রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সব চরিত্রই কাল্পনিক !!!

ধর্ম কর্কটরোগের চাইতেও মারাত্মক। হাইড্রোজেন বোমার চাইতে ভয়ংকর। আদিযুগ থেকে শোষকশ্রেণির শ্রেষ্ঠতম এবং উৎকৃষ্ট হাতিয়ার -- ধর্ম। শাসকের প্রয়োজনেই ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের সৃষ্টি করা হয়েছে নিরাকার ঈশ্বরের নামে। প্রাচীনযুগে ধর্মগ্রন্থগুলিই ছিল সংবিধান, অনুশাসন-যন্ত্র, আইন-কিতাব। মানবসমাজের প্রগতির দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের এক ভয়ংকর দিক হল ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। ফলে শোষিত মানুষগুলি আর একজোট হতে পারল না শোষণের বিরুদ্ধে।এই ভাগ-বিভাজনের ফায়দা লুটে ভোগ করেন দুর্বৃত্ত রাজনীতিকরা। এইসব শঠ রাজনীতিকরা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থেই ধর্মান্ধতার অবসান চায় না। যে-কোনো ধর্মের যে-কোনো জাতপাতের দরিদ্র শ্রমিক-কৃষকদের একটিই পরিচয় – সে দরিদ্র। দরিদ্র মানুষদের বিরুদ্ধে দরিদ্রদের লড়িয়ে দেওয়াই হল এখনকার শোষকশ্রেণির হাতিয়ার, গবেষণার বিষয়। এরা উলটে ধর্মনিরপেক্ষতার ভান করে। কে ধর্মনিরপেক্ষ? কোন্ রাজনৈতিক দল ধর্মনিরপেক্ষ ? ভারতবর্ষে একটিও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল নেই। এরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ জাহির করে অন্যকে সাম্প্রদায়িক সাব্যস্ত করে। মানুষ জেনেছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানে ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’। তাই কি ? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি দেশের মন্ত্রীসান্ত্রীদের মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেড়ানো ? মসজিদে গিয়ে মুসলমানি কায়দায় হিজাব বা রুমাল জড়িয়ে দোয়া করা ? গির্জায় ঢুকে শ্রদ্ধা জানানো ? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি পুজোয় ফিতে কাটা? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি রোজার শেষে ইফতার পার্টিতে উপস্থিত থেকে দোয়া করা ? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বড়োদিনে বেলাল্লপনা করা নয়।ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলার রাষ্ট্রে ধর্ম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হতে পারে, মাইক লাগিয়ে ক্যাওয়াজ করা নয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে তোমার ধর্মকথা শুনব কেন ? আমি বাধ্য নই, বাধ্য করতে পারো না কোনো অজুহাতেই। তাই রাষ্ট্রীয় জীবনে বা রাষ্ট্রীয় নীতিতে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস প্রকাশ্যে আচরণ করাটা স্বাস্থ্যকর নয় মোটেই। এ ব্যাপারে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অতি সতর্ক থাকা উচিত ছিল।ভারতবর্ষের সংবিধানে এটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, সেটা আর রক্ষা করা গেল কোথায় ! ভারতের মন্ত্রী-নেতারাই প্রকাশ্যে বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মাচার পালন করে থাকে। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কোনো পক্ষে নয়। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ মানে কোনো ধর্মের পক্ষে নয়। সোজা কথায় – সমস্ত ধর্মের সম্পর্ক বর্জন। ‘Secularism’ মানে ধর্মনিরপেক্ষতা কি না তাই নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, তবে অভিধানিক অর্থ হল -- এমন একটি যা মনে করে রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা প্রভৃতি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকা।কেউ কোনো ধর্মীয় মতবাদ প্রকাশ্যে প্রচার করবে না, অন্য ধর্মকে গালিগালাজ করবে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে আস্তিকদের যতটুকু স্পেস থাকবে, নাস্তিকদের জন্যও ততটুকুই স্পেস থাকবে।ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হিন্দুরা যেমন রাস্তা বন্ধ করে দুর্গাপুজো-কালীপুজো করতে পারে না, ঠিক মুসলমানরা রাস্তা বন্ধ করে ইদের নামাজ পড়তে পারে না, অনুরূপ বড়োদিনের উৎসবের নামে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রাতভর হুল্লোড় করা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হিন্দুরা মুসলিমদের ‘মোল্লা’ বা ‘কাটা’ বলে গালি দিতে পারে না, তেমনই মুসলমানরাও হিন্দুদের ‘মালাউন’ বা ‘মালু’ বলে গালি দিতে পারে না।অন্যথায় এদের সকলকেই, অর্থাৎ এই সংবিধান অবমাননাকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ সাব্যস্ত করা উচিত। ব্রিটিশমুক্তির ৭০ বছর পরও আমরা কেউই ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারলাম না – আমরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ শিখ। আর এখানেই আক্ষেপ। সোসাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া – সর্বত্র চলছে উসকানিমূলক কথাবার্তা, প্ররোচণামূলক বিবৃতি। এরা কি ‘দেশপ্রেমী’ ?
দেশ মাটিতে দিয়ে তৈরি হয় না, দেশ মানুষ দিয়ে তৈরি। ভাগ্যিস, নাহলে তো ‘দেশদ্রোহী’ বাছতেই তো গাঁ উজাড় হয়ে যেত ! রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, "দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবে দেশ প্রকাশিত। সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটান ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দেশ তো উপদানমাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি।” যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ বলেন – "আজ ‘দেশপ্রেম’ বলতে দেশের মাটিকে দেশের ভূখণ্ডের চৌহদ্দিকে চিহ্নিত করাটাই প্রচলিত সংস্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশপ্রেমের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করে যখন কোনো মানবগোষ্ঠী হুজুরের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তাদের শোষণের থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, তখন মগজ ধোলাইয়ের কল্যানে অমনি চারদিক থেকে নিপীড়িত মানুষগুলোই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সুরে সুর মিলিয়ে ‘গেল গেল’ রব তুলে ছুটে আসে, এবং যা নয় তাই বলে গাল পাড়তে থাকে। এরপর ওইসব আন্দোলনকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিতে পারলে কাজ অর্ধেক হাসিল। আমাদের সমাজে প্রকৃত দেশপ্রেমের কোনো ঐতিহ্য যাতে গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য তথাকথিত দেশপ্রেমীরা সদা-সতর্ক, সদা-তৎপর। এ দেশের ঐতিহ্যে দেশপ্রমিক বলতে চিত্রিত রাণাপ্রতাপ, শিবাজী থেকে শুরু করে ঝাঁসির রানি, বারো ভুঁইয়ার মতো ভিড় করে আসা বহু চরিত্র। এঁদের ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্বকেই বিকৃতভাবে আমাদের সামনে বারবার হাজির করা হয়েছে ও হচ্ছে দেশপ্রেমের নিদর্শন হিসাবে। ধনীকশ্রেণির অর্থপুষ্ট, ধনীক শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী রাজনীতিকদেরই ‘ভারতরত্ন’ বলে ভূষিত করার ঐতিহ্যই আমরা বহন করে চলেছি। হুজুরের প্রতি প্রেমময় এইসব ভারতরত্নরা যদি দেশপ্রেমিক হন, তাহলে দেশদ্রোহী কারা?” দেশপ্রেম মানে দেশবাসীর প্রতি প্রেম। হুজুরদের প্রেম দিলে মজুরদের অপ্রেম হয়, মজুরদের প্রেম দিলে হুজুরের অপ্রেমই হয়। একসঙ্গে সকলকে কি একইরকম প্রেম বিতরণ সম্ভব ! কে পেরেছে?
আমাদের দেশে মাঝেমাঝেই এরকম ‘দেশপ্রেম’-এর অগ্নিপরীক্ষা হয় ফি-বছর। দেশপ্রেমীরা সদা জাগ্রত। এতটাই জাগ্রত যে কোনো হিন্দু মুসলমানদের পক্ষে কথা বললে সেই হিন্দুও ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে যায়। ভারতের মুসলিমদের পরীক্ষা দিতে হয় যে তারা কতটা ‘দেশপ্রেমী’। তবে এটা যে শুধু ভারতেই হয় তা নয়, বাংলাদেশের হিন্দুদেরও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় যে তারা কতটা ‘দেশপ্রেমী’। কিছুদিন আগে একটা পোস্ট দেখছিলাম, তাতে লেখা ছিল – “আপনি কি ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চান ? যারা চান না তারা Like করুন, যারা চান তারা Comments করুন”। অর্থাৎ লাইকওয়ালারা ‘দেশদ্রোহী’, কমেন্টওয়ালারা ‘দেশপ্রেমী’। কী সহজ উপায় ! যুদ্ধরত সৈনিকদের ছবি অথবা মৃত সৈনিকদের ছবি দিয়েও ‘দেশপ্রেম’ যাচাইয়ের পদ্ধতিও আমাদের দেশে চালু আছে।আরে ভাই, দেশপ্রেম এতই সহজ ! বলি, কী করেছ দেশের জন্য ? দেশে যখন এতই দেশপ্রেমীদের ছড়াছড়ি, তাহলে খুন-ধর্ষণসহ অন্যান্য অভিযোগে অভিযুক্ত প্রার্থীরা নির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হতে পারতেন না। তারা কোন ‘দেশপ্রেমী’, যারা এইসব প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জেতানোর দায়িত্ব নেন ? গর্হিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি জেলে বসে কীভাবে জেতেন ? কারা দেন ভোট ? তারা কি আমাদের গর্বের ‘দেশপ্রেমী’ ? এই ভোটপ্রার্থীরাই আজ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক। তাদের কাড়ি কাড়ি টাকা চলে যাচ্ছে সুইস ব্যাংকে।দেশপ্রেমীদের আনুকূল্যে দেশ রসাতলে চলে যাচ্ছে, কারোর ভ্রূক্ষেপ নেই।এরা শুধু একটা কাজ ভালো করেন, সারা বছর অতন্দ্র প্রহরীর মতো ‘দেশদ্রোহী’ খুঁজে বেড়ান। পেয়েও যান। এ দেশে নেতাজিকে ‘তেজোর কুকুর’ বলা যায়, কিন্তু ‘বার খেয়ে খুদিরাম’ বলা যায় না। কিষাণ সিং ‘মমতা ব্যানার্জিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান’ বলেছেন বলে পশ্চিমবঙ্গে দিকে দিকে হোর্ডিং দিয়ে বোঝানো হয়েছিল, কী ভয়ংকর এই মানুষটা মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে চাইছেন, তার মানে মমতা মুখ্যমন্ত্রী হলে সারা রাজ্যে কিষেণ বেনিফিট করবে। আগুন জ্বলবে রাজ্যে।২০১১ সালে নির্বাচন হয়ে গেল, মমতা ব্যানার্জিই মুখ্যমন্ত্রী হল। মমতা ব্যানার্জির পুলিশের গুলিতে কিষেণ সিংয়ের মৃত্যু হল। যারা হোর্ডিং টাঙিয়ে ছিল তারাই কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন কিষেণ সিংয়ের মৃত্যুতে। সেই কান্নায় অংশগ্রহণ করেছিলেন আরও অনেকেই, যারা বস্তুত দেশপ্রেমী বলে চিহ্নিত। যারা প্রতিনিয়ত মানুষকে বিভ্রান্ত করে মানুষকে ভুল পথে চালিত করে চলেছেন, তারা দেশদ্রোহী নন।দেশ মাটিতে দিয়ে তৈরি হয় না, দেশ মানুষ দিয়ে তৈরি।এ দেশে “ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়” বললে কিংবা স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় উত্তোলন না করলেও ‘দেশপ্রেমী’ হতে বাধা নেই, কিন্তু “এ দেশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে” বললে অবশ্যই ‘দেশদ্রোহী’। বস্তুত কী বলা হচ্ছে সেটা বড়ো কথা নয়, কে বলছে কারা বলছে সেটাই বিচার্য। আসলে সব চরিত্রই কাল্পনিক !!!

কোন মন্তব্য নেই: