সালটা ১৯৯৩। তখন মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর শহরে “দৈনিক সব্যসাচী”-তে চাকরি করতাম। ওই সংবাদপত্রে কাজ করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। ঘনিষ্ট সম্পর্ক হয়েছিল কালুদা, সুধাংশুদা, রঞ্জিতদা, জাকির এবং আনোয়ারের সঙ্গে। সুধাংশুদা এবং রঞ্জিতদা আমার থেকে বয়সে সিনিয়ার ছিলেন, জাকির, আনোয়ার এবং আমি সমবয়সিই ছিলাম। বলতে গেলে জাকির ছিল আমার ছায়াসঙ্গী। ইদের আগের দিন জাকির আমাকে বলল, “আমার সঙ্গে একটু বেরবে ?” আমি বললাম, “কোথায় ?” জাকির বলল, “কাল ইদ আছে। কিছু কেনাকেটা করব।“ –- জামাকাপড় কিনবে? –- না গো, খাবার-দাবার কিনব।
বিকেল-বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম বাজারে। সন্ধেয় ডিউটি। ঠিক যখন বাজারের মুখটাতে পৌঁছলাম, জাকির আমার হাত টেনে ধরল। আমি হতচকিত হয়ে বললাম, “কী হল ?” জাকির বলল, “বাজারের ভিতর ঢোকার সময় ডানদিকে একদম তাকাবে না। আমি বললাম, “কেন, কী হয়েছে ?” –- যা বললাম, সেটাই করো। প্রশ্ন কোরো না।
না, আমি জাকিরের কথা শুনিনি। কারণ অত ভালো ছেলে আমি নই। কথা অমান্য করলাম। ডানদিকে তাকাতেই দেখলাম মাংসের দোকান, সারি সারি কয়েকটা দোকানে গোরুর মাংস ঝোলানো আছে। পাছে জাকির দেখে ফেলে আমি ডানদিকে তাকিয়েছি, তাই দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে সিম্যুই হাত দিয়ে পরীক্ষার ছলনা করতে থাকলাম। আমার হাতে-ধরা সিম্যুই দেখে জাকির বলল, “তোমার এটা পছন্দ ?” তারপর দোকানদারকে বলল, “এটাও দিয়ে দিন”।
আগামীকাল আমার ইদের নেমন্তন্ন হল। এটাই আমার ইদের প্রথম নেমন্তন্ন। তাই রাখবার দায় আছে। আর নেমন্তন্ন মানেই তো ব্যাপক ভোজন। তার উপর ভাবলাম, মুসলিমদের উৎসবে নেমন্তন্ন, নতুন নতুন রেসিপি তো মিলবেই। জাকিরকে মজা করে বললাম, “মেনুর বিস্তারিত বিবরণ দাও। পোষালে যাব, না পোষালে ….” জাকির বলল -- সিম্যুই, লাচ্চা-সিম্যুই, ফিরনি ছাড়াও নতুন কিছু আইটেমও পাবে। আমি উজ্জীবিত হয়ে বললাম, “নতুন আইটেম ? বিফ, মানে গোরুর মাংসও ?” –- “চো-ও-ও-ও-ও-প”। জাকিরের ওই দাবড়ানিতে আমার প্যান্ট হলুদ হয়ে যাওয়ার জোগাড় ! –- কী হল, এত ক্ষেপে যাওয়ার মতো আমি কী বলেছি ? – না, কিছু বলোনি। যা বলেছ তা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ কোরো না। বাবা শুনলে আমার কল্যা কেটে কংসাবতীতে ভাসিয়ে দেবে। এটা গুনাহ্।
পরদিন দাশপুরে জাকিরের বাড়িতে। আপ্যায়ন ? উঃ, জাস্ট ভাবা যায় না ! ভিভিআইপি সন্মান। কথা হল পরিবারের সকলের সঙ্গে। ছোটোদের চুমু, আর বড়োদের প্রণাম সেরে বসলাম। এলেন মা, জাকিরের মা। স্পেশাল পরিচয় পর্ব। মায়ের মুখমণ্ডলে যে উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম, তাতে মনে হল উনি যেন অনেকদিন পর তাঁর হারানো ছেলে ফিরে পেয়েছেন। মা বোধহয় এমনই হয়। মায়ের কোনো ধর্ম হয় না, জাত হয় না, বর্ণ হয় না, দেশ হয় না। মা মা-ই হয়।
দরজার বাইরে জনা দশেক মুখ অপেক্ষা করছে। তাদের দু-হাতে ভোজনপাত্র। জাকির বলল, “উপরে উঠে বসো। খেয়ে নাও”। উপর, মানে একটা মাঝারি মাপের চৌকি। চৌকির উপর ধবধবে সাদা কাপড় বিছানো মোটা গদি। গদির উপর ওই ভোজনপাত্রগুলি অর্ধবৃত্তাকারে সাজিয়ে দেওয়া হল। মা বললেন, “বাবা, বসে পড়ো। খেয়ে নাও। যেটা বেশি ভালো লাগবে, সেটা চাইবে”। আমার তো চক্ষু চড়কগাছ ! এত খাবার খাব কীরূপে !
জাকির বাঁচালো। “যেটা তোমার পছন্দ সেটা তুমি খাও। মা গল্প বলার জন্য উশখুস করছেন। মা গল্প করতে খুব ভালোবাসেন। একবার শুরু করলে থামতে চান না”—জাকির একথা জানাতেই আমিও লুফে নিলাম অফার। বললাম, “আমিও গল্প শুনতে ভালোবাসি”। তারপর শুরু হয়ে গেল গল্প বলা। যেন খই ফুটছে। সম্প্রীতির গল্প, বিচ্ছেদের গল্প, দেশভাগের গল্প, একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে চলে আসার গল্প, জীবন-সংগ্রামের গল্প, ধর্মসংকটের গল্প –- কত গল্প, গল্পের কত ডাইমেনশন, কত শেড।
-- খোদা হাফিজ।
-- আমি বললাম, “সব্বাই ভালো থাকবেন, সব্বাই”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন