প্রাচীনকালে প্রায় সব প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলিতে একটি “কমন স্টোরি”
আছে। সেই কমন স্টোরিটি হল Great Flod বা
মহাপ্লাবন । সত্যিই কখনো বা কোনোদিন
মহাপ্লাবন হয়েছিল ? মহাপ্লাবন বলতে আমরা বুঝব সমগ্র পৃথিবীজুড়ে জলোচ্ছ্বাস,
জলস্ফীতি। সেই প্লাবন এমন এক প্লাবন, যে প্লাবনে এই
প্রাণময় পৃথিবীতে কিছু নির্বাচিত প্রাণীযুগল ছাড়া সমস্ত প্রাণীর লয়, মৃত্যু। প্রাণময় পৃথিবীতে একটা
যুগের সমাপ্তি।একটা
প্রাণময় পৃথিবীর ধ্বংস, আর-একটা প্রাণময় পৃথিবীর সৃষ্টি
! আমরা কি সেই নতুন পৃথিবীর বাসিন্দা ? হলিউডে
“2012” নামে একটি সিনেমা নির্মাণ হয়েছিল, যে সিনেমায়
দেখানো হয়েছে ২০২০ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে – হ্যাঁ,
মহাপ্লাবনে।তার
মানে এ পৃথিবী মহাপ্লাবনে সৃষ্টি, মহাপ্লাবনেই ধ্বংস ! সত্যিই
কি পৃথিবীতে মহাপ্লাবন হয়েছিল ? কী বলছে প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি
?
মেসোপটেমীয় পুরাণে মহাপ্লাবন : প্রাচীন
যুগে একদিন দেবতাদের মনে হল পৃথিবীকে প্লাবিত করে মনুষ্যজাতিকে ধ্বংস করে দেবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিন্তু জলের দেবতা এই সিদ্ধান্ত নলখাগড়া বনের কাছে চুপিসাড়ে ফাঁস করে দিলেন।
এদিকে এই নলখাগড়াগুলি ব্যবহার করে এক
ব্যক্তি তার কূঁড়েঘর নির্মাণ করেছিল। নলখাগড়াগুলি আবার সেই কথা বলে দিল ওই লোকটিকে। তখন লোকটি একটি বিরাট নৌকা
বানালেন এবং নিজের পরিবার পরিজনকে সবাইকে নিয়ে ওই নৌকোতে তুলল।
এইখানেই শেষ নয়, ওই ব্যক্তিটি
দক্ষ
কারিগরদের এবং বিভিন্ন জাতীয় পশু
ও পাখি সঙ্গে
নিল । নির্ধারিত দিনে কালো
মেঘে সমস্ত আকাশ ঢেকে গেল। শুরু হল প্রবল বর্ষণ,
সমস্ত
পৃথিবী জলের নীচে তলিয়ে গেল। তলিয়ে গেল পৃথিবীর
সমস্ত মানুষ, প্রাণীকুল। কেবল যারা ওই নৌকোর মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল তারাই বেঁচে গেল।
বাইবেলের মহাপ্লাবন : বাইবেলের গল্পটিতে বলা হয়েছে “পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন বলে ঈশ্বরের মনে অনুশোচনা জেগেছিল।” ঈশ্বর বললেন, “আমি যাকে সৃষ্টি
করেছি, সেই মানুষকে আমি পৃথিবীর বুক
থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেব, ধ্বংস করে দেব। মানুষ আর জন্তু-জানোয়ার এবং গাছগাছালি আর
আকাশচারী সমস্ত পাখি
– সবই পৃথিবীর
বুক থেকে হারিয়ে যাবে।” কিন্তু ব্যতিক্রম
কেবলমাত্র নোয়া নামের একজন পবিত্র এবং ন্যায়পরায়ণ ভদ্রলোক। একমাত্র এই মানুষটিকে
ঈশ্বর রেহাই দিতে মনস্থ করেন। ঈশ্বর তাঁকে আসন্ন ধ্বংসলীলা
সম্বন্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন সে যেন ৩০০ হাত
লম্বা, ৫০ হাত চওড়া এবং ৩০ হাত উঁচু
একটা বিশাল নৌকো বানান। তিনতলা উঁচু এই নৌকাটা নোয়া এবং তাঁর স্ত্রীসহ প্রাপ্তবয়স্ক
সন্তানদের পরিবারের লোককে যেমন রক্ষা করবে;
তেমনি পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণীকুলের প্রজাতিকেও রক্ষা
করবে। ওই নৌকোটায় দীর্ঘ সময়ের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা হবে
এবং ওইসব পশুপাখি-কীটপতঙ্গের
সমস্ত বর্গের প্রত্যেকটিকে একজোড়া করে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে ঈশ্বর তাকে নির্দেশ দিলেন। নির্ধারিত সময়ে পৃথিবী থেকে
সমস্ত মানুষ আর প্রাণীকুল ধ্বংস
করার পর
নোয়া এবং তাঁর পরিবার এবং তিনি যেসব প্রাণীদের বাঁচাবেন তারা নতুন করে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে এক নতুন মানবজাতি আর নতুন প্রাণীজগৎ সৃষ্টি
করবে। এখানেই শেষ নয় -- বাইবেলে আরও বলা হয়েছে -- “এবং সাত দিন বাদে দেখা গেল, বন্যার জল পৃথিবীকে ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে।
৪০ দিন
আর ৪০ রাত ধরে পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি
ঝরে পড়ল। জল বেড়েই চলল এবং নৌকোটাকে ভাসিয়ে উপরের দিকে তুলে ধরল । বিপুল পরিমাণ জল জমে উঠল
পৃথিবীর উপরে এবং সমস্ত আকাশের
নীচে যত উঁচু পাহাড় আছে, সবই জলে ঢাকা পড়ল। জল জমে পনেরো হাত উঁচু হয়ে গেল।ফলে পৃথিবীর বুকের যত প্রাণী ছিল সকলেরই মৃত্যু হল -- একমাত্র নোয়া আর নৌকোটায় যারা তার সঙ্গে ছিল তারাই বেঁচে রইল।” অতএব বাইবেলের কাহিনি
অনুযায়ী, আরও ১৫০ দিন পৃথিবী জলে ডুবে ছিল। তারপর একদিন সেই জল নেমে গেল এবং যেসব
প্রাণীকে নোয়া রক্ষা করেছেন তাদের সবাইকে নিয়ে নৌকা থেকে বেরিয়ে এলেন এবং পৃথিবীকে
ফের প্রাণীকুল সমৃদ্ধ করে তুললেন।
তৌরাত শরিফে মহাপ্লাবন : তৌরাত শরিফে মহাপ্লাবন সম্পর্কে যে গল্প পাওয়া যায়, পৃথিবীতে প্লাবন শুরু হওয়ার সময় নুহের বয়স ছিল ৬০০ বছর। প্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়ার
জন্য নুহ (হিব্রু উচ্চারণ নোয়া, এবং আরবি উচারণ নুহ) তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেরা এবং
ছেলেদের স্ত্রীরা সেই জাহাজে গিয়ে উঠলেন। নুহকে হুকুম দেওয়ার
সময় আল্লাহ যা বলেছিলেন সেইভাবে পাপী ও পবিত্র পশু, পাখি ও বুকে হাঁটা প্রাণীরা স্ত্রী-পুরুষ মিলে জোড়ায় জোড়ায় সেই জাহাজে নুহের
কাছে গিয়ে উঠল। সেই
সাতদিন পার হয়ে গেলে পর পৃথিবীতে প্লাবন হল। নুহের বয়স যখন ছয়শো বছর,
সেই
বছরের দ্বিতীয় মাসের সতেরো দিনের দিন মাটির নীচের সমস্ত জল বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল
এবং আকাশ থেকেও প্রচুর বৃষ্টি পড়তে থাকল। ৪০ দিন আর ৪০ রাত ধরে পৃথিবী জুড়ে বৃষ্টিপাত হতে থাকল
(পয়দায়েশ, ৭:৬-১২)। ৪০ দিন ধরে পৃথিবীর বুকে প্লাবনর জল বাড়তেই থাকল। ক্রমশ জল বেড়ে যাওয়াতে নুহের জাহাজটা মাটি ছেড়ে উপরের দিকে ভেসে
উঠল। পৃথিবীর জল আরও বেড়ে
গেল। যেখানে যত বড়ো পাহাড়
ছিল সব ডুবে গেল। সমস্ত
পাহাড়-পর্বত ডুবিয়ে জল আরও ১৫ হাত উপরে উঠল। মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো প্রাণী, পাখি, গৃহপালিত আর বন্য পশু, ছোটো ছোটো প্রাণী এবং সমস্ত মানুষের মৃত্যূ হল। আল্লাহ এইভাবে ভূমির পৃথিবীর বুক থেকে সমস্ত প্রাণী মুছে
ফেললেন। শুধুমাত্র নুহ এবং
তাঁর সঙ্গে যাঁরা জাহাজে ছিলেন তাঁরা ছাড়া সকলেই মারা গেলেন মহাপ্লাবনে। সমগ্র পৃথিবী ১৫০ দিন জলের নীচে
ডুবে থাকল (পয়দায়েশ, ৭:১৭-২৪)।
আল্লাহ তাদের কথা ভুলে যাননি জাহাজে নুহ এবং তাঁর
সঙ্গে যেসব গৃহপালিত ও বন্য পশু ছিল তাদের কথা। তিনি পৃথিবীর বুকের উপর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত করালেন। বাতাসের প্রবাহে জল এবার ক্রমশ কমতে লাগল। মাটির নীচ থেকে সমস্ত জল বের
হওয়া এবং আকাশের সমস্ত ফাটলগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি পড়াও থেমে গেল। প্লাবন শুরু হওয়ার ১৫০ দিন পরে দেখা গেল জল অনেকটাই কমে
গেছে। সপ্তম মাসের ১৭ দিনের
দিন জাহাজটা আরারাতের পাহাড়শ্রেণির উপরে গিয়ে আটকে থাকল। জল আরও কমে গেল। আর দশম মাসের প্রথম দিনে পাহাড়শ্রেণির চূড়া প্রকট হল
(পয়দায়েশ, ৮:১-৫)। তখন নুহ জাহাজের ছাদ খুলে ফেললেন এবং তাকিয়ে দেখলেন মাটির উপর শুকোতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় মাসের ২৭ দিনের মধ্যে
মাটি একেবারে শুকিয়ে গেল। এই সময় আল্লাহ্ নুহকে
বললেন -- “তুমি তোমার স্ত্রীকে আর তোমার
ছেলেদের ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে জাহাজ থেকে বেরিয়ে এসো, সেইসঙ্গে সমস্ত পশুপাখি এবং বুকে হাঁটা প্রাণী, অর্থাৎ যত জীবজন্তু আছে তাদের সবাইকেই বাইরে বের করে নিয়ে
এসো। আমি চাই যেন পৃথিবীতে
তাদের বংশ অনেক বেড়ে যায় এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা দ্বারা তারা সংখ্যায় বেড়ে উঠে।” নুহ তাঁর স্ত্রীকে এবং তাঁর ছেলেদের এবং তাঁদের স্ত্রীদের
নিয়ে জাহাজ থেকে বের হয়ে এলেন। নিজের
জাত অনুসারে বেরিয়ে এলো সব পশুপাখী এবং
সরীসৃপ প্রাণীসমূহ, অর্থাৎ মাটির উপরে
ঘুরে বেড়ানো সমস্ত প্রাণী (পয়দায়েশ, ৮:১৩-১৯)।
হিন্দুধর্মে মহাপ্লাবন : হিন্দুধর্মের মহাপুরাণ “মৎস্যপুরাণ” এবং “শতপথ ব্রাহ্মণ”-এ বিষ্ণুর
দশটি অবতারের মধ্যে একটি অবতার “মৎস্য”। মৎস্যাবতার আবির্ভাবের যে প্রেক্ষাপট বর্ণিত আছে, তা সংক্ষিপ্ত করে বললে যা দাঁড়ায় তা হল -- মনু হাত-পা
ধৌত করতে গিয়ে এক জলাশয়ে একটি ক্ষুদ্র মাছ দেখতে পেলেন। ক্ষুদ্র মাছটি অন্যান্য রাক্ষুসে মাছ থেকে রক্ষা করার জন্য
মনুর কাছে অনুরোধ করল। মনু
সেই মাছটিকে নিরাপদ স্থান হিসাবে জলভর্তি পাত্রে রেখে দিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল মাছটি অতি বৃহৎ হয়ে গেল যে, আর ওই ক্ষুদ্র স্থানে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।বৃহৎ মাছটিকে
রাখা যায় এমন এক বৃহৎ জলাশয়ে মনু মাছটিকে স্থানান্তরিত করলেন। সেখানেও রাখার কিছুদিন থাকল মাছটি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে
মাছটি আরও বৃহৎ হয়ে গেল।
এই জলাশয়েও মাছের স্থান সংকুলান
হচ্ছে না। মনু বাধ্য হয়ে নিয়ে গেলেন
একটি পুকুরে, এরপর প্রয়োজন
হয়ে পড়ল নদী। এরপরও মাছটি আরও বৃহৎ হয়ে গেল -- স্থান
সংকুলানের জন্য এবার সমুদ্রে নিয়ে যেতে হল। এর মধ্যে একদিন মাছটি মনুকে দ্রুত একটি বৃহৎ নৌকা বানাতে নির্দেশ দিল। কারণ সমগ্র পৃথিবীতে
মহাপ্লাবন আসবে। তাই হুঁশিয়ারি।এই মহাপ্লাবন ধেয়ে এলে
পৃথিবীর সমস্ত জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। অতএব সম্ভাব্য মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পেতে মাছের কথামতো মনু
তখন নৌকা নির্মাণের কাজ শুরু করে দিলেন।
অবশেষে পৃথিবীতে মহাপ্লাবন শুরু হল। সারা পৃথিবী জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যেতে শুরু করল। সেই মাছটি এসে তখন মনু ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ
নৌকাটি টেনে নিয়ে একটি বিরাট পাহাড়ের উপর নিয়ে গেল। মহাপ্লাবনে সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর বিনাশ হল এবং বিষ্ণুর ইচ্ছা পূর্ণ হল।
এবার
আস্তে আস্তে মহাপ্লাবনের জল বিপদসীমার নীচে ক্রমশ নামতে থাকল। প্লাবনের জল কমে গেলে পৃথিবী পুনর্নিমাণের জন্য মনু ও তার
পরিবার পাহাড় থেকে ভূমিতে নেমে এল
এবং
পুনরায় পৃথিবীতে বংশবিস্তারের মাধ্যমে মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখল। কাহিনি অনুসারে মনু দ্বিতীয় পর্যায়ে পৃথিবীতে মানবজাতির উদ্ভাবন করেন। যদিও প্রথম পর্যায়ের প্রাণীদের স্রষ্টা কে ছিলেন তা জানা যায় না, যার বিনাশ করা বিষ্ণুর উদ্দেশ্য ছিল।
কোরান শরিফে মহাপ্লাবন : কোরান শরিফে হযরত নুহের নামে আটশটি আয়াত সংবলিত একটি
সুরাই (৭১ নম্বর) আছে, এই সুরাসহ আরও বিভিন্ন
সুরার বিভিন্ন আয়াতে হজরত নুহ এবং মহাপ্লাবনের কথা বলা হয়েছে।
তবে
তৌরাত শরিফের মতো এত বিস্তারিতভাবে মহাপ্লাবন বা নুহের জাহাজের বর্ণনা বিষয়ে তথ্য
রাখা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে -- আমি নুহকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছি।
তারপর
সে তাদের বলল, “হে আমার জাতির লোকেরা, তোমরা আল্লাহতায়ালার দাসত্ব কবুল করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মালিক নেই; আমি তোমাদের উপর এক কঠিন দিনের কষ্ট-যন্ত্রণা
আশঙ্কা করছি” (সুরা আল আরাফ, ৭:৫৯)। তার
জাতির নেতারা বলল, “হে নুহ, আমরা দেখতে
পাচ্ছি তুমি এক সুস্পষ্ট গোমরাহি বা দিকভ্রান্ততে ডুবে আছ (সুরা আল আরাফ, ৭:৬০)। সে
বলল, “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা, আমার মধ্যে কোনোই গোমরাহি/দিকভ্রান্ততা নেই, আমি হলাম সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা একজন
রসুল” (সুরা আল আরাফ, ৭:৬১)। “(আমার কাজ হল) আমি আমার মালিকের বাণীসমূহ তোমাদের কাছে
পৌঁছে দেব এবং (সে মতে) তোমাদের শুভ কামনা করব, (পরকাল সম্পর্কে) আমি আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে এমন কিছু কথা জানি, যা তোমরা জানো না (সুরা আল আরাফ, ৭:৬২)। তারপর
তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল, আমি তাকে এবং তার সঙ্গে
যারা নৌকায় ছিল, তাদের সবাইকে উদ্ধার
করেছি। আর যারা আমার আজাব বা যন্ত্রণাগুলিকে মিথ্যা
বলেছে, তাদের আমি জলে ডুবিয়ে মেরেছি:
এরা ছিল গোঁড়া অন্ধ” (সুরা আল আরাফ,
৭:৬৪)। এরপর আমি তার কাছে বার্তা
পাঠালাম যে, “তুমি আমার তত্ত্বাবধানে আমারই
বার্তা অনুসারে একটি নৌকো প্রস্তুত করো। তারপর যখন আমার আদেশ আসবে এবং চুল্লি প্লাবিত হয়ে যাবে, তখন সবকিছু থেকে এক-এক জোড়া করে নৌকোয় উঠিয়ে নাও, তোমার পরিবার পরিজনদেরও উঠিয়ে নেবে, তবে তাদের মধ্যে যার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার সিদ্ধান্ত এসে
গেছে সে ছাড়া, যারা জুলুম করেছে তাদের
ব্যাপারে আমার কাছে কোনো সুপারিশ পেশ করো না,
কারণ
মহাপ্লাবনে আজ তারা নিমজ্জিত হবেই (সুরা আল মোমেনুন, ২৩:২৭)। তুমি আমারই
তত্ত্বাবধানে, আমারই বার্তার আদেশে একটি নৌকো নির্মাণ করো এবং যারা জুলুম করেছে, তাদের ব্যাপারে তুমি আমার কাছে কোনো আবেদন নিয়ে হাজির হোয়ো
না, নিশ্চয়ই তারা নিমজ্জিত হবে” (সুরা হুদ, ১১:৩৭)।
এরপর পরিকল্পনা মোতাবেক নুহ নৌকো নির্মাণে মন দিলেন। সে সময় যখনই তার জাতির নেতৃস্থানীয়
লোকেরা তার পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করত, তারা নুহকে নৌকো
নির্মাণ করতে দেখে হাসাহাসি শুরু করে দিত। সে বলল “আজ তোমরা যদি আমাদের উপহাস করো তাহলে মনে
রেখো, যেভাবে আজ তোমরা আমাদেরকে লক্ষ
করে হাসছ, একদিন আমরাও তোমাদেরকে লক্ষ করে হাসব” (সুরা হুদ, ১১:৩৮)। অবশেষে
তাদের কাছে আজাব সম্পর্কিত আমার আদেশ এসে পৌঁছোল এবং চুলো থেকে একদিন জল উথলে উঠল, আমি নুহকে বললাম,
সম্ভাব্য
প্রত্যেক জীবের পুরুষ-স্ত্রীর এইভাবে এক-একজোড়া নৌকোতে উঠিয়ে নাও, সেইসঙ্গে
উঠিয়ে নাও তোমার পরিবার-পরিজনদেরও । বাতিল করো তাদের, যাদের ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে এবং তাদেরও
নৌকোয় উঠিয়ে নাও যারা ঈমান এনেছে; মূলত তার সঙ্গে
আল্লাহর উপর খুব কম সংখ্যক মানুষই ঈমান এনেছিল” (সুরা হুদ, ১১:৪০)। সে
তার সঙ্গীদের বলল, “তোমরা এতে উঠে পড়ো, আল্লাহর নামে এর গতি ও স্থিতি নির্ধারিত হবে, নিশ্চয়ই আমার
মালিক ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু”(সুরা হুদ, ১১:৪১)। এরপর
সে নৌকা পাহাড়সম বড়ো বড়ো ঢেউয়ের মধ্যে তাদের বয়ে নিয়ে চলতে থাকল। নুহ তার ছেলেকে নৌকায় আরোহণ
করার জন্যে ডাকল, সে আগে থেকেই
দূরবর্তী এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল – “ওহে আমার পুত্র, আমাদের সঙ্গে নৌকায় ওঠে এসো, আজ এমনি এক দিনে তুমি কাফেরদের সঙ্গী হোয়ো না” (সুরা হুদ, ১১:৪২)।
প্রাচীন রোমান পৌরাণিক
কাহিনিতে মহাপ্লাবন : মানুষের শয়তানি এবং না-ফরমানি দেখে আকাশ ও আলোর দেবতা জুপিটার একদা প্রচণ্ড ক্রোধী হয়ে
পড়লেন এবং সিদ্ধান্ত
নিলেন এই জীবজগতকে ধ্বংস করে দেবেন। প্রথমদিকে তিনি ঠিক করেছিলেন পৃথিবীর
সবকিছু অগ্নিদগ্ধ করে ভস্ম করবেন। কিন্তু পরে তিনি আবার
সিদ্ধান্ত বদলালেন, ঠিক করলেন প্লাবনের জলে ডুবিয়ে ধ্বংস করবেন এ পৃথিবী, পৃথিবীর প্রাণ। সেটা করতে দেবতা নেপচুনের
সাহায্য নিলেন জুপিটার। যুদ্ধ এবং ভূমিকম্পের
দেবতা নেপচুনকে ভয়ংকর ভূমিকম্প-বজ্রপাত ঘটিয়ে তৎসহ মহাপ্লাবনের জোয়ার সৃষ্টি করতে বললেন। যেই ভাবা সেই কাজ। সেই মহাপ্লাবনের স্রোতে ভেসে যেতে লাগল সমস্ত প্রাণ তথা প্রাণী, ডুবে যেতে লাগল গোটা পৃথিবী। কিন্তু গোটা পৃথিবী
ডুবলেও, ডুবল না শুধু পারনাস্সুস পাহাড়ের চূড়া। ভয়ংকর ওই মহাপ্লাবনের সময় নৌকো নির্মাণ করে স্রোতে ভাসতে ভাসতে
পাহাড়ের ওই চূড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রমিথিউয়াস পুত্র ডিউকেলিওন এবং তার স্ত্রী
পাইহা। তাঁদের সততা, নিষ্ঠায় মুগ্ধ ঈশ্বর তাঁদেরকে আশীর্বাদ করলেন এবং পৃথিবী থেকে প্লাবনের জল নামিয়ে দিলেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত
ডিউকেলিওন ও পাইহা একদিন পাহাড়ের চূড়া থেকে মাটিতে নেমে এলেন এবং দৈববাণী অনুসারে
পৃথিবীতে পুনরায় বংশবিস্তার শুরু করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রোমান পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনি একই। সবই এক, শুধুমাত্র রোমানদের ঈশ্বর জুপিটারের বদলে হয়েছে
গ্রিসের জিউস। তাই আলাদা করে পৌরাণিক গ্রিসের মহাপ্লাবনের ঘটনা এখানে পুনরাবৃত্তি করলাম না।
পূর্ব আফ্রিকার মহাপ্লাবন : পূর্ব আফ্রিকার মাসাইদের যে মহাপ্লাবনের
কাহিনি পাওয়া যায় তা হল -- অনেককাল আগে মাসাইদের ওখানে টামবাইনোত নামে সৎ এবং নিষ্ঠাবান
এক ব্যক্তি বাস করতেন। তার
স্ত্রীর নাম নাইপান্দে এবং ওশমো, বার্তিমারো, বারমাও হল তার তিন সন্তান। হঠাৎ একদিন টামবাইনোতের ভাই লেঙ্গারনির মৃত্যু হলে স্থানীয়
প্রথা অনুযায়ী তিনি মৃত ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করলেন। মৃত ভাইয়ের ঘরেও তিন সন্তান ছিল, ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করার ফলে ওই সন্তানও
টামবাইনোতের সন্তান হয়ে যায়। অর্থাৎ
আগের ৩ সন্তানসহ মোট ৬ সন্তান হয়। জনসংখ্যার ভারে
পৃথিবী তখন কম্পমান। কিন্তু
তখন পৃথিবীতে অধিক জনসংখ্যা থাকলেও মানুষের মধ্যে ন্যায়-নিষ্ঠা-নীতি-নৈতিকতা বলতে
কিছু ছিল না। খুন, দুর্নীতি,
লুঠতরাজ ইত্যাদি অপরাধপ্রবণতায় চারিদিক ভারী গিয়েছিল। ঈশ্বর মানুষের এহেন অধঃপতন
দেখে ব্যথিত হলেন এবং ক্ষুব্ধও হলেন।
অতএব ঈশ্বর
মনস্থির করলেন এক মুহূর্তেই বিনাশ করে ফেলতে হবে এই মনুষ্য প্রজাতিকে আবার নতুন করে গড়তে হবে। অরদিকে
ঈশ্বর আবার টামবাইনোতের সততায় খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন।
অতএব তাকে
কাঠ দিয়ে একটি জাহাজ নির্মাণ করতে নির্দেশ দিলেন, যেখানে আশ্রয় নেবে টামবাইনোত, তার দুই স্ত্রী, ছয় সন্তান, ছয় সন্তানের স্ত্রী
এবং কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণী। যখন
টামবাইনোত ঈশ্বরের পরামর্শ মতো জাহাজ নির্মাণের কাজ শেষ করে ফেললেন, তখন ঈশ্বর ভয়ংকর বৃষ্টিপাতের আদেশ দিলেন। একটানা বৃষ্টিতে চারিদিকে তুমূল প্লাবন হয়ে গেল। সেই বন্যায় ডুবে যেতে লাগল
সমস্ত মানুষ, পশুপাখিসহ নানা প্রাণী। টামবাইনোতের জাহাজটি আস্তে
আস্তে প্লাবনের জলে ভেসে বেড়াতে লাগল, একস্থান থেকে অন্যস্থানে। একসময় বৃষ্টি থেমে গেল। এরপর টামবাইনোত একটি পায়রা
উড়িয়ে দিলেন আকাশে। কিছুক্ষণ
পর পায়রাটি ক্লান্ত হয়ে এল এবং টামবাইনোত বুঝতে পারলেন পায়রাটি কোথাও বসার জন্য শুকনো স্থান না-পেয়ে আবার
ফিরে এসেছে। এরপর
আরও কিছু দিন চলে গেল। এবার তিনি একদিন একটি শকুন
আকাশে উড়িয়ে কৌশলে পালকের সঙ্গে তীর আটকে দিলেন।
শকুনটি
যদি কোথাও গিয়ে বসে, তবে তীরটি যেন ওই স্থানে
ফেঁসে যায়। ওইদিন সন্ধ্যার দিকে
শকুনটি ফিরে এল।
তবে পালকের মধ্যে আর তীর আটকে ছিল না। এবার টামবাইনোত বুঝতে পারলেন শকুনটি কোনো নরম কিছুর উপর বসেছিল।
সেখানেই
এই তীরটি আটকে গেছে। আরও
কিছুদিন পর প্লাবনের জল কমে গিয়ে মাটিতে মিশে গেল এবং ওদের জাহাজটিও এক জায়গায় এসে
আটকে রইল। তখন টামবাইনোত তার
পরিবারসহ ভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে আকাশে অপূর্ব রামধনু দেখতে পেলেন। একে তারা ঈশ্বরের ক্রোধ স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত
করলেন।
আসামের মহাপ্লাবন : আসামের লুসাই আদিবাসীদের
লোকগাঁথায় মহাপ্লাবনের এক কাহিনি পাওয়া যায়।একবার জলের রাজা যিনি আবার শয়তানদেবতা নাগাইতি নামে এক অপূর্ব সুন্দরীর প্রেমে পড়ে গেলেন। শয়তানদেবতা তাঁর চিত্তহরণকারী
নারীর কাছে যখন প্রেম নিবেদন করতে গেলেন তখন কিন্তু নাগাইতি
দেবতার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকার করল এবং পালিয়ে গেল। সাধারণ এক নারীর এহেন দুঃসাহস
দেখে অপমানিত বোধ করলেন এবং ক্ষুদ্ধ হলেন।
মানবীর সঙ্গে প্রেম করতে ব্যর্থ হয়ে দেবতা
কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলেন। প্রচণ্ড
ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তিনি মানবজাতিকে ফুন-লু-বুক পাহাড়ে জল দিয়ে ঘিরে ফেললেন। হুমকি দিলেন নাগাইতিকে না-পেলে সমস্ত প্রাণীদের তিনি জলে
ডুবিয়ে মারবেন। শয়তানদেবতার
হুমকিতে ভীত হয়ে সাধারণ জনগণ আশু বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নাগাইতিকে জোর করে প্লাবনের
জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অবশেষে
দেবতার ক্রোধ কমে গেল এবং তিনি পাহাড়ের চারপাশ থেকে প্লাবনের জল কমিয়ে দিলেন।
সুমেরিয়ান মহাপ্লাবন : সুমেরিয়ান ঈশ্বর
তাঁর সৃষ্টির প্রতি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে “মনুষ্য” নামক প্রজাতিকে ধ্বংস করে দিতে মনস্থির করলেন।
কিন্তু
সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজা জিউসুদ্রের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে দেবতা এনলিল আসন্ন ভয়ানক মহাপ্লাবনের
ব্যাপারে পূর্বেই হুঁশিয়ারি দিলেন। সেইসঙ্গে পরামর্শ
দিলেন সে যে একটি বিশাল জাহাজ নির্মাণ করেন। রাজা জিউসুদ্র দেবতা এনলিলের পরামর্শ মতো জাহাজ নির্মাণের কাজ
শুরু করে দিলেন। এরপর হাজির হয়ে গেল সেই
ভয়ানক কালরাত্রি। প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসা বাতাস
আর ৭ দিন ৭ রাত ধরে অবিরত বৃষ্টিধারায় এই পৃথিবী জলের তলায় তলিয়ে গেল। প্লাবনের সময় তখন জিউসুদ্র
সদ্যনির্মিত জাহাজ জলে ভাসিয়ে দিলেন। জাহাজে
চেপে জিউসুদ্র ভেসে বেড়াতে লাগলেন একস্থান থেকে অন্যস্থানে। রাজা জিউসুদ্র তখন সূর্য উদয়ের জন্য জাহাজে বসে সূর্যদেবতা
উতুর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। যাতে সূর্যের তাপে বৃষ্টি কমে গিয়ে প্লাবনের জল কমে যায়। ধীরে ধীরে যখন দেবতাদের ক্রোধ কমে
এল, তখন প্লাবনের জলও কমতে লাগল।
অবশেষে
একসময় আকাশে সূর্যের দেখা মিলল। প্লাবনের
জল একদম কমে গেলে রাজা জিউসুদ্র জাহাজ থেকে ভূমিতে অবতীর্ণ হলেন এবং দেবতা অনু এবং এনলিলের সন্তুষ্টি বিধানের
জন্য একটি ভেড়া ও ষাঁড় বলি দিলেন।
চিনের মহাপ্লাবন : চিনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের
ললোবাসীদের কাছে একটি মহাপ্লাবনের কাহিনি জানা যায়।
স্বর্গের
পিতা সিজুসিহ একজন মৃত মানুষের রক্ত ও সামান্য মাংস নিয়ে আসার জন্য পৃথিবীতে একবার
দূত প্রেরণ করলেন। দূতটি
পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় বিভিন্ন মানুষের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হলেন।
কিন্তু দুমু নামক একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র স্বর্গের পিতার কথা রক্ষা করল। স্বর্গের পিতা কিন্তু পৃথিবীর লোকদের এহেন বেইমানি দেখে ক্রোধে ফেটে
পড়লেন। তিনি আকাশ হতে
মুষলধারায় বৃষ্টিপাত করাতে লাগলেন। ফলে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে
পৃথিবী জুড়ে প্লাবনের সৃষ্টি হল। পৃথিবীর
সমস্ত প্রাণী প্লাবনের জলে ভেসে গেল, ধ্বংস হয়ে যেতে লাগল
বাড়িঘর সম্পদ। কিন্তু
দুমু এবং তার চার ছেলে, সঙ্গে কয়েকটি বুনো হাঁস, কয়েকটি ভোঁদরসহ একটি লম্বা বড়োসড়ো গাছে আশ্রয় নিল এবং স্বর্গের পিতার করুণায়
বেঁচে গেল। আজকে যারা সুসভ্য বা
লেখাপড়া জানে, তারা দুমুর ওই চার সন্তানের
বংশধর এবং যারা অশিক্ষিত বা সভ্যতার আলো পায়নি তারা কাঠ দিয়ে নির্মিত মূর্তির
বংশধর, যেগুলিকে দুমু ভয়ংকর সেই
মহাপ্লাবনের পর মেরামত করেছিল।
পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলেই এই ধরনের প্লাবন/মহাপ্লাবনের
কাহিনি প্রচলিত আছে। কাহিনির
উপস্থাপনা স্টোরিলাইন একটু এদিক-ওদিক থাকলেও “মহাপ্লাবন”
ব্যাপারটা কিন্তু কমন (Common)। এখন প্রশ্ন হল “মহাপ্লাবন” ব্যাপারটা
কমন হল কীভাবে ? এ পৃথিবীর বুকে মহাপ্লাবনের গপ্পোটা প্রথম কে
ফেঁদেছিল ? তারপরই কি টুকলিফাই পর্ব ? তর্কের
খাতিরে যদি ধরেই নিই মহাপ্লাবন হয়েছিল, তবে তা তো নিশ্চয় বহু
যুগ আগে। সব ধর্মবেত্তাগণ একযোগে
জানল কীভাবে ? এই মহাপ্লাবনের কতটা মিথ, কতটা বিজ্ঞানভিত্তিক
? চেষ্টা করব আলোচলার মধ্য দিয়ে সত্যকে খুঁজে বের করার।
জনৈক চিন্তাশীল ব্যক্তি ইমদাদুল হক মনে করেন – “মহাপ্লাবন আপন আপন
বিশ্বাসে হকিকত আবার আপন আপন অবিশ্বাসে মিথ, বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করেও হয়তো মিথ। প্রশ্ন উঠেছে
মহাপ্লাবন ব্যাপারটি ‘কমন’ হল কীভাবে ? কে প্রথম ফেঁদেছিল এই গপ্পো এবং তারপর কি সবই
টুকলিফাই ? বিজ্ঞানকে
একপাশে সরিয়ে আস্তিকতার দৃষ্টিতে বলব না কেউ মিথ্যে বলেনি।বিশেষ করে তৌরাত শরিফ, মৎস্যপুরাণ এবং শতপথ
ব্রাহ্মণ আর কোরানের কথা প্রায় একই। তাই বলে এটা
ভাবার কোনো কারণ নেই যে ধর্মগুলি তো আলাদা এবং তারা একে অপরের ধর্মকে মিথ্যা
প্রতিপন্ন করার খেলায় মেতে আছে বলে আমরাও সত্য থেকে বিচ্যুত হব। আসলে ঈশ্বর তার
বাণীসমূহ তার দূতেদের মাধ্যমে মানুষ জাতির কাছে পাঠিয়েছেন, বিনিময়ে এই মানুষ এক-একটি
দুতকে এক-একটি ভগবান বানিয়ে নতুন নতুন ধর্ম এবং নতুন
নতুন যোজন -বিয়োজন খেলায় মেতেছিল। তাই আজ আমাদের মনে হয় সব যেন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা। ঈশ্বরের
প্রত্যেক দূতই মানুষের কল্যাণের জন্য এবং কিছু দূত সঙ্গে এনেছিলেন ঈশ্বরের পুস্তক
বা কিতাব বা ধর্মগ্রন্থ। তাই ঈশ্বরের
কিতাব বা পুস্তক বা ধর্মগ্রন্থগুলি যে একই ঘটনার বিবরণ দেবে তাতে আশ্চর্যের কিছু
নেই। অতপর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যাবে একটি পুস্তক হলেই তো হত, তাহলে কী
দরকার ছিল মানুষকে এত বিভ্রান্তের মধ্যে ফেলা। না ঈশ্বর মানুষকে কখনোই বিভ্রান্তের মধ্যে ফেলেননি। মানুষের মধ্যে একটি অংশ ঈশ্বর প্রেরিত
প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে যোজন-বিয়োজন করতে চেয়েছে এবং সফলও হয়েছে। বেদ, বাইবেল, তৌরাত, কোরান এবং আরও অনেক অজানা
কিতাব -- এগুলি সবই সেই ঈশ্বরের কিতাব, যা একটি ঈশ্বরের কাছ থেকেই এসেছে।এক-একটি কিতাবের সময়কার মানুষ
সেইসময়ে নিজের সীমিত চিন্তায় ঈশ্বরের বাণীগুলি হয় নিজস্ব লাভ বা ঠিক
"এই কথাটিও যদি থাকত তাহলে ঈশ্বর আরও প্রচার হত" বা ঈশ্বরের
"এই বাণীটি কেমন কেমন লাগে এটাকে বাদ দিলেই ভালো (নিজের কল্পনায় আর ঈশ্বরের
জ্ঞানের অভাব আছে এরকম দৃষ্টিভঙ্গিতে) কিতাবগুলি যোজন-বিয়োজন করেছে।আর তখনি আবার নতুন কোনো
দূত সত্যের আলো নিয়ে হাজির হয় এবং তাকে নিয়ে শুরু হয় নতুন একটি ধর্ম।সম্প্রদায় আর ভাষা আর ভৌগোলিক
দূরত্বেও এক-একটি দূতের আনীত মতগুলি বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তারপর হাজার মানুষের হাজার মত এবং আপন আপন চিন্তাধারা এক
ঈশ্বরের এক বাণী, যা সব দূতের মুল বক্তব্য বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। আর ধর্মগ্রন্থগুলি এতই বিকৃত হয় যা
গড়ে তুলে আজকের এই নানা ধর্ম। তবু অনেক ‘কমন’ কথা আজও
গেছে থেকে। মহাপ্লাবনের
কাহিনি তারই একটি কাহিনি। কেউ ফাঁদেনি। আস্তিকের
দৃষ্টিতে কাহিনি সত্য, তাই প্রায় সব কিতাবেই একই। শুধু ভাষাগত কারণে হয়তো নামগুলি আলাদা। ভালো করে জানলে দেখা যাবে
একটাই কাহিনি। আর কোনো
টুকলিফাই নেই, যা মৌলিক তা
মৌলিক। আমি বলছি
"আমি ভারতবাসি," এ কথাটি আমার আগে শত কোটি লোক বলেছে তাতে আমার কি ! আমি কোনো টুকলি করিনি। যুগে যুগে সেই মহাপুরুষেরা
একাত্ববাদের প্রচার করে গেছেন। আর তারা চলে যাবার পরই আমরা তাদের এক-একটি ভগবান বানিয়ে ব্যাবসায়
নেমে পড়েছি। আর বিজ্ঞানের
ভিত্তিতে এ কাহিনি কতটা সত্যি তা বিজ্ঞানীরা বলতে পারেন, বা
যারা জানেন তারা পারেন। তবে বিজ্ঞানের ওই ডাইনোসর কাহিনিটি আমার কেন জানি মনে হয় এটাও একটা
মিথ।”
শুধু আমি নই, বাইবেলীয় কাহিনির সঠিকত্ব
নিয়েই বিশ শতকের বা তার অনেক আগে থেকেই ধর্মীয় পণ্ডিতরা অনেকগুলি প্রশ্ন তুলেছেন।
কারণ বাইবেলেই নুহ কাহিনির প্রাচীনতম রূপটি পাওয়া যায়। এই কাহিনিতে বস্তুত দুটি
বিবরণ আছে, গল্পদুটির
বুননও ঘনিষ্ঠ। প্রাচীনটির একটি ইয়াহউইস্ট উৎসের (বা জে) অংশ, এটি প্রাচীন ইসরায়েলি
গোত্রের মহাকাব্য। জে ঈশ্বরকে 'ইয়াহওয়ে' নামে সম্বোধন করে, ইংরেজিতে ‘লর্ড’ হিসেবে যিনি সম্বোধিত, এটির উদ্ভব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সাল
নাগাদ।
রিচার্ড ই. ফ্রিডম্যান
পুরনো লিপিগুলিকে পুনর্নির্মাণ করেছেন, তাঁর গ্রন্থ “বাইবেলের লেখক কে?”। এই
গ্রন্থ অনুসারে জে মহাপ্লাবনের যে বিবরণ দিয়েছেন : “ইয়াহওয়ে একদিন দেখলেন
পৃথিবীর মানুষের পাপ ভয়ংকর আকার নিয়েছে। তাদের হৃদয়ে ঝোঁক পাপেরই প্রতি। আর সেই
কারণেই ইয়াহওয়ে এ পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির জন্য খুবই অনুতপ্ত হলেন।তাঁর মনও
এক্কেবারে বিষিয়ে গিয়েছিল। ইয়াহওয়ে বললেন, “যে মানুষ আমি সৃষ্টি করেছি তাকে, মানুষ থেকে শুরু করে
পশুকুল, সরীসৃপসহ
আকাশের পক্ষীসমগ্র পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলব। কারণ আমি তাদের সৃষ্টি করেছি বলে
অনুতপ্ত”। কিন্তু নুহর প্রতি ইয়াহওয়ে
তুষ্ট ছিলেন (জেনেসিস ৬ : ৫-৮) । ইয়াহওয়ে নুহকে বললেন, “তুমি আর তোমার সমগ্র পরিবার আমি কিসতিতে গ্রহণ
করেছি, কারণ এই
প্রজন্মে আমার চোখে আমি কেবল তোমাকেই সদাচারী হিসাবে পেয়েছি। এরকমই পবিত্র নিষ্পাপ
জন্তুজানোয়ারদের নারী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া সঙ্গে নাও, আর অপবিত্র পাপবিদ্ধ জানোয়ারদের থেকে নাও দুই
জোড়া, আর আকাশের পাখিদের থেকে
নাও সাত জোড়া, যাতে তারা
পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে পারে। কারণ আর সাতদিনের থেকে আমি ৪০ দিন ৪০ রাত ধরে
বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করব, আর আমি পৃথিবীর বুক থেকে যা কিছু সৃষ্টি করেছি তা মুছে ফেলব”। অবশেষে নুহ ইয়াহওয়ের নির্দেশ অনুসারে সমস্ত কাজ সম্পন্ন
করলেন( জেনেসিস ৭ : ৭) । নুহ ও তার পুত্ররা এবং তার স্ত্রী ও তার পুত্রবধূরা
মহাপ্লাবনের জল আসার আগেই কিস্তিতে উঠে পড়ল(জেনেসিস ৭-৭)। আর সাতদিন পর পৃথিবীতে
মহাপ্লাবন শুরু হল(জেনেসিস ৭ : ১০) । ৪০ দিন ও ৪০ রাত ধরে পৃথিবীতে বৃষ্টি ঝরতে
থাকল। (জেনেসিস ৭ : ১২) ৪০ দিন আর ৪০ রাত ধরে প্লাবন চলতে থাকল, পৃথিবীতে প্লাবনের জল
বহুগুণ বৃদ্ধি পেল, আর কিসতিটা জলের উপর ভাসতে থাকল। পৃথিবীর উপর প্লাবনের জল ক্রমাগত বেড়েই
চলল। তারা সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ও ডুবিয়ে দিল। পাহাড়গুলি ডুবিয়ে দিয়ে প্লাবনের জল আরও
১৫ হাত উপরে উঠে গেল(জেনেসিস ৭ : ১৬-২০) ।যা কিছু নাসিকা দ্বারা নিঃশ্বাস নিয়ে
বাঁচে, যা কিছু শুকনো
জমিতে থাকে সকলেরই মৃত্যু হল। ঈশ্বর ইয়াহওয়ে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেললেন সমস্ত
প্রাণী। শুধু নুহ আর তার সঙ্গে যারা ছিল সবাই বেঁচে গেল (জেনেসিস ৭ : ২২-২৩) ।
বৃষ্টি পড়া বন্ধ করা হল এবং পৃথিবী থেকে সমস্ত জল ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকল
(জেনেসিস ৮:২-৩) । ৪০ দিন শেষে নুহ তার নির্মিত কিসতির জানালা খুলে দিলেন (জেনেসিস
৮ : ৬) । তিনি পৃথিবীতে জল কমে গেছে কি না দেখার জন্য একটি পায়রাকে কিসতির বাইরে পাঠালেন।
পায়রাটি পা রাখার মতো কোনো ভূমি পৃথিবীতে না-পেয়ে কিসতিতে তার কাছে ফিরে গেল। কারণ
পৃথিবী তখনও জলে প্লাবিত ছিল। তিনি তার হাত প্রসারিত করে সেটিকে আবার কিসতির ভিতর নিলেন। নুহ আরও
৭ দিন অপেক্ষা করলেন। তিনি আরও একটি পায়রাকে কিসতির বাইরে পাঠালেন। সন্ধ্যার সময়ে
পায়রাটি নুহের কাছে ফিরে এলো, আর তার চঞ্চুতে ছিল একটি ছেঁড়া জলপাই পাতা। নুহ বুঝতে
সমর্থ্য হলেন পৃথিবীতে জল কমে গেছে। তিনি আরও ৭ দিন অপেক্ষা করলেন এবং আরও একটি
পায়রাকে কিসতির বাইরে পাঠালেন। আর এটা কখনোই পায়রাটি নুহের কাছে ফেরত
আসেনি (জেনেসিস ৮ : ৮-১২) । নুহ কিসতির ঢাকনা খুলে দেখলেন পৃথিবী থেকে প্লাবনের জল
সব শুকিয়ে গেছে। (জেনেসিস ৮ : ১৩) । নুহ ইয়াহওয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটা বেদি
নির্মাণ করলেন।এবং তিনি প্রতিটি পবিত্র পশু ও পবিত্র পাখিদের থেকে কয়েকটিকে
বেছে নিলেন এবং তাদেরকে সেই বেদিতে কোরবানি দিলেন। ইয়াহওয়ে মনে মনে বললেন, “আর কখনো আমি মানুষের কারণে
ভূমিকে অভিশপ্ত করব না, কারণ মানুষের মতি তো প্রথম থেকেই অশুভের দিকেই, আর যেমনটা আমি করেছি, সেটাতে সকল প্রাণীকে আঘাত
করব না। পৃথিবীর বাকি দিনগুলোতে শস্য বোনা আর ফসল তোলা, তাপ আর শৈত্য, গ্রীষ্মকাল আর শীতকাল, দিবা আর রাত্রি কখনো
ব্যাহত হবে না”
(জেনেসিস
৮ : ২০-২২)।
সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ
শতকে ব্যাবিলনে ইজরায়েলিদের নির্বাসনের সময় নাগাদ রচিত। কাজেই নুহের কাহিনির
উৎপত্তি বিষয়ক যে-কোনো পর্যালোচানায় বাইবেলের জে উৎসটিই প্রাসঙ্গিক। কোনো কোনো
পণ্ডিতগণ মনে করেন, এই উৎপত্তিটি বাইবেলীয় নয়, বরং মেসোপটেমীয় বলেই অনুমিত হয়। প্রায় সকলেই নুহের
কাহিনির সঙ্গে পরিচিত হলেও খুব কম মানুষই এ বিষয়ে সচেতন যে প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য
থেকে আমাদের পর্যন্ত টিকে থাকা পৃথিবী প্লাবিত হওয়ার এটিই একমাত্র কাহিনি নয়। তবে
মহাপ্লাবনের গপ্পোটি খুবই প্রাচীন এবং বেশ কয়েকটি মেসোপটেমীয় সংস্কৃতিতে তা
বর্তমান। এই গল্পেরই দুটো প্রাচীনতর কথন এখনও টিকে আছে -- একটি হল নুহের
ব্যাবিলনীয় সংস্করণ রূপ উটনাপিসটিমের গপ্পো। উটনাপিসটিমের গপ্পোটি আবার বর্ণিত আছে
‘গিলগামেসের
মহাকাব্য’-এ।‘আটরাহাসিস’ নামের আর-একটি বিকল্প
মহাপ্লাবনের গপ্পো টিকে আছে।আটরাহাসিস-এর লিপিফলকগুলোর বয়স নির্ণীত হয়েছে ১৭০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ, যে কোন বাইবেলীয় ভাষ্যের চেয়ে যা প্রাচীনতর। প্রাচীন গ্রন্থভেদে এই নোয়া বা
নুহই কখনো ‘উটনাপিসটিম’, কখনো ‘আটরাহাসিস’, কখনো ‘দুমু’, কখনো ‘মনু’, কখনো-বা ‘জিউসুদ্র’।
মহাপ্লাবনের পর নুহ ৩৫০
বছর আয়ু পেয়েছিলেন। নুহের প্রতিটি দিন ছিল ৯৫০ বছরের সমান।আমরা নুহের গপ্পোর সঙ্গে
তুলনীয় যে প্রাচীনতর ব্যাবিলনীয় গপ্পোগুলি পেলাম তা এই সত্য নির্দেশ করে যে, বাইবেলীয় গপ্পোটি
কেবলমাত্র ক্রুদ্ধ দেবতাগণ কর্তৃক পৃথিবী প্লাবিত করার অপেক্ষাকৃত প্রাচীন পৌরাণিক
গাথারই একটি আঞ্চলিক হিব্রু সংস্করণ। বাইবেলে নৈতিকতাতাড়িত একক উপাস্য ইয়াওয়ে
কর্তৃক ব্যাবিলনীয় নৈতিকতা-অসাপেক্ষ দেবকুল কেবল প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এভাবে এটা
দৃশ্যমান হয় যে,
নোয়া
বা নুহের গপ্পো ইতিহাস নয়, স্রেফ পৌরাণিক মায় কল্পিত গপ্পো।
বাইবেলীয় মহাপ্লাবনের
গপ্পো যদি মহাপ্লাবন সম্পর্কিত মেসোপটেমীয় কিংবদন্তীরই পুনর্কথন হয়, তবে নুহের কোরানীয় বিবরণের
কি ঘটে ? এর উত্তর
দেওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন নুহের কোরানীয় বিবরণ অনুধাবন করা। নুহের মহাপ্লাবনের
কোরানীয় ও বাইবেলীয় সংস্করণ খুঁটিনাটি বর্ণনা ও উদ্দেশ্যর দিক থেকে বৈসাদৃশ্য
থাকলেও, একই সময়ে কোরান
নুহের আয়ুষ্কাল প্রসঙ্গে একই সংখ্যাগত বিবরণ দিয়ে বাইবেলীয় সংস্করণের সঙ্গে তার
সাধারণ মিলগুলির উপরও গুরুত্ব দিয়েছে – “বস্তুত, আমরা নুহকে তার জনগোষ্ঠীর নিকট প্রেরণ করি, আর সে ৫০ কম ১০০০ বছর ধরে
তাদের মাঝে অবস্থান করে; কাজেই মহাপ্লাবন তাদের গ্রাস করল, যেহেতু তারা পাপী ছিল।” (কোরান ২৯:১৪)
নোয়া বা নুহের সত্যি
কাহিনি কোনটি সে প্রশ্ন বারবার উঠেছে। আসলে এই প্রশ্নটিই ভ্রমাত্মক। আমরা যে
প্লাবনের গপ্পোগুলি পাঠ করলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে সনাতন এবং সবচেয়ে ‘খাঁটি’ মহাপ্লাবনের গপ্পোটি হল
গিলগামেসেরটি। যেটি শুধু বহুত্ববাদীই নয়, বরং এই অর্থে অনৈতিকও যে ব্যাবিলনের ঈশ্বররা বাইবেল বা
কোরানে যে নৈতিক কারণগুলি দেখানো হয়েছে, কোনোরকম হেতু ছাড়াই মানবজাতিকে ধ্বংস করে ফেলার
সিদ্ধান্ত নেন ঈশ্বর। গিলগামেসের গল্পটি এই অর্থে পুরোপুরি অনৈতিক বলে মুসলিম বা
ইহুদি এবং খ্রিস্টান প্রেক্ষিত থেকে এটা ধর্মীয় সত্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না।
সে ক্ষেত্রে পরবর্তীকালের বাইবেলীয় ও কোরানীয় মহাপ্লাবনের গপ্পোগুলি। আর নিরপেক্ষ
দৃষ্টিতে এ গপ্পোগুলি গিলগামেসের পরবর্তীকালের বলে তা ঐতিহাসিক সত্য হিসাবে
বিবেচিত হতে পারে না। বাকি রইল কেবল নুহের প্লাবনের কোরানীয় সংস্করণ, যেটিকে ইসলামী প্রেক্ষিত
থেকে ঐতিহাসিক সত্য নয়, কেবল ধর্মীয় সত্য হিসেবে দাবি করা যেতে পারে। অনেকে মনে করেন এটি একটি
ইসলামী পুরাণ। বস্তুত নুহের গপ্পোকে পৌরাণিক হিসাবে মূল্যায়ন করাটা এই সত্য থেকে
আরও সমর্থিত হয় যে, কোরানে মহাপ্লাবনের গপ্পোটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নুহের অপেক্ষা হজরত
মোহাম্মদের পয়গম্বরী-জীবনের সঙ্গেই সর্বাধিক সম্পর্কিত বলেই প্রকটিত হয়। এটি
ঐতিহাসিক সত্যতার প্রশ্নটিকেই একপাশে সরিয়ে দিয়েছে। কারণ প্রথম পর্যায়ের মুসলমান
সম্প্রদায়ের জন্য নৈতিক সমর্থন প্রদানই কোরানীয় কাহিনিটির উদ্দেশ্য। উল্লেখিত
আয়াতটি বিবেচনা করে দেখতে পারি --“আর আপনার সঙ্গে অতীতের যে পয়গম্বরদের ইতিহাস সম্পর্কিত
করা হয়, তার উদ্দেশ্য
আপনার মনোবল বৃদ্ধি করা। এর মাধ্যমে আপনার প্রতি সত্য এবং হুঁশিয়ারি অবতীর্ণ হয়েছে, আর সত্যবাদীর জন্য রয়েছে
তাগিদ।”(কোরান ১১ :
১২২)
পৌরাণিক কাহিনি হিসেবে
মহাপ্লাবনের গল্পটি মুসলিম সম্প্রদায়টির প্রতি সরাসরি প্রযোজ্য হওয়ার নমনীয়তা
অর্জন করেছে। আর এভাবেই এটা ইতিহাসের অপেক্ষা সর্বাধিক কার্যকর। রক্ষণশীলরা এই
সিদ্ধান্তে আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন, কারণ তাঁরা সবকালেই ঘোষণা করেন যে, কোরানের কাহিনিগুলির
ঐতিহাসিক সত্যতা সুনিশ্চিত। সে ঘোষণা রক্ষণশীলরা করতেই পারেন, মুক্তমনের চিন্তা সকলেরই
থাকা উচিত।কারণ বিশ্বাস যার যেমন, যুক্তি একটাই হয়। যদিও আমি মনে করি, ধর্মীয় দিক থেকে কোরানের
গল্পগুলির নৈতিকভাবে সত্য কি না তা দিয়েই বিবেচিত হওয়া উচিত, ঐতিহাসিক সত্যতা দিয়ে নয়।
ঐতিহাসিক সত্যতার নির্ধারণের বিষয়টি ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের জন্যই রেখে দেওয়া উচিত, যেমন বৈজ্ঞানিক সত্যতা
খোঁজা উচিত বৈজ্ঞনিক অনুসন্ধানে, দুই মলাটের মাঝে নয়। কারণ ইতিহাস কার্যত সামাজিক বিজ্ঞান
হিসাবেই নিজেকে দাবি করে।ঐশী বাণীর কাজ ইতিহাসের সত্য উপস্থাপন নয়, তার কাজ স্বতন্ত্র -- সেটা
হল যে সুনীতিগুলি নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি, সেগুলিকে রূপদান করে যে কাহিনি সেগুলি প্রদান করা।
কোথায় যেন পড়েছিলাম। কে
লিখেছেন তাও মনে নেই। সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। পাঠকদের জন্য শেয়ার করলাম : “In 1959, stereo photos
where taken by a Turkish airline pilot of a boat shaped object on the mountains
of Ararat for The Geodetic Institute of Turkey. Dr. Brandenburger of Ohio State
University, USA, after studying the photographs concluded, "I have no
doubt at all, that this object is a ship. In my entire career, I have never
seen an object like this on a stereo photograph. An American team ran a day and
a half expedition to the site, hardly enough time to carry out any scientific
testing. They blew a hole in the side of the structure with dynamite, although
some timber shaped stones were revealed, their conclusion was, "Nothing of
any archaeological interest". If this object was Noah's Ark, it would be
approximately 4400 years old so the wood would have petrified. So finding
timber shaped stone was encouraging evidence. However, because the material had
no growth rings, the team decided it could not be wood. But does this really
prove true ? After seeing an article published in LIFE magazine covering the
expedition, Ron Wyatt an amateur archaeologist, visited the site in 1977. His
interest was aroused and he decided the structure deserved further
investigation as to whether this could be Noah's Ark. It lay 6,300 feet above
sea level, much too high to be the remains of a boat from a local flood. It is
over 200 miles from the nearest sea. In 1991, Greg Brewer, found a petrified
antler in the side of the ark. As a result of a core drilling Ron found extinct
rodent hair, petrified animal droppings and red human hair.”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌরাণিক
মহাপ্লাবনগুলি সম্বন্ধে লিখেছেন, “বাইবেল-কথিত মহাপ্লাবনের বিবরণ সকলেই বিদিত আছেন।
এবারকার পত্রিকায় বিখ্যাত বিজ্ঞান-অধ্যাপক হক্স্লি তাহার অসম্ভাব্যতা প্রমাণ
করিয়াছেন। আমাদের দেশে প্রাচীন ধর্ম যে যে স্থানে জীর্ণ হইয়া ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম
হইয়াছে নব্য পণ্ডিতেরা সেইখানে বিজ্ঞানের "ঠেকো' দিয়া তাহাকে অটল বলিয়া
প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছেন। ইংলন্ডে সেইরূপ বিচিত্র কৌশলে বিজ্ঞানকে
শাস্ত্রোদ্ধারের কার্যে নিযুক্ত করার প্রয়াস চলিতেছে। কিন্তু সত্যের দ্বারা ভ্রমকে
বজায় রাখা অসাধারণ বুদ্ধিকৌশলেও সুসিদ্ধ হয় না। যখনই দেখা যায় সরল বিশ্বাসের
স্থানে কুটিল ভাষ্যের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে তখনই জানা যায় শাস্ত্রের স্বাভাবিক
মৃত্যুকাল উপস্থিত হইয়াছে। ইতিহাসে শুনা যায় প্রাচীন গ্রীক ধর্মশাস্ত্র মরিবার
প্রাক্কালে নানা প্রকার রূপক ব্যাখার ছলে আপনার সার্থকতা প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তৈল না থাকিলে কেবল
দীর্ঘ বর্তিকায় প্রদীপ জ্বলে না; কালক্রমে বিশ্বাস যখন হ্রাস হইয়াছে তখন বড়ো বড়ো
ব্যাখ্যাকৌশল সূক্ষ্ম শির তুলিয়া অন্ধকারকে আলো করিতে পারে না।”
মহাপ্লাবনের এই কাহিনি থেকে জটিল দুটি প্রশ্ন
উঠছে । প্রশ্ন দুটি হল -- (১) সবচেয়ে
উঁচু পাহাড়-পর্বতের চাইতেও উঁচু হয়ে জলস্তর জমে সম্পূর্ণ পৃথিবীকে মুড়ে ফেলার মতো
বৃষ্টিপাত হতে পারে কি ? এবং (২)
পৃথিবীতে যত বর্গের প্রাণী আছে, নোয়ার নৌকোয় তাদের
প্রত্যেকটির একজোড়ার স্থান সংকুলান হতে পারে কি ? দুটি প্রশ্নেরই গাণিতিক সমাধান করা যেতে পারে।
পৃথিবীর পরিধি হচ্ছে ৭,৯২৬ মাইল বা
১২,৭৫৬ কিলোমিটার। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ হচ্ছে প্রায় ৬,৩৭০ কিলোমিটার। তাহলে পৃথিবীর আয়তন হচ্ছে
প্রায় ১,০৮০ বিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার বা প্রায় ১,০৮২,৬৯৬,৯৩২,০০০ কিউবিক কিলোমিটার। এই বিশাল আয়তনের পৃথিবীকে
ডুবিয়ে দেওয়ার মতো মহাপ্লাবনের এত জল এল কোথা থেকে ? স্বভাবতই সকলেই বলবেন বায়ুমণ্ডল
বা মেঘমালা থেকে, আকাশ থেকে আকাশবন্যা হয়ে। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আকাশবন্যা ! তারপরে এত বিপুল
জলরাশি গেল কোথায় ? গোটা পৃথিবীব্যাপী একটা জলসমুদ্রকে মাটি
কিছুতেই শুষে নিতে পারে না। অন্য কোনোভাবেও সেই লক্ষ লক্ষ গ্যালন
জল অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। একমাত্র আবহমণ্ডলেই ওই মহাপ্লাবনের সমস্ত জলটার এখন
আবহমণ্ডলেই থাকা উচিত। সুতরাং, আবহমণ্ডলের সমস্ত বাষ্প যদি
জলবিন্দুতে ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর উপরে ঝরে পড়ত, তাহলে সবচেয়ে উঁচু
পাহাড়গুলিকে ঢেকে দিয়ে আর-একটি মহাপ্লাবন হতে পারত।
হতে পারে কি ? দেখা যাক। যাঁদের আবহবিজ্ঞানের ধারণা আছে তাঁরা নিশ্চয় অবগত থাকবেন আবহমণ্ডলের
আর্দ্রতা আছে কতখানি। প্রতি বর্গমিটারের
উপরে বায়ুর যে স্তম্ভ রয়েছে, সেটা বায়ুস্তম্ভের মধ্যে গড়ে ১৬ কিলোগ্রাম বাষ্প আছে। কোনোক্ষেত্রেই সেটা ২০
কিলোগ্রামের বেশি নয়, কখনোই নয়। এই সমস্ত বাষ্প যদি ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর বুকে এসে পড়ত। তাহলে ওই বৃষ্টির জলের গভীরতা
কতটা হত ? একটা অঙ্ক কষে দেখা যাক। ২৫ কিলোগ্রাম, অর্থাৎ ২৫,০০০ গ্রাম
জল ঘন মানের দিক থেকে ২৫,০০০ ঘনসেন্টিমিটার জলের সমান। এটাই
দাঁড়াত এক বর্গমিটার, অর্থাৎ ১০০ X ১০০ = ১০,০০০ বর্গসেন্টিমিটার, ক্ষেত্রফলের উপরে জমে ওঠা জলস্তম্ভের ঘনমান। এই ঘনমানকে ভূমির ক্ষেত্রফল
দিয়ে ভাগ করে আমরা জলস্তরের ঘনমান। এই ঘনমানকে ভূমির ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ করে আমরা
জলস্তরটির যে গভীরতা পাই -- ২৫,০০০: ১০,০০০ = ২.৫ সেন্টিমিটার। বন্যার জল ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঁচুতে উঠতেই পারে না।
কারণ আবহমণ্ডলে এর চেয়ে বেশি জল নেই। তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই এই উচ্চতাও সম্ভব। তাহলে মাটি একটুও জল শোষণ করত না – যেটাকে কষ্টকল্পনা
ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। প্রাচীন গ্রন্থগুলি বর্ণিত
মহাপ্লাবন যদি সত্যিই হত, তাহলেও বন্যার জল ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঁচুতে উঠতে পারে
না। সেক্ষেত্রে ৮,৮৮৪ মিটার উঁচু এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গে
পৌঁছোনো তো দূরস্ত। বন্যার জলস্তরের উচ্চতাটাকে
বাড়িয়ে তুলেছে মাত্র ৩,৬০,০০০ গুণ। যদি কোনো প্লাবনও হত তাহলেও
সেটা বাস্তবে সম্ভব হতে পারে না। সেটা হত শুধু ঝিরঝির বৃষ্টি। কারণ, ৪০ দিন ধরে
একটানা বৃষ্টির ফলে অধ:ক্ষেপণ হত মাত্র ২৫ মিলিমিটার। অর্থাৎ দিনে ০.৫ মিলিমিটারেরও কম। শরৎকালের ঝিরঝির বৃষ্টি
যদি সারাদিন ধরেও চলে, তাহলে তার ফলে এর ২০ গুণ বৃষ্টিপাত হতে পারে। যদি তা না হয়, তবে সমগ্র পৃথিবীর
বিপুল জলরাশি পাম্প করে অন্য কোনো গ্রহে ঈশ্বর পাঠিয়ে দিয়েছে ? মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এই বিপুল জলরাশি তো দূরের কথা এক গ্লাস আছে এমন গ্রহের সন্ধান
তো দিতে পারেনি। অন্ততপক্ষে আমাদের সৌরমণ্ডলের
কোনো গ্রহেই জল পাওয়া যায়নি।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে। প্রশ্নটা পৃথিবীতে যত বর্গের
প্রাণী আছে, নোয়ার নৌকোয় তাদের প্রত্যেকটির একজোড়ার স্থান সংকুলান হতে পারে কি না
? নৌকোটিতে কতটুকু জায়গা ছিল ? বাইবেলের গল্প
অনুয়ায়ী, নৌকোটি ছিল তিনতলা উঁচু। প্রতিটি তলা ৩০০ হাত লম্বা
এবং ৫০ হাত চওড়া। পশ্চিম এশিয়ায় প্রাচীন জাতিগুলির কাছে এক হাত লম্বা মাপটা ছিল ৪৫
সেন্টিমিটার বা ০.৪৫ মিটারের খুব কাছাকাছি। মেট্রিক পদ্ধতিতে পরিবর্তিত করে নিলে প্রত্যেকটি
তলা ছিল – ৩০০ X ০.৪৫ = ১৩৫ মিটার লম্বা এবং ৫০
X ০.৪৫ = ২২.৫ মিটার চওড়া। সুতরাং
প্রত্যেকটি তলার ক্ষেত্রফল ছিল -- ১৩৫ X ২২.৫ = ৩,০৪০ বর্গমিটার (পূর্ণ সংখ্যায়)। এবং এই তিনটি তলার সবগুলিতে
মোট বাসযোগ্য ছিল (৩,০৪০ X ৩) ৯১২০ বর্গমিটার। হিসাব করুন তো,
শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী জন্তুদের পক্ষেই কি এই জায়গাটুকু যথেষ্ট হয়
? পৃথিবীতে প্রায় ৩,৫০০ রকমের বিভিন্ন
স্তন্যপায়ী জন্তু আছে। তদুপরি নোয়াকে শুধু
১৫০ দিন চালানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যের সংস্থানও করতে হয়েছে। তা ছাড়া একথাও ভুললে
চলবে না যে, শিকার ধরে যেসব প্রাণীরা জীবনযাপন করে তাদের শুধু নিজেদের জন্যেই নয়,
তাদের ওইসব শিকারযোগ্য জন্তুদের থাকার জায়গা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে শিকারযোগ্য
জন্তুদের জন্যে খাদ্য সংগ্রহ করে রাখার মতো জায়গাও প্রয়োজন। ওই নৌকোয় একজোড়া করে
প্রত্যেকটি স্তন্যপায়ী জন্তুর জন্যে ৯,১২০ : ৩,৫০০ = ২.৬ বর্গমিটার
জায়গা ছিল। এই তথ্যটি যদি আমরা বিবেচনার মধ্যে ধরি যে, নোয়া
এবং তাঁর বিরাট পরিবারের জন্যেও কিছুটা বাসযোগ্য স্থান প্রয়োজন ছিল এবং খাঁচাগুলির
মধ্যে কিছুটা ফাঁক রাখারও প্রয়োজন ছিল। শুধু স্তন্যপায়ী প্রাণীই নয়, নোয়াকে অন্য বহু প্রাণীকেও নিতে হয়েছে। এরা হয়তো স্তন্যপায়ীদের মতো অতো
বড়ো নয়, কিন্তু তাদের বৈচিত্র্য বিভিন্নতা অনেক অনেক বেশি।
সেই ছবিটা কেমন ? একবার চোখ বোলানো যাক -- পতঙ্গ ৩ লক্ষ ৬০ হাজার, মাকড়সা ১৬ হাজার, পাখি ১৩ হাজার, সরীসৃপ ৩ হাজার পাঁচশো, উভচর ১ হাজার চারশো। (“Mathematics Can Be Fun”)
হিসাবে দেখা যাচ্ছে স্তন্যপায়ী জন্তুদেরই যদি স্থানাভাব ঘটে থাকে, তাহলে অন্য প্রাণীদের জন্যে থাকবার জায়গা কোথায় ? পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকুলের একজোড়া করে প্রতিনিধিকে স্থান দেওয়ার জন্যে নৌকোটা বাস্তবিকপক্ষে (বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী) ছিল একটি বিশাল ভাসমান আধার। এবং সেটি ভৌতবিজ্ঞানের নিয়মে ভাসমান অবস্থায় ২০,০০০ টন জলকে স্থানচ্যুত করেছিল। সেই প্রাচীনকালে যখন জাহাজ তৈরির কৃৎকৌশল ছিল নিতান্তই শৈশবস্থায়, তখন এহেন বিরাট আকারের জলযান তৈরির কলাকৌশল লোকের জানা ছিল ? এটা খুবই অবিশ্বাস্য নয় কি ! কিন্তু বিশালাকার হলেও বাইবেল-নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করার মতো এমন একটা বিশালাকার জাহাজ সেটা ছিল না। তাহলে তো পাঁচ মাসের মতো যথেষ্ট খাদ্যসামগ্রীসহ একটা গোটা চিড়িয়াখানার আয়োজন করতে হয় !
হিসাবে দেখা যাচ্ছে স্তন্যপায়ী জন্তুদেরই যদি স্থানাভাব ঘটে থাকে, তাহলে অন্য প্রাণীদের জন্যে থাকবার জায়গা কোথায় ? পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকুলের একজোড়া করে প্রতিনিধিকে স্থান দেওয়ার জন্যে নৌকোটা বাস্তবিকপক্ষে (বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী) ছিল একটি বিশাল ভাসমান আধার। এবং সেটি ভৌতবিজ্ঞানের নিয়মে ভাসমান অবস্থায় ২০,০০০ টন জলকে স্থানচ্যুত করেছিল। সেই প্রাচীনকালে যখন জাহাজ তৈরির কৃৎকৌশল ছিল নিতান্তই শৈশবস্থায়, তখন এহেন বিরাট আকারের জলযান তৈরির কলাকৌশল লোকের জানা ছিল ? এটা খুবই অবিশ্বাস্য নয় কি ! কিন্তু বিশালাকার হলেও বাইবেল-নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করার মতো এমন একটা বিশালাকার জাহাজ সেটা ছিল না। তাহলে তো পাঁচ মাসের মতো যথেষ্ট খাদ্যসামগ্রীসহ একটা গোটা চিড়িয়াখানার আয়োজন করতে হয় !
অতএব অঙ্কের নিয়মে বাইবেলের মহাপ্লাবনের কাহিনিটি
সত্য নয় বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। বাস্তবিকপক্ষে স্থানীয় বন্যার ঘটনাকে উর্বর
কল্পনাপ্রসূত বলা যায়। অতিকথন । অনেক জায়গাতেই কখনো-কখনো বৃষ্টিপাত ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি হতেই
পারে। কিন্তু সেইসব ক্ষেত্রে
সেটা শুধু নির্দিষ্ট এলাকার উপরের আবহমণ্ডল থেকেই সরাসরি আসবে না, আশপাশের
জায়গার আবহমণ্ডল থেকেও বায়ুস্রোতের দ্বারা বাহিত হয়ে আছে। বাইবেলের মহাপ্লাবন
অনুসারে মহাপ্লাবন পৃথিবীর সমগ্র উপরিতলকে যুগপৎ প্লাবিত করে দিয়েছিল এবং
সেইজন্যেই একটা কোনো জায়গা অন্য জায়গা থেকে আর্দ্রতা “ধার করে”
আনতে পারে না। স্থানীয় বন্যা বা প্লাবনকে অস্বীকার করছি না। বরং আমরা মনে করি সেটি হবার
সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, প্রাচীনকালের
সকল সভ্যতাই নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে। যেমন নিলনদের তীরে মিশরের সভ্যতা, সিন্ধুনদের
তীরে সিন্ধুসভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর তীরে
ব্যবিলনের সভ্যতা ইত্যাদি। নদীকেন্দ্রিক
সভ্যতা তৈরি হলে সহজেই অনুমান করা যায় স্থানীয়ভাবে বন্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি
বিষয়। ১৯৭৮ সালের পশ্চিমবঙ্গের
বিধ্বংসী বন্যা বা প্লাবনের ঘটনা কেউ নিশ্চয় ভুলে যায়নি। সে বন্যা তো আজও ইতিহাস ! ধারণা করতে পারি, স্থানীয় বন্যায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা প্রাচীনকালের মানুষকে আকর্ষণ করেছে। এই আকর্ষণের প্রভাব নিশ্চয় ওই
অঞ্চলের মানুষদের চিন্তা-ভাবনায় গিয়ে পড়েছিল। হয়তো সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পৌরাণিক গল্পে এবং আঞ্চলিক
লোকগাথায়।
খোদ চার্লস ডারউইন থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী লায়েল, চিত্রশিল্পী
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চিসহ আরও অনেকেই এই মহাপ্লাবনের বিপক্ষে নানা প্রমাণ হাজির
করে মানুষের ভ্রান্তি দুর করতে চেষ্টা করেছিলেন। তারপরও পশ্চিমাদের এই অর্ধসত্য থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ণসত্যের
সন্ধান লাভ সহজ হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। মুক্তমনা প্রাবন্ধিক অনন্ত বিজয় দাশ একটি প্রবন্ধে লিখেছেন – “ওল্ড টেস্টামেন্টের অন্তর্গত তৌরাত শরিফে (জেনেসিস অধ্যায়ে) হজরত আদম থেকে
হজরত ইব্রাহিমের বয়সের তালিকা সরাসরি দেওয়া আছে। কিন্তু হজরত ইব্রাহিম থেকে খ্রিস্টের জন্ম অবধি এই সময়কালের
সেরূপ কোনো তথ্য (জন্মলতিকা) সরাসরি বাইবেলে নেই। এ অবস্থায় প্রাচীন নানা ধর্মগ্রন্থ বিশ্লেষণ করে ১৬৫৪ সালে
আয়ারল্যান্ডের ধর্মযাজক জেমস আসার (১৫৮১-১৬৫৬), তাঁর “অ্যানালস
অফ ওল্ড অ্যান্ড নিউ টেস্টামেন্ট” গ্রন্থে বাইবেলে উল্লেখিত
আদম এবং তাঁর বংশধরদের জন্মতালিকা যোগ করে জানিয়েছিলেন --
ঈশ্বর এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালে, রবিবার
সকাল নয় ঘটিকায়, অক্টোবরের ২৩ তারিখে। এর কিছুকাল পরেই কেমব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জন লাইটফুট (১৬০২-১৬৭৫) নতুন গণনা করে জানালেন, আদমের জন্ম
সকাল নয় ঘটিকায়, সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালেই; এবং বাইবেলে উল্লিখিত ‘মহাপ্লাবন’ খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪৮ সালে হয়েছিল। সূক্ষ্ম দিনক্ষণের হিসাবকে
বিশ্বের বহু ইহুদি এবং খ্রিস্টান সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে থাকেন। বাংলা একাডেমি; ঐতিহাসিক
অভিধান (মোহাম্মদ মতিউর রহমান সংকলিত, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৩২৭) মতে -- আদম পৃথিবীতে আসেন ৫৮০৯
খ্রিস্টপূর্ব এবং মৃত্যুবরণ করেন ৪৮৭৯ খ্রিস্টপূর্ব। হজরত আদম থেকে হজরত নুহের বয়সের ব্যবধান ১০৫৬ বছর। হজরত নুহের বয়স যখন ৬০০ বছর, তখন
মহাপ্লাবন হয়েছিল। অর্থাৎ
হজরত আদম জন্মের ১৬৫৬ বছর পর (খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪৮ সালে) মহাপ্লাবন হয়েছিল। এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে ২৩৪৮ +
২০০৭ = ৪৩৫৫ বছর। আর
একটি বারের জন্যেও মহাপ্লাবন হয়নি, কী অদ্ভুত !”
নোয়ার নৌকায় আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো ছাড়া সমগ্র
মানব জাতির ধ্বংসেরও কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। পৃথিবীর এক অংশে বন্যা
হলে বাকি অংশের মানুষ ও জীবজন্তু এবং গাছপালার তো কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে সমগ্র
পৃথিবীব্যাপী
(Global) প্লাবন হওয়া সম্ভব নয়। মহাদেশগুলি এতই বিচ্ছিন্ন যে, একসঙ্গে সমস্ত মহাদেশ প্লাবিত
হওয়া সম্ভব নয়। কারণ পৃথিবী গোলাকার – এই পৃথিবী কোনোকালেই
রুটির মতো চ্যাপটা কিংবা বাক্সের মতো চৌকো ছিল বলে কোনোদিন শুনিনি। একমাত্র গ্লোবাল প্লাবন হলেই
বেশিরভাগ জীবের বিনাশ সম্ভব। বাস্তবেই নিকট অতীতে হঠাৎ করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী
ধ্বংস হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলেন, পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন মানবপ্রজাতি
বিদ্যমান। আমাদের ভিন্নতা এসেছে ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। চাইনিজ, ইউরোপিয়ান,
আফ্রিকান, দক্ষিণ আমেরিকান মানুষ একে অন্যের
থেকে এতই ভিন্ন যে, দেখলেই নিরূপণ করা যায়। কেউ সাদা তো কেউ
কালো, কেউ বেঁটে তো কেউ লম্বা, কারোর
নাক চ্যাপটা তো কারও সরু। এই ভিন্নতা কয়েক হাজার বছরের জেনেটিক মিউটেশন বা আবহাওয়া
গত কারণে হওয়া সম্ভব নয়। নুহের থেকেই যদি বর্তমানের মানুষের উদ্ভব ঘটে থাকে,
তাহলে এই মানুষে মানুষে ভিন্নতা ও বর্তমান সংখ্যায় উপনীত হওয়ার জন্য
প্রয়োজন কয়েক কোটি বছর। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যদি নুহের সন্তান হত তাহলে সমস্ত মানুষের
গায়ের রং একইরকম হত, আকার-আকৃতিও একইরকম
হত। নুহ ৯৫০ বছর
বেঁচেছিলেন। আজকের পৃথিবীতে মানুষের আয়ু ১০০ বছরের কিছু বেশি বা কম। প্রাচীন যুগে মানুষের
আয়ু এত বেশি ছিল, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তবে নুহ যদি
২৫ কোটি বছর আগে জন্ম নিয়ে থাকেন, তাহলে আর ব্যাপারটা
অস্বাভাবিক থাকে না। কারণ ২৫ কোটি বছর আগে পৃথিবী এখনকার চেয়ে অনেক দ্রুতবেগে
সূর্যের চারিদিকে ঘুরত। ফলে বছর ও দ্রুত পার হত এবং বাধ্য হয়েই তখন বছরের হিসাব
করতে হত ভিন্নভাবে। হয়তো-বা হিসাব করলে দেখা যাবে তখনকার ৯৫০
বছর আর এখনকার ১০০ বছরের সময়কাল সমান। পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে ঘোরার গতি সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে। এটা একটি বৈজ্ঞানিক
ভাবে প্রমাণিত এবং সত্য। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কোরানের বাণী তো নুহ নবির সময়ে
রচিত হয়নি, অথবা সে সময় পাঠানো হয়নি। পাঠানো হয়েছে বর্তমানে
আমরা যে সময়ের ধারণা বা বছরের ধারণা হিসাব করি সেই একই এককের কালেই। সময়ের এই কালে
আল্লাহতালা কেন ২৫ কোটি বছর আগের সময়ের হিসাবে নুহ নবির বয়স ৯৫০ লিখতে যাবেন
? ২৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীর অরবিট সূর্যের আরও নিকটে ছিল এবং পৃথিবীর
সূর্যের চারিদিকের ঘোরার গতিও আরও অনেক বেশি ছিল। সেই কারণে তখনকার বছর এখনকার
বছরের থেকে ভিন্ন ছিল এবং মানুষও দেরিতে বুড়ো হত। যেমন রকেটে করে মহাশুন্য পাড়ি
দিলে মানুষ দেরিতে বুড়ো হবে। স্মরণে
আসছে না, কোনো একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম রকেটে করে মহাশুন্যে ১০ বছর পাড়ি দিয়ে এলে,
দেখা যাবে পৃথিবীতে ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। ২৫১ মিলিয়ন বছর আগে দিন ও
বছর যেহেতু দ্রুত পার হত, তখন নিশ্চয় আমাদের বর্তমানের
হিসাবে বছর হিসাব করলে ঋতু পরিবর্তনের সঠিক সময় নির্নয় করা সম্ভব ছিল না। সেই কারণে
তাদের বছরের হিসাবের পদ্ধতি নিশ্চয় ভিন্ন ছিল। যেমনটি মায়াদের ক্যালেন্ডার -- ওদের মাস হত ২০ দিনে এবং বছর ২৬০
দিনে। নুহের সময় বছরে হিসাব কীভাবে করত জানি না, তবে আমার
ধারণা ওদের ৯৫০ বছর। অর্থাৎ আমাদের (+/-) ১০০ বছরের সমতুল্যই ছিল। তবে মে রাখতে হবে,
পৃথিবী থেকে সূর্যের "নির্দিষ্ট" দূরত্ব এবং বার্ষিক গতির তফাত হলে
নুহ কেন কোনো প্রাণেরই আবির্ভাব হত না। আসলে নুহ নামে কোনো মানুষ ২৫১ মিলিয়ন বছর
আগে পৃথিবীতে বাস করত কি না, সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন।
একটা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ৪.৫ বিলিয়ন
বছর আগে পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে সময় নিত ৬.৫ ঘন্টা। The
Sub-bureau for Rapid Service and Predictions of Earth Orientation Parameters of
the International Earth Rotation Service (IERS), located at the US Naval
Observatory, monitors the Earth's rotation. Part of its mission involves the
determination of a time scale based on the current rate of the rotation of the
Earth. They estimate that the Earth's rotation is slowing at about 1.4
milliseconds per solar day per century which roughly agrees with the rate of
rotation of the Earth has actually slowed down since 1820. Tracing these tiny
milliseconds back for 4.5 billion years adds up to a very significant amount of
time for a solar day. I have determined that the day/night rotation was 63,000
seconds shorter than the present 86,400 seconds it is today. This would put the
Earth's rotation at about 6.5 hours per day/night cycle, when it was created,
4.5 billion years ago. (This is a much faster rate of rotation than the
Cassini-Huygens mission (2003 to 2004) determined Saturn's 10.5 hours rotation
period to be.). নিজে নিজেই মন্থর হয়ে যাওয়া ছাড়াও বড়ো বড়ো
ভূমিকম্পও পৃথিবীর গতিকে মন্থর করে দেয়। জানি না কত শত-লক্ষ
ভূমিকম্প গত ২৫১ মিলিয়ন বছরে হয়েছিল। সেই কারণে সঠিক সময় নির্ধারণ বেশ জটিল হয়ে পড়ে।
অপরদিকে অনেকে বলেন, পারমিয়ান-ট্রিয়াসিক
এক্সটিংশনের সঙ্গে নুহের মহাপ্লাবনের ঘটনাকে মেলাতে সেটি মনে হয় না সম্ভব হবে।
কোরানে নুহের ৯৫০ বছর বলা হয়েছে। কারণ তার সমসাময়িক লোকজনের বয়স এত বেশি হলে আলাদাভাবে নুহের
কথা উল্লেখ করা হল কেন ? বাইবেলেও কিন্ত নুহের বয়স ৯৫০ বছর। কিন্ত আদমের বয়স ১৩০ বছর। আবার
পিতার বয়স ৮০০ বছরের উপরে, কিন্ত পুত্রের বয়স ১০০ বছর। অনুমান করতে পারেন যে নুহের ৯৫০ বছর বেঁচে থাকাটা তখনকার
দিনে অসম্ভব না-হলেও দুর্লভ ছিল। প্রমাণ হিসেবে হয়ত
৫ থেকে ৭ মিলিয়ন বছরের রেঞ্জে কোনো ফসিলের কথা বলা যেতে পারে -- যার আয়ু ৭০০, ৮০০ অথবা ৯০০ বছর। বিভিন্ন জাতির উদ্ভব
কয়েক কোটি নয় -- ৫০,০০০ থেকে ১,০০০০০ বছরের মধ্যেই ঘটেছে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের
বিকাশ ঘটা শুরু হয় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসোরদের বিলুপ্তির পরে। মানুষের সবচাইতে
কাছের রিলেডেট দু-পেয়ে প্রাণীর আভির্ভাব হয়েছিল ৬ থেকে ৭ মিলিয়ন
বছর আগে। তাও তার আজকের যুগের মানুষ নয়।
১৯১১ সালের একদিনের ঘটনা, জার্মানির অ্যালফ্রেড ওয়েজেনার (Alfred Wegener) লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা
করছিলেন, হঠাৎ একসময় খেয়াল করলেন একটা
বইয়ে পৃথিবীর নানা দেশে প্রাপ্ত ফসিলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই বইতে লেখা আটলান্টিকের
দু-পাশের দুটি দেশে প্রাপ্ত ফসিল একই প্রজাতির ডায়নোসোর আর
গিরগিটির। একই প্রজাতির ডায়নোসোরের ফসিল
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। সে স্থানগুলি শুধু আটলান্টিক মহাসাগরের দু-প্রান্তে বলা ভুল হবে, বলা উচিত পৃথিবীর এ-মাথা এবং ও-মাথায়। মাঝে বিশাল সাগর।
কি করে সম্ভব এটা ?
সেই বইখানিতে লেখক তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ারও
চেষ্টা করেছিলেন। তার বক্তব্য
: হয়তো আদি পৃথিবীতে মহাসাগরগুলির মাঝে চলাচলের জন্য কোন
রাস্তা ছিল, নয়তো প্রাচীনকালে পৃথিবীর সমস্ত স্থলভূমি একসঙ্গে সংযুক্ত
ছিল, সেই সংযুক্ত স্থলভূমিতে বিশালাকার ডায়নোসোর হাঁটাহাটি করত, দৌড়াদোড়ি করত। অ্যালফ্রেডের এ ধারণাটা পছন্দ
হল। তিনি ভাবলেন -- “হ্যাঁ তাই তো, একসময় তো
দুনিয়ার
তামাম স্থলভাগ একসঙ্গে এক জায়গায় মিশে থেকে মহা মহাদেশ তৈরি করে থাকতেই পারে।”
অ্যালফ্রেড খুব চিন্তাভাবনা করে একটি মানচিত্র এঁকে ফেললেন। সেই মানচিত্রে বিশাল এক মহামহাসাগরের মাঝে পৃথিবীর সব মহাদেশ মিলে একটা মহামহাদেশ। সেই মহামহাদেশের নাম তিনি দিলেন ‘প্যানজিয়া’ (Pangea), ‘প্যানজিয়া’-র অর্থ ‘সকল স্থলভূমি’। বিজ্ঞানীদের অনুমান আজ থেকে প্রায় ৩০ কোটি বছর আগের অবস্থা সেটা। এই ৩০ কোটি বছর আগেকার একটি মাত্র ভূমিকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল একটি মহাসাগর। এই মহাসাগরের নাম দেওয়া হল প্যানথালাস। প্যানজিয়া শব্দটার সঙ্গে মিল রেখেই এই শব্দ। গ্রিক Pan শব্দটার অর্থই হচ্ছে ‘সব’ বা ‘সমগ্র’ । Gaea শব্দের অর্থ দাড়ায় ভূমি বা স্থলভাগ। সব মিলে প্যানজিয়া শব্দের অর্থ হয় ‘সমগ্র ভূমি’। প্যানথালাস শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘সমগ্র মহাসাগর’। আলফ্রেড বললেন, “পৃথিবী ২০০ মিলিয়ন বছর আগে এরকমই ছিল।” অ্যালফ্রেড এ সম্পর্কে একটা তত্ত্বও দিলেন। এই তত্ত্বের নাম ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’। অ্যালফ্রেড নিজে ছিলেন পেশায় জ্যোতির্বিদ, সেই কারণে তার এই ‘তত্ত্ব’ অন্য বিজ্ঞানীরা মেনে নেবেন কেন ! তারা অ্যালফ্রেডকে বললেন, “তুমি ভাই তারা-নক্ষত্র নিয়েই থাকো। তোমার আবার ভূবিদ্যা বিষয়ে নাক গলানোর কি প্রয়োজন ? অনধিকার চর্চা নয় কি !” তারা আরও বললেন -- “তোমার কথা বিশ্বাস করলে বলতে হবে সারা পৃথিবীর স্থলভাগ সাগরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে জায়গা বদল করেছে।”
১৯৫০ সাল। প্রযুক্তির বেশ উন্নতি ঘটে গেছে তখন। সাগরতলের ছবি তোলার যন্ত্রপাতিও হাতে এসে গেছে। জাহাজে চড়ে সম্পূর্ণ পৃথিবীর সাগর পরিক্রমা করে সাগরতলের ছবি তোলা হয়েছিল। তাতে অবাক করার মতো একটা বিষয় বেরিয়ে এল। দেখা গেল, সাগরতলে অর্থাৎ জলের নীচে বিশাল পর্বতমালার এক লাইন পুরো ৪৬,০০০ মাইল জুড়ে ছড়ানো। এই লাইন পৃথিবীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে। শুরু হয়ে গেল নতুন নতুন সব আবিষ্কার। ভূতত্ত্ববিদরা এবার উপলব্ধি করলেন অ্যালফ্রেড যথার্থই বলেছিলেন। পৃথিবীর বর্তমান মহাদেশগুলি আগে পৃথক পৃথক ছিল না, একসঙ্গেই ছিল। এখন প্রশ্ন হল পৃথিবীর স্থলভাগ জায়গা পরিবর্তন করল কীভাবে ? ওয়েজেনার বলেছিলেন মহাদেশগুলি জাহাজের মতো চলে বেড়ায়। আসলে টেকটনিক সক্রিয়তার ফলে চলে বেড়ায় যেটা জাহাজের চলনের মতো নয়। ভূমিগুলি জলের উপরে থেকে ভেসে বেড়ায় না। বরং সমুদ্রের জলের তলদেশের যে মাটি সেটিও চলে বেড়ায়, তারাও টেকটোনিক প্লেটের অংশ।
অ্যালফ্রেড খুব চিন্তাভাবনা করে একটি মানচিত্র এঁকে ফেললেন। সেই মানচিত্রে বিশাল এক মহামহাসাগরের মাঝে পৃথিবীর সব মহাদেশ মিলে একটা মহামহাদেশ। সেই মহামহাদেশের নাম তিনি দিলেন ‘প্যানজিয়া’ (Pangea), ‘প্যানজিয়া’-র অর্থ ‘সকল স্থলভূমি’। বিজ্ঞানীদের অনুমান আজ থেকে প্রায় ৩০ কোটি বছর আগের অবস্থা সেটা। এই ৩০ কোটি বছর আগেকার একটি মাত্র ভূমিকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল একটি মহাসাগর। এই মহাসাগরের নাম দেওয়া হল প্যানথালাস। প্যানজিয়া শব্দটার সঙ্গে মিল রেখেই এই শব্দ। গ্রিক Pan শব্দটার অর্থই হচ্ছে ‘সব’ বা ‘সমগ্র’ । Gaea শব্দের অর্থ দাড়ায় ভূমি বা স্থলভাগ। সব মিলে প্যানজিয়া শব্দের অর্থ হয় ‘সমগ্র ভূমি’। প্যানথালাস শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘সমগ্র মহাসাগর’। আলফ্রেড বললেন, “পৃথিবী ২০০ মিলিয়ন বছর আগে এরকমই ছিল।” অ্যালফ্রেড এ সম্পর্কে একটা তত্ত্বও দিলেন। এই তত্ত্বের নাম ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’। অ্যালফ্রেড নিজে ছিলেন পেশায় জ্যোতির্বিদ, সেই কারণে তার এই ‘তত্ত্ব’ অন্য বিজ্ঞানীরা মেনে নেবেন কেন ! তারা অ্যালফ্রেডকে বললেন, “তুমি ভাই তারা-নক্ষত্র নিয়েই থাকো। তোমার আবার ভূবিদ্যা বিষয়ে নাক গলানোর কি প্রয়োজন ? অনধিকার চর্চা নয় কি !” তারা আরও বললেন -- “তোমার কথা বিশ্বাস করলে বলতে হবে সারা পৃথিবীর স্থলভাগ সাগরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে জায়গা বদল করেছে।”
১৯৫০ সাল। প্রযুক্তির বেশ উন্নতি ঘটে গেছে তখন। সাগরতলের ছবি তোলার যন্ত্রপাতিও হাতে এসে গেছে। জাহাজে চড়ে সম্পূর্ণ পৃথিবীর সাগর পরিক্রমা করে সাগরতলের ছবি তোলা হয়েছিল। তাতে অবাক করার মতো একটা বিষয় বেরিয়ে এল। দেখা গেল, সাগরতলে অর্থাৎ জলের নীচে বিশাল পর্বতমালার এক লাইন পুরো ৪৬,০০০ মাইল জুড়ে ছড়ানো। এই লাইন পৃথিবীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে। শুরু হয়ে গেল নতুন নতুন সব আবিষ্কার। ভূতত্ত্ববিদরা এবার উপলব্ধি করলেন অ্যালফ্রেড যথার্থই বলেছিলেন। পৃথিবীর বর্তমান মহাদেশগুলি আগে পৃথক পৃথক ছিল না, একসঙ্গেই ছিল। এখন প্রশ্ন হল পৃথিবীর স্থলভাগ জায়গা পরিবর্তন করল কীভাবে ? ওয়েজেনার বলেছিলেন মহাদেশগুলি জাহাজের মতো চলে বেড়ায়। আসলে টেকটনিক সক্রিয়তার ফলে চলে বেড়ায় যেটা জাহাজের চলনের মতো নয়। ভূমিগুলি জলের উপরে থেকে ভেসে বেড়ায় না। বরং সমুদ্রের জলের তলদেশের যে মাটি সেটিও চলে বেড়ায়, তারাও টেকটোনিক প্লেটের অংশ।
বিজ্ঞানীরা প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্বের মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন। পৃথিবীর বহিস্তর বা উপরিভাগে বেশ কয়েকটি জায়গা ফাটল আছে। ফাটলযুক্ত বহিস্তরকে বলা হয় ‘প্লেট’। পৃথিবীতে এরকম মোট ১২টি প্লেট
আছে। এই ফাটল বরাবর মাটির নীচে
সোজা ৬০ মাইল নেমে গেলে গরম পাথরের একটা ঘন স্তর পাওয়া যায়। এ স্তর উপরের প্লেটের
তুলনায় অনেক নরম। নরম এই স্তরের উপর
প্লেটগুলি
ভেসে আছে। সুপের বাটিতে চিপস দিলে যেমন করে ভেসে তাকে অনেকটা সেইরকম। নিজের অক্ষের উপর পৃথিবী যখন ঘোরে তখন এর ভিতরের
সেই নরম স্তরও নড়ে। এভাবে স্থলভুমিগুলি ক্রমাগত একে অপরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবী কিন্তু এখনও থেমে
নেই। পৃথিবী এখনও বদলাচ্ছে।
ভবিষ্যতেও এরকম থাকবে না। আজ থেকে হয়তো একশো মিলিয়ন বছর পর দেখা যাবে ইংল্যান্ড
জাপানের কাছে চলে এসেছে। ভারত চলে গেছে হয়তো দক্ষিণ আমেরিকার কাছে। ২০০ মিলিয়ন বছর আগে নিশ্চয় এমন এক সার্বিক ভূ-আলোড়ন হয়েছিল,
যার ফলে স্থলভাগগুলি একে অপরের কাছ থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। সেই ভূ-আলোড়নের ফলে পৃথিবীব্যাপী
ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস বা মহাপ্লাবন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে সময় সমস্ত মহাদেশ একসঙ্গে ছিল এবং হঠাৎ করেই এই সময়ে সামুদ্রিক জীবের ৯৬% ও স্থলভাগের ৭০% প্রাণীর বিনাশ
ঘটেছিল বলে অনেকে মনে করেন। সেই মহাপ্লাবনের ঘটনাটিই
কি তবে নোয়া বা নুহ নামে এক ব্যক্তি অতিরঞ্জিত করে শুনিয়েছেন হয়তো!
কন্টিনেন্টাল ড্রিফট থিওরি
মতে ভূখণ্ডগুলি তো সম্প্রসারিত হয়েই চলছে। আবার পৃথিবী হচ্ছে গোল, সমতল নয়। একটা উদাহরণ
হিসাবে বলা যায়, প্রতি বছরে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ আড়াই সেন্টিমিটার করে একে অপর
থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছরে প্রায় এক ইঞ্চি করে। এমন করে যদি
সঞ্চারিত হতেই থাকে, তবে শেষ
পরিণতিটা কী হবে ? পৃথিবী যেহেতু গোলাকার, তাই যদি একদিক থেকে প্রসারণ শুরু
হয় তাহলে লক্ষ লক্ষ বছর পর প্রসারিত হতে হতে ঠিক বিপরীত দিকে গিয়ে আবার
মিলিত হবে। এক পৃষ্ঠে শুরু হলে অপর পৃষ্ঠে মিলিত হতেই হবে, নইলে সঞ্চারিত হবে
কোথায়? কন্টিনেন্টাল
ড্রিফট জিনিসটাই এরকম, এটি যুগের পর যুগ চলতেই থাকে। একসময় ভারত অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকা একসঙ্গে ছিল
এবং একসময় আবার দূরে সরে গেছে। আবার একটা সময় আসবে যখন পুনরায় ভারত অন্য অংশের সঙ্গে মিলিত হবে। তবে
প্রথমবার যে পৃষ্ঠে মিলিত ছিল পরের বার মিলিত হবে ঠিক তার বিপরীত পৃষ্ঠে। একত্রে
মেশার পর আবার বসে থাকবে না, পুনরায় আবার সঞ্চারণ শুরু করবে। এভাবে চলতেই থাকবে। জিনিসটা এমন যেহেতু পৃথিবী
গোল এবং সসীম তাই একদিক থেকে মহাদেশীয় প্লেটের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে অন্যদিক দিয়ে
দূরত্ব কমে আসে। যেমন আমেরিকা আর আফ্রিকা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে
আটলান্টিক মহাসাগর ক্রমে ক্রমে আকারে বড়ো হয়েই চলছে, আবার অন্যদিকে আমেরিকা
যেদিক দিয়ে সরে যাচ্ছে সেদিক দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। আগে কোনো কোনো জায়গা উঁচু ছিল
এখন নিচু হয়ে গেছে, আবার কোনো জায়গা নিচু ছিল এখন উঁচু হয়ে গেছে। কিছু
জিনিস সাগরের তলায় ছিল, এখন জলের উপরে। আবার কোনো এলাকা স্থলভাগ হিসাবে ছিল এখন
সমুদ্রের তলায়। এরকম করে কোনো দুটি স্থান একসঙ্গে ছিল, এখন
দূরে। আবার কোনো দুটি
স্থান দূরে ছিল এখন একসঙ্গে ! এ যেন প্রকৃতির অপরূপ পেন্ডুলাম, যা একবার একদিকে যায় যাওয়ার
পর আবার ফিরে আসে। প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে একত্রে থাকা ভূমি প্রধান দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগের নাম দেওয়া হয়
লরেশিয়া (Laurasia) আর-এক ভাগের নাম দেয়া হয়
গন্ডোয়ানা
(Gondwana)। দুটি ভাগ হওয়া
ভূখণ্ডের মাঝে অবস্থান করে একটি সাগর। এই সাগরের নাম টেথিস। আমাদের ভারত ছিল
নিচের দিকের গন্ডোয়ানার সঙ্গে। পরবর্তীতে
এই দুটি অংশ আবার
ক্রমান্বয়ে বিভক্ত হয়ে হয়ে বেশ কয়েকটি অংশের সৃষ্টি করে। গন্ডোয়ানাল্যান্ডেই ছিল
দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা। তারাও একসময় বিভক্ত হয়ে যায় এবং তাদের বিভক্ত হয়ে
যাওয়ার মাঝখানের অংশটিতে আটলান্টিক মহাসাগরের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ভারত তার
আদি অবস্থান থেকে বিভক্ত হয়ে যেন একটু তাড়াহুড়ো করেই এগোতে থাকে। ভারত গন্ডোয়ানা থেকে
দ্রুত সরে গিয়ে মাঝখানের টেথিস সাগর পাড়ি দিয়ে এশিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়।
সেদিন সারা পৃথিবীজুড়ে মানুষ উত্তেজিত, মৃত্যুর বা পৃথিবী
বিনাশের আশঙ্কায় মানুষ তটস্থ। ‘2012’ নামের হলিউডি সিনেমাটি চোখের সামনে দেখিয়ে দিয়েছে ধ্বংসের রূপ। মায়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে
২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সে সময় পৃথিবীতে এমন মহাপ্লাবন হবে যে, সেই প্লাবনের
তোড়ে পৃথিবীর সবকিছু ভেসে যাবে। মারা পড়বে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদ। এই দুর্যোগে মাছদের কোনো
সমস্যা হবে না। বরং সারা পৃথিবী জলের
নীচে তলিয়ে গেলে তাদের আরও সুবিধা। এতে তাদের বিচরণ ক্ষেত্র আরও বেড়ে যাবে। তাই
বলা যায়, বাঁচতে হলে আমাদের বেশি বেশি জাহাজ বানাতে হবে। বন্যা শুরু হলেই জাহাজে
চেপে যেতে হবে। ব্যস, তারপর আর কোনো সমস্যা নেই। ডুবোজাহাজও
বানানো যেতে পারে। খাদ্যের প্রয়োজনে মাছ শিকারও
করা যেতে পারে। প্রয়োজন পড়লে
ডুবোজাহাজ নিয়ে খবর নেওয়া যাবে যে মাছেদের। মহাপ্লাবনের হাত থেকে বাঁচতে মহাকাশে চলে যাওয়া যেতে পারে।
পৃথিবী থেকে ২০০ মাইল উপরে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কোনো কাজে আসে না। সেখানে যে-কোনো বস্তুই
ভেসে থাকতে পারে। অতএব ২০১২ সালের আগে আমাদের পৃথিবী থেকে ২০০ মাইল উপরে বাড়ি বা আস্তানা
বানিয়ে থাকার জায়গা তৈরি করতে হবে এবং রকেটে চেপে সেখানে চলে যেতে হবে। নিশ্চয় প্লাবনের
জল ২০০ মাইল উপরের এই মনুষ্য আস্তানায় পৌঁছতে পারবে না। মহাকাশের বাসিন্দাদের মাছ
ধরার জন্য ২০০ মাইল লম্বা লাইলনের দড়ি দিয়ে বড়শি বানাতে হবে। তারপর আস্তানায় বসে
সেই বড়শি ফেলতে হবে পৃথিবীর জলে। মাছের খাবার হিসাবে বড়শিতে গাঁথার জন্য কেঁচো কোথায় পাওয়া
যাবে ? এখনও সেই সমাধানে আসা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনার ফলে আশা করা যায় অচিরেই সে সমাধান
পাওয়া যাবে। যারা জাহাজ কিনতে বা বানাতে পারবেন না বা মহাকাশে বাড়ি ভাড়া নিতে
পারবেন না, মায়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে তাদের জন্য বেঁচে থাকাটা দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। তবে
তারা একটা কাজ করতে পারেন, ঘরে ঘরে অক্সিজেনের দুর্গ গড়ে তুলতে
পারেন। মহাপ্লাবনের জল ঘরে
উঠতে দেখলেই অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগিয়ে জলে নেমে পড়ার পরিকল্পনা করতে পারেন। ২০১২ সাল চলে গেছ। যারা মরে যাওয়ার আশঙ্কায় নীল হয়ে
গিয়েছিলেন তারা কেউ আর প্রশ্ন তোলেননি কীভাবে বেঁচে আছেন এখনও। ২০১৩, ২০১৪ও চলে গেল,
এটা ২০১৫।
পৃথিবী বা অন্যান্য গ্রহের সৃষ্টির লগ্ন থেকেই এরকম
হাজার হাজার মহাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আজকের পৃথিবী। ভবিষ্যতেও এরকম আরও মহাবিপর্যয় হবে না সে কথা হলফ করে বলা যায়
না। পৃথিবীজুড়ে মহাবিপর্যয়
আসবেই। এমন ভবিষ্যত আসবে যেদিন
হয়তো পৃথিবীতে প্রাণসৃষ্টির কোনো উপাদানই থাকবে না। হয়তো অন্য কোনো নতুন ‘পৃথিবী’ সৃষ্টি হবে অন্য
কোথাও অন্য কোনোখানে। বিপর্যয়ের বিবর্তনের মধ্য
দিয়ে মঙ্গল, শুক্র, চন্দ্র, বৃহস্পতি ইত্যাদি
গ্রহ-উপগ্রহগুলির কোনো এক বা একাধিক প্রাণময় ‘পৃথিবী’র উদ্ভব হতেই পারে।
এখন আর নোয়ার যুগ নেই। এখন বিজ্ঞানের যুগ। নোয়ার মহাপ্লাবন না-হলেও একদিন নিশ্চয়ই পৃথিবী ধ্বংস হবেই কোনো এক
অনাহূত মহাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। গত শতাব্দীতে অর্থাৎ, ১৯৯৯ সালে একবার হিড়িক পড়েছিল পৃথিবীর বুকে
মহাবিপর্যয় নেমে আসার।বলা
হয়েছিল ওই শতাব্দী সম্পূর্ণ হবার আগেই পৃথিবীর আয়ু শেষ হয়ে যাবে। সে সময় এক এক জ্যোতিষীর ভিন্ন
ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বলেছিল : কোনো গ্রহ বা উল্কার সঙ্গে সংঘাত
ঘটবে, অথবা উভয় মেরুতে জমা বরফ পৃথিবীর তাপ বৃদ্ধির ফলে গলে মহাপ্লাবনের
সৃষ্টি করে সব ডুবিয়ে দেবে, অথবা প্রবল ভূমিকম্পে গোটা পৃথিবী
উথালপাতাল হয়ে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, অথবা পৃথিবী তার অক্ষদণ্ডে
হেলে গিয়ে বিপর্যয় নেমে আসবে, অথবা কোনো নির্বাপিত নক্ষত্রের
তপ্ত গ্যাসপিণ্ড পৃথিবীকে গ্রাস করবে -- অথবা সব একসঙ্গে হবে এবং এই সাধের
পৃথিবীর জড়-জীব সমস্ত চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তা-ও যদি না হয়
– তবে এসব কিছু না হয়, তাহলে পৃথিবীর সামনে অনেক
বিপদ হাজির হবে যে পৃথিবীর বুকে মানুষের পক্ষে বসবাস করা মুশকিল হয়ে যাবে। মাঝেমধ্যেই এমন অনেক জ্যোতিষীর
আবির্ভাব হয়, যাঁরা পৃথিবীর বুকে বিপর্যয় নেমে আসার গপ্পো শুনিয়ে নিজের পসার বাড়ায়,
বাজার গরম করে। যদি ঢিলে কাক মরে, তাহলে গুণিনের
নাম বাড়া আর ঠেকায় কে ! এ ব্যাপারে ওইসময় চিরঞ্জীব সেন ১৪৪ পৃষ্ঠার
একটি দীর্ঘ বই লিখে ফেললেন। তাঁর সেই বইটির নাম “৯৯ কি শেষ
?” বইটিতে তিনি তিনটি ধ্বংসের ধরন আশঙ্কা করেছেন -- (১) প্রবল জনসংখ্যার চাপ, (২) যথেচ্ছ
রসায়ন ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ এবং (৩) পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় শক্তির ব্যবহারের ধ্বংসের আশঙ্কা। কি হবে তা সময়ই বলবে। জানি না, ধ্বংসের পর নতুন
পৃথিবীতে কোনো নোয়া বা নুহ গপ্পো লিখে রাখবে কি না আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে।
-------------------------------------------------------
তথ্য নির্দেশিকা : (১) মানুষ মহাবিশ্ব ও ভবিষ্যৎ -- ফারসিম মান্নান মোহাম্মদি, (২) কোরান, (৩) মৎসপুরাণ, (৪) ডারউইন থেকে
ডিএনএ এবং চারশো কোটি বছর -- নারায়ণ সেন, (৫) ওল্ড টেস্টামেন্ট, (৬) আমি
কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না -- প্রবীর ঘোষ, (৭) সাগরের রহস্যপুরী -- আবদুল্লাহ আল-মুতি (৮) কোলাইডিং কন্টিনেন্টস
--
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডকুমেন্টারি, (৯) Wikipedia : Continental Drift, (১০) Wikipedia : Alfred Wegener, (১১) ৯৯ কি শেষ ? -- চিরঞ্জীব
সেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন