মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান (দ্বিতীয় পর্ব)



জ্যোতিষীবাবুদের গ্রহ, নক্ষত্র, রাশি, লগ্নের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
(১) ১৮ ডিগ্রির এক টুকরো আকাশে যদি ১২ টি রাশি থাকে, তাহলে ৩৬০ ডিগ্রি আকাশে ডিগ্রির আকাশে কত লক্ষ রাশি থাকতে পারে ভাবুন। তবে তো খুব ভয়ানক ব্যাপার, এত লক্ষ লক্ষ রাশির প্রভাব হিসাবে উচিত নয় ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(২) জন্মকালে চন্দ্র যে রাশিতে থাকে সেটিই জাতকের রাশি বলা হয়। শুধু চন্দ্র কেন, সৌরজগতে তো আরও অসংখ্য গ্রহ আছে উপগ্রহ আছে – সেগুলি বিচার্য নয় কেন ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৩) জাতকের জন্মসময় কোনটি ? এটা বড্ড গোলমেলে ব্যাপার ! কেউ মনে মনে করেন মাতৃজঠরে ভ্রূণের প্রথম দিন, কেউ মনে করেন মাতৃজঠরে থাকাকালীন যেদিন শরীরে প্রাণসঞ্চার হয়, কেউ মনে করেন যেদিন শিশু মাতৃগর্ভ ত্যাগ বেরিয়ে আসে, আবার কেউ মনে করেন শিশুর নাড়ি কাটার সময়, কেউ আবার এত ঝামেলায় না-গিয়ে চিকিৎসকের দেওয়া সার্টিফিকেটের জন্মসময় গ্রাহ্য করে – এক্ষেত্রে আবার সংশয়, চিকিৎসক বা চিকিৎসা-কর্মীরা যে সময় নথিভুক্ত করেছেন সেটা কতটা অথেনটিক ! যাই হোক, জ্যোতিষীবাবুরা কোন জন্মসময় বিচার করে জাতকের কোষ্ঠী বিশ্লেষণ করবেন ? ভিন্ন ভিন্ন সময়কে জন্মসময় ধরলে ভিন্ন কোষ্ঠী বিচার হবে না ? হবেই তো। রাশির অবস্থান পালটালে নির্ণয়ও পালটাতে বাধ্য।এক্ষেত্রে অবশ্য জ্যোতিষীবাবুরা বলেন, লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকাল ব্যতীত লগ্ন-মধ্যবর্তী সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের সন্নিবেশের এমন কিছু তারতম্য হয় না, ফলে রাশি পালটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ও মা, সে কি কথা ! যদি জমজ সন্তান হয় ? তাদের কোষ্ঠীবিচার তো একই হবে। মানে তারা একই সময়ে পটি করতে যাবে, একই শিক্ষকের কাছে পড়বে, একইরকম বিদ্বান হবেন, একই ক্লাসে পড়া শেষ করবে, একই জায়গায় একই চাকরি করবে, একই মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করবে, একই দিনে একই সময়ে একই কারণে মরবে – তাই-ই হবে, জ্যোতিষ বিজ্ঞান হলে।হয় কী ? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মানোর পরপরই একটি সন্তান মারা যায়। তাহলে একই লগ্ন, একই গ্রহস্থান, একই রাশিচক্র হওয়া সত্ত্বেও দুইজন জাতকের আয়ুষ্কাল দুই রকমের হবে কেন ? তাহলে কী পৃথিবীর সকল জমজ জাতকই লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকালে জন্ম নেয় ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? অবশ্যই নিরুত্তর থাকেন।
(৪) পুব আকাশে রাশি উদয় হয়—এই বিষয়টি এক্কেবারেই আপেক্ষিক। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সূর্যোদয়কাল বিভিন্ন হওয়ার ফলে পুবদিকে উদিত রাশিটি ভিন্ন হবে। ফলে একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো জাতকের লগ্ন বিভিন্ন রকমই হবে, কোষ্ঠীও হবে বিভিন্ন।অতএব একই সময়ে জন্মানো সত্ত্বেও আলাদা আলাদা জাতকের আলাদা লগ্নফল এবং কোষ্ঠীচক্র হবে না, তাই তো ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৫) জ্যোতিষীদের যে শাস্ত্র, তা ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে মেনে চলে। অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য সহ সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্ররা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তত্ত্ব তো অচল তত্ত্ব, আস্তাকুড়ে তার ঠিকানা। এই ধরনের তত্ত্ব কে. সি. পালের মতো বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে পারেন, যারা ভাঙা রেকর্ডের মতো এখনও চলেছেন ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’।এই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলতে অসুবিধা আছে। ভুল হবে রাশি-গ্রহের অবস্থান। সঠিক হবে না রাশিচক্র, কোষ্ঠী-ঠিকুজি।এ তত্ত্ব সঠিক হলে গ্রহ-উপগ্রহগুলিতে মহাকাশযান কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো সম্ভব হত না।ওই তত্ত্ব ভুল, তাই জ্যোতিষ ভুল।জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৬) কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীবাবুরা যোটক বিচার করে। অর্থাৎ পাত্রপাত্রীদের রাজযোটক হলে দাম্পত্যজীবন বড়োই সুখময় হয় !!! যোটক বিচার কাকে বলে ? এককথায় – “বিবাহের পূর্বে পাত্র এবং পাত্রীর পরস্পরের জন্মরাশ্যাদি থেকে যে শুভাশুভ বিচার করা হয়, তাকে রাজযোটক বলে”।এই বিচার আট প্রকার, অর্থাৎ আট প্রকারের কূট। ‘কূট’ কথাটির অর্থ জটিল। জ্যোতিষীবাবুরা প্রবল কূট বলে দু-হাতেই আট প্রকারের ‘কূট’ সামাল দিতে পারেন। এই কূটগুলি হল – বর্ণকূট, বশ্যকূট, তারাকূট, যোনিকূট, গ্রহমৈত্রীকূট, গণমৈত্রীকূট, রাশিকূট এবং ত্রিনাড়িকূট। এদের আবার ‘গুণ’ আছে। ‘বর্ণকূট’ থেকে ‘ত্রিনাড়িকূট’ পর্যন্ত গুণ হবে ১,২,৩ ইত্যাদি। মোট নম্বর ৩৬-এর মধ্যে ১৮ নম্বর পেতেই হবে, আর তা না-হলে ডাহা ফেল।যদি ৩০-এর উপর নম্বর হয় তাহলে লেটার মার্কস হবে। একটু ‘যোনিকূট’ নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক – যোনি চোদ্দ প্রকার। দুটি করে নক্ষত্র নিয়ে এক-একটি যোনি। অভিজিৎ নক্ষত্রকে ধরে নক্ষত্রের সংখ্যা ২৮।অবশ্য সবকটি যোনিই ইতর-যোনি, অর্থাৎ ঘোড়াযোনি, মোষযোনি, বাঘযোনি, সিংহযোনি, হাতিযোনি, কুকুরযোনি, বেড়ালযোনি, ইঁদুরযোনি, বানরযোনি ইত্যাদি। না, মানুষের জন্য মনুষ্যযোনি নেই। তামাম মনুষ্যকুল ইতর-যোনির অংশ।ছাগল, কুমির, হাঙ্গর, গোরিলা, গোসাপ, শিম্পাঞ্জি, টিকটিকিদের কি যোনি নেই !
আমার বিয়ের সময় আমার শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিস পাত্রের কোষ্ঠী দেখাতে হবে। বড়োই বিপদে পড়ে গেল আমার অভিভাবক। কারণ আমার কোনো কোষ্ঠী-ঠিকুজি ছিল না। অতএব জ্যোতিষে শরণাপন্ন। জ্যোতিষীকে বলে আমার একটা ‘রাজযোটক’-এ মিল হয়েছে এমন একটা কিছু করিয়ে আনা হল। কেল্লা ফতে, বিয়ে পাক্কা।আদতে আমার রাশি, লগ্ন, কোষ্ঠী কিছুই নেই – তার আবার রাজযোটক ! আমার ১২ বছরের সংসার দিব্য চলছে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়ো মেয়ের বিয়ে ছিল রাজযোটক। ভাটপাড়ার জনৈক জ্যোতিষী মেয়ে আর হবু জামাইয়ের কোষ্ঠীবিচার করে সেটাই বলেছিলেন। রাজযোটকের বিয়ে, তা সত্ত্বেও বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের বড়ো মেয়ে বিধবা হয়ে যান। এরকম হাজার হাজার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা যায়, যেখানে রাজযোটক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে অকালে নষ্ট হয়ে গেছে। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন। (৭) একদা, মানে দেড়শো বছর আগে পর্যন্ত জ্যোতিষীবাবুরা বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকলে বাল্যবিবাহের নিদান দিতেন। তাই ওই সময় প্রায় সকল মেয়েদেরই বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকার ফলে বাল্যবিবাহ হত। ১৯৯৯ সালে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন,১৯৯৯’ চালু হওয়ার পর থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে গেল। বলবান সপ্তমপতি গেল কোথায় ? কেন্দ্রের কোণে আর থাকেন না ? গেছে।ভুল।জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকবেন।

“পৃথিবীর ১০জন সেরা মনীষীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের দেখা সবচেয়ে অপদার্থ জিনিসটিকে নিয়ে আসতে বলুন। দেখবেন, সবাই একজন করে জ্যোতিষীকে ধরে এনেছেন।” – বলেছেন গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট।না-হলে কয়েকশো কোটি বছর সৃষ্ট গ্রহ-নক্ষত্রকে দিয়ে মানুষের ভাগ্য নির্ণয় করে ! মানুষের সৃষ্টি তো কয়েকশো কোটি বছর নয় !!! বর্তমানে সূর্যের বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছর। চন্দ্র বা চাঁদের বয়স পৃথিবীর বয়সের প্রায় সমান, যা প্রায় ৪.৬ কোটি বছর। পৃথিবীতে প্রাপ্ত উল্কার বয়স ৪.৩ কোটি থেকে ৫ কোটি।  মহাবিশ্বে এরকম ব্রহ্মাণ্ডের সংখ্যা কম নয়। এখনও পর্যন্ত ১০০টি ব্রহ্মাণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের ব্রহ্মাণ্ড ছাড়া খালি চোখে আর মাত্র ৩টি ব্রহ্মাণ্ড দেখা সম্ভব। এই ৩টির মধ্যে ২টি দক্ষিণ গোলার্ধে,  আর-একটি মাত্র উত্তর গোলার্ধে। ২০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত শেষের ব্রহ্মাণ্ডটির নাম দেওয়া হয়েছে অ্যানড্রোমিডা (Andromeda)।একটি ব্রহ্মাণ্ড থেকে আর-একটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যবর্তী অংশের নাম ‘আন্তর্ব্রহ্মাণ্ড মহাকাশ’।এই শতাধিক ব্রহ্মাণ্ড ও আন্তর্ব্রহ্মাণ্ড মহাকাশ নিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।নানা পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, ব্রহ্মাণ্ড জোটবদ্ধ অবস্থায় আছে। প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ড জোট অপর প্রতিটি জোট থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেগও বৃদ্ধি পায়। ব্রহ্মাণ্ডের এহেন অস্থির গ্রহ-নক্ষত্র নিয়েই জ্যোতিষীবাবুদের কারবার। জ্যোতিষীবাবুরা এখানেই থেমে থাকেননি – তাঁরা রাজা-উজির, জীবজন্তু, জীবজন্তু, পশুপাখি, বৃক্ষলতা, পাহাড়-পর্বত – এমনকি ভারতের ভাগ্য, পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যও বলে দেওয়ার সাহস রাখে – আবার দিল্লির সিংহাসনে কে বসবেন, পশ্চিমবঙ্গের মসনদের কে উপবেশন করবেন তাও বলে থাকেন – অনেকটা সাপ মরবে লাঠি ভাঙবে না কায়দায় – যদিও এ যাবৎকাল পর্যন্ত সবই ভুলভাল বলেছেন। জ্যোতিষীবাবুরা জানেন লাগলে রাতারাতি বিখ্যাত, না-লাগলে কেউ ফাঁসি তো দূরের কথা, কেউ কৈফিয়তই নেবে না।
জ্যোতিষীর জ্যোতিষী সেরা জ্যোতিষী হলেন বি. ভি. রমন। ইনি ‘অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ম্যাগাজিন’ নামে পত্রিকাও করেন। এহেন জ্যোতিষীর কয়েকটি ঐতিহাসিক ভাগ্যনির্ণয় এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৭৯ সালে অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ম্যাগাজিনে লিখলেন, “জনতা দল সরকারের উপর এখন বৃহস্পতির কোনো ক্রোধ নেই। ফলে জনতা সরকার এবারের মতো টিকে যাবে।” দেশের রাজনীতির খবর যাঁরা রাখেন তাঁরাই জানেন জনতা সরকারের কী হাল হয়েছিল। ১৯৮০ সালে লেখা হল, “তিন গ্রহের যা অবস্থান দেখছি তাতে দিল্লিতে পাকাপোক্ত সরকার হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।” সেবার ইন্দিরা গান্ধি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতলেন। তাঁর দল ব্যাপক ফল করল।সরকার হল পাকাপোক্তই।রাজনীতির এলেম না-থাকলে এরকম ভুলভাল ভবিষ্যৎ বাণীই হয়।২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের ভবিষ্যৎ কী যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বিনা জ্যোতিষ-গণনায় বলে দেওয়া যায় – “২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলই দ্বিতীয়বার সরকার গড়বে, কোনো অঘটন ছাড়াই। আসন সংখ্যা গতবারের থেকে বাড়ার সম্ভাবনা।” এটা বলার জন্য জ্যোতিষবিদ্যা-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান জানার প্রয়োজন নেই।এমনকি এও বলা যায় – “আগামী লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির মসনদে বিজেপি সরকারের দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করার সম্ভাবনা, যদি কোনো অঘটন না-ঘটে।” বলা যায় – “আগামী বছর অতি বর্ষণের সম্ভাবনা। মুম্বাই, কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন হতে পারে। আগামী বছর বেশ কিছু নক্ষত্রপতনের যোগ আছে” ইত্যাদি। ফললে নিশ্চয় আমার পসার বাড়বে, না ফললে কে মনে রাখবে ! মানুষের ক্ষেত্রেও প্রায় ৮০% মিলিয়ে দেওয়া সম্ভব বিনা জ্যোতিষবিদ্যায়। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা আছে। যে ভবিষ্যদ্বাণীটি আমি উল্লেখ করলাম, সেটিতে তথাকথিত কোনো অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ক্যালকুলেশন নেই, আছে পলিটিক্যাল ক্যালকুলেশন।এইভাবে অনেক কিছুরই ক্যালকুলেশন করে বলা সম্ভব হতে পারে। তার জন্য জ্যোতিষ, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতিষ-গণনার প্রয়োজন পড়বে না। তবে মিলতে পারে, নাও মিলতে পারে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন—“যেটা মেলে সেটাই বিশ্বাস করি। আর যেটা মেলে না সেগুলি ভুলে যাই।” এ প্রসঙ্গে আরও একটু বলতে পারি। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথের জন্য তাঁর বাড়িতে একটা কোষ্ঠী করা হয়েছিল। সেই কোষ্ঠীতে বলা হয়েছিল – মঙ্গলের যা অবস্থান, তাতে সত্যেন্দ্রনাথের পড়াশোনা হবে না।কোষ্ঠীকে উড়িয়ে দিয়ে হিন্দু স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন। এই মহাবিশ্বের মৌলকণা তাঁর নামেই ‘বোসন’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পরের ঘটনা তো ইতিহাস, সবাই জানেন।সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় বলেছেন – “জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনার উপর কিছুমাত্র বিশ্বাস করিবে না। আমি উহার অনেক পরীক্ষা করিয়া এক্ষণে ইহাতে বিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়াছি।” একদা জ্যোতিষী বিশ্বাসী বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সংগ্রহের সমস্ত জ্যোতিষ বিষয়ক বইপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেন।
জ্যোতিষীবাবুদের ভবিষ্যত বাণী যে বহুবার মিথ্যা হয়েছে তার ঝুড়ি ঝুড়ি প্রমাণ আছে। মানুষ সেসব ভুলে যাবে কেন ?! জ্যোতিষীবাবুরা অনেক সময় অনেক প্রমাণ-ট্রমাণ দিয়ে আমাদের বিশ্বাস  করতে বাধ্য করে যে আসলেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যে যত যুক্তি দিক, আর না-দিক – সত্যি কিন্তু পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা জ্যোতিষীবাবুরা বাণী না-ছাড়লেও হবে। এখন এমন দশটি ভবিষ্যৎ বাণীর কথা বলব যেগুলি বিশ্বজুড়ে আতঙ্কিত এবং আলোড়িত হয়েছে, অথচ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে।
(১) অপ্রামাণ্য রচনা (The Apocrypha), এই ভবিষ্যৎ বাণীটি করা হয়েছিল ১০০০ সালে। ইঞ্জিল শরিফের কয়েকটা লাইনের উৎস ধরে সবার মধ্যে আতঙ্ক ভাইরাল হয়ে যায় যে, ঈসার মৃত্যুর পর এক প্রজন্ম পরে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কী ছিল ইঞ্জিল শরিফের সেই লাইনটি ? – “Christ would be back in generation and that the genetation shall not pass.” অর্থাৎ, “জিশু আবার ফিরে আসবেন আগামী প্রজন্মে। এবং সেই প্রজন্ম পরিত্রাণ পাবে না”। তৎকালীন সময়ে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী চার্চ থেকে অর্থের বিনিময়ে মানুষেরা নিজেদের জন্য স্বর্গে জমি কিনে রাখতে পারতেন এবং মানুষজন সংশ্লিষ্ট চার্চে অর্থ প্রদান পাপ থেকে মুক্তি পেলেন বলে বিশ্বাস করতেন। যেহেতু সেসময় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে, সেইহেতু অনেকেই নিজেদের সর্বস্ব সম্পদ বিক্রিবাটা করে চার্চে অনুদান দিয়ে পাপমুক্তির হিড়িক পড়ে গেল। সেই সুযোগে এক লপ্তে চার্চগুলিতে কোটি কোটি টাকা রোজগার হয়েছিল, বলাই বাহুল্য। যেহেতু সেসময়ে ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার সহজলভ্য ছিল না, তাই সাধারণ মানুষ ধ্বংসের দিন হিসাবের জন্য মহান চার্চের উপরই নির্ভর করত। তখনকার দিনে পোপ/পাদরিদের বাণী বা ঘোষণাই ছিল শেষ কথা। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পৃথিবী ধ্বংসের ভবিষ্যৎ বাণী শুনিয়ে প্রচুর অর্থ কামিয়ে নয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এখন ২০১৬ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না !
(২) “The Watchtower Society” এক ধরনের অদ্ভুত সোসাইটি।এরা অনেকবার পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ নির্ধারণ করছে। বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, তবুও নিয়ম করে ভবিষ্যৎ বাণী আওড়াতে কখনো কার্পণ্য করেনি। আর এমন প্ররোচনাকারী সোসাইটিকে মানুষ বিশ্বাস করে এবং মানুষের এই অটুট বিশ্বাসের জন্য সোসাইটিটি আজও টিকে আছে।১৮৭৪ সাল, ১৯৪১ সালে পৃথিবী ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন, নির্দিষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করেই। আর বারবার সেই ভবিষ্যৎ বাণী ভণ্ডুল হয়েছে।অবশ্য এখন আর দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে ঘোষণা দেন না, একটু সুর পালটে শুধু “পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে” – এটুকু বলে ছেড়ে দেন।এখন ২০১৬ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না !

(৩) “Heavens Gate” বা স্বর্গের দরজা বলে পরিচিত এটি এমন একটি সংস্থা, যাঁরা মনে করত পৃথিবীটা সম্পূর্ণ ভিন গ্রহের বাসিন্দা বা এলিয়েন দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এমন কি সরকারের বেশির ভাগ মনুষই নাকি এলিয়েন ! তারা মনে করেছিলেন, ১৯৯৭ সালে এক উল্কাকে অনুসরণ করে এলিয়েনরা পৃথিবীতে আসবে এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষদের ক্রীতদাসে পরিণত করবে। এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে একমাত্র উপায় হল আত্মহত্যা করা। এইসব ধারণা বিশ্বাস করে শতাধিক মানুষ আত্মহত্যা করেছিল সে সময়ে।না, ১৯৯৭ সালে পৃথিবীতে একজন এলিয়েন  এসেও একজন মানুষকেও দাস করতে পারেনি।এখন ২০১৬ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!
(৪) নস্ট্রাদামুস ছিলেন একজন বিখ্যাত গণক, যিনি তাঁর জীবনে অনেক ভবিষ্যৎ বাণী লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি অনেক বড়ো বড়ো ঘটনার ভবিষ্যৎ বাণী আগেই করে দিতেন অনেকে বিশ্বাস করেন। এনার লিপিবদ্ধ হেঁয়ালি পাঠ করে জ্ঞানীরা (?) মর্মোদ্ধার করেছিলেন, ১৯৯৯ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন ২০১৬ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না! নস্ট্রাদামুসের তথাকথিত ভবিষ্যৎ বাণী মুখ থুবড়ে পড়ে।
(৫) ওয়াই টু কে (Y2K) মনে পড়ছে ? সালটা তখন ২০০০। ২০০০ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এই আশঙ্কা এবং আতঙ্ক নিয়েই জন্ম হল Y2K ধারণা।কোন্ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এই ভবিষ্যৎ বাণীর ঘোষক ছিলেন মনে পড়ছে না। যেটা মনে পড়ছে সেটা হল তৎকালীন সময়ে কম্পিউটারে ৯৯ সালের পরে পরের সাল, অর্থাৎ ২০০০ সাল উল্লেখ করা ছিল ০০ দিয়ে। অনেকে ধরে নেন ২০০০ সালে পৃথিবীর সব কম্পিউটার আপনা-আপনি অচল হয়ে যাবে। সযত্নে গচ্ছিত রাখা নিউক্লিয়ার বোমাগুলি এই বিগরে যাওয়া কম্পিউটারের জ্য নিক্ষেপিত হতে থাকবে।এই আতঙ্ক এতটাই ছিল যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই, খোদ আমেরিকা সরকার খাদ্য মজুতকরণ, অস্ত্র মজুত, বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, নিউক্লিয়ার বোমা দুর্ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার সরঞ্জাম মজুত, পর্যাপ্ত অর্থ জমিয়ে ফেলা যাতে পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা যায় ইত্যাদি। এত শ্রম সবই পণ্ড হল।২০০০ সাল অতিক্রান্ত হয়ে এখন ২০১৬ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!
(৬) ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে ধ্বংস হবে পৃথিবী। এমনটাই দাবি ছিল কন্সপিরাসি তাত্ত্বিকদের। তারা দাবি করছেন, তিন মাসের মধ্যেই ধ্বংস হতে চলেছে মানব সভ্যতা। ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ হয়ত আমাদের শেষ দিন। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের নতুন তথ্য। তাঁদের দাবি, ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মহাকাশে পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে একটি বড়ো গ্রহাণুর। আর এই আঘাতেই শুরু হবে প্রলয়। ধ্বংস হবে পৃথিবীর সাজানো বাগান। পৃথিবী ধ্বংসের এই খবর নাকি আছে পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের কাছেও ছিল। এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেইসব দেশের বেশকিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি ঘর গুছিয়ে নিচ্ছিলেন । এ বিষয়ে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রী লরেন্ত ফ্যাবিয়াস জানান, একটি বড়ো গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত হানতে পারে। এর ধ্বংসযজ্ঞ হবে কল্পনাতীত। তবে এটি পৃথিবীতে আঘাত হানার আগেই এটিকে ভেঙে ছোটো ছোটো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা করা হবে, যেন ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায়। তিনি আরও জানান, এই গ্রহাণুটি আটলান্টিক মহাসাগরে আঘাত হানতে পারে।  তবে এই তথ্য সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দিয়েছিলেন নাসা। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন – “তাদের কাছে পৃথিবীর সঙ্গে কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতুর সংঘর্ষ হওয়ার কোন খবর নেই। এমনকী আগামী একশো বছরেও এইরকম কিছু ঘটবে না।"এখন ২০১৬ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!
(৭) এই তো সেদিনের কথা, ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর – এ পর্যন্ত পৃথিবীর ধ্বংসের শেষতম দিন ঘোষণা হল। দামামা বেজে উঠল সমগ্র পৃথিবী জুড়ে।ফেসবুকের কল্যানে এমন একজনও মানুষ ছিল না যে জানেন না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এ সংবাদ ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেল। সেকি তুলকালাম কাণ্ড !!! এ নিয়ে আবার অনেকে কোরান শরিফের সঙ্গে সংখ্যার গুণ/ভাগ করে কত কিছুই-না বানিয়েও ফেলেছিল। এ নিয়ে “২০১২ এবং ইসলাম তথা ইসলাম তথা ১৪৩৩ আরো কিছু অজানা তথ্য” শিরোনামের লেখায় বিস্তর আলোচনাও হল। সব দোষ কিন্তু ওই মায়ানদের । তাদের ক্যালেন্ডার ২০১২ পর্যন্তই ছিল, অর্থাৎ ২০১২ সালের পরে আর কোনো সাল নেই। ২০১২ সালে পৃথিবী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেই বলেই পরের সালগুলি নেই।অবশ্য মায়ানদের এই ভবিষ্যৎ বাণী নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিলই। অতএব এদের ভবিষ্যৎ বাণীও মিথ্যা প্রমাণিত হল।
(৮) ২০১৫ সাল। ‘কেয়ামতের ঘড়িতে (ডুমসডে ক্লক)’ পৃথিবী ধ্বংস হতে আর মাত্র তিন মিনিট বাকি রয়েছে – এমনই খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। ওই ঘড়ির কাঁটা তিন মিনিট পার হয়ে মধ্যরাতে, অর্থাৎ ১২টায় পৌঁছালে মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হবে এ পৃথিবী! একই অবস্থানে রয়েছে কেয়ামতের ঘড়ির কাঁটাটি। সময়টা খুব কম, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না-নিলে, ঘড়ির কাঁটা পেছনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে  জানিয়েছিল বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের দুই বছর পর ১৯৪৭ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সাইন্টিস্ট’ ‘কেয়ামতের ঘড়িটি’ তৈরি করে। বুলেটিনের পরিচালক পর্ষদ এর দেখভাল করে। এ ঘড়িতে মধ্যরাত হতে যত সময় বাকি, সেটা দিয়ে পরমাণু অস্ত্র, পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত হুমকির তীব্রতা বিবেচনা করা হয়। মধ্যরাত হওয়ার অর্থ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে ঐশ্বরিক কোনো প্রভাব এখানে বিবেচনা করা হয় না।ঘড়িটির নিয়ন্ত্রণকারীরা  জানিয়েছিলেন, ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের দিকে এগিয়ে আসছে, যা মানবজাতির ধ্বংসকে নির্দেশ করে। এটা সত্যিই মানুষের কবর রচনার মতো সংবাদ। ‘বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সাইন্টিস্ট’-এর গবেষক লরন্সে ক্রায়াস বলেছিলেন, “আমরা যদি আমাদের পন্থা পরিবর্তন না করি, তাহলে আমরা মনে করি, মানবজাতি মারাত্মক বিপদের মধ্যে রয়েছে।” ওয়াশিংটন থেকে তিনি ঘোষণা দেন, ‘কার্যকরী পদক্ষেপ এসব হুমকি কমাতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সেগুলোকে (হুমকিগুলোকে) স্বীকৃতি দিই, তাহলে সত্যিই আমাদের সেগুলোর মুখোমুখি হতে হবে অচিরেই।’ ‘বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সাইন্টিস্ট’-এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ঘড়িটি স্থাপনের সময় মহাপ্রলয়ের সাত মিনিট বাকি ছিল। কিন্তু পরে পরমাণু ও মানুষের তৈরি হুমকি মোকাবিলায় বিশ্ব জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ায় এর অবস্থান পিছনে চলে আসে বেশ কয়েকবার। কিন্তু বিশ্বে পরমাণুশক্তির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘কেয়ামতের ঘড়ি’র কাঁটা ফের সামনের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে।ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতে পৌঁছাতে বাকি ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট। কিন্তু ওই বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ পরমাণু অস্ত্র ধ্বংসের ব্যাপারে অঙ্গীকার ব্যক্ত করায় ঘড়ির কাঁটা এক মিনিট পিছিয়ে চলে আসে।তবে পারমাণবিক অস্ত্রাগার ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে না-পারায় ২০১২ সালে ফের আগের অবস্থায় ফিরে আসে এটি। ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকীকরণের ফলে ঘড়ির কাঁটা চলে আসে ১১টা ৫৭ মিনিটে।এখনও পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।
(৯) ২১ মে ২০১১ সাল। পৃথিবীর আজই শেষ দিন। কারণ আজই পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তাদের মতে ২০১১ সালের ২১ মে সন্ধ্যা ৬টায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। নিউইয়র্কজুড়ে ধর্মযাজক ও ধর্ম প্রচারকরা টি-শার্ট পরে ও ব্যানার-ফেস্টুন, বাইবেল, পোস্টার নিয়ে সমাবেশ করে সবাইকে সতর্ক করছেন। সমাবেশে অংশ নেওয়া ধর্ম প্রচারক ম্যানি বলেন, বাইবেলের ‘বুক অব রেভুলেশন’ অনুসারে ২১ মে সারা বিশ্ব প্রলয়ংকরী এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বিশ্বের সব স্থানে একই সময়ে ভূমিকম্পটি আঘাত হানবে কি না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। কারণ, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সময়ের তারতম্য রয়েছে। তবে তা একই সময়ে সংঘটিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওদিকে বাইবেলের নানা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিষয় বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করার পর হ্যারল্ড ক্যাম্পিং (৮৯) পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে এ ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছেন। তিনি এর আগেও ১৯৯৪ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তবে সেবার তার গণনা ভুল হয়েছিল বলে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি। হ্যারল্ডের অনুসারীরা আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে পৃথিবী ধ্বংসের প্রচারণা চালাচ্ছেন। আর এ ঘটনায় বিশ্বাসীদের দলে যোগ দিয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এদিকে পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ক্যাম্পিং শেষ দিনটি তার উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার খবর দেখতে আমি টেলিভিশনে চোখ রাখব সেদিন। হ্যারল্ড ক্যাম্পিং ভবিষ্যদ্বাণীর পিছনে কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। যার মধ্যে আছে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও। খ্রিস্ট ধর্মানুসারীদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে একটি খণ্ড জেনেসিসে উল্লেখ রয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯০ অব্দে নূহের সময়কালে পৃথিবীতে একটি মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়েছিল। ঈশ্বর সে সময় নূহকে বলেছিলেন, ৭ দিনে তিনি পৃথিবী ধ্বংস করবেন। এদিকে বাইবেলের অপর একটি খণ্ড ২ পিটার ৩:৮ এ বলা হয়েছে, পৃথিবীর এক হাজার বছর ঈশ্বরের এক দিনের সমান। ক্যাম্পিং এ যুক্তি দেখিয়ে বলেন, মহাপ্লাবনের সময় থেকে এ পর্যন্ত ৭ হাজার বছর পার হয়ে গেছে। আর ঈশ্বর ৭ দিনে পৃথিবী ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে হিসাবে ১ হাজার বছর ঈশ্বরের ১ দিনের সমান হলে ৭ হাজার বছর নিশ্চয়ই ৭ দিনের সমান হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯০ অব্দের সঙ্গে ২০১১ খ্রিস্টাব্দ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭ হাজার বছর। আরও এক জটিল গণনার হিসাবে হ্যারল্ড ক্যাম্পিং আজই অর্থাৎ ২১ মে ২০১১ সালকেই পৃথিবী ধ্বংসের দিন বলে চিহ্নিত করেন। তবে বহু খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও অনুসারীকে তার এ গণনাকে অমূলক বলে দাবি করেছিলেন।এখন ২০১৬ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!
(১০) সুদূরের জন্য একটি ভবিষ্যৎ বাণী উচ্চারিত হয়ে আছে। এতদিন আমি অবশ্যই বেঁচে থাকব না, যাঁরা ভবিষ্যৎ বাণী শোনাচ্ছেন তাঁরাও বেঁচে থাকবেন না। ৩৭৯৭ সাল। ধ্বংস হবে পৃথিবী! অন্য গ্রহে বাসা বাঁধবে মানুষ। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি অবশ্য জনৈক ‘বাবা ভাঙা’-র। তাঁকে নাকি বলা হয় ‘এ যুগের নস্ট্রাদামুস’। ২০ বছর আগে তিনি মারা গিয়েছেন। কিন্তু আইএস-এর উত্থান বা টুইন টাওয়ারের হামলার কথা নাকি তিনি বলে গিয়েছিলেন। বাবা ভাঙা যা বলে গিয়েছেন, তার মধ্যে থেকেই তুলে ধরা হল কয়েকটি। মিলিয়ে নিন। (১) বারাক হুসেন ওবামাই হবেন আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট।(২) ২০১৬ সালেই ইউরোপ শেষ হয়ে যাবে। রাসায়নিক অস্ত্রে ইউরোপকে শেষ করে দেবে সন্ত্রাসীরা।(৩) ইউরোপ ছেয়ে ফেলবে মুসলিম জঙ্গিরা। আর এই সন্ত্রাসের সূত্রপাত হবে সিরিয়ায়।(৪) ২০১৮ সালের মধ্যে সুপারপাওয়ার হিসাবে উত্থান হবে চিনের। পর্যুদস্ত হবে আমেরিকা।(৫) ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা দূর হবে।(৬) শুক্র গ্রহে বাসা বাঁধবে মানুষ।(৭) ২০৪৫ সালের মধ্যে মেরু অঞ্চলের আইসক্যাপ গলে যাবে।(৮) ২০৭৬ সালে কমিউনিজম ফিরবে পুরোদস্তুর।(৯) ২১৩০ সালের মধ্যে জলের তলায় বসবাস শুরু করবে মানুষ।(১০) ৩৭৯৭ সালে ধ্বংস হবে পৃথিবী। ততদিনে অবশ্য অন্য গ্রহে থাকতে শুরু করবে মানুষ।সত্য/মিথ্যার সাক্ষী থাকুন আপনি। সময় তো আছেই।
হাত দেখা বা হস্তরেখা বিচার সম্ভবত জ্যোতিষীবাবুদের মধ্যে সবচেয়ে জয়প্রিয়তম ব্যবস্থা। জাতকরাও কেউ হাত দেখতে জানে জানতে পারলে তার দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেন না। অবশ্য এই ‘হস্তরেখা বিচার’ পদ্ধতির পুষ্টিলাভ খুব বেশিদিনের কথা নয়। পঞ্চদশ শতকে হস্তরেখা বিদ্যার উপর কিছু পরিমাণ বিক্ষিপ্তভাবে লেখালেখি হলেও মূলগতভাবে এই বিদ্যার রমরমা শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীতে।মহাভারতের যুগেও অনুমান করেই ভবিষ্যৎ বাণী করা হত। শকুন্তলাকে দুর্বাসাও ভবিষ্যৎ বাণী দিয়েছিল, যা অভিশাপ বলেই বিদিত। দুর্বাসা জানতেন রাজা দুষ্যন্ত জন্ম-পরিচয়হীন শকুন্তলাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে না। করার কথাও নয়।কারণ একজন বনবাসীকে কিছুতেই রাজপরিবারে জায়গা দিতে পারে না। সামাজিক অবস্থান তো ভিন্ন মেরুতে।
যাই হোক, হাত দেখার মহিমাই অপরিসীম।বন্ধুমহলে বেশ কদর পাওয়া যায়।অফিসের বসকেও খুব সহজে কবজা করা যায় হাত দেখে পজিটিভ বাণী শুনিয়ে। বিনা মূলধনে বিনা পরিশ্রমে টু-পাইস কামানোর সুযোগ হাতছাড়া করা যায় ! কী আছে হাতে ? কী দেখা হয় হাতে ? হাতে কী অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ লেখা থাকে ? জ্যোতিষীবাবুরা তো সেটাই বলে, হাতে লেখা থাকে ! শুধু হাতেই নয় -- কপাল, হাতের কবজি, শরীরের তিল, পায়ের রেখা সবেতেই নাকি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ লেখা থাকে।গতকাল এবং আগামীকাল, ভূত এবং ভবিষ্যৎ -- যত গণ্ডগোল তো এখান থেকেই, আদিকাল থেকেই। ‘ভূত’ শব্দটি বস্তুত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হলেও ব্যঞ্জনা প্রায় কাছাকাছিই। একটি অর্থ ‘অতীত’, অন্যটি হল ‘প্রেত-প্রতিনী’, ‘প্রেত-প্রতিনী’ তো যিনি অতীত বা মৃত হয়েছেন তার অশরীরী। আমরা ভূত জেনে অবাক হই, বর্তমান জেনে খুশি হই এবং ভবিষ্যৎ জেনে আতঙ্কিত হতে ভালোবাসি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না হলেও অতীত আমাদের মনে থাকে অনেকটাই, আমরা তাই জন্য স্মৃতিচারণ করতে পারি।আমার অতীত জানতে আমি জ্যোতিষবাবুর কাছে যাব কেন ! জ্যোতিষীবাবুরা মানুষের সেই অতীতই বলে থাকেন, সেগুলি সকলের জন্য খুবই কমন (Common)।আপনার মনে হয় উনি আপনার ‘অতীত’ বলতে পারলেন। আপনি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকলেন, এই বুঝি অতীতে করা আপনার অপকর্মগুলিও বলে ফেলল ! তবুও বারাবার জ্যোতিষীর কাছে যাই, গিয়ে একবার ঝালিয়ে নিই। আপনার মতে না মিললে সেই জ্যোতিষী খারাপ, অন্য ‘বিখ্যাত’ জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হবেন নিশ্চয়।আর মতে মিললে তো ভগবান – আপনি সব উজার করে দিতে রাজি হয়ে যান। বস্তুত সব জ্যোতিষীর মধ্যে ওই ‘মেলানোর’ পারদর্শিতা বা অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা থাকে না।
কীভাবে? বলব। আমি তো আমার কথা বলব, যুক্তিবাদীদের কথা বলব, বিজ্ঞানের কথা বলব। তার আগে জ্যোতিষীবাবুদের বক্তব্য শুনব না কি করে হবে ?
জ্যোতিষীবাবুরা বলেন – “জ্যোতিষ একটি ঐশ্বরিক ব্যাপার। আসলে এটা কোন মত পোষণ করা বা বিশ্বাসের ব্যাপার নয়।
জ্যোতিষে এমন কিছু বিষয় আছে, যা চট করে দেখলে একেবারেই মন-গড়া, বা বানানো মনে হয়। অথচ সেগুলিই বাস্তবে খুব ভালো মতো কাজ করে বা ফল দেয়। যেমন, রাশিচক্রের বিন্যাসের
(Arrangement) ব্যাপারটি বলা যেতে পারে। জ্যোতিষে ৯টি গ্রহ বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে আসল গ্রহ ৫টি - বুধ, শুক্র, মঙ্গল, শনি, এবং বৃহস্পতি। সূর্য ও চাঁদকেও ‘গ্রহ' নামে ডাকা হয়। এছাড়া রাহু ও কেতু নামে দুটো অবস্থানগত বিন্দুকেও (Positional Points) গ্রহ ধরে মোট ৯টি ‘গ্রহ' পাওয়া যায়। এদেরকে ‘নবগ্রহ' বলা হয়। এই নবগ্রহের মধ্যে সূর্য ও চাঁদের অবশ্যই একটা আলাদা অবস্থান বা গুরুত্ব আছে। কেন-না সূর্য আসলে গ্রহ নয়, বরং নক্ষত্র। সব গ্রহগুলির চেয়ে বহুগুণ বড়ো হওয়াতে এর একটা আলাদা প্রভাব আছে। সৌরজগতের সব গ্রহগুলি সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। তাছাড়া পৃথিবীতে দিন-রাত, ঋতু পরিবর্তন ইত্যাদিতে সূর্যের এমন প্রভাব আছে, যা অন্য কারও নেই। আবার চাঁদ গ্রহদের থেকে ছোটো হলেও, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে হওয়ার জন্য এর আলাদা এক রকম প্রভাব আছে, যা জোয়ারভাটা, মানুষের শরীরের বাত, আরও বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে। সুতরাং সূর্য ও চাঁদের এমন একটা অবস্থান বা প্রভাব আছে, যা বুধ, শুক্র, শনি ইত্যাদির নেই।রাশিচক্রে ১২টি রাশির প্রত্যেকটি রাশি কোন না-কোন গ্রহের মালিকানাধীন। আপনার যে রাশিই হোক না-কেন, তার একটি মালিক বা অধিপতি (Owner) আছে বলে রাশিচক্রের বইয়ে বা পত্রিকাতে পাবেন। রাহু-কেতু অবস্থানগত বিন্দু, তাদের আসলে কোনো দৃশ্যমান কাঠামো (Physical Structure) নেই। তাই তারা সেভাবে কোনো রাশির মালিক নয়। বাকি ৭টা গ্রহ এই ১২টি রাশির মালিক। আবার, রাহু-কেতু বাদে এই ৭টা গ্রহ, সপ্তাহের ৭টা দিনেরও মালিক। এবং সেই সেই দিনে সেই সেই গ্রহের প্রভাব, বাস্তব জীবনে খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। ১২টি রাশিকে কীভাবে ৭টি গ্রহের মধ্যে ভাগ করা যায় ? প্রত্যেক গ্রহ ২টি করে রাশি পেলে রাশি দরকার ১৪টি, আবার ১টি করে হলে ৭টি গ্রহের ৭টি রাশি পাওয়ার পর আরও ৫টি থেকে যায়। তাহলে ? জ্যোতিষে বিষয়টির সুরাহা করা হল এভাবে - সূর্য ও চাঁদ যেহেতু ৭টি গ্রহের মধ্যে একটু আলাদা (Special) , এদেরকে ১২টি রাশি থেকে ১টি করে রাশি দেওয়া হোক (মোট ২টি) আর বাকি থাকল ১০টা, এই ১০টা রাশি বাকি ৫টি গ্রহের মধ্যে ২টি করে ভাগ করে দেওয়া হোক। তাহলে সূর্য চাঁদ = + = , আর বাকি ৫টি গ্রহ ২টি করে = x = ১০, মোট ২ + ১০ = ১২, মিলে গেল। বিষয়টি খুব সাধারণ, মনে হয় কোন একটা ঘরোয়া আলোচনায় ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে। কিন্তু এটাই বাস্তব জীবনে খেটে যায়। কেন-না এটাই জ্যোতিষের ভিত্তি, আর সব হিসাব-নিকাশ এর উপর ভিত্তি করেই করা হয়। তাই এটা ঠিক না-হলে, কোনো কিছুই মিলত না।এখন, রাশির বিন্যাস (Positioning/Arrangement) কীভাবে করা হবে? এটাও এমন একটা ব্যাপার, দেখলে মনে হবে কারও বানানো বা কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু এটাই বাস্তবে খেটে যায়। কিভাবে দৃশ্যমান ভৌত শরীর (physical body) না-থাকায় রাহু-কেতুকে রাশির মালিকানা না-দেওয়া, এরপর বাকি ৭টি গ্রহের মধ্যে সূর্য ও চাঁদকে আলাদা বিবেচনা করে ১টি করে রাশি দিয়ে এরপর দু-পাশে একই গ্রহের ১টি করে রাশি বসিয়ে বসিয়ে সম্পূর্ণ রাশিচক্রটি (Zodiac) সাজানো বা বিন্যাস করা (Arrange) একেবারেই মানুষ বা অন্য কারও বানানো মনে হয়, যা খুব সাধারণ বিবেচনা নিয়ে (Casually) করা হয়েছে। এতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, ইত্যাদির মতো কোনো জটিলতা নেই। তাই দেখে যদিও মন-গড়া মনে হয়, এই জিনিসটাই বাস্তবে মিলে যায়, বা খেটে যায়। এটা অবশ্যই একটা ঐশ্বরিকত্ব।” আধুনিক তত্ত্বের সঙ্গে জ্যোতিষের তত্ত্বকে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। ইনি বাংলাদেশে বসবাসকারী বহু প্রচারিত এক জ্যোতিষীবাবু। এনার একটি ওয়েব সাইটও আছে বটে, জ্যোতিষের সমর্থনে প্রবন্ধ-ট্রবন্ধও লেখেন লেখকের নাম-পরিচয় ছাড়াই।
ভারত তথা হিন্দুধর্মের মানুষদের মধ্যেই জ্যোতিষচর্চা খুব বেশি প্রচলন। বস্তুত ব্রাহ্মণ তথা মুনিঋষিরাই ভবিষ্যৎ বলার কাজটা করতেন।ভারতে জ্যোতিষচর্চা মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদের হাত ধরেই এসেছে। একটু নজর রাখলেই জানতে পারবেন জোতিষীদের একটা বড়ো অংশই ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের। একমাত্র ভারতেই ঘরে ঘরে জ্যোতিষী পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে তো জ্যোতিষ-ব্যাবসা কুটিরশিল্প পর্যায়ে চলে গেছে। যিনি হাত-পা দেখেন তিনিও জ্যোতিষী, যিনি হাত-পা দেখান তিনিও জ্যোতিষী। খ্রিস্টানদের মধ্যেও এ বিদ্যা চর্চা অল্পবিস্তর আছে। তবে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে জ্যোতিষচর্চা নিষিদ্ধ।নক্ষত্র ও গ্রহ সংক্রান্ত গণনা অর্থাৎ জ্যোতিষচর্চাকে পূর্ববর্তী মুসলিম পণ্ডিতেরা সামগ্রিকভাবে ‘তানজিম’ বলে অভিহিত করেন। সমগ্র বিশ্ব যেহেতু জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রভাবে প্রভাবিত, তাই ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সব ঘটনাসমূহ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করা সম্ভব।এটা বিশ্বাস করা সর্বসম্মতিক্রমে বড়ো ধরনের কুফরি এবং ইব্রাহিম এর জাতির শিরকের মতো শিরক। “যে ব্যক্তি কোনো গণক তথা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে গেল, অতঃপর তাকে (ভাগ্য সম্পর্কে) কিছু জিজ্ঞেস করল অমনি ৪০ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল হবে না।” (সহিহ মুসলিম ২২৩, মুসনাদ আহমাদ ৪/৬৭)। গণক বা জ্যেতিষীদের কথা বিশ্বাস করা আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করার নামান্তর।জাদুবিদ্যা শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া কুফরি গোনাহ বা পাপ। যে সাতটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে তার মধ্যে একটি হচ্ছে জাদু। আল্লাহ বলেন, “যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত কোনো জ্ঞান নেই, তার পিছনে ধাবিত হোয়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।" (বনি ইসরাঈল ৩৬) । আল্লাহ আরও বলেন – “জাদুকর যেখানেই থাকুক সফল হবে না।" ( ত্বহা৬৯) । পক্ষান্তরে কেউ সত্যায়ন না করে, তাদের নিকট অভিজ্ঞতা লাভের জন্য বা পরখ করার জন্য গেলে এটা কুফরের পর্যায়ভূক্ত নয়, কিন্তু ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ ও ইবাদ কবুল হবে না। এ সম্পর্কে রাসুলাল্লাহ বলেছেন – “যারা গণক কিংবা এই জাতীয় লোকের নিকট গিয়ে কোনো কিছু জানতে চাইবে, ৪০ দিন পর্যন্ত তাদের নামাজ কবুল হবে না।" ( মুসলিম শরিফ)জ্যোতিষীর কাছে যাওয়া, হাত দেখানো তাঁর কথা বিশ্বাস করা একেবারে নাজায়েজ।
ইসলাম মতে, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ার কথা বিশ্বাস করা যেমন কুফরি, তেমনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রাশিফলের আশ্রয় নেওয়াও কুফরি। যে ব্যক্তি রাশিফলের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের কথা বিশ্বাস করবে, সে সরাসরি মুশরিক হয়ে যাবে। পত্র-পত্রিকা ও বইপত্রে  রাশিফলের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে সেগুলি পাঠ করা শিরক। তবে বিশ্বাস না-করে কেবল মানসিক সান্ত্বনা অর্জনের জন্য পড়লে তাতে শিরক হবে না বটে, কিন্তু সে গোনাহগার হবে।কেন-না শিরকি কোনো কিছু পাঠ করে সান্ত্বনা লাভ করা বৈধ নয়। তা ছাড়া শয়তান কর্তৃক তার মনে উক্ত বিশ্বাস জন্মিয়ে দিতে কতক্ষণ? তখন এ পড়াই তার শিরকের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে।রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন – “গণকের নিকটে কোনো ব্যক্তি গমন করে যদি তাকে কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে ৪০ দিন ও ৪০ রাত পর্যন্ত তাঁর সলাত কবুল হবে না।” (সহিহ মুসলিম)।“যদি কেউ গণকের বা জ্যোতিষীর নিকট গমন করে তাঁর কথায় বিশ্বাস করল, তাহলে সে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ বিষয়কে অবিশ্বাস করল।” (সুনান আবু দাউদ)। হাদিসগুলিতে দৈব জ্ঞানের দাবিদার, গণক, জাদুকর ও তদনুরূপ লোকদের কাছে আসতে এবং তাদেরকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে ও তাদের বক্তব্য সত্য বলে বিশ্বাস করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন ও করা হয়েছে। সুতরাং শাসকবর্গ ও মানুষকে সৎ কাজের আদেশদানের এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ— যাদের হাতে ক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই উচিত গণক, দৈব জ্ঞানের দাবিদার ও অনুরূপ পেশাজীবীদের কাছে আসতে লোকদের নিষেধ করা, হাটে-বাজারে ও অন্যত্র যেকোনো ধরনের দৈবজ্ঞান আদানপ্রদান নিষিদ্ধ করা, দৈবজ্ঞ ও তাদের কাছে যারা আসে সবার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।তাদের কথা কোনো কোনো ব্যাপারে সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ার ফলে এবং এক শ্রেণির লোক তাদের কাছে বেশি আনাগোনা করার ফলে তাদের দ্বারা কারও প্রতারিত হওয়া ঠিক নয়। কারণ ওই শ্রেণির লোকেরা মূলত মূর্খ। তাই তাদের দ্বারা প্রতারিত হওয়া অনুচিত। কেন-না এতে গুরুতর পাপ, মহাবিপদ ও খারাপ পরিণতি থাকায় এবং যারা এসব কাজে লিপ্ত তারা মিথ্যাবাদী ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক হওয়ায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে আসতে, প্রশ্ন করতে এবং তাদেরকে সত্যবাদী হিসাবে প্রতিপন্ন করতে নিষেধ করেছেন।
অনুরূপভাবে আলোচ্য হাদিসগুলিতে এও প্রমাণিত হয় যে, গণক ও জাদুকররা কাফির। কেন-না তারা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার দাবি করছে, যা কি না কুফুরি। তদুপরি তারা আল্লাহ্
কে ছেড়ে জিনের সেবা ও ইবাদাতের মাধ্যমেই তাদের উদ্দেশ্য সাধন করছে। অথচ এ কাজও কুফুরি এবং আল্লাহর সঙ্গে শরিক করারই নামান্তর। যে ব্যক্তি তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবিকে সত্য প্রতিপন্ন করে সে ও তাদেরই অনুরূপ। আর যেসব ব্যক্তি এ বিষয়গুলি এমন লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করে, যারা তা পরস্পর আদানপ্রদান করে থাকে, সে সব ব্যক্তির সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব লোক যাকে চিকিৎসা বলে ধারণা করে থাকে, তাকে মেনে নেওয়া ও গ্রহণ করা কোনো মুসলিমের জন্য জায়েজ নেই। যেমন বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ কিংবা জলে ইস্পাত চুবানো ইত্যাদি আরও অনেক কুসংস্কার যা তারা করে থাকে, তার কোনোটাই জায়েজ নয়। কেন-না তা দৈবকর্ম চর্চা ও মানুষকে বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। এসব ব্যাপারগুলোকে যারা মেনে নেয়, তারা মূলত এ লোকদেরকে তাদের বাতিল ও কুফুরি কাজে সহযোগিতা করল। অনুরূপভাবে কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য জ্যোতিষী ও দৈবজ্ঞানের দাবিদারদের কাছে গিয়ে একথা জিজ্ঞেস করা জায়েজ নেই যে, তার ছেলে কিংবা তার কোন আত্মীয় কাকে বিয়ে করবে? কিংবা স্বামী-স্ত্রী ও তাদের উভয়ের পরিবারে ভালবাসা ও মিল-মহব্বত হবে নাকি শত্রুতা ও দূরত্বের সৃষ্টি হবে ইত্যাদি। কেন-না এসব সে গায়েবি ও অদৃশ্য জ্ঞানেরই অন্তর্গত যা শুধু মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।সকল মুসলিম মনীষীদের সর্বসম্মত মতানুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ বৈধ। আর যে কোনো মুসলিম ব্যক্তিরই অধিকার রয়েছে যে, সে অভ্যন্তরীণ রোগের ডাক্তার কিংবা শৈল চিকিৎসক অথবা মানসিক রোগের ডাক্তার কিংবা অনুরূপ যে কারও কাছে যেতে পারে, যাতে তিনি তার রোগব্যাধি চিহ্নিত করে চিকিৎসাশাস্ত্রে তার জ্ঞান অনুযায়ী শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত পথ্য দ্বারা তার চিকিৎসা করেন। কেন-না এটা সাধারণ বৈধ পন্থাগুলিরই অবলম্বনেরই অন্তর্গত। উপরন্তু এ ধরনের পন্থাবলম্বন আল্লাহর উপর নির্ভরতার পরিপন্থী নয়। কারণ আল্লাহ রোগ দিয়েছেন এবং সে রোগ নিরাময়ের ঔষধও বাতলে দিয়েছেন। যার জানার সে তা জেনেছে এবং যে জানেনি, এ পথ্য তার অজ্ঞাতই থেকে গেছে। অবশ্য আল্লাহ বান্দার উপর হারাম করেছেন এমন কোনো বস্তুকে তার রোগ নিরাময়ের উপায় নির্ধারণ করেননি। সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য সেই সব গণক, জ্যোতিষী ও দৈবজ্ঞদের কাছে যাওয়া বৈধ নয়, যারা দাবি করে যে, তাদের কাছে অসুস্থ ব্যক্তির রোগ চিহ্নিত করার গায়েবি জ্ঞান আছে। অনুরূপ অসুস্থ ব্যক্তির জন্যও এসব গণক ও দৈবজ্ঞদের দেওয়া তথ্য ও সংবাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা বৈধ নয়। কেন-না তারা গায়েবি বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করেই এসব বলে থাকে কিংবা তারা তাদের ঈপ্সিত বিষয়ে সাহায্য নেওয়ার জন্য জিনদের হাজির করে থাকে। তার মানে এই নয় যে মুসলিমরা জ্যোতিষচর্চা করেন না। জ্যোতিষীদের চেম্বারে মুসলিম জাতকরাও গ্রহশান্তির জন্য আসেন। রত্ন ধারণও করেন।মুসলিম দেশে হয় কি না আমার জানা নেই। তবে ভারতে এক-আধজন মুসলিম জ্যোতিষী পাওয়া যায়। পিরবাবাদের আমি ভবিষ্যৎ বাণী শোনাতে দেখেছি। ধর্ম ধর্মের জায়গায় আছে, ব্যাবসা ব্যাবসার জায়গায়।

জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চায় মুসলমানদের বেশ সুনাম অদ্যাবধি কাল থেকেই আছে। পেশাগত জীবনযাপনের তাগিদে এবং স্থল ও জলপথে বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের প্রয়োজন হত আকাশের গ্রহ-তারকাদের অবস্থান জানার। মুসলমানদের বিজ্ঞানে অগ্রসরতা এবং সপ্তম শতক হতে পনেরো শতক পর্যন্ত যেসকল মুসলমান বিদূষী জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখায় প্রভূত অবদান রেখেছেন তারা আর যে বিষয়ই নিয়েই পড়ে থাকুন না-কেন, তারা সবাই কিছু না-কিছু অবদান রেখেছেন এই জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞানে। তারা গবেষণা করে গেছেন আর লিখেছেন একের পর এক বই। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই: