আজ থেকে ২৫ বছর আগের একটি ঘটনা
দিয়ে শুরু করতে চাই। ঠেকে কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ “মরে গেলাম রে,
মরে গেলাম রে” আর্ত চিৎকারে আমরা বিচলিত হয়ে
গেলাম। চিৎকার অনুসরণ করে চিৎকারের উৎসে পৌঁছে গেলাম আমরা। দিনুকাকু তাঁর দুই সোমত্ত
ছেলেমেয়েকে আগাপাছতলা রুল দিয়ে পিটাচ্ছে। দিনুকাকু পুলিশের কনস্টেবল। আর পাঁচটা
দিনের মতো দিনুকাকু সেদিনও ডিউটিতে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড পেট ব্যথার জন্য
মাঝপথেই বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে তাঁর
দুই ছেলেমেয়েকে বিছানায় মৈথুনরত অবস্থায় দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। শুধু যৌনমিলন
নয়, ভাইবোনে বিয়ে করে
অনেককে সংসারধর্ম করতেও দেখা যায়। এর বছর কয়েক বাদে আমার এক পরিচিত মেয়ে তাঁর
মাসির ছেলেকে বিয়ে করে বসল। দুটি ঘটনার মধ্যে একটা কমন ফ্যাক্ট ছিল, দুটি মেয়েই সঙ্গী হিসাবে বেছেছিল
ভাইকে, দাদাকে নয়। “বাবার সঙ্গে সহবাস
করে মেয়ে গর্ভবতী”।
“দাদার সঙ্গে বোনের
শারীরিক সম্পর্কে গর্ভবতী” ইত্যাদি -- আজকাল খবরের কাগজ খুললেই এমন
ঘটনা প্রচুর লক্ষ করা যায়। এই ধরনের সম্পর্ককে ‘অজাচার’ বলে। অজাচার হল ঘনিষ্ঠ রক্তীয় সম্পর্ক আছে এমন আত্মীয়ের সঙ্গে যৌনকর্ম
বা যৌনসঙ্গম। সাধারণত অজাচার তিনটি যৌনসম্পর্কে
ইঙ্গিত করে। যেমন -- কন্যার সঙ্গে
পিতার, পুত্রের সঙ্গে মাতার এবং বোনের সঙ্গে ভাইয়ের যৌনকর্ম
বা যৌনসঙ্গম। সকল প্রধান ধর্মে অজাচার নিষিদ্ধ ও গর্হিত হিসাবে ধিকৃত। তা সত্ত্বেও
ধর্মগ্রন্থগুলিতে অজাচার কাহিনিতে ভরপুর হয়ে উঠেছে। আধুনিক ও সভ্য সমাজে এই ধরনের
সম্পর্ক ঘৃণ্য পরিপ্রচলিত আইন ও সামাজিক মূল্যবোধ এই তিন মাপকাঠিতেই নিষিদ্ধ ও
পরিত্যাজ্য বিবেচিত হলেও সমাজে গোপনে অজাচার সংঘটিত হয়ে থাকে। কন্যার সঙ্গে পিতার
এবং ছোট বোনের সঙ্গে ভাইয়ের অজাচারের কথা বেশি শোনা যায়। এছাড়া সৎ কন্যার সঙ্গে
পিতার এবং সৎ বোনের সঙ্গে সৎ ভাইয়ের অজাচার তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে এ পর্যন্ত
পাঠ করে যাঁরা ভাবছেন আমরা যত সভ্য হচ্ছি তত নোংরা হচ্ছি, কিংবা
যাঁরা ভাবছেন এটি আধুনিক সমাজের ট্রেন্ড – তাঁদের বলব এসব
পরে ভাববেন। তার আগে জেনে নিই প্রাচীন যুগেও অজাচার ছিল কি না। থাকলেও কেমন ছিল
সেই অজাচার সম্পর্ক।
প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত
ফেরাউন তুতেনখামেন ছিলেন অজাচারের ফসল। অর্থাৎ তাঁর বাবা-মা ছিলেন আপন ভাই-বোন।
অনেকে মনে করেন, মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর
প্রধান কারণ এই রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে অজাচার।মিশরীয়দের বিশ্বাস রক্তের
সম্পর্কীয় আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষিত হয়। তৎকালীন মিশরীয়
বিশ্বাস ও সংস্কার বিবেচনা করলে তুতেনখামেন যে আপন ভাই-বোনের যৌন সম্পর্কের ফসল তা
অনেকখানি নিশ্চিত হওয়া যায়। মৌলিক বিবেচনায় ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি ধর্মগুলির ভিত্তিই
হছে অজাচারী। কোরানের মতে পৃথিবীতে আসার পর আদম
ও হাওয়ার ৩৬১টি সন্তান হয়। এর মধ্যে একমাত্র শিস ব্যতীত সবাই
জোড়ায়। হাদিসে আছে আদম ও হাওয়ার গর্ভে প্রতিবার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্ম
নিত। তারা যখন বড় হত, তখন ছেলে পূর্বে জন্ম নেওয়া মেয়ের
সঙ্গে এবং মেয়েকে পূর্বে জন্ম নেওয়া ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হত। যদিও তারা একই মায়ের সন্তান, তবু প্রয়োজনের
কারণে ও মানবজাতির বিকাশের জন্যে এটা বৈধ ছিল – তাই অজাচার,
কিন্তু অনাচার নয়। ইসলামে
এখন আপন ভ্রাতা ভগ্নী ভিন্ন অন্য কোনো জ্ঞাতিভাই বা বোনের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক
বৈধ। খ্রিস্টধর্মের কাহিনি মতে আদম ও ইভের ঔরসে নাকি মাত্র দুজন
পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল। সেটাই যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ছেলে আর মায়ের মাঝে ঘটিত
অজাচারের মাধ্যমে মানুষের বংশবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ আদম ও ইভের ঔরসে জন্ম নেওয়া ছেলেমেয়ে অর্থাৎ ভাই-বোনদের মাঝে ঘটিত অজাচার থেকেই
মানবজাতির শুভাযাত্রা। বাইবেলের মতে আদম ও ইভের অনেক সন্তানের মধ্যে প্রথম দুই
ছেলের নাম ছিল কেইন ও আবেল। কেইনের এক জমজ বোন ছিল আর আবেলের সঙ্গে জন্মায় আরও
দুই বোন -- মানে ত্রয়ী। আদমের প্রথম দুই
মেয়ের নাম ছিল আজুরা ও আওয়ান। কেইন ও আবেল দুজনেই নিজেদের জমজ বোনকে বিয়ে করে।
কিন্তু তৃতীয় বোনকে কে বিয়ে করবে এই নিয়ে ঝগড়ায় কেইন আবেলকে বধ করে। আদমের
তৃতীয় পুত্র শেথ তার এক ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বিয়ে করে। তওরাত আইনে (মোজেস প্রণীত) কাকা-ভাইঝি বিবাহ স্বীকৃত। ইহুদি ধর্মানুসারেও আদি
মানব-মানবী আদম ও লুসি এবং তাদের সন্তানদের মাঝে অজাচারের মাধ্যমেই মানবজাতির
বংশবৃদ্ধি হয়েছে। জৈন ও জুরাথ্রুস্ট ধর্মাবলম্বীরাও মূলত জারজত্বের
উপরই প্রতিষ্ঠিত।
বিশেষ করে পারস্য জুরাথ্রুস্টীয় ধর্মে অজাচার অর্থাৎ ভাই-বোন, বাপ-মেয়ে বা মা-ছেলের মধ্যে বিয়েকে বেশ সন্মানের চোখেই দেখা হত। অনেক
রাজপরিবার অজাচারেরই ফসল ছিল। হিন্দুধর্মের ভিত্তিও মূলত অজাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। কেন-না হিন্দুধর্মে
আদি পুরুষ মনু। প্রজাপতি ব্রহ্মার চতুর্দশ পুত্রের অন্যতম মনু।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ (১:৪১:২-৬) মতে স্বয়ং সেই প্রজাপতি দ্বি-বিভক্ত হয়ে মনু ওশতরূপা হলেন। মনু বা পরম ব্রহ্ম বা প্রজাপতি হতেই শতরূপা সৃষ্টির কারণে তাকে ব্রহ্মার কন্যা বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে মৎস্য পুরাণে। “সো হেয়মীক্ষাঞ্চক্রে কথং নু মাত্মন এব
জনয়িত্বা সমভবতি, হস্ত তিরোহসানীতি, সা
গৌরভবদৃষভ ইতরস্তা সমেবাভবঃ, ততে। গাবোহজায়ন্ত,
বড়বেতরাভবদশ্ববৃব ইতরো গর্দ্দভীতরা
গর্দ্দভ ইতরন্তাং; সমেবাতবং, তত একশফমজায়তাহজেতরাভবদ্ভন্ত ইতরোহবিরিতর। মেব ইতরস্তাং সমেবাভং, ততোহজাবয়োহজায়ন্তৈবমেব যদিদং কিঞ্চ মিথুনমা পিপীলিকাভ্যন্তং সর্ব্বমসৃজত।।
৪১।।৪”।
অর্থাৎ সেই শতরুপা চিন্তা করলেন, ভাল, মনু আমাকে নিজের থেকে উৎপন্ন করে আমাতেই আবার উপগত
হলেন কি করে
? যাই হোক, আমি
তিরোহিত হই এবং রূপান্তরে আবৃত হই। এইরূপ চিন্তা করে তিনি গোরু হলেন, তা দেখে
মনুও
বৃষভরূপী হয়ে গোরুতে উপগত হলেন। সেই সংসর্গের ফলে গো-জাতির উৎপত্তি হল। শতরূপা আবার অশ্বলূপা হলেন, মনু
তখন বলবান অশ্বরূপ ধারণ করলেন এবং উপগত হলেন। শতরূপা গাধী হলেন, মনুও গাধা হলেন এবং উপগত হলেন। এইভাবে তিনি সেই মথরূপাতে রমণ করলেন; তাতে একশফ
-- যাদের পায়ে একটিমাত্র খুর থাকে, সেই
অশ্ব, অশ্বতর ও গাধাজাতি উৎপন্ন হল। পুনশ্চ শতরূপা অজা (ছাগী) হলেন, মনুও
অজ হলেন। শতরূপা
আবার
মেষরূপ ধারণ করলেন, মনুও মেষশরীর গ্রহণপূর্ব্বক তাতে উপগত হলেন; তার ফলে ছাগ ও মেষজাতি
জন্মলাভ করল। এইভাবে পিপীলিকা থেকে আরম্ভ করে যে কিছু স্ত্রীপুংভাবাপন্ন প্রাণী আছে, সে
সমুদয়
প্রাণী সৃষ্টি করলেন। কাজেই
মনু ও আদি নারী থেকে যেসব মানব সন্তান বা অন্যান্য প্রাণীরা জন্মে, সেসব ভাই-বোনদের মাঝে অজাচারের মাধ্যমেই মানব সভ্যতার আদি যাত্রা।
হিন্দুধর্মে অজাচারের আরও ঘটনা রয়েছে। যেমন -- যম ও যমী
ভাইবোন অথচ যমী যমের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক কামনা করেছে। ’দশরথ
জাতক’-এ বর্ণিত আছে, রাজা দশরথ ও রানী কৌশল্যার
মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল, তথাপি তাদের মধ্যে বিয়ে
হয়েছিল। ঋগবেদে দেখা যায়, দম্ভ নিজ বোন মায়াকে, লোভ নিজ বোন নিবৃত্তিকে,
ক্রোধ নিজ বোন হিংসাকে ও কলি নিজ বোন নিরুক্তিকে বিয়ে করেছিল।
কাজেই দেখা যায়, হিন্দু ধর্মে অজাচারের ছড়াছড়ি। বৌদ্ধ জাতকে ও জৈন
সাহিত্যেও ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের কথা উল্লেখ আছে। শুধু ভাই-বোন নয়, হিন্দু ধর্মে মা-ছেলে (ইদিপাস কমপ্লেক্স) বা পিতা-কন্যার (ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স) মধ্যে দৈহিক সম্পর্কের স্বীকৃতিও দেখা যায়। ঋগবেদে
উল্লেখ আছে -- পূষণ তার বিধবা মাকে বিয়ে করে দ্বিধিষু
অর্থাৎ বিধবার স্বামী হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র ‘মৎসপুরাণ’-এ বর্ণিত আছে -- ব্রহ্মা নিজ কন্যা শতরূপার প্রতি প্রণয়াসক্ত হন এবং হিন্দুদের আদি মানব মনুর
জন্ম হয় ব্রহ্মা আর শতরূপার মিলন থেকেই।’ আদি মানব বা প্রথম স্রষ্টা ছিলেন ব্রহ্মা। তিনি ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করলেও, নিজে সেরকমভাবে কোথাও পূজিত হন না।
কারণ অনেকগুলি হলেও তার মধ্যে
উল্ল্যেখযোগ্য ওনার অজাচারী স্বভাব। ব্রহ্মা স্বয়ম্ভূ -- পদ্মফুল বা মতান্তরে জল থেকে জন্ম -- একটি মাথা
নিয়ে। নিজের দেহ থেকে উনি অন্য অনেক প্রাণীর সঙ্গে এক অপরূপ সুন্দরী নারী সৃষ্টি
করেন, যার
নাম শতরূপা। শতরূপা অনেকসময় সাবিত্রী বা ব্রাহ্মি বা সরস্বতী বা গায়ত্রী নামেও
পরিচিত। ব্রহ্মা নিজের সৃষ্টি করা কন্যার প্রেমে পড়ে গেলেন। শতরূপা লজ্জা পেয়ে যেদিকে
লুকোতে যান, ব্রহ্মা
সেইদিকে নিজের একটি করে মাথা তৈরি করেন। এভাবে উনি চারদিকে চারটি আর উপরে একটি -- মোট পাঁচটি মাথা তৈরি করেন।
ব্যাপারটা সামলাতে শিব এইসময় এগিয়ে এলে ব্রহ্মা শিবকে অপমান করে বসেন এবং
পরিণামে শিবের তৃতীয় নয়নের তেজে উপরদিকে মুখ করা মাথাটি ভস্ম হয়ে যায়। সেই থেকে
অজাচারী ব্রহ্মার পাঁচটি মাথা, আর অজাচারের শাস্তি হিসেবে
মর্ত্যলোকে পূজিত হন না। বিচিত্রবীর্য যখন টিউবারকোলেসিসে অকালে মারা যান, তখন বংশরক্ষার জন্য দুই সহোদরা
পুত্রবধুর ঘরে শাশুড়ি সত্যবতী পাঠিয়ে দেন তাঁরই কুমারী অবস্থায় পরিত্যক্ত জারজ
সন্তান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে। অর্থাৎ নিয়োগ প্রথায় ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর
জন্ম অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে, তাঁদের সম্পর্কে ভাসুর ব্যাসদেব দ্বারা। ফল : ধৃতরাষ্ট্র
এবং পাণ্ডু, যাঁরা অজাচার সন্তান। গ্রিক পুরাণেও অজাচারে ছড়াছড়ি।ওসিরিস
তার যমজ বোন আইসিসকে বিয়ে করেন। মাতৃজঠরে থাকার সময় থেকেই ওসিরিস তার বোন আইসিসকে
ভালবাসতে থাকেন। ওসিরিস ও তার বোন আইসিসের অজাচারের ফসল বাজপাখির মাথাবিশিষ্ট
মিশরের গুরুত্বপূর্ণ এক দেবতা হোরাস। ফেরাউনরা নিজেদের আইসিস ও ওসিরিসর
সন্তান হোরাসের বংশধর বলে মনে করতেন। দেবতা হোরাস অজাচারের ফসল, তবে এই অজাচারের কাহিনি কল্পনার অংশ নয়, প্রাচীন মিশরীয় রাজা-বাদশাদের
মধ্যে তা স্বাভাবিকভাবেই
ছিল। গ্রিক পুরাণের প্রধান দেবতা জিউসও তার বোন হেরাকে বিয়ে করেন। মাকে বিয়ে করার ঘটনাও গ্রিক পুরাণে পাওয়া যায়।
অজাচার রুখতে কঠোরতা : মেলানেশিয়ার ছেলেদের পক্ষে মা ও
বোনের সান্নিধ্য সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে নিষিদ্ধ। যেমন -- নিউ
হেব্রাইডসের লেপারস্ দ্বীপে ছেলে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মার বাড়ি ছেড়ে
সরাইখানাতে চলে যায়। সেইখানেই সে নিয়মিত আহারাদি করে ও নিদ্রা যায়। এরপরেও সে
বাড়িতে আসতে পারে এবং খেতে চাইতে পারে, তবে তার বোন যদি
বাড়িতে থাকে তাহলে না-খেয়েই তাকে ফিরে যেতে হবে। আর বোন যদি বাড়ির ধারে-পাশে না থাকে, তাহলে সে দোরগোড়ায় বসেও খেতে পারে। যদি
ভাই-বোনে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে যায়,
তাহলে বোন দৌড়ে পালাবে, কিংবা ঘুরে দাঁড়াবেন এবং নিজেকে
লুকিয়ে ফেলবে। যদি ভাই বোনের পদচিহ্ন কোথাও চিনতে পারে তাহলে সেই চিহ্ন সে অনুসরণ
করবে না। বোনের বেলায়ও ওই একইরকম নিয়ম। ভাই কখনও বোনের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করবে না। এমন কি চলতি কথার মধ্যে নামের আংশিক শব্দও যাতে উচ্চারণ
না-করে ফেলে সেই বিষয়ে অবহিত থাকতে হবে ! এই ‘এড়িয়ে
চলা’ শুরু হয় বালকের বয়ঃসন্ধি উৎসব হওয়ার পর থেকে এবং এই
নিয়ম সারাজীবন কঠোরভাবে পালিত হয়ে থাকে। মা ও ছেলের মধ্যে ব্যবধান বয়ঃবৃদ্ধির
অনুপাতে বাড়তে থাকে এবং এ বিষয়ে মার দায়িত্বই বেশি। মা যদি ছেলের জন্য কোনো খাবার
জিনিস নিয়ে আসে তাহলে সেই খাবার সরাসরি ছেলেকে নিজে পরিবেশন না-করে পাত্রটি ছেলের
সামনে মাটিতে নামিয়ে দেন। মা ও ছেলের ঘরোয়া সম্পর্কে সম্বোধন
না-করে মা ছেলের প্রতি ভদ্রতাসূচক সম্বোধন ব্যবহার করে। নিউ ক্যালিডোনিয়াতেও এই
ধরনের ব্যবস্থা প্রচলিত লক্ষ করা যায়। এখান যদি ভাই-বোনে
কোথাও দেখা হয়, বোন দৌড়ে বনের মধ্যে পালিয়ে যায়, আর ভাই বোনের দিকে ঘাড়টি না-বেঁকিয়ে সোজা এগিয়ে বলে চলে যায়।নিউ ব্রিটেনের গেজেলি উপদ্বীপে বোনেরা বিয়ের শুরু থেকে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ
করে দেয়। এমনকি তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে না। তবে ভাইকে উদ্দেশ করতে হলে
নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। নিউ নেকলেনবার্গে কোনো কোনো জ্ঞাতি ভাই-বোনেরা এইরূপ
নিষেধাবলির শাসনে এসে পড়ে। ভাই-বোনের পক্ষেও অবশ্য ওই নিষেধ
প্রযোজ্য। তারা পরস্পরের কাছে এগিয়ে হাত মেলাতে পারে না। একে অন্যকে উপহার দিতে
পারে না। তবে কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে পরস্পর কথা বলতে পারে। এখানে বোনের সঙ্গে অজাচার
সম্পর্কের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। সুমাত্রা দ্বীপের বাত্তাস জাতির মধ্যে দেখা যায় সকল প্রকার নিকট-সম্পর্কীয়দের
মধ্যেই সান্নিধ্য পরিহার করা বিধি। যেমন কোনো বাত্তাবাসীর পক্ষে বোনকে নিয়ে
সান্ধ্যভোজে যাওয়াটা অত্যন্ত আপত্তিজনক। অন্য
লোক উপস্থিত থাকলেও ভাই-বোনের একত্র উপস্থিতিতে ভাই অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করবে।
আত্মীয়দের একজন বাড়িতে প্রবেশ করলে অন্যজন বাড়ি থেকে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করবে।
বাপের পক্ষে মেয়ের সঙ্গে একা এক গৃহে থাকা এবং মায়ের পক্ষে ছেলের সঙ্গে অনুরূপ
অবস্থান অসম্ভব। যে ওলন্দাজ ধর্মযাজক এই সব প্রথা লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি বলেছেন যে, দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সব প্রথা খুব দৃঢ়মূল। একজন
পুরুষ ও একজন নারী একসঙ্গে একাকী থাকলে তারা যে ঘনিষ্টতম দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন
করবে, এ বিষয়ে এই সকল জাতির মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রিটিশ
ইস্ট আফ্রিকার আকাম্বা বা ওয়াকাম্বাদের মধ্যে প্রচলিত একটি বিশেষ বিধি হামেশাই
দেখতে পাওয়া যায়। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে বিয়ে না-হওয়া পর্যন্ত মেয়ে খুব
সাবধানে বাবাকে এড়িয়ে চলে। কোনো পুরুষের সঙ্গে বাগ্দত্তা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত
মেয়ে যদি পথে তার পিতাকে দেখতে পায় তাহলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবে এবং কখনও পিতার খুব
কাছাকাছি বসার চেষ্টা করবে না। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাবার সঙ্গে সামাজিক
ব্যবহারে আর কোনো বাধা থাকে না। ব্যাঙ্কস্ দ্বীপে এই সব বিধিনিষেধ খুবই কঠোর ও পীড়াদায়কভাবেই ত্রুটিশূন্য।
এখানে জামাতা ও শাশুড়ি উভয়েই পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। যদি তাদের পরস্পরের সঙ্গে পথে
দেখা হয়ে যায়, তা হলে শাশুড়ি জামাইয়ের দিকে পিছন ফিরে সরে
দাঁড়ায়। জামাইও এরূপ না-করা পর্যন্ত বা চলে না-যাওয়া পর্যন্ত শাশুড়ি ওইভাবে দাঁড়িয়ে
থাকে। ভ্যানা লাভাতে সমুদ্রতীরে চলার সময় যতক্ষণ-না শাশুড়ির পদচিহ্ন
ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায়, ততক্ষণ জামাই শাশুড়ির অনুগমন করবে
না। তবে তারা দূর থেকে কথাবার্তা বলতে পারেন। একে
যে অন্যের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবে না, সেকথা বলাই
বাহুল্য। সোলেমন
দ্বীপে বিয়ের সময় থেকেই জামাই শাশুড়ির সঙ্গে সাক্ষাৎ বা বাক্যালাপ করবে না। যদি
শাশুড়িকে পথে দেখতে পায় তাহলে সে যেন তাকে চেনে না। এমন ভাব দেখাবে এবং নিজেকে
লুকিয়ে ফেলার জন্য সাধ্যমতো দৌড় দেবে। তবে বাঙালিদের মধ্যেও একদা জামাই-শাশুড়ি এমন আচর লক্ষ
করেছি। জামাইকে
দেখলেই শাশুড়ির সরে যাওয়া এবং মাথার উপর ঘোমটাটাকে বাড়িয়ে দিতে দেখা যেত। আজও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ-দৃশ্য বিরল
নয়।
অজাচার এবং বিজ্ঞান : বিবর্তনবাদ অনুসারে আজকের যুগে
মানুষের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় হচ্ছে গরিলা (Gorrilla)। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, শিকারীদের হাত
থেকে বাঁচানোর জন্যে আটককৃত এক গরিলার দুটি সন্তান একটি পুরুষ ও আরেকটি নারী জন্ম দেয়। উক্ত
গরিলা সন্তান-দুটি যখন বড়ো হয়ে যৌবনে পদার্পণ করে, তখন মেয়েটি তার ভাইয়ের প্রতি প্রণয়াসক্তি প্রকাশ করে, কিন্তু ভাই তা গ্রহণ করে না। এ নিয়ে গবেষকগণ বিশেষ চিন্তায় পড়ে যান।
পরবর্তী সময়ে সেখানে অন্য আর-একটি মেয়ে গরিলাকে আনা হলে,
ওই পুরুষ গরিলাটি নূতন আগন্তুকের প্রতি প্রণয় প্রকাশে পাগল হয়ে
উঠে এবং যৌনমিলনে ব্যস্ত থাকে। আপন
বোন হওয়ার কারণে পুরুষ গরিলাটি নিজ বোনের প্রণয়কে প্রত্যাখ্যান করে। এভাবেই
হয়তো মানুষ ক্রমান্বয়ে অজাচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মহাবিজ্ঞানী ডারউইনের
বিবর্তনবাদ অনুযায়ী আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছে নিচুস্তরের প্রাণীদের থেকে
অত্যন্ত ধীরগতিতে বিন্দু বিন্দু পরিবর্তনের মাধ্যমে। আমরা নিচুস্তরের প্রাণীদের
মাঝে পিতা-মাতা ও তাদের সন্তানদের মাঝে যৌনমিলনকে অজাচার হিসেবে গণ্য করি না, কিংবা করি না এমন যৌনসম্পর্ক থেকে জাত সন্তানদেরকে জারজ হিসেবে চিহ্নিত।
অর্থাৎ আজকের যুগের মানবেতর প্রাণীদের মাঝে অজাচার বা জারজ বলে কিছু নেই বা
মানবেতর প্রাণীকুলের মাঝে অজাচার বা জারজত্ব বৈধ। বিজ্ঞান
মতে, আমাদের সুদূর অতীতের পূর্বপুরুষরা যখন
মানবেতর প্রাণীকুলের প্রবৃত্তির কাছাকাছি ছিল, তখন তাদের
মাঝে অজাচারের মতো সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল বা থাকতে পারে। আজ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে
পৃথিবীতে বিদ্যমান আমাদের পূর্বপুরুষদের যেসব ফসিল (Fossil) পাওয়া
যায়, তাদের দেহাকৃতি আমাদের আধুনিক মানুষের দেহাকৃতি থেকে
ভিন্ন ছিল। এবং স্পষ্টত তাদের মেধা, চিন্তাচেতনা ও মানবিক প্রবৃত্তি
আধুনিক মানুষের থেকে অনেক নিচুস্তরের বা পশুপ্রবৃত্তির কাছাকাছি ছিল। আমাদের ওইসব
আদি পুরুষদের মাঝে অজাচারের মতো ঘটনা ঘটে থাকতেও পারে। কিন্তু সেটাকে অজাচার বলা
যাবে না। যেমন
করে আজকের যুগের মানবেতর প্রাণীদের মাঝের সম্পর্ককে অজাচার বলা হয় না। কিন্তু ওই
আদি পুরুষেরা যখন ক্রমেই আধুনিক সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে থেকে, তারা নিকটাত্মীয়দের মাঝে যৌন সম্পর্ককে বর্জন করতে থাকে।
আজকের পৃথিবীতে ধর্মে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, সুসভ্য-অসভ্য
সকল মানুষই সাধারণত অজাচারকে বর্জন করে। আর বিজ্ঞান তো রীতিমত অজাচার জাতীয়
সম্পর্ককে বর্জনীয় আখ্যা দিয়েছে বৈজ্ঞানিক কারণেই। কেন-না অজাচার
জাতীয় সম্পর্ক জিনেটিক (Genetic) ত্রুটি বা রোগকে
ত্বরান্বিত করে, যা মানব বংশলতিকার জন্যে ক্ষতিকর। বিজ্ঞান
জিনেটিক তত্ত্বের ভিত্তিতে অজাচারকে আশ্রয় দেয় না। ইসলাম, ইহুদি,
খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মগুলি যদিও মানবজাতির সূচনাকে কেন্দ্র করে পরোক্ষভাবে
অজাচারকে সমর্থন করে, তথাপি এ সব ধর্মগুলিও অজাচারকে সুস্পষ্টভাবে
নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কাজেই আজকের এ সভ্য জগতে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলেই অজাচার
জাতীয় সম্পর্ককে বর্জন করেছে। তথাপি এ ধরনের যৌন-বিকৃতির ঘটনা কদাচিৎ ঘটে থাকে
প্রত্যেক সমাজেই বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে। ধার্মিক-অধার্মিক সবাই আজকের যুগে
অজাচারকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে বা ঘৃণা করে নৈতিক বিচারে এবং আধুনিক বিজ্ঞানও
সেটাকে সমর্থন করেছে যথার্থ বৈজ্ঞানিক কারণেই। কাজেই অজাচারের মাধ্যমে জাত
সন্তানদেরকেও বিজ্ঞান একদমই সমর্থন করে না।সেই
সুদূর অতীতে যখন আমাদের আদি পুরুষদের মাঝে অজাচার ঘটেছে, বিজ্ঞান মতে সে সময়ে মানুষ বর্তমান যুগের মানুষের তুলনায় অসভ্য
প্রাণীদের কাছাকাছি ছিল, যাদের মাঝে ঘটিত অজাচারকে প্রকৃত
বিচারে অজাচার বলা যায় না।
৯টি মন্তব্য:
খুব ভালো লিখেছেন। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
খুব খুশি হয়েছি। ভালো থাকবেন।
সন্তান জন্ম না দিয়ে অজাচার প্রতিষ্ঠা করলে কি হবে বিজ্ঞান কি বলে ?
এ বিষয়ে বিজ্ঞান কিছু বলেনি তবে নৈতিকতা বলে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ তাদের মাঝে সম্পর্ক যায় হোক তারা তাদের বিছানায় কি করবে কি করবে না তাতে কেউ নাক গলাতে পারে না।
এ বিষয়ে বিজ্ঞান কিছু বলেনি তবে নৈতিকতা বলে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ তাদের মাঝে সম্পর্ক যায় হোক তারা তাদের বিছানায় কি করবে কি করবে না তাতে কেউ নাক গলাতে পারে না।
যথার্থই বলেছেন। যৌনতার সম্পর্ক যৌনতা। কার সঙ্গে সেটা হচ্ছে তা নিয়ে টেবিল গরম করার কোনো যুক্তিযৌক্তিকতা আছে বলে আমি বলে মনে করি না, যদি উভয় পক্ষের সম্মতি থাকে।
অজাচার খুবই ঘৃণ্য এবং ঘোরতর পাপ । যারা এইধরণের সম্পর্কে লিপ্ত ভগবান যেন তাদের কঠোর শাস্তি দিক অথবা তাদের ধ্বংস করে দিক ।
অজাচার খুবই ঘৃণ্য এবং ঘোরতর পাপ । যারা এইধরণের সম্পর্কে লিপ্ত ভগবান যেন তাদের কঠোর শাস্তি দিক অথবা তাদের ধ্বংস করে দিক
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন