদত্ত শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনাদর্শও এর ভিত্তি । বলা হয় “সুন্নাহ” এবং “হাদিস” নামে লিপিবদ্ধ
রয়েছে। “ইসলাম” শব্দের অর্থ কেউ বলেন “আত্মসমর্পণ” বা একক স্রষ্টার নিকট
নিজেকে সমর্পণ করা, কেউ বলেন “শান্তি”। অনেকের ধারণা যে
মোহাম্মদই এই ধর্মের প্রবর্তক। তবে অনেক মুসলমানদের মতে, তিনি এই ধর্মের প্রবর্তক নন। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত
সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রাসুল বা পয়গম্বর। বস্তুত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে তিনি এই ধর্ম
পুনঃপ্রচার করেন। পবিত্র কোরান ইসলাম ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ। কোরান এবং হাদিস
বিশ্বাসীদের মুসলিম বা মুসলমান বলা হয়। হাদিসে প্রাপ্ত তাঁর নির্দেশিত কাজ ও
শিক্ষার ভিত্তিতে কোরানকে ব্যাখ্যা করা হয়। তবে কোনো হাদিসের মর্মার্থ কোরানের
বিরুদ্ধে গেলে তা বাতিল বলে গণ্য হয়।
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা আনুমানিক ১৬০
কোটি, অর্থাৎ তারা পৃথিবীর দ্বিতীয়
বৃহত্তম ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠী। হজরত মোহাম্মদ
ও তার উত্তরসূরিদের প্রচার ও যুদ্ধ জয়ের ফলশ্রুতিতে ইসলাম দ্রুত বিশ্বে
ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে -- বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা,
দক্ষিণ
এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা,
মধ্য
এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ইউরোপে মুসলমানরা বাস করেন। সৌদি আরবেই এ ধর্মের গোড়াপত্তন।মুসলমানদের
ধর্ম বিশ্বাসের মূল ভিত্তি আল্লাহ একত্ববাদ। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ
মানবজাতির জন্য তাঁর বাণী ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে রাসুল হজরত মোহাম্মদের নিকট
অবতীর্ণ করেন। আরও বিশ্বাস করেন তাদের পবিত্র গ্রন্থ কোরান নিখুঁত, অবিকৃত ও মানব এবং জ্বিন জাতির উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ আল্লাহর
সর্বশেষ বাণী, যা পুনরুত্থান দিবস বা
কেয়ামত পর্যন্ত বহাল ও কার্যকর থাকবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয়
ধর্মাবলম্বীরাই আব্রাহামের শিক্ষার ঐতিহ্য পরম্পরা। উভয় ধর্মাবলম্বীকে কোরানে
"আহলে কিতাব" বলে সম্বোধন করা হয়েছে এবং বহুদেবতাবাদীদের থেকে আলাদা
করা হয়েছে। ইসলামি বিশ্বাসানুসারে এই দুই ধর্মের অনুসারীগণ তাদের নিকট প্রদত্ত
আল্লাহর বাণীর অর্থগত ও নানাবিধ বিকৃতসাধন করেছেন; ইহুদিগণ তৌরাত বা তোরাহকে ও খ্রিস্টানগণ ইঞ্জিলকে (নতুন বাইবেল)। মুসলমানদের
বিশ্বাস ইসলাম ধর্ম আদি এবং অন্ত এবং স্রষ্টার নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম।
মুসলমানগণ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তাকে 'আল্লাহ' বলে সম্বোধন করেন। ইসলামের মূল বিশ্বাস হলো আল্লাহর
একত্ববাদ বা তৌহিদ। ইসলাম পরম একেশ্বরবাদী ও কোনোভাবেই আপেক্ষিক বা বহুত্ববাদী
নয়। আল্লাহ শব্দটি আল এবং ইলাহ যোগে গঠিত। আল অর্থ সুনির্দিষ্ট এবং ইলাহ অর্থ
উপাস্য, যার অর্থ সুনির্দিষ্ট উপাস্য।
খ্রিস্টানগণ খ্রিস্টধর্মকে একেশ্বরবাদী বলে দাবি করলেও মুসলমানগণ খ্রিস্টানদের
ত্রিত্ববাদ (trinity) বা এক ঈশ্বরের মধ্যে
পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মিলন
-- এই বিশ্বাসকে বহু-ঈশ্বরবাদী ধারণা বলে অস্বীকার করেন। ইসলামি ধারণায় আল্লাহ
সম্পূর্ণ অতুলনীয় ও পৌত্তলিকতার অসমতুল্য,
যার
কোনোপ্রকার আবয়বিক বর্ণনা অসম্ভব।
“ফেরেশতা” ফারসি শব্দ। ফেরেশতায় বিশ্বাস ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসের একটি
মূল নীতি। এরা অন্য সকল সৃষ্টির মতোই আল্লাহর আর-এক সৃষ্টি। তাঁরা মুলত আল্লাহ
দূত। ফেরেশতারা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তারা সর্বদা ও
সর্বত্র আল্লাহর বিভিন্ন আদেশ পালনে রত এবং আল্লাহর অবাধ্য হওয়ায় কোনো ক্ষমতা
তাদের নেই। ফেরেশতারা আলোর (নুর) তৈরি। তিন প্রকারের ফেরেশতার কথা জানা যায় -- (১)
ফেরেশতা মিকাইল –- ইনি বৃষ্টি ও খাদ্য
উৎপাদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। (২) ফেরেশতা ইসরাফিল –- এই ফেরেশতা আল্লাহর আদেশ পাওয়া মাত্র শিঙায় ফুঁ দেওয়ার মাধ্যমে কেয়ামত বা
বিশ্বপ্রলয় ঘটাবেন। তার কথা কুরআন শরিফে বলা না-হলেও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।
(৩) মালাক আল-মাউত ফেরেশতা –- ইনি মৃত্যুর ফেরেশতা
ও প্রাণ হরণ করেন।
কোরান ইসলাম ধর্মের বা মুসলমানদের মূল
ধর্মগ্রন্থ। ইসলাম ধর্মমতে, জিব্রাইল ফেরেশতার
মাধ্যমে নবি হজরত মোহাম্মদের কাছে ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬ জুলাই, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু অবধি বিভিন্ন সময়ে স্রষ্টা
তাঁর বাণী অবতীর্ণ করেন। এই বাণী তাঁর অন্তঃস্থ ছিল, সংরক্ষণের জন্য তাঁর অনুসারীদের দ্বারা পাথর, পাতা ও চামড়ার উপর লিখেও রাখা হয়। অধিকাংশ মুসলমান পবিত্র কোরানের যে-কোনো
পাণ্ডুলিপিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন, স্পর্শ করার পূর্বে
ওজু করে নেন। তবে ওজু ছাড়াও কোরান পাঠ করা যায়। কোরান জীর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী
হয়ে পড়লে আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেওয়া হয় না। বরং কবর দেওয়ার মতো করে মাটির
নীচে রেখে দেওয়া হয় বা পরিষ্কার জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
হজরত মোহাম্মদ ছিলেন তৎকালীন আরবের বহুল
মর্যাদাপূর্ণ কুরাইশ বংশের একজন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে তাঁর বিশেষ গুণের
কারণে তিনি আরবে “আল-আমিন” বা “বিশ্বস্ত” উপাধিতে ভূষিত হন। স্রষ্টার কাছ থেকে নবুওয়াত প্রাপ্তির পর
তিনি ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতি বা উম্মাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকে ইসলামের শ্রেষ্ঠ
বাণীবাহক বা নবি হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা হয়। মুসলমানরা তাঁকে একটি নতুন
ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে দেখেন না। তাঁদের কাছে হজরত মোহাম্মদ বরং আল্লাহ প্রেরিত
নবি-পরম্পরার শেষ নবি; যিনি আদম, ইব্রাহিম ও অন্যান্য নবিদের প্রচারিত একেশ্বরবাদী ধর্মেরই
ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। তার পূর্বের একেশ্বরবাদী ধর্ম বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত ও
বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তাই মোহাম্মদ ইসলামকে শেষ প্রেরিত ধর্ম হিসেবে আল্লাহর পক্ষ
থেকে উপস্থাপন করেন। বস্তুত হজরত মোহাম্মদ ছিলেন তৎকালীন আরব সমাজের ধর্মীয় শাসক। অস্থির মানুষদের ‘আনুগত্যের পথে’
আনতে একজন শাসক হিসাবে যা যা করণীয় (নরমে-গরমে) তার সবই মোহাম্মদ করেছেন।
মুসলমানদেরকে শেষ বাণীবাহক মোহাম্মদের নাম
উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে "সাল্লাল্লা-হু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম" বলতে হয়। এর অর্থ – “আল্লাহ তাঁর উপর রহমত এবং শান্তি বর্ষণ করুন”। একে
বলা হয় দরুদ শরিফ। এছাড়াও আরও অনেক দরুদ হাদিসে বর্ণিত আছে। 'হাদিস' আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে -- কথা, বাণী, কথা-বার্তা, আলোচনা, কথিকা, সংবাদ, খবর, কাহিনি ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় হজরত মোহাম্মদের কথা, কাজ, অনুমোদন এবং তাঁর
দৈহিক ও চারিত্রিক যাবতীয় বৈশিষ্ট্যকে হাদিস বলে। মোহাম্মদের জীবদ্দশায় তাঁর
সহচররা তাঁর হাদিসগুলি মুখস্থ করে সংরক্ষণ করতেন। প্রথমত হাদিস লেখার অনুমতি ছিল
না -- যাতে হাদিস এবং কোরান পরস্পর মিলে না যায়। পরবর্তীতে মোহাম্মদ নিজেই তাঁর কোনো কোনো সহচরকে হাদিস লেখার
অনুমতি প্রদান করেন। মোহাম্মদের সহচরদের ছাত্র তথা তাবেইরা ওমর ইবন আব্দুল আজিজের
আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাদিস লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেন। বিভিন্ন বিখ্যাত
পণ্ডিতেরা এই কাজে ব্রতী ছিলেন। তাঁদের সংকলিত সেসব হাদিস-সংকলন গ্রন্থের মধ্যে
ছয়টি গ্রন্থ প্রসিদ্ধ হয়েছে। এগুলো 'ছয়টি হাদিস গ্রন্থ' (কুতুবুস সিত্তাহ) আখ্যা দেওয়া হয়। তবে এটা ভাবা ভুল হবে
যে, এই ছয়খানা গ্রন্থের বাইরে আর
কোনো বিশুদ্ধ হাদিস নেই। এর বাইরেও বহু বিশুদ্ধ হাদিসের সংকলন রয়েছে। হাদিসের
বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের বিভিন্ন মাপকাঠি আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল হাদিসের সনদ
যাচাই।
ইসলামের ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায়, ইসলাম ধর্মের আতুরঘর হল আরব। আরব মানে তৎকালীন ১ কোটি
জনসংখ্যার ১০ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা। অর্থাৎ সেই অঞ্চল, যার উত্তরে ইরাক জর্ডন ও সিনাই উপদ্বীপ, পূর্বে পারস্য উপসাগর ও আরব সাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর, সুয়েজ খাল ও সিনাই মরুভূমি। এই সময়ের আরব ছিল অন্ধকারময়
যুগ। এমন অন্ধকার যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার যুগ বলেও ডাকা হয়। এই সময়
আরববাসীরা একে অপরের সঙ্গে নোংরামি, ভণ্ডামি, অত্যাচার, ব্যাভিচার, হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি, দাঙ্গা, যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকত।খ্রিস্টান, ইহুদি, হানাফিদের মধ্যে
একাধিক মূর্তিপূজক পৌত্তলিক ছিল। খ্রিস্টানরা জিশুখ্রিস্ট তথা ঈশা আ. কে আল্লাহর
পুত্র হিসাবে পুজো করত। ইহুদিরা উজাইর নবির পুজো করত। আদম আ.-এর তৈরি করা কাবায়
৩৬০ টি মূর্তি রেখে পুজো হত। এই ৩৬০ টি দেবতার মধ্যে লাত, মানত, ওজ্জা ও হোবল ছিল
প্রধান। এছাড়া গাছ, পাহাড়, পাথর, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র ও আগুনের
পুজো করত।তারা বিশ্বাস করত দেবতার অশুভ দৃষ্টির জন্য ভূমিকম্প, ঝড়, বিপদ-আপদ হয়। প্রতিটি
গোত্রের আলাদা আলাদা দেবতা ছিল। এদের মধ্যে হানিফরাই এক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখত। এহেন
অবস্থার আমূল বদলে দেন কোরায়েস বংশীয় হজরত মোহাম্মদ। বলা হয় আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে
হজরত মোহাম্মদ প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। বললেন, “তোমরা পুতুল পুজো কোরো না, এক আল্লাহর উপাসনা করো”। এ সময় হজরত মোহাম্মদ
ও তার অনুগামীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করত বিরোধীরা। তাদের যাতায়াতের পথে কাঁটা
বিছিয়ে দেওয়া হত, নামাজ রত অবস্থায়
গলায় ফাঁস দিয়ে দিত, উটের নাড়িভুঁড়ি গায়ে
ফেলে দিত। মোনাজাত করার করার সময় হাতে পশুর মলমূত্র ঢেলে দিত, উপহাস করত। এত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পৌত্তলিকতাকে নির্বিষ
করে অবশেষে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়। অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হল। ইসলামের
ইতিহাসে হিজরতের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘হিজরত’-এর অর্থ পরিত্যাগ করা বা স্থানান্তর করা। হজরত মোহাম্মদ
মক্কা ত্যাগ করে ইসলাম রক্ষার জন্য মদিনায় চলে যান, তাকে ইসলামি ভাষায় হিজরত বলে। ইসলামের ব্যাপর প্রচার প্রসার সবই হিজরতের পরেই
ঘটে। মদিনায় ইসলাম অতি অল্প সময়ে সুশোভিত হয়ে উঠল। মুসলমানরা নতুন জাতিতে পরিণত হল
। বিশেষ করে হজরতের হাতে যখন মদিনার রাষ্ট্রপ্রধান হলেন, শাসন এবং শোষণের ক্ষমতা পেলেন এবং রাজদণ্ড রূপে তলোয়ার
পেলেন – তখন একে একে প্রতিবেশী
দেশগুলিতেও ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে দিতে থাকল। অবশেষে বাধাদানকারীদের প্রতিরোধ করতে করতে
প্রবেশ করলেন কাবার গর্ভগৃহে। ১২ জন পৌত্তলিক এবং ২ জন মোহাম্মদ অনুসারীর প্রাণের
বিনিময়ে কাবা থেকে ৩৬০ টি দেবতা অপসারণ করা হয়। আবু বকর প্রথম সাবালক পুরুষ যিনি
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন রাসুলের হাতে। আবু বকরই প্রথম খলিফা। এককথায় ইসলাম ধর্ম হল
হজরত মোহাম্মদের ধর্ম, যা আল্লাহ এবং দ্বারা
নির্দেশিত। অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ, অনেক রক্তপাতের মধ্য
দিয়ে আজ প্রতিটি দেশে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। সেইদিক থেকে বিচার করলে হজরত মোহম্মদ
পূর্বতন পৌত্তলিকদের বিশ্বাসে চরমভাবে
আঘাত করেছেন, অসম্মান করেছেন, অবমাননা করেছেন,
অপমান
করেছেন, ধর্মান্তর করিয়েছেন, হত্যা করেছেন, ধুলিস্যাৎ করে
নিশ্চিহ্ন করেছেন। মোহম্মদের আস্তিক্যবাদ থেকে নাস্তিক্যবাদ, নাস্তিক্যবাদ থেকে আস্তিক্যবাদে রূপান্তর, পৌত্তলিকতা থেকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর। মক্কা থেকে শুরু
হয়েছিল, এখন বহু দেশে কোথাও প্রথম, কোথাও দ্বিতীয় অন্যতম ধর্ম।
নবি বা পয়গম্বর বা রাসুল মোহম্মদের জীবনীর
অধিকাংশটাই রূপকথা, বানোয়াট – এ বিষয়ে একাধিক ঐতিহাসিক লিখে গেছেন (http://en.wikipedia.org/wiki/Historicity_of_Muhammad)। সপ্তম শতাব্দীতে
আর্মেনিয়ান পণ্ডিত সেবেসের লেখা ছাড়া আর কোনো সমসাময়িক লেখাতে নবির অস্তিত্ব নেই
সন্তুষ্টিজনকভাবে। সুতরাং, হজরত মোহম্মদের
ঐতিহাসিক অস্তিত্ব আদৌ ছিল কি না -- সেটাই যখন ঐতিহাসিকদের প্রশ্নের মুখে।
মোহম্মদের অস্তিত্ব ছিল কী ছিল না, তা নিয়ে আমার
মাথাব্যথা নেই। তবে হজরত মোহম্মদ সম্বন্ধে যে তথ্যগুলি পাওয়া যায় তা কতটা
বিশ্বাসযোগ্য বা ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য,
তা নিয়ে
আলোচনা চলবেই।
ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্ম মূলত “সাম্রাজ্য” প্রতিষ্ঠার ধর্ম।
যদিও এই দুই ধর্মের শুরু “সাম্রাজ্যর” বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই। ফলে এই দুই ধর্ম মানুষকে তার নিজস্ব
পথের স্বাধীনতা দেয়নি। জনগণকে বান্দা বা ক্রীতদাস বা ভেড়ার পাল বানিয়ে রাজ্য শাসন
করাই আব্রাহামিক ধর্মের মূল উদ্দেশ্য।
(ii)
ইহুদি ধর্ম : পৃথিবীতে হিব্রু সভ্যতার ইতিহাস আজ অজানা নয়। যদিও হিব্রু
একটি ভাষার নাম; কিন্তু কালক্রমে এটি
একটি জাতির পরিচায়ক এমনকি একটি ধর্মের নামেও পরিচিত হয়। পৃথিবীতে আধুনিক যুগে আজকে
যে ইহুদিদের পরিচয় পাই তাদেরই আগের নাম হিব্রু। ইহুদি ধর্মের উদ্ভব ও একেশ্বরবাদ
-- ওল্ড টেস্টামেন্টের আলোকে বিশ্বের ধর্মবিশ্বাসীদের বড়ো অংশ একেশ্বরবাদে
বিশ্বাসী। পৃথিবীর অন্যতম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেমেটিক ধর্ম হিব্রু, খ্রিস্টান ও ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য হল একেশ্বরবাদ। ধারণাগত
মিল থেকে ধর্মতাত্ত্বিকগণ ধারণা করেন যে,
ইহুদি
ধর্মের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম ইত্যাদি ইব্রাহিমীয় ধর্ম। ইহুদি ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসাবে “ওল্ড টেস্টামেন্ট”-এর প্রথম পাঁচটি বইকে
গণ্য করা হয়, যেমন -- জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিটিকাস, নাম্বার্স এবং ডিউটেরোনমি। এই পাঁচটি বইকে একসঙ্গে
"তোরাহ"-ও বলা হয়ে থাকে। ইহুদি ধর্মবিশ্বাস মতে, ঈশ্বর এক। সেই
ঈশ্বরকে “জেহোবা” নামে আখ্যায়িত করা হয়।
ঈশ্বরের একজন বাণীবাহক হলেন মোজেস । ইসলাম
ও খ্রিস্টধর্মের মতোই ইহুদিগণ পূর্বতন সমস্ত বাণীবাহককে বিশ্বাস করেন। ইহুদিরা মনে
করেন মোজেসই সর্বশেষ বাণীবাহক। যদিও ইহুদিগণ জিশুকে ঈশ্বরের বাণীবাহক বা দূত
হিসাবে অস্বীকার করে, তা সত্ত্বেও
খ্রিস্টানরা ইহুদিদের সবগুলি ধর্মগ্রন্থ (ওল্ড টেস্টামেন্ট)-কে নিজেদের ধর্মগ্রন্থ
হিসাবে মান্য করে থাকেন। ইহুদি ধর্মকে
সেমেটিক ধর্মও বলা হয়। প্রায় চার হাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদি জনগণ এবং
ইহুদি ধর্মের সবচেয়ে লক্ষণীয় যে দিক,
তা হল
এই ধর্মের অভিযোজন এবং অবিচ্ছিন্নতা। প্রাচীন মিশর বা ব্যাবিলনিয়া সাম্রাজ্য থেকে
শুরু করে আধুনিক পশ্চিমা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী এবং আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর
সঙ্গে ইহুদিবাদকে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। প্রতিটি গোষ্ঠী এবং
মতাদর্শ থেকে বেশ কিছু জিনিস ইহুদি সমাজ-ধর্মীয় কাঠামোতে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যও কখনও ক্ষূণ্ন হয়নি। কোনো এক
যুগে যত অভিনবত্ব বা বিবর্তনই আসুক না-কেন ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে সবসময়ই প্রাচীনত্ব
বজায় রেখেছে ইহুদিরা।
ইহুদিদের মধ্যে অনেক শ্রেণি-উপশ্রেণি থাকলেও “ঈশ্বর এক” -- এই একটি বিষয়ে কারও
মধ্যে মতানৈক নেই। একেশ্বরবাদ প্রকৃতপক্ষে সার্বজনীন ধর্মের ধারণা দেয়, যদিও এর সঙ্গে কিছুটা স্বাতন্ত্র্যবাদ যুক্ত রয়েছে।
প্রাচীন ইজরায়েলে এই স্বাতন্ত্র্যবাদ নির্বাচনের রূপ নিয়েছিল। নির্বাচন বলতে
ঈশ্বর কর্তৃক মানুষের মধ্য থেকে কাউকে নিজের প্রতিনিধি হিসাবে মনোনীত করাকে
বোঝায়। সেই তখন থেকেই ইহুদিরা মনে করত,
ঈশ্বর ও
মানুষের মধ্যে একটি পূর্বপরিকল্পিত চুক্তিপত্র (কোভেন্যান্ট) থাকতে বাধ্য; সবাইকে এই চুক্তিপত্র মেনে চলতে হবে; না চললে পরকালে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ইহুদিদের এই
চিন্তাধারার সঙ্গে messianism-এর সুন্দর সমন্বয়
ঘটেছিল।
ইহুদিবিদ্বেষ বলতে ইহুদি, গোষ্ঠী বা ধর্মের প্রতি যেকোনো ধরনের বৈরিতা বা কুসংস্কারকে
বোঝানো হয়ে থাকে। এ ধরনের বিদ্বেষের মধ্যে ব্যক্তিগত ঘৃণা থেকে শুরু করে সংঘবদ্ধ
জাতিনিধনও পড়ে। ইংরেজিতে একে বলা হয় অ্যান্টি-সেমিটিজম, যার অর্থ দাঁড়ায় সেমিটিয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ। সেমিটীয়
একটি বৃহৎ ভাষাভাষী গোষ্ঠী, যার মধ্যে হিব্রুভাষী
ছাড়াও আরবি ভাষীরাও অন্তর্ভুক্ত। তথাপি অ্যান্টি-সেমিটিজম ইহুদিবিদ্বেষ বোঝাতেই
ব্যবহৃত হয়। উনিশ শতকের পূর্বে ইহুদি বিদ্বেষ ছিল মূলত ধর্মভিত্তিক। খ্রিস্টান ও
মুসলমানরা ইহুদি ধর্মের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণের
আলোকে এই বিদ্বেষভাব পোষণ করত। তৎকালীন খ্রিস্টানশাসিত ইউরোপে বৃহত্তম সংখ্যালঘু
ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে ইহুদিরা বিভিন্নসময় ধর্মীয় বিদ্বেষ, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হত। ধর্মীয় নির্যাতনের মধ্যে
ছিল ধর্ম পালনে বাধা, জোরপূর্বক
ধর্মান্তরকরণ, দেশ থেকে বিতাড়ন ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, যদিও ইহুদি ধর্ম আজ মৌলিক ধর্মীয় প্রথা থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে; তদুপরি বিশ্বব্যাপী ইহুদি ধর্মের পরিচয় পরিচিতি ও প্রভাব
প্রতিপত্তির কমতি নেই। ইহুদিদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বিভিন্ন দিক ও
বিভাগ ঐক্যতা ও সামঞ্জস্যতা রয়েছে। এ দুই ধর্মের মৌলিক বিষয়ে ঐক্য থাকার আহলি
কিতাব হিসাবে ইসলাম ধর্মে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা পৃথিবীর অন্য
ধর্মের চেয়ে বেশি। সেমেটিক ধর্মের মধ্যে এ তিনটি ধর্মের মিল ও ঐক্যতার কারণে
বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও হৃদ্যতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা সহজ।
(iii)
খ্রিস্টধর্ম : খ্রিস্টধর্ম হচ্ছে একেশ্বরবাদী ধর্ম। নাজারাথের জিশুর জীবন
ও শিক্ষাকে কেন্দ্র করে এই ধর্ম বিকশিত হয়েছে। খ্রিস্টানরা মনে করেন জিশুই মসিহ
এবং তাঁকে জিশুখ্রিস্ট বলে ডাকেন। খ্রিস্টধর্মের শিক্ষা নতুন টেস্টামেন্ট বা নতুন
বাইবেলে গ্রন্থিত হয়েছে। এই ধর্মাবলম্বীরা খ্রিস্টান পরিচিত। তারা বিশ্বাস করে যে
জিশুখ্রিস্ট হচ্ছেন ঈশ্বরের পুত্র।
খ্রিস্টধর্ম পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ধর্ম।
নজারেথের জিশু (হজরত ঈসা) ছিলেন এই ধর্মের প্রবর্তক। ৩০ বছর বয়সে জিশু সর্বপ্রথম
জনসাধারণের সম্মুখে আবির্ভুত হন এবং রাজা টিবিরিয়াসের রাজত্বকালে সিরিয়ার
অ্যান্টিয়ক নগরীতে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। এখানেই সেন্ট পল সর্বপ্রথম
জনসাধারণের কাছে জিশুর শিক্ষা প্রচার করতে আরম্ভ করেন। জিশুর অনুসারীদের প্রথমে “খ্রিস্টান” বলে কটুক্তি করা হত।
সেন্ট পলের প্রচেষ্টায় খ্রিস্টধর্ম এশিয়া মাইনর থেকে গ্রিক ও রোমে প্রসার লাভ করে।
রোমান সম্রাট নিরো ও ডায়াক্লিটিয়ানের বিরোধিতা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম দিকে দিকে
প্রসার লাভ করতে থাকে এবং রাষ্ট্রীয় আনুগত্য লাভে সমর্থ হয়। সম্রাট কনস্টানটাইন
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় রোমে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যের সূচনা
হয়। কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ আইনসম্মত বলে ঘোষণা করেন। তিনি খ্রিস্টধর্মকে
মর্যাদা দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২.১
বিলিয়ন খ্রিস্টধর্মের অনুসারী আছে। সে হিসাবে বর্তমানে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম।
ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা,
ফিলিপিন্স
দ্বীপপুঞ্জ ও ওশেনিয়া অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রধান ধর্ম হিসেবে পালিত হয়। প্রথম
শতাব্দীতে একটি ইহুদি ফেরকা হিসাবে এই ধর্মের আবির্ভাব। সঙ্গত কারণে ইহুদি ধর্মের
অনেক ধর্মীয় পুস্তক ও ইতিহাসকে এই ধর্মে গ্রহণ করা হয়েছে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ
তানাখ বা হিব্রু বাইবেলকে খ্রিস্টানরা পুরোনো বাইবেল বলে থাকে। ইহুদি ও ইসলাম
ধর্মের মতো খ্রিস্টধর্মও আব্রাহামীয়।
খ্রিস্টান ধর্মের উৎপত্তি থেকেই তারা ইহুদি
ধর্মীয়নেতাদের বিপক্ষে, কারণ তারা
খ্রিস্টধর্মের মূল নবিকে অস্বীকার করেন। ঈসা নবি সম্পর্কে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে
অনেক ভবিষ্যদ্বাণী থাকা সত্ত্বেও ইহুদিগণ ঈসা নবিকে তাদের ওয়াদাকৃত মসিহ হিসেবে
মেনে নেন না, যা কিনা তাদের মধ্যে অনেক
ইহুদি-খ্রিস্টান সংঘাতের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। ৪২০ সালে আধুনিক ইরাকের দক্ষিণের এক
পার্সিয়ান প্রদেশ খুজিস্তানের এক পারসিক মন্দিরে এক খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতা আগুন
ধরিয়ে দেয়। ধারণা করা হয় ওই চরমপন্থী নেতাকে ঘটনাস্থলেই নিরাপত্তা কর্মীরা মেরে
ফেলে। এই আত্মঘাতী হামলার পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন পার্সিয়ান
সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্ম, জুরাস্ট্রিয়ানইজমকে
একটি বড়ো রকমের আঘাত করা হয়। আর-এক খ্রিস্টান-যাজক আব্দাস সেই হামলায় সামিল ছিল, কিন্তু ঘটনার পর আত্মহত্যা করতে সে ব্যর্থ হয়। রক্ষীরা তাকে
গ্রেপ্তার করে তৎকালীন শাসক ইয়াজদেগার্দের সামনে নিয়ে আসে। ইয়াজদেগার্দ পারস্যের ত্রয়োদশ অধিপতি ছিলেন, যার শাসনকাল ছিল ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। নিজের শাসনকালের
প্রথনদিকে তিনি খ্রিস্টানদের প্রশ্রয় দিয়ে আসতেন। কিন্তু যখন তিনি তাদের
দুরভিসন্ধি বুঝতে পারেন ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই পারস্যে খ্রিস্টানরা
তাদের দখলদারিত্ব শুরু করে ক্রুসেডের মাধ্যমে। ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ বলতে যা
বোঝায় খ্রিস্টানরা এখানে সেটাই করেছিল। এরপর খ্রিস্টধর্ম প্রচার পায় আরও বৃহৎ
পরিসরে। এরপর দ্বিতীয় শতাব্দী পর মোহম্মদের মাধ্যমে ইসলামের জন্ম হয়। এবং এই
ইসলামের প্রসারে নবি ও তার অনুসারীরা এই ক্রুসেডের মতোই আর-একটি নীতি অনুসরণ করে
যাকে আমরা বলি জিহাদ। জিহাদ ও ক্রুসেড উভয়কেই বাংলায় বলা হয় “ধর্মযুদ্ধ”। কাজেই ধর্মের নামে “সন্ত্রাসবাদ” বলা যায় খ্রিস্টানরাই
শুরু করেছিল। এর আগে ইহুদিরা বা আর্যরা তাদের ধর্ম প্রচারে অস্ত্র ব্যবহার করলেও
এই ক্রুসেড বা জিহাদের মত এত পরিকল্পিত ও সংগঠিতভাবে আক্রমণ চালানোর মতো সৃজনশীলতা
তাদের মধ্যে ছিল না। কাজেই বলা যায় ধর্মীয় উন্মাদনা ও আগ্রাসন খ্রিস্টানদের
মাধ্যমেই শুরু হয়। যা আজও অব্যহত আছে। তবে এখন মূলত এটা জিহাদের আধুনিক প্রয়োগের
মাধ্যমেই টিকে আছে।
ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে বৃহৎ বিরোধ সংঘটিত
জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ইতিহাসে যাকে ‘ক্রুসেড’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পোপ আরবান
বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেক্সিস কোমনেনসের আবেদনে সাড়া দিয়ে পবিত্র ভূমি জেরুজালেমকে
মুসলিম সাম্রাজ্যের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য ‘প্রথম ক্রুসেড’-এর ডাক দেন। ‘Just War’ তত্ত্ব মূলত ক্রুসেডকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার জন্য
তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। ১২০০০০ ফ্র্যাঙ্ক বা ফ্রেঞ্চভাষী পশ্চিমা খ্রিস্টান
ক্রুসেডে অংশ নেয় এবং ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে চার্চ জেরুজালেমের দখল নেয়। তারা
মসজিদ-উল-মুকাদ্দাসকে চার্চে রূপান্তর করে। জেরুজালেম ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৩৭
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চার্চের অধীনে থাকে। তারা জেরুজালেম, এডেসা, এন্টিওক ও ত্রিপলি এই
চার ভাগে ক্রুসেড রাজ্যকে ভাগ করে। যদিও তারা লেবাননের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ারও চেষ্টা
করে, কিন্তু দামেস্কের শাসক জহির
আলদিন আতাবেকের কাছে পরাজিত হয়। ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দ ইমাদ আদদিন জেঙ্গি এডেসা দখল
করে। আর পুনরায় চার্চের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৪৯
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘দ্বিতীয় ক্রুসেড’ পরিচালিত হয়। ফরাসি রাজা সপ্তম লুইস ও পশ্চিম জার্মানীর
রাজা তৃতীয় কনরাড ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দে এডেসার উদ্দেশ্যে তার সেনাবাহিনী নিয়ে যাত্রা
শুরু করেন, কিন্তু জেঙ্গির কাছে পরাজিত
হয়। তবে এডেসায় ব্যর্থ তারা পর্তুগালের রাজা প্রথম আফনসোর সঙ্গে যৌথভাবে আক্রমণ
করে মুসলিমদের কাছ থেকে লিসবন দখল করে নেয়। তবে ক্রমান্বয়ে মুসলিম সাম্রাজ্য
শক্তিশালী হতে থাকে এবং ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে হাত্তিনের যুদ্ধে সালাউদ্দিন ইউসুফ ইবনে
আইউব চার্চের কাছ থেকে পুনরায় জেরুজালেমের দখল নেয়। তিনি ইহুদি ও অর্থোডক্স
খ্রিস্টানদের সঙ্গে সমঝোতায় আসেন এবং মসজিদমুকাদ্দাস পুনরাস্থাপন করেন। ১১৯২খ্রিস্টাব্দে
রিচার্ডের নেতৃত্বে ‘তৃতীয় ক্রুসেড’ পরিচালিত হয়, কিন্তু তারা
জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। তবে রিচার্ড ও সালাউদ্দিন রামলা চুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা
খ্রিস্টানদের জেরুজালেমে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার সুযোগ দেন। কিন্তু চার্চ থেমে
থাকেনি। ১২৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পবিত্র ভূমি পুনরুদ্ধারের নামে সর্বমোট ৯টি
ক্রুসেড সংঘঠিত হয়। আর ধর্মের নামে লক্ষাধিক মুসলমান ও ইহুদি হত্যা করা হয়। তবে
প্রায় সব ক-টি ক্রুসেডে পরাজিত হয় চার্চ। পরবর্তীতে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলীয়রা
আর ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে মামলুক সাম্রাজ্য জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ করে। তবে পূণ্যভূমির
নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান সেলিম, আলেপ্পো ও গাজার যুদ্ধে জেরুজালেমে মামলুক সাম্রাজ্যের পতন
ঘটান। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন বোনাপার্ড মিশর ও সিরিয়ার মাধ্যমে জেরুজালেম দখলের
চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে খ্রিস্টাব্দে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। আর ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে
শুরু হয় জিওনিস্ট বিদ্রোহ, যা ছিল মূলত ইসরায়েল
রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধ ইহুদি আন্দোলন। তবে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে যখন
হিটলারের নাৎসি বাহিনী ক্ষমতায় আসে, ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন
করতে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে নৃসংশতম হত্যাকাণ্ড, যা ইতিহাসে ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৭ মিলিয়ন ইহুদিকে
হত্যা করা হয়। ইহুদিদের হত্যার পিছনে অনেক ঐতিহাসিক হিটলারের ধর্মীয় অহংবোধকে দায়ী
করেন। ধারণা করা হয়, ইজরায়েলিদের মতো
হিটলারও ইন্দো-আর্য জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে বিশ্বাস করতেন এছাড়া ইহুদিদের প্রতি রোমান ক্যাথলিক চার্চের
বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবও তাকে প্রভাবিত করেছে বলে অনেকে মনে করেন। নিজ ধর্মের
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য হিটলার হয়তো ইহুদিদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেন, যদি-না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর কাছে তার পরাজয়
না ঘটত। আর দীর্ঘদিনের জিওনিস্ট বিদ্রোহের পর জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৪৭
খ্রিস্টাব্দে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ইসরায়েল
রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম মূলত বনি ইজরায়েল জাতিকে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিশ্রুত
পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে দিয়েছে। জেরুজালেমে ঐতিহাসিকভাবে ইহুদী, খ্রিস্টান ও পরবর্তীতে মুসলমান -- সবারই সহাবস্থান লক্ষণীয়।
তাই ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম অনেকেই জাতিসংঘের পক্ষপাতিত্ব বলে মনে করেন। তবে কেউ
কেউ মনে করেন যে, আপাতদৃষ্টিতে একটি
ধর্মযুদ্ধের অবসান ঘটালেও ভবিষ্যতে
মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম সাম্রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য পশ্চিমা শক্তির এক
ষড়যন্ত্র। আর এই বর্তমান সময়ে অনেকেই উক্ত ধারণার সত্যতা দেখতে পান। ধর্ম নিয়ে
সংঘাত হয়নি তা নয়। ইজরায়েল-ফিলিস্তানি দ্বন্দ্ব, ইরাকের শিয়াসুন্নি সংঘাত, আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, গুজরাটের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, রুয়ান্ডার-হুতোতুতসি সংঘাত, চেসনিয়া-বসনিয়া সংঘাত, তিব্বত-চিন দ্বন্দ্ব
কিংবা অতি সাম্প্রতিক মায়ানমারের রোহিঙ্গা-বৌদ্ধ দাঙ্গা ইত্যাদি বিভিন্ন সংঘাত
আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় ধর্মের নামে এখন পর্যন্ত কত নির্দোষ মানুষকে হত্যা
করা হয়েছে। আর খুব দ্রুতই যে, এর থেকে পরিত্রাণ
পাওয়া যাবেসে ব্যাপারেও অনেকে সন্দিহান।
(iv)
বাহাই ধর্ম : বাহাই ধর্ম হচ্ছে বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত
একেশ্বরবাদী একটি ধর্ম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পারস্যে (ইরান) বাহাই ধর্মের উৎপত্তি।
মূলত মানবজাতির আত্মিক ঐক্য হচ্ছে এই ধর্মের মূল ভিত্তি। বিশ্বে বর্তমানে ২০০-এর
বেশি দেশ ও অঞ্চলে এই ধর্মের আনুমানিক প্রায় ষাট লক্ষ অনুসারী আছে। বাহাই
ধর্মানুসারে ধর্মীয় ইতিহাস স্বর্গীয় দূতদের ধারাবাহিক আগমনের মাধ্যমে স্তরে
স্তরে সম্পন্ন হয়েছে। এইসব দূতদের প্রত্যেকে তাঁদের সময়কার মানুষদের সামর্থ্য ও
সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব স্বর্গীয় দূতদের মাঝে আছেন
ইব্রাহিম, গৌতম বুদ্ধ, জিশু, মোহাম্মদ ও
অন্যান্যরা। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিককালের বাব ও বাহাউল্লাহ। বাহাই ধর্ম মতে এসকল
দূতগণ প্রত্যেকেই তাঁদের পরবর্তী দূত আসার ব্যাপারে এবং তাঁদেরকে অনুসরণ করতে বলে
গেছেন। এবং বাহাউল্লার জীবন ও শিক্ষার মাধ্যমে দূতগণের এই ধারা ও পূববর্তী
ধর্মগ্রন্থগুলোর অঙ্গীকার সম্পূর্ণ হয়েছে। ‘বাহাই’ শব্দটি একটি বিশেষণ হিসাবে বাহাই ধর্মকে নির্দেশ করতে বা
বাহাউল্লার অনুসারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি উদ্ভূত হয়েছে আরবি ‘বাহা’ থেকে, যার অর্থ ‘মহিমা’ বা ‘উজ্জলদীপ্তি’। বাহাই শিক্ষা ও মতবাদের ভিত্তি তিনটি মূল নীতির উপর
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঈশ্বরের ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, এবং মানবজাতির ঐক্য।
এসকল স্বীকার্য থেকে এই বিশ্বাসটি অর্জিত হয় যে, ঈশ্বর নির্দিষ্ট সময় পর পর তাঁর ইচ্ছা স্বর্গীয় দূতদের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন।
আর এসকল দূতগণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতির চরিত্র পরিবর্তন ও উন্নয়ন। ধর্মের
ধারণাটি পরিবর্তিত হয়ে একটি নিয়মতান্ত্রিক,
একত্রীকৃত
ও বিকাশমান একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
বাহাইদের ধর্মীয় পুস্তকে ঈশ্বর হচ্ছেন ব্যক্তিগত, একক, সর্বজ্ঞ, অগম্য, অক্ষয়, সর্বব্যাপী, এবং অবিনশ্বর একটি সত্তা, যিনি বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। ঈশ্বরের ও মহাবিশ্বের উপস্থিতিকে
চিরকালব্যাপী মনে করা হয়, যার কোনো সূচনা বা
পরিণতি নেই। যদিও সরাসরিভাবে ঈশ্বরকে অনুভব করা সম্ভব নয়, তবে তাঁকে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে স্বজ্ঞা দ্বারা অনুভব করা
সম্ভব। আর এজন্য ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন, যা প্রকাশ পায় দূতগণের পরিভাষায় ঈশ্বরের সুস্পষ্টকরণের মাধ্যমে। বাহাই ধর্ম
বিশ্বের প্রায় সকল ধর্মের বৈধতায় বিশ্বাস করে, এবং সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিবর্গ হচ্ছে ঈশ্বরের
প্রতিনিধি। ধর্মীয় ইতিহাস হচ্ছে ধর্মগুলোর ধারাবাহিক বণ্টন।
বাহাইরা তাঁদের বর্তমান দূত বাহাউল্লাহর আবির্ভাবের
এক হাজার বছরের মধ্যে ঈশ্বরের আর কোনো দূতের আবির্ভাবে বিশ্বাস করে না। বাহাই
পুস্তক বলে প্রত্যেক মানুষের কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বও রয়েছে। যার মধ্যে আছে
ঈশ্বর কর্তৃক প্রবর্তিত দূতগণের মাধ্যমে ঈশ্বরকে চেনা ও তাঁদের প্রদত্ত শিক্ষাকে
গ্রহণ করা। বাহাই পুস্তক অনুসারে, এই পরিচয় ও
আনুগত্যের মাধ্যমে, এবং মানবতার জন্য কাজ
করা ও নিয়মিত প্রার্থনার ফলে মানুষ ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হতে থাকে। এটি বাহাই
বিশ্বাসের একটি আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। বাহাই ধর্ম অনুসারে মৃত্যুর পর কোনো পুরস্কার
বা শাস্তি প্রদানের বিধান নেই। তবে নীতিমালাগুলো বাহাই অনুশাসনের উল্লেখ করতে
গিয়ে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। এগুলো এসেছে বাহাই ধর্মগুরু আবদুল-বাহা’র বক্তৃতা থেকে। বাহাইদের প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান অনুসারে
১৯৮৬ সালে বিশ্বে বাহাই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ছিলো ৪০ লক্ষ ৭৪ হাজার, এবং বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৪%। বাহাই সূত্রমতে ১৯৯১ পর্যন্ত
সারা বিশ্বে বাহাই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ লক্ষেরও বেশি। ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান
এনসাইক্লোপিডিয়া, ২০০১ সালের এক জরিপে
প্রকাশ, ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বে
বাহাই অনুসারীর ছিল সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ ১০ হাজার, এবং ২১৮টি দেশে এদের অনুসারী রয়েছে। বাহাই ধর্মের উৎপত্তিস্থল পারস্য ও
উসমানীয় সাম্রাজ্য পেরিয়ে, বিশ শতকের দিকে
দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, ও উত্তর আমেরিকায় কিছু সংখ্যক ধর্মান্তরিত বাহাইয়ের
অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর দশকের মধ্যে বাহাই গোষ্ঠীর বড় ধরনের ধর্মীয়
প্রচারণার ফলে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে ও অঞ্চলে এই ধর্মের অনুসারীরা ছড়িয়ে
পড়েন। ১৯৯০-এর দশকে বাহাইরা নিজেদের মধ্যে একতা বাড়ানোর লক্ষ্যে
নিয়মতান্ত্রিকভাবে বড় ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ২১ শতকের
গোড়ার দিকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় অংকের মানুষ এ ধর্ম গ্রহণ করে।
বর্তমানে বাহাই ধর্ম ইরানের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়। জরিপ অনুসারে
বাহাই ধর্ম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বর্ধনশীল স্বাধীন ধর্ম। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে
এফপি ম্যাগাজিনের এক জরিপ অনুসারে বিশ্বে বাহাই ধর্মের অনুসারী বৃদ্ধির হার ১.৭%।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে বাহাইরা উপর্যুপরি
হয়রানি ও নানাবিধ প্রতিকূলতার শিকার হয়ে আসছে। কারণ মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বাহাই
ধর্মকে একটি স্বাধীন ধর্ম হিসাবে মানেন না। বাহাইদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো মাপের
হয়রানিগুলি সংগঠিত হয়েছে ধর্মটির উৎসভূমি ইরানে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৯৮
খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেখানে ২০০ জনেরও বেশি বাহাইকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
এছাড়া বাহাইদের ধর্মীয় অধিকার আরও অনেক দেশেই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মাঝে চালিত
হয়। সেসব দেশগুলি হল ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, মরক্কো এবং সাহারা সহ নিম্ন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ।
ভারতীয় ধর্মগুলি দেখব কে কোথায়। আগেই উল্লেখ
করেছি ভারতীয় ধর্মগুলি, সেগুলি হল -- জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শিখ ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মে ঈশ্বর বিশ্বাস নেই। আসলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে পার্থক্য
সামান্যই। জৈনধর্মকে
বৌদ্ধ ও তাওয়ের মিশ্রণ বলা যায়, যেমনটা শিখ ধর্মকে
হিন্দু ও সুফি বিশ্বাসের মিশ্রণ বলাটাই সঠিক।
(i)
জৈনধর্ম : জৈনধর্ম প্রাচীন ভারতে প্রবর্তিত একটি ধর্মমত। বর্তমানে বিশ্বের নানা দেশে এই
ধর্মমতাবলম্বীদের দেখা যায়। জৈনধর্মের মূল বক্তব্য হল, সকল জীবের প্রতি শান্তি ও অহিংসার পথ গ্রহণ। জৈন দর্শন ও
ধর্মানুশীলনের মূল কথা হল দৈব চৈতন্যের আধ্যাত্মিক সোপানে স্বচেষ্টায় আত্মার
উন্নতি। যে ব্যক্তি বা আত্মা অন্তরের শত্রুকে জয় করে সর্বোচ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হন
তাঁকে জিন (জিতেন্দ্রিয়) আখ্যা দেওয়া হয়। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলিতে জৈনধর্মকে
শ্রমণ ধর্ম বা নির্গ্রন্থদের ধর্মও বলা হয়েছে। কথিত আছে, তীর্থঙ্কর নামে চব্বিশ জন মহাজ্ঞানী কৃচ্ছ্বসাধকের একটি
ধারা পর্যায়ক্রমে জৈনধর্মকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ত্রাবিংশ তীর্থঙ্কর
ছিলেন পার্শ্বনাথ (খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দী) ও সর্বশেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন মহাবীর
(খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী)। আধুনিক বিশ্বে জৈনধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক
কম হলেও এই ধর্ম বেশ প্রভাবশালী। ভারতে জৈন ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ১০,২০০,০০০। এছাড়া উত্তর
আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও
বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে। জৈনধর্ম একসময়ে আদি ভারত উপমহাদেশে
একটি উল্লেখযোগ্য ধর্ম হলেও সমস্ত বাংলাদেশে তার প্রচার ও প্রসার ছিল না।
পশ্চিমবাংলার পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গে এই ধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল। তবে পশ্চিমবাংলায়
এই ধর্মের সাক্ষী হিসাবে মানভূম, সিংহভূম, বীরভূম ও বর্ধমান এ চারটি স্থানের নামই জৈনধর্মের
তীর্থাংকরদের নামের সঙ্গে জড়িত। জৈনপুরাণ মতে চব্বিশজন তীর্থাংকরের মধ্যে বিশজনেরই
নির্বাণ স্থান হাজারিবাগ জেলার পরেশনাথ পাহাড়ে।
প্রাচীন জৈন ধর্মগ্রন্থে উলেখ আছে যে, বর্ধমান মহাবীর রাঢ় প্রদেশে ধর্মপ্রচারে এসেছিলেন, কিন্তু সেখানকার লোকেরা মহাবীর এবং তার সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে
অসদ্ব্যবহার করেছিলেন। দিব্যাবদানে অশোকের সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। পুণ্ড্রবর্ধন
নগরীর জৈনগণ মহাবীরের চরণতলে পতিত বুদ্ধদেরেব চিত্র অঙ্কিত করেছে শুনে তিনি নাকি
পাটলিপুত্রের সমস্ত জৈনগণকে হত্যা করেছিলেন। সুতরাং অশোকের সময় পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে
জৈন-সম্প্রদায় বোধহয় ছিল না। তবে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে বঙ্গে যে জৈনধর্ম
দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধন, কোটীবর্ষ ও দক্ষিণবঙ্গে (তাম্রলিপ্তি) যে খুব প্রাচীনকাল
হতেই জৈনধর্ম প্রসার লাভ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আচার্য গৃহনন্দী সপ্তম
শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বৈশালী, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কলিঙ্গে
দিগম্বর নির্গ্রহ প্রচুর জৈন দেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন। সম্ভবত তিনি আজীবিক
সম্প্রদায়ের লোক দেখে জৈন মনে করে থাকতে পারেন। কারণ তখন দেশে প্রচুর সংখ্যক
আজীবিক ছিলেন; যারা আসনে-বসনে, পূজাপার্বণে জৈনদের মতই ছিল। ৬২৯-৬৪৫ সাল পর্যন্ত হিউয়েন
সাঙ ভারত ভ্রমণ করেন। বাংলা ভ্রমণ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, তাঁর সময়ে বাংলায় দিগম্বর জৈনের সংখ্যা খুব বেশি ছিল।
কিন্তু তার পরই বাংলায় জৈনধর্মের প্রভাব হ্রাস হয়। পাল ও সেনরাজগণের তাম্রশাসনে এই
সম্প্রদায়ের কোনো উল্লেখ নেই। তবে এটি যে একেবারে লুপ্ত হয় নি, প্রাচীন জৈনমূর্তি হতেই তা প্রমাণিত হয়। জৈনরা এদেশ ও দেশের
মানুষ সম্পর্কে অনেক বেশি খবরাখবর রাখত এবং অত্যন্ত সতর্কভাবে ধর্মপ্রচার ও
জীবনযাপন করত। জৈন ধর্মগ্রন্থ ভগবতী সূত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জৈন ধর্মের
বিকাশ ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও হয় নি। ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে জৈন ধর্মের মানুষেরা সংখ্যায়
অনেক। ভারতের বাইরে জৈন ধর্ম পা রাখতে না পারলেও ভারতের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের
মধ্যে জৈন ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল।
জৈনমাত্রেই নিরীশ্বরবাদী। জৈন ধর্মগ্রন্থের
লেখকেরা ঈশ্বর ধারণাকে খণ্ডন করেছিলেন। জৈনরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না
বটে, কিন্তু দেবতায় বিশ্বাস করে।
জৈন ধর্মে দেবতা ও ঈশ্বরের সংজ্ঞায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। জৈনরা গুণের প্রতীককে
'দেবতা' বলে। দেবতার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। পার্থিব কোনো কিছু
দেওয়ার ক্ষমতা নেই। মানুষ সাধনার মধ্য দিয়ে ‘দেবতা’ হতে পারে। তারা মনে করেন, সাধনা ও জ্ঞানার্জনের ফল হিসাবে পরজন্মে মানুষ ‘দেবতা’ হওয়া যায়। এই
দেবতারা জন্ম-মৃত্যুর অধীন। দেবতা জন্মে খারাপ কাজ করলে পরজন্মে কীট হয়ে জন্মাতে
হবে। অর্থাৎ জৈনরা পরজন্মে বিশ্বাসী। অজ্ঞাতসারে একটি পোকাকে হত্যা করলেও তা পাপ।
জৈনদের অনেকেই এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখে, যাতে কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী নাকে-মুখে ঢুকে মারা না
যায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি-জমিজমা কেনা জৈনধর্মে নিষিদ্ধ। জমিজমা কিনে শ্রমজীবীদের
দিয়ে চাষবাস করে আয়ের পথও ছিল বন্ধ। ফলে জৈনধর্মে দীক্ষিতরা ব্যবসার দিকে আকৃষ্ট
হয়েছিল।
মহাবীরের দিগম্বর মতবাদ : জৈন ধর্মের দুটি
ভাগ। একটি শ্বেতাম্বর, দ্বিতীয়টি দিগম্বর। প্রথম তীর্থঙ্করের
নাম ঋষভ বা আদিনাথ। পরবর্তী তীর্থঙ্কররা হলেন : অর্জিত, সম্ভব, অভিনন্দ, সুমতি, পদ্মপ্রভ, সুপার্শ্ব, চন্দ্রপ্রভ, সুবিধি, শীতল, শ্রেয়াংশ, বসুপুজ্য, বিমল, অনন্ত, ধর্ম, শান্তি, কুন্থ, আর, মল্লি, মুনিসুব্রত, নমি, অরিষ্টনেমি, পার্শ্ব বা পার্শ্বনাথ অথবা পরেশনাথ ও মহাবীর। মহাবীর হলেন
চব্বিশতম তীর্থঙ্কর। চব্বিশতম
তীর্থংকর মহাবীর জৈনদের দিগম্বর সম্প্রদায়ের স্রষ্টা। নগ্নতাবাদী মহাবীরের জন্মও
আনুমানিক ৫৯৯ বা ৫৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। জৈন শ্বেতাম্বরপন্থীদের মতে মহাবীরের
একটিই মেয়ে -- অনুজা।
মহাবীর দীর্ঘ বারো বছরের পরিব্রাজক জীবনে তিনি
মগ্ন হয়ে শীত-গ্রীষ্মের তাপের কষ্ট পেয়েছেন। নগ্নতার কারণে ভিক্ষেও জোটেনি।
দীর্ঘ দিন কেটেছে অনশনে, মানুষের ও কুকুরের
তারা খেয়ে। জৈনরা মনে করেন, শরীরকে এমনভাবে কষ্ট
দেওয়ার কারণ, মহাবীর এই সময় মনে করতেন
দুঃখভোগই পাপস্খলন এবং মুক্তির উপায়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে উপদেশ প্রচার করে বেরিয়েছিলেন।
৮৪ বছর বয়সে তিনি পাবা'য় (বর্তমান
গোরক্ষপুর) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মহাবীর বৈদিক যুগের সমসাময়িক ছিলেন। বেদকে
অভ্রান্ত মনে করতেন না। তিনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী নাস্তিক, অলৌকিকে অবিশ্বাসী,
নিয়তিবাদে
অবিশ্বাসী। মহাবীর 'পঞ্চব্রত' বা পাঁচটি নীতির কথা বলেছিলেন। চতুর্যামের চারটি নীতির
সঙ্গে একটি নতুন নীতি যুক্ত করেছিলেন। নীতিটি হল ব্রহ্মচর্য। 'ব্রহ্মচর্য' বলতে শুধু সহবাস থেকে
বিরত থাকা বোঝায় না, সমস্ত ইন্দ্রিয়ভোগ
থেকে বিরত থাকা বোঝায়। দিগম্বরপন্থীরা মনে করেন, তীর্থঙ্কররা প্রত্যেকেই পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েই জ্ঞানের সাধনা
করেছিলেন। জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সুতরাং তীর্থঙ্করদের ছবি আঁকতে হলে নগ্নই আঁকতে
হবে। মূর্তি খোদিত হলে, তা হবে নগ্ন। কাপড়
পরিয়ে সভ্য সাজানোর প্রয়াস মিথ্যাকে সত্যি বলে প্রচার ছাড়া কিছু নয়।
জৈনধর্ম মহাবীরের সময় দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়
-- ১. দিগম্বর ও ২. শ্বেতাম্বর। জৈনদের এই
দুটি ভাগ আবার পরবর্তীকালে আরও কিছু উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। শ্বেতাম্বররা
তিনটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত -- মূর্তিপূজক,
থেরপন্থী
ও স্থানকবাসী। উত্তরভারতে শ্বেতাম্বরদের প্রাধান্য রয়েছে। দিগম্বররা পাঁচটি
উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এরা হল বিসপন্থী,
থেরপন্থী, তোতাপন্থী, তারণপন্থী এবং
গুনামপন্থী। দক্ষিণভারতে এদেরই প্রাধান্য। ভারতে সামগ্রিকভাবে শ্বেতাম্বরপন্থীদেরই স্পষ্ট প্রাধান্য
রয়েছে। শ্বেতাম্বররা মনে করেন জৈন ধর্মের বারোটি প্রাচীন 'অঙ্গ' গ্রন্থ আছে। এই
বারোটি অঙ্গ নামের গ্রন্থ ছাড়াও 'উপাঙ্গ' নামে আরও বারোটি ধর্মগ্রন্থ আছে। অঙ্গ ও উপাঙ্গ ছাড়াও আরও
কিছু গ্রন্থকে শ্বেতাম্বররা জৈন ধর্মের অন্তর্গত বলে মনে করেন। দিগম্বররা শরীরে
কোনো কাপড় রাখেন না। তারা নগ্নতাবাদী ও প্রকৃতিবাদী। শ্বেতাম্বররা সাদা কাপড়
পরেন।
বৈদিক যুগের পুরোহিত সম্প্রদায়ের তীব্র ক্ষোভ
দিগম্বরদের উপর ছিল। ঈশ্বর নেই -- মানে ঈশ্বর উপাসনা, যাগ-যজ্ঞ, হোম, বলি, পুরোহিতদের প্রণামী
দেওয়া সবই অর্থহীন। এতো দস্তুরমতো বৈদিক পুরোহিতদের অস্তিত্বের সংকট ! এই সংকট
কাটাতে পুরোহিতরা নিরীশ্বরবাদীদের উপর খড়্গহস্ত ছিলেন। এমনকী নিরীশ্বরবাদীদের
ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করতে আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন হাতে।
সপ্তম থেকে দশম শতকে জৈন ধর্মে দেখা দেয় ভাটার
টান। শেষপর্যন্ত জৈন ধর্ম টিকে রইল কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে -- যাদের
মধ্যে সিংহভাগই গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও
মধ্যপ্রদেশবাসী। জৈনরা প্রাচীন শ্রমণ,
অর্থাৎ
কৃচ্ছ্বসাধনার ধর্মকে আজও বহন করে নিয়ে চলেছেন। ভারতের অপরাপর ধর্মমত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব বিশেষভাবে
লক্ষিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিদানের একটি প্রাচীন প্রথা জৈনদের মধ্যে আজও
বিদ্যমান। ভারতে এই সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার অত্যন্ত উচ্চ। শুধু তাই নয়, জৈন গ্রন্থাগারগুলি দেশের প্রাচীনতম গ্রন্থাগার হিসাবে
খ্যাতি আছে।
(ii)
বৌদ্ধধর্ম : বৌদ্ধ ধর্ম বা ধর্ম (পালি ভাষায় ধম্ম) গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক
প্রচারিত একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং জীবনদর্শন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে
গৌতম বুদ্ধের জন্ম। বুদ্বের পরিনির্বাণের পরে ভারতীয় উপমহাদেশ সহ এশিয়ার বিভিন্ন
অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার হয়। বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি প্রধান মতবাদে বিভক্ত। প্রধান
অংশটি হচ্ছে হীনযান বা থেরবাদ মহাযান নামে
পরিচিত। বজ্রযান বা তান্ত্রিক মতবাদটি মহাযানের একটি অংশ। শ্রীলংকা, ভারত, ভুটান, নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, চিন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ও কোরিয়াসহ পূর্ব ও
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বাস করেন।
বৌদ্ধ মতবাদ বলতে যেসব বাজারে চলতি বই আছে তাতে
বৌদ্ধত্বের চেয়ে হিন্দুত্বের প্রভাব প্রবল। যে বুদ্ধ নিরীশ্বরবাদী, কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী -- সেই বুদ্ধকে দেবতা বানিয়ে
ছাড়তে কেউই প্রায় কসুর করেননি। পালি ভাষায় বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে প্রথম লেখা হয় তাও
বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েক শত বছর পরে। তখন আদি বৌদ্ধ ধর্মের রূপান্তর ও বিভাজন
হয়েছে। পালি বৌদ্ধশাস্ত্রে আমরা পেলাম পল্লবিত, অলৌকিকে ভরা বুদ্ধকে।
বুদ্ধ বার্ধক্য, রোগ ও মৃত্যু দেখে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পান। এই দুঃখময় জীবন থেকে পরিত্রাণের
উপায় খূঁজতে সংসার ছেড়ে পথে বেড়িয়ে পরেন। গৌতম 'বুদ্ধ' হবার পর নারীদেরকেও দীক্ষা
দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ধনী মহিলা বিশাখা যেমন বুদ্ধের গৃহীশিষ্যা ছিলেন, তেমন বিমাতা গৌতমীও সঙ্ঘের সদস্যা হন। গৌতম নিরঞ্জনা নদীর
তীরে এক বটগাছের তলায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। জীবন ও জগৎ রহস্য নিয়ে তিনি
নতুন বোধ বা উপলব্ধিতে পৌঁছলেন। নিজের দুঃখময় জীবন থেকে নির্বান লাভ করে বুদ্ধ
হলেন। আত্মনিগ্রহ থেকে বিচ্যুত দেখে যে পাঁচ সঙ্গী বুদ্ধের সঙ্গ ত্যাগ করেছিল, তাঁদের সন্ধানে তিনি সারনাথে গেলেন। সেখানে সঙ্গীদের পেয়ে
তাঁদের সামনে নিজের নতুন পাওয়া 'বোধ' বিষয়ে বক্তব্য রাখলেন। এই বক্তব্য বা ভাষণ বৌদ্ধ ধর্মীয়
সম্প্রদায়ের কাছে 'ধর্মচক্র-প্রবর্তন' হিসাবে খ্যাত। এই পাঁচ শিষ্যকে নিয়ে বৌদ্ধ সঙ্ঘের সূচনা।
বুদ্ধের উপদেশাবলি বুঝতে হলে বুদ্ধের মূল চার
সিদ্ধান্ত জানাটা খুবই জরুরি। সিদ্ধান্তগুলো হল –- (১) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা। (২) আত্মাকে 'নিত্য' স্বীকার না করা। (৩)
কোনো গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা। (৪) জীবন প্রবাহকে স্বীকার করা।
তাঁর মতে, “জগতের সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক
নিয়মে। জগৎ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রকৃতি জগতের স্বাভাবিক নিয়ম দ্বারা”। কেউ কেউ মনে করেন,
ঈশ্বর
জগতের স্রষ্টা, যেমন কুম্ভকার মৃতপাত্রের
স্রষ্টা। ঈশ্বর সর্বব্যাপী। ঈশ্বর স্রষ্টা হলে তিনি কুম্ভকারের মতো মাটি ও
মৃতপাত্র হতে পৃথক। ঈশ্বর যদি তাঁর সৃষ্টি থেকে পৃথক হন, তবে তিনি সর্বব্যাপ্ত হতে পারেন না। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান
হন, তাঁর ইচ্ছাতেই যদি মানুষের
কাজ-কর্ম নির্ধারিত হয়, তবে অসৎ কাজের জন্য
মানুষ কেন দায়ী হবে ? মনুষ্য জগতের বাইরের
অন্যান্য প্রাণী, যাদের ভাল-মন্দ
বিচার-বোধ নেই, তাদের কাজ-কর্মের জন্য ঈশ্বর
কীভাবে তাদের দায়ী করবে ? পৃথিবীতে সুখের চেয়ে
দুঃখের পরিমাণ বেশি। তবে কি ঈশ্বর যতটা দয়ালু, তারচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর ? বুদ্ধের কথায়, 'আমাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ তৃষ্ণা ও অবিদ্যা। দুঃখ ঈশ্বরের
রুষ্টতা থেকে আসে না। ঈশ্বর মানুষের মনোজগতের কল্পনা।' ঈশ্বর যখন অস্তিত্বহীন, তখন ঈশ্বরের দৈববাণী নিয়ে বা ঈশ্বরের কথা নিয়ে ধর্মগ্রন্থ গড়ে উঠেছে, এমন তত্ত্বকে স্বীকার করা যায় না। আড়াই হাজার বছর আগে
ধর্মগ্রন্থগুলোর স্বতঃপ্রমাণ অস্বীকার করেছিলেন বুদ্ধ। আড়াই হাজার বছর আগে একজন
বুঝেছিলেন, কোনো ধর্মগ্রন্থই স্বতঃপ্রমাণ
নয়, ঈশ্বর সৃষ্ট নয়। আড়াই হাজার
বছর পরে আমরা একটুও না এগিয়ে আরো পিছিয়ে পড়েছি। 'আমরা' মানে সিংহভাগ তথাকথিত
শিক্ষিতরা। কী বিশাল যুক্তিমনস্কতার পরিচয় তিনি সেই সময়ে দিয়েছিলেন, ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। কোনো ধর্মগ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ
বলে মেনে নেওয়ার অর্থ, ওই গ্রন্থে লেখা কোনো
বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কেড়ে নেয়া। জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে অগ্রগতির যে
বিবর্তন আসে, তাকে রোধ করা। যদি গ্যালিলিও
বাইবেলের কথাকে স্বতঃপ্রমাণ বলে মেনে নিতেন,
তবে
তাঁর কাছে পৃথিবী গোল না-হয়ে চ্যাপটাই থাকত।
ত্রিপিটক : বুদ্ধ নিজে কোনো
গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর মৃত্যুর পরে কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তিনটি 'পিটক' রচনা করেছিলেন।
তিনটির একত্রিত নাম ত্রিপিটক। পিটক তিনটি হল – (১) বিনয়পিটক : এতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আচরণ সঙ্ক্রান্তকিছু নির্দেশ আছে। (২)
সূত্তপিটক : এতে আছে বুদ্ধের জাতক কাহ্নী। এর আবার পাঁচটি ভাগ- (ক) দীর্ঘনিকায়, (খ) মঝ্ঝিম নিকায়,
(গ)
সংযুক্ত নিকায়, (ঘ) অঙ্গুত্তর নিকায়
ও (ঙ) খুদ্দক নিকায়। (৩) অভিধম্মপিটক : এতে আছে দার্শনিক আলোচনা।
একসময় প্রাচীনপন্থীরা সাতটি উপদলে ভাগ হয়ে
যায়। মহাযানপন্থীরাও তাদের বিভাজন ঠেকাতে পারেননি। তারা আঠারোটি সম্প্রদায়ে ভাগ
হয়ে যায়। হীনযানপন্থীরা রইলেন বুদ্ধের নীতি নিয়ে। মহাযানপন্থীরা আবদ্ধ রইলেন
বুদ্ধকে ঈশ্বর বানিয়ে পুজো করার মধ্যে। সঙ্গে যুক্ত করলেন তন্ত্র-সাধনা।
মহাযানপন্থীদের হাতে শুরু হল বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয়। মহাযানপন্থীদের বৌদ্ধতন্ত্র অনুসারে
দীর্ঘস্থায়ী মৈথুনের মধ্যেই শুধু পাওয়া যায় অপার আনন্দ অনুভূতি, তখন সমস্ত মানসিক ক্রিয়া হারিয়ে ফেলে মানুষ। মিলনের এই
অপার আনন্দই হচ্ছে 'নির্বাণ'।
ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে যাদের শূদ্র বলে ঘোষণা করা
হয়েছিল, বৌদ্ধ গ্রন্থে তারাই চণ্ডাল, নেসাদ, পুক্কুস নামে পরিচিত।
পরিচয় পাল্টালেও ধনী মহাজনদের উৎপীড়ন একই রইল। বুদ্ধের যুগেই বণিকশ্রেণী জাতে
ওঠে। তাদের রমরমা বাড়ে। বৈদিক যুগে বা ব্রাহ্মণদের বোলবোলাওয়ের যুগে বণিক বা
শ্রেষ্ঠী শ্রেণীকে 'বৈশ্য' বলা হত। তারা ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক।
বুদ্ধ এই উঠে আসা নতুন শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে যে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে 'বুদ্ধ সুত্তনিপাত' গ্রন্থে। মুক্তির উপায় হিসেবে পালিয়ে যাওয়াকে অন্যায়
ঘোষণা করা হয়েছে। বুদ্ধের পশু হত্যার বিরোধিতা বণিকশ্রেণির স্বার্থকেই রক্ষা
করেছিল। কারণ ওই সময় সম্পদ হিসাবে পশুকে গণ্য করা হত। বৌদ্ধধর্ম হয়ে পড়েছিল
রাজধর্ম, উচ্ছবর্ণের ও উচ্চবিত্তের
ধর্ম। যদিও একথা ঠিক, শোষিত শূদ্ররাও বৌদ্ধ
ধর্মকে গ্রহণ করে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিল। কোন সময়ে বুদ্ধ এসেছিলেন ? একটু ফিরে দেখা যাক। সে সময় রাজশক্তি ছিল ভয়ংকর নিষ্ঠূর, উশৃঙ্খল, খামখেয়ালী চেহারার।
কোশল রাজশক্তি বুদ্ধের চোখের সামনেই তাঁর জাতিগোষ্ঠী শাক্যদের নির্বিশেষে হত্যা
করেছে। শিশু-নারী-বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি।বুদ্ধের চোখের সামনেই মগধরাজ অজাতশত্রুর
আক্রমণে বিদেহ, জ্ঞাতৃক, লিচ্ছবি ও বৃজি উপজাতিরা ধ্বংস হয়ে গেল। এমন এক ভয়ংকর, ভয়াবহ সময়ে গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর জৈনের আবির্ভাব।
ভারতের ইতিহাসে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব আকস্মিক
কোনো ঘটনা নয়। বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি ভারতবর্ষে। কিন্তু কেন সেই ধর্মের বিলুপ্ত
হয়েছিল ভারত থেকে ? কেনই-বা নাস্তিক
বুদ্ধের কপালে দেওয়া হল ভগবানের টিকা -- সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বৌদ্ধপণ্ডিত
রাহুল সাংকৃত্যায়ন। উনার “ভারত মে বৌদ্ধ ধরমাকা
উত্তান ঔর পতন” নামক পুস্তিকায়। রাহুল
সাংকৃত্যায়ন মতে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের মূল বিলোপ সাধন হয়েছে চতুর্দশ শতকে, তবে সে কারণটি ছিল বুদ্ধের মৃত্যুর পর থেকে। তাই সময়ের কালক্রমে
সিদ্ধার্থ গৌতমের নামের পূর্বে ‘ভগবান’ যোগ হয়ে হয়েছে,
ভগবান
গৌতম বুদ্ধ। বৈদিক
যুগের পর সুত্র যুগ হতে সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন নতুন ধর্ম বিপ্লবের
ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কাঠামো ও ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক মানসে এর
প্রাসঙ্গিকতা সহজেই এ ধর্মকে গোটা ভারতে জনপ্রিয় করে ফেলে। প্রশ্ন হচ্ছে গোটা
ভারতবর্ষ জুড়ে যে ধর্মের ছিল জয়জয়কার সেই জন্মভূমি ভারতবর্ষ হতে বৌদ্ধধর্ম
বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ কি ?
এ
বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ বেশ কিছু কারণ দাঁড় করিয়েছেন। কারও মতে, তুর্কি আক্রমণের ফলে বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তি ঘটে। যুক্তিটি
অযৌক্তিক কেননা তুর্কি আক্রমণের ফলে কেবল মাত্র বৌদ্ধ ধর্মেরই বিলুপ্তি ঘটবে কেন ? অন্য ধর্মের বেলায় তো তা ঘটেনি। তা ছাড়া তুর্কি আক্রমণের
আগে থেকে ভারতে বৌদ্ধধর্মের শিকড় আলগা হতে শুরু করে। তবে তুর্কি আক্রমণের ফলে
বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তির ধারা দ্রুততর হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অনেকে মনে করেন, বৌদ্ধ বিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ইখতিয়ার-উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি মনে করেছিলেন দুর্গ এবং বৌদ্ধভিক্ষুদের
পর্তুগিজ সৈন্য মনে করেছিলেন। ফলে প্রচুর বিহার সংঘ ও বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসস্তূপে
পরিণত হয়। বৌদ্ধরা ভীত হয়ে পড়ে। যেহেতু বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার অনেকটা
বৌদ্ধভিক্ষু সংঘের উপর নির্ভর করে, সেইহেতু বৌদ্ধভিক্ষু সংঘ বিতাড়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। এছাড়া তুর্কি আক্রমণে তাঁদের উপর জনগণের আস্থা
বিনষ্ট হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে অধিকাংশ লোক হয় হিন্দু, না হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ ছাড়াও বৌদ্ধধর্মের উপর
হিন্দুরাজাদের অত্যাচার, বৌদ্ধধর্মের ভিতরকার
বিভক্তিও এর কারণ হিসাবে ধরা হয়। তবে অনেকেই এসব কারণকে বাহ্যিক বা অন্যতম কারণ হিসাবে
বিবেচনা করা গেলেও মূল কারণ বলে মনে করে না । বৌদ্ধশাস্ত্রের বিশিষ্ট পণ্ডিত
টি.ডব্লিউ. রিজ মন্তব্য করেছেন, “গৌতমবুদ্ধ হিন্দু
হিসাবেই জন্মেছিলেন এবং হিন্দু হিসাবেই মারা গিয়েছিলেন। তাঁর মতবাদ হিন্দু
ঐতিহ্যেরই অন্তর্গত”। হিন্দু এবং
বৌদ্ধধর্মের অভিন্নতা, ভারতীয় সমাজ ও
সংস্কৃতির সঠিক স্বরূপ বিশ্লেষণে বলা চলে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের ঠিক বিলুপ্তি
হয়নি, সর্বভারতীয় হিন্দু ধর্ম ও
সংস্কৃতিতে ধর্মটি মিশে গেছে মাত্র। স্যার যদুনাথ সরকার ও মৌলিক বৌদ্ধ ধর্মকে
হিন্দুধর্মের এক নব রূপায়ণ বলে মনে করেন । হিন্দুদের মূর্তিপুজো, সন্ন্যাসীদের মঠ,
আধুনিক
রামকৃষ্ণ মিশন, গেরুয়া রং, আমাদের বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কুষাণ
বংশের রাজা কনিষ্কের সময় তৈরি হয় বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণের কাহিনি। সেইসময়
নির্ভেজাল মানবসন্তান বুদ্ধকে বসানো হয় ভগবানের আসনে। বুদ্ধের মূল দর্শনে আনা হয়
দেবতা এবং মিথের সমষ্টি। বুদ্ধের দর্শন বিকৃতিতে যোগ হল স্বর্গ-নরক, জাতক, বুদ্ধের জন্ম মৃত্যু
নানা কাহিনি নিয়ে হাজারো মিথ। তৎকালীন মানুষ ধ্যান-সাধনা পরিত্যাগ করে জামজমকভাবে
বুদ্ধের পুজোয় লিপ্ত হলেন। বৌদ্ধদর্শনে ভারত থেকে হিন্দুত্বের প্রভাব ঢুকে পরে।
যে কারণে বৌদ্ধদর্শনে হিন্দুধর্মের এবং স্বর্গ-নরকের বর্ণনা পাওয়া যায়।
মুক্তমনার প্রাবন্ধিক চিন্তিত সৈকত লিখেছেন, “ভারতীয় জনগণ যখন অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছিল, তখন ব্রাহ্মণরা শত বছরের নানা জাতিকে টুকরো টুকরো করে নানা
কলহের সৃষ্টি করে। এমন সময় পশ্চিম দেশীয় লোকেরা আক্রমণ শুরু করলেন, কারণ বৌদ্ধ বিহারগুলিতে ছিল রাজা শ্রেষ্ঠীদের দান করা অপার
ধনরাশি। শুধু ধনরাশি লুঠ করে তারা ক্ষান্ত হয়নি, ধ্বংস করেছে হাজার হাজার বৌদ্ধমূর্তি সহ নানা দেবদেবীর মূর্তি। সব থেকে
হাস্যকর বিষয় হচ্ছে এই সময় একদল তান্ত্রিক ভিক্ষু নিজেদের রক্ষা করার জন্য নানা
তন্ত্রমন্ত্রের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে আক্রমণকারীদের কিছুই হল না। মোহাম্মদ
বিন বক্তিয়ার মাত্র দুইশ সেনা দিয়ে উত্তর ভারত জয় করেছিলেন। নালান্দার নানা
বিহার মূর্তি টুকরো টুকরো করা হল। শত শত বৌদ্ধ ভিক্ষুকে শিরচ্ছেদ করা হয়
বক্তিয়ারের নেতৃত্বে। শত শত শিল্পকলার ধ্বংস হয়েছিল, এতে ধীরে ধীরে মানুষের বিশ্বাস উঠতে থাকে বৌদ্ধধর্ম থেকে।………… তুর্কিদের ভারতে আগমনে বিশাল ক্ষতি হয়েছিল
বৌদ্ধধর্মের। তুর্কিবীরেরা বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ উভয়ের মন্দির ধ্বংস করেছিল। গণহত্যা করেছিল
পুরোহিত ভিক্ষুদের। প্রশ্ন থাকতে পারে,
কী কারণ
আছে ভারতে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ আছে ? উত্তর হবে, ব্রাহ্মণ্যধর্মে
গ্রহন্ত এবং ধর্মের পরিচালক হতে পারে। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষুদের উপর গ্রহন্ত
রক্ষণাবেক্ষণের ভার ন্যস্ত। ভিক্ষুদের চিবরের কারণে খুব সহজেই চিহ্নিত হতেন। আবার
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অনেকেই তথাকথিত তন্ত্র-মন্ত্র এবং দেবতার অদ্ভুত শক্তিতে বিশ্বাসী
ছিলেন। তুর্কিদের তলোয়ারের শক্তিতে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই অপবিশ্বাস। জনসাধারণ
বুঝতে পারে, তাঁরা এতদিন মিথ্যের আশ্রয়ে
ছিল। এরপরেও কিছু বৌদ্ধভিক্ষু পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও অর্থাভাবে
তা আর সম্ভব হয় নি। কিন্তু অন্যদিকে ব্রাহ্মণরা নিজেদের কৃতিত্বের কারণে
নিজেদেরকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন। লামা এবং তারনাথের ইতিহাস থেকে জানা
যায়, দ্বাদশ শতকে নালান্দা
অদন্তপুরী, জেতবন ইত্যাদি বৌদ্ধ
তীর্থস্থান ধ্বংস করায় ভিক্ষুকেরা প্রাণ ভয়ে পালায়ন করে তিব্বত, নেপাল এবং অন্যান্য স্থানে চলে যান। সব থেকে মজার বিষয়
বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের মধ্যে সে সময় পৃথক কোনো জাতি বিভেদ ছিল না। একই ঘরে
ব্রাহ্মণধর্মী এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী উভয় ছিল। রক্তের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল
ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধের মধ্যে। কিন্তু একসময় দেখা যায় বৌদ্ধেরা নিচু জাত বলে অন্য
ধর্মাবলম্বীরা ভয় দেখাতে থাকে। সে সময়ের বৌদ্ধরাও হয় ভীতিতে নয় আকর্ষণে দু-এক
শতাব্দীতে হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্যধর্মী, নয়তো মুসলমান। কেউ
কেউ মনে করেন,বৌদ্ধধর্মের প্রধান
প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ব্রাহ্মণ্য-সনাতন ধর্ম,
ইসলাম
ঠিক ততটা নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাধারণ মানুষকে ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্যাতন মুখ
বুজে সহ্য করতে হয়। অন্ধকারের পর যেমন আলো দেখা যায়, গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে অনুরূপ নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা সংবলিত সমাজে
নির্যাতন বিরোধী প্রতিরোধ শক্তির অভ্যুদয় হয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে নিপীড়নমূলক
ব্যবস্থার ধারক ব্রাহ্মণ্য সমাজে জন্ম নেয় গৌতম বুদ্ধ। পর্যায়ক্রমে বৌদ্ধবাদ
সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে শোষণ ও বিবর্তনমূলক সমাজকাঠামোর ধারক
কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তি তাদের প্রভুত্ব হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ
এশিয়ায় মানবিক বিপ্লব প্রতিহত করার জন্য বৌদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়।
বৌদ্ধদের ধর্মবিরোধী নাস্তিক এবং বিদ্রোহী শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে বৌদ্ধ-বিরোধী
উন্মাদনা সৃষ্টি করে বৌদ্ধদের উৎখাতে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা।
গতিশীল বৌদ্ধবাদ যখন জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করল তখন থেকে শরু হল
ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে বৌদ্ধবাদের বিরোধ। সংঘাত ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠল।
উভয় পক্ষই পরস্পরকে গ্রাস করতে উদ্যত হল। হিন্দুরা তাদের রাজশক্তির আনুকূল্য নিয়ে
বৌদ্ধদের উৎখাতের প্রাণান্ত প্রয়াস অব্যাহত রাখে।
প্রাবন্ধিক এম কে আনিমুল হক লিখেছেন, “উপমহাদেশের বৌদ্ধবাদের উৎখাতের পর বহিরাগত আর্য অর্থাৎ
ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এখানকার মূল অধিবাসীদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম
হলেও অপরাজেয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের উপস্থিতি তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়।
মুসলমানরা বহিরাগত ব্রাহ্মণ-সৃষ্ট বর্ণবাদের শিকার এদেশের সাধারণ মানুষকে মুক্তির
নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। বিধ্বস্ত অবস্থায় ছোটো ছোটো অবস্থানে হিন্দুশক্তি
তার ক্ষত-বিক্ষত অস্তিত্ব কোনো মতে ধরে রাখলেও বৃহত্তর পরিসরে শেষপর্যন্ত বাংলাই
ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির দৃশ্যমান সর্বশেষ দুর্গ। সবশেষে বাংলা থেকে
ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি উৎখাতের পর তাদের প্রাধান্য বিস্তারে রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে
পড়ে”।
বুদ্ধ-পরবর্তী বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধের মূর্তিপুজো, তারাকে বোধিসত্ত্বের স্ত্রীরূপে কল্পনা এসব কারণে হিন্দু ধর্মের
সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সাদৃশ্য কমে আসে। মহাযান বৌদ্ধশাস্ত্রগুলি সংস্কৃত ভাষায় রচিত
হলে হিন্দুধর্মের সঙ্গে এর মিলনের পথ প্রশস্ত হয়। হিন্দু সংস্কারবাদীরা বৌদ্ধ
দেবদেবীকে নিজেদের দেবদেবীর বিকল্প বলে প্রচার করতে থাকেন। বুদ্ধকে ভারতীয়
ধর্মীয় ঐতিহ্যে বিষ্ণুর নবম অবতার মনে করার
কারণেও হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের স্বাতন্ত্র্যতা বিনষ্ট হয়। বৌদ্ধগণ
খুব সহজেই ব্রাক্ষণ ধর্মের গ্রাসে পরিণত হয়। কালক্রমে বৌদ্ধ আচার হিন্দু আচারে, বৌদ্ধ মন্দির হিন্দু মন্দিরে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে
শরৎকুমার রায় বলেন, “বুদ্ধকে ঘরের কোনে
ছোট একটি আসন দিয়া হিন্দুরা তাহার ধর্ম ও শাস্ত্রকে এই দেশ হতে এমন নিঃশেষে
বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছিলেন যে, এই ধর্ম একরূপ এদেশ
হতে অন্তর্হিত হয়েছিল।” বৌদ্ধধর্ম ঠিক ধর্ম
নয়, বরং বিশিষ্ট সাধনপদ্ধতি বলা
চলে। এই ধর্ম বা দর্শন উপমহাদেশের বাইরে একটি সুসংগঠিত ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত
হলেও এর মূল বিষয়গুলি ভারতের হিন্দুধর্মীয় কাঠামোতে বিদ্যমান থাকায় আলাদাভাবে
এর উপস্থিতির কোনো প্রয়োজন পড়েনি। অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, নবম শতাব্দী বা এর পূর্বে শংকরাচার্যের দাপটে ভারত থেকে
বৌদ্ধদের বহির্গমন হয়েছিল। প্রচলিত আছে যে শংকর হাজার হাজার বৌদ্ধকে সমুদ্রে
ডুবিয়ে মেরেছিল। এই কথার কিছুটা সত্যতা পাওয়া যায় আনন্দগিরি এবং মাধবাচার্জের
পুস্তকে। তবে আবার অনেকে মনে করে শংকরের এইসব কাণ্ড অনেকটা রটানো। কারণ শংকরের
জন্মভূমি কেরল থেকে বৌদ্ধের প্রসিদ্ধ তন্ত্র গ্রহন্ত “মঞ্জুশ্রীমূল -কল্প”
পাওয়া
যায়। এবং কেরল থেকেই ধর্ম বিলুপ্তি হয় শংকরাচার্যের বহু পরে। অন্যদিকে বিহার
বাংলায় পালবংশের প্রচণ্ড প্রতাপের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিহার এবং বৌদ্ধ
বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে বৌদ্ধদের প্রাবল্য যখন হিন্দুরা যথেচ্ছ দমন-পীড়নের
মাধ্যনে হ্রাস করে, মূর্তিটির উপর
হিন্দুদের অধিকার প্রবল হয়ে ওঠে।
(iii)
শিখধর্ম : শিখধর্ম একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে পাঞ্জাব অঞ্চলে
এই ধর্ম প্রবর্তিত হয়। এই ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব
প্রদেশের লাহোর শহর থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে 'রায় ভর দি তালবন্দী'
(বর্তমান
নাম নানকানা সাহিব) গ্রামে একটি সাধারণ হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিখধর্ম
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী। শিখ ধর্মমত ও দর্শন গুরমত (অর্থাৎ, গুরুর উপদেশ) নামেও পরিচিত। শিখধর্ম কথাটির উৎস নিহিত
রয়েছে ‘শিখ’ শব্দটির মধ্যে;
যেটি
সংস্কৃত মূলশব্দ শিষ্য বা শিক্ষা থেকে আগত। শিখ শব্দটি এসেছে 'শিসিয়া' শব্দ থেকে। শিখ
শব্দের অর্থ হলো_ অনুসরণকারী, অনুকরণকারী। এ ধর্মটি নন-সেমেটিক আরিয়ান নন-বেদিক বড়
ধর্মগুলোর মধ্যে সর্বকনিষ্ট ধর্ম। পঞ্চদশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া এ ধর্মটি ভারত
উপমহাদেশে বেশ পরিচিত। অন্যান্য আরিয়ান ধর্মের তুলনায় অনুসারী কিছুটা কর্ম হলেও
ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে তারা সদাসর্বদাই তৎপর। শিখধর্মের প্রবর্তক হলেন গুরু
নানক শাহি। যিনি পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তার এ ধর্ম মূলত উৎপত্তি হয় পাকিস্তান
ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের কাছে পাঞ্জাব রাজ্যে। ভারতের অমৃতসরে এ ধর্মের প্রধান
তীর্থস্থান গুর নানক শাহের এ ধর্মে আছেন দশজন গুরু। শেষ গুরুর নাম হল গুরু গোবিন্দ
সাহেব। গুরু নানক শাহির জন্ম হয়েছিল ক্ষত্রিয় বংশে। ক্ষত্রিয় হিন্দু ব্রাহ্মণ্য
জাত-শ্রেণির দ্বিতীয় স্তর। গুরু নানক জাতিপ্রথার এ বৈষম্য সহ্য করতে পারেননি। তিনি
যে নতুন শিখধর্মের ভিত্তি রচনা করেন তা কিন্তু আসলে হিন্দুধর্মেরই একটি শাখা।
হিন্দুধর্মের শাখা হলেও শিখধর্মে মুসলমানদের প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
শিখধর্মের পবিত্র গ্রন্থের নাম শ্রী গুরু গ্রন্থসাহেব। শিখধর্মের মর্মবাণী তাদের
পবিত্র গ্রন্থ গ্রন্থ সাহেবে সংরক্ষিত আছে। গ্রন্থটি শিখজীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা
রাখলেও এর তাৎপর্য আদি গ্রন্থের কাছাকাছি নয়। এর কিছু অংশ দৈনন্দিন প্রার্থনায়
ব্যবহৃত হয়। তবে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।
শিখধর্মের প্রধান বক্তব্য হল ওয়াহেগুরু অর্থাৎ
সর্বব্যাপী ঈশ্বরের প্রতীক এক ওঙ্কারের প্রতিভূ ওয়াহেগুরুতে বিশ্বাস। এই ধর্ম
ঈশ্বরের নাম ও বাণীর নিয়মবদ্ধ ও ব্যক্তিগত ধ্যানের মাধ্যমে মোক্ষলাভের কথা বলে।
শিখধর্মের একটি বিশিষ্টতা হল এই যে, এই ধর্মে ঈশ্বরের
অবতারতত্ত্ব স্বীকৃত নয়। বরং শিখেরা মনে করেন ঈশ্বরই এই ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ। শিখেরা
দশ জন শিখ গুরুর উপদেশ ও গুরু গ্রন্থসাহেব নামক পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুশাসন মেনে
চলেন। উক্ত ধর্মগ্রন্থে দশ শিখ গুরুর ছয় জনের বাণী এবং নানান আর্থ-সামাজিক ও
ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। গুরু গোবিন্দ সিংহ এই গ্রন্থটিকে
দশম গুরু বা খালসা পন্থের সর্বশেষ গুরু বলে ঘোষণা করে যান। পাঞ্জাবের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে শিখধর্মের ঐতিহ্য ও শিক্ষা
ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। শিখধর্মের অনুগামীরা শিখ (অর্থাৎ, শিষ্য) নামে পরিচিত। সারা বিশ্বে শিখদের সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষের
কাছাকাছি। শিখরা মূলত পাঞ্জাব ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বাস করেন। অধুনা
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশেও ভারত বিভাগের পূর্বে লক্ষাধিক শিখ বসবাস করতেন।
শিখ ধর্মের দার্শনিক চিন্তাধারার মূল এসেছে উত্তর
ভারতের দর্শন থেকে। কয়েকজন সাধুসন্তের জীবনাদর্শ এই ধর্মের দর্শনে বিশেষভাবে
প্রতিফলিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবিদাস এবং কবির। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের
প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের বিষয়ে শিখধর্ম প্রধান গুরুত্ব আরোপ করে। নানকের শিক্ষা
বৈষ্ণববাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিরোধী এই হিসাবে যে শিখধর্মে মূর্তিপুজো নিষিদ্ধ।
ভক্তি আন্দোলনের চেয়ে শিখধর্ম আরও কঠিন আত্মসাধনায় বিশ্বাসী। নানকের চিন্তাধারার
যে বিবর্তন তার মৃত্যুর পর ঘটেছে তাও শিখধর্মের অনন্য দর্শন সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা
রেখেছে। বুদ্ধিজীবীরা শিখবাদকে একটি অনন্য বিশ্বাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শিখরা
বিশ্বাস করে, তাদের ধর্ম সরাসরি ঈশ্বর
কর্তৃক অনুপ্রাণিত এবং তাদের অনেকেই বিশ্বাস করে শিখজাতি অনেকের সমন্বয় সাধন
করেছে বিধায় কখনই মারমুখী হতে পারে না। শিখ ধর্মমতে ঈশ্বর যাকে ওহেগুরু বলা হয়
তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি নিরাকার, আকাল ও আলেখ। আকাল
মানে হচ্ছে সময়হীন, আলেখ মানে হচ্ছে অদৃশ্য।
তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী, একেশ্বরে বিশ্বাসী। তারা অবতারবাদে বিশ্বাসী নয় এবং
মূর্তিপুজোও তাদের ধর্মে নেই। ঈশ্বরকে তারা ডাকে ওংকারা নামে। প্রত্যেক শিখকে
পাঁচটি বিষয় পালন করতে হয় -- প্রথমতঃ কেশ না-কেটে লম্বা করে ফেলা, দ্বিতীয়তঃ কাঙ্গা বা চিরুনি ব্যবহার করা, তৃতীয়তঃ আত্মশক্তি ও আত্মসংযমের জন্য কড়া বা লোহার চুড়ি
ব্যবহার করা, চতুর্থতঃ আত্মরক্ষার জন্য
কৃপাণ বা ছুরি সংরক্ষণ করা এবং পঞ্চমতঃ কাচ্চা বা হাঁটু অবধি লম্বা অন্তর্বাস এবং
মাথায় পাগড়ি পরিধান করা। শিখধর্মের প্রার্থনা কেন্দ্রকে বলা হয় 'গুরুদুয়ারা'।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “শিখ-স্বাধীনতা”
প্রবন্ধে
শিখদের এক লড়াইয়ের জ্বলন্ত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। মুসলিমদের দ্বারা শিখরা কীভাবে
বারবার লুণ্ঠিত হয়েছে, সেটাই বর্ণিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “অত্যাচারী বিদেশীদের
হাত হইতে স্বজাতিকে পরিত্রাণ করা গোবিন্দের এক ব্রত ছিল, সেই ব্রত বন্দা গ্রহণ করিলেন। বন্দার চতুর্দিকে শিখেরা
সমবেত হইতে লাগিল। বন্দার প্রতাপে সমস্ত পঞ্জাব কম্পিত হইয়া উঠিল। বন্দা সির্হিন্দ
হইতে মোগলদের তাড়াইয়া দিলেন। সেখানকার শাসনকর্তাকে বধ করিলেন। সির্মুরে তিনি এক
দুর্গ স্থাপন করিলেন। শতদ্রু এবং যমুনার মধ্যবর্তী প্রদেশ অধিকার করিয়া লইলেন, এবং জিলা সাহারানপুর মরুভূমি করিয়া দিলেন।
মুসলমানদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যুদ্ধ চলিতে লাগিল।
লাহোরের উত্তরে জম্বু পর্বতের উপরে বন্দা নিবাস স্থাপন করিলেন, পঞ্জাবের অধিকাংশই তাঁহার আয়ত্ত হইল। এই সময়ে দিল্লির
সম্রাট বাহাদুরশা’র মৃত্যু হইল। তাঁহার
সিংহাসন লইয়া তাঁহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে গোলযোগ চলিতে লাগিল। এই সুযোগে শিখেরা
সমবেত হইয়া বিপাশা ও ইরাবতীর মধ্যে গুরুদাসপুর নামক এক বৃহৎ দুর্গ স্থাপন করিল।
লাহোরের শাসনকর্তা বন্দার বিরুদ্ধে যাত্রা
করিলেন। উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হইল। এই জয়ের পর
সির্হিন্দে একদল শিখসৈন্য পুনর্বার প্রেরিত হইল। সেখানকার শাসনকর্তা বয়াজিদ্ খাঁ
শিখদিগকে আক্রমণ করিলেন। একজন শিখ গোপনে বয়াজিদের তাম্বুর মধ্যে প্রবেশ করিয়া
তাঁহাকে নিহত করিল; দিল্লির সম্রাট
কাশ্মীরের শাসনকর্তা আবদুল সম্মদ্ খাঁ নামক এক পরাক্রান্ত তুরানিকে শিখদিগের
বিরুদ্ধে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন। দিল্লি হইতে তাঁহার সাহায্যার্থে এক দল বাছা
বাছা সৈন্য প্রেরিত হইল। সম্মদ্ খাঁও সহস্র সহস্র স্বজাতীয় তুরানি সৈন্য লইয়া
যাত্রা করিলেন। লাহোর হইতে কামান-শ্রেণী সংগ্রহ করিয়া তিনি শিখদিগের উপরে গিয়া
পড়িলেন। শিখেরা প্রাণপণে যুদ্ধ করিল। আক্রমণকারীদের বিস্তর সৈন্য নষ্ট হইল। কিন্তু
অবশেষে পরাজিত হইয়া বন্দা গুরুদাসপুরের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। শত্রুসৈন্য
তাঁহার দুর্গ সম্পূর্ণ বেষ্টন করিয়া ফেলিল। দুর্গে খাদ্য-যাতায়াত বন্ধ হইল। সমস্ত খাদ্য
এবং অখাদ্য পর্যন্ত যখন নিঃশেষ হইয়া গেল তখন বন্দা শত্রুহস্তে আত্মসমর্পণ করিতে
বাধ্য হইলেন। ৭৪০ জন শিখ বন্দী হইল। কথিত আছে, যখন বন্দীগণ লাহোরের পথ দিয়া যাইতেছিল তখন বয়াজিদ্ খাঁর বৃদ্ধা মাতা তাহার
পুত্রের হত্যাকারীর মস্তকে পাথর ফেলিয়া দিয়া বধ করিয়াছিল। বন্দা যখন দিল্লীতে নীত হইলেন
তখন শত্রুরা শিখদের ছিন্নশির বর্শাফলকে করিয়া তাঁহার আগে আগে বহন করিয়া লইয়া
যাইতেছিল। প্রতিদিন একশত করিয়া শিখ বন্দী বধ করা হইত। একজন মুসলমান ঐতিহাসিক
লিখিয়াছিলেন যে, ‘শিখেরা মরিবার সময়
কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ করে নাই; কিন্তু অধিকতর
আশ্চর্যের বিষয় এই যে,আগে মরিবার জন্য
তাহারা আপনা-আপনির মধ্যে বিবাদ ও তর্ক করিত। এমন-কি, এইজন্য তাহারা ঘাতকের সঙ্গে ভাব করিবার চেষ্টা করিত।’ অষ্টম দিনে বন্দা বিচারকের সমক্ষে আনীত হইলেন। একজন মুসলমান
আমীর তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এমন বুদ্ধিমান্ ও
শাস্ত্রজ্ঞ হইয়াও এত পাপাচরণে তোমার মতি হইল কী করিয়া?’ বন্দা বলিলেন, ‘পাপীর শাস্তি-বিধানের
জন্য ঈশ্বর আমাকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ঈশ্বরের আদেশের বিরুদ্ধে যাহা-কিছু কাজ
করিয়াছি তাহার জন্য আবার আমারও শাস্তি হইতেছে।’ বিচারকের আদেশে তাঁহার ছেলেকে তাঁহার কোলে বসাইয়া দেওয়া হইল। তাঁহার হাতে ছুরি
দিয়া স্বহস্তে নিজের ছেলেকে কাটিতে হুকুম হইল। অবিচলিত ভাবে নীরবে তাঁহার ক্রোড়স্থ
ছেলেকে বন্দা বধ করিলেন। অবশেষে দগ্ধ লৌহের সাঁড়াশি দিয়া তাঁহার মাংস ছিঁড়িয়া
তাঁহাকে বধ করা হইল। বন্দার মৃত্যুর পর মোগলেরা শিখদের প্রতি নিদারুণ অত্যাচার
করিতে আরম্ভ করিল। প্রত্যেক শিখের মাথার জন্য পুরস্কার-স্বরূপ মূল্য ঘোষণা করা
হইল।
শিখেরা জঙ্গলে ও দুর্গম স্থানে আশ্রয় লইল। প্রতি
ছয় মাস অন্তর তাহারা একবার করিয়া অমৃতসরে সমবেত হইত। পথের মধ্যে যে-সকল জমিদার ছিল
তাহারা ইহাদিগকে পথের বিপদ হইতে রক্ষা করিত। এই ষাণ্মাসিক মিলনের পর আবার তাহারা
জঙ্গলে ছড়াইয়া পড়িত। পঞ্জাব জঙ্গলে আবৃত হইয়া উঠিল। নাদিরশা আফগানিস্থান হইতে
ভারতবর্ষে আসিবার সময় পঞ্জাব দিয়া আসিতেছিলেন। নাদিরশা জিজ্ঞাসা করিলেন, শিখদের বাসস্থান কোথায়? পঞ্জাবের শাসনকর্তা উত্তর করিলেন,
ঘোড়ার
পৃষ্ঠের জিনই শিখদের বাসস্থান।
নাদিরশাহের ভারত-আক্রমণকালে শিখেরা ছোটো ছোটো দল
বাঁধিয়া তাঁহার পশ্চাদ্বর্তী পারসিক সৈন্যদলকে আক্রমণ করিয়া লুটপাট করিতে লাগিল।
এইরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধবিগ্রহে রত হইয়া শিখেরা পুনশ্চ দুঃসাহসিক হইয়া উঠিল।
এখন তাহারা প্রকাশ্যভাবে শিখতীর্থ অমৃতসরে যাতায়াত করিতে লাগিল। একজন মুসলমান লেখক
বলেন – প্রায়ই দেখা যায়, অশ্বারোহী শিখ পূর্ণবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া তাহাদের তীর্থ
উপলক্ষে চলিয়াছে। কখনো কখনো কেহ বা ধৃতও হইত,
কেহ বা
হতও হইত, কিন্তু কখনো এমন হয় নাই যে, একজন শিখ ভয়ে তাহার স্বধর্ম ত্যাগ করিয়াছে। অবশেষে শিখেরা
উত্তরোত্তর নির্ভীক হইয়া ইরাবতীর তীরে এক ক্ষুদ্র দুর্গ স্থাপন করিল। ইহাতেও
মুসলমানেরা বড়ো একটা মনোযোগ দিল না। কিন্তু তাহারা যখন বৃহৎ দল বাঁধিয়া আমিনাবাদের
চতুষ্পার্শ্ববর্তী স্থানে কর আদায় করিতে সমবেত হইল, তখন মুসলমান সৈন্য তাহাদের আক্রমণ করিল। কিন্তু মুসলমানেরা পরাজিত হইল ও
তাহাদের সেনাপতি বিনষ্ট হইল। মুসলমানেরা অধিকসংখ্যক সৈন্য লইয়া দ্বিতীয়বার আক্রমণ
করিল ও শিখদিগকে পরাভূত করিল। লাহোরে এই উপলক্ষে বিস্তর শিখবন্দী নিহত হয়। যেখানে
এই বধকার্য সমাধা হয় লাহোরের সেই স্থান সুহিদগঞ্জ নামে অভিহিত। এখনও সেখানে ভাই
তরুসিংহের কবরস্থান আছে। কথিত আছে, তরুসিংহকে তাঁহার
দীর্ঘ কেশ ছেদন করিয়া শিখধর্ম ত্যাগ করিতে বলা হয়। কিন্তু গুরু গোবিন্দের এই বৃদ্ধ
অনুচর তাঁহার ধর্ম ত্যাগ করিতে অসম্মত হইলেন এবং শিখদের শাস্ত্রানুমোদিত জাতীয়
চিহ্নস্বরূপ দীর্ঘ কেশ ছেদন করিতে রাজি হইলেন না। তিনি বলিলেন, ‘চুলের সঙ্গে খুলির সঙ্গে এবং খুলির সঙ্গে মাথার সঙ্গে যোগ
আছে। চুলে কাজ কী, আমি মাথাটা দিতেছি।’ এইরূপে ক্রমাগত জয়পরাজয়ের মধ্যে সমস্ত শিখ জাতি আন্দোলিত
হইতে লাগিল, কিন্তু কিছুতেই তাহারা
নিরুদ্যম হইল না। এক সময়ে যখন তাহারা সির্হিন্দের শাসনকর্তা জেইন খাঁর উপরে
ব্যাঘ্রের ন্যায় লম্ফ দিবার উদ্যোগ করিতেছিল। এমন সময়ে দুর্দান্তপরাক্রম পাঠান
আমেদশা তাঁহার বৃহৎ সৈন্যদলসমেত তাহাদের উপর আসিয়া পড়িলেন। এই যুদ্ধে শিখদের
সম্পূর্ণ পরাজয় হয়, তাহাদের বিস্তর লোক
মারা যায়। আমেদশা অমৃতসরের শিখ-মন্দির ভাঙিয়া দিলেন। গোরক্ত ঢালিয়া অমৃতসরের সরোবর
অপবিত্র করিয়া দিলেন। শিখদের ছিন্ন শির স্তূপাকার করিয়া সজ্জিত করিলেন। এবং কাফের
শত্রুদের রক্তে মসজিদের ভিত্তি ধৌত করিয়া দিলেন। কিন্তু ইহাতেও শিখেরা নিরুদ্যম
হইল না। প্রতিদিন তাহাদের দল বাড়িতে লাগিল। প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি সমস্ত জাতির
হৃদয়ে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। প্রথমে তাহারা কসুর-নামক পাঠানদের উপনিবেশ আক্রমণ, লুণ্ঠন ও গ্রহণ করিল। তাহার পরে তাহারা সির্হিন্দে অগ্রসর
হইল। সেখানকার শাসনকর্তা জেইন খাঁর সহিত যুদ্ধ বাধিল। যুদ্ধে পাঠান পরাজিত ও নিহত
হইল। শতদ্রু হইতে যমুনা পর্যন্ত সির্হিন্দ প্রদেশ শিখদের করতলস্থ হইল। লাহোরের
শাসনকর্তা কাবুলিমলকে শিখেরা দূর করিয়া দিল। ঝিলম হইতে শতদ্রু পর্যন্ত সমস্ত
পঞ্জাব শিখদের হাতে আসিল। এই বিস্তৃত ভূখণ্ড সর্দারেরা মিলিয়া ভাগ করিয়া লইলেন।
শিখেরা বিস্তর মসজিদ ভাঙিয়া ফেলিল। শৃঙ্খলবদ্ধ আফগানদের দ্বারা শূকররক্তে
মসজিদ-ভিত্তি ধৌত করানো হইল”।
১৯৮৪ থেকে ২০১৫৷ প্রায় ৩০ বছর পর সুবিচারের
আশায় বুক বাঁধছে শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় নিহতদের পরিবর্গরা৷ ১৯৮৪ সালের ৩১শে
অক্টোবর৷ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই
দিল্লি ও উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে শিখ বিরোধী দাঙ্গার আগুন জ্বলে ওঠে৷ যেহেতু
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন৷ তার জেরেই বেশকিছু
কংগ্রেস নেতার প্ররোচনায় এই দাঙ্গা বাঁধে৷ সরকার ও পুলিশ প্রশাসন প্রথমদিকে ছিল
নীরব দর্শক৷ এই নীরবতা দাঙ্গায় ঘৃতাহুতির কাজ করে৷ এই দাঙ্গায় হত্যা হয় শিখ
সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০০০ মানুষ৷ আহত অগুনতি৷ বিভিন্ন স্তরে এই দাঙ্গায় প্ররোচনা
দিয়েছিলেন বলে যেসব কংগ্রেস নেতার নাম উঠেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম কংগ্রেস নেতা এবং
কংগ্রেস সরকারের একসময়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জগদীশ টাইটলার৷ নরেন্দ্র মোদি সরকারের
উদ্যোগে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের স্বার্থে এবার গঠিত হতে চলেছে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম
বা সিট৷
পৃথিবীর অন্যসব প্রধান ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থগুলি
যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু ধর্ম এবং
ধর্মগ্রন্থগুলি সৃষ্টি হয়নি। বেদে হিন্দু ধর্ম বলে কোনো উল্লেখ নেই, এমনকি মনুসংহিতাতেও নেই। কোনো ধর্ম সৃষ্টির জন্যেও
বেদ-মনুসংহিতা রচিত হয়নি। এই গ্রন্থগুলি পরবর্তীতে ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া
হয়েছে। হিন্দুধর্মের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই,
মোহাম্মদ-জিশুর
মতো কোনো নবি বা প্রচারকও নেই। সেকালের অর্থাৎ প্রাচীন যুগে মুনিঋষিদের জীবনচর্যা, জীবনবোধ, ঈশ্বর-ভাবনা, জীবন থেকে উত্তরণ,
যাগযজ্ঞ, আরাধনা-সাধনা, সমাজব্যবস্থা
বংশপরম্পরায় মুখে মুখে পরিবার থেকে পরিবারে গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠীতে বেদের বিষয়বস্তু
শুধুমাত্র স্মৃতিতে সংরক্ষিত হচ্ছিল। এরপর যখন লিপি এবং লিখনরীতি আবিষ্কার হল তখন তা সংরক্ষণ করা
গেল। বর্তমানে যে বেদ দেখি তা আদিরূপের নয়। তবে বলা হয় আদিতে বেদব্যাস নামে জনৈক
ঋষি বেদগুলি চারভাগে সংকলন করেছিলেন। বিস্তারিত পরে লিখব।
(iv)
হিন্দুধর্ম : হিন্দু, হিন্দুত্ব বা
হিন্দুধর্ম বলতে কী বোঝায় তার সংজ্ঞা এককথায় প্রকাশ করা খুব কঠিন কাজ। হিন্দুধর্ম
ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম তথা একটি দেশীয় ধর্মবিশ্বাস। হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ
স্বীয় ধর্মমতকে সনাতন ধর্ম নামেও অভিহিত করেন। হিন্দুধর্ম একাধিক ধর্মীয়
ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত। এই ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। লৌহযুগীয় ভারতের
ঐতিহাসিক বৈদিক ধর্মে এই ধর্মের শিকড় নিবদ্ধ। হিন্দুধর্মকে বিশ্বের
"প্রাচীনতম জীবিত ধর্মবিশ্বাস" বা "প্রাচীনতম জীবিত প্রধান
মতবাদ" আখ্যা দেওয়া হয়। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক কানাডা সফরে
জানিয়েছেন, “হিন্দুধর্ম কোনও ধর্ম নয়, এটি এক জীবনধারা”।অবশ্য সেই প্রসঙ্গেই তিনি
বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট হিন্দুধর্মের
একটি অসাধারণ সংজ্ঞা দিয়েছে”। শীর্ষ আদালত বলেছে, “হিন্দুধর্ম কোনও ধর্ম নয়, এটি একটি জীবনধারা”। সুপ্রিম কোর্টের এই মত তিনিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন বলে
জানান মোদী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “হিন্দুধর্ম এক বিজ্ঞানসম্মত জীবনধারার মধ্য দিয়ে বন্যজীবন সহ গোটা পরিবেশ-প্রকৃতির স্বার্থ রক্ষা করে চলে”।
বেদ সর্বপ্রাচীন, সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। “বেদ” হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ
বলা হলেও হিন্দুধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। হিন্দুশাস্ত্র শ্রুতি ও
স্মৃতি নামে দুই ভাগে বিভক্ত। এই গ্রন্থগুলিতে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও ৩৬টি (১৮ টি মহাপুরাণ এবং ১৮ টি উপপুরাণ) পুরাণ
আলোচিত হয়েছে এবং ধর্মানুশীলন সংক্রান্ত নানা তথ্য বিবৃত হয়েছে। বেদের পরেই
মনুসংহিতার স্থান। অন্যান্য প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল উপনিষদ্, পুরাণ ও ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত। ভগবদ্গীতা
নামে পরিচিত মহাভারতের কৃষ্ণ-কথিত একটি অংশ বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন ধর্মগ্রন্থের
মর্যাদা পেয়ে থাকে। এছাড়া কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’, বিক্রমোর্বশীয়ম্”,
‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ গ্রন্থগুলিও হিন্দুধর্মে প্রভাব ফেলেছে। এখানেই শেষ নয় – বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, শিখধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং
খ্রিস্টধর্মের অনেক নিয়মনীতি জ্ঞানত-অজ্ঞানত হিন্দুধর্মে প্রবেশ করে আজকের
হিন্দুধর্ম।প্রদেশভিত্তিক, জাতভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক, পরিবারভিত্তিক, ব্যক্তিভিত্তিক হিন্দুধর্মের ভিন্নতা তাই। দেশের ১,০২৮,৬১০,৩২৮ কোটি মানুষের ৮২৭,৫৭৮,৮৬৮ (৮০.৪৬%) কোটি হিন্দুর ৮২৭,৫৭৮,৮৬৮ কোটি ভিন্নতা।
হিন্দুরা যতই ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ বলে গর্ব অনুভব করুক না-কেন,আসলে এই ভিন্নতাই হিন্দুদের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। ধর্মে-ধর্মে বিভাজিত, জাতে-জাতে বিভাজিত,
বর্ণে-বর্ণে
বিভাজিত, রাজ্যে-রাজ্যে বিভাজিত, ভাষায়-ভাষায় বিভাজিত –
এই হল
ভারত, এই হল হিন্দু।একটু ইতিহাসের
দিকে ফিরে তাকালেই বুঝতে পারব ভারতের খণ্ডিত এবং বিভাজিত হিন্দুরাজাদের ধুলিস্যাৎ
করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টীয় সপ্তম
শতাব্দীর প্রথম ভাগে আরব ইসলাম সম্প্রদায়ের ভারতে আগমনের সূত্র ধরে ভারতবাসী
ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হন। ভারতবর্ষের বুকে মুসলিম শাসকদের প্রায় ৭০০ বছরের
শাসনাবসান হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্য দিয়ে।
জনসংখ্যার বিচারে হিন্দুধর্ম খ্রিস্টধর্ম ও
ইসলামের পরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মমত। এই ধর্মের অনুগামীদের সংখ্যা ১০০
কোটিরও বেশি। এদের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি হিন্দু বাস করেন ভারতীয়
প্রজাতন্ত্রে।এছাড়া নেপাল (২৩,০০০,০০০), মরিশাস (১৪,০০০,০০০) ও ইন্দোনেশীয়
দ্বীপ বালিতে (৩,৩০০,০০০) উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় হিন্দুরা বাস করেন।
১০৮টি উপনিষদ, ৩৬টি পুরাণ, ৬টি স্মৃতি, রামায়ণ-মহাভারত-গীতার কোনো স্থান “হিন্দু” শব্দটি পাওয়া যায় না।
পাওয়ার কথাও নয়। কারণ “হিন্দু” শব্দটির উৎপত্তি ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু বা ইন্দুস
শব্দ থেকে। সিন্ধু একটি নদীর নাম। ঋগ্বেদে সিন্ধু নদের স্তুতি করা হয়েছে। এই নদীর
তীরেই ২৫০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্রঞ্জযুগের সূচনা হয়। এই যুগের শেষের
দিকেই “হিন্দু” শব্দটির আবির্ভাব হয়। পরবর্তীকালের আরবি সাহিত্যেও আল-হিন্দ
শব্দটির মাধ্যমে সিন্ধু নদ অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতের নামের সমার্থক শব্দ হিসেবে হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান
শব্দটির উৎপত্তি হয়। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ "হিন্দুদের দেশ"। বস্তুত
১৯ শতকে “হিন্দু” শব্দটি ইংরেজি অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়।প্রথমদিকে “হিন্দু” শব্দটি
ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অধিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল।
কেবলমাত্র “চৈতন্যচরিতামৃত” ও “চৈতন্যভাগবত” ইত্যাদি কয়েকটি ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা গৌড়ীয়
বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থে যবন বা ম্লেচ্ছদের থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পৃথক করার জন্য
শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় বণিক ও
ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসগুলির অনুগামীদের একত্রে “হিন্দু” নামে অভিহিত করে।
ধীরে ধীরে এই শব্দটি আব্রাহামীয় ধর্মসমূহ অথবা অবৈদিক ধর্মবিশ্বাসগুলির (যেমন
জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও শিখধর্ম) অনুগামী
নন এবং সনাতন ধর্ম নামক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন সকল ভারতীয়
বংশোদ্ভুত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। ইংরেজি ভাষাতে ভারতের স্থানীয়
ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যগুলি বোঝাতে হিন্দুইজম বা হিন্দুধর্ম কথাটি চালু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে।
ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি তথা বিশিষ্ট দার্শনিক
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে একে “একটি বিশ্বাসমাত্র”
বলতে
অস্বীকার করেন। বরং এই ধর্মের যুক্তি ও দর্শনের দিকটি বিচার করে তিনি
খোলাখুলিভাবেই এই মত ব্যক্ত করেন যে হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দান করা অসম্ভব।
শুধুমাত্র এই ধর্ম অনুশীলনই করা যায়। তেমনই কোনো কোনো পণ্ডিত সুসংজ্ঞায়িত ও
রক্ষণশীল ধর্মীয় সংগঠন না বলে হিন্দুধর্মকে “অস্পষ্ট সীমানায়” বর্গায়ীত করার
পক্ষপাতী। কয়েকটি ধর্মমত হিন্দুধর্মে কেন্দ্রীয়। অন্যগুলি ঠিক কেন্দ্রীয়
না-হলেও এই পরিসীমার আওতার মধ্যেই পড়ে। উনবিংশ শতকে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদীগণ ‘হিন্দুইজম’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু
করার পর থেকেই হিন্দুধর্ম একটি বিশ্বধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যদিও হিন্দুধর্মের শিকড় ও তার বিভিন্ন
শাখাপ্রশাখার প্রাচীনত্বের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। সকলেই স্বীকার করেছেন যে
প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা থেকে ঐতিহাসিক বৈদিক সভ্যতার প্রাথমিক পর্ব জুড়ে ছিল
হিন্দুধর্মের সূচনালগ্ন। বৈদিক ধর্মের যে রূপগুলি পরিলক্ষিত হয়, তা হিন্দুধর্মের বিকল্প নয়, বরং তার প্রাচীনতম রূপ। তাই পশ্চিমি প্রাচ্যবিদদের লেখায় বৈদিক ধর্ম, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিন্দুধর্মের মধ্যে যে প্রভেদ দেখানো হয়ে
থাকে তারও বিশেষ যুক্তি নেই। কেউ কেউ মনে করেন, হিন্দুধর্মে কোনো “অনুশাসনের আকারে
নিবদ্ধ কোনো একক ধর্মীয় বিশ্বাস” প্রচলিত নেই।
কোনো কোনো পণ্ডিত এবং অনেক হিন্দু দেশীয় ‘সনাতন ধর্ম’-এর সংজ্ঞাটির
পক্ষপাতী। এই সংস্কৃত শব্দবন্ধটির অর্থ ‘চিরন্তন ধর্ম (বিধি)’ বা ‘চিরন্তন পন্থা’। হিন্দুধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম তবে হিন্দু নামটি আধুনিকালের
দেওয়া। এর প্রাচীন নাম হল সনাতন ধর্ম। অনেকে বলেন, মনুই পৃথিবীর প্রথম মানুষ (পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ৫৭৩৬ বছর আগে হয় তবে
মনুকে প্রথম মানুষ হিসাবে মানতে হবে)। বেদ-বেদান্ত, স্মৃতি-শ্রুতি, পুরাণে মনুকেই প্রথম
মানুষ বলা হত। মনু শব্দ থেকেই মানুষ শব্দের উৎপত্তি।যেহেতু পৃথিবীর প্রথম মানুষটির
কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই ধর্মের প্রসার লাভ করেছে, সেইহেতু সনাতন নামটা মোটেই অযৌক্তিক নয়। এই ধর্ম বৈদিক ধর্ম নামেও পরিচিত। এই ধর্ম
বেদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এই গ্রন্থগুলোর পাঠ করলে জানা যাবে সনাতন ধর্মের
কলেবর কতো বিশাল আর জ্ঞানগভীর। তবে রামায়ণ আর মহাভারতে বৈদিক যুগের ইতিহাস
লিপিবদ্ধ। ধর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে ভাগবতের। তবে
উল্লেখিত প্রতিটি গ্রন্থই মহা মূল্যবান আর প্রয়োজনীয়। ভাষাবিদদের মতে সংস্কৃত
ভাষার উদ্ভব ২০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আমরা এবার দেখে নিতে পারি হিন্দু
ধর্মগ্রন্থগুলির রচনাকাল : (১) বেদের রচনাকাল – ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, (২) উপনিষদের রচনাকাল – ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, (৩) মহাভারতের রচনাকাল – ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, (৪) রামায়ণের রচনাকাল –
৩০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, (৫) শ্রীমদভগবতগীতার রচনাকাল – ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, (৬) মনুসংহিতার
রচনাকাল – ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে
৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, (৭) পুরাণ রচনাকাল – ৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই। তাহলে বলা যায় সনাতন ধর্মের
আবির্ভাব মোটামুটি ২৯০০ থেকে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে।
হিন্দু বলতে একসময় সিন্ধুনদের তীরবর্তী স্থানের
লোক বোঝাত। পরে ভারতবর্ষের লোকজন ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত হয়। সবশেষে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত হয়। কারো
মতে সংস্কৃত ‘সিন্ধু’ থেকে হিন্দু শব্দটি এসেছে। এটা সঠিক নয়। ফারসি ‘হিন্দ’ থেকে হিন্দু শব্দটির
উত্পত্তি। ফারসিতে হিন্দ শব্দের অর্থ কালো। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন তার ‘বৃহত্ বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘সিন্ধুনদ থেকেই ‘হিন্দ’, ‘হিন্দু’ ও ‘হিন্দুস্থান’ প্রভৃতি শব্দ এসেছে।’
ফারসিতে সিন্ধুর উচ্চারণ ‘হিন্দু’। বিশেষ করে ফারসি
সাহিত্য ও ইতিহাসে সিন্ধুনদের অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে হিন্দু বলে আখ্যায়িত
করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ইংরেজিতে সিন্ধুনদের
নাম ‘Indus’। এই Indus-ই পরবর্তীকালে ‘India’ শব্দে রূপান্তরিত হয়। তবে হালের ফারসি সাহিত্য ও ইতিহাসে
হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীদের ‘হিন্দুস্থানি’ বলা হয়। হিন্দু শব্দটি বাস্তবতায় ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাভিত্তিক একটি ধারণা। নীরদ সি চৌধুরী তার
‘হিন্দুইজম: এ রিলিজিয়ন টু লিভ
বাই’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হিন্দুরাও এক সময় পরিচয় দিতে গিয়ে ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করত
না। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে মুসলিম শাসকরা (Even the word Hindu was not used by them to designate themselves
except when, under Muslim Rule, they employed this Muslim term for this purpose).
অন্নদাশঙ্কর রায়ও তার ‘সংস্কৃতির বিবর্তন’
প্রবন্ধে
লিখেছেন ‘হিন্দি’ শব্দটি হিন্দুর মতই বাইরে থেকে আমদানি। হিন্দু শব্দের মূল
সিন্ধ তথা সিন্ধু।’ জওহরলাল নেহরু তার ‘ভারত সন্ধানে’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘প্রাচীন সাহিত্যে ‘হিন্দু’ শব্দটি একেবারেই অনুপস্থিত।’ ভারতীয় পুস্তকের মধ্যে অষ্টম শতাব্দীর একখানি তান্ত্রিক গ্রন্থে এই শব্দের
প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বলে তিনি শুনেছেন। সেখানে হিন্দু শব্দটি জাতির নাম, ধর্মবাচক শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। বলা যায়, ‘হিন্দু’ শব্দটি তুলনামূলকভাবে
আধুনিক। প্রাথমিকভাবে শব্দটি দিয়ে কোনো বিশেষ ধর্মের লোক বোঝাত না। কিন্তু
ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ‘হিন্দু’, ‘হিন্দুধর্ম’ ও ‘হিন্দুসভ্যতা’ সমার্থক হয়ে
উঠেছে।
জিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৭০০ বছর পূর্বে
বর্তমান ইরান অঞ্চল থেকে আর্যরা ভারতের ইন্দাস উপত্যকায় আক্রমণ চালায় এবং
স্থানীয়দের পরাভূত করে ভারতে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়৷ অনেকে মনে করেন, আর্যরা হিন্দুকুশ অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেছিল বলে
তাদের প্রচারিত বৈদিক ধর্মকে হিন্দুধর্ম বলা হয়ে থাকে৷ তারা ভারতে প্রবেশ করার পর
তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের ধারণা (বৈদিক ধর্ম) প্রাচীন ভারতের স্থানীয় আদিবাসীদের উপর রোলার চালিয়ে চাপিয়ে দেয়৷ “বেদ” নামে পরিচিত
গীতিকবিতার একটি সংকলন গ্রন্থকে তাদের বৈদিক ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসাবে
প্রতিষ্ঠা করে৷ বেদ-বিধানাত্মক ধর্মই বৈদিক ধর্ম৷ বৈদিক ধর্ম বা সনাতন ধর্ম বা
ব্রাহ্মণ্যধর্মই বর্তমানের হিন্দুধর্ম৷
বেদ : হিন্দুধর্মের মূল
ধর্মগ্রন্থ বেদ, যা কি না ইতিহাসে
ঈশ্বরের বাণী বা অপৌরুষেয় বলে অবিবেচ্য৷ আর্য হিন্দুদের বিশ্বাস পরমপিতা ভগবান
অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা নামক চারজন ঋষিকে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ
চিত্ত দেখে এই চারজনের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন প্রথমে৷ এবং পরে এই চারজনের হৃদয়ে
অধিষ্ঠিত থেকে এদের চারজনের মুখ দিয়ে ঋক,
সাম, যজু ও অথর্ব নামক চারটি বেদ প্রকাশ করান। অন্য মতে, এই গ্রন্থগুলি অনাদি অনন্ত ঈশ্বরের নিঃশ্বাসে সৃষ্টি হয়েছে৷
সে যাই হোক, হিন্দুধর্মের যাবতীয় একান্ত
করণীয় বিষয়ই বেদে বর্ণিত হয়েছে৷ আর্য ঋষিগণ এই মন্ত্র দ্বারা ইন্দ্র ও অন্যান্য
দেবগণের আরাধনা করতেন৷ ঐতিহাসিকদের মতে,
বেদ
ঐশ্বরিক গ্রন্থ নয়৷ কারণ এটা শুধু প্রাচীন মুনি-ঋষিদের এবং আর্য রাজাদের ইতিহাসে
পরিপূর্ণ দেখা যায়৷ আবার কিছু অংশে ভারতবর্ষের বিভিন্ন নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, জনপদ সহ বিভিন্ন
যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়৷ তাই ঐতিহাসিকরা বেদকে মানুষ রচিত আর্য সভ্যতার ইতিহাস
মনে করেন৷ ঋগ্বেদে ২১৪ জন ঋষির নাম এবং ১২ জন স্ত্রীলোকের নামের উল্লেখ আছে৷
ঐতিহাসিকদের ধারণা এদের সকলের প্রচেষ্টায় বেদের বিভিন্ন অংশ রচিত হয়েছে৷ তাই বেদের
শ্লোকগুলি তৎকালীন এবং প্রাচীন আর্য ঋষিদের ধ্যান-ধারণায় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এবং
বাকিটা কাল্পনিক সৃষ্টি৷ বেদ লেখক নারীপুরুষরা নিজেদের রাজাদের আমলে রাজাদের খুশি
করতে বেদের বিভিন্ন খণ্ডে আর্য রাজাদের ভগবান হিসাবে লিপিবদ্ধ করে এবং তাদের
বিপক্ষের রাজ্যের রাজা এবং লোকদের অসুর (সুর নয়) হিসাবে। আর্যরা যখন যুদ্ধে জয়ী
হতেন তখন তাদের ওই জয়ের ঘটনাগুলিই বেদ নামক গ্রন্থে অসুর, রাক্ষস দেবতার যুদ্ধ নামে লিপিবদ্ধ করতেন। যেমন ধরুন, কোনো এক রাজার নাম ছিল শিব ,তার সঙ্গে অপর এক রাজার রাজনৈতিক কারণে যুদ্ধ হল ওই বিপক্ষের রাজ্যের রাজাদের
বেদ লেখকরা অসুর অথবা রাক্ষস নামে বেদে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা জোরের
সঙ্গে বলেন, বেদ নামক গ্রন্থটি কখনোই
ঈশ্বরের বাণী হতে পারে না। কারণ এর উল্লেখিত সকল ঘটনাই আর্য রাজাদের, ব্রাহ্মণ বা ঋষিদের নিয়ে লেখা। বেদ নামক গ্রন্থটি আর্য তথা
ব্রাহ্মণরা নিজেদের আধিপত্য লাভের জন্য ভারতবর্ষে চালিয়ে দেয় বলেও অনেক ঐতিহাসিক
মনে করেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরিপ্রসাদের মতে,
বেদ
আর্যরা আধিপত্য লাভের আশায় ভারতীয়দের কাছে ঈশ্বরের বাণী হিসাবে প্রচার করে এবং
দীর্ঘসময় এর সুফল ভোগ করেন এবং আজও করছেন। এরপর যখন বেদ জনসমক্ষে প্রচার শুরু হল
তখন, ভারতীয় পণ্ডিতরা বেদে কিছু
অনার্য দেবতাদের শক্তির ঘটনা যোগ করল,
কিছু
ভারতীয় প্রাচীন স্থানের নাম যোগ করল, সঙ্গে কিছু কাল্পনিক
স্থানের নাম ও যোগ করলেন। বেদ লক্ষ করলে
দেখা যাবে, বেদে অনার্য দেবতাদের শক্তি
তেমন নেই, তাদের তেমন মর্যাদাও দেওয়া
হয়নি। বৃহৎ বঙ্গ এবং কিছু জায়গায় দেখা যায় অনার্য দেবী কালির পুজো হয়, আবার অন্যস্থানে দেখবেন কালির কোনো মর্যাদাই নেই। মানুষ
কর্তৃক রচিত বেদে দেখা যায় এক-এক সময় এক-এক দেবতাকে সর্বশক্তিমান বলে, যার মূল কারণ হল আর্যদের মধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা
এসেছেন এবং বেদের এক-এক সময়ের লেখকরা এক-এক রাজাকে শ্রেষ্ঠ দেবতা বলে ঘোষণা করেছেন
। কিন্তু বেদের মূলে একটি জিনিস পরিবর্তন হয়নি যেটা হল আর্যদের শ্রেষ্ঠত্ব, শুদ্রদের উপরে স্থান আর্যদের। ঈশ্বরের চোখে তো সবাই একই
ধর্মের মানুষ এবং সবাই সমান হওয়ার কথা। কিন্তু ঈশ্বরের বাণী বলে প্রচার হওয়া বেদে
কেন আর্যদেরই শ্রেষ্ঠ বলা হয় ?
হিন্দুধর্ম অবতারবাদে বিশ্বাসী। অবতার অর্থ হলো
অবতরণকারী। হিন্দুশাস্ত্রের পরিভাষায় স্বর্গ থেকে ঈশ্বর মনোনীত যে মহাপুরুষগণ
মানুষকে নীতি শিক্ষাদানের জন্য মর্তে আগমন করেন
তাঁদেরকে অবতার বলা হয়। সাধারণত জগৎ-জীবনকে দিব্য প্রকৃতিতে উঠানোর এবং
ধর্ম সংস্থাপন ও অধর্মের বিনাশের জন্য ঈশ্বরের পক্ষ থেকে অবতারগণ আগমন করে থাকেন।
মনুসংহিতা : হিন্দুধর্মে “মনুসংহিতা”ও ধর্মশাস্ত্র হিসাবে
প্রাধান্য পায়। হিন্দুধর্মালম্বীদের জীবনে মনুসংহিতা প্রভাব অস্বীকার করা খুব
কঠিন। বৈদিক ধর্মের উৎস হিসাবে স্বীকৃত হয় ‘স্মৃতি’ বা ‘বেদ’ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই
ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠল মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। এর মাধ্যমে যে
সমাজ-কাঠামোর নির্মাণ যজ্ঞ চলতে থাকল তার ভিত্তি এক আজব চতুর্বর্ণ প্রথা। যেখানে
আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস।
কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য
নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী-বিদ্রোহী হয়ে উঠতে
চাইল, এদেরকেই সুকৌশলে অচ্ছ্যুৎ, দস্যু, সমাজচ্যুত বা
অস্পৃশ্য সম্প্রদায় করা হল । পৃথিবীতে যতগুলি কথিত ধর্মগ্রন্থ আছে তার মধ্যে মনে
হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ বা ‘মনুসংহিতা’। ব্রাহ্মণ্যবাদের আকর গ্রন্থ শ্রুতি বা ‘বেদ’-এর নির্যাসকে ধারণ
করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। তাই
মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মনুসংহিতা মানেই
ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই
মনুসংহিতা। এটাকে তৎকালীন বৈদিক আর্য সমাজ ও প্রচলিত হিন্দু সমাজের অবশ্য পালনীয়
পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বারোটি অধ্যায়ে প্রায় দু-হাজার সাতশো শ্লোক সংবলিত এ গ্রন্থটির পাতায় পাতায় ধর্মীয়
বিধানের নাম দিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে অক্ষরে যে শ্লোকগুলি উৎকীর্ণ রয়েছে, অধিকাংশ শ্লোকের ভাবার্থকে যদি মনুষ্য সমাজে পালনীয় নীতি
হিসাবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে মানুষের সমাজে
কোনো মানবিক বোধ আদৌ রয়েছে বা অবশিষ্ট থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করাটাই অবিশ্বাস্য
মনে হয়।
আসলে প্রভূত স্ববিরোধিতা থাকলেও বলা যায় মনুই
হলেন (সম্ভবত) ভারতবর্ষের প্রথম সুশৃঙ্খল এবং বিচক্ষণ প্রজাপালক বা শাসক, যিনি সুসংগঠিত রাষ্ট্রতন্ত্রের স্রষ্টা বা জনকও।
রাষ্ট্র-পরিচালনার লক্ষ্যে ভারতবর্ষের প্রথম সংবিধানটি ইনিই প্রণয়ন করেছেন, যা “মনুসংহিতা” নামে পরিচিত। “মনুসংহিতা” বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মনুবাবু খুব উঁচুতে রেখেছেন
ক্ষত্রিয় বা শাসক বা রাজাকে এবং ব্রাহ্মণদের। সবচেয়ে নীচে রেখেছেন শূদ্র এবং
নারীদের। ক্ষত্রিয় বা শাসক বা রাজাকে এবং ব্রাহ্মণদের উঁচুতে রাখার কারণ তিনি
একাধারে ব্রাহ্মণ ও রাজা। শূদ্র এবং নারীদের নীচে রাখার রাখার কারণ শূদ্ররা
ভারতবর্ষের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী এবং নারীদের শক্তি উনি আন্দাজ করতে
পেরেছিলেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন নারী অপ্রতিরোধ্য, দুর্দমনীয়, বিধ্বংসী। শূদ্র ও নারীদের
মধ্যে অনুশাসনের ভীতি সঞ্চার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল শাসক তথা আইন-প্রণেতার
উদ্দেশ্য। সেটাই স্বাভাবিক। প্রজাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই
রাষ্ট্রপ্রধান মনুর কৌশল। সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকগণ দেশের আইন মানতে বাধ্য, ঠিক তেমনই মনুর যুগেও মনুসংহিতা নামক অনুশাসন বা আইন মানা
বাধ্যতামূলক ছিল। অমান্য করলে হাত কেটে নেওয়া, পা কেটে নেওয়া, চোখ উপড়ে নেওয়া, শূলে চড়িয়ে হত্যা করা,
হিংস্র
পশুকে দিয়ে খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি পুরস্কার জুটত কপালে। বিদ্রোহ ? এখনও হয়, তখনও হত। বিদ্রোহ
দমনও হত অকথ্য পীড়ন দ্বারা। কেমন ছিল মনুর সংবিধান ? এই সংবিধান যাতে সকলে অক্ষরে অক্ষরে মান্য করেন সেজন্য অনুশাসন যাঁরা প্রয়োগ
করবেন তাঁরা কে সে বিষয়ে মনু নিপুণ হস্তে বর্ণনা করেছেন। কারণ মনু প্রথমে ব্রাহ্মণ, পরে রাজা। মনুসংহিতার কাঠামো দ্বারা তিনি ব্রাহ্মণকে
প্রকৃতপক্ষে দেবতার আসনে বসিয়ে একটি স্থায়ী বৈষম্যপূর্ণ ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস
পেয়েছেন। প্রতিটি বিধানের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রাহ্মণ। তাঁর স্বার্থকে রক্ষা, সংহত করার নিরঙ্কুশ করাই হচ্ছে মনুর একমাত্র উদ্দেশ্য। এর
জন্য যত ধরনের নিষ্ঠুরতা দরকার মনু তা অনায়সেই করেছেন। মনুসংহিতার মত অনুযায়ী মহান
স্রষ্টা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। এ সবকিছু রক্ষার জন্য তার মানব সৃষ্টিও জরুরি হয়ে
পড়ে। ফলে মানুষও সৃষ্টি হল। কিন্তু মানব সৃষ্টি ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে এসে
ব্রহ্মা বা ঈশ্বর বোধ করি নিজেকে আর সুমহান মর্যাদায় ধরে রাখতে পারেননি। যে
শ্রেণিবিদ্বেষপ্রসূত তীব্র অসমতাভিত্তিক বর্ণপ্রথার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে তাতেই
সন্দেহ গাঢ় হয়ে ওঠে যে এটা আদৌ কোনো অতিলৌকিক পবিত্র বিধিবিধান কি না। বরং ধর্মীয়
মোড়কে এক ঘৃণ্য আর্থ-সমাজ-রাজনীতির অত্যন্ত দূরভিসন্ধিমূলক ন্যাক্কারজনক প্রচেষ্টা
বলেই মনে হয়। তার পেছনে যে এক অতীব স্বার্থান্বেষী ভণ্ড-প্রতারক গোষ্ঠীর সূক্ষ্মতম
কারসাজিই কার্যকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব বেশি
যুক্তিবাদী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এহেন মনুর বিধান বা অনুশাসন হিন্দুদের
শিরা-উপশিরায়, যা হিন্দুধর্মকে প্রভূত
দুর্বল করে তুলেছে।
শ্রীমদভগবতগীতা : “শ্রীমদভগবতগীতা”
হিন্দু
সমাজে সর্বাধিক ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বিশেষ পরিচিত। যেহেতু মহাভারতের ভিক্ষুপূর্বের
প্রসিদ্ধ শ্রীমদ্ভগবতগীতা, তাই চতুঃস্তর বেদের
সার উপনিষদ আর উপনিষদের সার গীতা। গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত ১৮টি
অধ্যায়। এর বক্তা শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রোতা অর্জুন। এর অপর নাম হল সপ্তশাতী। কারণ এতে
৭০০ (সাত শত) শ্লোক আছে। গীতা একাধারে ধর্ম,
দর্শন ও
কাব্যগ্রন্থ। এতে বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ প্রভৃতি বিষয়ে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গীতাকে
হিন্দুধর্মে সকল আনুষ্ঠানিকতার ধর্মপুস্তক বলে গণ্য করা হয় এবং এর থেকে পাঠ
উপস্থাপন করা হয়। হিন্দুধর্মের প্রতিটি গ্রন্থ বা শাস্ত্রে পৃথক পৃথক শিক্ষা
রয়েছে। গীতার ঈশ্বর পরম তত্ত্ব, পরমাত্মা, পুরুষোত্তম ঈশ্বর সর্বভূতের সনাতন বীজ। তা ছাড়া গীতা আরও
শিক্ষা প্রদান করে, ঈশ্বর লাভ করতে হলে
যোগ, কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান -- এ চারটি মার্গের অনুসরণ করা আবশ্যক। এখানে
ধর্মতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, গার্হস্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
পুরাণ : পুরাণ হিন্দুধর্মের
অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ। যা পুরাতন বা প্রাচীন তাই পুরাণ। দার্শনিক
তত্ত্ব ও সাধনাতত্ত্ব নানাবিধ উপাখ্যানের মাধ্যমে পুরাণ প্রচার করেছে। এ কারণেই
তার নাম পুরাণ। একটি সময় যখন বেদ গ্রন্থ পাঠ করা জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত কঠিন
হয়ে দাঁড়ায় তখন খ্রিস্টীয়পূর্ব পঞ্চম থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত পুরাণ গ্রন্থটি
সংকলিত হয়। পুরাণের লক্ষণ পাঁচটি। যেমন -- স্বর্গ, প্রতিস্বর্গ, বংশ, মন্বন্তর ও বংশানুচরিত। আবার পুরাণকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা
যেতে পারে। যেমন -- ক. মহাপুরাণ, খ. উপপুরাণ। উভয়ের
সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে বিষ্ণুপুরাণ, পক্ষপুরাণ, বায়ুপুরাণ, অগ্নিপুরাণ ও ভাবগত
পুরাণ অন্যতম। এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে পূজা-পার্বণ ও ব্রতকেন্দ্রিক করা হয়।
পূরাণে দেবদেবীদের মানবায়ন ও জীবের আকৃতি দেওয়া হয়। পুরাণেই হিন্দুধর্মের
পৌত্তলিকতা প্রকাশ পায়। এখানে অগ্নি,
গণেশ, বরুণ, দুর্গা, চণ্ডী ইত্যাদি পৌরাণিক দেবতার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
পুরাণগ্রন্থের মধ্যে গল্পকথা, রূপক, উপমা ও প্রতীকের আশ্রয় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এ
জন্য মানুষের কাছে পুরাণ অধিকতর জনপ্রিয়। এখানে সৃষ্টিতত্ত্ব, ইতিহাস, দার্শনিকতত্ত্ব ও
সাধকপ্রণালীর শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে দেবদেবীর নামে পূজার প্রচলন, দেবদেবীর মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
রামায়ণ : “রামায়ণ” একটি মহাকাব্য, সাহিত্য – ধর্মশাস্ত্র নয়। তা
সত্ত্বেও হিন্দুধর্মের অন্যতম শাস্ত্রগ্রন্থ হিসাবে রামায়ণ সমীহ আদায় করে নিয়েছে। বেদের শাশ্বত
সনাতন ধর্মগুলি ঐতিহাসিক কল্পকাহিনির মধ্য দিয়ে জনসমাজে প্রচার করা এ মহাকাব্যটির
মুখ্য উদ্দেশ্য। রামায়ণ হল প্রাচীন ভারতীয় সূর্যবংশীয় রাজাদের কাহিনি অবলম্বনে
মহর্ষি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। এই গ্রন্থটির রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ
শতকে। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবনী হল এই গ্রন্থের মূল কথা। এই
গ্রন্থটি সাত খণ্ডে বিভক্ত। রাম, সীতা, লক্ষণ এবং রাবণের জীবনাতিহাস এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এই
গ্রন্থে শ্লোক সংখ্যা হল মোট ১৮৮৫৫টি। রামায়ণে ধর্ম, রাজধর্ম, গার্হস্থ্য ধর্ম, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সকল দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাই
গো-বলয়ের অধিকাংশ হিন্দু এ গ্রন্থটিকে শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করে থাকে। এটি
হিন্দুদের কাছে পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
মহাভারত : “মহাভারত”ও “রামায়ণ”-এর মতো একটি মহাকাব্য, সাহিত্য – ধর্মশাস্ত্র নয়। তা
সত্ত্বেও হিন্দুধর্মের অন্যতম শাস্ত্রগ্রন্থ হিসাবে মহাভারত সমীহ আদায় করে নিয়েছে। বেদের শাশ্বত
সনাতন ধর্মগুলি ঐতিহাসিক কল্পকাহিনির মধ্য দিয়ে জনসমাজে প্রচার করা এ
ধর্মগ্রন্থটির মুখ্য উদ্দেশ্য। এটি ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস কর্তৃক সংস্কৃত
ভাষায় রচিত। চন্দ্রবংশীয় কুরু-পাণ্ডবদের ভ্রাতৃবিদ্বেষ ও যুদ্ব হল এর মূল
উপজীব্য। বড়োভাই ধৃতরাষ্ট্র ও ছোটোভাই পাণ্ডুর সন্তানদের মধ্যে কুরুক্ষেত্রে যে
যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধই হল এই মহাভারতের মূল ঘটনা। যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন পাণ্ডুর
সন্তানদের পক্ষে। আরও সেখানে ছিলেন অর্জুন। এখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে সকল উপদেশ
দিয়েছেন এবং মানবকূলের প্রতিনিধি হিসাবে অর্জুন যে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তার
সারাংশ হল শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা ( ধর্মবিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন “শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা”
হল
প্রক্ষিপ্ত, পরে সংযোজন করা হয়েছে)। আর
তার বিস্তারিতাংশ হল মহাভারত। মহাভারতের ধর্ম, রাজধর্ম, গার্হস্থ্য ধর্ম, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সকল দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাই
অধিকাংশ হিন্দু এ গ্রন্থটির শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করে থাকে। এই গ্রন্থে
বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে মিথ্যার বিরুদ্বে সত্যের জয় আর অন্যায় ও অসত্যের
পরাজায় দেখানো হয়েছে। মহাভারতের চরিত্রসমূহে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের
চাওয়াপাওয়া, লাভক্ষতি, লোভলালসা, আশা-নিরাশা, ধর্ম-অধর্ম ও পাপ-পূণ্যের প্রতীক।
উপনিষদ : উপনিষদ মূলত বেদেরই
একটি অংশ। যে গ্রন্থ পাঠে ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করা যায়, তাকে উপনিষদ বলে। এটি বেদের সর্বশেষ অংশ। এখান থেকে যেই
জ্ঞানার্জিত হয় তা হল গুহ্যজ্ঞান নামে খ্যাত। উপ ও নি পূর্বক সদ ধাতুর উত্ত্র
ক্বিপ প্রত্যয় যোগ উপনিষদ। সদ ধাতুর অর্থ হল প্রাপ্তি ও বিনাশ যা মানুষকে
ব্রহ্মের নিকটবর্তী করে তাকে উপনিষদ বলা হয়। ঈশ্বর কোথায় এবং কীভাবে বিরাজমান, মানুষ জগতের সঙ্গে
ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়ে উপনিষদে আলোচনা করা হয়েছে। যে জ্ঞানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের
সন্ধান পাওয়া যায় তাই হল উপনিষদ। উপনিষদে কেবলমাত্র ব্রহ্মা বা ঈশ্বর হল প্রধান
আলোচ্য বিষয়। উপনিষদে বলা হয়েছে, যে জগতের মূলে আছেন
এক ব্রহ্ম। ব্রহ্মের সাক্ষাৎ পেলেই জীবের মুক্তি ঘটে। অর্থাৎ, তিনি প্রাপ্তি একমাত্র জীবের কামনা। হিন্দুধর্মে উপনিষদ এক
যুগান্ত সৃষ্টি করেছিল -- মূর্তিপূজা নয়,
বরং এক
ঈশ্বর ভাবনার গভীর আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা যাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে রাজা রামমোহন
রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
উপনিষদ সংখ্যায় অনেক। বর্তমানে ১১২টি উপনিষদের নাম জানা গেছে। তার মধ্যে
-- (১) বৃহদারণ্যক, (২) শ্বেতাশ্বেতরো,
(৩)
ছন্দোগ্য, (৪) কেন এবং (৫) কব, (৬) ঐতরেয়, (৭) ঈশ, (৮) কঠ, (৯) প্রশ্ন, (১০) সন্তক
উল্লেখযোগ্য। উপনিষদ গ্রন্থের
মৌলিক শিক্ষা হল মানুষকে স্রষ্টার চিন্তা-চেতনার দিকে আগ্রহী করে তোলা, যাতে মানুষ তার স্রষ্টাকে চিনতে পারে।
হিন্দুধর্ম আজ একাধিক শাখায় বিভক্ত। অতীতে এই
ধর্ম ছয়টি দর্শনে বিভক্ত ছিল। বর্তমানে এগুলির মধ্যে কেবল বেদান্ত ও যোগেরই
অস্তিত্ব আছে। আধুনিক হিন্দুধর্মের প্রধান বিভাগগুলি হল বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, স্মার্তবাদ ও শাক্তধর্ম।
এছাড়াও একাধিক ছোটো বিভাগ বা উপবিভাগ লক্ষিত হয়, যাদের অনেকগুলিই পরস্পরের সঙ্গে অংশত আবৃত। তবে আজকের হিন্দুরা মোটামুটিভাবে
পূর্বোক্ত চারটি প্রধান শাখার কোনো-না-কোনো একটির সদস্য। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে অধিকতর
জটিল ও সূক্ষ্ম বিবেচনার নিরিখে একাধিক মতের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের দিকটি বিচার
করে ম্যাকড্যানিয়েল হিন্দুধর্মের আরও ছয়টি শাখাকে চিহ্নিত করেছেন। এই বিভাগগুলি
হল -- লৌকিক হিন্দুধর্ম : বিভিন্ন স্থানীয় ঐতিহ্য ও লৌকিক দেবদেবীর পুজোকে
কেন্দ্র করে আঞ্চলিক বা সম্প্রদায় স্তরের ধর্মবিশ্বাস যা প্রাগৈতিহাসিক কাল বা
অন্ততপক্ষে বেদ রচিত হবার আগে থেকে প্রচলিত। বৈদিক হিন্দুধর্ম : এই বিশ্বাসটি এক
শ্রেণির ব্রাহ্মণ (বিশেষত শ্রুতিবাদী) সমাজে আজও প্রচলিত। বৈদান্তিক হিন্দুধর্ম :
উপনিষদের শিক্ষা অবলম্বনে প্রচারিত। উদাহরণ –
অদ্বৈত
(স্মার্তবাদ)। যৌগিক হিন্দুধর্ম : পতঞ্জলি রচিত যোগসূত্র অবলম্বনে প্রচারিত।
ধার্মিক হিন্দুধর্ম বা প্রাত্যহিক নৈতিকতা : কর্ম ও হিন্দুবিবাহ সংস্কার ইত্যাদি
সামাজিক নিয়মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাখা। ভক্তিবাদ : বৈষ্ণবধর্মের অনুরূপ
ভক্তিকেন্দ্রিক মতবাদ। হিন্দুধর্মে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গির সহাবস্থান লক্ষ করা যায়।
হিন্দুধর্ম বলতে কোনো একটি বিশেষ ধরনের ধর্ম সম্বন্ধীয় অভিজ্ঞতাকে বোঝায় না; বরং এ ধর্মে বিভিন্ন মনীষী ও মহাপুরুষদের দ্বারা প্রাপ্ত
ধর্ম সম্বন্ধীয় বিভিন্ন অভিজ্ঞতার একত্র সংযোগ লক্ষ করা যায়। কাজেই এই ধর্মে
পরস্পরবিরোধী বিশ্বাস লক্ষ করা যায়।
হিন্দুধর্ম পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসের
সহাবস্থান সংবলিত বৈচিত্র্যময় ধর্ম। এমন বিচিত্র ব্যাপার প্রচলিত
ধর্মসমূহের আর কোনোটিতেও দেখা যায় না।
হিন্দুধর্ম বর্জন করা যায় অনায়াসেই, অবলীলায়। হিন্দুধর্ম গ্রহণ করার কোনো পথ খোলা নেই, কোনো শাস্ত্রীয় বিধান নেই। কেউ হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন
এমনটা শোনা যায় না। হিন্দুধর্ম থেকে অন্য ধর্মে চলে যাওয়াটা বেশ শোনা যায়। এত হয়
যে তা বেশ উদবেগজনক। এত ধর্মান্তর অন্য কোনো ধর্মে হয় কি না আমার জানা নেই। দলে
দলে নিন্মবর্গের হিন্দুরা হিন্দুধর্ম থেকে বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টধর্মে
ধর্মান্তরিত হয়েছেন। শুধু নিন্মবর্গেরই-বা বলি কেন, উচ্চবর্ণেও ধর্মান্তরিত কম হয় না। এই মুহূর্তে হিন্দু গায়ক সুমন
চট্টোপাধ্যায়ের ধর্মত্যাগ করে কবীর সুমন হওয়ার ঘটনা তো সবাই জানে। ভারতের হিন্দুরা
সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন,
পরের
পছন্দ খ্রিস্টধর্ম, তৃতীয় পছন্দ
বৌদ্ধধর্ম। এই হিন্দুরা আসলে নতুনপ্রাপ্ত ধর্মকে উৎকৃষ্ট প্রমাণ করাতে চেয়েছেন, ফেলে আসা ধর্মকে নিকৃষ্ট প্রতিপন্ন করেছেন।এরাই বেশি বেশি
হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে পড়েন। সেই কারণেই ভারত উপমহাদেশে (পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ) হিন্দু-মুসলমানের এত বৈরিতা, এত ঘৃণা।ঠিক একই কারণে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে ইহুদি এবং
খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে বৈরিতা লক্ষ করা যায়।
হিন্দুধর্ম পাঁচটি প্রধান সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে
আছে। শৈবধর্ম বা শৈবপন্থ, বৈষ্ণবধর্ম, শাক্তধর্ম, গাণপত্য ধর্ম ও
স্মার্তধর্ম।
শৈবধর্ম বা শৈবপন্থ : শৈবধর্মের
অনুগামীদের "শৈব" নামে অভিহিত করা হয়। শৈবধর্মে শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা
বলে মনে করা হয়। শৈবধর্মের অনুগামীরা তাঁকেই সৃষ্টা, পালনকর্তা, ধ্বংসকর্তা, সকল বস্তুর প্রকাশ ও গোপনকর্তা বলে মনে করেন। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় শৈবধর্ম সুপ্রচলিত। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার
মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াতেও
শৈবধর্মের প্রসার লক্ষ করা যায়। শৈবধর্মের প্রাচীন ইতিহাস নিরূপণের কাজটি
দুঃসাধ্য। গুপ্তযুগে (৩২০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ) পৌরাণিক হিন্দুধর্ম বিকাশলাভ করে।
এই সময়ই শৈবধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। ক্রমে পৌরাণিক উপাখ্যানের কথক ও
গায়কদের মাধ্যমে এই ধর্ম সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
শৈবধর্মের প্রধান শাখাগুলি স্থান, প্রথা ও দর্শন ভেদে শৈবদের ভিন্ন ভিন্ন শাখা রয়েছে।
শৈবধর্মের সুবিশাল ধর্মীয় সাহিত্যে একাধিক দার্শনিক মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর
মধ্যে "অভেদ" (অদ্বৈত),
"ভেদ"
(দ্বৈত) ও "ভেদাভেদ" (অদ্বৈত ও দ্বৈতের মিশ্রণ) শাখা বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য। শৈব ধর্মগ্রন্থ ও সাহিত্য “শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ্” (রচনাকাল: খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ২০০ অব্দ) শৈবদর্শনের
প্রাচীনতম গ্রন্থ। এই গ্রন্থেই প্রথম শৈব দর্শন সুসংহতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, অগ্নিপুরাণ ও বায়ুপুরাণ হল শৈবদের প্রধান পুরাণ গ্রন্থ।
এগুলি সবকটিই মহাপুরাণ। শৈবদের প্রধান উপপুরাণগুলি হল শিবপুরাণ, সৌরপুরাণ, শিবধর্ম পুরাণ, শিবধর্মোত্তরপুরাণ,
শিবরহস্যপুরাণ, একাম্রপুরাণ, পরাশরপুরাণ, বশিষ্ঠলৈঙ্গপুরাণ ও বিখ্যাদপুরাণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য”
প্রবন্ধে
লিখেছেন, “কবিকঙ্কণে দেবী এই-যে ব্যাধের
দ্বারা নিজের পূজা মর্তে প্রচার করিলেন,
স্বয়ং
ইন্দ্রের পুত্র যে ব্যাধরূপে মর্তে জন্মগ্রহণ করিল, বাংলাদেশের এই লোকপ্রচলিত কথার কি কোনো ঐতিহাসিক অর্থ নাই? পশুবলি প্রভৃতির দ্বারা যে ভীষণ পূজা এক কালে ব্যাধের মধ্যে
প্রচলিত ছিল সেই পূজাই কি কালক্রমে উচ্চসমাজে প্রবেশলাভ করে নাই? কাদম্বরীতে বর্ণিত শবর-নামক ক্রুরকর্মা ব্যাধজাতির
পূজাপদ্ধতিতেও ইহারই কি প্রমাণ দিতেছে না?
উড়িষ্যাই
কলিঙ্গদেশ। বৌদ্ধধর্ম-লোপের পর উড়িষ্যার শৈবধর্মের প্রবল অভ্যুদয় হইয়াছিল, ভুবনেশ্বর তাহার প্রমাণ। কলিঙ্গের রাজারাও প্রবল রাজা
ছিলেন। এই কলিঙ্গরাজত্বের প্রতি শৈবধর্ম-বিদ্বেষীদের আক্রোশ-প্রকাশ ইহার মধ্যেও
দূর ইতিহাসের আভাস দেখিতে পাওয়া যায়”।
মূলত সূর্যপূজা পরবর্তী পর্বে শৈবধর্ম প্রভাবে
শিব পূজাকে অনেক সময় গম্ভীরা বুঝানো হত। সূর্যপূজায় সূর্য ছিলেন ধর্ম ঠাকুর। সেন
রাজাদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, তাঁরা ছিলেন
চন্দ্রবংশীয় 'ব্রহ্মক্ষত্রিয়' (যাঁরা আদিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে কোনো কারণে ক্ষত্রিয়ের পেশা গ্রহণ করেন।) কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সেনরা প্রথমে জৈন আচার্য বংশোদ্ভূত ছিলেন। পরে শৈবধর্ম
গ্রহণ করেন। কিন্তু এই মত নিয়ে বিতর্ক আছে। শৈবধর্ম প্রভাবিত দক্ষিণ ভারতে
খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে বৈষ্ণবধর্মের প্রসার ঘটে।
এই অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্ম আজও প্রচলিত। তামিলনাড়ুতে বারোজন অলভর সন্ত ভক্তিমূলক
স্তোত্ররচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষ্ণবধর্মকে ছড়িয়ে দেন।
বৈষ্ণব ধর্ম : ঠিক কবে থেকে বৈষ্ণব
ধর্মের উদ্ভব, প্রচার ও প্রসার আরম্ভ হয় --
এ সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা প্রায় অসম্ভব। সপ্তম শতকেই শ্রীধারণরাত ছিলেন
পরম বৈষ্ণব এবং পুরুষোত্তমের ভক্ত উপাসক;
তিনি
আবার পরম কারুণিকও ছিলেন এবং শাস্ত্রনিয়ম ছাড়া অযথা প্রাণীবধের বিরোধী ছিলেন।
পৌরাণিক বিষ্ণুর বিভিন্ন রূপ ও ধ্যানের সঙ্গে সমসাময়িক বাঙালির পরিচয় ছিল। রংপুর
জেলায় প্রাপ্ত একাধিক ধাতু নির্মিত বিষ্ণু-মূর্তি ও একটি অনন্ত শয়ান বিষ্ণু-মূর্তি, বরিশাল জেলার লক্ষণকাটির গরুরবাহন এবং সপরিবার বিষ্ণু, রাজশাহী জেলায় যোগীর সওয়ান নামেপ্রাপ্ত বিষ্ণু-মূর্তি, মালদহ জেলার হাঁকরাইল গ্রামে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তি ঢাকা
জেলার সাভার গ্রামে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ এক বিষ্ণুর প্রতিমা প্রভৃতি
সমস্তই এই পর্বের। বৈষ্ণব ধর্ম, গুপ্তযুগের পূর্বেই
বাংলাদেশে পরিচিতি লাভ করে এবং সাদরে গৃহীত হয়। বিশেষ করে পূর্ব বাংলার রাজন্যবর্গ
থেকে আরম্ভ করে শূদ্ররা পর্যন্ত এ ধর্মের ভক্ত ছিল। আজও বাংলাদেশের কৈবর্ত
সম্প্রদায় ও নিন্মবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে বৈষ্ণবধর্মের যথেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা ও
গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে যুক্ত
কৃষ্ণায়ণ ও রামায়ণ-কাহিনি যে গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বেই বাংলাদেশে প্রচার ও প্রসার
লাভ করেছিল তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়পুর মন্দিরের পোড়ামাটির ও পাথরের
ফলকগুলোতে। জয়দেবের (দ্বাদশ শতক) পূর্বেই কোনও সময়ে, এই বাংলাদেশেই রাধাতত্ত্ব ও রাধার রূপ-কল্পনা সৃষ্টিলাভ করেছিল বলে ধারণা করা
হয়। বস্তুত বৈষ্ণব ধর্মের রাধা শাক্তধর্মের শক্তিরই বৈষ্ণব রূপান্তর ও নামান্তর
মাত্র। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের লোকায়ত বাঙালি জীবনে কৃষ্ণলীলা ও রামায়ণের কাহিনি
যথেষ্ঠ প্রসার ও সমাদর লাভ করেছিল এবং এই কৃষ্ণলীলা ও রামায়ণ আশ্রয় করে
বৈষ্ণবধর্মের সীমাও বিস্তৃত হয়েছিল।
বৈষ্ণবধর্ম এবং প্রেমের ধর্ম আসলে তাই, যা গীতা নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। আদিতে বিষ্ণুপ্রেম
কৃষ্ণপ্রেমে রূপান্তরিত হলেও রাধার অস্তিত্ব জানা ছিল বলে ধারণা করা যায় না। কাজেই
দেবীরাধার আগমন স্বভাবতই আরও অনেক পরের ঘটনা। সম্ভবত সেন পর্বের পরেই রাধা-কৃষ্ণের
লীলাভিত্তিক প্রেম নির্ভর ভক্তের ধর্ম সঞ্চারিত ও পল্লবিত হয়ে ওঠে।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে
ভক্তরা বলেন মহাপ্রভূ। সব মিলিয়ে নাম তাঁর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভূ। শ্রীচৈতন্য
মধ্যযুগে (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে) আর্যাবর্তেও বৈদিকধর্মের
চতুর্বর্ণ প্রথার (Caste System) নিষ্পেষণ এবং বিদেশি
শাসকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক অহিংস আধ্যাত্মিক আন্দোলনের সঞ্চার করেন, যার নাম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম। ধর্মগুরু আর রাজ-শাসনের
অত্যাচারে জর্জরিত বাংলার দিশেহারা অন্ত্যবর্ণ সাধারণ জনগণকে তিনি মুক্তির পথ
দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিজের
পায়ে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে। তাঁর আবির্ভাবে এবং
কর্মতৎপরতায় গণমানুষের উদ্যোগে তৎকালীন সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। মানুষ হিসেবে
জন্মলাভ করে স্বাভাবিক মনুষ্য জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। ধর্মের জন্য মানুষ না-হয়ে
মানুষের জন্য ধর্ম -- এই বোধ সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব সাহিত্যের নতুন ধারা
সৃষ্টি হয়, যা গণমানুষকে জাগাতে সাহায্য
করে। বাংলার সংস্কৃতিতে উদারনৈতিকতা, সহনশীলতা ও সাহসিকতার
রূপান্তর ঘটে।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন বাঙালি সভ্যতাকেও ভারতীয়
হিন্দু সভ্যতা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। তাই, বাঙালির গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মকে আর্যাবর্তের বৈদিক ধর্ম থেকে
পুরোপুরি আলাদা মনে করাই সংগত। ধর্মতত্ত্বের ইতিহাসে দেখা যায়, কোন ধর্ম ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ না-থাকলেও প্রতিটি ধর্মের
আবির্ভাব ঘটেছে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায়, সেখানকার সামাজিকসাংস্কৃতিক সংকট সমস্যাকে কেন্দ্র করে। যেমন ইসলামের উদ্ভব
হয়েছে আরবের মক্কায় হজরত মোহাম্মদের
মাধ্যমে সেকালের ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ থেকে মুক্তিকে কেন্দ্র করে। ঠিক তেমনই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মও
এসেছে প্রাচীন বাংলার বাঙালি শ্রীচৈতন্যের মাধ্যমে তৎকালীন হিন্দুধর্মের চতুর্বর্ণ
প্রথা, বিদেশি শাসকদের নিপীড়ন এবং
হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের এলিটদের জোরজবরদস্তি থেকে ব্রাত্যজনের মুক্তির
বার্তা নিয়ে। আর খ্রিস্টপূর্ব প্রায় চার-পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে বৃহত্তর বাংলাদেশ তৎকালীন ভারত থেকে সবদিক থেকে
স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। তাই
হিন্দুসভ্যতা বা হিন্দুধর্মের সঙ্গে বাঙালি সভ্যতা বা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মকে এক করা
ঠিক নয়। বাইবেলের অনুসারী হলেও হযরত মুসা ইহুদি ধর্ম আর হজরত ঈসা মসিহের খ্রিস্টান
ধর্ম যেমন আলাদা, তেমনই
গীতা-উপনিষদ-পুরাণের অনুসারী হলেও আর্য বা
বৈদিক ধর্ম আর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মও আলাদা।
ডক্টর অতুল সুরের মতে, “চৈতন্যের প্রবর্তিত ধর্মেই বাঙালি জাতির প্রথম জাগরণ।
বাঙালির চিন্তাধারাকে চৈতন্যের ধর্মই প্রথম আধুনিকতার দিকে প্রবাহিত করেছিল”। ভাষাতাত্ত্বিক
সলিমুল্লাহ খানের মতে, “ষোলো শতকে
শ্রীচৈতন্যের সময় থেকে তাঁর হাত ধরেই বাংলায় আধুনিকতা শুরু হয়। মানবতার বাণীর
সফলতা বাংলায় ইউরোপীয় সভ্যতার সমসাময়িক”।
শাক্তধর্ম : শাক্তধর্ম
হিন্দুধর্মের আর-একটি শাখাসম্প্রদায়। হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও
সর্বোচ্চ ঈশ্বর – এই মতবাদের উপর
ভিত্তি করেই শাক্তধর্মের উদ্ভব। এই ধর্মমতাবলম্বীদের শাক্ত নামে অভিহিত করা হয়।
হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি বিভাগের অন্যতম শাক্তধর্ম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অন্য দুটি বিভাগ হল বৈষ্ণবধর্ম ও শৈবধর্ম। শাক্তধর্ম
আক্ষরিক অর্থে শক্তিবাদ। হিন্দুধর্মের একটি শাখা সম্প্রদায়। শাক্তধর্মের উদ্ভব
ঘটেছে “দিব্য মাতৃকাশক্তি বা দেবী
পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর” মতবাদের উপর ভিত্তি
করে। শাক্তধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম ও শৈবধর্ম
— হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি
বিভাগের মধ্যে শাক্তধর্ম অন্যতম। শাক্তধর্মে দেবী হলেন পরব্রহ্ম। অন্য সব দেবদেবী
তাঁর রূপভেদমাত্র। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। অন্য সকল দেব ও দেবী তাঁর রূপভেদমাত্র।
দর্শন ও ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে শাক্তধর্মের সঙ্গে শৈবধর্মের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়।
যদিও শাক্তরা কেবলমাত্র ব্রহ্মের শক্তিস্বরূপিণী নারীমূর্তিরই পুজো করে থাকেন। এই
ধর্মে ব্রহ্মের পুরুষ রূপটি হল শিব। তবে তাঁর স্থান শক্তির পরে এবং তাঁর পুজো
সাধারণত সহায়ক অনুষ্ঠান রূপে পালিত হয়ে থাকে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ভারতে শক্তিপুজো
প্রচলিত। ২২,০০০ বছরেরও আগে ভারতের
প্যালিওলিথিক জনবসতিতে প্রথম দেবীপুজোর প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে সিন্ধু
সভ্যতার যুগে এই সংস্কৃতি আরও উন্নত রূপে দেখা দেয়। বৈদিক যুগে শক্তিবাদ
পূর্বমর্যাদা হারালেও পুনরায় ধ্রুপদী সংস্কৃত যুগে তার পুনরুজ্জীবন ও বিস্তার
ঘটে। তাই মনে করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই
"হিন্দু ঐতিহ্যের ইতিহাস নারী পুনর্জাগরণের ইতিহাস রূপে লক্ষিত হয়"।
শাক্তধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংস্কৃত সাহিত্য ও হিন্দুদর্শনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ
গ্রন্থকে অনুপ্রেরণা জোগান দিয়েছিল শক্তিবাদ এবং হিন্দুধর্মের উপর এই মতবাদের প্রভাব
অপরিসীম। ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার বাইরেও বহু অঞ্চলে তান্ত্রিক ও অতান্ত্রিক পদ্ধতি
সহ একাধিক পন্থায় শাক্ত ধর্মানুশীলন চলে। যদিও এই ধর্মের বৃহত্তম ও সর্বাধিক
প্রচলিত উপ-সম্প্রদায় হল দক্ষিণ ভারতের শ্রীকুল (ত্রিপুরসুন্দরী বা শ্রী আরাধক
সম্প্রদায়) এবং উত্তর ও পূর্ব ভারতের,
বিশেষত
বঙ্গদেশের কালীকুল (কালী আরাধক সম্প্রদায়)। শাক্ত বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবীই সর্বোচ্চ ও পরম দৈবসত্ত্বা। তিনিই সমগ্র সৃষ্টির উৎস
ও স্বরূপ এবং সর্বজীবের শক্তি ও চালিকা। শাক্ত মতবাদ দৈব নারীসত্তায় কেন্দ্রীভূত
হলেও তা পুরুষ বা জড় দৈবসত্ত্বাকে অস্বীকার করে না। যদিও মনে করা হয় যে এই উভয়
প্রকার দৈবসত্তায় শক্তির উপস্থিতি বিনা নিষ্ক্রিয়। আদি শংকর তাঁর প্রসিদ্ধ শাক্ত
স্তোত্র সৌন্দর্যলহরীর প্রথম পংক্তিতে বলেছেন, “শক্তির সহিত মিলিত হইলে শিব সৃষ্টিক্ষম হন; না হইলে তাঁহার আলোড়ন তুলিবার ক্ষমতা পর্যন্ত নাই।” এই হল শাক্তধর্মের
মূলতত্ত্ব। আপাতদৃষ্টিতে
প্রাণহীন শিবের দেহের উপর দণ্ডায়মান দেবী কালীর বহুপরিচিত মূর্তিটি এই তত্ত্বেরই
মূর্তরূপ।
সাধারণভাবে,
শক্তিকেই
মহাবিশ্ব মনে করা হয়। তিনি বলশালিতা ও কর্মক্ষমতার মূর্ত প্রতীক। তিনি পার্থিব
জগতের অস্তিত্ব ও সকল ক্রিয়ার পশ্চাতে বিদ্যমান কারণস্বরূপা ঐশীশক্তি। শিব তাঁর
সহকারী পুরুষ সত্ত্বা; তিনি সমগ্র সত্ত্বার
দিব্যক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। "শিব বিনা শক্তি অথবা শক্তি বিনা শিবের কোনো
অস্তিত্ব নাই”। ঐতিহাসিক ভি. আর. রামচন্দ্র
দীক্ষিতের মতে, “শাক্তধর্ম হল জীবনবাদী
হিন্দুধর্ম। শাক্তধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত রয়েছে চৈতন্যরূপে শক্তির স্বীকৃতি ও
শক্তি ও ব্রহ্মের সত্তাপরিচিতির মধ্যে। সংক্ষেপে বললে, ব্রহ্ম হল জড়রূপী শক্তি ও শক্তি হল জীবনরূপী ব্রহ্ম।” ধর্মীয় শিল্পকলায় অর্ধশক্তি-অর্ধশিব দেবতা অর্ধনারীশ্বর
মূর্তিতে এই বিশ্বজীবনতত্ত্ব জোরালোভাবে মূর্ত হয়েছে।
শাক্তধর্ম মনে করে, শিব সহ কার্যত সৃষ্টির দৃশ্য ও অদৃশ্য “সবেরই” উৎস, সার ও সত্তা হলেন
দেবী। প্রধান শাক্ত ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ-এ দেবী ঘোষণা করেছেন -- "আমিই
প্রত্যক্ষ দৈবসত্ত্বা, অপ্রত্যক্ষ
দৈবসত্ত্বা, এবং তুরীয় দৈবসত্ত্বা। আমি
ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। আবার আমিই
সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতী। আমি সূর্য, আমি নক্ষত্ররাজি,
আবার
আমিই চন্দ্র। আমিই সকল পশু ও পাখি। আবার আমি জাতিহীন, এমনকি তস্করও। আমি ভয়াল কর্মকারী হীন ব্যক্তি; আবার আমিই মহৎ কার্যকারী মহামানব। আমি নারী, আমি পুরুষ, আমিই জড়।"
ধর্মবিশারদ সি. ম্যাককেঞ্জি ব্রাউন শাক্তধর্মের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, "স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, দুই লিঙ্গের মধ্যে নারীসত্ত্বাই মহাবিশ্বের প্রধান
শক্তিস্বরূপা। যদিও সত্যকারের পরম সত্ত্বাকে পেতে দুই লিঙ্গকেই পরম সত্ত্বার সঙ্গে
যোগ করতে হবে। পুরুষ ও নারী দৈবসত্ত্বার দুই রূপ। তুরীয় সত্য তাঁদের নিয়েই
তাঁদের বাইরে প্রসারিত হয়েছে। এইভাবেই চৈতন্যরূপা দেবী লিঙ্গকে অতিক্রম করেন।
কিন্তু তাঁর এই অতিক্রমকরণ তাঁর সর্বেশ্বরবাদী সত্ত্বার বাইরে ঘটে না।"
ব্রাউন আরও লিখেছেন, "বাস্তবিক, তুরীয় ও সর্বেশ্বরবাদী সত্ত্বার এই স্বীকৃতি দিব্য জননী
সর্বোচ্চ বিজয়ের সারবত্তা। এমন নয় যে তিনি শেষাবধি পুরুষ দেবতাদের তুলনায়
অনন্তভাবে শ্রেষ্ঠতর। যদিও শাক্তধর্ম মতে তিনি তা-ই। কিন্তু তিনি প্রকৃতি রূপে
তাঁর নারীসত্ত্বাকে অতিক্রম করেন, তাকে অস্বীকার না
করেই।"
গাণপত্য ধর্ম : গাণপত্য ধর্ম হল
হিন্দুধর্মের একটি শাখাসম্প্রদায়। গণেশকে সর্বোচ্চ দেবতা স্বীকার করে গাণপত্য
সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। গণেশ সংক্রান্ত প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল গণেশপুরাণ, মুদগলপুরাণ ও গণপতি অথর্বশীর্ষ। পুরাণ ও কাব্যে গণেশের
উপস্থিতি লক্ষণীয়। এই সম্প্রদায়ের অনুগামীরা গণেশকে সগুণ ব্রহ্ম রূপে পূজা করে।
হিন্দুধর্মে গণেশ পূজা যে-কোনো পুজোরই একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ। সকল সম্প্রদায়ের
হিন্দুরাই প্রার্থনা, কাজকর্ম বা ধর্মীয়
কৃত্য শুরু করেন গণেশকে আবাহন করে। আদি শঙ্কর প্রবর্তিত পঞ্চদেবতা পুজোতে যে
পাঁচজন দেবতাকে পুজো করা হয় তাঁরা হলেন গণেশ, শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও দুর্গা।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে শৈবরা গণেশ পূজা
করেন বলে জানা যায়। সম্ভবত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়
গাণপত্য ধর্মের উদ্ভব ঘটে। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে এই সম্প্রদায় বিশেষ
প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। পরে মোরয়া গোসাবি এই ধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায়
সপ্তদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় মহারাষ্ট্র অঞ্চলে গাণপত্য সম্প্রদায়
বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করে। এখনও উচ্চবর্ণীয় মারাঠিদের মধ্যে ও দক্ষিণ ভারতে এই
মত বিশেষ জনপ্রিয়। এই সম্প্রদায়ের অনুগামীরা কপালে লাল ফোঁটা ও কাঁধে হাতির মুখ
ও দাঁত আঁকেন।
স্মার্তধর্ম : স্মার্ত মতটি অনেক
উদারপন্থী। তাঁরা মনে করেন, সকল দেবতাই সর্বোচ্চ
ঈশ্বর ব্রহ্মের স্বরূপ। তাই তাঁরা দেবতা নির্বাচনের ভারটি ভক্তের উপর ছেড়ে দেন।
অবশ্য এও মনে রাখতে হবে যে, স্মার্ত মতটি
হিন্দুধর্মে বহুল প্রচলিত হলেও, প্রধান মত নয়। সনাতন
ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধী তান্ত্রিক ধর্ম স্ত্রীলোক ও শূদ্রকে ধর্মাচরণে পর্যাপ্ত
অধিকার দেয়। এরূপ একটি অবস্থার সম্মুখীন হয়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজের নেতারা
স্মৃতিনিবন্ধসমূহ রচনা করে শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধের নিগড়ে জনগণকে নিয়ন্ত্রিত
করতে প্রয়াসী হন। ফলে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলায়ও স্মার্তসম্প্রদায়
গড়ে ওঠে এবং রচিত হয় অসংখ্য স্মৃতিগ্রন্থ। বঙ্গীয় বা গৌড়ীয় স্মার্ত
সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটে তিনটি যুগ ধরে রঘুনন্দন-পূর্বযুগ, রঘুনন্দনযুগ ও রঘুনন্দনোত্তর যুগ। রঘুনন্দন-পূর্বযুগের
স্মার্তদের মধ্যে প্রাচীনতম ভবদেব ভট্ট আনুমানিক ৮০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে
কোনোও এক সময় আবির্ভূত হন। তিনি বালক,
জিকন
প্রভৃতি নামে যে প্রাচীনতর স্মার্তদের উলে¬খ করেছেন, তাঁরা বাঙালি হলেও
তাঁদের কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি, প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ (বা নিরূপণ) ভবদেব রচিত সুবিদিত
স্মৃতিগ্রন্থ। সেযুগের অপর বিখ্যাত স্মৃতিকার জীমূতবাহনের দায়ভাগ বাঙালি
হিন্দুদের সম্পত্তির স্বত্বাধিকার ও উত্তরাধিকারক্রম সম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা
প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। কৌলীন্যপ্রথার প্রবর্তক রাজা বল্লালসেনের
নামাঙ্কিত দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর দুটি সুপরিচিত স্মৃতিগ্রন্থ। তাঁর গুরু অনিরুদ্ধ
হারলতা ও পিতৃদয়িতা রচনা করেন। লক্ষ্মণসেনের কর্মাধ্যক্ষ বা প্রধান বিচারপতি
হলায়ুধের ব্রাহ্মণসর্বস্বও একখানা প্রামাণিক গ্রন্থ। শূলপাণি অন্তত এগারোখানি স্মৃতিনিবন্ধ রচনা
করেছিলেন। তাঁর শ্রাদ্ধবিবেক ও প্রায়শ্চিত্তবিবেক দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
স্মৃতিরত্নহার রায়মুকুট বৃহস্পতি মিশ্র (আনু. পঞ্চদশ শতকের পূর্বার্ধ) কর্তৃক
রচিত। রঘুনন্দনের গুরু শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণি রচিত বহু নিবন্ধের মধ্যে
কৃত্যতত্ত্বার্ণব একখানা বিখ্যাত স্মৃতিগ্রন্থ। এই যুগের কুল্লুকভট্ট মনুস্মৃতির
জনপ্রিয় টীকা মন্বর্থমুক্তাবলি রচনা করেন। বাংলায় স্মৃতিশাস্ত্রের ইতিহাসে
যুগস্রষ্টা ছিলেন রঘুনন্দন ভট্টাচার্য
(পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক)। তাঁর মলমাসতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ২৮খানা তত্ত্ব অর্থাৎ স্মৃতিগ্রন্থ
রচনা করেছিলেন। সেগুলির দ্বারা দীর্ঘকাল বাংলার হিন্দুসমাজ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
স্মৃতিশাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াও রঘুনন্দনের সমাজ-সংস্কারকের
দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যে তন্ত্রশাস্ত্র ব্রাহ্মণসমাজে উপেক্ষিত ছিল, তার বিপুল জনপ্রিয়তা লক্ষ করে রঘুনন্দন সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে
তান্ত্রিক দীক্ষাকে স্বীকৃতি দেন। জ্যেষ্ঠার পূর্বে কনিষ্ঠা ভগ্নীর বিবাহ নিন্দিত
হলেও তিনি বিধান দেন যে, বিশেষ কোনো কারণে
জ্যেষ্ঠার বিবাহ বিলম্বিত হলে কনিষ্ঠার বিবাহে কোনো দোষ নেই। তাঁর প্রায় সমকালীন
গোবিন্দানন্দ দানক্রিয়াকৌমুদী, বর্ষক্রিয়াকৌমুদী
প্রভৃতি চারখানি গ্রন্থ ছাড়াও শূলপাণির প্রায়শ্চিত্তবিবেক ও শ্রীনিবাসের
শুদ্ধিদীপিকার টীকা রচনা করেছিলেন। রঘুনন্দনোত্তর যুগের অধিকাংশ স্মৃতিগ্রন্থই হয়
মূল গ্রন্থসমূহের সংক্ষিপ্তসার, না হয় পৌরোহিত্যের
উপযোগী প্রয়োগবিষয়ক। তবে এই যুগের প্রখ্যাত স্মার্ত পন্ডিত চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার স্বাধীন চিন্তার
স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর উদ্বাহচন্দ্রালোক,
শুদ্ধিচন্দ্রালোক
ও ঔর্ধ্বদেহিক চন্দ্রালোক নামক তিনটি গ্রন্থে। তিনি নানা বিষয়ে রঘুনন্দনের মত
খণ্ডন করে নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসকদের বিচার-কার্যের সুবিধার্থে
তাঁদেরই উদ্যোগে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন এবং
বাণেশ্বর বিদ্যালংকার অপর কযেকজনের
সহযোগিতায় যথাক্রমে বিবাদভঙ্গার্ণব ও
বিবাদার্ণবসেতু নামক দু-খানি স্মৃতিগ্রন্থ
সংকলন করেন।
স্মৃতিগ্রন্থসমূহে আলোচিত বিষয়গুলিকে মোটামুটি
তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন-- আচার, প্রায়শ্চিত্ত ও ব্যবহার। কোনো কোনো গ্রন্থে মৈথিল, উড়িয়া ও কামরূপীয় গ্রন্থের উল্লেখ আছে। সেসবের কিছু
মতামতও খন্ডন করা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থে
দুর্গাপুজো সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে কুমারীপুজোকে অপরিহার্য
বলা হয়েছে। দশমীকৃত্যের মধ্যে শবরোৎসব বিহিত হয়েছে। এতে ভক্তরা গায়ে লতাপাতা
জড়িয়ে কাদা মেখে পরস্পর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে।
আইন-কানুনবিষয়ক কোনো কোনো ক্ষেত্রে
স্মৃতিশাস্ত্রগুলি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার পার্থক্য সৃষ্টি করেছে।
যেমন, জীমূতবাহনের মতে পিতার
মৃত্যুর পর তার সম্পত্তিতে পুত্রের অধিকার জন্মে, কিন্তু ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে জন্মমাত্রই পুত্র পিতার সম্পত্তির অংশভাগী হয়।
এই আইন ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব বলবৎ ছিল। স্মৃতিনিবন্ধসূত্রে প্রতিফলিত সমাজে দেখা
যায়, প্রাচীন শাস্ত্রানুসারে
যোগ্যপাত্রের অভাবে কন্যা আমরণ পিতৃগৃহে থাকবে, তথাপি অযোগ্য পাত্রে তাকে সমর্পণ করা উচিত নয়। উল্লিখিত অদ্ভুতসাগরে নানা
প্রকার অশুভ লক্ষণ এবং সেগুলির প্রতিকার সম্পর্কে লোকবিশ্বাস দেখা যায়।
রঘুনন্দনের মতে কিছু অশুভ লক্ষণ হলো: গাছে অকালে ফুল ফোটা বা ফল ধরা, মাথায় কাক বা শকুনের পতন, গৃহোপরি বানর, পেঁচক প্রভৃতির
অবস্থান ইত্যাদি। বর্তমানে আধুনিক শিক্ষার প্রভাব এবং সমাজ পরিবর্তনের ফলে
স্মৃতিশাস্ত্রের এসব বিধিনিষেধ আগের মতো পালিত হয় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি
ক্ষেত্রে স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভাব অনেকটাই অটুট রয়েছে।
এছাড়া হিন্দুধর্মে আরও একটি সম্প্রদায়ের কথা জানা
যায় – সে সম্প্রদায়ের নাম সৌরধর্ম।
আদিম উপজাতি সমাজে কুষ্ঠরোগ বরাবরই ব্যাপক আকারে ছিল (স্মর্তব্য কোণার্ক মন্দিরের
কৃষ্ণপুত্র শাম্ব সম্পর্কিত উপাখ্যান)। এই রোগের দূরীকরণের জন্য তারা সূর্য দেবতার
উপাসনা করত । কুষ্ঠরোগের থেকে নিরাময়ের আশায় সূর্যপুজো । শবর জাতির প্রধান দেবতা আবার
উইউংসুন, যিনি ক্রুদ্ধ হলে কুষ্ঠরোগ
বিতরণ করেন এবং তাকে শান্ত রাখার জন্য উইউংসুন পুজো । আবার আর্যদের মধ্যেও
সূর্যদেবতার পুজো প্রচলিত ছিল । তার সঙ্গে ছিল পুরাকালে সূর্যদেবের রথযাত্রার
কল্পনা। এখনও ইটালির সিসিলি দ্বীপে সূর্যের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যা আর্যদের একত্র থাকার সময় সূর্যের রথযাত্রার কল্পনার
উদ্ভবের পরিচায়ক হতে পারে। সুতরাং, শবরদের আর্য বশ্যতা
স্বীকার করানোর কূটনৈতিক আর-একটি দিক এই রথযাত্রা। ধারণা করা হয় শৈব বা বৈষ্ণবদের
মত আর্যদের মধ্যে আর-একটি ধর্মবিশ্বাস ছিল যার নাম সৌরধর্ম। পরবর্তীতে শৈব বা
বৈষ্ণবদের কাছে তারা রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে তারা পরাজিত হয়। মহাভারতে সূর্যপুত্র
কর্ণের বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের সমর্থকদের কাছে পরাজয় স্বীকার তার একটি উদাহরণস্বরূপ
উপাখ্যান।
স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের এইসব
সম্প্রদায়দের সম্বন্ধে এক ভাষণে বলেছেন –
“আশ্রমীর
বিভিন্ন কর্তব্য এখনও পর্যন্ত অল্প বিস্তর অনুসৃত হইতেছে। দ্বিতীয় ভাগ জ্ঞানকান্ড – আমাদের ধর্মের আধ্যাত্মিক অংশ। ইহার নাম ‘বেদান্ত’ অর্থাৎ বেদের শেষ ভাগ—বেদের চরম লক্ষ্য। বেদজ্ঞানের এই সার ভাগের নাম বেদান্ত বা
উপনিষদ্। আর ভারতের সকল সম্প্রদায–দ্বৈতবাদী, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী,
অদ্বৈতবাদী
অথবা সৌর, শাক্ত, গাণপত্য, শৈব ও বৈষ্ণব– যে কেহ হিন্দুধর্মে অন্তর্ভুক্ত থাকিতে চাহে, তাহাকেই বেদের এই উপনিষদ ভাগকে মানিযা চলিতে হইবে। তাহারা
নিজ নিজ রুচি অনুজায়ী উপনিষদ্ ব্যাখ্যা করিতে পারে; কিন্তু তাহাদিগকে উহার প্রামাণ্য স্বীকার করিতেই হইবে। এই কারণেই আমরা ‘হিন্দু’ শব্দের পরিবর্তে ‘বৈদান্তিক’ শব্দ ব্যবহার করিতে
চাই। ভারতে সকল প্রাচীন পন্থী দার্শনিককেই বেদান্তের প্রামাণ্য স্বীকার করিতে হইয়াছে— আর আজকাল ভারতের হিন্দু ধর্মের যত শাখাপ্রশাখা আছে তাহাদের
মধ্যে কতকগুলিকে যতই বিসদৃশ বোধ হউক না কেন,
উহাদের
উদ্যেশ্য যতই জটিল বোধ হউক না কেন, যিনি বেশ ভাল করিয়া
উহাদের আলোচনা করিবেন, তিনিই বুঝিতে পারিবেন
– উপনিষদ হইতেই উহাদের ভাবরাশি
গৃহীত হইয়াছে। এইসকল উপনিষদের ভাব আমাদের জাতির মজ্জায় মজ্জায় এতদূর প্রবিষ্ট
হইয়াছে যে, যাঁহারা হিন্দু ধর্মের খুব
অমার্জিত শাখাবিশেষেরও রূপকতত্ত্ব আলোচনা করিবেন, তাহারা সময়ে সময়ে দেখিয়া আশ্চর্য হইবেন যে, উপনিষদে রূপকভাবে বর্ণিত তত্ত্ব দৃষ্টান্তরূপে পরিণত হইয়া ঐ সকল ধর্মে স্থান
লাভ করিয়াছে। উপনিষদেরই সূক্ষ আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক রূপক গুলি আজকাল স্থূলভাবে
পরিণত হইয়া আমাদের গৃহে পূজার বস্তু হইয়া রহিয়াছে। অতএব আমাদের পূজার যতপ্রকার
যন্ত্র – প্রতিমাদি আছে, সকলই বেদান্ত হইতে আসিয়াছে, কারণ বাদান্তে ঐগুলি রূপকভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। ক্রমশ ঐ ভাবগুলি জাতির
মর্মস্থলে প্রবেশ করিয়া পরিশেষে যন্ত্র —প্রতিমাদিরূপে
প্রত্যহিক জীবনের অঙ্গীভূত হইয়া গিয়াছে”।
বেদকে অস্বীকার, বেদের অপৌরুষতায় অনাস্থা, ব্রাহ্মণ্যবাদকে
প্রত্যাখ্যান করে
চার্বাকধর্ম-বৌদ্ধধর্ম-জৈনধর্ম-শিখধর্ম-শৈবধর্ম-শাক্তধর্ম-বৈষ্ণবধর্ম-স্মার্তধর্ম-গাণপত্যধর্ম-সৌরধর্মের
উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষ নামক অঞ্চলটিতে বরাবরই শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে
চরম বিবাদ, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে
বিবাদ ছিল, যা এমনকি পাঠান-মুঘল বিজতাদের
বিরুদ্ধেও এদের একত্র হতে দেয়নি । পরবর্তীতে এই বিবাদের সুযোগ নিয়ে হিন্দুদের
পর্যুদস্ত করে মুসলিম এবং ব্রিটিশের শাসন কায়েম হয়। এখন ভাগের মা গঙ্গায় পায়
না।পৃথিবীর একমাত্র বিচ্ছিন্ন এবং ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণহীন ধর্ম – হিন্দুধর্ম। আদিশঙ্করাচার্য থেকে শুরু করে
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দরা চেষ্টা করেছিলেন,
ফলপ্রসূ
হয়নি। এখন আরএসএস তোগারিয়ারা “স্বপ্নবিলাস” করছেন। অবশ্য ফলাফল বিগ জিরোই। পুনরুত্থান নৈব নৈব চ।
চৈনিক,
কোরীয়, জাপানি ধর্মগুলি জানব।
(১) তাও ধর্ম : খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়
শতাব্দিতে চিনে তাওধর্মের জন্ম। তাও ধর্মের ইতিহাস প্রায় ১,৮০০ বছরেরও প্রাচীন। তাওবাদ একটি ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারা। 'তাও' শব্দের অর্থ অনেক
বিস্তৃত। তবে মূলত এটি 'পথ', 'শিকড়' 'তত্ত্ব' বা 'মূলনীতি' অর্থে বোঝায়। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা চিনাদর্শন ও ধর্মচর্চার দিক থেকে
এটি একটি অধিবিদ্যিক ধারণা। এর মূলে আছেন লাওৎস। তার হাত ধরে এ দর্শনের বিকাশ ও
প্রসার লাভ করে। তাওধর্মের লোকেরা চিনের প্রাচীনকালের প্রকৃতি আর পূর্বপুরুষদের
আত্মার উদ্দেশে পুজো নিবেদন করেন। এই ধর্মের বহু সম্প্রদায় ছিল। পরে ধীরে ধীরে এই
ধর্ম ছুয়েন চেন তাও আর চেন ই তাও এই দুটো বড়ো সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। হান জাতির
মধ্যে তাওধর্মের বেশ প্রভাব রয়েছে। তাও ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্য বিশেষ কোনো
নিয়মবিধি নেই। ফলে এই ধর্মাবলম্বীদের সঠিক পরিসংখ্যান করা কঠিন। চিনে তাওধর্ম
মন্দিরের সংখ্যা ১৫০০। এইসব মন্দিরে নরনারী ধর্মপ্রচারকের সংখ্যা ২৫,০০০। তাও ধর্ম ছুয়ান চেন ও চেং ই -- দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত
। ছুয়ান চেন সম্প্রদায়ের লোকেরা সবাই সন্ন্যাসী । বৈশিষ্ট্য : (১) তারা বিয়ে করেন
না এবং (২) মাংস জাতীয় খাবার খান না । তারা সাধারণত তাওধর্মের মন্দিরে বাস করেন । চেং ই সম্প্রদায়ের
লোকেরা সাধারণত নিজেদের বাড়িতে থাকেন । বৈশিষ্ট্য : (১) তারা বিয়ে করতে পারেন এবং
(২) মাংস জাতীয় খাবার খেতে পারেন। পাই ইয়ুন মন্দিরের পরিচালক ইন ছেং আন হচ্ছেন
ছুয়ান চেন সম্প্রদায়ভুক্ত। শানতুং প্রদেশের লাও শানে ৩০০ ধরে আত্মশোধনের পর ইন ছেং
আন থাই পাহাড়, উ তাং পাহাড় ও চিয়াং চিয়া
চিয়ের মতো চিনের তাওধর্মের বিখ্যাত তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের
শরৎকালে ইন ছেং আন পেইচিংয়ের পাই ইয়ুন মন্দিরে আসেন। তাওধর্মের মর্মকথা ব্যাখ্যা
করে তিনি বলেছেন, চিনের জনসাধারণের
বিশ্বাস থেকে তাওধর্ম এসেছে । জনসাধারণের বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাওধর্ম তাদের বাস্তব
রূপ পেয়েছে। তাওধর্ম সর্বত্রই বিদ্যমান আছে।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে চিনের তাওধর্ম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। তাওধর্মে
বিশ্বাসী সন্ন্যাসীরা শুধু মন্দিরগুলিতে সীমাবদ্ধ নন। তারা প্রায়শই বিশ্বের
অন্যন্যা দেশের সঙ্গে সফর বিনিময় করেন। কেন-না, এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়ও তাওধর্মের প্রচলন রয়েছে ।
সন্ন্যাসী হু ছেং হাই তাও ধর্মের বিনিময়ের জন্যে অন্যান্য দেশ সফর করেছেন ।
(২) শিন্ত ধর্ম :
শিন্ত বা শিন্তো বা শিন্টো বা শিন্তৌধর্ম। জাপানি জাতির জাতীয় আধ্যাত্মিকতা এবং
প্রচলিত ধর্ম। এটাকে আচার ধর্ম বলা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রথা এবং আচারের মাধ্যমে
এই ধর্ম পালিত হয় যা বর্তমান এবং অতীতের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। জাপানি
পুরাণ খ্রিস্টের জন্মের ৬৬০ বছর পূর্বে শিন্তোধর্ম উৎপত্তি লাভ করে খ্রিস্ট্রীয়
অষ্টম শতকে কোজিকি এবং নিহন শকির ঐতিহাসিক দলিলে শিন্তো আচারের কথা লিপিবদ্ধ আছে।
শিন্তো শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দেবতার পথ। শিন্তো শব্দটি শিন্দো শব্দ থেকে এসেছে।
শিন্ডো শব্দটির মূল খুঁজে পাওয়া যায় চিনা শব্দ শেন্ডো থেকে। শিন্তো শব্দটি দুটি শব্দ
নিয়ে গঠিত। শিন অর্থ ইংরেজি স্পিরিট বা আধ্যাত্বিক শক্তি এবং তো অর্থ পথ। শিন্তো
জাপানের প্রধান ধর্ম। দেশটির ৮০% মানুষ বিভিন্নভাবে শিন্তো রীতিনীতি পালন করে, কিন্তু জরিপে খুব অল্প সংখ্যক লোক নিজেদেরকে শিন্ত
ধর্মানুসারী বলে পরিচয় দেয়। শিন্ত ধর্ম ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকে বিস্তার লাভ করে। মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার
সময় জাপানি নেতারা শিন্তধর্ম গ্রহণ করেন এবং এটিকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান
করে জাপানিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমী অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে ব্যবহার
করেন। জাপানের সম্রাটকে ঈশ্বরের অবতার মনে করা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
শিন্তধর্মের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যায় এবং সম্রাট দেবত্ব বিসর্জন
দেন। বর্তমান জাপানিদের জীবনে শিন্তধর্মের কোনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেই। স্বল্প
সংখ্যক অনুসারী বিভিন্ন শিন্তো উপাসনালয়গুলিতে যান। ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত বা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় উপাসনালয়গুলিতে অনেক পর্যটকেরাও বেড়াতে আসেন। এগুলিতে বহু
বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় এবং জন্মের পর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শিশুদের
এখানে নিয়ে আসা হয়। প্রতি বছর এগুলিকে কেন্দ্র করে অনেক উৎসব হয়। জাপানের অনেক
বাসাতে শিন্ত দেবদেবীদের পুজোর উদ্দেশে নির্মিত একটি স্থান থাকে। টোকিয়োর
সুবিখ্যাত ‘ইয়াসুকুনি জিনজা’ শিন্তোও মন্দিরের কথা বলা যায়। এখানে বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত
নারী-শিশুসহ ২,৪৬৬,০০০ জনেরও বেশি জাপানির আত্মা সমাহিত আছে এবং তাঁরা ঈশ্বর
বা দেবদেবীরূপে স্বীকৃত।
এছাড়া আরও কয়েকটি ধর্মের কথা না বললেই নয়।
জরাথ্রুস্টীয়ধর্ম : জোরোয়াস্টার বা
জরথ্রুস্ট্রা, অথবা জরথ্রুস্ট ছিলেন একজন
প্রাচীন পারস্যীয় ধর্ম প্রচারক এবং জরথ্রুস্ট ধর্মমতের প্রবর্তক। জরথ্রুস্ট এমন
একটি ধর্ম, যা ছিল প্রাচীন ইরানের
আকামেনিদ, পার্থিয়ান এবং সাসানিয়ান
সাম্রাজ্যের জাতীয় ধর্ম; যা মূলত বর্তমানে
আধুনিক ইরানের জরথ্রুস্ট সম্প্রদায় এবং ভারতের পারসি সম্প্রদায় কর্তৃক পালিত
হয়।
জরথুস্ত্র ধর্ম প্রাচীন আকামেনিদ সাম্রাজ্যের
পূর্ব অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে। ধর্ম দার্শনিক জেরোয়াস্টার প্রাচীন ইরানি ঈশ্বর
তত্ত্ব সরলভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু করেন। তিনি ঈশ্বরের দুটি রূপের কথা বর্ণনা করে।
ধর্ম প্রচারক জরথ্রুস্ট সাধারণভাবে স্বীকৃত একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তার
সমসাময়িক কাল সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে তেমন কিছুই জানা যায় না। অনেক পণ্ডিতের
মতানুসারে, তিনি আনুমানিক ১২০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়ের একজন মানুষ, যিনি প্রাচীন ধর্মমত
প্রবর্তকদের অন্যতম, যদিও অন্য অনেকের মতে, তিনি ১৮০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দ থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
মধ্যবর্তী সময়ের একজন ধর্ম প্রচারক ছিলেন।
কনফুসীয় ধর্ম : কনফুসীয় ধর্ম চিনের
একটি নৈতিক ও দার্শনিক বিশ্বাস ও ব্যবস্থা যা বিখ্যাত চৈনিক সাধু কনফুসিয়াসের
শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ কনফুসিয়াস হলেন কনফুসীয় ধর্মের
প্রতিষ্ঠাতা। এটি মূলত নৈতিকতা, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন এবং ধর্মীয় বিশ্বাস
ও চিন্তাধারাসমূহের সম্মিলনে সৃষ্ট একটি জটিল ব্যবস্থা, যা একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও
ইতিহাসে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অনেকের মতে, এটি পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে। কারণ এই
দেশগুলিতে এখন কনফুসীয় আদর্শের বাস্তবায়নের উপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে। কনফুসীয়
মতবাদ একটি নৈতিক বিশ্বাস এবং দর্শন। এটাকে ধর্ম বলা হবে কি না এই নিয়ে
বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতভেদ আছে। অনেক শিক্ষাবিদ কনফুসীয় মতবাদকে ধর্ম নয়, বরং দর্শন হিসেবে মেনে নিয়েছেন। কনফুসীয় ধর্মের মূলকথা
হচ্ছে মানবতাবাদ।
প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম : প্রাচীন মিশরের
ধর্মীয় বিশ্বাস মিশরীয় পুরাণে প্রতিফলিত হয়েছে। ৩০০০ বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে
মিশরে পৌরাণিক ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশর গ্রিক
শাসকদের পদানত হলেও মিশরের পৌরাণিক ধর্ম টিকে থাকে। পরবর্তীতে গ্রিক শাসকদের
স্থানে রোমান শাসকগণ এসে মিশর অধিকার করে নেন এবং সপ্তম শতক পর্যন্ত রোমানরাই মিশর
শাসন করেন, এসময়ও পৌরাণিক বিশ্বাস টিকে
ছিল তবে গ্রিক-রোমান ধর্মীয় বিশ্বাসের সংস্পর্শে এসে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়।
অবশেষে ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে আরব মুসলমানদের হাতে মিশরের শাসনভার চলে গেলে পৌরাণিক
ধর্ম বিলুপ্তির পথ ধরে। প্রাচীন মিশরের ইতিহাস সাধারণত প্রাচীন সাম্রাজ্য, মধ্য সাম্রাজ্য এবং নতুন সাম্রাজ্য -- এই তিনটি কালে বিভক্ত
করে আলোচনা করা হয়। মিশরীয় সভ্যতার তিনটি স্বর্ণযুগকে এই তিনটি কালের মাধ্যমে
প্রকাশ করা হয়। মিশরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি তার পুরাণও বিবর্তিত হয়েছে
এবং অনেক ক্ষেত্রেই পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে যুগ ভেদে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায়।
প্রাচীন সাম্রাজ্যে মিশরীয় পুরাণের
দেবদেবীগণ অনেকটা আঞ্চলিক ছিলেন, অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা-আরাধনা চলত। সেই হিসেবে
প্রাচীন সাম্রাজ্যের দেবকূলকে পাঁচটি প্রধান দলে ভাগ করা যায়। যেমন – (১) হেলিয়োপোলিসের ৯জন দেবদেবী -- আতুম, গেব, আইসিস, নুট, ওসাইরিস, নেপথিস, সেত, শু এবং তেফনুত। (২) হার্মোপোলিসের ৮জন দেবদেবী – নুনেত, নু, আমুনেত, আমুন, কুকেত, কুক, হুহেত এবং হুহ। (৩) এলিফ্যান্টাইনের খুম-সাতেত-আনুকেত
ত্রয়ী। (৪) থিবিসের আমুন-মাত-খেনসু ত্রয়ী। (৫) মেম্ফিসের প'তাহ-সেকমেত-নেফেরতেম ত্রয়ী।
দ্রুজ ধর্ম : দ্রুজ একটি
একেশ্বরবাদী ধর্ম এবং সামাজিক সম্প্রদায়। দ্রুজদের আবাসভূমি সিরিয়া, লেবানন। ইসরাইল এবং জর্ডান। জর্ডানে দ্রুজ ধর্মকে আলাদা
ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কারণ এই ধর্মের ভিত্তিমূল ইসলাম। দ্রুজ ধর্ম
মূলত শিয়া ইসলামের একটি শাখা। দ্রুজদের ধর্ম বিধানে ইব্রাহিমীর ধর্মসমূহের
পাশাপাশি নিও-প্লাতিনিক এবং পিথাগোরীয় মতবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। দ্রুজগণ
নিজেদেরকে “আহলে তাওহিদ” (অর্থাৎ একেশ্ববাদী মানুষ বা একতাবদ্ধ মানুষ) অথবা “আল মুয়াহিদুন”
বলে
পরিচয় দেয়। লেবাননের ইতিহাস গঠনে দ্রুজদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুজদের
সামাজিক রীতিনীতি মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের থেকে ভিন্ন।
ঈশ্বর নিরাকার। বেদের ঈশ্বর নিরাকারই, কোরানের ঈশ্বর
নিরাকারই, বাইবেলের ঈশ্বর নিরাকারই – পৃথিবীর
সব ধর্মের ঈশ্বর নিরাকার। শিব, দুর্গা, কালী, কার্তিক
ইত্যাদি এসব মানুষের কল্পনার ঈশ্বর। পুরাণ তথা ধর্মগ্রন্থের পৃষ্ঠাতেই এসব দেবতার আবিষ্কার। বৈদিক হিন্দুরা একেশ্বরবাদে
বিশ্বাসী -- ব্রহ্ম, ইসলামিরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী -- আল্লাহ, খ্রিস্টানরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী --
গড, ইহুদিরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী -- গড। ঈশ্বর এক, ঈশ্বর অদ্বিতীয়। ধর্ম এক, ধর্ম অদ্বিতীয়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলেই
এত ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থের অবতারণা। দু-চারটে মৌলিক বিধান বা নিয়মনীতি ছাড়া বাকি সব ধর্মগ্রন্থই দোষেগুণে
এক। আরও শ্রেষ্ঠতর বিধান-নিদান সৃষ্টির
বাসনায় নতুন নতুন ধর্মচিন্তার অবকাশ। প্রতিটি মানুষই ধর্মগুলির ভিন্ন মত পোষণ করেন। ভিন্ন মত থেকেই ভিন্ন
ধর্মের সৃষ্টি হয়, হয়ে আসছে। যে ইসলাম ধর্মে ধর্মের সমালোচনা করা, নবির সমালোচনা
করা, আল্লাহকে সন্দেহ করা গুনাহ -- সেই
ইসলাম ধর্মেও এখন ভিন্ন মত পোষণ করছেন অনেকেই।সমালোচনা করছেন।
সারাবিশ্বে ৪২০০-র বেশি ধর্ম আছে। তারই মধ্যে
কয়েকটি ধর্মের বিস্তারিত পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রশ্ন হল কোন ধর্ম
পৃথিবীতে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছিল ? পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির
শুরু থেকেই ধর্ম শুরু হয়েছে ? ধর্ম বলতে আমরা বুঝব
ধর্মগ্রন্থ আছে এমন সব ধর্ম। ধর্মগ্রন্থ রচনার অনেক আগে থেকেই মানুষ ধর্ম-চেতনায়
মশগুল ছিল। সৃষ্টির আদিতে মানুষ বড়োই
অসহায়। তখন তো এত মানুষ চতর্দিকে কিলবিল করত না। চতুর্দিকে হিংস্র শ্বাপদ, সূর্য ঢুকতে না-পারা ঘন-গভীর অরণ্যের মাঝে দূরে দূরে
গুটিকয়েক মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তখনও কোনো বন্ধন তৈরি হয়নি মানুষে-মানুষে। খোলা
আকাশের নীচে পশুপাখির মতো যৌনতা করত আর সন্তান জন্ম দিত। একক মানুষ, যার যার মতো। ঘর নেই,
বাড়ি
নেই, মাথার উপর ছাদ নেই – খোলা আকাশের নীচে আর পাঁচটা বন্য জন্তুজানোয়ারদের মতো
মানুষদের টিকে থাকা। হিংস্র শ্বাপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সংঘবদ্ধ হতে শুরু করল।
গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে একসাথে থাকতে শুরু করল।বিভিন্ন গোষ্ঠীতে যিনি সবচেয়ে
বেশি বুদ্ধিমান, সবচেয়ে বেশি যার
শক্তি – সেই-ই হল গোষ্ঠীপতি। শক্তি আর
বুদ্ধির জন্য গোষ্ঠীপতিরা সমীহ পেতে থাকল। গোষ্ঠীপতিকে সবাই মান্য করত। সে সময়
সকলে সকলের সঙ্গে যৌনমিলন করত। নারী-পুরুষ হলেই মিলিত হতে বাধা ছিল না। নানা
ক্ষেত্রে সম্পদ-সম্পত্তি অধিকারের প্রশ্ন উঠতে থাকল। দখলের দাবি উঠতে থাকল। দাবি
আর অধিকারের প্রশ্নে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে নিত্য কলহ ও যুদ্ধ সংঘটিত হত। মারামারি আর
রক্তারক্তি। শান্তির আশায় শুরু হল নানা নিয়মকানুন। সবই মুখে মুখে, বংশ পরম্পরায় চলতে থাকল। প্রয়োগের মধ্য দিয়েই নিয়মকানুনগুলি
সংরক্ষিত হতে থাকল। বলাই বাহুল্য, তখন তো
লিপি-বর্ণমালা-লিখনপদ্ধতিই সৃষ্টি হয়নি। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে নিয়মকানুনের অনেক
পার্থক্যও ছিল, যে যেমন ভালো বা খারাপ
বিবেচনা করত। সেটাই স্বাভাবিক।
আদিম অসহায় মানুষের মধ্যে ঈশ্বর-ভাবনার উদয় মূলত
ভয় এবং অনিশ্চয়তার ভাবনা থেকে। জীবন ধারণের জন্য রসদ সংগ্রহের ভাবনা, বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার ভাবনা এবং সর্বোপরি
মৃত্যু-ভাবনা – মৃত্যু দর্শন।সেইসঙ্গে ছিল
প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্য, অপার বৈপরীত্য নিয়ে
বিপুল বিস্ময়বোধও।পাহাড়-পর্বত-নদী-সমুদ্র-অরণ্যের উত্তরহীন অপার প্রশ্নমালা।দিনে
ফটফটে আলো, রাতের নিকষ অন্ধকার। শূন্য
থেকে অঝোরে বৃষ্টিপাত, আকাশের বহুদূরে
বিদ্যুতের ঝলকানি, বজ্রপাত, প্লাবন, ভূকম্পন, দাবানল, আগ্নেয়গিরির অগ্নির
আস্ফালনই আতঙ্ক এবং বিহ্বলতা-তাড়িত মানুষের মনে অদৃশ্য এক ক্ষমতাধরের কথা কল্পনা
করেছেন। সেই কল্পনার নাম “ঈশ্বর” – নিরাকার একেশ্বর নিয়ন্ত্রক।মানুষের চিন্তাজগতে সব
অসম্পূর্ণতা পূর্ণতা লাভ করেছে ঈশ্বর-ভাবনার মধ্যে।পদার্থবিজ্ঞানী এস চন্দ্রশেখর
যথার্থই বলেছেন – “ঈশ্বরই মানুষের
শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার”।
যে কথা বলছিলাম। এই গোষ্ঠীপতিরাই কালে কালে
গোষ্ঠীর শাসক হয়ে উঠল। জানিয়ে দিল কী করবে কী করবে না তার বিধান। এই মৌখিক বিধানই
পরবর্তীতে ধর্মগ্রন্থ, রচিত হল ধর্মের অনুশাসন।
বৈদিক ধর্মে বা সনাতন ধর্মে বা ব্রাহ্মণ্যধর্মে বা বর্তমানের হিন্দুধর্মে সেগুলিই
বেদ-মনুসংহিতা-পুরাণ ইত্যাদি নামে পরিচিত,
যা
ইসলাম ধর্মে কোরান-হাদিস, যা ইহুদি ধর্মে ওল্ড
টেস্টামেন্ট, খ্রিস্টান ধর্মে নিউ
টেস্টামেন্ট, বৌদ্ধধর্মে ত্রিপিটক ইত্যাদি।
গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে মতানৈক – তাই ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ধর্মগ্রন্থ,
ভিন্ন
শ্রেণি, ভিন্ন জাতি, ভিন্ন দেশ।তাই সমগ্র পৃথিবীর সমগ্র মানুষের যেখানে
একটিমাত্র ধর্ম এবং একটিমাত্র ধর্মগ্রন্থ এবং একটিমাত্র ঈশ্বর থাকতে পারত, সেখানে ৪২০০টি ধর্ম এবং ৪২০০ ধর্মগ্রন্থ এবং ভগবান-আল্লাহ-গড
সহ কোটি কোটি দেবতার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কেউ কারোর মুখ পর্যন্ত দেখে না। অনেকগুলি
একক মানুষ নিয়ে এক-একটি পরিবার, অনেকগুলি পরিবার নিয়ে
এক-একটি গোষ্ঠী, অনেকগুলি গোষ্ঠী নিয়ে
এক-একটি অঞ্চল, অনেকগুলি অঞ্চল নিয়ে এক-একটি রাষ্ট্র। প্রাচীনকালে ধর্মীয়
নেতারাই অঞ্চল বা রাষ্ট্র শাসন করতেন।এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধর্মীয় নেতারা
রাষ্ট্র শাসন করছিল।কয়েক বছর আগেও দেখেছি ইরাক-ইরানের মতো কিছু দেশে ধর্মীয় শাসন
চলত। সম্ভবত শেষ ধর্মীয় শাসকের নাম আয়াতুল্লা আলি খোমেইনি(ইনি ১৯৮০-র দশকের
এক্কেবারে শেষের দিকে সলমন রুশদির “দ্য স্যাটানিক
ভার্সেস” প্রকাশিত হওয়ার পর রুশদিকে
হত্যা করলে পুরস্কার ঘোষণা করেন)। একটা সময় এল যখন
পুরোহিত-পোপ-পাদরি-মোমিন-ইমামদের আধিপত্য অনেকটাই খর্ব হয়ে গেল। ধর্মীয়
অনুশাসনগুলি সামাজিকভাবে কিছু কিছু থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে একদম অচল হয়ে গেল। সেই
কারণে রাষ্ট্র ধর্মভিড়ু বা ধর্মবিশ্বাসীদের সুরক্ষা দেয়, এদের হত্যার অধিকার দেয় কখনো কখনো। কারোর ধর্মীয় বিশ্বাসে
আঘাত-টাঘাত লাগলে রাষ্ট্র অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়। সক্রেটিস, ব্রুনো, হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার (থাবা বাবা), অভিজিৎ রায়দের হত্যা করলে এবং এই হত্যাগুলিকে সমর্থন করলেও প্রায় নিরুত্তর
থাকে। রাষ্ট্র তাই ধর্মবিশ্বাসীদের ধর্মপ্রচারের অধিকার সুরক্ষিত রাখে -- কিন্তু
ধর্মহীন, ধর্ম-অবিশ্বাসী, নাস্তিকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না। ধর্মবিশ্বাসীদের ধর্মীয়
বিশ্বাসে আঘাত করলে যদি অপরাধ হয় – তবে ধর্মহীন, ধর্ম-অবিশ্বাসী,
নাস্তিকদের
বিশ্বাসে আঘাত করলে অপরাধ নয় কেন ? ঈশ্বরের অস্তিত্ব
যেমন সত্য বা মিথ্যা, তেমনই ঈশ্বরের
অনস্তিত্বও সত্য বা মিথ্যা। ধর্মবিশ্বাসীদের বিশ্বাস যদি গ্রহণ করতে হয়, নাস্তিকদের বিশ্বাস গ্রহণ করতে হয়। কারণ ঈশ্বরের
অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব কোনোটাই প্রমাণিত নয়,
ভবিষ্যতেও
প্রমাণিত হবে এমন সম্ভাবনাও নেই। তবে বিশ্বাসীদের দায়িত্ব অনেক বেশি।যদি কেউ বলে
সে পায়খানার ট্র্যাংকিতে ইলিশ মাছ চাষ করেছে,
তবে
তাকে পায়খানার ট্র্যাংকি থেকে ইলিশ তুলে দেখাতে হবে। কিন্তু যিনি নাস্তিক, তিনি তার যুক্তির
বিচারে জানেন পায়খানার ট্র্যাংকি ইলিশ চাষ অসম্ভব। তাই সে ট্র্যাংকির দরজা খুলে
দেখিয়ে দিতে পারবে ওখানে একটিও ইলিশ নেই।
যাই হোক,
এহেন
ঈশ্বরকে ঘিরেই ধর্ম, ধর্মগ্রন্হ এবং
রাষ্ট্রের উৎপত্তি। এই গ্রন্থগুলির কোনোটারই লেখকের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায় না।
প্রতিটি ধর্মের গুরুরা গোরস্থানে বা বধ্যভূমিতে শয্যা নেওয়ার পর তাদের সাগরেদরা
যেমন ইচ্ছা খুশি রং চড়িয়ে তাদের কিতাব লিখেছে। তারপর সেটাকেই ধর্মের কিতাব বা
গ্রন্থ বলে চালিয়ে এসেছে। যখন এইসব গ্রন্থ বা কিতাব রচিত হয়, তখন ছাপাখানার ব্যবস্থা না-থাকায়, মানুষজনের লেখাপড়ার সুযোগ না-থাকায়, খুব সামান্য মানুষই এগুলি তাঁদের তত্ত্বাবধানে রাখত বলে এবং
দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা হয়েছিল বলে সবাই জানতে বা পড়তেও পারত না এসবের মধ্যে কি সব
গাঁজাখুরি কেচ্ছাকাহিনি আছে। এভাবে শত শত বছর চলে যাওয়ার পর, এক পর্যায়ে মানুষ স্বতঃসিদ্ধভাবেই সেগুলোকেই তাদের ধর্মীয়
অভ্রান্ত কিতাব হিসাবে গণ্য করতে থাকে। সুতরাং এইসব কিতাবের প্রকৃত লেখক কে, কবে প্রকাশ করেছিল সেটা জানা সম্ভব নয়।
বস্তুত এই ধর্মগ্রন্থগুলি কোনোটাই প্রাচীন নয়, সবই মধ্যযুগের কিছু আগে-পরে লেখা। সারা বিশ্বে ব্রিটিশ
উপনিবেশ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রন্থগুলির কথা জানা যায়। প্রথমে দু-আকারে (তালপাতার)
চার পাতার পুথি, তারপর ছাপা গ্রন্থ
আকারে। লিপি আবিষ্কার এবং ছাপা পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে তো বই বা কিতাবগুলি রচিত হতে
পারে না। লিপি এবং ছাপাখানার আবিষ্কার তো খুব বেশি বেশিদিনের নয় (মানব সভ্যতার
শুরুর দিকে মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ছিল ভাষা। তখনও লিখন-পদ্ধতি আবিষ্কার
হয়নি। লিখন-পদ্ধতি আবিষ্কারের পর গাছের ছাল বা বাকল, পাতা, পশুর চামড়া, পাথরের উপর লেখা হত। চিনে সর্বপ্রথম ছাপা তৈরি করা হয়। এই
ছাপাখানায় কাঠ খোদাই করে অক্ষর তৈরি করে কাগজে ছাপানো হত। রাবার স্ট্যাম্পের মতো
নির্মিত অক্ষরের ছাপ দিয়ে বই ছাপা হত। এতে সমস্যা ছিল,
একবার
ছাপানো হলে পুনরায় চাপানো যেত না। পুনরায় অক্ষর সাজিয়ে ছাপার সরঞ্জাম বানাতে হত।
জার্মানির ইওহান গুটেনবার্গ (১৩৯৮-১৪৫৮) সর্বপ্রথম আধুনিক মানের ধাতব অক্ষরের
ছাপাখানা বানানোর পরিকল্পনা করেন। তিনি
১৪৫০ সালে বিশ্বের প্রথম ধাতব টাইপ বা অক্ষর তৈরি করতে সক্ষম হন। এ চিন্তা থেকেই
ছাপাখানা বানানোর পরিকল্পনা করেন। ১৪৫২ সালে ইওহান কুশটের আর্থিক সহযোগিতায়
ছাপাখানা তৈরি করতে সক্ষম হন। গুটেনবার্গ আলাদা আলাদা অক্ষর সাজিয়ে বই ছাপার
পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ইউরোপের দেশ জার্মানিতে আধুনিক ছাপাখানা উদ্ভাবন হলেও প্রায়
৩২৬ বছর পর অখণ্ড ভারত উপমহাদেশে ১৭৭৮ সালে সর্বপ্রথম ছাপাখানা বসানো হয়। তবুও
বাংলা হরফে ছাপার কাজ শুরু হয় আরও পরে। ১৭৭৮ সালে হুগলিতে নাথানিয়েল ব্র্যাসি
হ্যালহেড লিখিত “এ গ্রামার অব বেঙ্গল
ল্যাঙ্গুয়েজ” বই মুদ্রণের উদ্যোগ নেন
চার্লস উইলকিন্স। তখন হুগলি জেলার ত্রিবেণীর পঞ্চানন কর্মকার বাংলা হরফ প্রস্তুত
করেন। বই মুদ্রণে ছেনিকাটা, ঢালাই করা চলনশীল
ধাতব হরফ ব্যবহার করা হয়। উইলকিন্স ও পঞ্চাননের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলা হরফ তৈরি করা
হয়েছিল। ১৭৯৯ সালে উইলিয়াম কেরির উৎসাহে শ্রীরামপুর মিশনে ছাপাখানা স্থাপন করা হয়।
পঞ্চানন কর্মকার এখানে কাজ শুরু করেন। পুরোনো মেশিন নিয়ে কাজ শুরু হলেও মেধা, পরিশ্রম ও চেষ্টার মাধ্যমে পঞ্চানন কর্মকার এ ছাপাখানাকে
এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর কারখানায় উন্নীত করতে সক্ষম হন। এ ছাপাখানা হতেই বাংলাভাষায়
বই ছাপা শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, উইলিয়াম কেরি বাংলা
ভাষা ভাল জানতেন এবং বাংলা ভাষায় বই লিখেন। ১৮০১ সালে শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানা
হতে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট ইঞ্জিল শরিফ মুদ্রিত হয়। পঞ্চানন কর্মকার সর্বপ্রথম
বাংলা হরফ নির্মাণ করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি বাংলা বর্ণমালার অক্ষর নির্মাণে
বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে সমর্থ হন। গুটেনবার্গের বাইবেল ছাপার ঠিক একশো (১৪৫৫ ) বছর
পরে (১৫৫৬) পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের বছরে কাকতালীয়ভাবে ভারতের গোয়া বন্দরে একটি
মুদ্রণ যন্ত্র আসে এবং ছাপার কাজ শুরু হয়। অনন্ত কাকবা, প্রিয়োলকার তার “দি প্রিন্টিং প্রেস
ইন ইন্ডিয়া” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ১৫৫৬
থেকে ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গোয়ায় মোট ৩৪টি বই ছাপা হয়। গোয়ায় মুদ্রণযন্ত্রে
প্রথম ছাপা পর্তুগিজ ধর্মগ্রন্থ “কনক্লুসোয়েস এ
উত্তরাখ কায়সাস”। সম্ভবত এটিই ভারতবর্ষে রচিত
প্রথম পুস্তক। মনে রাখতে হবে, যে গ্রন্থগুলিকে আমরা সাধারণত ধর্মগ্রন্থ বলি সেগুলি তো
আসলে অনুশাসনের গ্রন্থ, যাকে বলে ধর্মীয়
অনুশাসনের গ্রন্থ = সংবিধান (Constitution)। আমাদের পৃথিবীতে বহু
যুগ ধরে বহু শাসক বহু দেশ বহু অনুশাসনে শাসন করেছেন। সেসময়ে যেহেতু নিয়মনীতি, আইনশৃঙ্খলা লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হত না -- অতএব শাসক
বিশেষ অনুশাসনও বদলে যেত। যেহেতু তৎকালীন সময়ে শাসক হতেন বংশপরম্পরায়, সেহেতু পিতার শাসননীতি পুত্র, পুত্রের শাসননীতি প্রপৌত্র -- এইভাবে
শাসননীতি পরিচালিত হত। এরপর যখন লিপি এবং ছাপাখানা হতে থাকল তখন সংশ্লিষ্ট শাসকগণ
নিজেদের তত্ত্বাবধানে বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ করে তাঁকে খাইয়ে-পড়িয়ে অনুশাসনের গ্রন্থ
লেখাতেন। এই গ্রন্থগুলি ঈশ্বর দ্বারা প্ররিত বা অপৌরুষেয় বলে পোপ-মোমিন-পুরোহিত
প্রমুখদের দিয়ে ঘোষণা করালেন। কারণ এরাই ঈশ্বরের কথা প্রচারটচার করতেন। মানুষ
ঈশ্বরটিশ্বরের অলৌকিক গল্পগুলি এদের মুখ থেকেই শুনতেন এবং প্রভাবশালী লোকেরা শাসকের
ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। কারণ তখন এরাই ছিলেন সমাজের উঁচু স্থানে। এঁদের কথা না-মেনে
উপায়ই ছিল না। চরম শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও
দিতে হত। শাসক বা রাজার প্রসাদে এরা তখন খুবই ক্ষমতাবান ছিলেন। যদিও তৎকালীন
শাসকগণ ভেবেছিলেন এইসব মোমিম-পাদরি-পোপ-পুরোহিত-ইমামদের ঘাড়ে অনুশাসনের দায় চাপিয়ে
দিয়ে প্রজাদের অর্জিত সম্পদ হরণ করে নেবে এবং এইরূপে শাসনকার্য চালিয়ে যাবে, কিন্তু না, চিরদিন কাহারও সময়
নাহি যায়। কথায় বলে সাপের ছোবলে সাপুড়ে মরে। একদা ধর্মনীতি এবং রাষ্ট্রনীতি ছিল
প্রায়-সমার্থক। পরবর্তীকালে ধর্মনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রনীতি খানিকটা-খানিকটা করে
বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল। শাসকরা এবার বুঝল ঈশ্বরের নামে আর শাসন করা যাবে না।
ঈশ্বরের নামে যে অনুশাসনগুলি রচনা করা হয়েছিল সেগুলি বেশির মানুষই মান্য করে না।
উলটে ঈশ্বরের নামে প্রজা-নাগরিকদের ঠকিয়ে নীচু বর্ণদের শোষণ করে যাচ্ছে এক শ্রেণির
পুরোহিত-মোল্লারা। সারা বিশ্বে কোনো দেশের নাগরিকই ধর্মীয় শাসন চান না। তাঁরা
জানেন ধর্মীয় শাসন ফিরিয়ে আনা মানে বর্বর সমাজকে ফিরিয়ে আনা। কারণ ধর্মীয়
অনুশাসনের গ্রন্থগুলি হল “বর্বরের জন্য, বর্বরদের দ্বারা,
বর্বরদের
শাসন”(of the barbar, by the barbar
and for the barbar)।
বলেছিলাম একদা ধর্মনীতি এবং রাষ্ট্রনীতি ছিল
প্রায়-সমার্থক। একদা নয়, আজও রাষ্ট্র ধর্ম
থেকে আলাদা করতে পারেনি। যাতে ধর্মব্যবস্থা মহাসমারোহে টিকে থাকে সেইজন্য
পৃষ্ঠপোষকতা করে, যাতে যথেচ্ছভাবে
ধর্মস্ফূর্তি করতে পারে তাই করমুক্তও করা হয়। আর ধর্ম-ব্যবসায়ীরা কেজি কেজি
সোনা-রূপোর ভাণ্ডার এবং কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালান্সের মালিক হয়ে সমাজের
উঁচুতলায় উঠে বসে আছেন। সেই কারণে
যত্রতত্র মন্দির-মসজিদ গজিয়ে উঠলেও রাষ্ট্র আপত্তি করেন না, কিন্তু কোনো গৃহহীন যদি ব্যক্তি যত্রতত্র বাসস্থান গড়ে
বসবাস করেন তবে বুলডোজার চালিয়ে উচ্ছেদ করে দেবে।
কেন নয় ?
রাষ্ট্রই
তো ধর্মের পৃষ্ঠপোষক, ধর্মই রাষ্ট্রের
পৃষ্ঠপোষক। প্রথমে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে এবং পরে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত আধুনিক চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটে রাষ্ট্রচিন্তার
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা দেখব রাষ্ট্র উৎপত্তির মতবাদ। আলোচনা করব ঐশ্বরিক
উৎপত্তি মতবাদ এবং বলপ্রয়োগ মতবাদ নিয়ে।
ঐশ্বরিক উৎপত্তি মতবাদ : ঐশ্বরিক উৎপত্তি
মতবাদ বা (Theory of Divine Origin) হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি
সংক্রান্ত সবচেয়ে প্রাচীন মতবাদ। হিন্দু পুরাণে, ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং প্রাচীন হিব্রু-চিন্তাতে ঐশ্বরিক উৎপত্তি মতবাদের ধারণা
পাওয়া যায়।মধ্যযুগেও সেন্ট অগাস্টাইন,
সেন্ট, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের লেখনিতে এই মতবাদ পাওয়া যায়। এই
মতবাদের মূল বক্তব্য হল -- (১) রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর।এই সৃষ্টির পিছনে
মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। (২) রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা
রাজার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। সেইজন্য রাজা আদেশ বা নির্দেশ, যা আইনরূপে গণ্য হয়ে থাকে। তা মান্য করা সকল মানুষের একান্ত
কর্তব্য। বস্তুত রাজার নির্দেশই আসলে ধর্মীয় নির্দেশ।তাই রাজার আইন না-মানার অর্থ
হল ঈশ্বরকে অবমাননা করা।এ থেকেই বোঝা যায় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাই ঈশ্বর-ভাবনা এবং
ধর্ম-ভাবনার বিকাশ। (৩) ঈশ্বরের বিধান অনুসারে রাজপদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা
যায়। (৪) রাজা যেহেতু ঈশ্বর-প্রেরিত, সেইহেতু তিনি কখনোই
অন্যায় করতে পারে না। ঈশ্বর ছাড়া তিনি আর কারও কাছে তাঁর কাজের জন্য জবাব দিতে
বাধ্য নন। যেমন – হজরত মোহম্মদ। তাঁর
সব কাজকর্ম প্রশ্নাতীত। প্রশ্ন করলে তিনি সেই প্রশ্নের জবাব আল্লাহ ছাড়া কাউকে
দিতে বাধ্য নন। তেমনই মোহম্মদও বলেছেন,
আল্লাহকেও
কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। সন্দেহ করা যাবে না। আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
অন্যথা সে কাফের।রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক ঐশ্বরিক মতবাদে নবি তথা শাসক হজরত
মোহম্মদের দৃষ্টান্ত এককথায় পারফেক্ট।(৫) ঈশ্বর-প্ররিত রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
ঘোষণা করা যায় না। হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্রগুলিতে বিদ্রোহ-দমনের কাহিনিতে ছড়াছড়ি, যা দেবতা এবং অসুরের যুদ্ধ বলে সর্বজনবিদিত। এই অসুররাই
কখনো রাক্ষস-খোক্কস, কখনো দৈত-দানো বলে
পরিচিত।
বস্তুত
এখানে অসুররা বিদ্রোহী, দেবতারা শাসক। দেবতা
তথা শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ! তাই মারি অরি কৌশলে। সেই কাহিনি হিন্দুরা ভক্তিভরে
পাঠ কিংবা শ্রবণ করেন।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল (Gettel) বলেছেন,
যখন
মানুষ নিজেরাই নিজেদের শাসন করার উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি, সেই সময় ঐশ্বরিক মতবাদ মানুষকে আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছিল।এই
তত্ত্ব মানুষকে আনুগত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত করে রাষ্ট্রের বিবর্তনে সহায়তা করেছিল।
এই ধর্মীয় চিন্তা মানুষকে আনুগত্য ও সহযোগিতার শিক্ষা প্রদান করেছে। ফলে রাষ্ট্র
গঠনের পথ অত্যন্ত সহজ হয়েছে।
বলপ্রয়োগ মতবাদ : অপরদিকে রাষ্ট্রের
উৎপত্তিতে বলপ্রয়োগের মতবাদে বলা হয়েছে,
প্রাচীনকালে
মানুষ ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী, দল ও উপজাতিতে বিভক্ত
ছিল। নানা কারণে এই বিভিন্ন গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সূচিত হত। এই
দ্বন্দ্বে বিডয়ী গোষ্ঠী পরাজিত গোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করত। বেশিরভাগ
দ্বন্দ্বই ছিল এলাকা দখলের দ্বন্দ্ব। সভ্য কথায় সাম্রাজ্য বিস্তারের
দ্বন্দ্ব।এইভাবে অনেকগুলি গোষ্ঠীর একজন শক্তিশালী গোষ্ঠীপতির কাছে আত্মসমর্পণ এবং
আনুগত্য প্রদর্শন করতে আরম্ভ করল।হ্যাঁ,
ধর্মের
ইতিহাস আর রাষ্ট্রের ইতিহাস লিখতে বসলে বক্তব্য বা বিষয়টা একই রাখতে হবে। রসদ একই।
মধ্যযুগে রাজার কর্তৃত্বের তুলনায় পোপের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে
খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণ এই তত্ত্বের ব্যাপক প্রচার করেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রাষ্ট্র সৃষ্টির একেবারে আদি যুগে অসভ্য, বর্বর এবং রাজনৈতিক জ্ঞানহীন মানুষকে আনুগত্যের শিক্ষায়
শিক্ষিত করে তুলেছিল এই বলপ্রয়োগের মতবাদ।“আনুগত্য” এক সন্মানজনক অসন্মানীয় শব্দ-উদ্ধৃতি। আসল কথা দাসত্ব, যে বা যাঁরা যত বেশি দাসত্ব মেনে নিতে পারবে সে তত বেশি
ঈশ্বরের বান্দা হয়ে উঠবে। “যে সাপের চোখ নেই,/শিং নেই/নোখ নেই,/ছোটে না কি হাঁটে না,/কাউকে যে কাটে না,/করে নাকো ফোঁস ফাঁস,/মারে নাকো ঢুঁশ ঢাঁশ,/নেই কোনো উৎপাত,/খায় শুধু দুধ ভাত,/সেই সাপ জ্যান্ত/গোটা
দুই আনতো?/তেড়ে মেরে ডাণ্ডা
ক'রে দিই ঠান্ডা”। হ্যাঁ, এমন সাপেদেরই শাসকদের
পছন্দ –- তা সে ধর্মীয় শাসকই হোক কিংবা
রাষ্ট্রীয় শাসক। চোখ-দন্ত-নখ-ফোঁসহীন সাপ। কোনো প্রশ্ন যে করে না, তাঁর জন্য স্বর্গ রচনা হবে, মজুত রাখা হবে প্রচুর হুরী-অপ্সরা-পরী। অন্যথায় তিনি দেশদ্রোহী বা নাস্তিক বা
ধর্মবিরোধী বা কাফের।
“যেমন রক্তের মধ্যে
জন্ম নেয় সোনালি অসুখ/তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।/জাতির শরীরে আজ
তেম্নি দেখো দুরারোগ্য ব্যাধি/ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ী রূপে/ক্রমশ উঠছে
ফুটে ক্ষয়রোগ, রোগেরপ্রকোপ/একদার অন্ধকারে
ধর্ম এনে দিয়েছিল আলো,/আজ তার কংকালের হাড়
আর পঁচা মাংসগুলো/ফেরি কোরে ফেরে কিছু স্বার্থান্বেষী ফাউল মানুষ-/সৃষ্টির অজানা
অংশ পূর্ণ করে গালগল্প দিয়ে।/আফিম তবুও ভালো,
ধর্ম সে
তো হেমলক বিষ।/ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃণ্য চতুরতা,/মানুষের পৃথিবীকে শত
খণ্ডে বিভক্ত করেছে/তারা টিকিয়ে রেখেছে শ্রেণীভেদ ঈশ্বরের নামে।/ঈশ্বরের নামে
তারা অনাচার করেছে জায়েজ।/হা অন্ধতা! হা মুর্খামি ! কতোদূর কোথায় ঈশ্বর !/অজানা
শক্তির নামে হত্যাযজ্ঞ কতো রক্তপাত,/কত যে নির্মম ঝড়
বয়ে গেল হাজার বছরে !/কোন্ সেই বেহেস্তের হুর আর তহুরা শরাব?/অন্তহীন যৌনাচারে নিমজ্জিত অনন্ত সময়?/যার লোভে মানুষও হয়ে যায় পশুর অধম।/আর কোন দোজখ বা আছে এর
চেয়ে ভয়াবহ/ক্ষুধার আগুন সে কি হাবিয়ার চেয়েখুব কম?/সে কি রৌরবের চেয়ে নম্র কোন নরম আগুন ?/ইহকাল ভুলে যারা পরকালে মত্ত হয়ে আছে/চলে যাক সব পরপারে
বেহেস্তে তাদের/আমরা থাকবো এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে,/দ্বন্দ্বময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায়/আগামীর স্বপ্নে
মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ”। -- কবিতাটি লিখেছেন
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এই প্রবন্ধে কত প্রাসঙ্গিক দেখুন।তাই উল্লেখ করার লোভ
সামলাতে পারলাম না।
বস্তুত আমাদের যা নেই; তাই আমরা ঈশ্বরের কাছে চাই। ভয়, বিপদ, বাধা কাটিয়ে ওঠার
জন্য ঈশ্বরই আমাদের আশ্রয় হয়ে ওঠে। অতএব অভীষ্ট লাভের জন্য দেবতার আশ্রয়-সম্পদ
নিতে গেলে তার জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার,
ব্রত, নিয়ম, সংযম আর কিছু বস্তু
উপহারের মাধ্যমে ঈশ্বরকে তুষ্ট করার চেষ্টাটা করতে হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৈদিক
সনাতন ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে প্রধানত এই ভাবনা থেকেই। বেদে দেবতা অনেক, মানুষের চাওয়াও অনেক। তাকেই একটা সংযত রূপ দেওয়ার জন্য
যাগ-যজ্ঞ, নিয়ম-সংযমের প্রক্রিয়া প্রচলন
হয়েছিল। নিজের চাওয়া-পাওয়ার জন্য সেই যে বিশাল নিয়ম-আচার বা কর্মের প্রথা তৈরি
হয়েছিল, তা আজও চলছে। আদি রূপটা নিশ্চয়
নেই, তবু চলছে বিবর্তনের মধ্য
দিয়ে। মানুষের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিমুহূর্তে সেই আচার-অনুষ্ঠান পরিবর্তন
হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন
ধর্মের, নতুন নতুন মতের। ধর্মগুলিতে
বিদ্রোহ নিষিদ্ধ হলেও বিদ্রোহ থেমে থাকেনি কোনোদিন। চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি সবই বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ধর্ম – সেই জন্যই এ ধর্মগুলি নাস্তিক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছে।
শুধুমাত্র এই বিদ্রোহ হিন্দুধর্মেই নয় –
ইসলাম এবং খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মেও মতান্তর লক্ষ করা
যায়।
মানুষ জন্ম নেওয়ার বেশ কিছু বছর সে থাকে নিতান্তই
সাধারণ এক মানব-সন্তানই থাকে। পরবর্তীতে তার কানে তখন তার পিতৃপুরুষের ধর্মবিশ্বাস
অনুসারেই হিন্দু হলে দেবদেবতার নাম-মন্ত্র-উলুধ্বনি, মুসলিম হলে আজান শেখানো হয়, খ্রিস্টান হলে জিশুকে
স্মরণ করানো হয়। সেই মানব-সন্তানকে বড়ো করে তোলা হয়, হাঁটতে এবং কথা বলতে শেখানো হয় -- তেমনই শেখানো হয় তাকে তার পিতৃপুরুষের
ধর্মাচার ও ধর্মাচরণ। এইভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সন্তানরা ভগবানের উপাসনা করে, মুসলমানের সন্তান ইসলামে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং খ্রিস্টান-সন্তানেরা জানে গডের মহিমা। মুসলিমরা
যায় মসজিদে, হিন্দুরা মন্দিরে, শিখরা যায় গুরুদ্বার আর খ্রিস্টানরা গির্জায়। মানবজাতি
বিভক্ত হয়ে যায় ধর্মানুসারেই। যদি ধর্মানুসারেই মানুষ জন্মাত, তবে পৃথিবিতে একটিই ধর্ম সৃষ্টি হত। তাহলে এত এত ধর্মগ্রন্থ
বা আসমানি কিতাব না হয়ে একটাই হত। সৃষ্টিকর্তা যদি ভিন্ন ভিন্ন হত তাহলে নিজের
প্রবর্তিত ধর্মের বাইরের অন্য কোনো ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের ঘরে সন্তান জন্মানোর
সুযোগ দিতেন না। যে সন্তানটি জন্মালো সে কোন্ ঘরে জন্মালো সেটির উপরই নির্ভর করবে
তার কী ধর্ম হবে। মুসলিম ঘরে জন্মালে কিংবা পালিত হলে সে মুসলিম হবে, হিন্দু ঘরে জন্মালে কিংবা পালিত হলে সে হিন্দু হবে, খ্রিস্টান ঘরে জন্মালে কিংবা পালিত হলে সে খ্রিস্টান হবে
ইত্যাদি ইত্যাদি।ভারতবর্ষে খ্রিস্টান অনাথ আশ্রমগুলিতে প্রচুর সন্তান খ্রিস্টান
হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম পালন করে বেড়ে ওঠে। অথচ এরা কিন্তু কেউই খ্রিস্টান-ঘরে জন্ম
নেয়নি। এরা হিন্দু-ঘরে, কেউ-বা মুসলিম-ঘরে, কেউ-বা অন্য কোনো ঘরে জন্ম নিয়েছিল। মানুষ পরিচয়ের পরে আসে ধর্মপরিচয়, ধর্ম পরিচয় কখনোই আগে আসে না। তাই একজন মানুষ আগে মানুষ, পরে তার ধর্মবিশ্বাস অনুসারে হিন্দু অথবা মুসলমান অথবা
খ্রিস্টান অথবা নাস্তিক অথবা অন্য কিছু। কেউ যদি সকাল-সন্ধে নিজেকে হয় হিন্দু, নয় মুসলিম, নয় খ্রিস্টান ভাবতে
থাকে আর এটাকেই যিনি একমাত্র পরিচয় বলে ভাবেন – তবে তাকে “মানুষ” বলতে আমার অসুবিধা আছে।
ধর্মের উদ্ভব এবং প্রসার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে
ওয়াহিদা রেজা তাঁর “ধর্ম চেতনা ও
ঈশ্বর-বিশ্বাস” প্রবন্ধে যথার্থই লিখেছেন, “আদিম বা আদম মানব মানব গোষ্ঠীর প্রারম্ভিক যুগে পৃথিবীতে
না-ছিল কোনো ঈশ্বর, না-ছিল কোনো ধর্মের
অস্তিত্ব। মানুষের মন থেকেই ধর্মের জন্ম,
ঈশ্বর
নামক অদৃশ্য অলীক ব্যক্তিটির গর্ভপাত। তারপরও মানুষ তার অ-মানুষ স্তর থেকে মানুষের
অবস্থায় বিবর্তিত হওয়ার কালে কেন বা কী করে ধার্মিক হয়ে উঠল এবং আজ পর্যন্তই-বা
কেন ধর্মবিশ্বাসকে আগলে রেখেছে, কোন্ নিয়মে বা কোন্
প্রয়োজনে মানুষ তার আদিম জীবনের স্থুল ধর্মীয় ধারণাকে পরবর্তী যুগে উচ্চতর মার্জিত
রূপ দান করেছে এ প্রশ্নের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তরটিতে যে কথাগুলি উঠে আসে, তা হল সম্প্রদায়ের আধিপত্য বিস্তার ও ধর্মীয় চেতনার ধোঁয়ার
অস্পষ্টতায় ক্ষমতার লিপ্সা । অর্থাৎ প্রভুত্ব। ধর্মীয় মৌলবাদের রাজত্ব। অরাজকতা।
মানবতার অবমূল্যায়ন। মানুষের স্বাধিকার হরণের একচ্ছত্র শোষণ। আজ ঐতিহাসিকভাবে এ
কথা প্রমাণিত সত্য যে, প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত
কোনো ধর্মই রক্তপাতহীন প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। সব ধর্মেরই প্রাতিষ্ঠানিকতার পবিত্র
হাতে লেগে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের দাগ। ধর্ম তার এই তথাকথিত অগ্রগতির
সঙ্গে নিজের যথার্থতা নিরূপণের জন্য অতীয়ন্দ্রিয় সত্তার সমর্থন ব্যতীত ধর্ম
স্বপ্নের অর্থহীন শিল্পকলায় বা একটি সুন্দর মায়ায় পর্যবসিত হয়। বিস্তৃত বিশ্বজগতের
অন্তর্নিহিত সত্তার সঙ্গে রয়েছে ধর্মবোধের চিরবৈরিতা। আজ বিজ্ঞান ও বস্তুবাদী
দর্শনের ক্রমউৎকর্ষকালে মানুষের মৌলিক মেধা,
মনন ও
জ্ঞান চর্চা যখন প্রতি পদে পদে সকল রকম কুসংস্কার ও অন্ধত্বের কালো পর্দা ছিঁড়ে
ছিঁড়ে বিশ্বমানবতার সর্বজনীন উষার আলোমুখী ধাবমান তখন ধর্মের অন্তঃসার শূন্যতা ও
ধর্মবোধের অযথার্থতা যে আগামী একদিন প্রমাণিত হবেই এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে
পারে না। তখন ধ্বংস হয়ে যাবে ধর্মের ভীতিকর অলীক ঈশ্বরতত্ত্ব। ধুলোয় মিলিয়ে যাবে
ধর্মীয় লোভ ও বিভীষিকার তথাকথিত স্বর্গ-নরকের পরলৌকিক বাগাড়ম্বর। মানুষের জ্ঞান
বিকাশের প্রাথমিক স্থরটি ছিল ভয়, সংশয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্বের অধ্যায়।
প্রাকৃতিক বিবর্তন, আলোড়ন, দুর্যোগ ইত্যাদি এ সবের মূল কারণ। তৎকালীন সময় অর্থাৎ
প্রাগৈতিহাসিক যুগে এ সমস্ত প্রাকৃতিক কার্যবিধির যথোপযুক্ত ব্যাখ্যাহীনতারই
একমাত্র কারণ, অবলম্বন বা ধারণাই মানব
মস্তিষ্ককে বাধ্য করেছে অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক নামক ভুয়া সংশয়ের কাছে আত্মসমর্পণে।
যার ধারাবাহিক অনিবার্য ফলশ্রতি হল ধর্মচেতনা। আর এই ধর্মচেতনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে
পরবর্তী উন্নত মানুষের মৌলিক উন্নতির প্রধান অন্তরায়”।
ধর্ম
নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত
লেখক ও গবেষক ক্যারেন আর্মস্ট্রং
তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, “জেসাস যে
সত্যিকারের ঈশ্বরের অবতার
ছিলেন এর নিশ্চয়তা
কী ? আর এমন
বিশ্বাসের অর্থই-বা কী ? কারণ
বাস্তব পর্যালোচনায় দেখা
যায়, নিউ টেস্টামেন্টে
জেসাস আমাদেরকে দারুণ ভাবে
পরস্পর-বিরোধী ট্রিনিটি মতবাদের শিক্ষা দিয়েছেন”৷ এরই পরিপ্রেক্ষিতে
ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের মনে এই
সন্দেহ জাগে যে,
“বিভিন্ন ধর্মের
অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের
মতো জেসাসের এই
ঘটনাও কি জেরুজালেমের
ক্রাইস্টের মৃত্যুর শত
শত বছর পর
ধর্মতাত্বিকদের তৈরি করা এক কল্পনা
প্রসুত বিষয়”!
শুধু
মুষ্টিমেয় কুচক্রী রাজরাজরা
বা পুরোহিতগণ মানুষের
প্রাচীন এবং আদিম
সেক্যুলার বিশ্বাস ও
স্বভাবের উপর এই
বিশ্বাসের অপব্যবহার চাপিয়ে
দেয়নি, বরং এটা
মানুষেরই স্বভাবজাত স্বাভাবিক
প্রবৃত্তি৷ কারণ মানুষ
শূন্যতা ও নৈঃসঙ্গ
সহ্য করতে পারে
না ; মানুষ তখন অর্থবহতার
নতুন কেন্দ্র সৃষ্টি
করে এই শূন্যতাকে
পূরণ করে নেয়৷
তাই হয়তো হাজার হাজার বছর
থেকে ধর্মীয় বিশ্বাস
টিকে আছে৷ সমাজ
বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে
কিছু মানুষ ধর্মের
আতঙ্ক এবং আকাঙ্ক্ষাকে
অন্য মানুষ ও সমাজের কাছে
তুলে ধরেছে এবং
মানুষও অনায়াসে তা
গ্রহণ করেছে৷ ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা
ও গবেষণার এক পর্যায়ে
তার কাছে মনে
হয়েছে যে, সেমিটিক
ধর্মবিশ্বাসী মানুষের কাছে
গুরুত্বপূর্ণ অর্থে ধর্ম
ও ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষের এক
সৃজনশীল কল্পনার সৃষ্টি, যা অন্যান্য
সামাজিকভাবে অনুপ্রেরণাদায়ক কবিতা
ও সঙ্গীত সৃষ্টির মতোই, অর্থাৎ
মানুষের শিল্পকলা ইত্যাদি সৃষ্টির
মতোই ৷ প্রকৃতপক্ষে মানুষের
প্রচলিত বিশ্বাসের ঈশ্বরের
বাস্তবভিত্তিক কোনো অস্তিত্বই
নেই, কোনো কালেও ছিল না
৷ তার
পরেও মানুষের ঈশ্বর এবং ধর্মে
বিশ্বাস এই বিশ্বের
সবচেয়ে গুরুত্বপৃর্ণ বাস্তবতা৷ ক্যারেন আর্মস্ট্রং এটাই মনে করেন।
পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক মানবের কাহিনি মানেই হচ্ছে
ধর্মের ইতিহাস। ঈশ্বর, আত্মা, স্রষ্টা, অমরতা, মৃত্যু, স্বর্গ, নরক ইত্যাদির নামই এক অর্থে ধর্ম। আসলে ধর্মের আবির্ভাব
হয়েছে মানুষের মৃত্যু, ভয় ও অসহায়ত্ব থেকে, যাতে পুরোহিত-মোল্লারা নানাভাবে মশলা দিয়েছে এতে, দিয়েছে নিজেদেরই স্বার্থেই। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের “টোটেম ও টাবু” গ্রন্থে যে টাবুর কথা
উল্লেখ করেছেন, তা প্রাচীন হিন্দু ধর্মেও ‘টাবু’ বা ‘টোটেম’ প্রথা চালু ছিল বৈদিক
যুগে কিংবা তার আগেও। বলিদান প্রথার মূলেও ছিল টোটেমবাদ, শক্তির উপাসনা বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন প্রপঞ্চে চলমান ছিল।
প্রাচীন ফোনিকান, হিব্রু, ক্যানানাইট, মায়া, ইনোকা, আজটেক, ওলমেক্স, গ্রিক, রোমান, কার্থাগিনিয়ান, টিউটন, সেল্ট, ড্রুইড, গল, থাই, জাপানি, নিউজিল্যান্ডের মাউরি,
তাহিতিয়ান
ও হাওয়াই দ্বীপের মানুষেরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী শিশু, নারী ও পুরুষ বলি দিত দেবতাদের খুশি করার জন্যে। ‘সৃষ্টি থাকলে স্রষ্টা থাকবে’ এই মতবাদ থেকে ধর্ম এসেছিল। ওই সময়েই যুক্তিবাদীরা প্রশ্ন করেছিলেন ‘‘তবে ঈশ্বরের স্রষ্টা কে?” না, উত্তর পাওয়া যায়নি। উত্তর
দিতে পারেনি কোনো ধর্ম প্রবর্তক কিংবা প্রণেতারা। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের মধ্যে প্রথম ধর্মবিশ্বাস জন্মে ‘নিয়ান্ডার্থাল’
মানুষের
আমলে, যা এখন থেকে বহু বছর আগে।
ধর্মের উৎপত্তি কমবেশি আনুমানিক ১০,০০০ বছর হলেও
পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও বসবাস কমপক্ষে এক লক্ষ বছর আগে। প্রাকপ্রাথমিক যুগের আদিম
মানুষের ধর্মে বিশ্বাস ছিল না। আসলে ওই সময় ধর্ম মানে ছিল নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার
তাগিদে মানবজাতির আত্মসম্মান বিসর্জন। নাস্তিক্য ও যুক্তিবাদী মানুষের মধ্যে
চার্বাক, বুদ্ধ, মহাবীর, কভুর, ডিরোজিও, হেগেল, স্পিনোজা, দেকার্ত, মার্কস, ভলতেয়ার, ফায়ারবাখ, এ্যাঙ্গেলস, কান্ট, লেনিন, মাও সেতুং, আরজ আলি মাতবর,
যুক্তিবাদকে
স্থান দিয়েছিলেন জীবনধর্মের অনেক ঊর্ধ্বে।
মূলগতভাবে ধর্ম একটি তাত্ত্বিক বিষয়। জগত ও জীবন সৃষ্টি
সম্পর্কে কিছু তাত্ত্বিক ধারণা এবং সে তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে কিছু
আচার-আচারণ-উপাসনা ও তৎ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নিয়েই ধর্ম। ধর্মীয় তাত্ত্বিকতার
ভিত্তি হল বিশ্বাস এবং একমাত্র বিশ্বাস। ধর্ম হল শুধুমাত্র পরকাল এবং পরলৌকিক
মোক্ষলাভ। এর বাইরে ধর্মের আর কোনো ইহজাগতিক ভূমিকা নেই। যদিও গোঁড়া ধর্মপন্থীরা
তাদের ধর্মের মৌলিক বিধিবিধানকে সমাজ ও রাষ্ট্রে অবিকলভাবে প্রয়োগ করতে চায়। তারা
রাষ্ট্রের ও সমাজের সকল দিগনির্দেশনার জন্য ধর্মের আদিম ধারণা বা বিধিবিধানকে
অনুসরণ করে। মুসলিম মৌলবাদীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের তাবৎ সমস্যাসমাধানের জন্য তাদের
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন ও সুন্নাহের উপর নির্ভর বা আস্থা রাখতে চায়। মুসলিমরা
যেহেতু কোরানকে ঐশীগ্রন্থ এবং হজরত মোহাম্মদ আল্লাহের প্রেরিত পুরুষ বলে মনে করেন, সেহেতু কোরান ও সুন্নাহের বাইরে কোনো দিগনির্দেশনা
মুসলমানেরা মানতে নারাজ। শুধু মুসলমানেরাই নয়, ইহুদি মৌলবাদীরা তোরাহের আক্ষরিক
ব্যাখ্যার বাইরে এক্কেবারেই যেতে প্রস্তুত নন। খ্রিস্টান মৌলবাদীরাও প্রায় সকল
প্রশ্নে বাইবেলের শিক্ষা অভ্রান্ত বলে দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে। ধর্মীয় বিশ্বাস
একান্ত ব্যক্তি বিশ্বাস হলেও জন্মলগ্ন থেকে প্রত্যেক ধর্ম ধর্মানুসারীদের
গোষ্ঠীবদ্ধ আচার-আচরণের কারণে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এভাবে মানুষের
চিন্তাচেতনা একটি সামাজিক সত্ত্বার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। রাষ্ট্র জনগণকে
শাসন-শোষণ করে যাচ্ছে এবং সে ক্ষেত্রে তাদের অব্যর্থ হাতিয়ার হল ধর্ম। তাই
বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগেও, পেট্রো-ডলারের বদৌলতে
বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সে সব দেশে পৌছোলেও বিজ্ঞানের মূল যে দর্শন, তা সেখানে পৌঁছোতে দেওয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রযন্ত্র সেখানে
অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে। এর
বিরুদ্ধে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় একটু রা করলেই একেবারে
কল্যা-কর্তন। আর তখনই রাষ্ট্র ও ফারাবিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
আদিযুগ থেকে একই ট্র্যাডিশন চলছে। কিছুই বদলায়নি।
কারণ ধর্মের উদ্ভব যুক্তি-তর্ক থেকে হয়নি। ধর্মবেত্তারা বলেন, এগুলি বস্তুত উপলব্ধি বা বোধি থেকে হয়েছে। বুদ্ধি কেবল এইসব
উপলব্ধিকে বোধগম্য রূপ দেয়। অথচ সময়ের কত কিছুরই রূপ বদল হয়ে যায়। এক সময়ে মধ্যযুগ
পর্যন্ত নারীর থুতু ও মূত্রকে পবিত্র মনে করা হত। তা দিয়ে ভাত পর্যন্ত খাওয়া হত(জিজ্ঞাসা
– ত্রয়োবিংশ বর্ষ – তৃতীয়-চতুর্থ যুগ্ম সংখ্যা – ২০০৩ – পৃষ্ঠা ৩৬৮)।আর এখন পিরিয়ড
চলাকালীন মেয়েদের শুভকাজে অংশগ্রহণ ও স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না, পটল আর পানের বরজে ‘অপবিত্র’ প্রতিপন্ন করে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্ম বলতে অনেকে
আচার-অনুষ্ঠান মনে করেন। এ বিষয়ে অনেক ‘নিত্য ক্রিয়া কর্ম
পরিধি’ জাতীয় ঢাউস ঢাউস পুস্তকাদিও
আছে। নানা ধর্মে rituals-এর উপর নানা বইপত্র
আছে। কোনো কোনো অনুষ্ঠান যেমন ভয়ংকর(কাপালিকের শব-সাধনা, নরবলি ইত্যাদি),
কোনো
কোনো অনুষ্ঠান নিপাট নিরীহ, কোনো কোনো অনুষ্ঠান
আবার আপাত-নিরীহ। এই দেখুন নরবলি -- নরবলি এক সময় নানা দেশে বিভিন্ন জনসমাজের
মধ্যে বহুলভাবে প্রচলিত ছিল। মানুষ নরবলি প্রদান করে বলি প্রদত্ত মানুষের রক্ত
ছড়িয়ে দিত ফসলের ক্ষেতে। ভাবত ফসলের দেবী তুষ্ট হবেন। ক্ষেতে ভরে উঠবে ফসল।
মানুষ নরবলি প্রদান করেছে ব্যক্তিগত জীবনের সাধারণ লাভক্ষতির কথা বিবেচনা করে।
হিন্দুদের মধ্যে একটি বিশেষ সাধনা পদ্ধতিকে বলা হয় তন্ত্র। পৃথিবীর প্রধান ধর্মসমূহে
নরহত্যা তথা নরবলির বিধান নেই, বরং নরহত্যা নিষিদ্ধ।
নরহত্যার সঙ্গে নরবলির পার্থক্য হল নরবলি সামাজিকভাবে অনুমোদিত মানুষ হত্যা যার
উদ্দেশ্য দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জন। পাঁচ হাজার বছর আগে আদি ইউরোপের কৃষিভিত্তিক
সমাজে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ছিল। অপরাধের কারণে বিচারাদেশ অনুযায়ী হত্যা বা
দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মহত্যা নরবলি হিসাবে গণ্য নয়। নরবলি চল ছিল এমন
কয়েকটি সভ্যতা হল -- খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-১১০০ সাল ব্যাপী ক্যানানাইটিস, খ্রিস্টপূর্ব ৮০০-১০০ সাল ব্যাপী এত্রুস্ক্যানস্, খ্রিস্টপূর্ব ৮০০-১ সাল ব্যাপী কেল্টস্ এবং ৫০০ থেকে ১৫০০
খ্রিস্টাব্দ অবধি বিস্তৃত আজটেক সভ্যতা। কখনো-কখনো গণ-নরবলিও সংঘটিত হত, যেমন ফেরাউনদের রাজত্বকালে। নরবলিতে নির্গত রক্তকে
গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত; নরবলির রক্ত দিয়ে
উপাসনা স্থান পরিষ্কারকরণের রীতিও প্রচলিত ছিল। মায়া সভ্যতায় শিরশ্ছেদের
সঙ্গে সঙ্গে উৎসর্গীকৃত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড বের করে ফেলার রীতি ছিল। তান্ত্রিকদের
মধ্যে একদল ছিল, যাদের বলা হতো
কাপালিক। কাপালিকরা নরবলি দিত। বলি প্রদত্ত মানুষের বুকের ওপর বসে করত ধ্যান। তারা
ভাবত, এভাবে লাভ করতে পারবে
মহাশক্তি। এমনকি অমরতা। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার সম্পাদিত ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’
গ্রন্থের
দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন—“তান্ত্রিকরা অনেক
বীভত্স আচরণ করে যেমন, মানুষের মৃতদেহের ওপর
বসিয়া মরার মাথার খুলিতে উলঙ্গ স্ত্রী-পুরুষের সুরা পান”। উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র উনবিংশ শতাব্দীতে লিখেছেন তার
বিখ্যাত উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’। কপালকুণ্ডলাতে আছে নরবলি ও কাপালিকের বর্ণনা। একদল ডাকাত
ডাকাতি করত কালীপূজা করে। কালীপূজায় তারা দিত নরবলি। তারা বলত, তারা ডাকাতি করছে,
লোক খুন
করছে মা কালীর ইচ্ছায়, এটা তাদের ধর্ম। এই
নরবলি রাজারাজড়ারা দিতেন। আবার ধনী সমাজপতিরাও দিতেন। নবাবি আমলে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে
হিন্দু জমিদার কর্তৃক দেবীর তুষ্টি সাধনের জন্য প্রজার কুমারী মেয়ে ধরে এনে
বলিদানের কাহিনিও ইতিহাসে রয়েছে।
এহেন ধর্মীয় আচার কি বন্ধ হয়ে গেছে, যা নরবলি ? না, বন্ধ হয়নি। ফল্গুধারার মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে আজও বেঁচে আছে এই
প্রথা। অতএব ‘আমরা সভ্য হয় গেছি’ বলে যাঁরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিলেন, তাঁরা সংবাদটি পড়ুন –
“সীতাকুণ্ডে
পূণ্য অর্জনের জন্য দেবী মা কালীর উদ্দেশ্যে নরবলি দিয়েছে এক যুবক ! গত রবিবার
(২৩ অক্টোবর, ২০১২) গভীর রাতে উপজেলার ছোট
কুমিরা মসজিদ্দা গ্রামে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ ঘাতক যুবককে গ্রেপ্তার ও
হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল (সোমবার) সকালে সীতাকুন্ডের কুমিরা ইউনিয়নের উত্তর
মসজিদ্দা গ্রামের কয়েকজন কৃষক ক্ষেতে যাওয়ার সময় ডোবার ধারে এক যুবকের গলা কাটা
লাশ দেখতে পায়। শরীর থেকে গলা আলাদা হয়ে পড়ে ছিল। পুলিশকে জানায়, তার অনেক দিন ধরে মা কালীকে একটি নরবলি দেওয়ার ইচ্ছা জাগে।
একথা বন্ধু রিটুকে বলার পর রিটু নিজে বলি হতে রাজি হয়। কারণ, মা কালীর জন্য বলি হলে স্বর্গে যাবে বলে তার বিশ্বাস।
পরিকল্পনা অনুযায়ী রবিবার গভীর রাতে রিটুকে বলি দেয় সে”।
আরও একটি ঘটনা : দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে
মন্দিরে পূজা হচ্ছে না। এতে মা কালী রুষ্ট হয়েছেন। তাই এখন পূজার ব্যবস্থা করলে মা
কালী মাটি ফুঁড়ে স্বর্ণের মূর্তিসহ অচিরেই আবির্ভূত হবেন। তার আবির্ভাবের সময়
বাড়ির আশপাশে পাওয়া যাবে বিপুল স্বর্ণালংকার। শুধু তাই নয়, মা কালীর সন্তুষ্টির জন্য যতো তাড়াতাড়ি নরবলি (জবাই) দেয়া
যায়, ততো তাড়াতাড়ি মা কালী
আবির্ভূত হবেন। পাশাপাশি এলাকাবাসীরও মঙ্গল হবে। এলাকার ধর্মপ্রাণ লোকজনের কাছ
থেকে চাঁদা তুলে ওই পুরনো মন্দির ভিটিতে ঘর তুলে কালী পূজা দেন ওই দুই ভণ্ড সাধক।
মাঝে মধ্যে সেখানে তারা কবুতর জবাই করে রক্ত পান করতেন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
ধর্মের আচার হিসাবে কুখ্যাত সেই প্রথা, যা সতীদাহ প্রথা বলে সবাই জানে। একদা ধর্মীয়ভাবে আদরনীয়
প্রথা আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ বটে ! সতীদাহ বা সহমরণ বলতে বুঝায় স্বামীর মৃত্যুর
পর সদ্য-বিধবা স্ত্রীকে তার স্বামীর চিতায় জীবন্ত স্থাপন করে পুড়িয়ে মারা। এই
প্রথা এখন নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত বলে মনে হলেও হিন্দুসমাজে একসময় তা পরম শ্রদ্ধার
সঙ্গে দেখা হত। অনেক মুসলিম শাসক সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা তাদের চেষ্টায় সফল হতে পারেননি। হিন্দুদেরই
অদম্য চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয় ইংরেজ আমলে।
ধর্মীয় ব্যবস্থা চিরকাল শক্তিশালীদের
পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। ধর্ম প্রশ্রয় দিয়েছে সামাজিক শোষণকে। ব্রাহ্মণ্যধর্ম মানুষে
মানুষে বিস্তর ব্যবধান তৈরি করেছে। যে মানুষ ঈশ্বর ভক্তিতে ঢলঢল, ধর্মীয় আচরণে তন্নিষ্ঠ – সেই মানুষই একই সঙ্গে গর্হিত, অনৈতিক কাজকর্মে
নির্ভীক লিপ্ত, পাপাচারে নিষ্কম্প। ধর্মের
সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে পড়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামি। প্রকৃত ধর্মে যত উদারতার কথা বলা হোক
না-কেন, ভিন্ন ধর্মকে হেয় জ্ঞান করা
প্রায় প্রত্যেক ধর্মাচারীর চরিত্রেরই আবশ্যিক অঙ্গ। শুধু ধর্ম ভিন্ন হওয়ার কারণে
দীর্ঘদিনের বন্ধু, প্রতিবেশী মহূর্তের
মধ্যে শত্রু হয়ে যায়।ধর্মীয় আবেগ পর্যবসিত হয় জিঘাংসায়, বীভৎস হিংস্রতায়,
নিষ্ঠুর
গণহত্যায়।এই ঘাতকেরা হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ সকলে। যাদের আমরা
ধার্মিক বা ধর্মবিশ্বাসী বলে দেখি তারা কি সত্যিই ধর্ম মানেন ? তাঁরা কি মানেন ধর্মের নিদান ? না, সৌভাগ্য সমগ্র
মানবজাতির। ধর্মের নিদান ঠিকঠাক মেনে চলা হয় না। আবার ধর্মের নামে ব্যবস্থা মানতে
দেখা যায় যা ধর্মে কোথাও উল্লেখ নেই। হিন্দু,
মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ সকল ক্ষেত্রেই
এমন শাস্ত্রহীন ব্যবস্থা দেখা যায়।হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে দু-একটা
উদাহরণ এখানে উল্লেখ করব। প্রথমে হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একদা অবশ্য
পালনীয় নিদান বা প্রথা আলোচনা করব, ধর্মে কোনোরকম সমর্থন
নেই : অধুনা লুপ্ত সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা।এহেন ধর্মীয় প্রথা হিন্দু
ধর্মশাস্ত্রগুলিতে কোনোরকম উল্লেখ নেই।প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সতীদাহ প্রথা নামে
কোনো শব্দের উপস্থিতি পাওয়া যায় না। তবে সহমরন শব্দ ও তার প্রয়োগ দেখা যায়। সতীদাহ
প্রথা হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মহুতি
দেওয়ার প্রথা। তবে পৌরাণিক কাহিনিতে এ আত্মাহুতি অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ
হিসেবেই দেখা হত। মহাভারত অনুসারে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান।
কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পাণ্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী যেহেতু পাণ্ডুকে
যৌনসহবাসে মৃত্যুদণ্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। রাজপুতানায় ‘জহর ব্রত’ প্রচলিত যাতে কোনো
শহর দখল হওয়ার পূর্বেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ)
দিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ। কিন্তু কালক্রমে
বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু স্ত্রীকে সহমরণে বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোনো
ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা
স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ
দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার মৃত স্বামীর মরদেহর সঙ্গে চিতায়
শুইয়ে পুড়িয়ে মারত।
পাশ্চাত্যের গবেষকদের অনেকের মাঝে দ্বন্দ্ব
থাকলেও ভারতীয় বেদ ভাষ্যকারগণদের মতে বেদে সতীদাহের উল্লেখ নেই। বরং স্বামীর
মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহের ব্যাপারেই তাঁরা মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে অথর্ববেদের দুটি
মন্ত্র প্রণিধানযোগ্য : অথর্ববেদ ১৮.৩.১ ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত
উপত্ব্য মর্ন্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ
ধেহি।। হে মনুষ্য ! এই স্ত্রী পুনর্বিবাহের আকাঙ্খা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার
নিকট আসিয়াছে। সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।
অথর্ববেদ ১৮.৩.২ (এই মন্ত্রটি ঋগবেদ ১০.১৮.৮-এও আছে) “উদীষর্ব নার্ষ্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপশেষ এহি।
হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সংবভূব”।। হে নারী ! মৃত পতির শোকে অচল হয়ে লাভ কি ? বাস্তব জীবনে ফিরে এসো। পুনরায় তোমার পাণিগ্রহণকারী পতির
সঙ্গে তোমার আবার পত্নীত্ব তৈরি হবে। বেদের অন্যতম ভাষ্যকার সায়ণাচার্যও তাঁর তৈত্তিরীয়
আরণ্যক ভাষ্যে এই মতই প্রদান করেন।
অথচ এমন এক অমানবিক এবং পৈশাচিক প্রথা
হিন্দুধর্মে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। মৃত স্বামীর চিতার উপর জলজ্যান্ত সদ্য বিধবা
হওয়া নারীকে জোর তুলে দিয়ে মেরে ফেলা হত। সেই ঘটনা পরম শ্রদ্ধা এবং পবিত্রতার
সঙ্গে দেখা হত। এই সতীর দাহ দেখার জন্য অন্যান্য সাধারণ মানুষের ভিড় জমে যেত
প্রত্যক্ষ করার জন্য। সতীমায়ের মন্দির,
সতীমায়ের
পায়ের ছাপ পরম পবিত্র জিনিস ছিল।
অবশেষে,
দিল্লি
সুলতানি রাজত্বকালে সতীদাহ প্রথার জন্য যাতে বিধবাকে বাধ্য না-করা হয় তাই সতীর
কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সতীদাহ প্রথা সম্পাদন করার রীতি ছিল। যদিও পরে এটি একটি
প্রথানুগামিতার রূপ নেয়। মুঘল সম্রাটরা স্থানীয় চলিত প্রথায় সাধারণত
অন্তর্ভুক্ত হতেন না। কিন্তু তারা এই প্রথা বন্ধের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। মুঘল
সম্রাট হুমায়ুন (১৫০৮-১৫৫৬) সর্বপ্রথম সতীদাহের বিরুদ্ধে রাজকীয় হুকুম দেন। এরপর
সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫) সতীদাহ আটকানোর জন্য সরকারিভাবে আদেশ জারি করেন যে, কোনো নারী, প্রধান পুলিশ
কর্মকর্তার সুনির্দিষ্ট অনুমতি ছাড়া সতীদাহ প্রথা পালন করতে পারবেন না। এছাড়াও
এই প্রথা রদের জন্য তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের অধিকার দেন, যা তারা যতদিন সম্ভব ততদিন সতীর দাহের সিদ্ধান্তে বিলম্ব
করতে পারেন। বিধবাদেরকে উত্তরবেতন, উপহার, পুনর্বাসন ইতাদি সাহা্য্য দিয়েও এই প্রথা না পালনে
উত্সাহিত করা হত। ফরাসি
বণিক এবং ভ্রমণকারী তাভেনিয়ের লেখা থেকে জানা যায় যে, সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বে সঙ্গে শিশু আছে এমন বিধবাদেরকে
কোনোমতেই পুড়িয়ে মারতে দেওয়া হত না এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে, গভর্নররা তড়িঘড়ি সতীদাহের অনুমতি দিতেন না (কিন্তু ঘুষ দিয়ে করান যেত)।
হিন্দুদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান : হিন্দুশাস্ত্রে
উল্লেখ নেই এমন আর-একটি প্রথা হল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। হিন্দুদের আদি বা মূল
ধর্মগ্রন্থ বেদ হিন্দুদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নিয়ে কী নির্দেশ দিয়েছেন প্রাজ্ঞগণ।
বৈদিক সংস্কারে মৃতের শেষকৃত্য সমাপনে যে মন্ত্রাদি ব্যবহৃত হয় তা পৌরাণিক নিয়ম
অর্থাৎ হিন্দুদের বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম বা মন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈদিক
নিয়মে মৃতের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে দুই থেকে তিনদিন লাগে। মানুষ মারা গেলে তাকে
দাহ করার নাম “অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া”। ‘অন্ত্যা’ অর্থে অন্তিম, চরম বা সর্বশেষ এবং ‘ইষ্টি’ অর্থে যজ্ঞ, শুভকর্ম বা সংস্কারকে বোঝায়। বৈদিক পণ্ডিত শ্রীমদ্ দয়ানন্দ
সরস্বতী তাঁর রচিত “সংস্কার বিধি”-তে বলেছেন, “এখানে ‘ইষ্টি’ বলিতে যজ্ঞ বা
শুভকর্ম বোঝায় বলিয়া অন্ত্যেষ্টি কর্মে পুণ্যই হইয়া থাকে। ইহাতে পাপ বা অশৌচ হইলে
ইহার নাম ‘ইষ্টি’ হইত না। ‘অন্ত্যেষ্টি’ শব্দ স্বয়ং ঘোষণা করিতেছে যে, মৃতদেহ দাহ করাই পুণ্যের কাজ”। বড়োজোর, স্বামী দয়ানন্দ বলেছেন, শব দাহান্তে যে গৃহে মৃত্যু হয়েছে সেই গৃহ মার্জন, লেপন ও প্রক্ষালন করে বিশুদ্ধ করে নেওয়া যেতে পারে। এমনকি
স্বস্তি বাচন ও শান্তি প্রকরণাদি মন্ত্র দ্বারা ঈশ্বরের উপাসনা করা যেতে পারে।
কিন্তু পুরাণগুলির (বিশেষ করে গোরুড়পুরাণ) ছত্রে ছত্রে যজমানদের নিঙড়ে কামানোর
ফরমান। সবৎস্য গোরু দান, ভূমিদান, স্বর্ণদান, ষোড়শদান ( ১৬টি
দ্রব্য – ভূমি বা ভূমিমূল্য, আসন, শয্যা, অন্ন, বস্ত্র, গোরু, জল, প্রদীপ, তাম্বুল, ছত্র বা ছাতা, গন্ধ, মাল্য বা মালা,
ফল, পাদুকা, সোনা, রুপো।এগুলি দান করলে মৃত ব্যক্তি ৯৬০ হাজার বছর স্বর্গে
সুখে কাল কাটাতে পারবে। মৃতের আত্মীয়গণ যত ভালো ভালো দ্রব্যাদি ব্রাহ্মণকে দান
করতে পারেন তত ভালো ভালো দ্রব্যাদি মৃত ব্যক্তি স্বর্গে পাবেন।), মৃতের পছন্দের জিনিসপত্র, ব্রাহ্মণভোজন ইত্যাদি কঠোর বিধান। সামর্থ্য থাক-বা-থাক, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে এসবের আয়োজন করতে হবে। এইসব ব্রাহ্মণগণ
মৃত আত্মীয়ের স্বর্গে পাঠানোর বাহানায় সমগ্র হিন্দুজাতিকে ভিখিরি করে ছেড়েছে।
কিন্তু ব্রাহ্মণগণ বুঝলেন এই বেদ অনুসরণ করলে
ব্যাপক কোনো ফায়দা হবে না। অথচ মৃতের পরিবারের কাছ থেকে ব্যাপক ফায়দা সম্ভাবনা
রয়েছে। পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যু একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়। কোন্ পরিবার না-চায়
তাঁর মৃত সদস্য স্বর্গসুখ পাক ? অতএব মৃত সদস্যের
স্বর্গের সমস্ত রকম সুখ দেওয়ার সবরকম ব্যবস্থার বিধি সৃষ্টি করতে হবে। অতঃপর
ব্রাহ্মণগণ পুরাণের মতো গ্রন্থগুলি রচনার কাজে হাত দিলেন। রচিত হল ১৮টি প্রধান
পুরাণ এবং ১৮টি উপপুরাণ নামক আকর গ্রন্থ। এই পুরাণগুলির পাতায় পাতায় বর্ণিত
ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ বিষয়ক ভয়ংকর সব বক্তৃতা এবং স্ববিরোধী নিয়ম-বিধি-বিধান। এই
পুরাণগুলিই হল ব্রাহ্মণ্যবাদের রক্ষাকবচ। ব্রাহ্মণ্যবাদের আলোচনায় পরে আসছি। এখন
ফিরে যাই শ্রাদ্ধের প্রসঙ্গে।নিয়ম করলেন শোকার্ত পরিবারের কাছ থেকে কীভাবে কতটা
চুষে খাওয়া যায়।
হিজাব : আরও একটি
প্রথা, তার নাম হিজাব বা বোরখা বা
পর্দা। এই প্রথাটি মুসলিম সমাজে জাঁকিয়ে বসে আছে। দেখলেই মনে হয় এটি ধর্মীয় আদেশ
বা নির্দেশ। যে আদেশ বা নির্দেশ আছে তা নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্য সেই নির্দেশ
প্রযোজ্য। কোরানে হিজাব রাখার কথা বলা হয়েছে বটে -- কিন্তু এইভাবে নয়, যেভাবে মুসলিম সমাজে হিজাব প্রচলিত আছে।Wikipedia বলছে,
আরবিতে
হিজাব পদের সাহিত্যিক অর্থ “একটি অন্তঃপট বা
পর্দা” এবং কোরানে বিভাজন নির্দেশ
করতে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। কোরান বলে পুরুষ বিশ্বাসীরা (মুসলিম) মোহাম্মদের
স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলত একটি পর্দার আড়াল থেকে। এই পর্দা পুরুষদের দায়িত্বের
অংশ ছিল মোহম্মদের স্ত্রীদের নয়। এই থেকে অনেকে দাবি করে কোরানের মোহম্মদের
স্ত্রীদের হিজাব প্রয়োগের নির্দেশ থাকলেও,
সাধারণ
নারীদের নেই। যদিও হিজাব প্রায়শই পুরুষ কর্তৃক নারীদের নিয়ন্ত্রণ এবং শব্দহীন
করতে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে পশ্চিমাদের কর্তৃক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, এই চর্চা ভিন্নভাবে ভিন্ন প্রসঙ্গে উপলব্ধ হয়। এক নতুন
উদ্ভাবিত বস্তু হিসাবে হিজাব এসেছে ইসলামে। এটি একটি গতানুগতিক পুরোনো আমলের পোশাক, যা ধর্মীয় নয়। এর পক্ষে ও বিপক্ষে কোরান কিছু বলে না।
হিজাব কথাটি কোরানে ব্যবহৃত হয়েছে ৭ বারের মধ্যে
৫ বার হিজাব হিসাবে এবং হিজাবান হিসাবে ২ বার।
৭:৪৪,
৩৩:৫৩, ৩৮:৩২, ৪১:৫, ৪২:৫১, ১৭:৫১, ১৭:৪৫, ১৯:১৭ এসব আয়াতে ‘হিজাব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে
সুপারিশ হিসাবে কিন্তু কিছু মুসলিম মহিলারা এটাকে আদর্শ পোশাক মনে করে। হজরত
মোহাম্মদের ওফাতের পর ‘হিজাব’ কথাটি পোশাকের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু নবিজি
এটাকে নিদিষ্ট পোশাক করে যাননি। আল্লাহ ‘হিজাব’ কথাটি ব্যবহার করেছেন তেমন যেমন হাদিস কথাটি ব্যবহার
করেছেন। হিজাব মুসলমান মহিলাদের আদর্শ পোশাক এ সম্পর্কে কোরান কিছুই বলেনি। আবার
অনেক ‘খিমার’ শব্দটিকে হিজাবের সমার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু
‘খিমার’ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ ঢাকনা, পর্দা পোশাক। তাই কোনো কিছু ঢাকার কাপড় ও খিমার হয়। আরবে ‘খামরা’ শব্দটি খিমার হিসাবে
ব্যবহৃত হয়। কিমার ওখামার দুটি শব্দর অর্থই পর্দা। একটি জানালা, শরীর, টেবিল ঢাকার পর্দা
অপরটি খিমরা -- যা মনের পর্দা। কিন্তু বেশির ভাগ অনুবাদক হাদিস দ্বারা উদ্বুদ্ধ
হয়ে এটাকে মাথা ঢাকার বা শরীর আবৃত রাখার পর্দা হিসাবে অনুবাদ করেছেন। কোরআনের
২৪:৩১ আয়াতে এছাড়া পোষাক সম্পর্কে প্রথম যে বিধান সেখানে (৭:২৬) এই শব্দটি আছে।
কিন্তু কিছু মুসলিম মনে করে সুরা ২৪:৩১ আয়াতে হিজাবের (মাথার ঘোমটা) বদলে ‘খিমোরিহিন্না’ শব্দটি ব্যবহার
করেছেন। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে আল্লাহ ‘হিজাব’ কথাটি কয়েকবার ব্যবহার করেছেন। এতে বোঝা যায় ‘খিমার’ কথাটি অন্য অর্থে
ব্যবহৃত হয়েছে, হিজাব বা ঘোমটা হিসাবে নয়।
আজ থেকে ৫০০০ বছর পূর্বে পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা
মেসোপটেমিয়ায় হিজাব বা পর্দা প্রথা শুরু হয়েছিল। মেসোপটেমিয়ার সম্ভ্রান্ত নারীরা
নিজেদের কে দাসী ও বেশ্যা নারীদের থেকে পৃথক রাখার জন্য যখন উনারা ঘরের বাইরে
যেতেন তখন উনাদের সারা শরীর লম্বা কাপড় দিয়ে ঢেকে ও মাথার চুল কাপড় দিয়ে ঢেকে
তারপর ঘর থেকে বের হতেন। যদি কেউ কোন কারণে মাথা মুখ না ঢেকে বাইরে বের হয়ে পড়ত, তখন তাঁকে আইন অমান্য করার অপরাধে শাস্তি দেয়া হত। ৫৩৯
খ্রিস্টপূর্ব অব্দে যখন প্রথমবারের মতো পার্সিরা অ্যাসিরীয়দের রাজধানী মেসোপটেমিয়া
দখল করে বিজয়ীর বেশে নগরে প্রবেশ করে,
তখন
রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ বেশভূষা পরিহিত নারীদের মধ্যে ২/১ জন নারীকে বিশেষ পোশাক
পরা এবং মাথা, মুখ ঢেকে চলাচল করতে দেখে।
তখন তারা জানতে পারে যে, অ্যাসিরীয়দের অভিজাত
নারীরা ঘরের বাইরে আসেনা, কোনো কারণে ঘরের
বাইরে এলে তারা যে অভিজাত পরিবারের নারী,
তা
পথচারীদেরকে জানান দিতেই তারা তাদের মাথা এবং মুখ ঢেকে রাখে। পার্সিরাও আভিজাত্যের
প্রতীক হিসাবে তাদের নারীদের মধ্যেও এই প্রথাকে গ্রহণ করে।
কালক্রমে পার্সি সাম্রাজ্য বিস্তার এবং বর্ধিত
আকার ধারণের সঙ্গে সঙ্গে নব বিজিত এলাকার অভিজাত শ্রেণির লোকেরাও এই প্রথাকে গ্রহণ
করে নেয়। পরবর্তীতে পার্সিদের হাত ধরে এই প্রথা ভূমধ্যসাগরের পূর্ব পাশের দেশ সমূহ
সিরিয়া, লেবানন ও উত্তর আরবে ছড়িয়ে
পড়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপের রাজা বাদশার পরিবার পরিজনও বাইরে বের হবার সময় পর্দা
করত। তবে সেই সময় হিজাব বা পর্দা প্রথাটা ছিল শুধু অভিজাত শ্রেণির নারীদের জন্য।
অনেক ধার্মিক মুসলিমগণ মনে করেন দ্বিন ইসলামের প্রত্যেকটা মেয়েই হল এক একজন
সম্ভ্রান্ত নারী। তাই
ইসলাম প্রত্যেকটা মেয়েকেই হিজাব বা পর্দা করতে বলেছে।
যে-কোনো ইহুদি ধর্মীয় পুস্তক থেকে জানা যায় তাদের
ধর্মীয় নেতারা মাথা আবৃত রাখতে বলেছেন। এখনও ইহুদি মহিলারা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে
মাথা আবৃত রাখে। এবং খ্রিস্টানরাও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাথা আবৃত রাখে।
সুতরাং হিজাবকে ব্যবহার করা যায় আরবি প্রথা, ইহুদি খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় লোকেরা ব্যবহার করে এই
হিসাবে কিন্তু কোরানে বা ইসলামে আছে এই হিসাবে নয়। সৌদি আরবে এখনও সবাই মাথা আবৃত
রাখে। কারণ এটা তাদের পোশাক, কোনো ইসলামিক
দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়। উত্তর আমেরিকায় অনেক উপজাতি মুসলিম মহিলাদের পরিবর্তে পুরুষরা
হিজাব ব্যবহার করে। যদি হিজাব আর্দশ পোশাক হয় তবে বলতে হবে এর প্রথম কৃতিত্ব মাদার
তেরেসার। হিজাব একটি প্রথাগত পোশাক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের। যার সঙ্গে মুসলমান বা
ইসলামের নিদিষ্ট কোনো সর্ম্পক নেই। পৃথিবীর কোথাও হিজাব পরে মেয়েরা, কোথাও ছেলেরা। মেয়েদের মুখ খোলা রাখার ব্যাপারে আলেমদের
মাঝে অনেক মতভেদ আছে। তবে আমি নিজে মুফতি আমিনের এক সাক্ষাৎকারে শুনেছিলাম উনার
মৃত্যুর ১ বছর আগে ইন্ডিপেন্ডেন্ট চ্যানেলে যেখানে মুফতি আমিন বলেছিলেন, মেয়েদের মুখ ঢাকা ফরজ না। ইসলামি শরিয়তেও মেয়েদের মুখ ঢাকা
বা নিকাব পরিধান করা ফরজ না। কোনো মেয়ে চাইলে তার মুখ খোলা রাখতে পারবে বা মুখে
নিকাব পরিধান করতে পারবে। মুখ ঢাকার ব্যাপারে আল কোরানের কোনো আয়াত বা সরাসরি কোনো
হাদিস নেই। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবিত থাকা অবস্থায়
আরবের মেয়েরা যে মুখ খোলা রাখত এর অনেক প্রমাণ হাদিস শরিফে পাওয়া যায়।
খতনা : ইসলাম
ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আরও একটি হল ধর্মীয় আচার সুন্নতে খতনা। সুন্নতে খতনা
শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য নয়।তা
সত্ত্বেও বিশ্বে কমপক্ষে ১৫ কোটি মুসলিম নারী খতনা প্রথার মতো বর্বরতার শিকার হয়।
আফ্রিকায় এখনও কুমারী মেয়েদের খতনা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে কুমারীদের
প্রজননতন্ত্রের বিশেষ একটি অঙ্গকে (ভগাঙ্কুর বা ক্লাইটোরিস) কেটে ফেলা হয়। নারীর
জৈবিক চাহিদা কমাতে এ প্রথা চালু হয়েছিল। এ ধারাটি শুধু আফ্রিকাতে নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো সভ্য সমাজেও প্রচলিত। ইউরোপ বা আমেরিকায়
বসবাসকারী হাজার হাজার মা তাদের ছোট্ট কুমারী মেয়েদের খতনা করাচ্ছেন প্রথাগত
বিশ্বাস থেকে। ইয়েমেন, ইন্দোনেশিয়া, কুর্দিস্তান (ইরাক),
সোমালিয়া, সুদান, ইরিত্রিয়া, জিবুতি, সিয়েরালিয়ন, মালি, গিনি, ইথিওপিয়া প্রভৃতি আফ্রিকান আরব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ঐতিহ্যের
দোহাই দিয়ে মেয়েদের খতনা করা হয়। এর সঙ্গে কুমারিত্বের প্রশ্নও নাকি জড়িত।
সিয়েরালিয়নে মেয়েদের খতনা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধ। প্রতিদিন বিশ্বে ৬ হাজার কুমারীকে
খতনার শিকার হতে হয়। কিছু মানুষের মধ্যে এমন বিশ্বাসও চালু আছে, যেসব নারীকে খতনা দেওয়া হয় না, তারা খাঁটি নন। তবে যাদের খতনা দেয়া হয়, তারা যে দীর্ঘস্থায়ী দৈহিক ও মানসিক বিশৃঙ্খলতা নিয়ে বেঁচে
থাকেন – একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০০৮ সালে মিশর একটা আইন পাশ করে যা নারীদের এফজিএম (মুসলমানি/লিঙ্গের ত্বকচ্ছেদ)
নিষিদ্ধ করে।
যদিও পুরুষদের খতনা করার ব্যাপারে বহু মত আছে।
কেউ মনে করেন ফরজ, কেউ মনে করেন সুন্নত, কেউ-বা মনে করেন প্রাচীন আরবীয়দের প্রথা বা সংস্কারমাত্র।
কোনো স্পেশাল ধর্মের অংশ নয়। এ প্রথা ইসলাম,
খ্রিস্ট
ও ইহুদি ধর্মে বিদ্যমান। এ ধর্ম তিনটি আরবদের থেকে প্রচারিত বিধায় প্রাচীন আরবদের
একটি সংস্কার বা প্রথা এসব ধর্মে ঢুকে গেছে।
খতনা একজন পুরুষের জীবনঘনিষ্ঠ স্বভাবকর্ম
(ফিতরাত)। ইসলামে এটি সুন্নত। বলা হয় মুসলমানদের অনুসরণীয় স্বাস্থ্যবিধি। সাধারণ
পরিভাষায় খতনাকে ‘মুসলমানি’ বলা হয়। মুসলিম জাতির পিতা অভিধায় ভূষিত হজরত ইব্রাহিম
প্রবর্তিত সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত এটি। হজরত ইব্রাহিম ঐশী নির্দেশে ৯৯ বছর বয়সে, হজরত ইসমাইল ১৩ বছর
বয়সে এবং হজরত ঈসা ৮ বছর বয়সে খতনা
করেছেন। প্রিয় নবি হজরত মোহাম্মদও খতনা করেছেন। এটি মূলত পয়গম্বরের প্রবর্তিত
সুন্নত। এ মর্মে কয়েকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
ইসলাম
গ্রহণ করলে নবি করিম খতনা করার আদেশ
করেছেন আর নবিজির নির্দেশ মেনেই তা পালন করা ওয়াজিব। হজরত আবু হুরায়রা বর্ণিত,
রাসুলে
করিম বলেছেন, “পাঁচটি বিষয় মানুষের ফিতরাতের
অন্তর্ভুক্ত। গোঁফ ছাঁটা, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নখ কাটা, নাভির নিম্নাংশের লোম
চেঁছে ফেলা ও খতনা করা।“ (সুনানে নাসায়ি)।
মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরানে খতনা বিষয়ে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। তা সত্ত্বেও
মুসলিমগণ মনে করেন, পুরুষদের খতনার
বিষয়টি ইসলামসম্মত, ওয়াজিব বটে যা নবী
করিম (সা.) এর নির্দেশিত পদ্ধতি।
ফেসবুকে পুরুষদের মুসলমানী নিষিদ্ধ করার
প্রচারণা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে আর
সদস্য পেয়েছে। ড: সেহাম আব্দেল সালেম একজন গবেষক ও লেখক সমর্থন করেছেন যে, পুরুষদের মুসলমানী খাঁটি কসাইয়ের কাজ,
আর
সরাসরি এর সম্পর্ক পুরুষশাসিত সমাজের সঙ্গে ।এই ধরনের অভ্যাসের সঙ্গে ইসলামের কোনো
সম্পর্ক নেই। আরো নসিরিক নামে একটা আমেরিকান সংস্থা (http://www.answers.com/NOCIRC ) যারা পুরুষদের
মুসলমানি প্রতিকারের চেষ্টা করছে। হল্যান্ডের ১৬১ বছরের পুরোনো ডাক্তারদের সংগঠন
"The Royal Dutch Medical
Association" ছোটো বাচ্চাদের circumcisions (খাঁটি বাংলায়
মুসলমানি) করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের ভাষ্যে এটা "medically unnecessary" এবং বাচ্চাদের অধিকার খর্ব
করে। ডাক্তার এবং শিক্ষানবিশ ডাক্তার সহ হল্যান্ডের এই সংগঠনের মোট সদস্য সংখ্যা
৪৬০০০। এই ডাক্তারদের মতে এটি হল -- "a
violation of the integrity of the body." বিশ্বের বাকি মুসলিমগণ কী
ভাবছেন ?
খ্রিস্টান বলতেই আমরা বুঝি গলায় ঝোলানো ক্রুশ।
গলায় ঝোলানো ক্রুশ ছাড়া খ্রিস্টানদের ভাবাই যায় না। এই ক্রুশ কি ধর্মীয় বিধান ? দেখব। লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্রুশের প্রতি ভক্তি ও সম্মান
প্রদর্শন করে থাকে। “দি এনসাইক্লোপিডিয়া
ব্রিটানিকা” ক্রুশকে “খ্রিস্টধর্মের প্রধান প্রতীক” বলে থাকে। তা সত্ত্বেও সত্য খ্রিস্টানরা উপাসনায় ক্রুশ ব্যবহার করে না। কেন
করে না? লক্ষ লক্ষ লোক ক্রুশের প্রতি
ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। দি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ক্রুশকে “খ্রিস্টধর্মের প্রধান প্রতীক” বলে থাকে। তা সত্ত্বেও, সত্য খ্রিস্টানরা
উপাসনায় ক্রুশ ব্যবহার করে না। কেন করে না ?
একটা
গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল যে, যিশুখ্রিস্ট একটা
ক্রুশের উপর মারা যাননি। যে গ্রিক শব্দটিকে সাধারণত “ক্রুশ” হিসাবে অনুবাদ করা
হয়েছে, তা হচ্ছে ‘স্টেরস’, এর অর্থ মূলত খাড়া
কোনো খুঁটি বা দণ্ড। দ্যা কমপ্যানিয়ন বাইবেল উল্লেখ করে : “(স্টেরস) বলতে কখনো কোনাকুনিভাবে একটার উপর আর-একটা স্থাপিত
দুই টুকরো কাঠকে বোঝায় না। . . . (নিউ টেস্টামেন্ট) এর গ্রিক ভাষায় এমন কোনোকিছুই
নেই, যা দুই টুকরো কাঠকে ইঙ্গিত
করে।”
খ্রিস্টের মৃত্যুর পর প্রথম ৩০০ বছর পর্যন্ত
নিজেদের খ্রিস্টান বলে দাবি করত এমন কোনো ব্যক্তি তাদের উপাসনায় ক্রুশ ব্যবহার
করেছিল কি না, সেই বিষয়ে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ
নেই। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীতে পৌত্তলিক সম্রাট কনস্ট্যানটিন ভাক্ত খ্রিস্টধর্মে
ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং এর প্রতীক হিসেবে ক্রুশের ব্যবহারকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কনস্ট্যানটিনের উদ্দেশ্য যাই-ই হোক না-কেন,
ক্রুশের
সঙ্গে যিশুখ্রিস্টের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বস্তুতপক্ষে ক্রুশের উৎস হচ্ছে
পৌত্তলিক। আরও অন্যান্য উৎস ক্রুশকে প্রকৃতি পুজো ও পৌত্তলিক যৌন আচার-অনুষ্ঠানের
সঙ্গে যুক্ত করেছে।
তাহলে কেন এই পৌত্তলিক প্রতীককে ছড়িয়ে দেওয়া
হয়েছিল ? স্পষ্টতই পৌত্তলিক উপাসকরা
যেন সহজেই ‘খ্রিস্টধর্ম’ গ্রহণ করে নেয়। তা সত্ত্বেও, যে-কোনো পৌত্তলিক প্রতীকের প্রতি ভক্তিকে বাইবেলে স্পষ্টভাবে নিন্দা করা
হয়েছে। (২ করিন্থীয় ৬:১৪-১৮) এ ছাড়া,
শাস্ত্র
সমস্ত ধরনের প্রতিমাপুজোকে নিষেধ করে।
(যাত্রাপুস্তক ২০:৪, ৫; ১ করিন্থীয় ১০:১৪) অতএব, অত্যন্ত উপযুক্ত কারণেই সত্য খ্রিস্টানরা উপাসনায় ক্রুশ ব্যবহার করে না।
হলিউডের সিনেমাগুলিতে খুব ক্রুশের কেরামতি দেখা
যায়। অশরীরি আত্মা বা ওই জাতীয় কিছু রুখে দিতে ক্রুশের জবাব নেই।তার অলৌকিক কাণ্ড
দেখিয়ে সবাইকে চমকে দেয়। চলচ্চিত্রে এহেন ক্রুশ-মাহাত্ম্যও সাধারণের মনে মিথ্যা
বিশ্বাস জন্ম দেয়।অনেক হিন্দু মানুষদের গলাতেও আমি ক্রুশ ঝুলতে দেখেছি। ক্রুশ
দু-চোখ স্পর্শ করে মুখে তুলে চুমো-টুমোও খায়।ধর্মীয় বিধান বা নিদান না-থাকা
সত্ত্বেও ক্রুশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একমাত্র আচার হয়ে আছে। এখন দস্তুর।
এরকম সব ধর্মে এমন অনেক কিছু মেনে চলা হয়, যার কোনো ধর্মীয় সমর্থন নেই। আসলে এক জাতীয় সুবিধাবাদী
মানুষ ধর্মের নামে অনেক কিছু মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। ধর্মের নামে এইসব আচার আদতে
কোনো বাস্তবতা আছে কি না তা যাচাই করার শ্রম দেওয়ার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের কারোর
নেই। অতএব “মানলে যদি কোনো ক্ষতি না-হয়
তাহলে মানবে না কেন ?” বা “বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূরে” – এসব ডায়লগ পড়লেই বোঝা যায়, কিছু ধুরন্ধর মানুষের সৃষ্টি। অতএব প্রশ্ন কোরো না। আমি যা বলি তা অক্ষরে
অক্ষরে পালন করো। শিথিল করলে আমিই করব,
কঠোর
করলে আমিই। ভাবটা এমন যেন ধর্ম সে গুলে খেয়েছে। ধার্মিকের পরাকাষ্ঠা যেন।
আসলে এরা ধর্মের ধারকাছ দিয়ে যায় না। ধর্মের “ধ”ও জানে না। ওকে ধর্ম ধরে ধরে
পালন করতে বললে পাগল হয়ে যাবে, অতিষ্ঠ জীবন বহন করতে
না-পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেবে। দিনে দিনে বর্ণহীন হয়ে পড়বে। সাধারণত যেসব আচরণ
ধর্মীয় ভেবে পালন করে থাকি বা দেখি, তার মধ্যে বেশিরভাগই
অশাস্ত্রীয়। আবার ধর্মে নির্দেশ আছে এমন অনেক কিছুই মানা হয় না। শাস্ত্রীয় হোক বা
অশাস্ত্রীয়, তা মানা-না-মানায় কারোর কিছু
যায় আসে না। কিছু যায় আসে না যখন আপনার নিয়ম আপনি মানুন, অন্যকে বাধ্য করাবেন না। ধর্মবিশ্বাসী বা আস্তিকদের মধ্যে
এই একটা বড়ো সমস্যা, নিজেদের ব্যক্তিগত
বিশ্বাস নির্লজ্জের মতো অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তি তা না মানলে
তাকে তিরস্কৃত করা হয়, অপমান করা হয়, লাঞ্ছিত করে, মানসিক পীড়ন দেয়, হত্যা করা হয়। অথচ এরা ভুলে যায় -- একদা আরুজ আলি
মাতুব্বুরের মা মারা যাওয়ার পরে তার একটা ছবি তোলার কারণে জানাজা বয়কট করেছিল
গ্রামবাসী। আর এখন হাজিরা হজ্ব করতে গিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয় !
তসবির বা ছবি তোলা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। পূর্বে
যেটা ছিল ধর্মনিদান আজ তা পরিত্যাজ্য। হজ্ব করতে সুদূর সৌদি আরবে পাড়ি দিতে হয়।
ছবি না-তুলে ভিসা দেবে কে ? ভিসা ছাড়া হজ্ব করা
যাবে ? কোনো নিদানই চিরন্তন নয়, সে কথা কবে বুঝবে মৌলবাদী ? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই পালটে যায়,
এই
বাস্তবটা বুঝতে হবে। অতীতে সবাই বিশ্বাস করত সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে, এখন দু-একটা ছাগু ছাড়া কেউ এ বিশ্বাস করে না। ধর্মের কত
কিছুই ছিল, আজ কত কিছুই নেই।
“ধর্মানুভূতিতে আঘাত”
! – এমন
একটা শব্দবন্ধনী খুবই শোনা যায়। আজকাল নিরন্তর আহত আর আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন মানুষের
একটি অসাধারণ অনুভূতি, যার নাম ধর্মানুভূতি।
ধর্ম নাকি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। স্পর্শকাতর কেন ? আসলে স্পর্শকাতরতা আসে অজ্ঞানতা থেকে।ধর্ম নিয়ে যাঁর সম্যক জ্ঞান হয়েছে তাঁর কাছে ধর্ম
স্পর্শকাতর হয় না। ধর্ম সহিষ্ণুতা শেখায়,
যদি না
শেখায় সেটা ধর্ম নয়। যে ধর্ম মানুষকে বিভাজিত করে, সেটাকে ধর্ম বলি কীরূপে ! আপনি কি সেই জাতীয় ধর্মে স্পর্শকাতর ? তাহলে বলব আপনিই পৃথিবীর সবচেয়ে অনিষ্টকারী সদস্য। আপনি কি
ধর্মের সমালোচনা করার জন্য সক্রেটিস, ব্রুনো, হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার (থাবা
বাবা), অভিজিৎ রায়ের হত্যাকে সমর্থন
করেন ? তাহলে আপনিও পৃথিবীর সবচেয়ে
অনিষ্টকারী সদস্য। আমাকে অনেকে বলেন পৃথিবীতে এত বিষয় থাকতে সেগুলি নিয়ে লিখুন না, ধর্ম নিয়ে কেন ! আপনিও কি তাই বলেন ? তাঁদের আমি বলব ধর্মকে বাদ দেওয়া যায় এমন কোনো বিষয় আমি
এখনও পাইনি।পাব বলে আমি মনে করি না।ধর্ম তো বিশ্বাসমাত্র, প্রমাণিত তো নয়। তাহলে সেই ধর্মের অনুভূতিতে এত আঘাত লাগে
কেন ? ধর্মের অস্তিত্ব কি মানুষের
প্রতি মানুষের অসহিষ্ণুতা-অনাস্থার উপরই টিকে থাকে ? ধর্মের ভিত্তি কি এতই নড়বড়ে, যে কারোর অনাস্থাতেই
ধসে পড়তে পারে ? ধর্মের শরীর কি ঠুনকো
কাচের তৈরি যে শুধু স্পর্শতেই ঝনঝন করে ঝরে পড়বে ? পৃথিবীতে এত অঘটন ঘটে যাচ্ছে সেখানে তো তো কোনো অনুভূতি দেখি না, পৃথিবীতে এত অন্যায় হয় অবিচার হয় সেখানে তো তো কোনো অনুভূতি
দেখি না, ধর্মের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি
করে এত নারী-পুরুষ-শিশুদের নির্বিচারে-নির্বিবাদে হত্যা করা হচ্ছে, তখন তো কারোর অনুভূতি জাগ্রত হতে দেখি না !
ধর্মানুভূতি বিষয়ে প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদ কী
বলছেন দেখব : “সবচেয়ে আহত হচ্ছে একটি
অনুভূতি, যেটি পুরোপুরি পৌরাণিক উপকথার
মতো, তার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ
বিশ্বকে অনুভব করে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে; ইন্দ্রিয়গুলো মানুষকে দেয় রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শ্রুতির অনুভূতি; কিন্তু মানুষ, একমাত্র প্রতিভাবান
প্রাণী মহাবিশ্বে, শুধু এ-পাঁচটি
ইন্দ্রিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে অজস্র
ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয়। তার আছে একটি ইন্দ্রিয়, যার নাম দিতে পারি সৌন্দর্যেন্দ্রিয়,
যা দিয়ে
সে অনুভব করে সৌন্দর্য; আছে একটি ইন্দ্রিয়, নাম দিতে পারি শিল্পেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে উপভোগ করে শিল্পকলা; এমন অনেক ইন্দ্রিয়
রয়েছে তার, সেগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে
প্রখর প্রবল প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে তার ধর্মেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে ধর্ম, তার ভেতরে বিকশিত হয়
ধর্মানুভূতি, এবং আজকের অধার্মিক বিশ্বে
তার স্পর্শকাতর ধর্মানুভূতি আহত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয়
ভোরবেলা থেকে ভোরবেলা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরাভূত ক’রে এখন এটিই হয়ে উঠেছে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়; ধর্মেন্দ্রিয় সারাক্ষণ জেগে থাকে, তার চোখে ঘুম নেই;
জেগে
জেগে সে পাহারা দেয় ধর্মানুভূতিকে, মাঝেমাঝেই আহত হয়ে
চিৎকার ক’রে ওঠে এবং বোধ করে প্রচণ্ড
উত্তেজনা। এটা শিল্পানুভূতির মতো দুর্বল অনুভূতি নয় যে আহত হওয়ার যন্ত্রণা একলাই
সহ্য করবে। এটা আহত হ’লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ধর্মানুভূতির উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বিশ্ব কাঁপছে”।
কীভাবে কাঁপছে বিশ্ব ? কীভাবে কাঁপে বিশ্ব ?
কীভাবে
কাঁপবে বিশ্ব ? “বিশ্বাসের ভাইরাস” বইয়ে অভিজিৎ রায় আমাদের বলেছেন : “কোনো নতুন প্রাসাদ কিংবা ইমারত তৈরি করার সময় সেই জায়গায়
শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত; এটা করা হত এই ধারণা
থেকে যে, এটি প্রাসাদের ভিত্তি মজবুত
করবে। অনেক আদিম সমাজেই বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা
পাওয়ার জন্য কুমারী উৎসর্গ করার বিধান ছিল;
কেউ কেউ
সদ্য জন্মলাভ করা শিশুদের হত্যা করত, এমনকি খেয়েও ফেলত।
প্রাচীন মায়া সভ্যতায় নরবলি প্রথা প্রচলিত ছিল। অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে
হাজার হাজার মানুষকে মাথা কেটে ফেলে, হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলে, অন্ধকূপে ঠেলে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হত। ১৪৪৭ সালে গ্রেট
পিরামিড অব টেনোখটিটলান তৈরির সময় চার দিনে প্রায় ৮০,৪০০ বন্দিকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল। কোনো কোনো
সংস্কৃতিতে কোনো বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে অন্য মহিলা এবং পুরুষদেরও তার সাথে
জীবন্ত কবর দেওয়া হত, যাতে তারা পরকালে
গিয়ে পুরুষটির কাজে আসতে পারে। ফিজিতে ‘ভাকাতোকা’ নামে এক ধরনের বীভৎস রীতি প্রচলিত ছিল যেখানে একজনের হাতপা
কেটে ফেলে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কর্তিত অঙ্গগুলো খাওয়া হত। আফ্রিকার বহু জাতিতে
হত্যার রীতি চালু আছে মৃতপূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য। এগুলো সবই
মানুষ করেছে ধর্মীয় রীতিনীতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে। এগুলোকে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ছাড়া কি বলা যায় ? ইতিহাসের পরতে পরতে অজস্র উদাহরণ লুকিয়ে আছেকীভাবে
বিশ্বাসের ভাইরাসগুলো আণবিক বোমার মতোই মারণাস্ত্র হিসেবে কাজ করে লক্ষ কোটি
মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ধর্মযুদ্ধগুলোই তো এর বাস্তব প্রমাণ। ১০৯৫ সালে সংগঠিত প্রথম ক্রুসেডের কথাই ধরা
যাক। সে সময় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় এবং বাস্তুচ্যুত করা হয়।
জেরুজালেমের প্রায় প্রতিটি অধিবাসীকে হত্যা করা হয়েছিল শহর ‘পবিত্র’ করার নামে। তৃতীয়
ক্রুসেডে তিন হাজার জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় সেন্ট
বার্নাড ফতোয়া দিয়েছিলেন – ‘প্যাগানদের হত্যার
মাধ্যমেই খ্রিস্টানদের মাহাত্ম্য সূচিত হবে। আর জিশুখ্রিস্ট নিজেও এতে মহিমান্বিত
হবেন।’ এই ক্রুসেডগুলো কি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’-এর উদাহরণ নয়? ১২০৯ সালে পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট উত্তর ফ্রান্সের আলবেজেনসীয়
খ্রিস্টানদের উপর আক্ষরিক অর্থেই ধর্মীয় গণহত্যা চালিয়েছিলেন। স্রেফ চেহারা দেখে
বিশ্বাসী এবং অধার্মিকদের মধ্যে পার্থক্য করতে অসমর্থ হয়ে পোপ তখন আদেশ দিয়েছিলেন – ‘সবাইকে হত্যা কর’। পোপের আদেশে প্রায়
বিশ হাজার বন্দিকে চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে
একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর বার শতকের দিকে সাড়া ইউরোপ
জুড়ে আলবেজেনসীয় ধর্মদ্রোহীদের খুঁজে খুঁজে হত্যার রীতি চালু হয়। ধর্মদ্রোহীদের
কখনো পুড়িয়ে, কখনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে
ক্ষতবিক্ষত করে কখনো-বা শিরচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট এই সমস্ত
হত্যায় প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। কথিত আছে, ধর্মবিচরণ সভার সংবীক্ষক (Inquisitor)
রবার্ট
লি বোর্জে এক সপ্তাহে ১৮৩ জন ধর্মদ্রোহীকে হত্যার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ইতিহাস
কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর সময়(১৩৪৮- ১৩৪৯) বহু ইহুদিকে সন্দেহের বশে জবাই করে
হত্যা করা হয়। পোড়ানো দেহগুলোকে স্তূপ করে মদের বড়ো বড়ো বাক্সে ভরে ফেলা হয় এবং
রাইন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ধরা যাক মধ্যযুগে ডাইনি হত্যার নামে নারীদের
হত্যার অমানবিক দৃষ্টান্তগুলো। সে সময়
১৪০০ সালের দিকে চার্চের নির্দেশে হাজার হাজার রমণীকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে
মারা শুরু হয়। এই ডাইনি পোড়ানোর রীতি এক ডজনেরও বেশি দেশে একেবারে গণহিস্টেরিয়ায়
রূপ নেয়। সে সময় কতজনকে যে এরকম ডাইনি বানিয়ে পোড়ানো হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
সংখ্যাটা এক লক্ষ থেকে শুরু করে ২০ লক্ষ ছড়িয়ে যেতে পারে। ‘ঠগ বাছতে গা উজাড়ের’
মতোই
ডাইনি বাছতে গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। সতের শতকের প্রথমার্ধে
অ্যালজাস নামের ফরাসি প্রদেশেই প্রায় ৫০০০ জন ‘ডাইনি’-কে হত্যা করা হয়, ব্যাম্বার্গের ব্যাভারিয়ান নগরীতে ৯০০ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়।
ডাইনি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ধর্মীয় উন্মত্ততা সে সময় অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে
ম্লান করে দিয়েছিল। শুধু নারীরা নয়, খ্যাতিমান বিজ্ঞানী
দার্শনিকেরাও রেহাই পাননি রক্তলোলুপ চার্চের কোপানল থেকে। জিওর্দানো ব্রুনোর মতো
দার্শনিককে বাইবেলবিরোধী সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করার অপরাধে জ্যান্ত পুড়িয়ে
মারা হয় সে সময়, গ্যালিলিওকে করা হয়
অন্তরিন। আর আমাদের উপমহাদেশে তো ধর্মীয় কুসংস্কার ছিল রীতিমত ভয়াবহ। পনেরো শতকে
ভারতে কালীভক্ত কাপালিকের দল মা কালীকে তুষ্ট করতে গিয়ে ২০ লক্ষ মানুষকে জবাই করে
হত্যা করেছিল। আর ছিল সতীদাহ। কেবল ১৮১৫ থেকে ১৮২৮ সালের মধ্যে ৮১৩৫ নারীকে সতীদাহের
নামে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ।ইদানীংকালে ডাইনি পোড়ানো বাদ দিলেও অ্যাবরশন
ক্লিনিকগুলোর উপর রাগ যায়নি এখনও। ১৯৯৩ থেকে আজ পর্যন্ত ‘আর্মি অব গড’ সহ অন্যান্য গর্ভপাত
বিরোধী খ্রিস্টান মৌলবাদীরা আট জন ডাক্তারকে হত্যা করেছে। ক’বছর আগেও নৃশংসতার সর্বশেষ নিদর্শন হিসেবে খ্রিস্টান
মৌলবাদী স্কট রোডার কর্তৃক ডঃ জর্জ ট্রিলারকে হত্যার ব্যাপারটি মিডিয়ায় তুমুল
আলোচিত হয়। ন্যাশনাল অ্যাবরশন ফেডারেশনের সরবরাহকৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭৭ সালের
পর থেকে আমেরিকা এবং ক্যানাডায় গর্ভপাতের সাথে জড়িত চিকিৎসকদের মধ্যে ১৭ জনকে
হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়, ৩৮৩ জনকে হত্যার
হুমকি দেয়া হয়, ১৫৩ জনের উপর চড়াও হওয়ার এবং
৩ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটে। ……. ধর্মীয় নির্দেশনা
অতীতে ভাইরাসরূপে কাজ করেছে, এখনো এর প্রভাব আছে
পুরোমাত্রায়”।
কে যেন বলেছিলেন, যে ঈশ্বর যে ধর্ম আমার জীবদ্দশায় দু-মুঠো অন্ন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, সেই ঈশ্বর আমার
মৃত্যুর পর আমায় কী স্বর্গসুখ দিতে পারে ! না, তাঁকে কেউ হত্যা করেছে বলে শুনিনি। শুনিনি তাঁর কারণ বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন
ধর্মধ্বজীরা।প্রকৃত ধার্মিকরা কখনো বেসামাল হন না, বেসামাল হন ভণ্ড-বকধার্মিকেরা। তবে ধর্মের অনুভূতিতে রাষ্ট্র রক্ষাকবচ রেখেছেন
খুব যত্ন করে। অথচ ধর্মের অনুভূতি ছাড়াও আরও অনেক অনুভূতি আছে, যা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। সে ব্যাপারে
রাষ্ট্রের যে তেমন অনুভূতি আছে সেটা তো দেখি না। কোনো রক্ষাকবচও রাখা হয়নি। এ
ব্যাপারে হুমায়ুন আজাদই আমার শেষ আশ্রয় : “আমার অজস্র অনুভূতি
দিনরাত আহত হয়; পত্রপত্রিকায় গ্রন্থে গ্রন্থে
নিকৃষ্ট শিল্পকলাহীন কবিতার মতো ছোটো বড়ো পংক্তির প্রাচুর্য দেখে আহত হয় আমার
কাব্যানুভূতি, নিকৃষ্ট লঘু উপন্যাসের
লোকপ্রিয়তা দেখে আঘাত পায় আমার উপন্যাসানুভূতি; রাজনীতিবিদদের অসততা ভণ্ডামোতে আহত হয় আমার রাজনীতিকানুভূতি; এবং আমার এমন অজস্র অনুভূতি নিরন্তর আহত রক্তাক্ত হয়, আমি ওগুলোর কোনো চিকিৎসা জানি না, ওগুলো নিয়ে আমি কোন্ জঙ্গলে কোন্ রাস্তায় চিৎকার করব, তাও জানি না। রাষ্ট্র এগুলোকে অনাহত রাখার কোনো ব্যবস্থা
করেনি, রাষ্ট্রের মনেই পড়েনি এগুলোর
কথা। রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব নয় আমার এসব অমূল্য অনুভূতিকে অনাহত রাখার সাংবিধানিক
ব্যবস্থা নেওয়া? সবাই বলবে এটা
রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে তাকে খুলতে হবে
একটি বিকট ‘অনুভূতি মন্ত্রণালয়’, যার কাজ হবে কোটি কোটি মানুষের কোটি কোটি অনুভূতির হিসাব
নেওয়া, সেগুলোর আহত হওয়ার সূত্র বের করা, এবং সেগুলোকে সব ধরনের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা
করা। আমার শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি রাজনীতিকানুভূতি কাব্যানুভূতি প্রভৃতি
পাহারা দেওয়া রাষ্ট্রের কাজ নয়, কিন্তু এখন রাষ্ট্র
এক উদ্ভট দায়িত্ব নিয়েছে, মনে করছে ধর্মানুভূতি
পাহারা দেওয়া তার কাজ। তাই রাষ্ট্র দেখে চলছে কোথায় আহত হচ্ছে কার ধর্মানুভূতি।
আমার শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি রাজনীতিকানুভূতি কাব্যানুভূতিকে কেনো রাষ্ট্র
পাহারা দিচ্ছে না, কেনো আইন তৈরি করছে
না এগুলোকে অনাহত রাখার ? তার কারণ রাষ্ট্র
শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি প্রভৃতিতে বিশ্বাস করে না, শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি হাস্যকর রাষ্ট্রের কাছে, বা রাষ্ট্র মনে করে শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি ব্যক্তিগত
ব্যাপার, তা যতই আহত বা নিহত হোক, রাষ্ট্রের কিছুই করার নেই। কিন্তু ধর্মানুভূতি এমন তুচ্ছ
হাস্যকর ব্যাপার নয়, তা অত্যন্ত
গরুত্বপূর্ণ; রাষ্ট্র এতে বিশ্বাস করে, তাই রাষ্ট্র একে অক্ষত রাখার জন্যে ব্যগ্র”।
তবে বিশেষ কোনো ধর্ম কোনো অবিনশ্বর ব্যাপার নয়।
গত পাঁচ হাজার বছরে পৃথিবীতে কয়েক হাজার ধর্ম প্রস্তাবিত হয়েছে, অনেক ধর্ম কয়েক হাজার বছর ধরে প্রচলিত থেকে নতুন ধর্মের
আক্রমণে লুপ্ত হয়ে গেছে। এমন অনেক ধর্ম এখনও আছে যা সংখ্যার বিচারে খুবই ক্ষুদ্র, সংখ্যালঘু। এই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বীরা
সংখ্যাগুরু ধর্ম মায় ধর্মাবলম্বীদের ভয়ে কুঁকড়ে আছে। চরম বিপন্নতায় অস্তিত্বহীনতার
দিন গুনছে। এক ধর্ম অন্য ধর্মকে গিলে খেয়ে ফেলছে। বৃহৎ ধর্মগুলির মধ্যেও সেই গিলে
ফেলা প্রতিনিয়ত অব্যাহত। সারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সারাক্ষণ। হীন চোখে দেখছে
সর্বক্ষণ। পাশের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের একটা অংশ
ভারতকে “মালাউনের দেশ” বলে গালি দেয় ভোর থেকে রাত পর্যন্ত। “মালাউন” মানে কী ? পাকিস্তানী সেনারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুদের
বাড়ি-ঘর পোড়ানোর সময়, হিন্দুদের হত্যা করার
আগে, হিন্দু নারীকে ধর্ষণের আগে
মালাউন বা মালাউনের বাচ্চা বলে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিত যে, তাঁরা মালাউন অর্থাৎ তাঁরা অভিশপ্ত। ইসলাম ধর্মে যারা
বিশ্বাস করে না, বিশেষ করে যারা
পৌত্তলিক তাদেরকে বলা হয়েছে মালাউন মানে অভিশপ্ত এবং মৃত্যুর পর এদের স্থান হবে
দোজখের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়াগায় যেখানে তাদের সীমাহীন নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে
অনন্তকাল। কিন্তু কেউ যদি “মালাউন” শব্দটি গালি হিসেবে ব্যাবহার করে তবে তা বৈধ নয়, কেন-না ইসলামে অন্য ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের দেবদেবীদেরকে
গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কাফের,
মুশরিক
কোনো গালি নয়। মুসলিমরা নাস্তিক এবং অমুসলমানদের “কাফের”ও বলেন। কোরানে কি কোথাও ‘হিন্দু’ শব্দটি আছে ? অথবা হিন্দুদের বোঝায় এমন কোনো শব্দ আছে ? অথবা এমন কী লেখা আছে অমুসলিমরা সবাই কাফের ? তবে হিন্দুরা কেমন করে কাফের হল ? আমি যতদুর জানি কোরানে ইহুদি, নাসারা ইত্যাদি শব্দ রয়েছে। এবং এদেরকেই কাফের বলা হয়েছে। অতএব ইসলামের
দৃষ্টিতে হিন্দু বা বৌদ্ধরা কাফের নয়। “কাফারা” থেকে কাফের, কাফারা অর্থ
"ঢেকে রাখা", এখন প্রশ্ন কী ঢেকে
রাখা ? সত্য যার মধ্যে ঢাকা পরে আছে, সেই কাফের। কোরানের পরিভাষায় সত্যকে যারা সত্য জেনেও ঢেকে
রাখে তারা কাফের। সুতরাং কাফের কে নয় ?
নজরুল
বলেছেন, “আমরা কথায় কথায়
সাম্যবাদীদের কাফের বলিয়া থাকি। কাফেরের অর্থ আবরণ বা আবৃত করে রাখা। আল্লাহ ও
আমার মাঝে যতক্ষণ আবরণ রইল ততক্ষণ আমি কাফের। যতক্ষণ আবরণ অর্থ্যাৎ ভেদাভেদ জ্ঞান, সংস্কার, কোনো প্রকার বাঁধা
বন্ধন আছে ততক্ষণ আমার মাঝে কুফুরও আছে। এমনি আবরণমুক্ত, বন্ধনমুক্ত, সংস্কারমুক্ত কেউ যদি
থাকে আমি তাঁর কাছে মুরিদ হিতে রাজি আছি।”
ইসলামি
পরিভাষায় কাফির বলা হয় যে আল্লাহ পাক ও তার নবিদেরকে অস্বীকার করে। তাই বাংলায়
নাস্তিক শব্দই হল আরবি কাফির। অপরদিকে মুশরিক হল যে আল্লাহ পাকের সাথে অন্য কাউকে
শরিক বা অংশীদার করে। তাই হিন্দুদেরকে মুশরিক বলা যায়। যেহেতু তারা তাদের
নবি/অবতারগণকে ভগবান বানিয়ে ফেলেছেন। ঠিক তদ্রুপ খ্রিস্টানরাও তাদের নবি হজরত
ইসাকে আল্লাহ পুত্র বানিয়ে মুশরিক হয়েছে,
ইহুদিরা
হজরত উজায়েরকে আল্লাহর পুত্র বানিয়ে মুশরিক হয়েছে।
শুধু মুসলিমরাই নন, হিন্দুরাও কম যান না। হিন্দুরাও অহিন্দুদের যবন বা ম্লেচ্ছ বলে গালি দিতেন এবং
এখনও দেন। মুসলমান শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ওরা ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার করেছেন যবন, ম্লেচ্ছ, পাতকী, পাষণ্ড, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দূরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, বানর, নেড়ে, লেড়ে, দেড়ে ধেড়ে, এঁড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ প্রভৃতি
শব্দ। এমনসব শব্দের ব্যবহার থেকেই ধারণা করা যায় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুরা কতটা বিদ্বেষভাবে পোষণ করেন। শ্রীচৈতন্যদেবকে
সাম্যের মূর্তি হিসেবে অনেকেই মনে করে থাকে। অথচ মুসলমানদের ব্যাপারে সে নিজে
মুক্তমনের পরিচয় দিতে পারেনি। সে তার মুসলমান ভক্তের নাম দিয়েছিল ‘যবন হরিদাস’। মুসলমানদের ক্ষেত্রে
ঘৃণা ও বিদ্বেষসূচক নানাবিধ শব্দ ও উপমা প্রয়োগ করেছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে
এদের আজন্ম লালিত ক্রোধ ও প্রতিশোধ চরিতার্থ করেছেন। মুসলমানদেরকে এরা যেসব শব্দে
রূপায়িত করেছেন সে সবের মধ্যে ‘যবন’ শব্দটি অন্যতম। 'যবন' কথাটি বাংলাভাষী উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের কাছে একটা বহুল
প্রচলিত শব্দ। মুসলমানদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করার জন্য তারা এ
শব্দ ব্যবহার করে থাকে। কারন বিদেশ থেকে আগত মুসলমানদেরকে হিন্দুরা কখনোই শাসক বা
প্রতিবেশী হিসেবে মন থেকে গ্রহণ করে নিতে পারেনি। বাংলা-ভারতের অভিজাত হিন্দু
শ্রেণি বরাবরই ছিল বর্ণবাদী। ‘যবন’ মানে ‘অহিন্দু জাতি বিশেষ, ম্লেচ্ছ জাতি। বিধর্মী, অসদাচারী, গ্রিস, আফগানিস্তান, আরব, পারস্য প্রভৃতি দেশের অধিবাসী।
যবন বা ম্লেচ্ছই বলুক, কিংবা মালাউন বা মালুই বলুক – এগুলি কারা বলেন। ধর্ম বিশ্বাসী বা আস্তিকরা বলেন, অধার্মিক বা নাস্তিক বা ধর্মহীন মানুষরা বলেন না। যাঁরা ধর্মবিশ্বাস
নিয়ে থাকেন, যাঁরা ধর্ম নিয়ে আলোচনা করেন
তারাই এই ধরনের বিষবাষ্প ছড়ান। যাঁরা ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করেন, তাঁরা অন্য ধর্মকে বা ধর্মাবলম্বীদের কোনোভাবেই অসন্মান
করেন না।
ঘৃণা,
প্রবল
ঘৃণা। এক ধর্মের প্রতি অন্য ধর্মের ঘৃণা। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, শিখ ইত্যাদি – সকলেই সকলের প্রতি
সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর কোনায় কোথায়।পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৮৩.৭
শতাংশ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ এই বিষ ছড়ানোর কাজটি করে যাচ্ছে – কখনো সোচ্চারে,
কখনো
চুপিসারে। সেই বিষ জন্ম দিচ্ছে বিষবৃক্ষের,
সেই
বিষবৃক্ষের ফল এই সর্বশেষ হত্যাকারী মাদ্রাসার দুই ছাত্র, যারা মুক্তমনা ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা
করেছে।ওয়াশিকুর রহমানেরাই পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৬.৩ শতাংশ। বড়োই সংখ্যালঘু
! এই ১৬.৩ শতাংশ নাস্তিক এবং ধর্মহীন মানুষ ৮৩.৭ শতাংশ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের পাকা
ধানে মই দিয়েছে। তাই এদের হত্যা করার জন্য প্রতিদিন চাপাতিতে শান দিচ্ছে।
দু-একজন নাস্তিক বা ধর্মহীন মানুষ মরলে কারোর
কিছু যায় আসে না ! কিন্ত যখন ৩১.৫ শতাংশ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার খ্রিস্টান)
ধর্মাবলম্বী মানুষ হত্যা করে ২৩.২ শতাংশ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মুসলিম)
ধর্মাবলম্বী মানুষকে; যখন ২৩.২ শতাংশ
(পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মুসলিম) ধর্মাবলম্বী মানুষ হত্যা করে ৩১.৫ শতাংশ (পৃথিবীর
মোট জনসংখ্যার খ্রিস্টান)) ধর্মাবলম্বী মানুষকে; যখন ১৫.০ শতাংশ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার হিন্দু) ধর্মাবলম্বী মানুষ হত্যা করে
২৩.২ শতাংশ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মুসলিম) ধর্মাবলম্বী মানুষকে; যখন ২৩.২ শতাংশ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মুসলিম) ধর্মাবলম্বী
মানুষ হত্যা করে ১৫.০ শতাংশ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার হিন্দু) ধর্মাবলম্বী মানুষকে (Pew Research Center, 2012) –- তখন অনেক কিছু আসে
যায় বইকি। ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গার সংক্রামক আগুন।এক-এক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের
মৃত্যু হবে, শত শত মহিলাকে ধর্ষণ করা হবে, গৃহে অগ্নিসংযোগ,
উচ্ছেদ – বিভীষিকাময় সব ঘটনাই ঘটতে থাকবে সমস্ত অনুভূতির কথা ভুলে
গিয়ে। নড়ে উঠবে রাষ্ট্র, নড়ে উঠবে সরকার এবং
অবশ্যই পিছন থেকে, অথবা সামনে থেকে, অথবা দু-দিক থেকেই উসকানি দেবে রাজনৈতিক দলগুলি।
সব ধর্মেই কিছু পালনীয় প্রথা ও আচার এবং
আনুষ্ঠানিকতা আছে। এই আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিলে, ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনই সব চাইতে জরুরি এই ধারণাকে
প্রাধান্য দিলে ধর্মকর্ম নিষ্প্রাণ ও যান্ত্রিক হয়ে পড়ে।তখন আর ধর্ম সব মানুষের
জন্য কাজ করে না। ধর্ম সীমিত হয়ে পড়ে একটা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে – মিলনের চাইতে বিভেদের কথাই বড়ো হয়ে ওঠে।আর তখন সম্প্রীতির
পরিবর্তে সহিংসাই মাথা চাড়া ওঠে।সব চাইতে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যখন রাষ্ট্রীয়
এর মধ্যে নাক গলায়। ব্যক্তিমানুষের ধর্ম পালন বা না পালন করার উপর খবরদারি করার
অধিকার ও দায়িত্ব রাষ্ট্র যখন নিজের উপর টেনে নেয়। ধর্মীয় অন্ধত্ব, অসহিষ্ণুতা এবং গোঁড়ামি শুধু মধ্যযুগের ইউরোপের এক
বিভীষিকাময় পরিবেশের জন্ম দিয়েছিল তা নয়,
বিশ্বের
প্রায় সমস্ত দেশেই এখন ধর্মীয় উন্মাদনা বিষ ছড়িয়ে চলেছে মৌলবাদীদের দল।ভাবা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই
প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষ একে অন্যের বিরুদ্ধে ৩০ বছর ব্যাপী
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।রোমান ক্যাথলিক চার্চের সমর্থনে সবরকম
মুক্তচিন্তাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার লক্ষ্যে এবং রাজার যাবতীয় স্বৈরাচারী
কার্যকলাপকে বৈধতা দানের জন্য তখন ইউরোপে অমানবিক “ব্ল্যাসফেমি” আইনের ব্যাপক ব্যবহার
শুরু হয়।
সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোন
ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ
ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার
অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এ ক্ষেত্রে
কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ
পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হল সম্পদায়। ধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্ক আছে ধর্মীয়
তত্ত্ব এবং আচার-বিচারের। সাম্প্রদায়িকতার যোগ আছে সম্পদায়ের সঙ্গে। অর্থাৎ
ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি। সাম্প্রদায়িকতার
ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব
বেশি। এ ছাড়া সত্যকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী। পরকালেই তার সত্যকার পুরস্কারের আশা।
সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ইহলোকে। ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন
নেই।
আজ মানুষ ধর্ম
এবং বর্ণের কারণে সম্প্রদায় সম্প্রদায়ে বিভক্ত। সেকারণে মানুষ নিজ নিজ সম্প্রদায় নিয়ে ভাবে, উন্নতির চিন্তা করে সম্মিলিত সম্প্রদায়ের। সম্প্রদায় নিয়ে ভাবা দোষের কিছু নয়। কিন্তু
সম্প্রদায় নিয়ে ভাবতে গিয়ে পাশাপাশি
বসবাসকারি অন্য সম্প্রদায়কে ছোটো মনে করা ,
ঘৃণা
করা, বিদ্বেষ ভাব পোষণ করা - এসবই ঘৃণ্যকর। কিছুলোক নিজ
সম্প্রদায় নিয়ে ভাবে, আবার অপর সম্প্রদায়ের লোকজনকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। আবার কিছু লোক শুধু নিজ সম্প্রদায় নিয়ে ভাবে, আর অপর সম্প্রদায়ের লোকজনকে ঘৃণা করে বা ভালোবাসতে পারে না। দ্বিতীয় পক্ষ
সাম্প্রদায়িক। তবে যারা একই জাতির মধ্যে
সব সম্প্রদায়ের জন্য একসাথে চিন্তা করেন,
সকল
ধর্ম সম্প্রদায়ের ভালোমন্দ একসাথে চিন্তা
করেন তারা উন্নত মানুষ। পরিবারের বয়ষ্ক
সদস্যরা তাদের পার্শ্ববর্তী অপর
ধর্মের বা সম্প্রদায়ের লোকজনকে অশ্রদ্ধার
চোখে দেখে বা ভালোবাসে না , তাহলে সে বড়ো হয়ে
আর অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না বা অপর
ধর্মের লোকজনকে আর ভালোবাসতে পারে না।
আর এসব পরিবারের সন্তানেরা সাম্প্রদায়িক চেতনায় পুষ্ট হয়। কারণ সে ধরে নেয় তার ধর্ম, তার গোত্র শ্রেষ্ঠ,
অন্য
কোনো ধর্ম বা গোত্র তার ধর্মের সমকক্ষ
নয় । এভাবে সে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে এবং নিজ ধর্মের
শ্রেষ্ঠত্ব দাবির পাশাপাশি সে অপর ধমের্র
লোকজনকে বা ধর্মকে অসম্মান করতে শেখে।
সাম্প্রদায়িকতা মানে প্রতিদিন সংখ্যালঘু নির্যাতন বা সংখ্যালঘুর উপর হামলা নয় । মানসিক নির্যাতনও এর মধ্যে পড়ে ।
এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে চাকরিতে যদি ধর্মীয়
কারণে বৈষম্য করা হয় সেটাও সাম্প্রদায়িকতা।
মুসলিম ধর্মের মৌলবি, হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের
পুরোহিত, খ্রিস্টানদের ফাদার -- এরা
নিজ নিজ ধর্মের লোকদের মধ্যে
অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি করতে পারে। কিন্তু আমরা কখনো দেখি না কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনার সময় এরা
প্রতিরোধে নেমেছে । তাই এদেরও মনোভাবের
পরিবর্তন দরকার, বেশি দরকার । আমার
মনে হয় ধর্মীয় চেতনার মৌলবি, পুরোহিতরা যদি পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা দেখাতেন, নিজ নিজ ধর্মীয়
অনুসারীদের অসাম্প্রদায়িক হবার শিক্ষা দিতেন তাহলে দেশে অধিক পরিমাণে অসাম্প্রদায়িক মানুষ তৈরি হত ।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism) বলতে বোঝানো হয় কিছু
নির্দিষ্ট প্রথা বা প্রতিষ্ঠানকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা
করা। এক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে প্রকাশ করে। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার কোনোরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোনো ধর্মে কোনো
প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা হবে না। ধর্মনরপেক্ষতাবাদ সেই বিশ্বাসকে ধারণ
করে, যাতে বলা হয় মানুষের
কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্তগুলো, বিশেষত রাজনীতিক
সিদ্ধান্তগুলো, তথ্য এবং প্রমাণের উপর নির্ভর
করবে, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর
নয়। অর্থাৎ বলা যায়, "ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার"। রাজনৈতিক ব্যবহারের দিক থেকে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হল ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করার আন্দোলন, যাতে ধর্মভিত্তিক আইনের বদলে সাধারণ আইন জারি এবং সকল
প্রকার ধর্মীয় ভেদাভেদ মুক্ত সমাজ গড়ার আহবান জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে
সেকুলারিজম অর্থে উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যবহার করা হয় না। উপমহাদেশে
ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা হল, রাষ্ট্রের নাগরিকদের
ধর্ম থাকবে, তবে রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম
থাকবে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই
মনে করে যেসব ধর্মের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে
বোঝায় রাষ্ট্র সব ধর্মকে সমান সুযোগসুবিধা দেবে। কিন্তু আমি যতটুকু বুঝি বিষয়টা
তা না। বিষয়টা হচ্ছে রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই আর্থিক সহযোগিতা, কোনো ধর্মের প্রচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা কিংবা
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো ধর্মের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি দেখাবে না। কোনো ধর্মের
সঙ্গেই রাষ্ট্র নিজেকে সম্পৃক্ত করবে না। যেমন ধরা যাক, জল একটা নিরপেক্ষ
অক্সাইড, কারণ জল অম্ল বা ক্ষার, কোনো ধর্মই প্রদর্শন করে না। আবার আমরা জানি, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড উভধর্মী অক্সাইড, কারণ এইটা অম্ল-ক্ষার উভয় অক্সাইডের ধর্মই প্রদর্শন করে।
আব্রাহাম লিঙ্কনের একটা ঘটনা বলি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ধর্মনিরপেক্ষ
রাষ্ট্র। কোনো একটা কাজে তাঁকে একবার গির্জায় যেতে হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর পাদরি
বলল, " আপনাদের মধ্যে কে কে স্বর্গে
যেতে চান ?" তখন সবাই হাত তুলল
লিঙ্কন বাদে। পাদরি তখন অবাক হয়ে লিঙ্কনকে জিজ্ঞাসা করে যে সে কেন স্বর্গে যেতে
চান না। তখন লিঙ্কন বলল, "আমার স্বর্গে যাওয়ার
সময় নেই, আমাকে এখনই কংগ্রেসে যেতে
হবে।" এইটাই একটা আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির বৈশিষ্ট্য হওয়া
উচিত, যা থেকে আমরা কয়েক শত ক্রোশ
দূরে অবস্থান করছি।
তখন পাকিস্তান (পূর্ব পাকিস্তান), এখন বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে
পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষার দেশ সৃষ্টি হয়। সেদিন পাকিস্তান
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের উপর। ধর্মের
ধুয়া তুলেছিলেন। বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল : পাকিস্তান মুসলমানের রাষ্ট্র, উর্দু মুসলমানের ভাষা ; তাই উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে।বাংলা ভাষা হিন্দুদের ভাষা, তাই পরিত্যাজ্য। অতএব বাংলা ভাষা কখনোই পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। উর্দুর আধিপত্য প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের
সমস্ত বাঙালি ধর্মের নামে শোষণ ও উৎপীড়ন এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান
করেছিল।ইসলাম রক্ষার নামে, মুসলিম রাষ্ট্রের
নামে কী অমানুষিক অত্যাচারই না-হল দেশের মানুষের উপর।পূর্ব পাকিস্তানে সে সময়
পাকিস্তানবাদীরা বললেন, “পাকিস্তানের বিরোধিতা
মানে ইসলামের বিরোধিতা”। ভাবটা এমন যেন
পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ইসলামের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।এখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের
কায়া নেই, ছায়া আছে অব্যাহত। সেই
পাকিস্তানি ছায়ার আগুনে বাংলাদেশ জ্বলছে। মতলব : বাংলাদেশকে আর একটা পাকিস্তান
তৈরি করা।বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ সৃষ্টি করেছেন। তাতে বলা
হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি
বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
রাষ্ট্র
কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান,
রাজনৈতিক
উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা
হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাই-ই বোঝাবে, রাষ্ট্রীয় উদযোগের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ের সংযোগহীনতা, ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংস্রবশূন্যতা, পারলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন ইহজাগতিকতা। ধর্ম থাকবে
নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হয়ে, রাষ্ট্র সকলকে নিজস্ব ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও অধিকার দেবে – কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না।
বেতার বা রেডিয়ো, টেলিভিশনে কিংবা কোনো
রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সর্বত্র একসঙ্গে কোরান শরিফ, গীতা, বেদ, উপনিষদ, বাইবেল, ত্রিপিটক পাঠ হতে থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা হয় না।
ক্যাথলিক ধর্মের অসাধারণ প্রাধান্য সত্ত্বেও
ফ্রান্স ধর্মনিরপেক্ষ, প্রোটেস্ট্যান্টদের
গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এসব দেশে সরকারি
কাজকর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করা, অথবা কর্মক্ষেত্রে ঈশ্বরের নামে শপথ নিতে বলা, অথবা শিক্ষাক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে বাইবেল পাঠ বা
প্রার্থনা করা সংবিধানবিরোধী।
ধর্মগ্রন্থগুলির সবচেয়ে প্রথম শর্ত হল বিশ্বাস।
ওইসব গ্রন্থে যা লেখা আছে, কোনোরকম দাঁড়ি-কমাও
অদলবদল করা যাবে না এবং সেই অবস্থায় তা বিশ্বাস করতে হবে এবং মানতে হবে। সেই মানা
মানতে গিয়ে এবং মানাতে গিয়ে কত মানুষকে যে অযথা জীবন দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
জ্ঞানী লোকেরা সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে মানবকল্যাণের কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞদের দ্বারা
অত্যাচারিত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন, বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ছেন। অজ্ঞ বলেই তো তাদের হিতাহিত
জ্ঞান হারিয়ে পশু হয়ে যায়। মোদ্দা কথা হল –
সমস্ত
রকমের কুশিক্ষা এবং কুসংস্কারই হচ্ছে প্রগতির এবং সব রকমের উন্নতির সবচেয়ে বড়ো
অন্তরায়।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ বাস করে।ধর্মে যাঁরা
অবিশ্বাস করে তাঁদের কথা না-হয় বাদ দিলাম। কিন্তু যাঁরা কোনো-না-কোনো ধর্মের লোক, ধর্মে বিশ্বাস রাখে –
তাঁরাও
তো অন্য ধর্ম মানেন না, পালন করেন না। এভাবে
যদি দেখা যায় – নিজের ধর্ম বা ধর্মেরটা মানি, অন্য ধর্ম মানি না –
এমনি
করে মানি আর মানি না করতে করতে সকলেই তো না-মানার দলে পড়ে যাবে। ইসলাম
ধর্মাবলম্বীরা যেমন মনে করেন ইসলাম যাঁরা মানেন না, তাঁরা সকলেই নাস্তিক, অতএব কাফের। হিন্দু
ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যাঁরা বেদ মানেন তাঁরা আস্তিক, যাঁরা বেদ মানেন না তাঁরা নাস্তিক-যবন-ম্লেচ্ছ ইত্যাদি।
নাস্তিকে তো বিশ্ব ভরে আছে ! ঈশ্বরও আর তাঁর ধর্ম নিয়ে বেশিদূর যেতে পারলেন না, মুষ্ঠিমেয় মানুষের গোষ্ঠীর মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকলেন।
লবিবাজিতেই ঈশ্বর শেষ হয়ে গেল। হিন্দু-লবি,
মুসলিম-লবি, খ্রিস্টান-লবি ইত্যাদি হাজারো লবি। লবি ভুলে সব ঈশ্বররা আগে
এক ছাতার নীচে আসুক, তবেই-না মানুষ একত্রিত
হবে। আসলে ঈশ্বর, ধর্ম এসব
ধান্দাবাজরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেইজন্যই মাঝেমধ্যেই পচনের দুর্গন্ধ নাকের ভিতর
ধেয়ে আসে !
বস্তুত এক শ্রেণির মানুষ নিয়মের মধ্যেই থাকতে চায়, আর-এক শ্রেণির মানুষ নিয়ম ভেঙে সংস্কার চায়, অন্য এক শ্রেণির মানুষ নিয়ম ভাঙতেও চায় – নিয়মের মধ্যেও থাকতে চায়। সারা বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ
জাত-ধর্ম-ভাষা-দেশে যতই আলাদা হোক না-কেন আদতে তো সকলেই মানুষ। এই মানুষ বিভ্রান্ত, ধর্ম নির্বাচনে বিভ্রান্ত। কোন্ ধর্ম মানবে তাঁরা ? বলতে পারেন, যেটা শ্রেষ্ঠ যেটা
সহি সেটাই মানা হোক। এখন প্রশ্ন, কোন্ ধর্ম শ্রেষ্ঠ ? সকল ধর্মের মানুষই বলবে তাঁর ধর্মই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু সকল
ধর্মই তো একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না ! যাঁর যাঁর ধর্ম শ্রেষ্ঠ বলেই তো সে সেই
ধর্মে আছে এবং গর্বিত বোধ করেন। তা ভালো তো। যে-কোনো একটা ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে
নিলে ক্ষতি কী ! কোন্ মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়ে যাবে? সকলে মিলে একটা ধর্মে চলে আসুন না। শান্তির ধ্বজাধারীরা কী বলেন ? তখন সেই ধর্মটিতে হিন্দু-ইসলাম-খ্রিস্ট-বৌদ্ধ ইত্যাদি পরিচয়
সব বিলীন হয়ে যাবে। নতুন একটি নাম হবে সেই ধর্মের।যে-কোনো একটা ধর্মে সকলে চলে এলে
তো পৃথিবীতে কোনো ধর্মীয় অশান্তি থাকত না। এমন এক ভাষায় সেই নতুন ধর্ম লেখা হবে, যে ভাষা সবচেয়ে বেশি লোক পাঠ করতে পারবে। একই সঙ্গে বিশ্বের
সমস্ত ভাষায় সেই ধর্ম অনূদিত হবে, যাতে সকলেই সেই ধর্ম
পাঠ করে মেনে চলার সুবিধা হবে। তাহলে সমাজে ব্রাহ্মণ-মুমিন-পোপদের মতো জ্ঞান
দেওয়ার লোকের প্রয়োজন হবে না।সমাজে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে এরাই নষ্টের গোড়া। এরাই
মানুষের ব্রেন ওয়াশ করে ভ্রান্ত পথ দেখায়।
ধর্ম এক বিশাল ব্যাবসা-প্রতিষ্ঠান। বহু যুগ ধরে
এই ব্যবসা পরম্পরাগতভাবে চলে আসছে। ধর্ম সৃষ্টি করে কোন ধর্মের কোন মানুষের কী
উপকার হয়েছে, তা আমি জানি না। তবে ধর্ম
সৃষ্টি হওয়ার ফলে একশ্রেণির মানুষ ধর্ম বিক্রি করে করেকর্মে
খাচ্ছে।পুরুত-মুমিন-মোল্লারাই ধর্ম-ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। যে
মন্দির-মসজিদ যত বিখ্যাত, সেখানে তত রোজগার, তত সম্পদ। ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানাবিধ পেশা। জ্যোতিষ, তুকতাক, জল-পড়া, তেল-পড়া, ভিক্ষাবৃত্তি, ৫ মানিটে বশীকরণ,
ডাইনিবিদ্যা, গুরুগিরি – এ সবেরই প্রাণভোমরা
ধর্ম। যত্রতত্র মন্দির-মসজিদ গজিয়ে রোজগার শুরু করে দেওয়ার রেওয়াজ বহুদিনের। পথ
চলতে চলতে দেখবেন কিলবিল করছে বিভিন্ন দেবদেবতার মন্দির, মাজার, দরগা। মন্দিরের কথাই
বলি তাহলে দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে শনিদেব, তার পরের মা কালী। তবে গোবলয়ে প্রচুর হনুমানের মন্দির দেখা যায়। মন্দিরের
সামনে পেল্লাই একটা প্রণামী বাক্স, যা মোটকা একটা চেইন
দিয়ে বাঁধা। আর প্রণামী বাক্সের ভিতর প্রচুর টাকাপয়সা। সময়ে সময়ে কেউ এসে বাক্স
খুলে টাকাপয়সা নিয়ে চলে যায়। এই টাকায় পেট চলে। বনগাঁয় সাতভাই কালীতলা বলে একটা
জায়গা আসে। সেখানে প্রতিবছর পৌষমাসে মেলা হয় এক মাস ব্যাপী। শনি-মঙ্গলবারে ধুমধাম
করে পুজোর আয়োজন হয়। প্রচুর প্রণামী আমদানি হয়। পুজোর দেওয়ার জন্য প্রচুর বাতাসা
ভক্তেরা মায়ের চরণে দেন। পুজোর এই বাতাসা,
ফলমূল
ক্যুইন্টাল ক্যুইন্টাল জমে যায়।মন্দির কর্তৃপক্ষ সেইসব বাতাসা-ফলমূল পুনরায় বাজারে
বিক্রি করে দেয়।এর ফলে বিশাল অর্থের আমদানি হয়।ধর্মের ব্যাবসা লাভজনক ব্যবসা। মার
যাওয়ার ভয় নেই। মন্দিরের গুণাগুণ বিষয়ে বেশ করে প্রোপাগান্ডা করতে পারলে জীবনভর
আয়েসে থাকা যায়। ধর্ম বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। তার উপর তো আছে
সোনার জিভ, সোনার চোখ, সোনার দাঁত, সোনার নখ, আরও কত কী ! এমন অনেক মন্দির-মসজিদ আছে যেখান ভিখারিদের
ভিক্ষা করতে হলেও লাখ লাখ টাকা সেলামি দিতে হয়। ধর্ম না-থাকলে এগুলো হত। এমন অনেক
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ধর্মের নামে কোটি কোটি টাকা ডোনেশন আসে। কোথায় যায়
এই কোটি কোটি কোটি টাকা ? কারা ভোগ করে এই
বিপুল অর্থ ? ভক্ত , না ভগবান ?
কোটি কোটি মানুষের দানে ভারতের মন্দিরগুলোতে
প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা জমা হয়। তবে সব মন্দিরে সমানভাবে অর্থ-সম্পদ জমা পড়ে
না। সম্প্রতি ভারতের মেইল টু ডে পত্রিকায় প্রকাশিত এক আর্টিকেলে ভারতের কয়েকটি
সম্পদশালী মন্দির নিয়ে লিখেছে। ভারতের সবচেয়ে সম্পদশালী মন্দিরটি হল কেরালায়।
মন্দিরটির নাম পদ্মনাভস্বামী। এদের বার্ষিক আয় কত জানা যায় না। তবে এখানের সম্পদের
মূল্য প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা।
তালিকার দ্বিতীয় নাম্বারে রয়েছে তিরুপতি বালাজি
মন্দির। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেবতা ।
মন্দির চত্বরের মূল মন্দিরটি সোনা দিয়ে মোড়া। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রদীপের আলোয়
দেবদর্শন । কালো বিশাল মূর্তির মাঝে সোনার প্রলেপ। বছরভর ভিড় লেগেই থাকে এই
বিশ্ববিখ্যাত মন্দিরে। হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি, অভিনেতা থেকে মেগাস্টার, রাজনীতিবিদ থেকে
মন্ত্রীসান্ত্রী, এমনকি দেশের বাইরের
কূটনীতিবিদরাও তিরুপতি মন্দিরে আসেন। বছরভর প্রচুর মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে।
প্রতিদিন প্রায় ৭০ হাজার ভক্ত এখানে উপাসনা করতে আসেন। উৎসব ও পার্বণে এই সংখ্যা ৫
লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই মন্দিরের বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে
প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আয় হয় দান থেকে। দর্শনার্থীদের কাছে টিকিট বিক্রি করে
আয় হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বাকিটা আসে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ থেকে। আছে ডোনেশন ।
এই মন্দিরে ২০ টন সোনা ও হিরার গহনা আছে। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুমালা তিরুপতি
ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে শুধু সোনা রয়েছে ৩০০০ কেজি, আর তাদের ঘোষিত সম্পত্তি রয়েছে ৫০,০০০ কোটি টাকা।
জম্মু ও কাশ্মীরের বিষ্ণুদেবী মন্দির সবচেয়ে
পুরাতন মন্দির। প্রতিবছর আনুমানিক ৮০ লাখ ভক্ত এখানে উপাসনা করতে আসেন। যে
সংখ্যাটি বালাজি মন্দিরের পরেই। এই মন্দিরের আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। অন্য
মন্দিরগুলোর মতোই এখানেও থাকার বন্দোবস্ত আছে।
সম্পদের দিক থেকে চার নাম্বারে পাঞ্জাবের
অমৃতসরের গোল্ডেন টেম্পল বা সোনালি মন্দির। শিখ গুরু অর্জুন ষোড়শ শতকে এই মন্দির
নির্মাণ করেন। প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার ভক্ত এখানে আসেন। কাঠ, সোনা আর রূপার কারুকাজে পুরো মন্দির দৃষ্টি কাড়ে। এই
মন্দিরের বার্ষিক আয় সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।
মুম্বাইয়ের গণপতি মন্দির হল দেবতা গণেশের মন্দির।
অষ্টাদশ শতকে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছে। গণেশের মূর্তির মুকুটে সাড়ে তিন কেজি
সোনা ব্যবহার করা হয়েছে। দিনে গড়ে প্রায় লাখ খানেক ভক্ত গণেশকে একনজর দেখতে এখানে
আসেন। মুম্বাইতে হওয়ার কারণে বলিউডের নামিদামি তারকারা এখানে আসেন। তারা
মুক্তহস্তে দান করেন। ফলে সবমিলেয়ে বছরে আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা আয় করে এই
মন্দির।
মুম্বাই শহরের প্রান্তে আর-একটি মন্দির আছে
সাঁইবাবা মন্দির। প্রতিবছর কয়েক লাখ দর্শনার্থী এখানে আসেন। এই মন্দির দান থেকে
প্রতিবছর আয় করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
এ তো গেল ধর্মের নামে ব্যাবসা। ধর্মকে সামনে রেখে
ভণ্ডামির ব্যাবসাও জারি আছে বিশ্বজুড়ে। এর বাইরে যে ভন্ডরা মহাগুরু সেজে বসে আছে, তাদের সম্পত্তির পরিমান দেখলে মাথা খারাপের জোগাড় হবে। বালক
ব্রহ্মচারী জীবিত থাকা কালীন প্রতিদিন তার শিষ্যদের কাছ থেকে শুধু প্রনামী পেতেন
এক কোটি রুপি ! তাও বাধ্যতামূলক এবং জনপ্রতি প্রতিদিন মাত্র দশ পয়সা হিসাবে ! অথচ
এরা বলে, তারা নাকি সব ভোগবিলাস, সব মোহ ত্যাগ করে সাধু বা ব্রহ্মচারী হয়েছেন ?
(১) স্বামী বিমানন্দ
একমাত্র রাঘব বোয়াল, যিনি পুলিশের জালে
ধরা পড়েছেন। জানা যায় যে, সাধু বিমানন্দের
লিস্টে প্রায় ২০ হাজার যৌনকর্মী ছিল। যাদের রেট বেশ চড়া। দুই ঘণ্টার এক ট্রিপের
জন্য ৫০০০ থেকে ৮০০০ রুপি। সারারাতের জন্য (৮ ঘণ্টা) ২৫ হাজার রুপি। আবার দুই
ঘণ্টায় দুই ট্রিপের জন্য ৮০০০-১০০০০ রুপি। চার ঘণ্টায় দুই ট্রিপ হলে সেটা ১৫০০০
রুপি। তবে সাধু বিমানন্দের সুনাম ছিল যে,
সে তার
মেয়েদের ওভারটাইম ও নিয়মিত ছুটি দিত। ৩৯ বছর বয়সি এই সাধু বিমানন্দ ১৯৮৮ সালে
দিল্লিতে সিকিউরিটি গার্ড হিসাবে তার কেরিয়ার শুরু করেছিল। ১৯৯৭ সালে তাকে
যৌনকর্মীদের দিয়ে ব্যাবসা চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া
পেয়ে সে ধর্মের আড়ালে যৌন-ব্যাবসা চালাতে শুরু করে। নিজের প্রকৃত নাম শিবমুর্তি
বেদী বদলে স্বামী বিমানন্দ নাম ধারণ করে। শুধুমাত্র কমিশন হিসেবেই প্রতিদিনের আয়
দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ রুপি।
(২) ভারতের কথিত ‘গডম্যান’ আশারাম বাপু। প্রায়
১০ কোটি তাঁর শিষ্য। স্বঘোষিত ধর্মগুরু আশারাম বাপু এক নাবালিকাকে যৌন হেনস্থার
দায়ে অভিযুক্ত তাঁর আশ্রম থেকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগকারিণী বলেছে, ধর্মগুরু আশারাম বাপু তাকে নগ্ন করে শরীরের উপর খামচি মারে।
আর চিৎকার করায় সে তাকে হত্যার হুমকি দেয়। যৌন নিগ্রহ এবং জমি কেলেঙ্কারির
পাশাপাশি ঘুষের অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তবে এ ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর সরাসরি
আশারাম বাপুর দিকে নয়, তার সমর্থকদের দিকে।
টেলিভিশন চ্যানেলে লাগাতার ধর্মীয় বাণী প্রচার আর ভজন গোটা ভারত জুড়ে আশারাম
বাপুর কোটি কোটি ভক্ত তৈরি করেছে, সেই সঙ্গে উত্তর
ভারতের নানা রাজ্যে তিনি তৈরি করেছেন বিশাল সব আশ্রম ও বহু কোটি টাকার সম্পত্তি।
ভারতের আলোচিত স্বঘোষিত ভগবান আশারাম বাপুর পর এবার বাপুর ছেলের বিরুদ্ধেও ধর্ষণ
এবং দীক্ষা দেওয়ার নামে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। ধর্ষণের অভিযোগে
গ্রেফতার হল তার ছেলে নারায়ণ সাঁই।
(৩) হরিয়ানা রাজ্যের
স্বঘোষিত ধর্মগুরু রামপাল গত ২০১৪ সালে ১৯ নভেম্বর গ্রেফতার হন। তাঁকে গ্রেফতার
করতে প্রায় ২৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে সরকারের। পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও চন্ডিগড় প্রশাসন এবং কেন্দ্র মিলিতভাবে এই টাকা
খরচ করেছে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে পেশ করা
হরিয়ানা পুলিশের ডিজি এস এন বশিস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী এই খরচের টাকা ২৬.৬১
কোটি টাকা। তাঁর আশ্রম থেকে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি বারুদ, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, কমান্ডোদের পোশাক,
পেট্রোল
বোমা ৫ হাজার লাঠি, হেলমেট, প্রচুর মোবাইল ফোন এমনকি প্রেগনেন্সি টেস্ট করা ও গর্ভ
নিরোধক সরঞ্জামও উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১২ একর আশ্রমে তল্লাশি চালিয়ে গোপন সুড়ঙ্গ
পথে ঢুকে পুলিশ খোঁজ পেয়েছে ২৪টি এসি ঘর,
ম্যাসাজ
পার্লার, এলিভেটর, সুইমিং পুলসহ বিলাসবহুল সামগ্রীর। তিনি শত কোটি রুপির মালিক।
‘সারগুরু রামপাল জি
মহারাজা’ নামে তার যে ডেরা বা আশ্রম
আছে তার মূল্য ১০০ কোটি রুপির কাছাকাছি।
৬৩ বছর বয়সী রামপালের রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল
গাড়ি। বিএমডব্লিউ থেকে মার্সিডিজ রয়েছে তার গাড়িবহরে। হরিয়ানায় ১২ একর জমির ওপর
তার আশ্রম বা আখড়া প্রতিষ্ঠিত।
(৪) চন্দ্রস্বামীর
সঙ্গে একাধিক রাজনীতিকদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তার, খুবই প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। রাজীব গান্ধী হত্যায় তাঁর যোগসূত্র ছিল বলে ১৯৯৮
এম সি জৈন রিপোর্টে দাবি করা হয়। আশ্রমে
আয়কর হানাতেও একাধিক অস্ত্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ মেলে।
(৫) ধীরেন ব্রহ্মচারী
ইন্দিরা গান্ধীর যোগগুরু ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের ধরন নিয়ে সেই সময় বিতর্ক
ছড়ায়। ১৯৯৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর একাধিক সম্পত্তি বেআইনি বলে ঘোষণা করে দখল
করে সরকার।
(৬) গুরমিত রাম রহিম
সিং ডেরা সাচ্চা সওদা গোষ্ঠীর প্রধান গুরু। সিরসায় গোষ্ঠীর সদর দফতরে মহিলা
ভক্তদের ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। দুই সাংবাদিকের হত্যার চক্রান্তেও
নাম জড়িয়েছে। কোটি টাকার সম্পত্তি তাঁর
(৭) নিত্যানন্দ স্বামী
এক দক্ষিণী অভিনেত্রীর সঙ্গে তাঁর যৌনসম্পর্কের ভিডিও ফুটেজ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত
হওয়ার পরে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয় তাঁকে নিয়ে।
(৮) স্বামী
প্রেমানন্দ তিরুচিরাপল্লি আশ্রমের এই
ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ১৩ জন মহিলাকে ধর্ষণ করার প্রমাণ মেলে। এক
শ্রীলংকার নাগরিককে হত্যার অভিযোগও ছিল।
(৯) স্বামী সদাচারী
একসময় প্রভাবশালী ছিলেন খুবই, কিন্তু রাজনৈতিক
ক্ষমতাবলে প্রভাব হারান। যৌনপল্লী চালানোর দায়ে আপাতত জেলে আছেন।
(১০) মহাঋষি মহেশ যোগী
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মগুরু বলে দাবি। দেশের নানা জায়গায় ও বাইরের একাধিক
দেশে আশ্রম রয়েছে। মহিলা ভক্তদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াসহ টাকা পয়সা
নয়-ছয়ের অভিযোগ ওঠে।
(১১) শুধু যৌনতা-মাখা
বাণী দেওয়া নয়, সাধারণ চুমাচাট্টি
থেকে অসাধারণ ‘ওসবকিছু’র বন্দোবস্তও যখন করে দেন স্বয়ং ভগবান, রচনা করেন সেক্সের অভয়ারণ্য তখন তা কামবুভুক্ষু মানুষকে
টেনে আনবেই। গ্রিক ফিলোতেস, রোমান কিউপিড, হিন্দু মদনদেব এঁরা টেক্কাই পাননি কলির এই ভগবানের কাছে
ভগবান শ্রী রজনীশ। ওরফে ‘সেক্স গুরু’ ওশো। ১৯৮১ সালে আচার্য রজনীশের পদধূলি পড়ল মার্কিন মুলুকে।
ওয়েগনে গড়ে উঠল নতুন আশ্রম ‘রজনীশপুরম’। সাংবাদিকরা তো তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘রোলস রয়েস গুরু’!
যে
কেউকেটারা এই ‘নব্য সন্ন্যাস’-এ দীক্ষা নিতেন,
তাঁদের
সৌজন্যে রজনীশের ব্যক্তিগত রোলস রয়েসের সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছিল ৯৯ সংখ্যায়। সেবার
ছিল মার্কিন কাউন্টি নির্বাচন। অতএব রজনীশপুরমের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গেলে
চূড়ান্ত ক্ষমতা নিজেদের প্রার্থীকে জেতাতে হবে, বিরোধীরা যাতে ভোট দিতে যেতেই না পারে। অতএব বিষ মেশাও খাবারে !
পরীক্ষামূলকভাবে ছড়ানো হল বিষ স্যালমোনেলা ব্যাকটিরিয়া। বিষক্রিয়ায় অসুস্থ
হয়ে পড়লেন শত শত নিরীহ মানুষ। শুরু হল তদন্ত। মার্কিন মুলুকে ভগবান রজনীশের
সাজানো বাগান শুকোতে আরম্ভ করল অচিরেই। তাঁর শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন অভিনেতা বিনোদ
খান্না, মহেশ ভট্ট, পরভিন বাবি প্রমখ বিখ্যাত মানুষজন। গুণমুগ্ধতার সার্টিফিকেট
দিয়েছেন মনমোহন সিংহ, ম্যাডোনা, কপিল দেব, টম ক্রুজ, দলাই লামা, ফেদেরিকো ফেলিনি।
পঞ্চান্নটি ভাষায় অনূদিত তাঁর বই, বেস্টসেলারও। মৃত্যুর
পরও পুনেতে তাঁর আশ্রম রমরমিয়ে চলছে। ধর্ম বেচে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
এই আশ্রমের।
(১২) ভগবান সাঁই বাবার
অনুগামীর সংখ্যা অসংখ্য এবং সেইজন্য ভগবানের ধনদৌলত প্রচুর। সেই ধনদৌলত অন্যান্য
অধুনা জাগ্রত ভগবানের থেকে অনেক অনেক বেশিই। ধনদৌলতের ঠিক প্রামাণ্য তথ্য দেওয়া
যাবে না। কারণ হিসাবে বলা হয়, এই ধনদৌলতের
প্রদানকারীরা নিজেরাও ভগবানের লোক। আর ঠিক সেই কারণেই এই সব দানের উৎস জানা যায়
না। ভগবানের জীবন অনেক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে মসীলিপ্ত। উনি শূন্য থেকে বিভূতি এবং
সোনার চেন আনার ব্যাপারে দক্ষ ছিলেন। আগে তিনি এইচএমটি ঘড়ি আনতেন, কিন্তু সেই ঘড়িগুলোতে তৈরির তারিখ লেখা থাকত বলে বন্ধ করে
দেন। স্বনামধন্য যাদুকর পি.সি. সরকার (জুনিয়ার) এই অলৌকিক ব্যাপারের
প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চেয়েছিলেন। সাঁই বাবাকে শূন্য থেকে কুমড়ো আনার জন্য বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি যুক্তিগ্রাহ্য কারণেই আনতে অস্বীকার করেন।
সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে তাঁর অনুগামীর বা ভক্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে।
নিজেকে পুনর্জন্ম নেওয়া সির্দ্দির সাঁই বাবা বলে দাবি করা এই বাবা, অতি স্বচ্ছল ছিলেন এবং সোনার সিংহাসনে বসতেন। সম্পদের
চূড়াতে বসে থাকা এই স্বঘোষিত পুনর্জন্ম নেওয়া সাঁই বাবা নিজেকে স্বয়ং ভগবান বলেই
প্রচার করতেন। সাঁই বাবা আরও বলেছিলেন,
তিনি ৯৬
বছরে তার মরদেহ ত্যাগ করবেন। কিন্তু তিনি ৮৫ বছরের বেশি বাঁচতে পারলেন না।
পুত্তাপুর্তির প্রশান্তি নিলয়মে সত্য সাঁই বাবার
আশ্রম থেকে পাওয়া গিয়েছে কোটি কোটি টাকার ধন-সম্পত্তি. সত্য সাঁই বাবার ঘর থেকে
মিলেছে ৯৮ কিলোগ্রাম সোনা, ৩০৭ কিলোগ্রাম রূপো
এবং ১১ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। আর বাকি যে
গয়না পাওয়া গিয়েছে তার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। এছাড়াও পাওয়া
গিয়েছে হিরে সহ আরও অনেক জিনিস। মৃত্যুর প্রায় দু-মাস পর সত্য সাঁই বাবার ঘর খোলে সেন্ট্রাল ট্রাস্ট।
তারপরেই তাঁদের নজরে আসে ওই ধনসম্পত্তি,
নগদ
টাকা ও সোনারূপার গয়না। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা লেগেছিল ওই টাকা, গয়নার অডিট করতে। টাকা গুনতে ব্যবহার করা হয়েছিল তিনটে
মেশিন। আধ্যাত্মিকতার কথা বলে সারা বিশ্বের ১৬৬টি দেশে পাঁচ কোটি ভক্ত ছড়িয়ে
দিয়েছেন সাঁই বাবা, যিনি অর্জন করেছেন ৪০
হাজার কোটি রুপির সম্পত্তি, অর্জন করেছেন
প্রণামীর নগদ অর্থ, চেক, সোনা ও রত্মরাজির পাহাড়। সাঁইবাবা মন্দিরের মোট সম্পত্তি
২০০০ কোটি টাকা, এছাড়া ৩০০ কেজি সোনা
ও ৩০,০০০ কেজিরও বেশি রূপা আছে।
(১৩) জলন্ধরের কাছে
নুরমহলে দিব্য জ্যোতি জাগৃতি সংস্হান৷ মোট সম্পত্তির পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকা৷
আশ্রমের প্রধান গুরু আশুতোষ মহারাজ৷ গুরুর মৃত্যু হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি (২০১৪)৷
কিন্তু শিষ্যরা মানতে রাজি নন৷ তাঁদের দাবি,
‘সমাধিতে' গিয়েছেন গুরুজি৷ জেগে উঠবেন সময় হলেই৷ আর সেই প্রতীক্ষায়
দেহ রাখা রয়েছে বিরাট ডিপ ফ্রিজের ভিতর৷ ঠিক যেমন হয়েছিল ১৯৯৩ সালে বালক
ব্রহ্মচারীর সুখচর আশ্রমে৷ ২৯ জানুয়ারি চিকিত্সকরা গুরুজিকে ‘ক্লিনিক্যালি ডেড'
ঘোষণা
করলেও ভক্তরা মানতে রাজি হননি৷ তাই দেহ সত্কারেও রাজি নন৷ ডিপ ফ্রিজে দেহ ঢুকিয়ে
আশ্রমের বাইরে অবরোধ তৈরি করা হয়েছে৷ রামপালের মতোই আশুতোষ মহারাজের শিষ্যরা
গড়েছেন নিজস্ব বাহিনী৷ প্রবেশপথে কড়া তল্লাশি করা হচেছ৷ আশুতোষ মহারাজ ওরফে মহেশ
কুমার ঝায়ের অন্ত্যেষ্টি না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে গত এপ্রিলে আদালতের দ্বারস্থ হন
পুত্র দলীপকুমার ঝা৷ দাবি করেন, পিতার অস্হি তাঁর
হাতে তুলে দেওয়ার জন্য৷ আবার সঙঘগুরুর গাড়িচালক পুরণ সিং মহারাজের মৃত্যুর প্রকৃত
কারণ উদঘাটনে সিবিআই তদন্ত দাবি করে হাই কোর্টে আর্জি জানান৷
এছাড়া ধর্মের নামে আইসিস, আল কায়দা, আনসারুল্লাহ বাংলা
টিম, ইসলামিক জিহাদ, হামাস, হরকত-উল-জিহাদ, হরকত-উল-মুজাহিদিন,
জেইস-মুহম্মদ, জিহাদ-এ-মুহম্মদ,
তাহ-রিখ-এ-নিফাজ-সারিয়াত-এ-মুহম্মদ, আল-হিকমা, আল-বদর-মুজাহিদিন, জামাতে ইসলামিয়া,
হিজাব-এ-ইসলামিয়া, জমিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাত ই আল হিকমা ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ
(জেএমজেবি), শাহাদাত-ই আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি, শহিদ নসুরুল্লাহ আল আরাফাত বিগ্রেড,
হিজবুত
তাওহিদ, জামায়াত-ই ইয়াহিয়া, আল তুরাত, আল হারাত আল ইসলামিয়া, জামাতুল ফালাইয়া তাওহিদি জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট,
জুম্মাতুল
আল সাদাত, শাহাদাত-ই-নবুওয়ত, আল্লাহর দল, জইশে মোস্তফা
বাংলাদেশ, আল জিহাদ বাংলাদেশ, ওয়ারত ইসলামিক ফ্রন্ট,
জামায়াত-আস-সাদাত, আল খিদমত, হরকত-এ ইসলাম আল
জিহাদ, হিজবুল্লাহ ইসলামি সমাজ, মুসলিম মিল্লাত শরিয়া কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট ফর জিহাদ, জইশে মুহাম্মদ,
তা আমীর
উদদ্বীন বাংলাদেশ, হিজবুল মাহাদী, আল ইসলাম মার্টায়ারস বিগ্রেড ও তানজীম ইত্যাদি শত শত
জঙ্গিদলগুলি ইসলাম কায়েমের বাসনা নিয়ে জিহাদ,
কোতল
করার কর্মকাণ্ড – এর ফলেও ধর্মের প্রতি
মানুষের অনীহা বাড়ছে, বাড়ছে ঘৃণা।
এতো গেল খবরের শিরোনামে উঠে আসা কয়েকটি
ঘটনামাত্র। এখানেই শেষ নয়। পাড়ায়-পাড়ায় অঞ্চলে-অঞ্চলে জেলায়-জেলায় রাজ্যে-রাজ্যে
এরকম হাজার হাজার হাজার ধর্মের নামে ভণ্ড প্রতারক কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বানিয়ে
ফেলছে দুর্বল আর্ত মানুষদের প্রতারিত করে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বহুযুগ আগে থেকে
এই ভণ্ডামি চলছে। সব ঘটনা সামনে আসত না। এখনও আসে না। তবে তবে উন্নত প্রযুক্তির
কল্যাণে খুব বেশিদিন গুরুরাজ চালানো সম্ভব হয় না। এইসব গুরুদের শেষ ঠিকানা হয় “শ্রীঘর”। সাম্প্রতিককালে একটি
প্রবচন চালু হয়েছে “ধরা পড়লে ধনঞ্জয়, না-পড়লে এনজয়”।
ধর্ম,
ঈশ্বর
না-মানাটা নাস্তিকদের কত বড়ো অপরাধের কাজ যে,
তাঁর
নিজের মতো বাঁচার অধিকার কেড়ে নিতে হবে চাপাতির আঘাতে ? শতছিন্ন করতে হবে নিরপরাধ শরীর ? রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে হবে, কারণ সেটাই নাকি কত্তার নির্দেশ? আর নাস্তিক বা মুক্তমনারা যাঁদের বিরুদ্ধে লেখেন বা বলেন
সেইসব ভণ্ডরা দিব্যি বহাল তবিয়তে জীবন কাটাবেন ? সাঁই বাবা, চন্দ্রস্বামী, রজনীশ, আশারামরা ধর্মের নামে
বেওসা করে যাবে, তাঁদের কিছু হবে না ? আর যাঁরা নিরীহ নিরস্ত্র লেখকমাত্র, তাঁদের কল্যা কেটে নেওয়া হবে দিনেদুপুরে ? কেন ? সেটা কি ধর্মানুভূতি, নাকি বেওসানুভূতি ?
মুক্তমনা
যুক্তিবাদীরা ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে ক্ষতিটা কোথায় হবে ধর্মে, না বেওসায় ? ধর্ম ভ্যানিস হয়ে
গেলে ধর্মের নামে বেওসাও ভ্যানিস হয়ে যাবে,
সেই ভয়ে
! ধর্ম কি ছেলের হাতের মোয়া, যে ফুঁস করলেই হাওয়া
! ভয় কীসের ? ভরসা রাখুন, যে ধর্মে আস্থা রাখেন। ধর্মের ভিত যদি লৌহকঠিন হয়, নাস্তিকদের সাধ্য কি তা টলায় ! ইসলাম, সনাতন তথা হিন্দু,
খ্রিস্ট
ইত্যাদি ধর্মগুলি অত্যন্ত প্রাচীন – প্রতিষ্ঠিত। শুধু
ইসলাম হিন্দুধর্মকে, হিন্দুধর্ম ইসলাম
ধর্ম ওয়ান ইস্টু ওয়ান ভ্যানিস করার ক্ষমতা রাখে না – সেখানে গুটিকতক যুক্তিবাদী মুক্তমনা এসে এতোগুলি যুযুধান ধর্ম-প্রতিষ্ঠানকে
ভ্যানিস করতে পারে ? যুক্তি কী বলে ? আসলে সবাই জানেন ধর্ম ধর্মের জায়গাতেই থাকবে। কিন্তু বন্ধ
হবে বেওসা। সাচ্চা ধর্মবাদীরা জানেন কোথাকার কে নাস্তিক নাকি মুক্তমনারা ধর্মের
সমালোচনা করলে ধর্মের অবস্থান একচুলও টলাতে পারবে না। কিন্তু নাস্তিক তথা
মুক্তমনাদের ভীষণ ভয় পান ভণ্ড, বকধার্মিকরা – যাঁরা ধর্মের নামে ধর্ম ভাঙিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁরা
মনে করেন সাধারণ মানুষের চোখের সামনে যদি ভণ্ডদের মুখোশ খুলে যায়, তাহলে তো শেষ ! অতএব নাস্তিকদের হত্যা করো এবং মুখ বন্ধ করে
দাও।এসব ভণ্ডেরা জানেন অসির চাইতে মসির জোর বেশি, বল্লমের চাইতে কলমের ক্ষমতা অবর্ণনীয়।আর এইসব খুনিদের কাজকর্মকে সমর্থন করেন
যেসব অন্ধ মানুষ, তাঁরা জানেন না
মোক্ষলাভ থেকে কতদূর চলে যাচ্ছে তাঁদের তৃষ্ণার্ত আত্মা !
তসলিমা নাসরিন ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “যত বেশি কোরান পড়বে মানুষ, মানুষ তত বেশি নাস্তিক হবে। বাই দ্য ওয়ে,
আমি
নাস্তিক হয়েছিলাম কোরান পড়ার পরই। নাস্তিকতার উপর কোনও কঠিন কঠিন বই আমার আর পড়ার
দরকার পড়েনি”। এটা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই
খাটে। তবে যে যত বেশি ধর্মবিশ্বাসী, সে তত বেশি মৌলবাদী
হয়ে পড়ে, অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে।
ধর্মবিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস থাকা, আর ধর্মবিশ্বাসের
নামে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া এক নয়। এখন কথা হল কারা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় এবং বইয়ে
দিতে পছন্দ করে ? অবশ্যই
ধর্মবিশ্বাসীরা নয়, তবে অবশ্যই
অন্ধবিশ্বাসীরা পৃথিবীকে রক্তাক্ত করে থাকেন।পৃথিবীতে হাজার হাজার ধর্ম এখনো
বিদ্যমান। এখনও আছে হাজার হাজার রকমের অন্ধবিশ্বাসী। সবগুলিই প্রগতিবিরোধী, মানবতাবিরোধী, জ্ঞান-বিজ্ঞানবিরোধী।
তবুও মানুষের মন-মানসিকতার উন্নতি হচ্ছে,
পৃথিবীর
নানাবিধ উন্নতি হচ্ছে। তাই প্রথাভাঙা নির্ভীক লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “পৃথিবীতে ধর্ম থাকার পরেও পৃথিবীর উন্নতি হচ্ছে, কারণ মানুষ কখনোই পুরোপুরি ধার্মিক নয়। ধর্মগুলিতে এত এত
বাজে কথা আছে যে, ধার্মিকদের পক্ষেও
সেসব পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব নয়। অনেক বিশ্বাসী তাদের ধর্মের বাজে কথাগুলি কারুর
কাছে শুনতে পেলে বলে থাকে, “না না, অসম্ভব, এমন খারাপ কথা আমার
ধর্মে থাকতেই পারে না”।
কার্যত কোনো বস্তুর ধর্ম হচ্ছে তার স্বভাব ও
প্রকৃতি সে ক্ষেত্রে অবশ্যই যে-কোনো প্রাণেরও ধর্ম হবে তার স্বভাব ও প্রকৃতি। তাই
প্রাণের প্রধান ধর্ম বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া ও টিকে থাকার জন্য বংশবিস্তার করা।
মানুষ যেহেতু প্রাণী জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী, তাই তার কিছুটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে শাস্ত্রনিদিষ্ট বিধিবিধান কেন তার ধর্ম হবে ? যেখানে শাস্ত্রনিদিষ্ট বিধিবিধান বলতে বোঝায় যুক্তিহীন কিছু
বিশ্বাসের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার পক্ষে প্রার্থনা ও কিছু অদ্ভুত নিয়মাবলি অনুসরণ করা
মাত্র। তাই বলে ধর্মনীতি সবই খারাপ এ কথা বলতে পারি না। ধর্মগ্রন্থগুলিতে প্রচুর
পথ চলার সঠিক দিশা আছে। ধর্মগ্রন্থগুলিতে প্রচুর ভালো ভালো কথা বা বাণী আছে, যেগুলি ঠিকঠাকভাবে অনুসরণ করলে মানুষ পশু না-হয়ে মানুষ হয়ে
উঠতে পারত। অনুতাপের বিযয়ে এই যে, ধর্মের সেই ভালো
দিকগুলি ধর্মগ্রন্থগুলিতেই আবদ্ধ থেকে গেছে,
সজ্জন
মানুষের অভাবে সেগুলির কোনো প্রয়োগই হয়নি।দুষ্টু ও দুষ্ট মানুষের হাতে পড়ে ধর্মের
সত্যনাশ হয়েছে, সর্বনাশ হয়েছে, বদনাম হয়েছে।এইসব দুষ্টু ও দুষ্ট মানুষদের সমবেতভাবে পৃথিবী
থেকে নির্মূল করতে হবে। যতদিন-না এটা সম্ভব হবে, ততদিন ধর্ম যোগ্য মর্যাদা পাবে না। ভাবুন, আজকে কয়েকজন সন্ত্রাসবাদীদের জন্য গোটা ইসলাম ধর্মেই বদনাম হয়ে গেছে। সারা
বিশ্বের কাছে এখন ইসলাম শান্তির নয়, ত্রাসের ধর্মে
রূপান্তরিত হয়েছে।সারা বিশ্বের সমগ্র মুসলিম সমাজ এই সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করতে
এগিয়ে না-এলে বদনাম ঘুচবে কীভাবে ?
বেশির ভাগ মানুষ কোনো-না-কোনো ধর্মগুরুর আদেশ
মেনে চলেন।তাঁদের বিশ্বাস সেই ধর্মগুরু বিধাতার প্রেরিত পুরুষ। সেই বিধাতার সেরা
উপকরণ দিয়ে সৃষ্ট এই ধর্মগুরুগণ। আর বাকিরা সব নিকৃষ্ট উপকরণে তৈরি। ভয়, দুর্বলতা এবং অজ্ঞতা –
এই
তিনটি মনোভাবই ধর্মবিশ্বাসের জননী। যে জাতি,
অর্থাৎ
যে জাতির মন এখনও উলঙ্গ তথা বর্বর যুগের কাছাকাছি পড়ে অন্ধগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে, সে জাতির ভয়-দুর্বলতা-অজ্ঞতা তত বেশি।অতএব তাঁর ধর্মবিশ্বাস
তত গভীর, যিনি ধর্মগুরুর আদেশ যত
অক্ষরে অক্ষরে পালনে তৎপর । কারণ এই ভয়ে –
পাছে
তাঁর কোনো অনিষ্ট ঘটে।
যে-কোনো ধর্মবিশ্বাসী বা যে-কোনো ধর্মাবলম্বী
মানুষের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষই আছেন,
যিনি
তাঁর ধর্মগ্রন্থের মূল ভাষা জানেন না। জানেন না, কারণ সাধারণের বোধগম্য ভাষায় ধর্মগ্রন্থগুলি রচিত হয়নি – যাতে ওই ধর্মগ্রন্থগুলি অসাধারণ(!) মানুষদের কুক্ষিগত থাকে।
সাধারণ মানুষকে তাই অনুবাদের সাহায্য নিতে হয়। অনুবাদের একটা সুবিধা হল, যিনি অনুবাদ করছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করা।মূল
জায়গা থেকে সরে এসে অন্য কিছুও লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। ধর্মবিশ্বাসীরা বুঝে হোক বা
না-বুঝে নিজ নিজ ভাষায় যতই ধর্মশাস্ত্র চর্চা করুক-না-কেন, তাতে কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় যখন কেউ ধর্মশাস্ত্র বা
ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন অলিগলি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা সংশয় প্রকাশ করেন, সমস্যা হয় তখনই। ধর্মবাদীরা কেউ বলেন ওটা ওই অনুবাদকের
গ্রন্থে উল্লেখ নেই, অমুক গ্রন্থে উল্লেখ
নেই। অমুক গ্রন্থ ঠিক নয়, তমুক গ্রন্থ ঠিক নয় ইত্যাদি।
ধর্মতন্ত্র নির্দেশিত এক ঈশ্বর অথবা একাধিক
দেবতার প্রতি আস্থায় ও ভক্তিতে অবনত থাকে,
হৃদয়হীন
এবং আত্মাহীন বাস্তব পরিপার্শ্বে ধর্মতন্ত্রই সেইসব সাধারণের জন্য কল্পিত হৃদয় এবং
কল্পিত আত্মায় বিশ্বাসের জোগান দেয়। এহেন প্রশ্নহীন আস্থা, আশ্রয় এবং ভক্তির উপর ভর করেই বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের
আস্তিক্যবাদ গড়ে ওঠে। পুরুত-মুমিন-মোল্লা-পাদরি-যাজকরা ধর্ম বিষয়ে যেরকম বিবৃতি
দিয়ে থাকেন সেটাই অব্যর্থ বলে মনে করেন এবং প্রশ্নহীন ভাবে বিনা প্রতিবাদে মেনে
নেন। কারণ আস্তিক্যবাদে এটাই দস্তুর।
যাঁরা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী তাঁদের উচিত হবে লৌকিক
ধর্মতন্ত্রানুসারী ওইসব সাধারণের বিশ্বাস ও আচরণের প্রতি যথার্থ দরদ এবং সহানুভূতি
ব্যক্ত করা – দরদ এবং সহানুভূতির সঙ্গেই তাঁদের
সঙ্গে মিশে তাঁদের লোকায়ত বস্তুবাদকে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদে উন্নীত করতে হবে। ধর্ম
প্রচারকদের জীবন-ইতিহাস তাঁর অনুসারিরাই সৃষ্টি করেন তাঁরা ইতিহাসে মহাপুরুষে
পরিণত হন। যে ধর্ম প্রচারকের যত বেশি স্তাবক এবং যত বেশি আনুগত্য, সে ধর্মের তত বেশি প্রসার। এই স্তাবক তথা অনুসারী তথা দাস
গোছের অনুগত মানুষরা তাঁদেরই স্বার্থে ধর্মের মহাপুরুষদের জীবনকে রহস্যাবৃত করে
তোলে না কাহিনির উপস্থাপনায়। সৃষ্টি করা হয় ইন্দ্রজাল।সময়ের সারণি বেয়ে বেয়ে যুগ
থেকে যুগান্তরে ধর্মগ্রন্থগুলিতে নিত্যনতুন অলৌলিকতা সংযোজন করতে ধর্মবাদীরা খুবই পারঙ্গম
হন – যা অজ্ঞ-ভীতু ধর্মবিশ্বাসীদের
প্রহেলিকা সৃষ্টি করে।
হজ্জ,
জাকাত, নামাজ, রোজা, নামকীর্তন, তবলিগ জামাত ইত্যাদির
মাধ্যমে মানুষের নৈতিকতা উন্নয়নের যতই চেষ্টা করা হোক-না-কেন, সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের নামে ধর্মের জিগির তুলে যে
হানাহানি, মারামারি, হিংসা, সন্ত্রাসের বিস্তার
চলছে তা দেখে সহজেই বোঝা যায় “বিশ্বাস” আসলে কোনো বিশাল অনুপ্রেরণা হয়ে মানুষের মধ্যে কখনোই কোনো
কাজ করেনি। পৃথিবীতে বহু যুগ ধরে মনীষী-মহাপুরুষেরা জন্মেছেন, ধর্মের কথা বলে জ্ঞান দিয়েছেন, দিস্তা দিস্তা কাগজে লিখেছেন, গণ্ডায় গণ্ডায় গ্রন্থ-কিতাব লিখে গেছেন এবং লিখে চলেছেন – সেগুলি কোন্ পুজোয় লেগেছে, কোন্ কম্মে লেগেছে ? আসলে ভালো ভালো কথা
তো শুধু বলার জন্যেই, অনুসরণের জন্য নয়।
ধান্দা না থাকলে প্রয়োগ হয় না।
ধর্মেই অন্দরমহলেই সমস্ত অকাজ-কুকাজ করেও নিস্তার
পাওয়ার ব্যবস্থা মজুদ আছে। সব ধর্মেই। গঙ্গাসাগর, পুরী, বারাণসী(কাশী), তিরুপতি, মক্কা, জেরুজালেম ইত্যাদি
পবিত্র স্থান দর্শনে আছে জীবনের সব পাপ ধুয়েমুছে সাফ করার নিশ্চিত
গ্যারান্টিপত্র।খ্রিস্টধর্মে কনফেস বক্সে ঢুকে কনফেস করার করার ব্যবস্থা আছে। কোটি
টাকার চোরাকারবারি প্রতারক দুর্নীতিগস্ত মানুষ তাই ধুমধাম করে পুজো-যজ্ঞ করে।অতএব
যতদিন ধর্ম থাকবে, ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকবে, বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় থাকবে ততদিন ধর্মের হানাহানি থাকবে, খুনোখুনি থাকবে,
রক্তারক্তি
থাকবে, অসহিষ্ণুতা থাকবে।যতদিন
মানুষের আনুগত্য ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে বিভক্ত হয়ে থাকবে ততদিন তা মানুষকে
স্বাধীনভাবে আর বিজ্ঞানসম্মতভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অর্জনে বাধা দেবেই।স্বর্গ
যাপনের লোভে নয়, বেহেস্তে হুরের লোভে
নয় কিংবা ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য নয় –
মানুষকে
ভালোবেসে মানুষের জন্য কাজ করার প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তবেই সর্বজনীন মানবতাবাদ। তা নাহলে চলবে মৌলবাদীদের তাণ্ডব, নর-সংহার। মৌলবাদ কী ?
‘মৌল’ শব্দের অর্থ মূল থেকে আগত, বা মূল সম্বন্ধীয়। এবং ‘বাদ’ শব্দের অর্থ যে মত বা তত্ত্ব। অতএব ‘মৌলবাদ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ
কী দাঁড়ালো – মূল থেকে আগত তত্ত্ব। কোন্
মূল আগত তত্ত্ব ? ধর্মগ্রন্থগুলির
বিবৃতি বা নীতি থেকে আগত তত্ত্ব।মৌলবাদ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল “Fundamentalism”। যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায় বলেন, “ধর্ম হল বিষবৃক্ষ,
আর
মৌলবাদ হল সে বৃক্ষের বিষাক্ত এক শাখা”। ধর্মশাস্ত্রের
মূলনীতিগুলিকে চরম সত্য এবং অপরিবর্তনীয় বলে যাঁরা মনে করেন, মূলত তাঁরাই শেষপর্যন্ত মৌলবাদী হন।মুক্তমনা অভিজিৎ মনে
করেন – পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মমতগুলি
সৃষ্টি হয়েছে বড়োজোর বিগত দুই থেকে চার বছরের মধ্যে। হিন্দু, ইসলান কিংবা খ্রিস্টধর্ম কোনোটাই সে অর্থেই চিরন্তন বা
সনাতন নয়। কাজেই ‘সনাতন ধর্ম’ নিছকই একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। আজকের দিনে ধর্মবিশ্বাসগুলির
মধ্যে বৈদিক ধর্মের (হিন্দুধর্মের পূর্বসূরি) উদ্ভব হয়েছিল আজ থেকে মাত্র ৩৫০০ বছর
আগে, ইসলাম ধর্ম এসেছে ১৪১৪ বছর
আগে, খ্রিস্টধর্ম ২০১৪ বছর আগে।
একটা সময় সামাজিক প্রয়োজনে যে ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়মকানুন তৈরি হয়েছিল। আজ তার
অনেককিছুই কালের পরিক্রমায় স্থবির, পশ্চাৎপদ, নিবর্তনমূলক এবং অমানবিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
একটা কথা প্রায়শই শোনা যায়, তা হল ‘ধর্মের অধিকার’।এটি একটি সাংবিধানিক কথা। ধর্মের অধিকার ব্যাপারটা ঠিক
কীরকম ? ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার
বলতে বোঝায় নাগরিকদের ধর্মাচরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা।প্রত্যেক ব্যক্তির বিবেকের
স্বাধীনতা এবং ধর্ম গ্রহণ, ধর্ম পালন ও ধর্ম
প্রচারের স্বাধীনতা।প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায়ের ধর্ম বা দানের উদ্দেশ্যে সংস্থা
স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করার, নিজেদের ধর্ম বিষয়ক
কার্যাবলি পরিচালনা করার এবং স্থার ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন করার এবং আইনানুসারে
তা ভোগ করার অধিকার।ধর্ম নিয়ে কোনো হানাহানি খুনাখুনির অধিকার দেওয়া হয়নি কোনো
সংবিধানে। যেকোনো ঘটনা বা ব্যক্তিকে নিয়েই ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকা যেতেই পারে।
তাতে কারুর ঠুনকো অনুভূতিতে আঘাত লেগে গেলে সেও লেখা বা বিদ্রুপের মাধ্যমে তার প্রতি-উত্তর
দেবে। এটাই তো হওয়ার কথা। শুধুমাত্র একজনের কার্টুন আঁকার জন্য ১২জন মানুষকে
প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে ফেলা হয়েছে। কোনো ধর্মের স্বাধীনতায় এ অধিকার দেওয়া
হয়নি।নবিকে নিয়ে মুভি বানালে মানুষ মেরে ফেলে তার অনুসারীরা, নবির কার্টুন আঁকলে মানুষ মেরে ফেলে তার অনুসারীরা। ভাবুন, দেড় হাজার বছর আগে মারা যাওয়া একটা লোকের এখনও পর্যন্ত কতটা
বাজে প্রভাব রয়ে গেছে পৃথিবী জুড়ে।
তথাকথিত ধর্মগ্রন্থগুলিতে বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে
আছে উত্তেজক নির্দেশাবলির ছড়াছড়ি। এই নির্দেশাবলিই আসলে মৌলবাদের আতুরঘর। সেগুলি
সবই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব। হাতেনাতে ধরা পড়ার পর আলোচকদের মুখ বন্ধ
করার জন্য কেউ অর্থাৎ ঈশ্বরের দুষ্টু ছেলেরা অনর্থক তর্কে মাতবেন, কেউ-বা অর্থাৎ ঈশ্বরের শান্ত ছেলেরা চাপাতিতে শান দিতে নেমে
পড়বেন ধর্মবাদীরা।ধর্ম মানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অচল এবং ভোঁতা হয়ে যাওয়া প্রাচীন
ধ্যানধারণা ও রীতিনীতি, অবৈজ্ঞানিক
চিন্তাচেতনা, কুসংস্কার এবং নিষ্ঠুরতা।ধর্ম
যে কীরকম নিষ্ঠুর তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সহমরণ বা সতীদাহ প্রথা। Pascal বলেছেন,
“Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from
religious conviction.”।
একদা প্রাচীন যুগে ধর্মীয় বিধানই ছিল আইন, অনুশাসন। রাষ্ট্র তথা সমাজের সুশৃঙ্খল আনতে হলে অনুশাসন
আবশ্যিক। অনুশাসন ছাড়া উচ্ছৃঙ্খল নাগরিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা সম্ভব নয়। আইনের শাসন
অনিবার্য সমাজ বিকাশের জন্য। এমন আর ধর্মীয় যুগ নেই। তাই ধর্মীয় অনুশাসনের
প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে। ধান্ধাতার আমলের ধর্মীয় আইনকে পিছন ফেলে রাষ্ট্রের প্রচলিত
ও পরিচালিত আইনের যুগ। রাষ্ট্রের অনুশাসনই
মেনে চলতে হবে সেই রাষ্ট্রের নাগরিকদের। যে দেশে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন বলবৎ আছে, সেখানে ধর্মীয় অনুশাসন-নিয়মকানুন গুরুত্ব পাবে কেন ? রাষ্ট্রের আইনের দুটি দিক – একটি সুপরিবর্তনীয়, অপরটি
দুষ্পরিবর্তনীয়। ধর্মীয় আইন সবটাই
দুষ্পরিবর্তনীয়। আর সেখানেই মূল সমস্যা। রাষ্ট্রীয় অনুশাসন সময়ের তালে তালে যুগের
চাহিদাকে মাথায় রেখে পরিবর্তন করা হয়,
সংস্কার
করা হয়, এমনকি চিরতরে বিলুপ্ত করে
দেওয়া হয়। ধর্মীয় অনুশাসনে এমন কোনো সুযোগ নেই। ধর্মবাদীরাও বিলক্ষণ জানেন ধর্মের
অনেক অনুশাসনই অমানবিক এবং ভোঁতা। যেহেতু পূর্বেই ধর্মগ্রন্থগুলি ঐশীবাণী বা
ঈশ্বরের বাণী বা অপৌরুষেয় বলে প্রপাগান্ডা করে ফেলেছেন, সেহেতু ওতে আর হাত দেওয়া যাবে না। অপৌরুষেয় হঠাৎ করে
পৌরুষেয় হয়ে গেলে তো কেলো হয়ে যাবে ! পরিবর্তন সম্ভব হবে যদি ঈশ্বর এসে পরিমার্জন
করেন। তাও কী সম্ভব ? ঈশ্বর শেষবারের মতো
ধর্মগ্রন্থ লিখেছিলেন ১৪১৪ বছর আগে ! তারপর ঈশ্বর যে কোথায় হারিয়ে গেল ! আল্লাহ, ভগবান, গড – সকলেরই একই রকম অবস্হা। সভ্যতার অগ্রগামিতার সঙ্গে সঙ্গে
ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফুরিয়ে গেছে ধর্মপ্রবর্তক-নবি-পয়গম্বর-অবতারদের
ভূমিকাও। আজ আধুনিক মননের অধিকারী মানুষের কাছে প্রাচীন ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলি
একেবারেই অপাঙক্তেয় হয়ে উঠছে। ধর্মের ভয় দেখিয়ে, অথবা ঈশ্বরের শাস্তির দোহাই দিয়ে মানুষজনকে সৎ পথে পরিচালিত করার ব্যাপারটি
নিদারুণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।ভগবান বা আল্লাহ বা গডের ভয় দেখিয়ে মানুষকে
যদি পাপ থেকে বিরত রাখা যেত, তাহলে রাষ্ট্রে
পুলিশ-দারোগা-আইনকানুন-কোর্টকাছারির আর প্রয়োজন হত না। ঈশ্বরে বিশ্বাস, পরকালে, স্বর্গ বা বেহেস্তের
লোভ এবং দোজখ বা নরকের ভয় দেখিয়ে কিছুই করা যায়নি।ধর্মের কোনো পথই অপরাধীদের অপরাধ
থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারেনি।
মানষের সাময়িক ‘না-জানার’ বা ‘না-ব্যাখ্যা’ করতে পারার সুযোগ
ধর্ম গ্রহণ করে। ভয়ের সুযোগে আতঙ্ক সৃষ্টি করে মানুষকে ‘বিশ্বাসী’ করে তোলাটাই ধর্মের
মূল কাজ বা কর্মসূচি।ভয়ের সুযোগ নিয়েই আতঙ্ক এবং আতঙ্কবাদ।বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে
বড়ো আতঙ্কবাদী মতবাদের নাম ‘ধর্ম’। কেঊ সরাসরি খুন করার হুমকি দিয়ে কিংবা চাপাতির আঘাতে ধড়
থেকে গলাটা ছিন্ন করে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করে। কেউ-বা আবার মানসিকভাবে আতঙ্কিত
করে রাখে।যখন মানুষের বঞ্চনারইতিহাস শুরু হয়,
তখন
থেকেই ধর্মের প্রয়োজন দেখা যায়। দেখা যায় সেগুলিকে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা এবং
সেগুলির পক্ষে যুক্তি খোঁজা। ধর্মের প্রধান প্রয়োগ মানুষের দুর্বলতাগুলিকে কাজে
লাগিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত এবং লোভী করে তোলা।এইভাবে ধর্মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি পার্থিব
জগবে ফ্যাসিবাদ।
প্রাচীনকালের ধর্মগ্রন্থগুলোর আলোকে নৈতিকতাকে
বিশ্লেষণ করলে আর হবে না। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান এবং বিচার-বিশ্লেষণ
করতে হবে। ধর্মকেন্দ্রিক নৈতিকতার বিষয়গুলির অগ্রণী চিন্তার মানুষদের কাছে
গুরুত্বহীন। নাস্তিক্যবাদকে আর অবহেলা করা যাবে না। যদি নাস্তিক্যবাদকে একমুখী করা
সম্ভব হয়, তাহলে নতুন একটা রক্তপাতহীন
পৃথিবী গড়া সম্ভব। শঙ্করাচার্য প্রমুখ দার্শনিক প্রাচীনকালের নাস্তিক্যবাদী ‘চার্বাক দর্শন’-কে ‘লোকায়ত’ বা ‘ইতর লোকের’ দর্শন হিসাবে
প্রতিষ্ঠিত করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতাটির কথা এক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে
পারে। এখানেই শেষ নয়, চার্বাক দর্শনের
উৎপত্তি সম্বন্ধেও বলা হয়েছে, মহাভারতের এক
কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাকের নাম থেকেই চার্বাক দর্শনের উৎপত্তি।মহাভারতে উল্লেখ করা
হয়েছে, চার্বাক ছিল দুর্যোধনের বন্ধু
এক দুরাত্মা রাক্ষস। বোঝাই যায়, প্রাচীন ভাববাদীরা এই
নাস্তিক্যবাদী দর্শনটির প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এমন ঘৃণ্য
চরিত্রের রাক্ষসের সঙ্গে দর্শনটিকে জুড়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।কিন্তু সবিশেষ লাভ
হয়নি। আস্তিক্যবাদের পাশাপাশি নাস্তিক্যবাদও বহমান। আস্তিক্যবাদ ও নাস্তিক্যবাদের
জন্মলগ্ন প্রায় একই। নাস্তিক্যবাদ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নব্য-ধারণা নয়।
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম নাস্তিক্যবাদেরই সার্থক ফসল। নাস্তিকদের অবিশ্বাস তাই শুধু
অতিমানবিক সত্তায় নয়, তার চাইতেও অনেক
গভীরে প্রোথিত। নাস্তিক্যবাদীরা অবিশ্বাস করেন প্রথাগত সভ্যতায় প্রায় সমস্ত
অপবিশ্বাসে। সবকিছুই তাঁরা যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখতে চান। চাপাতির ভয় দেখিয়ে এই
প্রবাহ আটকানোর ক্ষমতা কারোর নেই। নাস্তিক্যবাদীরা অস্ত্র এবং রক্তপাতে বিশ্বাসী
নয়। নিরস্ত্র নাস্তিক্যবাদীদের হত্যা করা সহজ হলেও নাস্তিক্যবাদকে হত্যা করা যাবে
না। আস্তিক্যবাদী বা ধর্মবাদীদের কাছে একটাই অনুরোধ – এখন আর চার্বাকের যুগ নেই। আপনারা নাস্তিক্যবাদীদের
অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য করবেন না। আত্মরক্ষার অধিকার সবার থাকে, নাস্তিক্যবাদীদেরও আছে। নাস্তিক্যবাদীরা অস্ত্রধারণ করলে
সেটা ধর্মবাদীদের পক্ষে খুব সুখের হবে না।
পরিশেষে বলি, আমাদের ধর্ম আমাদের কাছে, তোমাদের ধর্ম তোমাদের
কাছে। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। কেউ
যায় মসজিদে, কেউ যায় মন্দিরে। প্রার্থনা রত কেউ প্যাগোডায়
গির্জাতে। ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকলে ধর্ম বিরোধিতার স্বাধীনতাও আছে, থাকতে হবে। যে যুক্তিতে আস্তিকতা ন্যায়সংগত হয়, তাহলে সেই যুক্তিতে নাস্তিকতাও ন্যায়সংগত। তোমার ঈশ্বরে
বিশ্বাস ধর্মে আস্থা যদি পবিত্র হয়, তাহলে নাস্তিকদের
ধর্মে অনাস্থা ঈশ্বরে অবিশ্বাসও পবিত্র। তাই নয় কি ?
________________________________________________________________________
তথ্যসূত্র : (১) কোরান দর্শন -- সদর উদ্দিন আহমদ
চিশতী, (২) বিশ্বাসের ভাইরাস --
অভিজিৎ রায়, (৩) ধর্মানুভূতির উপকথা – হুমায়ুন আজাদ,
(৪)mgnabi.wordpress.com, (৫) দুই বাংলার যুক্তিবাদীদের
চোখে ধর্ম – প্রবীর ঘোষ ও ওয়াহিদ রেজা, (৫) যার যা ধর্ম –
মোহাম্মদ
হাবিবুর রহমান, (৬) মনু মোহম্মদ
হিটলার – আজিজুল হক, (৭) নির্বাচিত প্রবন্ধ – হুমায়ুন আজাদ, (৮) প্রবন্ধ সংগ্রহ – হায়াত মামুদ, (৯) জিজ্ঞাসা (ধর্ম/), (১০) ধর্ম ও প্রগতি –
জয়ন্তানুজ
বন্দ্যোপাধ্যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন