কোন্ এক বিদেশি পাইলট নাকি ব্যঙ্গ করে বলেছিল : “বাংলাদেশে সবচাইতে
সস্তা হল মেয়ে মানুষ। মাত্র 10$ এর বিনিময়ে সারা রাত একটা মেয়েকে ভোগ করা যায়”। বাংলাদেশের মেয়ে হোক
কিংবা ভারত, পাকিস্তান হোক কিংবা আমেরিকার মেয়ে – তাতে কী ফারাক
পড়ে ! নারী বাঙালি নাকি জার্মানি – তাতেই-বা কী এসে যায় ! ১০ ডলার, নাকি ১০০ ডলার – তাতেই-বা কী এসে যায় ! চিত্রটা
কি খুব বদলায়! নারী নিজেকে বিক্রি করে, নারী বিক্রিত হয়। বিনিময় ছাড়া একজন পুরুষও নারীসঙ্গ পেতে পারে না(আজকাল অবশ্য কিছু নারী নিজের গাঁটের কড়ি খরচা করে পুরুষ-সঙ্গ প্রাপ্ত হচ্ছে।)। অবচেতন মনে নারী কবেই নিজেকে পণ্য বানিয়ে ফেলেছে তা নারীরা
নিজেই জানে না। তাই নারী মানুষ হতে পারছে না। নারী পণ্য হতে পেরেছে। অজ্ঞানতায়
অথবা সজ্ঞানতায় নারী নিজেকে ‘খাদ্য’ ছাড়া কিছুই নির্মাণ করে
উঠতে পারেনি। শরীর সর্বস্বই নারীর অস্তিত্ব। তাই নারীর বেশিরভাগ কাজের জগৎ নারীর
শরীরকে ঘিরে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। প্রয়োজনে (?) নারীকে শরীর
খুলে দিতে হবে – এই শর্তে অনেক সিনেমা-সিরিয়ালে চুক্তি-সই
করতে হয়। তাই নারীকে পণ্যের মতো নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে হয়। সঙ সাজতে হয়।
নারীর রুমাল ক্ষুদ্র হয়, নারীর ছাতা ক্ষুদ্র এবং পলকা হয়,
নারীর জুতো পর্যন্ত পলকা, নারীর পোশাক ক্ষুদ্র
হতে থাকে। নারী আরও মোহময়ী হয়। যে যার সাধ্যমতো কসমেটিক ঘসে ঘসে মোহময়ী হয়ে উঠতে
চায় প্রতিদিন। নারী জানে, নারী সব জানে। সঙ সাজবার সংস্কার
থেকে নারী বেরতে পারে না, বেরতে চায় না। কে যেন বলেছিল নারীর
চাইতে পুরুষ প্রকৃতিভাবে সুন্দর। পুরুষকে সাজতে হয় না, নারীকে
সাজতে হয়। সাজতেই হয়। নারী এত রং মাখে কেন !
নারী প্রসঙ্গে দুটো কথা প্রচলন আছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। একটি
শ্রদ্ধার, নারী মায়ের জাত। আর একটি অনুকম্পার, নারী পরের
ভাগ্যে খায়। দেশভেদে তারতম্য থাকলেও পুরুষদের ধারণা দেওয়া হয় যে, তারা নারীদের ঊর্ধ্বতন এবং নারী তাদের অধঃস্তন ব্যক্তি। বিলীয়মান সামান্য
কিছু মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এই পুরুষতন্ত্র বিরাজমান হয়ে
আছে। যেখানে নারী নিজের ভাগ্যে খায় আর পুরুষ নারীর ভাগ্যে বা তার অর্জনে খায়
সেখানে কেবল পুরুষতন্ত্রের মহিমায় কোনো পুরুষ কি ঊর্ধ্বতন মর্যাদা দাবি করতে পারবে?
পুরুষ শাস্ত্রকারদের চিরন্তন অধঃস্তনতার বিধানে নারী আমৃত্যু পিতা,
স্বামী ও পুত্রের অধীন-অভিভাবকত্বে থাকবে। এমন অবস্থা শুধু হিন্দু
সমাজে নয়, পৃথিবীর প্রায় সকল পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত
ছিল। “বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য
যৌবনে।/পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম্” ।। স্ত্রীলোক বাল্যাবস্থায়
পিতার অধীনে থাকবে, যৌবনকালে পাণিগ্রহীতার অর্থাৎ স্বামীর অধীনে থাকবে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে
পুত্রদের অধীনে থাকবে। (পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ড, স্বামীর
সপিণ্ড না-থাকলে পিতার সপিণ্ড এবং পিতার সপিণ্ড না থাকলে রাজার বশে থাকবে),
কিন্তু কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলোক স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না।
(৫/১৪৮)। কেন এই প্রহরা ? কীসের প্রহরা ? নারীর, না নারীর শরীরের ? পুরুষ-কেন্দ্রিকতায়
নারীর প্রতি এই সম্পত্তি-ধারণা থেকেই হয়তো পুরুষের নারীসংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি
উদ্ভূত। অসতর্ক হলেই এ সম্পত্তি নষ্ট বা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই মনুশাস্ত্রে
উক্ত হয় : “অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্যাঃ পুরুষৈ
স্বৈর্দিবানিশম্।/বিষয়েষু চ সজ্জন্তঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে”।। স্ত্রীলোকদের আত্মীয়
পুরুষগণের (অর্থাৎ পিতা,
স্বামী, পুত্র প্রভৃতি যে সব পুরুষ
স্ত্রীলোককে রক্ষা করার অধিকারী, তাদের) উচিত হবে না,
দিন ও রাত্রির মধ্যে কোনও সময়ে স্ত্রীলোককে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন
করতে দেওয়া (অর্থাৎ স্ত্রীলোকেরা যে নিজেদের ইচ্ছামতো ধর্ম, অর্থ
ও কামে প্রবৃত্ত হবে তা হতে দেবে না)। স্ত্রীলোকেরা গান-বাজনা প্রভৃতি বিষয়ে আসক্ত
হতে থাকলে তা থেকে তাদের নিবৃত্ত করে নিজের বশে রাখতে হবে। (৯/২)।
১৮৮৪ সালে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস্ তাঁর ‘দ্য ওরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি’,
‘প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’ গ্রন্থে
বলেন, শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে যেসব সমাজ প্রতিষ্ঠিত,
যেখানে জনজাতির সবাই শ্রম দান করে এবং সব সম্পত্তি সম্প্রদায়ের
মালিকানাভুক্ত, সেখানে নারী কোনো দ্বিতীয় স্থান ভোগ করত না।
তিনি উল্লেখ করেন, ”নারীর অধঃস্তনতার অভ্যুদয় ঘটে ব্যক্তিগত
সম্পত্তির ওপর ভিত্তি করে যখন নির্দিষ্ট শ্রেণীসমাজ গড়ে ওঠে। এঙ্গেল্স্ এই মত পোষণ
করেন যে, পুরুষ প্রাধান্য কম-বেশি বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতায়
পরিলক্ষিত হয়, তা দুই লিঙ্গের মধ্যে কোনো দেহগত বৈশিষ্ট্যের
জন্য নয়, বরং কালক্রমে তা ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পুরুষের ওপর বর্তালে নারীর
অধঃস্তনতা বিকাশ লাভ করে।”
সময় বদলেছে,
সমাজ কি বদলেছে ? মানুষ আধুনিক থেকে আধুনিকতম
হচ্ছে, তবু কেন নারী দ্বিতীয় স্থানে ? কে
দায়ী ? পুরুষ জাতি ? পুরুষতন্ত্র ?
পুরুষতন্ত্রের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নারীরা আর কতদিন নারীবাদী আন্দোলন
করবেন ? নারীরা কী চাইছেন ? সমানাধিকার
? সমানাধিকার কে দেবে ? পুরুষ ?
কেন, পুরুষ কেন দেবে ? অধিকার,
স্বাধীনতা কি দেওয়ার জিনিস ? অর্জন করে নিতে
পারবেন না ? লেডিস ট্রেন, লেডিস বাস,
লেডিস টোটো, লেডিস কম্পার্টমেন্ট, মহিলা পুলিশ, মহিলা থানা, মহিলা
সিট নারীকে কোন্ সমানাধিকার দিতে পারে ! এগুলি কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়
নারীকে পিছিয়ে রাখার হারিয়ে রাখার ফসল নয় ? নারী অবলা,
নারী দুর্বল – নারীবাদীরা কী এইসব বিশেষণে
খুশি ? খুশি না-হলে স্বতন্ত্র সুযোগগুলি ভোগ করেন কেন ?
কেন প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি ? একদিকে
অধিকার চাইতে চাইতে মুখে ফেনা তুলছেন, অন্যদিকে নারীর জন্য
তৈরি করা স্পেশাল সুযোগগুলি ভোগ করছেন। স্পেশাল ? একদিকে “স্পেশাল” হয়ে থাকতে চাইবেন, উলটোদিকে
সমানাধিকার চাইবেন। কোথায় পাবেন ? পৃথিবীর প্রচুর মহিলা কত
কিছু করে ফেলেছে এবং ফেলছে। তাঁরা কোন্ “স্পেশাল” নিয়েছেন সমাজের কাছ থাকে ? পাশাপাশি জাতিগঠনে নারীকে
অংশগ্রহণ করতে হবে। সবকিছু বাবা-দাদা-স্বামী-পুরুষরা করে দেবে – এই প্রত্যাশা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সদিচ্ছাপূর্বক নিশ্চিত করতে হবে
শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ(যোগ্যতার বিচারে)। অন্যদিকে
নারী-পুরুষ সম্পর্কে পরিবর্তন আনতে হবে। নারী-পুরুষের সম্পর্ককে অধঃস্তন-মনিব
না-ভেবে একে অপরের শরিক হিসাবে গণ্য করলে নারী-পুরুষ উভয়ই উপকৃত হবে। তার জন্য
দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে নারীকে। নারীদের সমানাধিকারের দাবিতে বিয়ের আইনটার
বদলেও দাবি তুলতে হবে। বলুন ভরণপোষণর দায়িত্ব উভয়ের, কেবলই
পুরুষের নয়। খোরপোশ উভয়েরই থাকবে, একতরফা কেন ? বিয়ে মন্ত্রে কেন বর একাই দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করবে ? সমানাধিকার মানে কি শুধুই নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার অধিকার ? এ পরিবর্তনে যেমন পুরুষকে পরিবারের গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালনের ভাগিদার হতে
হবে, তেমনি নারীকেও সংসার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে।
সমানাধিকার দায়িত্ব এড়াবেন কেন ? একজন পুরুষ যদি
সংসার-স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব পালনে উদাসীন থাকে এবং তা যদি আইনত দণ্ডনীয় হয়,
নারীর ক্ষেত্রে তা নয় কেন ? কাঁধে কাঁধ
মেলাবেন কীভাবে ? অসমান কাঁধ মিলবে কেন ? নারী অধিকার প্রশ্নে বর্তমান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ডেভিড বারস্ মিয়ানের সঙ্গে আলাপচারিতায় নোম চোমস্কি
(Noam Chomsky) ) বলেন, “আপনি যদি আমার
ঠাকুরমাকে জিজ্ঞাসা করতেন তিনি নিপীড়িত কিনা, আপনি কী বলছেন
তিনি সে কথা বুঝতে পারতেন না। আপনি যদি আমার মাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তিনি জানতেন যে তিনি নিপীড়িত এবং তিনি ক্ষুব্ধ, কিন্তু
প্রকাশ্যে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেন না। তিনি আমার বাবা ও আমাকে রান্নাঘরে যেতে দিতেন
না, কারণ সেটা আমাদের কাজ ছিল না। আমাদের কাছ থেকে আশা করা
হতো লেখাপড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি অন্য সব কাজ করবেন। এখন আপনি আমার
কন্যাদের জিজ্ঞাসা করুন যে, তারা নিপীড়িত কিনা, তারা কোনো আলাপ করবে না। তারা সোজা বাড়ি থেকে আপনাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে
দেবে”। পারবেন
লাথিটা দিতে ? আমেরিকার ওই কন্যাটি আর আপনি নিজেকে এক মনে করেন?
জগতে পুরুষই রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, ধর্মে,
অধর্মে, সমাজে, সংসারে,
শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতি, বিছানাতে মহান
মস্তান হয়ে বসে আছে। এই রীতিনীতিগুলি পুরুষময় করে রাখার জন্য পুরুষেরা ভয়ংকর রকম
অ্যাকটিভ। অপরদিকে নারীগণ রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, ধর্মে, অধর্মে, সমাজে, সংসারে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতি, বিছানাতে ভয়ানকভাবে প্যাসিভ। প্যাসিভ ভূমিকায় কতটুকু পাওয়া যায় স্বাধীনতার
স্বাদ ? পুরুষ বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যুগ যুগ ধরে নারীর
মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে ত্যাগী হওয়ার মন্ত্র। নারীর ত্যাগই পুরুষের সবচেয়ে বেশি
প্রার্থনীয়। নারী তার নিজস্বতা, তার পৃথক অস্তিত্ব, তার সাধ, তার সুখ সবই সানন্দে ত্যাগ করবে আর এই
ত্যাগকেই পুরুষ তাড়িয়ে তাড়িয়ে ভোগ করবে। নারীর ত্যাগের মতো এতো সুস্বাদু আর উপাদেয়
জগতে আর কোনও খাদ্য নেই।সেই যুপকাষ্ঠে বলি দিয়েছেন “মা”
নামক একটি নারী। মহান মহান সব বক্তৃতা সংরক্ষিত হয়ে আছে মাকে ঘিরে।
পৃথিবীর সব নারীই অবশেষে “মা”। স্যাক্রিফাইসের
পরাকাষ্ঠা। নারী তথা মা রূপী স্থায়ী দাসী -- স্বামীর কাছে, সন্তানের
কাছেও।সনাতন ধর্মে উল্লেখ আছে স্ববংশবৃদ্ধিকামঃ পুত্রমেকমাসাদ্য..”। আবার সন্তান লাভের পর
নারী তাঁর রমণীমূর্তি পরিত্যাগ করে মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা করবেন। তাই
মনু সন্তান প্রসবিনী মাকে গৃহলক্ষ্মী সম্মানে অভিহিত করেছেন। তিনি মাতৃ গৌরবের কথা
বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এভাবে -- উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা।
সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে” (মনু,২/১৪৫) অর্থাৎ “দশজন উপাধ্যায় (ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা একজন আচার্যরে গৌরব অধিক, একশত আচার্যরে গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব অধিকতর; সর্বোপরি,
সহস্য পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানার্হ।” ‘‘মাতৃ
দেব ভব''৷ অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত
ঈশ্বরী৷ তাছাড়া হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় আমরা যাঁদের পেয়েছি, তাঁদের
কিন্তু আমরা মাতৃরূপেই চিনেছি৷ এ জন্য কুসন্তান বলা হলেও, কুমাতা
কখনও বলা হয় না৷ ইসলামে নবি মোহাম্মদ বলেছেন ‘মায়ের পায়ের
নীচে বেহেস্ত' পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। নারীর সব অধিকার,
সব স্বাধীনতা মায়ের রোলেই পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। মাতৃ-মাহাত্ম্যেই
নারীর স্বর্গ। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষতম। মাহাত্ম্য মহিমায় মায়েদের বন্দিদশা,
বাবারা মুক্ত।
বাংলাদেশের বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “সাম্যবাদ
সূচনালগ্ন থেকে নারীমুক্তির কথা বলে আসছে এবং সে সঙ্গে এও বলেছে যে, পুঁজিবাদী সমাজ নির্মূল না হলে নারী-অধঃস্তনতা দূর করা যাবে না। নারীবাদ ও
সাম্যবাদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও দুই মতবাদের বিশ্বধারণা দুই রকম। এ ক্ষেত্রে
মানবসমাজ লিঙ্গভেদে স্বতন্ত্র ও পৃথক, অন্য ক্ষেত্রে
পার্থক্য বৈষম্য সামাজিক শ্রেণিবন্ধতার কারণে। নারীবাদ তার আন্দোলন স্বতন্ত্র
রাখতে চায়। তার আশঙ্কা সাম্যবাদ পুরুষতন্ত্রের আর-এক রূপ”। দেশ নাকি এগোচ্ছে। কীভাবে
এগোচ্ছে ? কোথায় এগোলো ? মজবুত উন্নয়নের কথা বলি তাহলে আমাদের
সামনে উঠে আসে ‘অর্থনৈতিক সমতা’, ‘সামাজিক
সমতা’ এবং ‘পরিবেশগত সমতা’-র কথা। আর এই তিন সমতা পুরোপুরি নির্ভর করে দেশের নারী এবং পুরুষের সমান
অংশগ্রহণের উপর। দেশ যদি সত্যিই এগিয়ে থাকে তাহলে এবার প্রশ্ন করা যাক, আমাদের সমাজের নারী এবং পুরুষের কি এখনও সমান অংশীদারিত্ব রচিত হয়েছে ?
ড. স্টিভেন নামের এক অর্থনীতিবিদ মোড়ল দেশগুলির অর্থনৈতিক অচলাবস্থার
প্রশ্নে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দিকে আলোকপাত করেছেন এই । তিনি গবেষণা করে দেখিয়েছেন
যে, পুঁজিবাদী এই বিশ্ব ধাক্কা খাওয়ার অন্যতম কারণ হল
দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরুষ প্রধানের অর্থনীতির ভুলের কারণে এই ধস সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু
নারীরা ওই অর্থে ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষে অবস্থান করেনি তাই নারীদের অবস্থা আরও
খারাপ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকই হোক আর অপ্রাতিষ্ঠানিকই হোক -- সকলক্ষেত্রে নারীদের
জ্ঞানত এবং অজ্ঞানত পিছিয়ে থাকার কারণেই এইসব নানামুখী সমস্যা। ঠিক এই জায়গায়
দাঁড়িয়ে যে প্রশ্নটি উত্থিত হয়, তা হল -- আত্মনির্ভরশীল নারী
এবং নারীর স্বাধীনতা কি একই বিষয় ? উপেক্ষিত পরনির্ভরশীল
নারী কি আত্মনির্ভরশীল মর্যাদাপূর্ণ নারী উন্নীত হবেন না ? নাকি
প্রকাশ্যে রাস্তাঘাটে সিগারেট ফোকা, মদ্যপান করে রাজপথে
বেলাল্লাপনা করা, অর্ধনগ্ন হয়ে বিচরণ করা এবং মুঠোমুঠো
এমার্জেন্সি পিল গলার্ধকরণ করার নারী স্বাধীনতা ভোগ করবেন !
‘নারীর অধিকার’ বিষয়টিও পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক।
কারণ পুরুষই সেই অধিকারগুলি নারীর জন্য ঠিক করে দিচ্ছে, যে
অধিকারগুলি একবিংশ শতাব্দীর এই সন্ধিক্ষণে নারীদের দিলেও পুরুষের
ক্ষমতাতান্ত্রিকতায় কোনো ছেদ পড়বে না, উলটে নারীকে
বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যাবে। এই নারী অধিকারের অন্তর্নির্হিত মনোজাগতিক দাসত্বের
সোজাসাপটা উদাহরণ আমরা হরহামেশাই বিভিন্ন চলচ্চিত্র-বিজ্ঞাপনী চিত্রে দেখতে পাই।
নগ্ন নারীর ছড়াছড়ি। কথায় কথায় কাপড় খুলে ফেলছেন। নারী ক্রমশ নিজেকে অসম্মানিত করছে,
ঘৃণিত করছে। কিংবা বলা ভালো, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা
তার নিজের শরীরের একটি অংশ হিসাবে নারীকে গ্রহণ করছে সত্যি। কিন্তু সেই নারীকেও
অধিকারের প্রশ্নে পণ্য বানিয়ে দিচ্ছে, যাতে সেই পণ্য-নারী
পুঁজি-পুরুষের বিরুদ্ধে মাথা তুলে না-দাঁড়াতে পারে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে আদতেই ‘নারীর অধিকার’ নারীর
আত্মনির্ভরশীলতা এবং তার স্বাধীনতা অর্জনের পথে কতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে
পারে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়।
স্বাধীনতার বিষয়টি মূলত লৈঙ্গিক নয়। পুঁজি তার স্বার্থে স্বাধীনতাকে
বিভিন্ন মাত্রায় দেখায়,
যারই মুর্তরূপ নারী স্বাধীনতা কিংবা পুরুষ স্বাধীনতা। যে কারণে
মানুষের স্বাধীনতা দরকার, সেই একই কারণেই নারীরও স্বাধীনতা
দরকার। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মাত্রই নারী
স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হবেন। একজন নারীদের বন্দি করে রাখার মানে একজন মানুষকে বন্দি
করে রাখা। সর্বোপরি আত্মনির্ভরশীলতা নয়, নারী স্বাধীনতা নয়
-- মানুষ হিসাবে একজন নারীও স্বাধীন। রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োগ লাভের ব্যাপারে সব
নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো
নাগরিক রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োগ বা কর্ম লাভের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না অথবা তাঁর
প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। যে আইনের বিধান বা পরিণতি চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে
তা অন্যায্য এবং অযৌক্তিক হলে সংবিধানের লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের নারী মুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন চেয়েছিলেন
সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ নারীসমাজকে শিক্ষায়, জ্ঞানে বিজ্ঞানে আলোকিত করতে, সামাজিক উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাকে দৃঢ়তর করতে। নারীদের
নিয়ে তার সকল কর্মকাণ্ড ও সাহিত্যে সে কথার প্রতিফলন ঘটে। তিনি লিখেছেন – “আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে
কী রূপে ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খুঁড়াইয়া
কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ ও আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে।
তাহাদের জীবন আদর্শ ও লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই”। কিন্তু দুঃখের বিষয় সমস্ত
কূপমণ্ডূকতা থেকে নারী মুক্তির জন্য তার কঠোর সংগ্রামকে আজ নারী স্বাধীনতার নামে
ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে একশ্রেণির মানুষ। যারা পাশ্চাত্য ধ্যান
ধারণাকে, সংস্কৃতি, উশৃঙ্খলতা, বেপরোয়া
জীবনযাপন ও পোশাক-পরিচ্ছদকেই নারী স্বাধীনতার মানদণ্ড ধরে নিয়ে বেগম রোকেয়ার
অনবদ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিশ্রিত করে এক জগাখিচুরি অবস্থা সৃষ্টি করেছে। তাদের
সঙ্গে বেগম রোকেয়ার উদ্দেশ্য ও আদর্শের কোনো মিল নেই এবং কোনো-কোনো ক্ষেত্রে
সম্পূর্ণ বিপরীত।
ভার্জিনিয়া উলফ্ তাঁর “এ রুম অফ ওয়ান্স ওন” বলেছেন,
কেন ছেলেরা মদ্যপান করে মেয়েরা নয় ? কেন যৌন
পার্থক্যে একাংশ গৌরবান্বিত অন্য অংশ হীন ? বস্তুত দাসসমাজ
ধ্বংস হওয়াতে দাসেরা মুক্ত হয়েছে, নারীরা হয়নি। সামন্তবাদ
থেকে পুঁজিবাদের উত্তরণ ঘটলে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মানসিকতা দেখা দিল। কিন্তু নারী
যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটার পরেও
শ্রমিকশ্রেণি রাজনৈতিক মুক্তি লাভ করেছে, নারীমুক্তি অর্জিত
হয়নি। ব্যতিক্রম দু-একজন নারীর কোনো কোনো দেশে রাজনৈতিক কর্তৃত্বে আসার অর্থ হল
পুরুষতন্ত্রের রথের নারী-সারথী মাত্র।রাশিয়ায় প্রায় ১০০ বছর হল লেনিন নারীদের
সম-অধিকারের আইনগত ও সমাজগত নিশ্চয়তা সৃষ্টি করে থাকলেও আজও রাজনৈতিক নেতৃত্বে
সামরিক কর্তৃত্বে নারীর ভূমিকা প্রায় অনুপস্থিত। আমেরিকায় নারীমুক্তি আন্দোলনের
বিরাট ইতিহাস বহু অধিকার লাভকে বাস্তবায়িত করেছে। কিন্তু আজও কোনো নারী আমেরিকার
প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হতে পারেনি। সেখানকার সুপ্রিম কোর্টে আজও কোনো নারী
বিচারক পাওয়া যায়নি।
তাহলে নারীমুক্তি কীভাবে আসবে ? মার্গারেট মিউ তাঁর “সেক্স অ্যান্ড টেম্পারমেন্ট” গ্রন্থে বলেছেন,
স্ত্রী-পুরুষ বৈষম্যের সীমারেখাকে ভেঙে দিয়ে তাকে শ্রেণিগত বিরোধের
সীমারেখায় পরিবর্তিত করা প্রকৃত অগ্রসর অগ্রসর পদক্ষেপ নয়।সিমন দ্য বোভেয়ার তাঁর “সেকেন্ড সেক্স”-এ নারীমুক্তি আন্দোলনের এক অন্য দিশা
তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “পুরুষ-বিরোধিতার নারীত্ব নিয়ে আর
বিবাদের দরকার নেই। এখন প্রয়োজন পরস্পরকে বোঝা”। তাহলে কেন সমাজের অতি
ক্ষুদ্র অংশ সমস্ত রকম সুবিধাভোগকারী কিছু নারীদের ‘নারীবাদ’ ‘নারী
স্বাধীনতা’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করা ছাড়া একটা বৃহৎ অংশে
সেই বার্তা বা সেই সুসমাচার পৌঁছে দেওয়া যায়নি।
মোদ্দা কথা হল, নারীকে মুক্ত হতে হলে সমাজের
সবরকম কর্তৃত্বে নির্দ্বিধায় অংশ নিতে হবে। গভীর আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়েই আসবে
স্বাধীনতা। পৃথিবী থেকে বেশ্যাবৃত্তিকে হয় নির্মূল করতে হবে, নয় তাঁদেরকে সম্মানিত করতে হবে। সমাজের যে অংশ যৌনবৃত্তি করে সেই অংশ
কখনো সম্মানিত হতে পারে না। "নারী নরকের দ্বার" হিসাবেই ঘৃণিত হতে
থাকবে। শুধু যৌনতা নয়, মেধা এবং মননশীলতা দিয়ে সমাজের
সবাইকে আকৃষ্ট করতে হবে। দক্ষতায় অগ্রদূত এবং অপরাজেয় হতে হবে। প্রশাসনিক বিভাগ, পুলিশ, মিলিটারির মতো ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে অংশগ্রহণ করতে হবে।সেক্ষেত্রে
(কোনো ক্ষেত্রেই নয়) নারী বলে কোনোপ্রকার অতিরিক্ত সুযোগ নেওয়া চলবে না। রিজার্ভে
নয়, সরাসরি ময়দানে নেমে কাজ করতে হবে নারীদেরকে।
শুধুমাত্র মেয়ে অপরাধীদের জন্য নয়, নারী পুলিশকে কাজ করতে
হবে সকলের জন্য। কোনো অভিযানে ১০ জন পুলিশ বেরলে তার মধ্যে কম করে ৫ জন মহিলা
থাকবে। মানবজাতির অর্ধেক মস্তিষ্ক সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির ভূমিকায় প্রায়
নিষ্ক্রিয়। তাকে যদি সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করানো যায় তবে পৃথিবীতে যে পরিবর্তন
ঘটবে তা হবে মানব-ইতিহাসে যে-কোনো বিপ্লবের চাইতে বৃহৎ ঘটনা। মুক্ত দুনিয়ারআকাশের
নীচে পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে পরিপূর্ণ দুটি সত্তা – নর ও নারী। অধিকার, কর্তব্য, দায়িত্ব বিষয়ে যতদিন-না নারীদের সচেতনতা আসবে ততদিন পর্যন্ত “নারী স্বাধীনতা” শুধুমাত্র সেমিনারে আলোচনার
বিষয়বস্তু হয়েই থাকবে, প্রয়োগ হবে না – মুক্তিও আসবে না।বিপ্লব চাই, বিপ্লব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন