পশ্চিমবঙ্গকে সরিয়ে রেখে ভারতের অন্য রাজ্যগুলির দিকে একটু তাকালে একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি
দেখতে পারবেন। ভারতের বাইরে অন্যান্য তথাকথিত সভ্য দেশগুলিতেও নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়। সেগুলি কিছু উল্লেখ করতে মন চাইছে। বীভৎসতার বিচারে কিছু বাছাই ঘটনা।
ঘটনা – ১ : আতঙ্কিত করা, যথেচ্ছ প্রহার, যন্ত্রণা দেওয়া, ভয় দেখানো এবং শেষ পর্যায়ে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারায় গেস্টাপো (গেহেইম স্ট্যাটসপোলজে) ছিল সিদ্ধহস্ত। গেস্টাপো, জার্মানের একটি সিক্রেট পুলিশ সংস্থা। গেস্টাপো ছিল মানুষের তৈরি জঘন্য, নৃশংস, হিংস্র এক সংস্থা। জার্মানিতে একটা সময় এসেছিল যখন গেস্টাপোর নাম শুনলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে শিউরে উঠত।বন্ধ হয়ে যেত হৃদস্পন্দন। নিরপরাধ মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার করত এই সংস্থা। ‘ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট’ ও ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’ যদি কোনো জার্মান নাগরিক, তবে তাদের যৌনাঙ্গে ইলেকট্রোডের শক, মহিলাদের ধর্ষণ, গোড়ালিতে দড়ি বেঁধে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য গাঁইতির হাতল বা রবারের ডাণ্ডা বা বিষাক্ত ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হত। অত্যাচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হত।
ঘটনা – ২ : রাশিয়ার পুলিশ সংস্থা কেজিবি। সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের অসামরিক গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনী ‘কমিটেট গাসুদোর্স্তভেন্নই বেজোপোসনোস্তি’, সংক্ষেপে কেজিবি। নাম শুনলেই প্যান্টে হিস্যু হয়ে যাবে অসাড়ে। সরকার চালাত কমিউনিস্ট পার্টি, আর সেই সরকারের নির্দেশে কেজিবি সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার করত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাশিয়ার সিক্রেট পুলিশ বাহিনী কাজ করছে ১৯১৭ সাল থেকে।জারের আমলে রাজ্যপাট চালাতে অন্যান্য সরকারি দপ্তরের চেয়ে সিক্রেট পুলিশকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তোলা হয়েছিল। এটা গড়ে ওঠার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই পুলিশ বাহিনী কত লক্ষ রুশ নাগরিককে যে হত্যা করেছে তার হিসাব নেই।
ঘটনা – ৩ : ইরাকের সিক্রেট সিকিউরিটি পুলিশ। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সামরিক সরকারের সঙ্গে কুর্দদের সংঘর্ষ লেগেই থাকত। শিশু, মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে সুযোগ পেলেই নিরপরাধ কুর্দদের ঠান্ডা মাথায় খুন করত ইরাকের সিক্রেট পুলিশ। সাদ্দামের সামরিক সরকার প্রায় ৩০০০ সাধারণ নিরীহ কুর্দদের হত্যা করেছিল বলে জানা যায়।
ঘটনা – ৪ : ও জি পি ইউ, অর্থাৎ ‘ইউনাইটেট স্টেট পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন’। এই পুলিশ সংস্থাটি রাশিয়ার আর-একটি ঘাতকের দল।সামরিক বাহিনীতে কারা প্রশাসন ও পার্টির সমালোচক, অন্য অর্থে বিপ্লবের প্রতিবন্ধক বা দেশের শত্রু, তাদের খুঁজে বের করার কাজে ওজিপিইউ প্রথমদিকে ব্যস্ত থাকলেও পরে রাশিয়ার বৃহত্তম গণহত্যার জন্য এই সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। তিরিশের দশকে যখন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের ‘কালেকটিভাইজেশন প্রোগ্রাম’ রূপান্তরিত হয় তখন দেশের কৃষকরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চারে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ওই প্রতিবাদী কৃষকদের কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল এই ওজিপিইউ। রাশিয়ার ইতিহাস অনুযায়ী বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই কোটি রুশ নাগরিক জার্মানদের হাতে নিহত হয়েছিল। কিন্তু তার আগে তিরিশের দশকে যে প্রায় সমসংখ্যক রুশি কৃষককে সে দেশের সরকার গুলি করে, ফাঁসি দিয়ে, বেয়নেটে বিদ্ধ করে ও লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে হত্যা করেছিল।এই গণহত্যার নায়ক পরবর্তীকালে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেননি, বরং আমজনতার সামনে তা গর্ব করে বলতেন। প্রথমদিকে অবশ্য ব্যাপারটা চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানরা যখন সব ফাঁস করে দেয়, তখনই এই নৃশংস কৃষক হত্যার কথা বিশ্ব জানতে পেরেছিল। স্তালিনের দ্বিতীয় স্ত্রী নাজেদদা এই গণহত্যার মানসিক চাপ সহ্য করতে না-পেরে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল।
ঘটনা – ৫ : দেশের নাম আর্জেন্টিনা। তখন আর্জিন্টিনার রাষ্ট্রপ্রধান কর্নেল জুয়ান ডোমিঙ্গো পেরন।‘ডিভিশন দা ইনফরমেশন পলিটিকাস অ্যান্টিডোমোক্রেটিকাস’ হল সিক্রেট পুলিশের দল। সংক্ষেপে ‘ডিপা’।নিপীড়ন, নির্যাতন ও প্রচণ্ড অত্যাচারের জন্য অল্পদিনের মধ্যেই ‘ডিপা’ বিখ্যাত হয়ে ওঠে। আন্দোলন দমনের কাজে এই সিক্রেট পুলিশ বাহিনীকে সাহায্য করত ‘আলিজায়া অ্যান্টি কমিউনাস্টা আর্জেন্টিনা’ ও ‘কমান্ডো লিবারোটেডোরস দ্য আমেরিকান’ নামের দুটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক গুণ্ডার দল, যাদের প্রত্যক্ষ মদত দিতেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পেরন। রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার পর ভালো করে হাত-পা বেঁধে লরিতে তোলা হত। এরপর কবরখানায় নিয়ে গিয়ে আগের থেকে খোঁড়া ট্রেঞ্চের সামনে জোর করে বসানো হত তাদের। অবধারিত মৃত্যুর জন্য আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হত না হতভাগ্য বন্দিদের। অকস্মাৎ পিছন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি এসে ঝাঁঝরা করে দিত ওদের শরীর। রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহগুলি গড়িয়ে পড়ত ট্রেঞ্চের ভিতরে। অনেক সময় ভারপ্রাপ্ত অফিসার বন্দিদের মৃত্যুর আগে শেষবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার জন্য পাঁচ মিনিট সুযোগ দিত। গুলি করার আগে বন্দিদের জানানো হত সরকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাদের এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যাই হোক, ট্রেঞ্চে মৃতদেহের স্তূপ জমে উঠলে তরল দাহ্য বস্তু ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হত। এই সিক্রেট পুলিশের কীর্তিকলাপের এখানেই শেষ নয়। পৈশাচিক আনন্দের জন্য এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক শক দিত পুরুষ বন্দিদের অণ্ডকোশে। মহিলা বন্দিদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হত স্তনবৃন্তে। বন্দিদের মাথার উপর কয়েক ক্যুইন্টাল ওজনের ভেজা ভূষির বস্তা চাপিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অত্যাচার চালাতে চালাতে পুলিশ বা আর্মির লোকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রামের সময় সিগারেট ধরাত। ওই সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো নেভাতে মহিলাদের যৌনাঙ্গকে অ্যাসট্রে হিসাবে ব্যবহার করত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনায় অন্তত ৫০০০ পরিচিত রাজনৈতিক কর্মী চিরতরে হারিয়ে গেছেন।
ঘটনা – ৬ : দেশের নাম কলম্বিয়া।গোপন পুলিশ সংস্থার নাম ‘মুয়ের্তে এ সিকুয়েস্ট্রেটরস’, সংক্ষেপে ‘মাস’। গ্রেপ্তার ও অপহরণের পর সাধারণ মানুষকে হত্যা করায় সিদ্ধহস্ত এই স্কোয়াড। ১৯৮৩ সালে ৩০০০ বন্দিকে বিনাবিচারে হত্যা করে এই ডেথ স্কোয়াড। কলম্বিয়ার ম্যাগডালেনা মিডিও এলাকায় ফাওয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী হাজার খানেক দরিদ্র কৃষক পতিত জমি পরিষ্কার করে উন্নত পদ্ধতিতে চাষবাস শুরু করে। বছর দুই/তিন ভালো ফসল পেয়েছিল ওই কৃষকেরা। এটাই চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল। ভাড়াটে সেনা ও ডেথ স্কোয়াড ‘মাস’ একসঙ্গে ৮০০ কৃষককে হত্যা করল কোনোরকম প্ররোচনা ছাড়াই।
ঘটনা – ৭ : উগান্ডা, আফ্রিকা মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। ইদি আমিনের শাসনকাল।১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল – ইদি আমিনের রাজত্বকালের এই ৯ বছরে উগান্ডায় কমপক্ষে ১ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই নিহতের আসল হিসাবে ১০ লক্ষও ছাপিয়ে যেতে পারে। প্রকৃত হিসাব কারোরই জানা নেই।
না, আর নয়। সারা পৃথিবী জুড়ে পুলিশ কর্তৃক ধৃতদের হত্যা করার ঘটনা পাওয়া যায় যে, চমকে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হাড় হিম করা সেসব কীর্তি।
“……..’নৈরাজ্য’ শব্দটার ভিতরে আছে 'রাজা' বিষয়ক ধ্যানধারণা। আসলে রাজ, বিরাজ, রাজ্য, রাজা, রাজন, সম্রাট, রাষ্ট্র প্রভৃতি শব্দের
আদিতে আছে 'রাজ্' নামের ধাতুটি (হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বঙ্গীয় শব্দকোষ, পৃষ্ঠা ১৯০৭)। এই
‘রাজ্’-এর অর্থ হচ্ছে ‘শোভা’, ‘দীপ্তি’ (হরিচরণ)। এই
ধাতু থেকে উৎপত্তি লাভ করা ‘রাজ’ শব্দটির অর্থ ‘শোভা
পাওয়া’, ‘দীপ্তি পাওয়া’, ‘প্রকাশ পাওয়া’, ‘বিদ্যমান থাকা’। এইভাবে ‘বিরাজ’ শব্দের অর্থ ‘শোভমান’, ‘শোভিত’, ‘দীপ্যমান’, দীপ্ত’; কিংবা ‘শোভা
পাওয়া’, ‘শোভিত হওয়া’; ‘শোভা করে অবস্থান করা’, ‘বিদ্যমান থাকা’, ‘উপস্থিত থাকা’। ‘সম্রাট’ শব্দেরও অন্যতম অর্থ ‘রাজা’, এর গোড়ায় আছে ‘সম্ + রাজ
+ কিপ’, অর্থাৎ ‘যিনি
মণ্ডলেশ্বর ও রাজগণের শাসক, তিনি সম্রাট’। তার
মানে
যিনি
শোভা পান, যিনি দীপ্তি
পান, যিনি প্রকাশ
পান, যিনি বিদ্যমান
থাকেন, তিনিই হন রাজা।
কিন্তু ‘রাজা’ ছাড়া বাকি সব মানুষ কি
শোভা পান না ? দীপ্তি পান না ? প্রকাশ পান না ? বিদ্যমান থাকেন না ? নিশ্চয়ই পান, নিশ্চয়ই থাকেন। কিন্তু ‘রাজা’ ছাড়া অন্যসব লোকের
শোভা, দীপ্তি, প্রকাশ, বিদ্যমানতা প্রভৃতির বিশেষ
কোনো মূল্য ‘আইনত’ নেই (আইন এখানে রাজার আইন, রাষ্ট্রের আইন)। কেন-না ‘রাজা’ ছাড়া অন্যসব
ব্যক্তিও যদি শোভা পান, দীপ্তি পান, প্রকাশিত হন, বিদ্যমান থাকেন, তাহলে আর ‘রাজা’-র সঙ্গে সবার পার্থক্য কী
থাকে ?
সুতরাং, রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন “আমরা
সবাই রাজা”, তখনই আসে নৈরাজ্যের প্রশ্ন। কেন-না যে রাজ্যে বা যে রাষ্ট্রে
এক ‘রাজা’ ছাড়া আর কারোর অস্তিত্বের, বিদ্যমানতার, বিরাজমানতার স্বীকৃতিই নেই, সেই রাজ্য দিয়ে কার লাভ ? শুধু রাজাদের লাভ। এ
কথা কে না জানে,
রাজতন্ত্রের
সর্বনিম্নপদস্থ দায়োয়ানটিও স্থানকালপাত্র মতো নিজেই খোদ রাজা; আগাপাছতলা এই রাজাদের
সিস্টেম বা বন্দোবস্ত বা তন্ত্রের নামই তো দাঁড়িয়েছে রাজতন্ত্র। রাজতন্ত্রে দাসত্ব ছাড়া আমাদের
জন্য কিছু বরাদ্দ নেই। রাজাকে দেশ লিখে দাও, তারপর দেশের মালিক রাজাকে খাজনা দাও, আর রাজপেয়াদার লাঠির বাড়ি
খাও—এই আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য।
তাহলে তো নৈরাজ্যই ভালো। রাজতন্ত্রের বদলে অরাজতন্ত্রই ভালো।
'রাষ্ট্র' শব্দের উৎপত্তিও ওই একই জায়গা থেকে—‘রাজ্’ (হরিচরণ)। ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির গোড়ায় আছে: “রাজ্+ত্র (স্ট্রন্)”, যার অর্থ “রাজ্য”। আর এই যে ‘স্ট্রন্’ —এর অর্থ সবসময়ই কোনোকিছুর গঠন-পরিগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
মানে রাজত্ব বা বিরাজত্ব জিনিসটার যে গাঠনিক কাঠামো, তারই নাম 'রাষ্ট্র'। আবার, ‘রাষ্ট্র’ কথাটার আরও একটা অর্থ ‘প্রচার, প্রকাশ’ (হরিচরণ)। রাজার
বিরাজত্ব যখন প্রচারিত হয়, প্রকাশিত হয় এবং সবাই সে ব্যাপারে সম্মত হয়, তখনই ‘রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যায়। এই গ্রামময়
রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই উপরের ওই ‘ত্র’ কথাটার সম্পর্ক। ‘ত্র’ অর্থ ‘তরণ-রহন (এখনি তরিত হয়ে অন্য
কোথাও চলে যাব,
এই ভাব)’ (২০০৯ সালে প্রকাশিত কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ'’ (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের
অভিধান) পৃ. ৪৮৮]। তার মানে হলে, ‘রাজা’-র একক, অদ্বিতীয় ও প্রশ্নাতীত বিরাজত্ব যখন বাকি সবাইকে ‘তরিত’ হয়ে কোথাও ‘রহন’ করে বা রহে বা
স্থিতি-কাঠামো লাভ করে, তখনই তার নাম হয় রাষ্ট্র।
‘রাষ্ট্র’ জিনিসটা তার মানে নিতান্তই রাজা’-র একক ও অদ্বিতীয়
বিদ্যমানতার সংস্থা। এ জিনিস কখনো জনগণের হতে পারে না। অতএব, বিদ্যমান গঠনকাঠামোয় ‘জনগণের রাষ্ট্র’ বলে
কিছু হয় না। এইজন্যই রাষ্ট্র শব্দের আরও একটা অর্থ ‘উপদ্রব, মকরাদি, দুর্ভিক্ষ’ (হরিচরণ)। তথাপি ‘সভ্যতা’ নামক গত পাঁচ হাজার বছরের রাজতন্ত্রে-শাসনতন্ত্রে
‘রাজা’ ‘রাষ্ট্র’ প্রভৃতিকে এতটাই
স্বাভাবিকভাবে দেখানো হয়েছে যে, এগুলো সব ডালভাত তো বটেই, আলো-জল-হাওয়ার মতো প্রশ্নাতীত প্রাকৃতিক
ঘটনায় পরিণত হয়েছে যেন।
আজকের ‘রাজতন্ত্র’-এর মালিক-গোলাম-পেয়াদা আর
নবরত্নসভার রাজ-বুদ্ধিজীবীরা এতক্ষণে হয়তো বলেই ফেলেছেন -- তো জনাব, দেশটা চলবে কী করে, চালাবেটা কে ? প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ-অজ্ঞ
রাজাদের, তাঁদের
বাচাকাচ্চাদের, বাচ্চা-রাজাদের
বা রাজসন্তানদের
এইরকম শিশুসুলভ প্রশ্নেরও সযত্ন উত্তর রচনা করতে হবে বৈকি। এবং সে উত্তর
হতে হবে চিন্তারহিত সাবালকের উপযোগী। কেন-না সে নিজে চিন্তা করবে না, খুঁজবে না, ভাববে না, শুধু মুখস্থ কথা বলবে এবং ‘উত্তম পশু’-র মতো কুলগুরু পুরুতঠাকুরের
শেখানো ‘গায়ত্রী মন্ত্র’ জপে যাবে, আর এক প্রশ্ন হাজারোভাবে
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যাবে -- রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে তো, নইলে দেশটা চলবে কীভাবে?
তাকিয়ে দেখুন -- খোদ এই
মহাবিশ্বপ্রকৃতিকে পরিচালনা করার জন্য কী কোনো ব্যক্তি-রাজা লাগে ? রাজতন্ত্র লাগে ? থানা-পুলিশ-পাইক-পেয়াদা-উজির-নাজির-হাকিম-হুকুম-কারাগার-মন্ত্রী-মিনিস্টার লাগে ? লাগে না। এগুলো লাগে
পদার্থ-শক্তি-প্রাণের সর্বোচ্চ অভিপ্রকাশ মানুষের বেলায়ই শুধু।
বাঘ-ভাল্লুক-শেয়াল-কুকুর-ইঁদুরের যা লাগে না, শাসকদের তা লাগে। আশ্চর্য ঘটনা বটে। বনের রাজা সিংহ, অথবা মাছের রাজা ইলিশ থেকে
শুরু করে বাতির রাজা ফিলিপস পর্যন্ত যত বানোয়াট কেচ্ছা যে নিছকই ‘রাজা’-র দীপ্তি বাড়ানোর
বুদ্ধিবৃত্তিক ছলনা, সে কথা বোঝা কী এতই কষ্ট ? প্রয়োজনে স্মরণ করুন লোক-ছড়ার ইঙ্গিত – “মাছের রাজা রুই, শাকের রাজা পুঁই, নারীর মধ্যে আমেনার মা, পুরুষের মধ্যে মুই”।
হ্যাঁ, ‘রাজা’ একটি অভ্যাসের নামই বটে।
আনুষ্ঠানিক ‘রাজতন্ত্র’ তো এখন বিলুপ্ত-প্রায় পদার্থ। তার
বদলে গণপতি গণেশের গণতন্ত্রের উত্থানের হাওয়া নতুন করে বইতে লেগেছে শ' দুয়েক বছর ধরে। তথাপি
তথাকথিত নিরক্ষর-অশিক্ষিতদের জন্য মাতব্বর-চেয়ারম্যান তো লাগেই, সর্বোচ্চ শিক্ষালয়ের
জন্যেও একজন বাদশাহি ভাইস-চ্যান্সেলরই লাগে। এতসব দীক্ষায়ন-প্রশিক্ষণ
সত্ত্বেও কিন্তু ‘রাজা’ এবং ‘রাজতন্ত্র’-র বৈধতা ও যুক্তিসিদ্ধতা
সম্পর্কে খটকা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় না। মনের মধ্যে
কোথায় একটা খচখচানি থেকেই যায়। খটকাটা একেবারে আদি থেকেই ছিল বৈকি। মহাভারত তার প্রমাণ।
মহাভারতের যুদ্ধের পরে তাঁর সর্বগ্রহণযোগ্যতার কারণে সকলেই যুধিষ্ঠিরকে ‘রাজা’ হওয়ার জন্য অন্তহীন
কাকুতি-মিনতি করেই চলেছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির ছিলেন অনড়। ‘রাজা’ হতে চাননি তিনি মোটেও।
তিনি বলছিলেন তিনি ধর্ম-জগতের লোক, রাজা তিনি হতে পারবেন না। মহাভারতের ‘শান্তিপর্ব’-এর গোড়ায় অর্জুনকে তিনি
বলছিলেন: “আমি রাজ্যলোলুপ হইয়াই পাপপঙ্কে লিপ্ত হইয়াছি।
... অতএব আমি সমস্ত রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগপূর্বক শোকদুঃখবিবর্জিত হইয়া
অরণ্যে গমন করিব। আমার
রাজ্য বা উপভোগ্য দ্রব্যে কিছুমাত্র অভিলাশ নাই। অতঃপর তুমিই নির্বিঘ্নে এই পৃথিবী শাসন
করো।"
যুধিষ্ঠিরের এই একান্ত
উপলব্ধির উত্তরে নিতান্তই রুষ্ট অর্জুনের বক্তব্য ছিল খুবই আক্রমণাত্মক ও সুস্পষ্ট
এবং তাতে চিরন্তন ক্ষত্রিয়ধর্ম তথা কর্তৃত্বধর্মের মহাসারকথাই
ফুটে ওঠে – “যদি রাজধর্মে দ্বেষ প্রকাশ
করিয়া আলস্যে কালহরণ করিবেন, তবে কি নিমিত্ত ধৃতরাষ্ট্রপক্ষীয় বীরগণকে বিনাশ
করিলেন ? ক্ষাত্রধর্মাবলম্বী
ব্যক্তিরা মিত্রের প্রতিও ক্ষমা, অনুকম্পা, কারুণ্য বা অনৃশংসতা প্রকাশ করেন না। ... ক্ষত্রিয়গণ হিংসার্থই
জন্মগ্রহণ করেন। হিংসাই তাঁহাদের একমাত্র অবলম্বন, সুতরাং সেই সহজ-হিংসাধর্মের ও তাহার সৃষ্টিকর্তার
নিন্দা করা ক্ষত্রিয়ের নিতান্ত অকর্তব্য।" (মহাভারত, ২০০১ সালে প্রকাশিত
কলকাতার 'তুলিকলম
প্রকাশনী'-র রাজ-সংস্করণ)
ক্ষত্রিয়/শাসক/রাজনীতিবিদ এবং তাদের
শাসনযন্ত্র তো আজকের দিনেও এমনকি বন্ধুর প্রতিও “ক্ষমা, অনুকম্পা, কারুণ্য বা অনৃশংসতা” প্রকাশ করে না, তা তো সমকালীন জাতীয় আন্তর্জাতিক
রাজনীতির দিকে তাকালেই বোঝা জলজ্যান্ত বোঝা যায়। ‘রাজনীতিতে চিরস্থায়ী
শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই’ জাতীয় কথা তো আর এমনিতেই রটেনি! আদি ক্ষত্রিয় অর্জুন থেকেই
এইসব ধারণার উত্পত্তি। কিন্তু যুধিষ্ঠির তাঁর কথায় অনড়। রাজা হওয়ার যুক্তিপ্রণালী
কিছুতেই তাঁর গ্রাহ্য হয় না— হওয়ার কথা না বলেই।
শেষপর্যন্ত রাজ-রাজত্বের
যুক্তিসিদ্ধতা কীসের উপরে দাঁড়াচ্ছে সেটাই আপাতত আমাদের দেখার বিষয়। তো অর্জুনের যে নিজের
ক্ষত্রিয়ধর্ম নিয়ে গর্ব, সেই গর্ব নিয়ে ‘দেবত্ব’ অর্জন করা যায়
না, ‘দেবলোকে’ যাওয়া
যায় না, সে কথাই তুলে ধরেন
যুধিষ্ঠির। অনেক অনেক কথার পর অর্জুনকে এক পর্যায়ে তিনি বলেন – “যে ভূমিপতি এই অখিল
ভূমণ্ডল মধ্যে একাধিপত্য বিস্তার করেন, তাঁহারও এক ভিন্ন দ্বিতীয় উদর নাই। তবে তুমি কি নিমিত্ত বিপুল
রাজ্যভোগের প্রশংসা করিতেছ ? ... অতএব তুমি অগ্রে উদরকে পরাজিত করো, তাহা হইলেই তোমার সমুদয় পৃথিবী পরাজয়
করা হইবে। ... রাজ্যালাভ ও রাজ্যরক্ষা এই উভয়েই ধর্ম ও অধর্ম আছে, অতএব উহা পরিত্যাগ করিয়া মহদ্ভার হইতে
বিমুক্ত হও। ... যাহাদের বর্ণ ও আশ্রমাদির অভিমান থাকে, তাহারা পিতৃলোক, আর যাহারা অভিমানশূন্য, তাহারা দেবলোকে গমন করিয়া থাকে”।
কী সাংঘাতিক কথা। দেখা যাচ্ছে, বর্ণপ্রথার শ্রেষ্ঠত্বের
ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে যে রাজতন্ত্র, খোদ সেই “বর্ণ ও আশ্রমের অভিমান”
যুধিষ্ঠির আর বহন করতে প্রস্তুত নন। আর এই অভিমান না-থাকলে যে ‘রাজত্ব’-ই অর্জন করা যায় না, সেই গুরুতর সত্যের প্রতিও এভাবে তিনি ভাবিকালের
মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে বসে থাকেন। ‘রাজত্ব’ অর্জনের চেয়ে ‘দেবত্ব’ অর্জনের দিকেই তাঁর ঝোঁক। ফলত তাঁর শোক, আক্ষেপ, অনুতাপ ও পাপবোধ
কিছুতেই প্রশমিত হয় না, বারংবার উথলে উঠতে থাকে। বেদব্যাসের কাছে তিনি অতঃপর এই ভয়াবহ সত্য
উচ্চারণ করতে ছাড়েন না যে ‘রাজা’ এবং ‘ধর্ম’, ‘রাজত্ব’ ও ‘ধর্মবোধ’ আসলে পরস্পরের বিরোধী – “ধর্মচর্যা ও রাজ্যরক্ষা এই উভয় পরস্পর বিরুদ্ধ, অতএব এক ব্যক্তি কীরূপে
ধর্মরক্ষা ও রাজ্যভার গ্রহণ করিতে পারে, নিরন্তর এই চিন্তা করিয়া আমি মোহে বারংবার অভিভূত
হইতেছি।"
নকুল-সহদেব-দ্রৌপদী-ভীমের
এবং ঋষি দেবস্থান ও
মহর্ষি ব্যাসদেবের এবং সর্বোপরি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বহু বহু প্রকার, উপর্যুপরি, অনুরোধ-উপরোধ-যুক্তি-তর্ক-দৃষ্টান্ত
ও উত্তেজনা-উক্তি এবং বিশেষত
মহর্ষি বৈশম্পায়ন বেদব্যাস কর্তৃক প্রায়শ্চিত্ত পাওয়ার উপায় বর্ণনার পর
যুধিষ্ঠির অবশ্য রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। কিন্তু সংশয় শোক তাঁর পিছু ছাড়ে না কিছুতেই। তখন বহু কিছুর পর
মহর্ষি বৈশম্পায়নের পরামর্শে সবাই মিলে তাঁকে নিয়ে যান ‘সর্বজ্ঞ ধর্মবেত্তা’ ‘কুরুকুলপিতামহ বৃদ্ধ ভীষ্মের নিকট’ যুধিষ্ঠিরের ‘ধর্মগত সংশয় নিরাকরণ’ করার জন্য, সবিস্তারে রাজধর্ম
সম্পর্কে জানার জন্য। সেখানে ভীষ্ম কর্তৃক নানারকম রাজধর্মবন্দনা এবং রাজার
কর্তব্য-অকর্তব্য প্রভৃতি শোনার পরও যুধিষ্ঠির সংশয়মুক্ত হন না; বরং তিনি এবার সেই মোক্ষম, একেবারে গোড়ার প্রশ্নটি
উত্থাপন করেন
– “পিতামহ! ‘রাজা’ এই শব্দটি কীরূপে
সমুত্পন্ন হইল ?
রাজার
হস্ত, গ্রীবা, পৃষ্ঠ, মুখ, উদর, শুক্র, অস্থি, মজ্জা, মাংস, রক্ত, নিঃশ্বাস, উচ্ছ্বাস, প্রাণ, শরীর, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়, সুখ, দুঃখ, জন্ম ও মরণ যেরূপ, প্রজাগণেরও তদ্রূপ। তবে
রাজা কিরূপে একাকী অসংখ্য বিশিষ্টবুদ্ধি মহাবলপরাক্রান্ত পুরুষের উপর আধিপত্য করিয়া
সমুদয় পৃথিবী পালন করিতে সমর্থ হয়েন? সকল লোকে কি নিমিত্ত রাজার প্রসাদলাভের আকাঙ্ক্ষা করে ... ?” এ প্রশ্ন তো চিরন্তন
স্বাধীনতাপরায়ণেরই বটে।
‘রাজা’-র এবং ‘প্রজা’-র মধ্যে কী এমন দৈহিক-প্রাকৃতিক
পার্থক্য আছে যে, একজন মাত্র ব্যক্তি কোটি কোটি মানুষের ‘রাজা’ হয়ে বসে থাকেন ? আর লোকে তাঁকে মানেই-বা কী কারণে? গুরুতর এই প্রশ্নের
উত্তরে ভীষ্মদেব কিছুই লুকান না, ফাঁস করে দেন রাজতন্ত্রের গোড়ার গুমোর।
একটু ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও, এমনকি ‘রাজা’-দের দিক থেকে হলেও মহাজ্ঞানী
ভীষ্মদেব সেই স্মৃতিকথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বয়ান করেন কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ-পরবর্তী
কলিযুগের আদি রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে। এই পৃথিবীর আদিতে যে অরাজ ছিল তার এবং সেই
অরাজকে বলপ্রয়োগ ও শাস্ত্রপ্রয়োগের মাধ্যমে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত নয়া
রাজতন্ত্রের, আদি বৃত্তান্ত।
ভীষ্মদেবের কথায় যা বোঝা
গেল: আদি সেই অরাজকে ভেঙে ফেলে দেবতারা যে আদি দেবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন তা ছিল
মনুষ্যশ্রমনির্ভর। মানুষের প্রদত্ত ‘হোমাদি’ স্বরূপ অন্নেই দেবতাদের গ্রাসাচ্ছাদন হতে এবং সেটাকেই
দেবতারা বেদের নাম দিয়ে ‘ধর্ম’ বলে মেলা দিন চালিয়েছেন। কিন্তু মনুষ্যসমাজ এক পর্যায়ে যখন
তা আর মানল না, তখন দেবকুলের মুখে এই
মর্মে অন্নাভাবের হাহাকার শোনা গেল -- নরলোকে আর বেদ নাই; নরলোকে আর ধর্ম নাই; সব বিনষ্ট হয়ে গেছে; "মানবদিগের ক্রিয়াকলাপ
উচ্ছিন্ন হওয়াতে আমাদিগের অন্নাভাব হইয়াছে"; শুধু তাই নয়, সেই অন্নাভাবের পরিণামে দেবতারা আর দেবত্বই বজায় রাখতে
পারছেন না বলে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে আক্ষেপ করছেন – “অতঃপর আমরা মনুষ্যের ন্যায় অবস্থাপ্রাপ্ত
হইলাম”।
মাঝখানে একটু টুকে রাখি – ‘দেবত্ব’ বা বৈষম্য টিকিয়ে রাখার
শর্তই হচ্ছে 'প্রিভিলেজ' বা বিশেষাধিকারতন্ত্র, অর্থাত্ অন্যের (মানুষের)
শ্রমে বসে বসে খাওয়া। বসে খাওয়ার ‘বিশেষ অধিকার’ না-থাকলে দেবতাও আর দেবতা থাকেন না, তাঁর অন্নাভাব ঘটে, তিনি মনুষ্যদশাপ্রাপ্ত
হন।
তো, ব্রহ্মা যেন নরলোক থেকে
বেদ ও ধর্ম ধ্বংস হতে না দেন; একটা কিছু উপায় যেন তিনি ‘বুদ্ধি’
খাটিয়ে,
“স্বীয়
বুদ্ধিপ্রভাবে” বের করেন— দেবতাগণের এই সম্মিলিত নালিশ এবং আহাজারির মুখে ব্রহ্মা
তাঁদের আশ্বস্ত করেন -- নো টেনশন, মুনষ্যজাতিকে আবার বেদ ও ধর্ম মানতে বাধ্য
করা হবে। কিন্তু কীভাবে ? রাজাপ্রথার জোরে, রাজতন্ত্রের জোরে। কিন্তু
রাজতন্ত্র চলবে কীসের জোরে ? রাজতন্ত্র চলে কীসের জোরে ? কেন — শাস্ত্রের জোরে ! স্বয়ং ব্রহ্মা সে উপায় বের করেন ‘বুদ্ধিবলে’। আদিতম ‘শাস্ত্র’ রচনা করে বসেন ‘প্রজাপতি’ ব্রহ্মা — সৃষ্টি করেন তিনি ‘প্রকৃষ্টরূপে জাত’ বিশেষ ধরনের মানুষকে যারা অতঃপর ‘প্রজা’ হিসাবে পরিচিত হবে।
আদিতম ‘শাস্ত্র’ আর ‘বুদ্ধিজীবী’-র সন্ধান তাহলে মহাভারতেই
পাওয়া গেল — তিনি খোদ
ব্রহ্মা। জানা গেল-- তাঁর কাজ হচ্ছে শাসকদের অনুকূলে বৈষম্য
ও বিশোধিকারতন্ত্র টিকিয়ে রাখা — প্রজাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে এবং তাতে কাজ না-হলে
শাস্ত্রের জোর, শাস্তির জোর ও ভয়ের জোর খাটানোর ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়ে। এভাবে অবশেষে বুদ্ধির জোরে এবং গায়ের জোরে দুর্দান্ত ও
দুর্দমনীয় মানুষকে শান্ত ও দমিত করার ব্যবস্থা হলে -- তাঁদেরকে এই পৃথিবীতে রাজার রাজত্ব মানানো হলে, রাজবশীভূত করা হলে আদিতম শাস্ত্রের
জোরে এবং ‘দণ্ড’-ই হচ্ছে এই ভূভারতের আদিতম
শাস্ত্র। আর সেই শাস্ত্র চলে রাজা এবং রাজবুদ্ধিজীবীর যুগলবন্দিতে। এবার সেই চাঞ্চল্যকর ইতিহাসের
সারবিবরণী হুবহু শোনা যাক কুরুকুলপিতামহ সর্বজ্ঞ বৃদ্ধ ভীষ্মের মুখে।
ভীষ্ম কহিলেন, “ধর্মরাজ ! সত্যযুগে প্রথমে
যেরূপে রাজত্বের সৃষ্টি হয়, তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ করো। সর্বপ্রথমে
পৃথিবীতে রাজ্য,
রাজা, দণ্ড বা দণ্ডার্হ ব্যক্তি কিছুই ছিল না।
মনুষ্যেরা একমাত্র ধর্ম অবলম্বনপূর্বক পরস্পরকে রক্ষা করিত। মানবগণ এইরূপে
কিছুদিন কালযাপন করিয়া পরিশেষে পরস্পরের রক্ষণাবেক্ষণ নিতান্ত কষ্টকর বোধ করিতে
লাগিল। ওই সময় মোহ তাহাদিগের মনোমন্দিরে প্রবিষ্ট হইল। মোহের আবির্ভাববশত ক্রমশ জ্ঞান ও ধর্মের
লোপ হইতে লাগিল এবং মানবগণ ক্রমে ক্রমে লোভপরতন্ত্র, পরধনগ্রহণতত্পর, কামপরায়ণ, বিষয়াসক্ত ও কার্য্যাকার্য্যবিবেকশূন্য হইয়া উঠিল। ...
নরলোক এইরূপে কুমার্গগামী হইলে বেদ বিনষ্ট ও ধর্ম এককালে বিলুপ্ত হইয়া গেল।
তখন দেবগণ নিতান্ত
শঙ্কিতচিত্তে লোকপিতামহ ভগবান ব্রহ্মার শরণাপন্ন হইয়া তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া
কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্ ! লোভমোহাদি প্রভৃতি নীচবৃত্তিসমুদয় নরলোকস্থ সনাতন বেদ গ্রাস করাতে আমরা ভীত
হইয়াছি। বেদ ধ্বংস হওয়াতে ধর্মও বিনষ্ট হইয়াছে। অতঃপর আমরা মনুষ্যের ন্যায় অবস্থাপ্রাপ্ত
হইলাম। মানবগণ হোমাদি কার্য দ্বারা ঊর্দ্ধবর্ষী বলিয়া বিখ্যাত ছিল এবং আমরা
বারিবর্ষণাদি দ্বারা অধোবর্ষী বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলাম; কিন্তু এক্ষণে মানবদিগের ক্রিয়াকলাপ উচ্ছিন্ন
হওয়াতে আমাদিগের অন্নাভাব হইয়াছে। অতএব যাহাতে আপনার প্রভাবে সম্ভত এই প্রাকৃতিক নিয়ম ধ্বংস না
হয়, আপনি স্বীয়
বুদ্ধিপ্রভাবে তাহার সদুপায় উদ্ভাবন করুন।'
তখন ভগবান্
কমলযোনি (ব্রহ্মা) সুরগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে দেবগণ! তোমরা ভীত হইও
না; আমি অচিরাত
উহার উপায় চিন্তা করিতেছি।” প্রজাপতি দেবগণকে এই কথা
বলে বুদ্ধিবলে একটি লক্ষ অধ্যায়যুক্ত নীতিশাস্ত্র রচনা করলেন। ...
ভগবান্ পদ্মযোনি ওই নীতিশাস্ত্র
প্রণীত করিয়া ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণকে হৃষ্টমনে কহিলেন, “সুরগণ! আমি ত্রিবর্গ
সংস্থাপন ও লোকের উপকার-সাধনের নিমিত্ত বাক্যের সারস্বরূপ এই নীতিশাস্ত্র
উদ্ভাবন করিয়াছি। ইহা পাঠ করিলে নিগ্রহ ও অনুগ্রহ দর্শনপূর্বক
লোকরক্ষা করিবার বুদ্ধি জন্মিবে। এই শাস্ত্রদ্বারা জগতের যাবতীয় লোক
দণ্ডপ্রভাবে পুরুষার্থ ফললাভে সমর্থ হইবে; অতএব ইহার নাম দণ্ডনীতি হইল।
এতটা সুস্পষ্ট কথা আর কী হতে পারে।
পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, ভূভারতের আদিতম নীতিশাস্ত্রটি হলো ‘দণ্ডনীতি’ এবং যুধিষ্ঠিরকে পিতামহ ভীষ্মদেব আরো বলেছিলেন, “দণ্ডপ্রভাবেই জনসমাজে নীতি ও
ধর্ম্মের প্রচার হইয়াছে”। তার মানে, ‘দণ্ডনীতি’-ই যে কর্তৃত্বতন্ত্রের
আদিতম নীতিশাস্ত্র শুধু তা-ই নয়, এ জিনিস জনসমাজে প্রচলিত নীতিবোধের জনকও বটে। এবং
এই নীতিবোধের প্রধান দুই উপায় হচ্ছে “নিগ্রহ ও অনুগ্রহ”। এ-ই হলে সেই “নিমিত্ত”, যে নিমিত্তে “সকল লোকে ... রাজার প্রসাদলাভের আকাঙ্ক্ষা করে”। নইলে যে মার খেতে হবে, নিগৃহীত হতে হবে। তারচেয়ে অনুগ্রহ-তাড়নাই
বাস্তবোচিত।
দণ্ডনীতি কী বস্তু, সমাজ-সংসারে এর কাজ কী তাও
যুধিষ্ঠিরকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলেছিলেন অর্জুন – “দণ্ড প্রজাদিগকে শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকে। সকলে নিদ্রায় অভিভূত হইলেও দণ্ড
একাকী জাগরিত থাকে। পণ্ডিতেরা দণ্ডকে প্রধান ধর্ম বলিয়া নির্দ্দেশ
করিয়াছেন”।
এসব কথা আজকের সংসদীয় গণতন্ত্র ও
আইনের শাসনের অত্যাধুনিক প্রবক্তাদের মুখে শোনাও, ‘সভ্যতা’-র উষালগ্নের দণ্ড বা আইন প্রয়োগকারী সত্তা
অর্জুনের মুখে শোনাও তা-ই। কেন-না আইনের শাসন তথা দণ্ডনীতি
প্রতিষ্ঠার নামই ‘সভ্যতা’ এবং সত্যিকারের সভ্যতার নামে
এই জিনিসই চলছে গত পাঁচ হাজার বছরের ‘কর্তৃত্বতান্ত্রিক সভ্যতা’ জুড়ে। এই দণ্ডনির্ভর সভ্যতায় দণ্ডই ‘প্রধান
ধর্ম’ বটে, তবে তা ‘মনুষ্যধর্ম’ নয়, ‘শাস্ত্রধর্ম’ তথা ‘রাজধর্ম’ এবং সেই কারণেই বিপরীত দিক থেকে ‘প্রজা’-র ধর্মও বটে। অন্য কথায় এ বস্তুই
আজকের ‘সভ্য’যুগের রাষ্ট্রের ধর্ম। আইনের
ধর্মই তো দণ্ড। শাসনের ধর্মই তো দণ্ড। এই আইনের শাসনকে কখনও সত্যিকারের
মনুষ্যধর্মের নামে চালানো যায় না। একে চালাতে হয় শাস্ত্রধর্মের নামে। এবং
পুনরাবৃত্তি করতেই হবে, আদিতম শাস্ত্রধর্মের নামই দণ্ডশাস্ত্র বা দণ্ডধর্ম
বা কর্তৃত্বনীতি বা কর্তৃত্বধর্ম। এই জিনিসটিকেই কর্তৃত্বতন্ত্র মানুষের ধর্ম এবং প্রকৃতির ধর্ম বলে
চালাতে চায়।
যুধিষ্ঠিরকে অর্জুন বলছেন, ভয়ের রাজত্বই হচ্ছে
দণ্ডনীতির প্রাণ: “দণ্ডপ্রভাবে ধন ও ধান্য রক্ষিত হয়। ...
অনেকানেক পাপপরায়ণ পামরেরা রাজদণ্ডভয়ে, অনেকে যমদণ্ডভয়ে, অনেকে পরলোকভয়ে এবং অনেকে লোকভয়ে পাপানুষ্ঠান করিতে
পারে না। অনেকে কেবল দণ্ডভয়েই পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে না। ফলত সংসারে
প্রায় সমুদয় কার্য্যই দণ্ডভয়ে নির্বাহ হইতেছে। ... ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও ভিক্ষুক ইহারা দণ্ডের ভয়ে স্ব স্ব পথে অবস্থান
করিতেছেন। ভীত না হইলে কেহই
যজ্ঞানুষ্ঠান, দান ও নিয়ম প্রতিপালন
করিতে ইচ্ছা করে না।“ তত্কালীন
প্রধান সেনাপতি অর্জুনের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। দণ্ডনীতি মানেই হচ্ছে দমননীতি এবং
শাসন-ত্রাসনের নীতি: “দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে
নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে"। আর কার জন্য কোন দণ্ড সমুচিত তার মোক্ষম বিধানও
প্রস্তুত-- “দণ্ড সংসার রক্ষা না করিলে সমুদয়ই গাঢ়
অন্ধকারে নিমগ্ন হইত। দণ্ড দুর্দান্তদিগকে দমন ও দুর্বিনীত ব্যক্তিদিগকে শাসন করিয়া থাকে। দমন ও
শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। ব্রাহ্মণের তিরস্কার, ক্ষত্রিয়ের বেতন প্রদান না
করা, বৈশ্যের
রাজসমীপে দ্রব্যজাত সমর্পণ এবং শূদ্রের সর্বস্বাপহরণই সমুচিত দণ্ড।"
কি সুনির্দিষ্ট, কি তীব্রসূচিমুখ এই
দণ্ডনীতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আর শাসনের প্রশ্নে সে কাউকেই ছাড়ে না। শাসনযন্ত্রের হাতে তথা শাসকের
হাতে, রাষ্ট্রযন্ত্রের
ম্যানেজারদের হাতে ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত কারও কোনো নিস্তার নাই।
পার্থক্য আছে বৈকি। ব্রাহ্মণের জন্য “তিরস্কার”-ই যথেষ্ট। আর শূদ্রকে শায়েস্তা করার
জন্য চাই তার “সর্বস্ব অপহরণ? করা।” (সেলিম রেজা নিউটন)
প্রাক-ঐতিহাসিককালে
মানুষের আত্মরক্ষার প্রধান উপকরণ ছিল দণ্ড। এক্কেবারে প্রথমদিকে ছিল শক্ত কাঠের লাঠি, পরবর্তী
সময়ে হাড় বা ধাতুর তৈরি দণ্ড বা অস্ত্র।লগুড়, গাছের গুঁড়ি, বীণার ছড়, যষ্টি, নৌকার
দাঁড় লাঙলের ঈষ, হাত বা ভুজ – সবই
দণ্ড। সুস্থিত সমাজ ও
রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজদণ্ড হল আইন ও বিচারের প্রতীক। জগতের সকলকে এ দমন করে, শাসন বা সংযত করে –
তাই এর নাম দণ্ড। তাই শাসক হলেন দণ্ডধারী বা দণ্ডধর বা দণ্ডপাণি। মনু বলেছেন – লঘু পাপে
লঘু দণ্ড, গুরু পাপে গুরু দণ্ড। দণ্ড বিধান এবং দণ্ড প্রণয়ন
রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম কর্তব্য।
মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের
১৮ নম্বর শ্লোকে মনু বলছেন –“দণ্ড শাস্তি প্রজাঃ সর্বা এবাভিরক্ষতি।/দণ্ড সুপ্তেষু
জাগর্তি দণ্ডং ধর্মং বিদূর্বুধাঃ ।।” অর্থাৎ দণ্ডই প্রজাদের শাসন করে, দণ্ডই তাদের রক্ষা করে, রক্ষক পুরুষেরা নিদ্রিত
থাকলে দণ্ডই জেগে থাকে।
পণ্ডিতগণ
দণ্ডকেই ধর্ম বলে জানেন।অপরদিকে দণ্ড না-থাকলে কী হত সে বিষয়েও মনু বলেছেন – “যদি ন প্রণয়েদ্রাজা দণ্ডং দণ্ড্যেষ্বতন্দ্রিতঃ।/শূলে মৎসানিবাপক্ষ্যন্
দূর্বলান বলবত্তরা।।” (মনুসংহিতা – সপ্তম অধায় – শ্লোক ২০) অর্থাৎ রাজা যদি অনলসভাবে দণ্ডনীয় ব্যক্তির
দণ্ডবিধান না করতেন তবে শূলে মৎস্যের ন্যায় বলবান ব্যক্তিরা দুর্বল ব্যক্তিগণকে উৎপীড়ন
করত। আরও যা যা ঘটত সেগুলিও
মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের ২১ নম্বর শ্লোকে উল্লেখ আছে – “অদ্যাৎ
কাকঃ পুরোডাশং শ্বাবলিহ্যাদ্ধবিস্তথা।/স্বাম্যঞ্চ ন স্যাৎ কস্মিংশ্চিৎ প্রবর্তেতাধরোত্তরম্।।” অর্থাৎ
দণ্ড না হলে কাক যজ্ঞীয় পিঠা ভক্ষণ করত, কুকুর যজ্ঞীয় হবি
লেহন করত এবং কারও কোনো বিষয়ে অধিকার থাকত না। এক ওলট-পালট অবস্থার সৃষ্টি হত।মনু মনে করেন, “ সর্বো
দণ্ডজিতো লোকো দুর্লভো হি শুচির্নরঃ।/দণ্ডস্য হি ভয়াৎ সর্বং জগদ্ভোগায় কল্পতে।।”(মনুসংহিতা
– সপ্তম অধ্যায় – শ্লোক ২২) অর্থাৎ দণ্ডের দ্বারাই সকল মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, কারণ স্বভাবশুচি লোক দুর্লভ। দণ্ডেরই ভয়ে সমগ্র জগৎ ভোগে সমর্থ হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি লঘু পাপে
লঘু দণ্ড, গুরু পাপে গুরু দণ্ড।কোনো অপরাধ লঘু কোন অপরাধ গুরু, তা সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়।
শাস্তির
ধরনও বদলে যায়।
এ
বড়ো আপেক্ষিক ব্যাপার।
কোন
অন্যায়ের কোন শাস্তি হবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সেই রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থার উপর, যা শাসক
দ্বারা নির্দেশিত।
লঘু
পাপেও যে গুরু দণ্ড দেওয়া হয় এমন উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি আছে। প্রাচীন ভারতে ভয়ংকর আঘাতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধ
– যেমন বাবা-মা-ভাই-বোন-শিক্ষক-গুরু এবং সন্ন্যাসী বা তপস্বীর মৃত্যু ঘটালে আগুনে পুড়িয়ে অথবা জলে ডুবিয়ে
অথবা বিষ খাইয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রযুক্ত হত। প্রাচীন রোমেও পিতৃহত্যা, স্বজনহত্যা বা রাজহত্যার অপরাধীকে
বুনো কুকুর বা বিষধর সাপের সঙ্গে থলির মধ্যে ঢুকিয়ে হত্যা করা হত। ১৭৯৫-৫০ খ্রিস্টপূর্বে
হামুরাবির আইন অনুসারে ব্যাবিলনে বিক্রেতা যদি মদ বিক্রিতে মাপে কম দিত তাহলে তাকে
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। প্রাচীন ভারতে নরহত্যা ছাড়া যেসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হত, তার মধ্যে আছে – রাজদ্রোহ, মানী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে অপহরণ – বিশেষত নারীহরণ, উচ্চবর্ণের স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্ক, রাজাদেশ জাল বা নকল করা, চুরি ও চোরাই মালসহ ধরা পড়া, রাজকোশ থেকে মণিমাণিক্য চুরি, চাষের জন্য তৈরি বাঁধ বা সেতু নষ্ট করা, রাজার হাতি-ঘোড়া-রথ চুরি করা, ঘরবাড়ি বা খেতখামারে আগুন লাগানো, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীর মৃতদেহ সৎকার করা ইত্যাদি।এখানেই শেষ নয় – বৈদিক ও পরবর্তী যুগে ব্রাহ্মণ ছিল অবধ্য। ব্রাহ্মণগণ প্রাণদণ্ডার্হ কোনো অপরাধ করলে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে দেশ থেকে নির্বাসন দেওয়া হত। তখনকার সময়ে ‘দেশ’ বলতে ভারত বহির্ভূত বোঝাত না, বোঝাতো অন্য রাজ্য। অর্থাৎ কাম্পিল্যের নির্বাসিত ব্রাহ্মণ আরামসে মগধে বসবাস করতে কোনো অসুবিধা ছিল না।প্রাচীন গ্রিসেও ‘nobleman’-দের ক্ষেত্রেও মৃত্যুদণ্ডের বদলে নির্বাসন দেওয়া হত।তবে সেই নির্বাসিত ব্যক্তিটি যদি পুনরায় রাষ্ট্রে প্রবেশ করলে তার সম্পত্তি হরণ করে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত।তবে প্রাচীন ভারতে শূদ্ররাই বেশি শাস্তি ভোগ করত।ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা শূদ্রদের তুলনায় মৃত্যুদণ্ড কমই হত।
শাস্তির নামে মানুষ যে কত নৃশংস
হত তার নমুনা ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে।
হত্যার
ইতিহাসে রক্তাক্ত হয়ে আছে মানুষের সভ্যতা। ধমকে, দাবিয়ে রাখার সভ্যতা। শুষে খাওয়ার সভ্যতা। ছোটো মাছকে গিলে খাওয়ার সভ্যতা। শাস্তি কেন দেওয়া হত? ‘সবক’
শেখানোর জন্য ? বিশ্বাস করি না। মৃত্যুদণ্ড যিনি দেন, মৃত্যুদণ্ড
যিনি কার্যকর করেন, মৃত্যুদণ্ডের মতো হত্যাকাণ্ড যে বা যাঁরা
সমর্থন করেন উল্লসিত হন তাঁরা প্রত্যেকেই হত্যাকারী। হত্যার সপক্ষে যাঁরা বক্তৃতা দেন, আসলে তাদের
অন্তরের ভিতর হত্যার
স্পৃহা জেগেই থাকে, অবচেতন মনে।
দেশদ্রোহী
হলে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড। দেশদ্রোহী এবং দেশপ্রেমী – এই দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়
মানুষ।
কেন ? কে দেশদ্রোহী
? কেই-বা দেশপ্রেমী ? যদি কিষাণজি দেশদ্রোহী হন,
যদি কাসভ দেশদ্রোহী হন, যদি আফজল গুরু দেশদ্রোহী
হন – তবে ব্রিটিশ-ভারতে কাকোরি ষড়যন্ত্র
মামলায় ধৃত রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিসমিল ও রোওশনলাল, লাহোর ষড়যন্ত্র
মামলায় ধৃত গণেশ পিংলে ও কর্তার সিং, দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলায়
ধৃত বসন্ত বিশ্বাস, আলিপুর বোমা মামলায় ধৃত কানাইলাল দত্ত
ও সত্যেন বসু, পুনা কালেকটর হত্যার দায়ে ধৃত দামোদর চাপেকর
ও বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর প্রমুখ ব্যক্তিদের দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসবাদীদের কী বলবেন
? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক
গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনী। এটি অখন্ড পাকিস্তানপন্থী বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি অভিবাসীদের
নিয়ে গঠিত হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় প্রথম
রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের কাছে অপরাধী হলেও অখণ্ড পাকিস্তানের কাছে চরম আনুগত্য বইকি
! রেজাকার বা
রাজাকার মানে স্বেচ্ছাসেবী, এই রাজাকারেরা হলেন গোলাম আজম, আব্বাস আলি খান (জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের
সিনিয়র নায়েবে আমির), মতিউর রহমান
নিজামী, আলি আহসান মুহাম্মদ
মুজাহিদ (ইসলামী
ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান), মো: কামরুজ্জামান (জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল), দেলোয়ার হোসেন সাঈদি (জামাতে ইসলামীর মজলিসের শুরার সদস্য), আবদুল কাদির মোল্লা (জামাতে
ইসলামের প্রচার সম্পাদক), ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী – যাদের অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি
আনুগত্য দেখানোর অভিযোগে অনেককেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রেজাকার বা রাজাকার বাহিনী কোরান ছুঁয়ে শপথ নিতেন, "I shall bear true
allegiance to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend
Pakistan, if necessary, with my life." অর্থাৎ, "আমি আইনের মাধ্যমে
প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং জীবন দিয়ে হলেও
পাকিস্তানকে রক্ষা করব।" ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বর তারিখের আগে যারা ছিলেন পাকিস্তানের দেশপ্রেমী, ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বর তারিখের পর
থেকে তারাই দেশদ্রোহী হয়ে গেলেন। অসম সাহসিকতার জন্য যাদের পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল
, তাদেরই কপালে জুটল মৃত্যুদণ্ড। অথচ ভাবুন তো, যদি কোনো কারণে মুক্তিযুদ্ধ
সফল না হত এই কাদের মোল্লারাই অখণ্ড পাকিস্তানের ঘরে ঘরে দেশপ্রেমী হিসাবে পূজিত
হতেন। তাই না ?
১৯৪৭ সালের আগে ভারত কবে ভারতীয়দের
ছিল ? প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছিল, তার আগে
প্রায় ৭০০ বছর মুসলিম শাসকরা শাসন করেছিল, তারও আগে বেদের
যুগ পর্যন্ত ভারত বিদেশিদের কর্তৃক শাসিত হয়েছে।এমনকি যে আর্যদের নিয়ে আমাদের অহংকার, সেই আর্যরা
কিন্তু ভারতের ভূমিপুত্র নন, ভারত বংশোদ্ভূত নয় --
বিদেশিই।
তখন
বিপ্লবীরা কোথায় ছিলেন ? অত্যাচার কোন্ শাসক করেননি ! তাহলে
কার বা কাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ ? দেশদ্রোহিতাই-বা কেন ? ব্রিটিশ-ভারতে
বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের মৃত্যুদণ্ড যদি অনৈতিক হয়, অন্যদের
ক্ষেত্রে সেটা উলটো হবে কেন ! অর্থাৎ দেশদ্রোহিতা বা সন্ত্রাসবাদিতা
যেহেতু দেশ-কাল বিশেষে আপেক্ষিক, সেই কারণে সেইসব কোনো ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডও মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
দেশপ্রেমের প্রসঙ্গে বলব, কারা দেশপ্রেমী
? যাঁরা নানা ছলনায় কোটি কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে
প্রতারণা করেন তাঁরা দেশপ্রেমী ? যেসব নিয়োগ কর্তৃপক্ষ শ্রমিক
বা কর্মচারীদের রক্ত শুষে খায় তাঁরা দেশপ্রেমী ? যেসব শ্রমিক
বা কর্মচারীরা নানা কায়দায় শ্রম চুরি করে, মালপত্র ঝেঁড়ে ফাঁক
করে দেয় তাঁরা দেশপ্রেমী ? যে সব মাননীয় নাগরিকরা কালো টাকার
পাহাড় জমান তাঁরা দেশপ্রেমী ? যেসব মাননীয় নাগরিকরা আয় বহির্ভূত
প্রচুর অর্থ সুইস ব্যাঙ্কে জমা রেখে আসেন তাঁরা দেশপ্রেমী ? আয়কর দপ্তরের যেসব অসৎ অফিসারেরা অসৎ ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার আয়কর
ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নিজে ‘লাল’ হয়ে সরকারকে দিনের পর দিন ‘কালো’ করে চলেছেন তাঁরা দেশপ্রেমী ? যেসব নির্লজ্জ নাগরিকরা
দেশের যত্রতত্র দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব ছিটিয়ে দেশের সর্বত্র কলুষিত করেন তাঁরা দেশপ্রেমী?
একদা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীকে
জনসমক্ষে প্রকাশ্যে দণ্ড কার্যকর করা হত। সেক্ষেত্রে দণ্ড প্রয়োগের স্থান-সময় আগেভাগে
জানিয়ে দেওয়া হত, যাতে সাধারণ মানুষ যত বেশি সংখ্যক উপস্থিত
থাকতে পারে।
উদ্দেশ্য : যাতে সুস্থ
স্বাভাবিক মানুষেরা অপরাধীর দণ্ড নিজের চোখে দেখে অপরাধ বিষয়ে তার একটা বিরূপ মানসিক
প্রতিক্রিয়া হয় এবং তাতে সামাজিক সুফল মিলবে। না, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এক ইঞ্চিও সামাজিক সুফল
মেলেনি।
হাজার
হাজার বছর ধরে এত নৃশংস কঠোর দিয়েও পৃথিবী অপরাধমুক্ত করা যায়নি। অপরাধ হয়েই চলেছে এবং তা হাজারবার
মৃত্যুদণ্ড দিয়েও অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। কারণ প্রায় সব অপরাধের পিছনে থাকে আর্থ-সামাজিক
সংকট এবং মানসিক বৈকল্য, যার দায় কোনো রাষ্ট্র এড়াতে পারে
না।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি হত্যাকাণ্ড উপমহাদেশের
ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গান্ধির হত্যাকারী ছিলেন তার মতোই একজন উচ্চশ্রেণীর
ব্রাহ্মণ। তার নাম নাথুরাম গডসে।। গান্ধি হত্যাকাণ্ডে গডসের যে যুক্তি ছিল তা তার একার ছিল না। হিন্দুদের
একটি বিরাট অংশ গডসের যুক্তি সঠিক বলে মনে করত। ১৯৩৪ সালের জুলাই থেকে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট
ছয়বার গান্ধিকে হত্যা করার চেষ্টা
করা হয়। নাথুরাম গডসে ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার গান্ধিকে হত্যার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি আবার ১৯৪৮
সালের ২০ জানুয়ারি একই চেষ্টা চালান।
পরপর দু-বার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বার ১৯৪৮
সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি সফল
হন। তিনি মনে করতেন, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগলদের বিরুদ্ধে মারাঠা দস্যু শিবাজি, রাজা রাবণের বিরুদ্ধে হিন্দু বীরদের সহিংস লড়াইয়ের আদর্শ
থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী
আন্দোলনে
অহিংস পথ অবলম্বন করে গান্ধি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেছেন। তাই তাকে হত্যা করা পুণ্যের কাজ। গডসে এ সিদ্ধান্তে আসেন
যে, জাগতিক বিচারে তার পরিণাম যাই হোক, পরজন্মে তিনি মুক্তি পাবেন। শুধু তাই নয়,
গান্ধি হত্যাকাণ্ড সফল হলে তার স্বধর্মের অনুসারী ভারতের
৩০ কোটি হিন্দুও অবিচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি
পাবে। গান্ধি হত্যাকাণ্ডে এগুলোই ছিল নাথুরাম গডসের যুক্তি।
মনে করতেন
-- শিবাজি, রানা প্রতাপ ও গুরু গোবিন্দের মতো ঐতিহাসিক বীর যোদ্ধাদের বিপথগামী দেশপ্রেমিক হিসাবে নিন্দা করে গান্ধিজি
নিজের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেছেন। গান্ধিজি
অহিংস ও সত্যাগ্রহ নীতির নামে দেশে অবর্ণনীয় দুর্দশা ডেকে এনেছেন।
পক্ষান্তরে, রানা প্রতাপ, শিবাজি ও গুরুগোবিন্দ
তাদের জাতিকে যে মুক্তি এনে
দিয়েছিলেন সেজন্য তারা জাতির হূদয়ে চিরজাগরুক হয়ে থাকবেন।
এই হল
নাথুরাম গডসে।
মেরঠে নাথুরাম গডসের
মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হবে বলা হয়েছিল অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে। হিন্দু মহাসভার সভাপতি শুধু
জানিয়েছেন, মন্দিরে নাথুরাম গডসের সঙ্গে থাকবেন অখণ্ড ভারতমাতা। হিন্দু মহাসভার
তরফে চন্দ্রপ্রকাশ কৌশিক বলেছেন, "মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে
নাথুরাম গডসের কোনো ব্যক্তিগত দুশমনি ছিল না। তবুও তিনি গান্ধিজিকে খুন করেছিলেন।
কেন সেই ঘটনা ঘটেছিল, তার তদন্তও হয়নি। কেন হয়নি, সেটা একটা প্রশ্ন। যদি আকবর রোড, হুমায়ুন রোড,
ঔরঙ্গজেব রোড থাকে, তা হলে গডসের নামে কেন
রাস্তা থাকবে না ? কেন তাঁর একটি মূর্তি তৈরি হবে
না।" অর্থাৎ, আপনার কাছে যে টেররিস্ট, আমার কাছে সে বিপ্লবী শহিদ। আপনার কাছে যে গড, আমার কাছে সে গডসে – এরকম ব্যাপার আর কি ! মহাত্মা
গান্ধির ঘাতক নাথুরাম গডসেকে 'দেশপ্রেমিক' বলেছিলেন বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ। সাক্ষী মহারাজ বলেন,
"নাথুরাম গডসে একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধি যতটা
করেছেন দেশের জন্য, গডসের অবদানও ততটা।" পরে অবশ্য চাপে
পড়ে সাক্ষী মহারাজ বলেন, "যদি ভুল করে কিছু বলে থাকি,
তা হলে কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। নাথুরাম গডসে দেশপ্রেমিক নয়। কখনও ছিল
না।" চাপে পড়ে ভুল স্বীকার করা আর শ্রদ্ধা থেকে সরে আসা এক ব্যাপার নয়।গডসের ফাঁসি হয়েছে একথা ঠিক। তবে
তিনি যে চিন্তায় আলোড়িত হতেন সে চিন্তার মৃত্যু হয়নি। এখনও ভারতের কট্টরপন্থি এবং উগ্রবাদী হিন্দু গডসের
চিন্তা ও চেতনায় আলোড়িত হয়। তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
রেহানা জাব্বারি। ইরানের
এই ছাব্বিশ বর্ষীয় নারীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে ধর্ষণ চেষ্টাকারীর বুকে
ছুরি বসানোর অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ইরানের সুপ্রিম কোর্ট। ২৫ অক্টোবর তার
মত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রেহানার ফাঁসির বিরোধিতা করে গোটা বিশ্বের অজস্র
মানবাধিকার সংগঠন। প্রাণভিক্ষার আবেদন জানায় দুনিয়ার অনেক মানুষ। আর মেয়ের বদলে
তাকেই ফাঁসিতে ঝোলানোর মিনতি করেছিলেন রেহানার মা শোলেহ। কিন্তু কোনো কিছুতেই কান
দেয়নি সরকার। মৃত্যুর আগে মাকে শেষ চিঠি লিখে গেছেন রেহানা। মৃত্যুকে তিনি অভিহিত করেছেন নিয়তির বিধান হিসাবে। ফাঁসির পর তার দেহাংশ দান
করার অনুরোধ জানিয়েছেন জন্মদাত্রীকে। রেহানার সেই মর্মস্পর্শী চিঠি গণমাধ্যমের
হাতে তুলে দিয়েছেন মানবাধিকার সংগঠন ও শান্তিকামী গোষ্ঠীর সদস্যরা।
“প্রিয় শোলেহ,
আজ জানতে পারলাম এবার আমার
‘কিসাস’ (ইরানের আইন ব্যবস্থায় কর্মফল বিষয়ক বিধি)-এর
সম্মুখীন হওয়ার সময় হয়েছে। জীবনের শেষ পাতায় যে পৌঁছে গিয়েছি, তা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি ভেবে খারাপ লাগছে। তোমার কি মনে হয়নি
যে এটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল? তুমি দুঃখে ভেঙে পড়েছ
জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তোমার আর বাবার হাতে চুমু খেতে
দাওনি কেন আমায়?
দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে
দিয়েছিল। কেন-না সেই অভিশপ্ত রাতে আমারই তো মরে যাওয়া উচিত ছিল, তাই না? আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল
শহরের কোনো অজ্ঞাত কোনে। কয়েক
দিন পর মর্গে যা শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার। সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার
আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা অবশ্যই ধরা পড়ত না, কারণ
আমাদের না আছে অর্থ, না ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন
শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হত। এটাই যে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাতের আকস্মিক
আঘাত সবকিছু ওলটপালট করে দিল। শহরের কোনো গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে ছুড়ে ফেলা হল এভিন জেলের নিঃসঙ্গ
কুঠুরিতে, আর সেখান থেকে কবরের মতো এই শাহরে
রায় কারাগারের সেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ কোরো না মা, এটাই নিয়তির বিধান। আর তুমি
তো জানো যে মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না।
মা, তুমিই তো শিখিয়েছ অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই
আমাদের জন্ম। তুমি বলেছিলে,
প্রত্যেক
জন্মে আমাদের কাঁধে এক বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া থাকে। মাঝে মাঝে লড়াই করতে হয়, সে শিক্ষা তো তোমার কাছ থেকেই
পেয়েছি। সেই গল্পটা মনে পড়ছে, চাবুকের ঝাপটা সহ্য করতে করতে একবার প্রতিবাদ জানানোর ফলে
আরো নির্মমতার শিকার
হয়েছিল এক ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিবাদ তো সে করেছিল! আমি শিখেছি, সত্যকে প্রতিষ্ঠা
করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে, নালিশ ও ঝগড়াঝাটির মাঝেও যেন
নিজের
নারীসত্তাকে
বিসর্জন না দিই। তোমার মনে আছে মা, কত যত্ন করেই-না মেয়েদের খুঁটিনাটি সহবত শিখিয়েছিলে আমাদের ? কিন্তু তুমি ভুল জানতে, মা। এই ঘটনার সময় আমার সেসব তালিম একেবারেই
কাজে লাগেনি। আদালতে আমায় এক ঠান্ডা মাথার খুনি হিসাবে পেশ করা হয়। কিন্তু আমি চোখের জল
ফেলিনি। ভিক্ষাও করিনি। আমি কাঁদিনি, কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা ছিল।
কিন্তু
বিচারে
বলা হল, খুনের অভিযোগের মুখেও নাকি
আমি নিরুত্তাপ। আচ্ছা মা, আমি তো কোনো দিন একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড় ধরে জানলার বাইরে ফেলে দিয়েছি। সেই
আমিই নাকি মাথা রেখে মানুষ খুন করেছি! উলটো
ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি।
তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না,
ঘটনার
সময় আমার হাতের লম্বা নখের উপর কী সুন্দর নেল পালিশের জেল্লা ছিল। হাতের তালু কত
নরম তুলতুলে ছিল।
সেই বিচারকের হাত থেকে
সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড়ো আশাবাদীও করতে পারে কি ? তাই তো নারীত্বের পুরস্কার
হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জনবাসের হুকুম দেওয়া হল। দেখেছ মা, তোমার
ছোট্ট রেহানা এই ক-দিনেই কতটা বড়ো হয়ে গিয়েছে ?
এবার আমার অন্তিম ইচ্ছেটা
বলি, শোনো। কেঁদো না মা, এখন শোকের সময় নয়। ওরা
আমায় ফাঁসি দেওয়ার পর আমার চোখ, কিডনি, হৃদ্যন্ত্র, হাড় আর যা যা কিছু দরকার
-- যেন আর কারও জীবন রক্ষা করতে কাজে লাগানো হয়। তবে যিনিই এসব পাবেন,
কখনোই যেন আমার নাম না জানেন। আমি চাই না, এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক, এমনকি তুমিও না। আমি চাই না, আমার কবরের সামনে
বসে কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙে পড়ো তুমি। বরং আমার দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে
দিয়ো।
এই পৃথিবী আমাদের ভালোবাসেনি, মা। চায়নি, আমি সুখী হই। এবার মৃত্যুর আলিঙ্গনে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে।
তবে সৃষ্টিকর্তার এজলাসে সুবিচার আমি পাবই। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি
অভিযোগের আঙুল তুলব সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারের দিকে, বিচারকদের দিকে, আইনজীবীদের দিকে, আর তাদের দিকে- যারা আমার
অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে, বিচারের নামে মিথ্যা ও
অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে। একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায়
সেটাই সর্বদা সত্যি নয়।
আমার নরম মনের শোলেহ, মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর
আসনে। আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়। দেখিই না, সৃষ্টিকর্তা কী চান! তবে একটাই আরজি, মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরুর প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত
তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই, মা গো! তোমাকে যে খুব খু-উ-ব ভালোবাসি।”
তবে রেহানার মৃত্যুদণ্ডের কারণ নিয়ে অন্যেরা অন্য মতও পোষণ করেন।তারা বলছেন -- ইরানের রেহানা জাব্বারি নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে
সারা
বিশ্বে
ব্যাপক অপপ্রচার চলছে।
গণমাধ্যম
ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় উঠেছে ওই নারীর পক্ষে তবে নিতান্তই অসত্যের পক্ষে। প্রকৃত সত্য হল
রেহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন করেননি। ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
ইরানের বিচার বিভাগ এতটা নারী বিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে। হত্যাকাণ্ডটি
পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ওই মহিলা তার দোষও স্বীকার করেছেন আদালতে। রেহানা নিজেকে
নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন। ঘটনাটি হচ্ছে দুজনের অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়
এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালো মানুষ ছিলেন তা বলার
সুযোগ নেই। টানাপড়েনের একটি পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে রেহানা
লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। খুনের দুই দিন আগে রেহানা নতুন ছুরি
কিনেছিলেন এবং তার এক বান্ধবীকে এসএমএস করেছিলেন যে, খুনের ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এই মহিলার সঙ্গে ইরানের
আদালতের এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, তাকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। অথবা এই মহিলা
ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন সে কারণে তার ফাঁসি কার্যকর করা হল। বরং যদি এমন হত যে, খুন হয়নি বরং অবৈধ সম্পর্ক বা
ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে, তাহলে ওই পুরুষ লোকটাও মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়ত। এবং এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হত। দেখা হত না কে পুরুষ আর কে নারী।
যেমনটি দেখা হয়নি রেহানার ক্ষেত্রে।
আলোচ্য
হত্যাকাণ্ডটি ২০০৭ সালে সংঘটিত হয়। ঘটনাটি সাত বছর ধরে পুঙ্খানুপঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে
তারপর ইরানের আদালত রায় দিয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে পরে আবার বিচার হয়েছে এবং রায়
বহাল রাখে। তারপরও এক মাস দেরি করা হয়েছে যে ভিক্টিম পরিবার যদি মাফ করে
দেয় তাহলে ফাঁসিটি কার্যকর করা হবে না। কিন্তু ওই পরিবার মাফ করেনি। ইরানের বিচার
ব্যবস্থায় খুনের ঘটনায় কারও মৃত্যুদণ্ড হলে ভিক্টিম পরিবার ছাড়া কারও পক্ষে সে রায়
উল্টানোর সুযোগ নেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট বা সর্বোচ্চ নেতাও পারেন না।
ঔরঙ্গজেব ছিলেন মুঘল সম্রাটদের
মধ্যে
সবচেয়ে বেশি অত্যাচারী, নৃশংস, ধর্মান্ধ ও কামুক প্রকৃতির একজন শাসক। ঔরঙ্গজেবের আদেশ মেনে মুঘলসেনারা হিন্দু তথা অমুসলিমদের ধরে এনে মুসলমান বানাত। যারা মুসলমান
হতে
অস্বীকৃতি জানাত তাদেরকে
শিরচ্ছেদ করা হত। ঔরঙ্গজেব ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের লোভে ভাইদের হত্যা করেছিল এবং পিতা সম্রাট শাজাহানকে বন্দি করেছিল কারাগারে। সেই অপরাধের অভিযোগের ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে বলে শুনিনি।
কোনোভাবেই মৃত্যুদণ্ড সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। হত্যা করার অধিকার কারোর থাকতে পারে না। নখের বদলে নখ, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ
– এ ব্যবস্থা সমাজে কোনো কাজে লাগে না। এটা প্রতিহিংসাপরায়ণতা। অপরাধের
বদলে অপরাধ করা।
সমাজ,
ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ লেখকদের জন্য সবসময়
ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আছে এবং হয়তো-বা থাকবে। ভিন্ন মতাবলম্বী লেখকের উপর যে-কোনো সময়ে রাষ্ট্রের খড়গহস্ত নেমে আসতে পারে। গ্রেফতার হতে পারেন লেখক,
লেখক
নির্বাসিত হতে পারেন, এবং মৃত্যুদণ্ড পেতে
পারেন। শুধু রাষ্ট্রই নয় — বিভিন্ন
ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং
ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হতে পারে লেখক। সেই লেখক যদি সরকারের অপ্রিয়ভাজন হন তাহলে রাষ্ট্র
সেই সুযোগ নিয়ে সেই একই পদ্ধতি
প্রয়োগ হতে পারে।
ধর্ম এবং বিজ্ঞান বিষয়ে নতুন চিন্তাধারা প্রকাশ
করেছিলেন ইটালিয়ান দার্শনিক ও বিজ্ঞানী জিওর্ডানো
ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০) তার রচনাসমূহে। সাত বছর ব্যাপী মামলার পরে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আগুনে পুড়িয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। প্যাটৃক ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডের কবি ও টিচার প্যাট্রিক হেনরি পিয়ার্স (১৮৭৯-১৯১৬) তার সহবিপ্লবীদের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে
লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ধরা পড়েন ও তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। স্পেনের সুবিখ্যাত লেখক ও নাট্যকার ফেডারিকো
গার্সিয়া লোরকাকে (১৮৯৬-১৯৩৬) স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের
প্রথমদিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ন্যাশনালিস্ট সিভিল গভর্নর। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনী তাকে প্রথমে অকথ্য অত্যাচার করে এবং পরে তাকে হত্যা করে। তার কবর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সমাজ,
রাষ্ট্র
ও ধর্ম বিষয়ে এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি
অনেক বদলে গিয়েছে। এমনকি যারা ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তাদের মধ্যেও নিজেদের ধর্ম বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা এসেছে।
এর কারণ হচ্ছে মানুষ চেয়েছে ধর্মের
আওতায় থেকেও পরিবর্তিত যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। আর তার ফলে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ইসুতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে ।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘পঞ্চশিলা’-তে বলা হয়েছে—“প্রত্যেকেই শাস্তিকে
ভয় পায়। প্রত্যেকেই মৃত্যুকে ভয় পায়। ঠিক তোমারই মতো। সুতরাং তুমি কাউকে হত্যা করবে না, অথবা এমন কিছু করবে না যার ফলে কেউ নিহত হতে পারে।” বলা হয়েছে – “তাকেই আমি ব্রাহ্মণ বলব যে অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং সকল প্রাণীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ছেড়ে
দিয়েছে। সে কাউকে হত্যা করে না। সে অন্য কোনো
ব্যক্তিকে হত্যায় সাহায্য করে না।” অনেক বৌদ্ধগণ
মনে
করেন কোনো আইনগত পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিরোধী তাদের ধর্ম।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ দেশে কিছু অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৮১৮ খ্রিস্টাব্দে জাপানের
সম্রাট সাগা মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও কিছু জমিদার তাদের এলাকায় মৃত্যুদণ্ড চালু রেখেছিলেন। ১১৬৫
খ্রিস্টাব্দে জাপানে আবার
মৃত্যুদণ্ড চালু হয়। এখনো তাই।
অবশ্য সম্প্রতি জাপানের কিছু বিচারক মৃত্যুদণ্ড সই করতে
রাজি হননি। এ ক্ষেত্রে যুক্তিস্বরূপ তারা
নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোর
মধ্যে ভুটান ও মঙ্গোলিয়া মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। শ্রীলংকা একসময়ে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করলেও আবার সেটা চালু
করেছে। থাইল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ড
বরাবরই চালু ছিল এবং আছে। তবে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভিন্নতা আছে। বুদ্ধ তার বাণী দিয়ে খুনি এবং অপরাধীদের যে সংশোধিত করেছিলেন সে বিষয়ে বৌদ্ধ পুরাণে অনেক কাহিনি আছে। যেমন, আঙ্গুলিশালা ৯৯৯ জনকে হত্যার পর নিজের মা এবং বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু
বুদ্ধের প্রভাবে তিনি অনুতপ্ত
হন এবং
বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
সব পশুপ্রাণী হত্যা সম্রাট অশোক নিষিদ্ধ
করেছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন মানুষ
হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে। মৃত্যুদণ্ড
বিষয়ে
ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে বহু রকমের মতামত আছে। কেউ মনে করেন, জিশু যে ক্ষমার বাণী প্রচার করেছিলেন তার সম্পূর্ণ বিরোধী মৃত্যুদণ্ড, কারণ এটি
প্রতিহিংসার
বাস্তবায়ন। সুতরাং এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। আবার কেউ মনে করেন,
ওল্ড
টেস্টামেন্ট আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। মৃত্যুদণ্ড
বিরোধীরা মনে করিয়ে দেন, জিশু বলেছিলেন, এক গালে চড় খেলে আর-এক গাল বাড়িয়ে দিতে। তারা মনে করিয়ে দেন, পরকীয়া প্রেমে
অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এক
নারীকে
যখন পাথর ছুড়ে মারা হচ্ছিল তখন জিশু সেটা বন্ধ করেন। মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা বলেন, এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, শারীরিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার
বিপক্ষে
ছিলেন যিশু। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের
পক্ষেও ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা আছেন। আমেরিকায়
সকল
ধরনের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা যারা সবচেয়ে আগে করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের একটি শাখা, দি রিলিজিয়াস সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস বা কোয়েকার চার্চ। সাদার্ন ব্যাপটিস্টরা খুন ও দেশদ্রোহিতার দায়ে দণ্ডিতদের মৃত্যুদণ্ড
সমর্থন করলেও তারা বলেন, সেখানে যেন কোনো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা অথবা রাষ্ট্রীয়
বৈষম্য না থাকে। ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চ এবং অন্যান্য মেথডিস্ট চার্চও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী।
তারা বলেন, সামাজিক প্রতিশোধ নিতে কোনো মানুষকে মেরে ফেলা উচিত নয়। মেথডিস্ট
চার্চ আরও বলে, মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়
অসমভাবে গরিব, অশিক্ষিত, সংখ্যালঘু এবং মানসিক রোগাক্রান্ত অথবা আবেগপ্রবণ মানুষরা। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং
বিপক্ষে বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে অহিংসার
বাণী প্রচারিত হয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে “আত্মা অবিনশ্বর … মৃত্যু
কেবল দৈহিকভাবে হতে পারে।” কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, খুনের কারণে এবং ন্যায়সঙ্গত
যুদ্ধের সময়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে
পারে। মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে ইসলামি জ্ঞানীজনদের মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে।
প্রায় সব ইসলামি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান
আছে। তবে সেটা কার্যকরের পন্থা হয় ভিন্ন। কিছু ইসলামি দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে বাঁচতে পারেন। বর্তমান যুগে অধিকাংশ খ্রিস্টানরা যেমন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন তেমনটা
মুসলিমরা করেননি। তদুপরি কিছু
মুসলিম
দেশে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় এবং সেই ছবি পত্রিকা ও ইন্টারনেটে প্রকাশ করায় মুসলিমরা সাধারণত চিত্রিত
হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী এবং
প্রাচীনপন্থী রূপে। ইহুদি ধর্মে নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করা হয়।
তবে সেই দণ্ড দেওয়ার আগে সুষ্ঠু বিচার
ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি নির্দেশে বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডের মামলায় তিনজন নয়, অন্ততপক্ষে ২৩ জন বিচারককে থাকতে হবে। দ্বাদশ
শতাব্দীর
ইহুদি জ্ঞানী ব্যক্তি মুসা ইবনে মায়মুন বলেন,
একজন
নিরপরাধের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
করার চাইতে এক হাজার অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া শ্রেয়। মুসা বিন মায়মুন যুক্তি দেন, সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত
না-হয়ে একজন অভিযুক্তকে মেরে ফেললে আমরা একটা পিচ্ছিল পথে পড়ে
যাব এবং শেষ পর্যন্ত বিচারকের অভিরুচি
মোতাবেক দণ্ড হবে। “It is better and
more satisfactory to acquit a thousand guilty persons than to put a single
innocent one to death... that executing a defendant on anything less than
absolute certainly would lead to a slippery slope of decreasing burdens of
proof, until we would be convicting merely, according to the judge's caprice.”
কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর মনে করেন, সন্ত্রাসবাদীদেরও
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয়। শশী থারুর ট্যুইট করে বললেন, “এটি একটি বিলুপ্তপ্রায় শান্তি। এইসব দোষীদের কোনও
ছুটি না-দিয়ে সারাজীবন জেল বন্দি করে রাখা উচিত।” শশী বলেন,
“একসময়
সমাজে এই ধারণা ছিল যে কেউ কাউকে খুন করলে তাকে মৃত্যুর সাজাই দিতে হবে। আমরা এযুগে
দাঁড়িয়ে কেন সেই পন্থা অবলম্বন করব ? আমরা যখনই মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করি, তখন আমরা ওদের জায়গাতেই পৌঁছে যাই। ওরা খুনি। তাই বলে আমাদের উচিত নয় ওদের মতো ব্যবহার করা।” মুম্বই বিস্ফোরণে দোষী
সাব্যস্ত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির পর দুঃখপ্রকাশ করে ট্যুইট করেছিলেন শশী থারুর।
সেই প্রসঙ্গে এদিন এই কংগ্রেস সাংসদ বলেন, “আমি কোনও নির্দিষ্ট মামলার বিরুদ্ধে একথা বলিনি।
মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিরুদ্ধে বলেছি।” থারুর জানান, ইতিমধ্যেই ১৪৩টি দেশে মৃত্যুদণ্ড উঠে গিয়েছে। অন্য ২৫ টি দেশে আইনের থাকলেও তা
প্রয়োগ করা হয় না। মাত্র ৩৫ টি দেশে এই আইনের প্রয়োগ রয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড : শাসনের ছলনায় রাষ্ট্র কর্তৃক নরমেধ যজ্ঞ (নবম পর্ব)
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
অপরাধবিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিক পণ্ডিতরা মনে করেন, সুসংগঠিত
সুস্থিত সমাজব্যবস্থায় কিছু সংখ্যক মানুষ কেন অসুস্থ-অস্বাভাবিক-অসামাজিক মানসিকতায় সমাজবিরোধী অপরাধে প্রবৃত্ত হয় এবং কঠোর শাস্তির বিধান ও দৃষ্টান্ত থাকলেও কেন অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হয় না ?
মানুষের সামাজিক অস্তিত্বে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় চিন্তাভাবনা এবং নানান মানসিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া কার্যকর থাকে। এসব বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞানে গবেষণা
চলছে। আর্থ-সামাজিক প্রভাব,
অপরাধমনস্কতা, বংশানুক্রমিক
বা জিনগত প্রবণতা – মানসিক ও শারীরিক প্রক্রিয়ার দ্বারা
অপরাধীর সংশোধন প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে জড়িত।প্রাচীন ভারতে এবং অন্যান্য দেশেও সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আদর্শে মানুষ নামক প্রাণীটির সম্পর্কে দু-রকম ভাবনা নিবদ্ধ।মনু দণ্ডের আলোচনায় বলেছেন – দণ্ড ছাড়া সমাজ অচল। কারণ সবদিক বিচারে একেবারে খাঁটি মানুষ বিরল। “দুর্লভো হি
শুচির নরঃ”।
মানুষ জৈবিক কারণে (ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও
যৌনতাড়নায়) এবং সামাজিক ও
পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিতাড়িত হয়ে অনেকসময় অপরাধে প্ররোচিত হয়। অর্থাৎ সামাজিক বৈষম্য এবং বিরুদ্ধ অবস্থায় অসহিষ্ণু হয়ে মানুষ অপরাধে প্রবৃত্ত হয়। সুতরাং
তাঁদের মতে অপরাধ তথা অপরাধী দুই-ই সমাজের
সৃষ্টি। অতএব মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যার পথ থেকে সরে গিয়ে সমাজব্যবস্থাকে সার্বজনীন
কল্যাণ এবং সুসংহত আদর্শের অনুকূল করে গড়ে তুলতে পারলে সমাজ থেকে অনেক অপরাধই লুপ্ত হয়ে যাব। চাই একটা সাম্যের সমাজ। সাম্যের সমাজ তৈরি করতে পারলে অপরাধমুক্ত পৃথিবী উপহার দেওয়া সম্ভব।
কিছুদিন আগে ভারতে এক সন্ত্রাসবাদীর
মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে জনৈক ব্যক্তি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে বললেন, যাঁরা মৃত্যুদণ্ডের
বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন তাঁরা আসলে দেশদ্রোহী। তিনি আরও বলেছিলেন, এদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে আমৃত্যু সশ্রম
কারাদণ্ড দিলে আমাদের ট্যাক্সের টাকা থেকে পুষতে হবে কেন ? আমি বলি -- ট্যাক্সের টাকা ? কী হয় আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে ? কোথায় খরচ
হয়ে যায় সেই টাকা ? সুইস ব্যাঙ্কে যে হাজার হাজার কোটি কালো
টাকা যেসব মহামতিরা গচ্ছিত রেখেছেন তারা কি দেশপ্রেমী ? এই
যে হাজার হাজার কোটি টাকা তাঁদের সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত আছে সেগুলি কোন্ টাকা
? দেখবেন নাকি পাসবইগুলি ? এইসব তথ্য WikiLeaks–এ ফাঁস হয়েছে।
(১) Ashok Gehlot (2,20,000 কোটি টাকা),
(২) Rahul Gandhi (1,58,000 কোটি টাকা),
(৩) Harshad Mehta (1,35,800 কোটি টাকা), (৪) Sharad Pawar (82,000
কোটি টাকা), (৫) Ashok Chavan
(76,888 কোটি টাকা), (৬) Harish
Rawat (75,000 কোটি টাকা), (৭) Sonia
Gandhi (56,800 কোটি টাকা), (৮) Muthuvel
Karunanidhi (35,000 কোটি টাকা), (৯)
Digvijay Singh (28,900 কোটি টাকা), (১০)
Kapil Sibal (28,000 কোটি টাকা), (১১)
Rajeev Gandhi (19,800 কোটি টাকা), (১২)
Palaniappan Chidambaram (15,040 কোটি টাকা), (১৩) Jayaram Jaylalitha (15,000 কোটি টাকা),
(১৪) Kalanithi Maran (15,000 কোটি টাকা),
(১৫) HD Kumarswamy (14,500), (১৬)
Ahmed Patel (9,000), (১৭) J M Scindia (9,000), (১৮) Ketan Parekh (8,200 কোটি টাকা), (১৯) Andimuthu Raja (7,800 কোটি টাকা),
(২০) Suresh Kalmadi (5,900 কোটি টাকা)। (http://www.india.com/news/india/list-of-black-money-holders-in-swiss-bank-accounts-leaked-by-wikileaks-182160/)
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ভারতের কোনো লাগবে ? এত হাজার হাজার কোটি টাকা সব
দেশ থেকে বিদেশে চলে গেল !! দেশ সর্বস্বান্ত হল। লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি আর মুদ্রাস্ফীতির
জন্য কে বা কারা দায়ী ? আর একটা মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত মানুষকে বাঁচিয়ে রেখে সশ্রম
কারাদণ্ড দিলে কত কোটি টাকা খরচা হয়ে যেত ? জেলে আসামীদের
রেখে দিলে যদি আপনার ট্যাক্সের টাকা খরচা হয়ে যায়, তাহলে তো
লাখো লাখো জেলবন্দি সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের হত্যা করে ফেলা উচিত। শুধু যে সাজাপ্রাপ্ত আসামীরাই জেলবন্দি থাকে তা তো নয়,
বহু অভিযুক্ত বিনা বিচারে জেলখানাগুলিতে বছর বছর ধরে পচছে। টাকা লাগে না ? টাকা লাগে
বলে মৃত্যুদণ্ড বা হত্যা করা কোন্ যুক্তিতে? প্রাণদণ্ড বহাল
রাখা মানবাধিকারের পরিপন্থী।
এই
দণ্ড বিচারক ও জুরিমহোদয়দের ব্যক্তিগত নীতিবোধ, আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা,
জন্মগত সংস্কার-পরম্পরা এবং পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী প্রযুক্ত হয়। কখনো-কখনো তাদের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে নির্দোষ
মানুষও এমন দণ্ড পায়।
কোনো-কোনো ক্ষেত্রে
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ সাপেক্ষে এই দণ্ড বিহিত হয়।পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে খুব কম খুনিই দ্বিতীয়বার
খুন করে। কিন্তু ফাঁসুড়েরা
একাধিকবার খুন করে।
খুন
করে রাষ্ট্রের নির্দেশে।
অনেকেক্ষেত্রেই
এইসব ফাঁসুড়েরা হয় সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা। প্রাসঙ্গিক কারণেই, আমি এমনই এক ফাঁসুড়ের কথা এখানে উল্লেখ
করতে চাই, যিনি নিজেই একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। বঙ্গবন্ধুর খুনী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর
যে কয়েকটা নাম খুব বেশি আলোচিত হয়েছে তার মধ্যে একটি নাম শাহজাহান। শাহজাহানের পুরো নাম কাদের মোহম্মদ শাহজাহান ভূঁইয়া। জেলখানার
ভিতর তাকে
‘জল্লাদ শাহজাহান’
নামেই চেনেন সবাই। এই
শাহজাহান জেলখানার ভিতরে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের অনেকগুলি বসন্ত। জল্লাদ শাহজাহান দীর্ঘ ৩৬ বছর যাবৎ কারাবন্দি অবস্থায় আছেন। রাষ্ট্রের নির্দেশে এ পর্যন্ত ৪৫ জনকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছেন তিনি। ব্যক্তি হিসেবে শাহজাহান ভূঁইয়া খুবই ভালো প্রকৃতির ছিলেন। পারতপক্ষে কারোর উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। তিনি প্রচণ্ড বন্ধুপাগল ছিলেন। একবার তার গ্রামে নারীঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। তাতে দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। তাকে নিয়ে গ্রামে বিচার-সালিশ বসে। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণ করে সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তার ক্ষিপ্রতা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না-পেরে সিদ্ধান্ত
নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ
করে এই
অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন। নারীঘটিত
ওই ঘটনার পর শাহজাহান ভূঁইয়া বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তা ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যে-কোনো অপারেশনে তার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেছিলেন ১৯৭৯ সালে মাদারিপুর জেলায়। আর
তা ছিল শাহজাহান ভূঁইয়ার জীবনের শেষ অপারেশন।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। রাতভর মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। শাহজাহান ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন। পথে পুলিশ তাকে আটক করে এবং তার গতিময় জীবনের সমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় বন্দিজীবন। ১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও
পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং ৩৪টি হত্যা মামলা। ১৯৮৮ সালে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে তার ১৪৩ বছরের সাজা হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১০০ বছর মকুব হয়ে ৪৩ বছরের জেল হয়। জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ শাহজাহানের জেল কার্ডের উপর লেখা আছে ‘ডেট অব রিলিজ ২০৩৫’।
যখন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন তখন তার বয়স হবে ৮৫ বছর।
কী লাভ হবে তখন কারাগার থেকে বের হয়ে ?
এ জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন জল্লাদের খাতায় নাম লেখাতে। তিনি জানতেন একটা ফাঁসি দিলে দুই মাস চার দিনের সাজা কমে। এভাবে যদি সাজা কিছুটা কমে ! জেলারের অনুমতি
নিয়ে ১৯৮৯ সালে প্রথম তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসাবে গফরগাঁওয়ে নুরুল ইসলামকে ফাঁসি দেন। ওটাই ছিল শাহজাহানের জীবনে কারাগারে কাউকে প্রথম ফাঁসি দেওয়া। তার যোগ্যতা দেখে আট বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের আসন প্রদান করে। আর প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর
ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন তিনি। ১৯৭১ সালের পর এখন পর্যন্ত সাড়ে চার শতাধিক মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে
এক হাজারের বেশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি কারাগারে রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন শতাধিক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়াও দেশের আরও ১৪টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, “যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তিনি তাদের ফাঁসি দিয়েছেন।” তিনি আশা করেছিলেন
“শেখের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী, সে তার দিকে একটু সুনজর দেবেন। কিন্তু কে রাখে কার খবর ? তার কথা কেউ বিবেচনা করেনি।” তিনি বলেন, “নেলসন ম্যান্ডেলা বেশি সময় জেলখানায় কাটিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। আর এখন তিনি (শাহজাহান) জীবনের
৩৬টি বছর কারাগারে কাটিয়ে দিলেন। বাইরে মানুষ হত্যা করলে জেল হয়, ফাঁসি হয়। আর এখানে এত মানুষ হত্যা করছি, কিন্তু
কিছুই হয় না।”
মেরঠের কাল্লু ও তাঁর ছেলে মামু এবং পশ্চিমবঙ্গের
নাটা মল্লিক মারা যাওয়ার পরে বর্ষীয়ান বাবুই আপাতত ভারতের তথা দেশের একমাত্র
ফাঁসুড়ে। ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকারী সতবন্ত সিংহ ও কেহর সিংহের ফাঁসিও দিয়েছিলেন
বাবু ও কাল্লু। নাটা
মল্লিক শেষবার ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে ফাঁসি দেন। তবে বাবু অসমে ফের ফাঁসি
দিতে আসতে রাজি হলেও বাবুর দুই ছেলে বাবার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তাঁরা ফাঁসুড়ের
বৃত্তি গ্রহণে রাজি নন।
যেসব রাষ্ট্র হত্যা করবেনই ঠিক করে ফেলেছেন তখন সাধারণ মানুষকে দিয়ে কেন হত্যা করানো হবে, সেই ব্যক্তি যিনি সাজাপ্রাপ্ত ? এই হত্যাকাণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতা অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি অথবা দণ্ডদাতা বিচারপতিই কার্যকর করুন না, নিজের হাতে।
বহুকাল আগে থেকেই চালু থাকলেও বিংশ শতাব্দীতে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে ক্রমেই
বিভিন্ন দেশে জোরালো যুক্তিতর্ক হচ্ছে। বিশেষত মৃত্যুদণ্ড বিলোপের জন্য বিভিন্ন
দেশে প্রভাবশালী কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে। যেমন ব্রিটেনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
ইত্যাদি। যাদের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে পৃথিবী থেকে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা।
অপরদিকে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও মতামত আসতে থাকে, বিশেষত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে।
মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে যে সাধারণ যুক্তি দেওয়া হয়, তা হল -- এর ফলে অপরাধের সংখ্যা কমে যায়, এটা পুলিশ ও সরকারি উকিলের সহায়ক
হয়। মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করে বিনিময়ে জীবন রক্ষার ডিল করতে
পারে, দণ্ডিত অপরাধী আর
কোনোদিনই যে অপরাধের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে না সেটা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে। শিশু
হত্যা, সিরিয়াল খুন এবং
নির্যাতনমূলক হত্যার মতো নৃশংস অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডই হচ্ছে ন্যায়সঙ্গত শাস্তি।
মৃত্যুদণ্ড বিরোধীরা যুক্তি দেন যে, এসব যুক্তির বিপরীতে যারা হত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের
সবাই যে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড চান, তা নয়। যেমন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব
গান্ধির হত্যাকারীকে সোনিয়া গান্ধি মকুব করে দিয়েছিলেন। সাধারণত দেখা যায়, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা
ও বিত্তশালীরা বিভিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়। কিন্তু
সংখ্যালঘিষ্ঠ ও গরীবরা মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়। মৃত্যুদণ্ড সহিংসতার কালচারকে
উৎসাহিত করে। ফলে দেশে সহিংসতা বেড়ে যায়। মৃত্যুদণ্ড মানুষের মৌলিক অধিকার লংঘন
করে। মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার পিছনে আর যুক্তির মধ্যে আছে। যেমন – (১) নানা স্তরে সাক্ষ্য, জিজ্ঞাসাবাদ, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পরই
একজনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায় সে বিচারও কি
ভুলত্রুটিমুক্ত ? প্রশ্নাতীতভাবে এর উত্তর হবে, না। তাহলে নির্দোষ ব্যক্তির ফাঁসি হয়ে যাওয়ার প্রবল
সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। তাহলে যার জীবন নেওয়া হল তার জীবন কি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব, যদি পরে দেখা যায় সে ব্যক্তি
সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ ? (২) দোষী ব্যক্তি যেন আর অপরাধ করতে না-পারে সেজন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।
অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তার দণ্ডও হয়ে থাকে। কিন্তু দোষী ব্যক্তিকে যদি
মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে সে তো আর অপরাধ করতে পারছে না। “বিরল থেকে বিরলতম” অপরাধের ক্ষেত্রে যদি অপরাধীকে
কঠোরভাবে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় আমৃত্যু -- তাহলে কেন মৃত্যুদণ্ড ? (৩) খুনের শাস্তি আর-একটি ‘খুন’ দিয়ে হতে পারে না। এটাকে কোনোভাবেই ন্যায়বিচার বলা যায়
না। প্রতিশোধ বলা যেতে পারে। (৪) সংবিধানের জীবনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তার
সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়।
দেখা গেছে, সারা বিশ্বে যত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তার ৯০ শতাংশই হয় এশিয়ায়। এমনকি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন
করে সুদান, ইরান এবং সৌদি আরবে ১৮
বছরের কম বয়সিকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কী ভয়ঙ্কর ! চিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড
দেওয়া হয়। ২০১২ সালে এ সংখ্যা চার হাজারেরও অধিক। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে প্রায় সব
দেশেই প্রকাশ্যেই ফাঁসি দেওয়ার রীতি থাকলেও বর্তমানে ইরান, সৌদি আরব এবং সোমালিয়া ছাড়া অন্য
সব দেশে তা বন্ধ করা হয়েছে।
সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তখনকার আদালত। অভিযোগ— তিনি যুবসমাজকে ধ্বংস করছেন। তার
বয়স ছিল তখন ৬৩ বছর। তিনি আরও দীর্ঘ জীবন পেলে পৃথিবী আরও কত কী পেত, সেটা ভাবাই যায় না। মৃত্যুদণ্ডের
মাধ্যমে এভাবে কত ক্ষতি হয়ে গেল পৃথিবীর, কে তার হিসাব রাখে ? একবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের অপরাধের জন্য আর মৃত্যুদণ্ড
দেওয়া হয় না ঠিকই, কিন্তু অন্যান্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হার এখনও অনেক বেশি। মূলত
হত্যা, নিজ দেশের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ, ধর্ষণ, মাদক পাচার এ ধরনের অপরাধের কারণেই
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে। সামান্য কিছু চুরি করার কারণেও ইংল্যান্ডের মতো দেশে
বছরে শত শত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হত একসময়। অষ্টম হেনরির সময় ৭২ হাজার চোরকে ফাঁসি
দেওয়া হয়েছিল। নিশ্চয়ই সেদিন আর নেই। মানুষ সভ্য হয়েছে বলে দাবি করে। সভ্য হওয়ার
নমুনা হিসাবে পৃথিবীর অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত হচ্ছে একের পর এক। যেসব দেশে
এখনও বন্ধ হয়নি, সেখানেও মৃত্যুদণ্ড
বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চলছে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০ টি মানবাধিকার সংস্থা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে
মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে লন্ডন ভিত্তিক মনেস্টি
ইন্টারন্যাশনাল অন্যতম। অ্যামনেস্টির দেওয়া তথ্য মতে -- "এখন পর্যন্ত ১৪০টি
দেশ মৃত্যুদণ্ড আইনগতভাবে বা প্রথা হিসাবে বাতিল করেছে। যে মাত্র নয়টি দেশ ২০০৯
থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ফাঁসি কার্যকর করেছে তার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ অন্যতম।" প্রতিবছর
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড এবং কার্যকর বিষয়ে অ্যামনেস্টি বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, শাস্তি হিসাবে বিশ্বে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে
মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে৷ ২০১৪ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ২ হাজার ৪৬৬ জন, যা আগের বছরের তুলনায় শতকরা হিসাবে
২৮ ভাগ বেশি৷ মিশর ও নাইজেরিয়ায় গণবিচারে কয়েক শত মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় এই
সংখ্যা বেড়েছে৷ অ্যামনেস্টি বলছে, চিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ রাষ্ট্রীয়
গোপনীয়তার কারণে সেখানকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হিসাব পাওয়া যায় না৷ চিন এই হিসাব
প্রকাশ করে না৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রদত্ত বার্ষিক রিপোর্টের পরিসংখ্যান থেকে
যায় যে, ১৯৯৬ সালে সারা বিশ্বে
মোট ৪২৭২ জন ফাঁসিতে মৃতর মধ্যে ৩৫০০ জন শুধু চিনের। এই তালিকায় এগিয়ে আছে মুসলিম
রাষ্ট্রগুলি। রাশিয়া, ইউক্রেন, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, আমেরিকা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো
রাষ্ট্রগুলিতে মাত্র ওই এক বছরে শত শত মানুষকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।১৯৯৫
সালে গোটা দুনিয়ায় হত্যা করা হয়েছিল ৩২৭০ জনকে। ২০১৩ সালের মতো ২০১৪ সালেও ২২টি
দেশেই শুধু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ ২০ বছর আগে সংস্থাটি যখন প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ
করে তখন মোট ৪২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল৷
অ্যামনেস্টির ‘ডিরেক্টর অফ গ্লোবাল ইস্যুজ' অড্রে গাউঘ্রান বলেন, ‘‘মৃত্যুদণ্ড কোনো সুবিচার নয়৷'' মিশর এবং নাইজেরিয়ার পরিস্থিতি
নিয়ে অ্যামনেস্টি ভীষণ উদ্বিগ্ন৷ ২০১৪ সালে নাইজেরিয়ায় ৬৫৯ জন এবং মিশরে কমপক্ষে
৫০৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ দু-দেশেই বৃদ্ধির হার উদ্বেগজনক৷ ২০১৩ সালে ১৪১
জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল নাইজেরীয় সরকার৷ মিশরে সে বছর ১০০-র মতো লোককে
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল৷
আমি মৃত্যুদণ্ড বিরোধী। আমি মনে করি রত্নাকররা “বাল্মীকি” হতে পারলে ধনঞ্জয়রাও অন্য কিছু হতে পারত । সেদিন যদি রত্নাকরকে জঘন্য খুনের
অপরাধের কারণে ক্ষমা না-করে হত্যা করা হত, “রামায়ণম্” কোথায় পেতাম ? মহাকবি কোথায় পেতাম ? রত্নাকরকে বাঁচিয়ে সমাজের কি খুব ক্ষতি হয়ে গেছে ? মৃত্যুদণ্ড কোনো রাষ্ট্রের
স্বৈরচারিতারই নামান্তর। না, রাষ্ট্রের এহেন স্বৈরাচারিতা মেনে নেওয়া যায় না। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার
আছে। ফাঁসির বদলে অন্য যে-কোনো শাস্তি তারা পেতে পারে। আমৃত্যু যাবজ্জীবন ? নয় কেন? অবশ্য আজকাল আমি যাবজ্জীবনেও
আপত্তি করি। জেলখানা ব্যাপারটাকেই পছন্দ করি না। জেলখানাগুলি হতে পারে সংশোধনী কেন্দ্র।
যতদিন মাথার দুষ্টু কীটগুলি মরে যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত অপরাধীরা থাকবে ওই কেন্দ্রে। কে যেন একজন
বলেছিলেন, “জেলখানার ঘরগুলি হতে
পারে এক-একটা ক্লাসরুম, আর জেলখানাগুলো এক-একটা বিশ্ববিদ্যালয়”। কিছুদিন আগে সুইডেনের কিছু জেলখানা বন্ধ করে দিতে
হয়েছে। কারণ জেলে মোটেও লোক নেই। অপরাধের সংখ্যা কম, তাই আসামীর সংখ্যাও কম। সমাজটাকে বৈষম্যহীন যত করা যায়, যত সমতা আনা যায় মানুষে-মানুষে, অপরাধ তত কমে যায়। কোনও প্রাণীই বা
কোনও মানুষই অপরাধী বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয় না। একটি শিশুকে যদি সুস্থ সুন্দর
শিক্ষিত পরিবেশ দেওয়া না-হয়, একটি শিশুর গড়ে ওঠার সময় যদি তার মস্তিষ্কে ক্রমাগত আবর্জনা ঢালা হতে থাকে, তবে এই শিশুরাই বড়ো হয়ে অপরাধ আর
সন্ত্রাসে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। এ কি ওদের দোষ? নাকি যারা আবর্জনা ঢালে, আবর্জনা ঢালার যে প্রথা যারা চালু রাখছে সমাজে, তাদের দোষ ! একই সমাজে বাস করে আমি
মৌলবাদ-বিরোধী, কেউ মৌলবাদী, কেউ খুনী, ধর্ষক, চোর, আবার কেউ সৎ, সজ্জন। সমাজ এক হলেও শিক্ষা ভিন্ন বলেই এমন হয়। একদল লোক
বিজ্ঞান শিক্ষা পাচ্ছে, মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করছে, আলোকিত হচ্ছে। আর-এক দলকে ধর্মান্ধ, মূর্খ, কূপমণ্ডুক আর বর্বর বানানো হচ্ছে।
ফেলে রাখা হচ্ছে ঘোর অন্ধকারে। শিক্ষার ব্যবস্থাটা সবার জন্য সমান হলে, শিক্ষাটা সুস্থ শিক্ষা হলে, সমানাধিকারের শিক্ষা হলে, মানুষেরা মন্দ না-হয়ে ভালো হত।
ছোটখাটো অভদ্রতা, অসভ্যতা, অপরাধ থাকলেও সমাজ
এমনভাবে নষ্টদের দখলে চলে যেত না, এত লক্ষ লক্ষ লোক খুনের পিপাসা নিয়ে রাজপথে তাণ্ডব করত
না। যে দেশে সবার জন্য খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য নেই, সেই দেশে অরাজকতা থাকবেই। অন্য সব
ব্যবস্থার মতোই বিচারব্যবস্থাতেও আছে পাহাড়প্রমাণ গলদ। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, “অপরাধীর যথার্থ দণ্ড না হইলে
সমাজের অমঙ্গল”। কিন্তু দণ্ডের
যথার্থতাই যদি প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায় ? আইএসআইয়ের ফলিত রাশিবিজ্ঞানের দুই অধ্যাপকের গবেষণা
প্রশ্ন তুলেছে এক দশকেরও বেশি আগের ধনঞ্জয়ের ‘বিরলতম’ অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়াকে নিয়েই। প্রশ্ন তুলেছে, বহুচর্চিত আরুষি মামলার মতো হেতাল
পারেখ হত্যাকাণ্ড ‘অনার কিলিং’ নয় তো ? তারাশঙ্করের ভাষায় – “কলঙ্কিনী রাধার দণ্ড না দিলে মান
থাকে কোথা?” গবেষকদের বিলম্বিত
গবেষণা ভিত্তিহীন হতেই পারে। কিন্তু সর্বনাশা সংশয়টা অন্যত্র। যে তদন্তের শাস্তি
হিসাবে রাষ্ট্র কেড়ে নিয়েছে জলজ্যান্ত একটা প্রাণ, সে তদন্ত ঘিরে আদৌ কোনো প্রশ্নের অবকাশ থাকবে কেন ? কেন থাকবে এক শতাংশ সন্দেহের
জায়গাও ? “জাজমেন্ট অফ এরর” হলে আর ফেরানো যাবে না ফাঁসিতে
ঝোলানো দণ্ডিতকে ! সে কারণেই অপরাধ করলে কী কারণে অপরাধ করেছে, কোথায় ভুল ছিল এসব না ভেবে, ভুলগুলি শোধরানোর চেষ্টা না-করে
অপরাধীকে জেলে ভরা হয়, অথবা হত্যা বা খুন করা হয়। আসলে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অনেক সমস্যার চটজলদি সমাধান
করতে চায় রাষ্ট্রগুলি। কিন্তু একে সমস্যার সত্যিকারের সমাধান হয় না। অপরাধ বন্ধ
হওয়া তো দূরের কথা, এক চিলতেও কমে না। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে সেই ভয়ে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে
বলে যাঁরা এরকম ধারণার পক্ষপাতী, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা বলেন – যেহেতু অনেক খুনের ঘটনায় অপরাধী
ধরা পড়ে না, দীর্ঘসূত্রী
বিচারপদ্ধতি, জুরিদের মতপার্থক্য
এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান বিরলতম (rarest of the rare) হওয়ার ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে অপরাধ কমবে। যদি
কমত তাহলে মৃত্যুদণ্ড চলছে হাজার হাজার বছর ধরে, এতদিনে অপরাধমুক্ত একটা পৃথিবীতে বাস করতাম আমরা। এখন বসে
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আর্টিকেল লিখতে হত না।তা ছাড়া এমন কোনো পরিসংখ্যান আমাদের
জানা নেই, যার দ্বারা প্রমাণ করা
যায় যে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় অপরাধ কমেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। এমন কোনো প্রমাণ নেই
যে, যে দেশগুলি থেকে
মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত হয়ে গেছে চিরতরে, সে দেশে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতায় ভরে গেছে !
সারা পৃথিবীতে ঈশ্বর বিশ্বাসীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের বলি আস্থা রাখুন
ঈশ্বরের প্রতি। মৃত্যুদণ্ড দিলে তিনিই দেবেন, আপনি নন। ঈশ্বর কারোকে হত্যা করার অধিকার দেননি, এমন কোনো দলিলও নেই মানুষের হাতে।
সুস্থ সমাজের জন্য আপনি বড়োজোর সেই সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে সংশোধনের সবরকমের ব্যবস্থা
করতে পারেন। আপনার উপযুক্ত করে পুনর্বাসনও দিতে পারেন। যেদিন মানুষ একটা জীবন
ফিরিয়ে দিতে পারবে সেদিন মানুষ অবশ্যই জীবন নেবে। একজন অসুস্থ মানুষ হঠকারিতা করে
ফেলেছে বলে অন্য একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেই একই হঠকারিতা করবে ? (সমাপ্ত)
======================================================
তথ্যসূত্র : (১) রাজা এবং রাষ্ট্রের ধর্ম: দণ্ডনীতির উৎপত্তির গল্প --
অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, (২) প্রাণদণ্ড – ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশ (৩) মনুসংহিতা (সপ্তম অধ্যায়), (৪) সেতু – ১৫ জুলাই, ১৯৯৯, (৫) মানবাধিকার ও সিক্রেট পুলিশ – প্রদীপচন্দ্র বসু, (৬) লাঞ্ছিত মানবাত্মা – সৌমেন নাগ, (৭) মাসিক বাঙলাদেশ – মে ২০০৩, (৮) Wikipedia, (৯) WikiLeaks, (১০) অর্থশাস্ত্রম্ – কৌটিল্য, (১১) দেশ – চিঠিপত্র – ৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৩, (১২) এবেলা – ৮ আগস্ট, ২০১৫।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন