সবার
গার্লফ্রেন্ড আছে। আমার নেই। খু-উ-ব খুব আপেক্ষ হত। খুব খারাপ লাগত। কিন্তু কোনো
সুন্দরীকে প্রস্তাব দেবার মতো স্নায়ুশক্তি আমার ছিল না। যতই মেয়েদের দেখি ততই
হতাশ হই। পৌঁছতে পারি না। তবে কী মনের মানুষ জুটবে না এ জীবনে ! আমি কি
বিন্দুমাত্র আকর্ষণীয় নই ! খুব কুৎসিত,
কিম্ভূতকিমাকার ? আমি কী কোনো একজন নারীর
প্রেমাষ্পদ হতে পারি না। নিদেন পক্ষে বয়ফ্রেন্ড ..........!
১৯৮৮
সাল। শ্রীময়ী আমাদের পাড়ায় পড়াতে আসত। আমার বোনের সঙ্গে পরিচয় হবার সুবাদে
আমাদের বাড়িতেও আসা-যাওয়া ছিল শ্রীময়ীর।প্লাবনে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো ওকেও
আঁকড়ে ধরার বাসনা হল। উপমার জন্যই উপমা। ওকে ‘খড়কুটো’ বলে বিশেষিত করে ছোটো
করব না। ছোট্ট একটা চিরকুটে ছোট্ট একটা বাক্যে আমার অভীপ্সা জানিয়ে দিলাম,
এক বুক সাহসে ভর করে। খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম – প্রত্যাখ্যাত
হব না তো!
না, প্রত্যাখ্যাত হইনি। গাছে না-উঠতেই
যেন এক কাদি। আমার প্রস্তাব অনুমোদিত হল, সহাস্যেই। আমি যেন
হাতে চাঁদ পেলাম। শ্রীময়ীও কি আমার প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করে ছিল ! জানি না।
কোনোদিন এ বিষয়ে প্রশ্নও করিনি। তবে সেদিন নিজেকে গর্বিত পুরুষ মনে হল। ওর জন্যই
সেদিন থেকে নিজেকে একজন ‘পুরুষ’ বলে
আইডেন্টিটি খুঁজে পাচ্ছিলাম।
মানুষ
দাঁড়াতে পারলে বসতে চায়, বসতে পেলে শুতে চায়। আমারও ছুঁতে ইচ্ছে হল।
সেদিন ছিল দোলের দিন। দোল আমি কখনোই খেলি না। কোনোদিন না। তাই ফি-বছর ঘরবন্দিই থাকি। রান্নার কাজে বোনকে সাহায্য করছিলাম। কাজের মেয়ে, বোন এবং আমি মিলিয়ে বাড়িতে তিনজনই ছিলাম, চারজন হলাম শ্রীময়ীর উপস্থিতিতে। শ্রীময়ী বোনের কাছে জানতে চাইল, আমি দোল খেলছি না কেন। দ্বাদশবর্ষীয়া কাজের মেয়েটি আগ বাড়িয়ে জানাল, দাদা রং খেলে না। -- তোমার দাদার রং আছে যে খেলবে ! শ্রীময়ীর তির্যক বাক্যবাণ আমার বুকে বিঁধল। সেদিনই প্রথম অনুভূত হল এক নারী-শরীরের স্পর্শ।ভাব হয়ে গেল। প্রতিদিন দু-বেলা ওকে না দেখলে একদম ভালো লাগত না। মন উচাটন হয়ে যেত। শ্রীময়ীও চলে আসত প্রতিদিন, দু-বেলাই। একটা সময় শরীরীভাবেও জড়িয়ে পড়লাম।
এইভাবে
চলছিল দিন-রাত-মাস-বছর। ভাবলাম ওকে আমার প্রেমের স্বীকৃতি দিতে হবে। ওকে নিয়েই সংসার
পাতার স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। সংসার কীভাবে পাতব ? তখন তো কাঠ-বেকার। একটা ভালো কাজের আশায় এখানে ওখানে
দৌড়াদৌড়ি করতে থাকলাম। এক ভদ্রলোকের প্ররোচনায় বেনারস চলে গেলাম কাজের আশায়।
দীর্ঘ দু-বছর মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম সেখানে। সবই নিষ্ফলা হল। কোনোরকমে দিন
কাটাচ্ছিলাম। মাকে চিঠি লিখে জানালাম, আমি ঠগের পাল্লায়
পড়েছি। বাড়ি ফেরার টাকা নেই। কিছু টাকা পাঠাও মানি অর্ডারে। আমাদের তখন ল্যান্ডফোন
ছিল না। মোবাইল নামটা তখনও পর্যন্ত কেউ শোনেনি। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে শুধুই চিঠি।
কয়েকদিন
পর দেখি স্বয়ং মা এসে হাজির, বেনারসে। আমাকে আবিষ্কার করলেন, বললেন, “এখনই বাড়ি চলো।“ আমি বললাম, “মা,
আর দুটোদিন দেখে যাই। যদি কিছু হয়। তুমি চলে যাও”। মা সেদিন চলে এসেছিল বটে। পড়ে ব্যাপারটা ভেবে অসম্ভব খারাপ লাগছিল।
মাকে কি একা একা ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া একদম ঠিক হয়নি। পরে ভাবলাম, কী করে পারলাম মাকে একা
বিদেশ-বিভুঁইয়ে ছেড়ে দিতে ! তাহলে কি মা-ছেলের বন্ডিংয়ে কোনো ত্রুটি আছে! কে
জানে।
অবশেষে
দু-দিন পর শীর্ণকায় ভগ্নদেহে বাড়ি ফিরলাম।অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।পরদিন সকালে
শ্রীময়ীর খোঁজ করলাম। কেউই ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারল না। আমি সে সময় সন্ধ্যা হলেই
বনগাঁ রেলস্টেশনের রেলওয়ে হুইলার জগন্নাথ-বলরামের বইপত্রের দোকানে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতাম।এমনই এক সন্ধ্যায় আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল অপার বিস্ময়।
-- “আপনার বন্ধুকে একটু আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবেন ?” আমি
দোকানের যেদিকে দাঁড়িয়েছিলাম, তার উলটোদিক থেকে কথাগুলি
ভেসে এল আমার কানে।
-- “বিপ্লব, তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়”। জগন্নাথ বলল।
চোখ
তুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার জোগাড় ! দোকানের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে এক নববধু।
লালের আধিক্য শরীর জুড়ে।শ্রীময়ী, নববধুরূপে শ্রীময়ী। নতুন বউকে যেমন অতি সুন্দরী লাগে, ওকেও তেমনি লাগছিল। আমার বুকের ভিতর যেন সিরিয়াল বিস্ফোরণ হয়ে চলছিল।
তপ্ত লাভা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল যেন হৃদপিণ্ড ।আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কথা
হারিয়ে গেল। মাথার ভিতর সব ব্ল্যাংক।“আমার সঙ্গে কি কথা বলা
যাব না?” – শ্রীময়ীর নরম প্রশ্নে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো
এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।এগিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু মুখ থেকে যেন
কথা সরছিল না। একটা দম বন্ধ-করা অবস্থা। ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ও আজ পরস্ত্রী হয়ে গেছে, অথচ কালও তো ভেবেছিলাম আমার বউ হবে
! “খুব তাড়াতাড়ি ছেলে দেখে আমায় বিয়ে দেওয়া হল।আমার
কিছু করার ছিল না, বিয়েতে বসে যাওয়া ছাড়া। এই দেখো আমার
বরের ছবি”। --- আমার হাতে পোস্টকার্ড
সাইজের একটা ফোটোগ্রাফ দিল। তারপর আবার বলতে শুরু করে দিল – “এ বর আমার পছন্দ হয়নি।তার ওপর ও
জেনে গেছে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। তোমার একটা চিঠি ও পেয়ে গেছিল। আমার
সঙ্গে শোয় পর্যন্ত না। বলে আমার সঙ্গে ও শারীরিক সম্পর্ক করলেও নাকি আমাদের
সন্তান তোমার মতোই দেখতে হবে”।
--সব্বোনাশ, সেকি ! তোমার বাবা-মা জানতেন আমাদের
সম্পর্কের কথা, তোমার দিদিরাও তো জানতেন। তাহলে ধরে-বেঁধে
তোমায় বিয়ে দিলেন কেন ! তুমি আপত্তি করোনি?”
-- “কে শুনবে আমার আপত্তি ? ওদের যুক্তিতে আমার হার মেনে
নিতে হয়েছিল”।
-- “কী যুক্তি?”
–- “তোমরা কুলীন ব্রাহ্মণ, আমরা কৈবর্ত। এমন বিয়ে মহাপাপ।
তুমি আমার বর হলে জামাই হিসাবে নিশ্চয় আমার মা-বাবাকে প্রণাম করতে…..সেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে মহাপাতক হত”।
-- “এমন সমস্যা হয় আগে তো কখনো জানাওনি
! তোমাদের জাতপাতের জাতাকলে সম্পর্ক শেষ ?”
– “নিয়ম ভাঙার ক্ষমতা বা সাহস
সবার হয় না। আমাদেরও হয়নি, আমারও না। যা হওয়ার হয়ে গেছে।
আমরা নিয়মের দাস। তবে আমাকে ভুলে যেয়ো না। এ জীবনে তোমার বউ হতে পারলাম না বলে
বন্ধুত্ব হওয়া থেকে বঞ্চিত কোরো না। বন্ধুত্বে কোনো নিষেধাজ্ঞা রাখেননি ঈশ্বর !
যাতায়াতের পথে দেখা হলে কথা বোলো। ডাক দিলে সাড়া দিয়ো । এড়িয়ে যেয়ো না,
এড়িয়ে গেলে খুব কষ্ট পাবো”।
না, আর কোনোদিন শ্রীময়ীর সঙ্গে দেখা
হয়নি। এক অনিবার্য কারণে বনগাঁর বাড়ি বিক্রি করে মধ্যমগ্রাম চলে এলাম। শুনেছি
চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়। মনের আড়াল ! শ্রীময়ী এখন কেমন আছে ? কেমন দেখতে হয়েছে ? বুড়ি হয়ে গেছে আমার মতো ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন