সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান (প্রথম পর্ব)



প্ল্যাটফর্মে ধাতুর আংটি বিক্রেতা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে আংটিটি আঙুলে ঢোকানোর। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ হবেন নাই-বা কেন ! আঙুলগুলিতে তো আর আংটি ঢোকানোর জায়গাই নেই।দশ আঙুলে কুড়িটা রত্নখোচিত আংটির উপর ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি কোথায় ঢুকবে ? পোখরাজ, গোমেদ, পান্না, চুনি, প্রবাল -- কী নেই সেই দশ আঙুলে ! ডাবল ডাবলও আছে। ‘রহিস আদমি’ পেয়ে জ্যোতিষীরা ওর দশ আঙুলে বিশটা আংটি ভজিয়ে দিয়েছে। ওই বিশটা আংটিতেও যে কাজ হয়নি, তা ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি পরার ব্যাকুলতাতেই আন্দাজ করা যায়।

আর-একটা ঘটনা বলি : বছর কুড়ি আগে আকাশবাণীর ‘বিজ্ঞানরসিকের দরবারে’ শিরোনামে অনুষ্ঠান হত।কোনো একদিনের অনুষ্ঠানে কলকাতার স্বনামখ্যাত পাঁচজন জ্যোতিষীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট কোষ্ঠী বিচারের জন্য।পাঁচ জ্যোতিষীই জানতেন এই কাজটি করতে শুধুমাত্র তাঁকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যদিও ট্যবলেট বিক্রেতা এক স্বনামধন্য লাল-জ্যোতিষী ছাড়া বাকি চারজন জ্যোতিষী আকাশবাণীতে গিয়েছিলেন নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রমাণ করতে। চারজন জ্যোতিষীকে চারটি ভিন্ন ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছিল একই ব্যক্তির কোষ্ঠী দিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে চারজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে একই ব্যক্তির চারটি কোষ্ঠী জমা নেওয়ার পর দেখা গেল  চার ধরনের বিচার। কারোর সঙ্গে কারোর মিল নেই।এখানেই শেষ নয় বিস্ময়ের। সেই কোষ্ঠীর জাতক ছিলেন একজন মৃত শিশুর। সেই মৃত শিশুর কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীরা বলেছিলেন যে জাতকের বিয়ে হবে, চাকরি হবে, ফাঁড়া ইত্যাদি ইত্যাদি হাস্যকর কথাবার্তা।
এরকম ঘটনার ঝুড়ি ঝুড়ি উল্লেখ করা যায়। তাতে লাভ কিছু নেই। মানুষ যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে, জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষী যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি জ্যোতিষ আসলে কী ? জ্যোতিষ কি শাস্ত্র ? নাকি বিজ্ঞান ? প্রচুর বিতর্ক, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এ বিষয়ে। তবুও আমি আমার মতো চেষ্টা করি। বোঝার এবং বোঝাবার।

‘জ্যোতির্বিদ্যা’(Astronomy) আর ‘জ্যোতিষবিদ্যা’(Astrology) কি একই বিষয় ? না, একই বিষয় নয় তো ! যদিও উচ্চারণের দিক থেকে দুটি শব্দ খুবই কাছাকাছি।অর্থ কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত।জ্যোতিষবিদ্যা যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জ্যোতিষী এবং জ্যোতির্বিদ্যা যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা জ্যোতির্বিদ। জ্যোতিষী হলেন কিরো, ভৃগু, পরাশর, অমুক সম্রাট, তমুক সমুদ্ররা। অপরদিকে জ্যোতির্বিদ হলেন উইলিয়ম হার্শেল, ভেইনু বাপ্পু, মেঘনাদ সাহা, জয়ন্ত বিষ্ণু নার্লিকার, আর্যভট্ট, গ্যালিলিও, কোপারনিকাস প্রমুখ।জ্যোতির্বিদ্যার বিষয় সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ছায়াপুঞ্জ, উল্কা, ধূমকেতু। জ্যোতিষবিদ্যার বিদ্যার বিষয় হাত-পা-মুখ গুনে ব্যক্তির ভূত-ভবিষ্যত বলে দেওয়া।জ্যোতির্বিদ্যায় সূর্যের চারপাশে পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহরা ঘুরপাক খায়।জ্যোতিষবিদ্যায় পৃথিবীর চারপাশে সূর্য সহ অন্যান্য গ্রহরা ঘুরপাক খায়। পৃথিবী নামে কোনো গ্রহের অস্তিত্ব নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় উপগ্রহ আছে, জ্যোতিষবিদ্যায় কোনো উপগ্রহ নেই।জ্যোতির্বিদ্যায় রাহু ও কেতুর কোনো অস্তিত্ব নেই, জ্যোতিষবিদ্যায় রাহু ও কেতুর অস্তিত্ব প্রবল। জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহ বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো ইত্যাদি। জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহরা বালি-পাথর-গ্যাসীয় মহাজাগতিক নিথর বস্তু বিশেষ। জ্যোতিষবিদ্যার গ্রহ সূর্য বা রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু এবং কেতু। জ্যোতিষবিদ্যার গ্রহরা সবাই দেবতা, তাদের কোপে মানুষের সব্বোনাশ হয়। জ্যোতিষবিদ্যায় গ্রহরত্ন, গ্রহমূল, অষ্টধাতুর ব্যবহার আছে। জ্যোতির্বিদ্যায় এসবের কোনো ব্যবহারই নেই।জ্যোতিষবিদ্যায় মামলা-মোকদ্দমা জিতিয়ে দেওয়া, বিয়ে হওয়া, পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়া, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার দাবি করে। জ্যোতির্বিদ্যায় এসবের কোনো চর্চা নেই।জ্যোতির্বিদ্যায় পদার্থবিদ্যা, গণিত, দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রয়োজন হয়। জ্যোতিষবিদ্যায় কোনো বিদ্যাই লাগে না -- লাগে ব্যক্তির দুর্বলতা খুঁজে বের করার ক্ষমতা, কৌশল-চাতুরতা, সম্মোহনী আর রত্ন-মাদুলি-কবচ গছানোর ক্ষমতা। গ্রহ-নক্ষত্র দেখতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগে না, দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়াই বহুদূরে থাকা ভবিষ্যত আর অতীত দেখাই জ্যোতিষ।
ভারতে বৈদিক যুগের মাঝামাঝি মায় ব্রাহ্মণ সাহিত্যাদি রচনার যুগ থেকেই জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ অগ্রগতি হয়েছিল। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা বলেন – প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে জ্যোতিষীর ভবিষ্যবিচারের কোনো ইঙ্গিত নেই। হস্তরেখা বিচারের প্রাচীনতম আলোচনা গরুড়পুরাণে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ শতকের ‘বৃহৎসংহিতা’, যে গ্রন্থটির রচয়িতা বরাহমিহির। ব্রাহ্মণ্য যুগে জ্যোতর্বিদ্যাকে একটি স্বতন্ত্র বিদ্যা হিসাবে গণ্য করত। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে জ্যোতিষকে বলা হয়েছে ‘নক্ষত্রবিদ্যা’ এবং জ্যোতির্বিদকে ‘নক্ষত্র দর্শক’ বলা হয়েছে।আর্যভট্টই প্রথম ভারতীয় জ্যোতির্বিদ, যিনি পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথা বলেন। গ্রিকদের অনেক আগে থেকেই ব্যাবিলনীয়, মিশরীয় এবং ভারতীয়রা ২০০০ বছর ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করে এসেছে। সেই জ্ঞান চর্চা অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের পরিপূর্ণ সদব্যবহার গ্রিক বিজ্ঞানীরা করেছেন। গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কখনোই জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় ধর্ম এবং ফলিত জ্যোতিষের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করেনি।
আরিস্টটল মনে করতেন – বিশ্ব দুটি ভাগে বিভাজিত। (১)পার্থিব, যেখানে পাপে পরিপূর্ণ এবং (২) গাগনিক বা স্বর্গীয়, যেখানে সবই নিখুঁত ও অপরিবর্তনীয়।বিশ্বের কেন্দ্রে আছে অনড় পৃথিবী, আর তাকে কেন্দ্র করে পূর্ব থেকে পশ্চিম ঘুরে চলেছে ৫৬টি গোলক, যেখানে আছে গাগনিক বস্তুগুলি। সবচেয়ে নীচের গোলকে আছে চাঁদ, এই চাঁদই পাপী পৃথিবী এবং পবিত্র স্বর্গীয় অঞ্চলের সীমারেখাকে নির্দেশ করছে। অ্যারাস্টটলের এই ধারণাই চার্চের মতবাদ হিসাবে প্রচারিত হত। এই মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ করা মানে ধর্মদ্রোহিতার সমতুল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ টলেমি চিন্তাবিদ দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ধারণার উপর ভিত্তি করে ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের এক সম্পূর্ণ ছবি সামনে আনেন। তিনি বলেন – অনড় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সাতটি নিখুঁত গোলক (যথাক্রমে চাঁদ, বুধ, শুক্র, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি) সুসম বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে এবং অষ্টম গোলকে নক্ষত্রেরা অবস্থান করছে।বহু পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাস ১৫৪৩ সালে এক গ্রন্থে বললেন – পৃথিবী নয়, বিশ্বের কেন্দ্রে আছে সূর্য। সূর্যকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। ইতালির চিন্তাবিদ জিওনার্দো ব্রুনো কোপারনিকাসের এই সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করতে থাকলেন। ব্রুনো অপরাধী সাব্যস্ত হলেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে বিচার চলল এবং বিচারে মৃত্যুদণ্ড আদেশ হল। প্রকাশ্যে জনসমক্ষে ব্রুনোকে দাউদাউ আগুনে পুড়িয়ে মারা হল। সাল ১৬০০। মারা গেলেন জ্যোতির্বিদ, সত্য আজও বেঁচে আছে।সৌরতত্ত্ব আজও সত্যে অটুট।সাল ১৬০৯, জার্মানির জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বললেন – কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বটি সঠিক।
সভ্যতার উষাকালে জ্যোতিষবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্দশ বিদ্যার কথা বলা হয়েছে – চার বেদ, ছয় বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ন্যায়, ধর্মশাস্ত্র এবং পুরাণ। ছয় বেদাঙ্গের মধ্যে জ্যোতিষ অন্যতম। পাণিনীয় শিক্ষায় জ্যোতিষকে বেদপুরুষের দুই চক্ষুরূপে কল্পনা করা হয়েছে – “জ্যোতিষাময়নং চক্ষঃ”।শাস্ত্রজ্ঞগণ বলেন – যে শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা জ্যোতিষ্কসমূহের পরিভ্রমণকাল, তাদের স্বরূপ, সঞ্চার, অবস্থান এবং তৎসম্বন্ধীয় যাবতীয় ঘটনাবলি মানুষের জীবনে তাদের প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে জানতে পারি তাই জ্যোতিষ। বোঝাই যাচ্ছে এ জ্যোতিষের প্রবক্তা ব্রাহ্মণ্যবাদ। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে ভগবান সাজার শ্রেষ্ঠ উপায়। বিস্ময়াভূত মানুষদের কাছে জ্যোতিষের আসন ভগবান শ্রদ্ধার। তাই জ্যোতিষচর্চায় পোপ-পাদরি-ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার।
ভারতে জ্যোতিষচর্চার সূত্রপাত ঋগবেগের কাল থেকে। ক্রান্তদর্শী ঋষিগণ চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বৈচিত্র্য ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজতে চেয়েছেন। বৈদিক ধর্মকর্ম, যাগযজ্ঞের জন্য কাল নির্ধারণে জ্যোতিষের জ্ঞান থাকা একান্ত অপরিহার্য ছিল। ফলে সূর্য-চন্দ্রের গতি, উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন বিভাগ, সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ নির্ণয়, মাস-পক্ষ-দিন-তিথি নির্ণয়, পূর্ণিমা-অমাবস্যা, ঋতুবিভাগ প্রভৃতি নির্ণয়ে জ্যোতিষে জ্ঞান আবশ্যিক। জ্যোতিষবিদ্যা হাত-পা-মুখ দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া নয়।
জ্যোতিষবিদ্যাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয় – (১) গণিত জ্যোতিষ এবং (২) ফলিত জ্যোতিষ।গণিত জ্যোতিষে জ্যোতিষ্ক পরিবারের অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের স্থান, তাদের গতি ও কার্যকলাপ এবং সে বিষয়ে গাণিতিক সূত্রাবলি অর্থাৎ পাটিগণিত, বীজগণিত, পরিমিতি প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। এই শাখার প্রাচীন এবং অন্যতম মনীষীগণ হলেন প্রথম আর্যভট্ট, বরাহমিহির (গ্রন্থ : পঞ্চসিদ্ধান্তিকা), ব্রহ্মগুপ্ত (গ্রন্থ : ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত), ভাস্করাচার্য (গ্রন্থ : সিদ্ধান্তচূড়ামণি) প্রমুখ।অপরদিকে ফলিত জ্যোতিষ হল গ্রহ-নক্ষত্রাদির জ্যোতিষ্ক পদার্থগুলির আবর্তন ও অবস্থান ভেদে মানবজীবনে তথা পৃথিবীর উপর তাদের অনুসন্ধান এবং তার জন্য শুভাশুভ ফল গণনা। ফলিত জ্যোতিষীর প্রাচীন মনীষীগণ হলেন বিষ্ণুগুপ্ত, জীবশর্মা, দেবস্বামী, যবনাচার্য, সত্যাচার্য, সিদ্ধসেন, পৃথু প্রমুখ।ফলিত জ্যোতিষীর গ্রন্থগুলি হল – বৃহৎবিবাহপটল, পল্লববিবাহপটল, বৃহজ্জাতক, লঘুজাতক, বৃহৎসংহিতা ইত্যাদি। বৃহৎবিবাহপটল, পল্লববিবাহপটল গ্রন্থদুটিতে জ্যোতিষবিদ্যা অনুসারে বিবাহের শুভাশুভ কাল বর্ণিত হয়েছে।ফলিত জ্যোতিষকে বরাহমিহির তিনটি শাখায় ভাগ করেছেন। যেমন – (১) তন্ত্র : জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত। গ্রহগতির আলোচনা গণিতাংশে আছে। (২) হোরা বা জাতক : কোষ্ঠী সম্পর্কিত বিভাগ। ‘অহোরাত্র’ শব্দের আদি ও অন্ত্যাক্ষর বাদ দিয়ে ‘হোরা’ শব্দ উদ্ভূত হয়েছে।মানুষের ভাগ্য ও কর্মফল, গ্রহের প্রভাব প্রভৃতি আলোচনা হয়েছে।  (৩) সংহিতা : সাধারণ জ্যোতিষ বিষয়ক আলোচনা। যেমন – ‘বৃহৎসংহিতা’।
বৃহৎসংহিতা বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক উল্লেখযোগ্য ফলিত জ্যোতিষগ্রন্থ।এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়গুলি কি তা দেখা যাক। (১) রবি প্রভৃতি অষ্টগ্রহের এবং সপ্তর্ষি, ধূমকেতু প্রভৃতির রাশির স্থানান্তর হেতু শুভ ও অশুভ ফল। (২) নতুন গ্রহের আগমনে তার প্রভাব, বর্ষফল, বৃষ্টিপাত, উল্কাপাত ও পরিবেশের প্রভাব। (৩) বিভিন্ন রত্ন পরীক্ষার বিধান, স্ত্রী ও পুরুষের লক্ষণ, বৈবাহিক নক্ষত্র ও লগ্ন বিষয়ক আলোচনা।(৪) পূর্তকর্ম, স্থাপত্য, জাতকশাস্ত্র, অঙ্গবিদ্যা, রাজব্যবহার, বাস্তুবিদ্যা, ভূবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা প্রভৃতি। (৫) বিভিন্ন গ্রহ বক্র হলে তার খারাপ ফল কেমন হতে পারে তার বিস্তৃত আলোচনা। (৬) গর্গ, পরাশর, কশ্যপ, ভৃগু, বশিষ্ঠ, বৃহস্পতি, মনু প্রমুখ মনীষীদের নাম ও তাঁদের মতামত আছে।পঞ্জিকাগুলি আসলে সেই জ্যোতিষবিদ্যার ফল।
অতএব জ্যোতিষশাস্ত্র বলতে যা বোঝায় একজন ব্যক্তির বা জাতকের জন্মপত্রিকা অনুশীলনসাপেক্ষে তার চরিত্র ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা আপাত ধারণা তৈরি করা এবং এই কাজে জাতকের জন্ম সময়ের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রদের অবস্থান পর্যালোচনা করা। জ্যোতিষবিদ্যার এই সাম্প্রতিক সংস্করণ প্রকৃতপক্ষে সুমেরীয় যুগের অপরিণত জ্যোতিষবিদ্যারই ক্রমবিকাশ।জন্মপত্রিকা থেকে একজন ব্যক্তি বা জাতকের ভাগ্য আগাম বলে দেওয়ার ভাবনা জ্যোতিষীয় পদ্ধতি দৃশ্যমান কোনো ঘটনার উপর তৈরি হয়নি, এর উদ্ভব হয়েছিল জন্মকালে গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে জাতকের তৈরি হওয়া এক অদৃশ্য বন্ধনের অলীক কল্পনা থেকে।বস্তুত জ্যোতিষশাস্ত্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সভ্যতার ধর্মীয় ভাবনাকে ভিত্তি করে। প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ায় প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রকে কোনো-না-কোনো ঈশ্বর বা অতিমানবের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। তারা মনে করতেন, ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন এইসব বস্তু সত্ত্বা পার্থিব জীবনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই বুঝি পৃথিবীর প্রাণীজগত এক অদৃশ্য বন্ধনে মহাজাগতিক গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে আবদ্ধ। অবশ্য এখানে প্রাণীজগত বলতে মানুষের জগত বুঝতে হবে। কেন-না মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীদের ভাগ্য-গ্রহ-প্রতিকার নিয়ে বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই।
অপরদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান হল মহাবিশ্ব, মহাবিশ্বের প্রশ্নোত্তর।মহাবিশ্বের অধিকাংশই ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শূন্যস্থান। তাপমাত্রা -২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।এর মধ্যে অনেক দূরে দূরে ভেসে আছে গ্যালাক্সি (Galaxy) চক্রাকার, ডিম্বাকৃতি, এরকম নানা আকৃতির জ্বলন্ত তারা, গ্যসের পুঞ্জ এবং ধুলোর মেঘের সমন্বয়ে গঠিত তারাজগত। এক-একটি তারাজগতে ১০০ কোটি থেকে ৫০ হাজার কোটিরও বেশি তারা আছে। আছে ছায়াপথ, এই ছায়াপথে আছে প্রায় ১০ হাজার কোটি তারা। এই ছায়াপথ, অ্যান্ড্রোমিডা, কোলস্যাক, অশ্বমুণ্ড, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র মাজেলানিক ক্লাউড ইত্যাদি প্রায় ২৪ টি তারাজগত মিলে তৈরি করেছে একটি মহাতারাজগত।এরকম হাজার হাজার মহাতারাজগত মহাশূন্যের বিপুল নিকষ কালো অন্ধকারে পুঞ্জে পুঞ্জে অবস্থান করছে।তারাজগতের বিশাল বস্তুপুঞ্জগুলো তাদের নিজ নিজ কেন্দ্রের প্রচণ্ড অভিকর্ষ বলে সারাক্ষণ পাক খেয়েই চলেছে। যে বস্তু তারাজগতের কেন্দ্রের কাছাকাছি তার গতি দ্রুত এবং যে বস্তু প্রান্তবর্তী তার গতি মন্থর। সূর্য তার গ্রহমণ্ডলী নিয়ে ছায়াপথের কেন্দ্রের চারিদিকে প্রতি সেকেন্ডে ২৫০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। যাই হোক, এবার আমরা দেখে নিতে পারি জ্যোতিষবিদ্যার জ্যোতিষীবাবুদের গ্রহ আর জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহদের চেহারা কেমন। প্রথমেই আসি সূর্যের প্রসঙ্গে। যেটি জ্যোতিষবিদ্যায় নক্ষত্র বলা হয় না, বলা হয় গ্রহ।
সূর্য (Sun): সূর্য একটি জি-ধরণের প্রধান ধারার তারা যার ভর সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬৩২ ভাগ। এর গঠন প্রায় নিখুঁত গোলকের মতো, কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিকে কমলালেবুর মতো একটু চাপা। এই কমলাকৃতির পরিমাণ প্রতি ৯০ লক্ষ ভাগে এক ভাগ। অর্থাৎ সূর্যের মেরু অঞ্চলীয় ব্যস বিষুবীয় ব্যাসের চেয়ে মাত্র ১০ কিলোমিটার কম। যেহেতু সূর্য প্লাজমা তথা আয়নিত গ্যাস দিয়ে গঠিত, সেহেতু এটি বিষুবীয় অঞ্চলে মেরু অঞ্চলের চেয়ে বেশি বেগে ঘোরে। এই পরিবর্তনশীল বেগকে বলা হয় ব্যাবকলনীয় বেগ। এ ধরনের বেগের কারণ, সূর্যের মধ্যকার পরিচলন এবং কেন্দ্রের চেয়ে পৃষ্ঠের দিকে তাপমাত্রার ঢাল বেশি বাঁকা হওয়ায় ভরের স্থানান্তর। ভূকক্ষের উত্তর মেরু থেকে দেখলে সূর্যের যে বামাবর্তী কৌণিক ভরবেগ পর্যবেক্ষণ করা যায় তার কিছু অংশ এই ভর স্থানান্তরের কারণে পুনর্বণ্টিত হয়। অর্থাৎ এক স্থানের ভরবেগ কমে গিয়ে অন্য স্থানে বেড়ে যায়। এই প্রকৃত ঘূর্ণন বেগের মান হচ্ছে বিষুবীয় অঞ্চলে ২৫.৫ দিন এবং মেরু অঞ্চলে ৩৩.৫ দিন। তবে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকায় আমরা এই আবর্তন বেগের মান পাই ২৮ পার্থিব দিন। দেখা যাচ্ছে, সূর্যের নিজ কক্ষের চারদিকে আবর্তন বেগ খুবই কম, এই ঘূর্ণন বেগ থেকে যে কেন্দ্রাতিগ বলের সৃষ্টি হয় তা সূর্যের পৃষ্ঠ অভিকর্ষের তুলনায় ১৮০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। গ্রহগুলির জোয়ার বলও এ তুলনায় এত নগণ্য যে তারা সূর্যের আকার-আকৃতির কোনো পরিবর্তন করতে পারে না।
সূর্য একটি পপুলেশন-১ তারা, অর্থাৎ এতে ভারী মৌলিক পদার্থের পরিমাণ বেশি। তারাটির উৎপত্তির পিছনে খুব সম্ভবত আশপাশের এক বা একাধিক অতিনব তারা বিস্ফোরণের ভূমিকা আছে। উল্লেখ্য অতিনব তারা বিস্ফোরণ বিশাল গ্যাসীয় মেঘকে সংকুচিত করার মাধ্যমে নতুন তারা সৃষ্টির সূচনা ঘটাতে পারে। সৌরজগতে সাধারণ পপুলেশন-২ তারার (যাদের মধ্যে ভারী পদার্থ কম থাকে) চেয়ে বেশি ভারী মৌল দেখা যায়। যেমন, ইউরেনিয়াম এবং স্বর্ণ। এই ভারী মৌলগুলো সম্ভবত অতিনবতারা বিস্ফোরণের সময় তাপহারী বিক্রিয়ার মাধ্যমে, অথবা কোনো বৃহৎ দ্বিতীয় প্রজন্ম তারার অভ্যন্তরে নিউট্রন শোষণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়েছিল।পার্থিব গ্রহগুলোর মত সূর্যের কোন নির্দিষ্ট পৃষ্ঠসীমা নেই এবং এর গ্যাসের ঘনত্ব ব্যসার্ধ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সূচকীয় হারে হ্রাস পায়। তথাপি এর প্রায় সুনির্দিষ্ট একটি অভ্যন্তরীন গঠন রয়েছে যা নীচে বর্ণনা করা হবে। সূর্যের ব্যাসার্ধ নির্ণয় করা হয় কেন্দ্র থেকে আলোকমণ্ডলের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। আলোকমণ্ডল সূর্যের এমন একটি অঞ্চল যার বাইরে গ্যাস এত পাতলা হয়ে যায় যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিকিরণ নিঃসরণ করতে পারে না। এজন্যই দৃশ্যমান আলোয় আমরা সাধারণত সূর্যের আলোকমণ্ডলই দেখি।সূর্যের অভ্যন্তরভাগ সরাসরি দেখা যায় না, সূর্য তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের প্রতি অনচ্ছ। কিন্তু সৌরকম্পনবিদ্যার মাধ্যমে অভ্যন্তরভাগ সম্পর্কে ধারণা লাভ সম্ভব, ঠিক ভূকম্পনবিদ্যার মতো। ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গের মাধ্যমে যেমন পৃথিবীর অভ্যন্তরীন গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, ঠিক তেমনই সূর্যের অভ্যন্তরভাগ দিয়ে চলমান অবশাব্দিক চাপ তরঙ্গের মাধ্যমে সূর্যের অভ্যন্তরীন গঠনও জানা সম্ভব। এছাড়া কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমেও সূর্যের অদেখা ভুবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।
সূর্যের কেন্দ্র থেকে শুরু করে মোট ব্যাসার্ধের শতকরা ২০-২৫ ভাগ পর্যন্ত যে অঞ্চলটি আছে তার নাম কোর বা কেন্দ্রভাগ। এই অঞ্চলের ঘনত্ব ১৫০ গ্রাম/ঘনসেন্টিমিটার (জলের ঘনত্বের ১৫০ গুণ) এবং তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৩৬ লক্ষ কেলভিন। অথচ সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন। সোহো মহাকাশ মিশন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সূর্যের কেন্দ্রভাগে ঘূর্ণন বেগ বিকিরণ অঞ্চলের অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশি। এই অঞ্চলে প্রোটন প্রোটন শিকলের মাধ্যমে হাইড্রোজেন সংযোজনের (ফিউশন) মাধ্যমে হিলিয়াম তৈরি হয়। এটিই সূর্যের শক্তির প্রধান উৎস। সূর্যে উৎপাদিত মোট হিলিয়ামের শতকরা মাত্র ২ ভাগ সিএনও চক্র থেকে আসে।কেন্দ্রভাগে সূর্যের মোট শক্তির প্রায় পুরোটাই উৎপাদিত হয়। ব্যাসার্ধের ২৪% -এর মধ্যে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যের মোট শক্তির শতকরা ৯৯ ভাগ উৎপাদিত হয়, ৩০% এর পর আর কোনো ফিউশন বিক্রিয়া দেখাই যায় না। সুতরাং সূর্যের বাকি অংশ কেন্দ্রভাগের শক্তি দিয়েই চলে, কেন্দ্রভাগ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শক্তি বাইরের স্তরগুলির দিকে প্রবাহিত হয়। অনেকগুলি স্তর ভেদ করে অবশেষে এই শক্তি আলোকমণ্ডলে পৌঁছোয়, এরপর পদার্থ কণার গতিশক্তি বা সূর্যালোক হিসাবে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি সেকেন্ডে ৯.২×১০৩৭ টি প্রোটন-প্রোটন শিকল বিক্রিয়া ঘটে। প্রতিটি বিক্রিয়ায় যেহেতু ৪টি হাইড্রোজেন মিলে একটি হিলিয়াম তৈরি হয় সেহেতু বলা যায়, প্রতি সেকেন্ডে সূর্য ৩.৭×১০৩৮ টি প্রোটনকে (প্রায় ৬.২×১০১১ কিলোগ্রাম) আলফা কণা তথা হিলিয়াম কেন্দ্রিনে রূপান্তরিত করে। সূর্যে মোট মুক্ত প্রোটনের সংখ্যা প্রায় ৮.৯×১০৫৬ টি। হাইড্রোজেনের সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সংযোজিত ভরের শতকরা ০.৭ ভাগ শক্তিতে পরিণত হয়। হিসাব করলে দেখা যায় ভরশক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে ৪২ লক্ষ মেট্রিক টন শক্তি বিমুক্ত হয়। ভর ধ্বংস হয় না, বরং এই ভরশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, যা বিকিরণ হিসাবে মহাশূন্য ছড়িয়ে পড়ে। আইনস্টাইনের ভরশক্তি সমতুল্যতা দিয়ে এটি ব্যাখ্যা করা যায়।তবে কেন্দ্রেভাগের সব স্থানে একই হারে বিক্রিয়াটি ঘটে না। কেন্দ্র থেকে দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিবর্তিত হয়। তাত্ত্বিক মডেল থেকে দেখা যায় সূর্যের কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ প্রতি ঘন মিটারে ২৭৬.৫ ওয়াট। পরিমাণটি কিন্তু মোটেই বেশি নয়। এই সংখ্যা পারমাণবিক বোমার বদলে আমাদেরকে সরীসৃপদের বিপাক ক্রিয়া ব্যবহৃত শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। সূর্যের প্রতি একক আয়তনে উৎপাদিত সর্বোচ্চ শক্তিকে খাদ্যশস্যের বর্ধনে ব্যবহৃত সারের ব্যয়িত শক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সূর্য থেকে যে আমরা এত শক্তি পাই তার কারণ এই নয় যে, এই গ্যাসপিণ্ডের প্রতি একক আয়তনে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হয়, বরং এইজন্যে যে সূর্যের আয়তন অনেক বেশি। একক আয়তনে শক্তির পরিমাণ অনেক কম হলেও সমগ্র আয়তনে সংখ্যাটি অনেক বড়ো হয়ে যায়।
কেন্দ্রভাগের সংযোজন বিক্রিয়া একটি আত্মসংশোধনযোগ্য সাম্যাবস্থায় আছে। বিক্রিয়ার হার যদি একটু বেড়ে যায় তাহলে কেন্দ্রভাগ উত্তপ্ত হয়ে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে, এতে গ্যাসের ঘনত্ব কমে যায়, বিক্রিয়া হারও কমে যায়। আবার বিক্রিয়ার হার স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে কেন্দ্রভাগ সামান্য সংকুচিত হয়ে গ্যাসের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে বিক্রিয়ার হার আবার বেড়ে যায়। এভাবেই সাম্যাবস্থা রক্ষিত হয়।বিক্রিয়া যেসব উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি উৎপন্ন হয় তারা বিকিরিত হওয়ার মাত্র কয়েক মিলিমিটারের মধ্যেই সৌর প্লাজমা দ্বারা আবার শোষিত হয়, এরপর সামান্য নিম্ন শক্তিতে আবার বিকিরিত হয়। এভাবে বিকিরিণ-শোষণের খেলা চলতেই থাকে। এজন্যই সূর্যের কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠে শক্তি পৌঁছোতে অনেক সময় লাগে। কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠে ফোটনের আসতে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১৭০,০০০ বছর লাগে বলে অনুমান করা হচ্ছে। পৃষ্ঠমুখী যাত্রার পথে ফোটন পরিচলন অঞ্চল পার হয়ে শেষে আলোকমণ্ডলে পৌঁছোয়, এই স্তর পেরোলেই অবারিত মহাশূন্য, যাতে দৃশ্যমান আলো হিসাবে ফোটনগুলি ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতিটি রশ্মি সূর্য থেকে পালানোর পূর্বে কয়েক মিলিয়ন দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফোটনে রূপান্তরিত হয়। সংযোজন বিক্রিয়া গামা রশ্মির পাশাপাশি নিউট্রিনোও উৎপন্ন হয়, কিন্তু গামা রশ্মির মতো তারা পদার্থের সঙ্গে এত মিথস্ক্রিয়া করে না, আসলে মিথস্ক্রিয়া করে না বললেই চলে। সুতরাং উৎপাদিত নিউট্রিনোর প্রায় সবগুলিই তৎক্ষণাৎ সূর্য থেকে পালাতে সক্ষম হয়। অনেক বছর ধরে সূর্য থেকে যে পরিমাণ নিউট্রিনো পাওয়ার কথা তার চেয়ে প্রায় ৩ গুণ কম পাওয়া যাচ্ছিল। এই সমস্যার নাম দেয়া হয়েছিল সৌর নিউট্রিনো  সমস্যা। কিন্তু ২০০১ সালে নিউট্রিনো স্পন্দন আবিষ্কৃত হওয়ার পর এর সমাধান হয়েছে। আসলে সূর্য থেকে অনেক নিউট্রিনো আসে, কিন্তু পৃথিবীতে দুরবিনের মাধ্যমে আমরা মাত্র ৩ ভাগের ২ ভাগ নিউট্রিনো সনাক্ত করতে পারি, কারণ পৃথিবীতে আসতে আসতে নিউট্রিনোগুলো স্বাদ পাল্টায়।
সূর্যের বয়স বের করার কোনো সরাসরি উপায় না-থাকলেও পরোক্ষভাবে তা করা হয়েছে। যেমন পৃথিবীতে প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন প্রস্তর ও উল্কাপিণ্ডের বয়স হচ্ছে ৪৬০ কোটি বৎসর। ধারণা করা হয়, সমগ্র সৌরজগতের সৃষ্টি একই সময়ে। সেক্ষেত্রে সূর্যেরও বয়স হয় একই।সূর্যের ভরের শতকরা ৭৪ ভাগই হাইড্রোজেন, বাকি অংশের মধ্যে ২৫% হিলিয়াম । এছাড়াও আছে উচ্চ ভরসম্পন্ন কিছু বিরল মৌলিক পদার্থ। সূর্যের নাক্ষত্রিক শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে এর শ্রেণি হচ্ছে জি২ভি (G2V) "জি২" দ্বারা বোঝায় এর পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি  K দ্বারা বোঝায় এর বর্ণ সাদা, অবশ্য পৃথিবীর পরিবেশে বিচ্ছুরণের কারণে এর বর্ণ হলুদ দেখায়। এর বর্ণালি রেখা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তাতে আয়নিত নিষ্ক্রীয় উভয় ধরনের ধাতুর বর্ণালি রয়েছে, এছাড়াও রয়েছে খুব দূর্বল হাইড্রোজেন রেখা। V-বর্ণটি দ্বারা বোঝায়, অন্যান্য অধিকাংশ তারার মতোই সূর্য একটি প্রধান ধারার তারা। অর্থাৎ সূর্য তার প্রয়োজনীয় শক্তি হাইড্রোজেন কেন্দ্রীনকে কেন্দ্রীন সংযোজন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম কেন্দ্রীনে পরিণত করার মাধ্যমে উৎপাদন করে। এছাড়া প্রধান ধারার তারায় hydrostatic balance লক্ষ করা যায়, তথা এরা সম্প্রসারিত বা সংকুচিত হয়না। আমাদের ছায়াপথে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি G2 শ্রেণির তারা রয়েছে। সূর্যের সমগ্র আকারের লগারিদমভিত্তিক বিন্য্যাসের কারণে এই ছায়াপথের ৮৫% তারার চেয়ে এর উজ্জ্বলতা বেশি। অবশ্য আমাদের আকাশগঙ্গার অনেকগুলি তারাই লাল বামন পর্যায়ে রয়েছে। সূর্যের অবস্থান আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে ২৫,০০০ - ২৮,০০০ আলোক বর্ষ, আর এই দূরত্বে থেকেই এটি অবিরত ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে। একবার কেন্দ্রের চারদিক দিয়ে সমগ্র পথ ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে ২২৫ - ২৫০ মিলিয়ন বছর। এর কক্ষপথীয় দ্রুতি ২১৭ কিমি/সে; এ থেকে দেখা যায় সূর্য ১,৪০০ বছরে এক আলোক বর্ষ দূরত্ব এবং ৮ দিনে এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক (AU) দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।সূর্য একটি তৃতীয় প্রজন্মের তারা, কাছাকাছি কোনো একটি অতি নব তারা থেকে উদ্ভূত অভিঘাত তরঙ্গ এর উৎপত্তিতে একটি চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছিল। পুরো সৌরজগতে স্বর্ণ বা ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌলসমূহের প্রাচুর্য লক্ষ্ করে চালিকাশক্তি হিসাবে এই ঘটনাটি প্রস্তাব করা হয়েছে। খুব সম্ভবত একটি অতি নব তারার বিবর্তনের সময় ক্রিয়াশীল endergonic কেন্দ্রীন বিক্রিয়া অথবা দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বৃহৎ তারার অভ্যন্তরে নিউট্রন শোষণের ফলে উদ্ভূত ট্রান্সম্যুটেশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই মৌলসমূহ সৃষ্টি হয়েছে। এই সূর্যকে বশে রাখার জন্য চুনি (রত্ন Ruby) বা তামা/সোনা (ধাতু) বা স্টার রুবি (উপরত্ন) বা বিল্বমূল (মূল) বা মাতঙ্গী (কবচ) বা ১ মুখী/১০ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।
চন্দ্র বা চাঁদ (Moon) : চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ, কোনোভাবেই গ্রহ নয়। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩৮৪,৩৯৯ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৩০ গুণ। চাঁদের ব্যাস ৩,৪৭৪.২০৬ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বল পৃথিবী পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের এক-ষষ্ঠাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবী পৃষ্ঠে কারও ওজন যদি ১২০ পাউন্ড হয় তাহলে চাঁদের পৃষ্ঠে তার ওজন হবে মাত্র ২০ পাউন্ড। বেরিকেন্দ্র নামে পরিচিত একটি সাধারণ অক্ষের সাপেক্ষে পৃথিবী এবং চন্দ্রের ঘূর্ণনের ফলে যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এবং কেন্দ্রবিমুখী বল সৃষ্টি হয় তা পৃথিবীতে জোয়ারভাটা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির জন্য যে পরিমাণ শক্তি শোষিত হয় তার কারণে বেরিকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে পৃথিবী-চাঁদের যে কক্ষপথ রয়েছে তাতে বিভব শক্তি কমে যায়। এর কারণে এই দুইটি জ্যোতিষ্কের মধ্যে দূরত্ব প্রতি বছর ৩.৮ সেন্টিমিটার করে বেড়ে যায়। যতদিন-না পৃথিবীতে জোয়ারভাটার উপর চাঁদের প্রভাব সম্পূরণ প্রশমিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত চাঁদ দূরে সরে যেতেই থাকবে এবং যেদিন প্রশমনটি ঘটবে সেদিনই চাঁদের কক্ষপথ স্থিরতা পাবে।চাঁদই একমাত্র জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যাতে মানুষ ভ্রমণ করেছে এবং যার পৃষ্ঠতলে মানুষ অবতরণ করেছে। চাঁদের আবর্তনের পর্যায়কাল এবং তার কক্ষপথের পর্যায়কাল একই হওয়ায় আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ সবসময় দেখতে পাই। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে ২৭ দিন, ৭ ঘন্টা, ৪৩ মিনিট এবং ১১ সেকেন্ড সময় নেয়, কিন্তু সমসাময়িক আবর্তনের ফলে পৃথিবীর পর্যবেক্ষকরা প্রায় ২৯.৫ দিন হিসাবে গণনা করে। একটি ঘণ্টা আবর্তনের পর্যায়কাল অর্ধেক ডিগ্রি দূরত্ব অতিক্রম করে। চাঁদ পৃথিবীকে যে অক্ষরেখায় পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করছে, সে অক্ষরেখায় চাঁদ একদিন বা ২৪ ঘন্টায় ১৩° কোণ অতিক্রম করে। সুতরাং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ চাঁদের সময় লাগে ২৭ দিন, ৭ ঘণ্টা, ৪৩ মিনিট এবং ১১ সেকেন্ড। এই জন্য আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ দেখে থাকি। পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ দেখতে পেয়ে থাকি। চাঁদ আকাশের সবসময় একটি অঞ্চল থাকে তাকে জোডিয়াক বলে। যা ক্রান্তিবৃত্তের প্রায় ৮ ডিগ্রি নীচে এবং গ্রহণরেখা উপরে অবস্থান করে। চাঁদ প্রতি ২ সপ্তাহে একে অতিক্রম করে৷ পৃথিবী-চন্দ্র সমাহারের অবিরত পরিবর্তন হচ্ছে। চাঁদের আকর্ষণে চাঁদের দিকে অবস্থিত সমুদ্রের জল তার নীচের মাটি অপেক্ষা বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। এ কারণে চাঁদের দিকে অবস্থিত জল বেশি ফুলে উঠে। আবার পৃথিবীর যে অংশে অবস্থিত জল চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে, সেদিকের সমুদ্রের নীচের মাটি তার উপরের জল অপেক্ষা চাঁদ কর্তৃক অধিক জোরে আকৃষ্ট হয়। কারণ এই মাটি জল অপেক্ষা চাঁদের বেশি নিকটবর্তী। ফলে সেখানকার জল মাটি থেকে দূরে সরে যায়, অর্থাৎ ছাপিয়ে উঠে। এক্ষেত্রে ফুলে উঠার কাহিনিটিই ঘটে। পৃথিবী যে সময়ের মধ্যে নিজ অক্ষের চারদিকে একবার আবর্তন করে (একদিনে) সে সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে-কোনো অংশ একবার চাঁদের দিকে থাকে এবং একবার চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে। এ কারণে পৃথিবীর যে-কোনো স্থানে দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা হয়।তবে জোয়ারভাটার জন্য সূর্যের আকর্ষণও অনেকাংশে দায়ী। তবে অনেক দূরে থাকায় সূর্যের আকর্ষণ চাঁদের আকর্ষণের থেকে কম কার্যকর। সূর্য এবং চাঁদ যখন সমসূত্রে পৃথিবীর একই দিকে বা বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন উভয়ের আকর্ষণে সর্বাপেক্ষা উঁচু জোয়ার হয়, জোয়ারের জল বেশি ছাপিয়ে পড়ে। এই চন্দ্রকে বশে রাখার জন্য মুক্তো (রত্ন Pearl) বা মুন স্টোন (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা ক্ষীরিকা (মূল) বা কমলা (কবচ) বা ২ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।
মঙ্গল (Mars): সৌরজগতের চতুর্থতম গ্রহ হচ্ছে মঙ্গল । মঙ্গল সৌরজগতের শেষ পার্থিব গ্রহ। অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মত ভূত্বক আছে। এর অতি ক্ষীণ বায়ুমণ্ডল রয়েছে, এর ভূত্বকে আছে চাঁদের মতো অসংখ্য খাদ, আর পৃথিবীর মতো আগ্নেয়গিরি, মরুভূমি এবং মেরুদেশীয় বরফ। সৌরজগতের সর্ববৃহৎ পাহাড় এই গ্রহে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মন্স। সর্ববৃহৎ গভীর গিরিখাতটিও এই গ্রহে যার নাম ভ্যালিস মেরিনারিস। মঙ্গলের ঘূর্ণন কাল এবং ঋতু পরিবর্তনও অনেকটা পৃথিবীর মতো।মঙ্গলের ব্যাসার্ধ পৃথিবীর অর্ধেক এবং ভর পৃথিবীর এক দশমাংশ। এর ঘনত্ব পৃথিবী থেকে কম এবং ভূপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল পৃথিবীর শুষ্ক ভূমির মোট ক্ষেত্রফল থেকে সামান্য কম। মঙ্গল বুধ গ্রহ থেকে বড়ো হলেও বুধের ঘনত্ব মঙ্গল থেকে বেশি। এর ফলে বুধের পৃষ্ঠতলের অভিকর্ষীয় শক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। মঙ্গল দেখতে অনেকটা লাল রঙের কমলার মতো। এর কারণ মঙ্গলের পৃষ্ঠতলে প্রচুর পরিমাণে আয়রন (৩) অক্সাইডের উপস্থিতি। এই যৌগটিকে সাধারণভাবে রাস্ট বলা হয়। মঙ্গলের পৃষ্ঠ মূলত ব্যাসল্ট দ্বারা গঠিত। মঙ্গলের কিছু কিছু অংশে ব্যাসল্টের চেয়ে সিলিকা জাতীয় পদার্থ বেশি রয়েছে। এই অঞ্চলটি অনেকটা পৃথিবীর অ্যান্ডেসাইট (এক ধরণের আগ্নেয়শিলা) জাতীয় পাথরের মতো। পৃষ্ঠের অনেকটা অংশ সূক্ষ্ণ আয়রন (৩) অক্সাইড যৌগ দ্বারা আবৃত। ধূলিকণা নামে পরিচিত এই যৌগটি অনেকটা ট্যালকম পাউডারের মতো।মঙ্গলের কোনো অভ্যন্তরীণ চৌম্বক ক্ষেত্র নেই। কিন্তু কিছু পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে এর ভূত্বকের কিছু অংশ চুম্বকায়িত হয়ে আছে। চুম্বকীয়ভাবে susceptible খনিজ পদার্থের কারণে সৃষ্ট এই চৌম্বকত্বকে প্যালিওম্যাগনেটিজ্ বলা হয়। এই প্যালিওম্যাগনেটিজমের ধরন অনেকটা পৃথিবীর মহাসাগরীয় গর্ভতলে প্রাপ্ত অলটারনেটিং ব্যান্ডের মতো। গ্রহটির কেন্দ্রীয় অংশটির (core) ব্যাসার্ধ প্রায় ১,৪৮০ কিলোমিটার। এই কেন্দ্রভাগ মূলত লোহা দিয়ে গঠিত, অবশ্য লোহার সঙ্গে ১৫ থেকে ১৭% সালফার রয়েছে বলে জানা যায়। এ হিসাবে মঙ্গলের কেন্দ্রভাগ আয়রন সালফাইড দ্বারা গঠিত, যা অনেকাংশে তরল। এই পদার্থগুলোর ঘনত্ব পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত পদার্থের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কেন্দ্রের চারদিক ঘিরে সিলিকেট দ্বারা গঠিত একটি ম্যান্টল আছে, যা গ্রহটির অনেকগুলি শিলাসরণ এবং আগ্নেয় প্রকৃতির কাঠামো তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে ম্যান্টলটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। মঙ্গলের ভূত্বকের গড় পুরুত্ব ৫০ কিলোমিটার। তবে এই পুরুত্ব সর্বোচ্চ ১২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে দেখা যায়। অন্যদিকে পৃথিবীর ভূত্বকের পুরুত্ব গড়ে ৪০ কিলোমিটার। পৃথিবী এবং মঙ্গল এই গ্রহ দুটির আকৃতির অনুপাত বিবেচনায় আনলে পৃথিবীর ভূত্বক মঙ্গলের ভূত্বক থেকে মাত্র তিনগুণ পুরু। মঙ্গলকে বশে রাখার জন্য লাল প্রবাল (রত্ন Coral) বা তামা (ধাতু) বা অনন্ত (মূল) বগলা (কবচ) বা ৩ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।
বুধ (Mercury): বুধ সৌরজগতের প্রথম এবং ক্ষুদ্রতম গ্রহ। এটি সূর্যের সর্বাপেক্ষা নিকটতম গ্রহ। এর কোনো উপগ্রহ নেই। এটি সূর্যকে প্রতি ৮৮ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে। এর উজ্জ্বলতার আপাত মান -২.০ থেকে ৫.৫ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু একে পৃথিবী থেকে সহজে দেখা যায় না। কারণ সুর্যের সঙ্গে এর বৃহত্তম কৌণিক পার্থক্য হচ্ছে মাত্র ২৮.৩ ডিগ্রি। কেবল সকাল ও সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় একে দেখা যায়। গ্রহটি সম্বন্ধে তুলনামূলক অনেক কম তথ্য জানা গেছে। ভৌত বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বুধ অনেকটা চাঁদের মতো। কারণ এই গ্রহেও রয়েছে প্রচুর খাদ। গ্রহটির কোনো স্থিতিশীল বায়ুমণ্ডল নেই, নেই কোনো প্রাকৃতিক উপগ্রহ। এর একটি সুবৃহৎ লৌহকেন্দ্র আছে। এই কেন্দ্র কর্তৃক উৎপাদিত চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের তুলনায় ০.১% অধিক শক্তিশালী। বুধের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৯০ থেকে ৭০০ কেলভিনের মধ্যে থাকে। সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান হচ্ছে অর্ধসৌর বিন্দু এবং শীতলতম স্থান হল এর মেরুর নিকটে অবস্থিত খাদসমূহের নিম্ন বিন্দু।বুধ চারটি পার্থিব গ্রহের একটি অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মতো কঠিন পৃষ্ঠভূমি আছে। চারটি পার্থিব গ্রহের মধ্যে এর আকার সবচেয়ে ছোটো; বিষুবীয় অঞ্চলে এর ব্যাস ৪৮৭৯ কিলোমিটার। বুধের গাঠনিক উপাদানসমূহের মধ্যে ৭০% ধাতব এবং বাকি ৩০% সিলিকেট জাতীয়। এর ঘনত্ব সৌরজাগতিক বস্তসমূহের ঘনত্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৫.৪৩ গ্রাম/সেমি³; পৃথিবী থেকে সামান্য কম। মহাকর্ষীয় সংকোচনের প্রভাব সম্পূর্ণ উদ্ধার করতে পারলে বুধের গাঠনিক উপাদানসমূহের ঘনত্ব আরও বেশি হত।বুধের অভ্যন্তরীণ গঠন বোঝার ক্ষেত্রে এর ঘনত্ব ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর উচ্চ ঘনত্বের মূল কারণ হচ্ছে মহাকর্ষীয় সংকোচন যার পরিমাণ কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি। বুধ অনেক ছোটো এবং এর কেন্দ্র পৃথিবীর মতো অতটা দৃঢ় ও সংকুচিত নয়। তাহলে বুধের এত উচ্চ ঘনত্বের মূল কারণ হতে পারে, এর কেন্দ্র অনেক বড়ো এবং লৌহসমৃদ্ধ। আধুনিককালে ভূতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন যে বুধের সমগ্র আয়তনের ৪২% ই হচ্ছে এর কেন্দ্র। যেখানে পৃথিবীর কেন্দ্র মাত্র ১৭%।কেন্দ্রের চারপাশে ৬০০ কিমি অঞ্চল জুড়ে রয়েছে ম্যানটেল। ধারণা মতে বুধের ভূত্বকের পুরুত্ব ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে। এর পৃষ্ঠতলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে প্রচুর সরু ridge রয়েছে যার কয়েকটি প্রায় কয়েকশো কিলোমিটার পর্যন্ত প্রলম্বিত। আমাদের সৌর জগতের অন্যান্য বৃহৎ গ্রহগুলোর যে কোনটির তুলনায় বুধে লৌহের পরিমাণ বেশী। বুধ গ্রহের পৃষ্ঠতলের গড় তাপমাত্রা হচ্ছে ৪৫২ কেলভিন (৩৫৩.৯° ফারেনহাইট, ১৭৮.৯° সেলসিয়াস)। তবে এই মান স্থানভেদে ৯০ কেলভিন থেকে ৭০০ কেলভিনের মধ্যে উঠানামা করে। দেখা যাচ্ছে বুধ পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৬১০ কেলভিন পর্যন্ত উঠানামা করে যেখানে পৃথিবীতে পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৮০ কে পর্যন্ত উঠানামা করতে পারে। এর মূল কারণ বুধের কোন বায়ুমণ্ডল নেই। পৃথিবীর তুলনায় বুধ পৃষ্ঠে সূর্য রশ্মির তীব্রতা ৬.৫ গুণ বেশী। তবে এই সমানুপাতিক সম্পর্কের মধ্যে একটি সৌর ধ্রুবক রয়েছে যার মান ৯.১৩ কিলোওয়াট/বর্গমি.।যদিও বুধ দীর্ঘ ১৭৬ দিনে একবার নিজ অক্ষে আবর্তন করে তথাপি এর একটি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী এবং আপাতভাবে আঞ্চলিক চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। এটি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের ০.১%। বুধের চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তির কারণ পৃথিবীর মতো হতে পারে। বুধ গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র এর চারপাশের সকল সৌরবায়ুকে বিক্ষিপ্ত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে এই চৌম্বক ক্ষেত্র গ্রহটির চারপাশে চুম্বক গোলক নামক একটি আস্তরণের সৃষ্টি করেছে, সৌরবায়ু যাকে অতিক্রম করতে পারে না। চাঁদের সঙ্গে বুধের মূল পার্থক্য এখানেই। চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্র বেশ দুর্বল হওয়ায় কোনো চুম্বক গোলক নেই, যার ফলে সৌরবায়ু চন্দ্রপৃষ্ঠে চলে আসে অতি সহজেই।এহেন বুধকে বশে রাখার জন্য পান্না (রত্ন Emerald) বা ওনেক্স (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা বৃহদ্বারক (মূল) বা ত্রিপুরেশ্বরী (কবচ) বা ৪ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।
বৃহস্পতি (Jupiter) : বৃহস্পতি গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে পঞ্চম এবং আকার আয়তনের দিক দিয়ে সৌরজগতের বৃহত্তম। বৃহস্পতি ব্যতিত সৌরজগতের বাকি সবগুলি গ্রহের ভরকে একত্র করলেও বৃহস্পতির ভর তা থেকে আড়াই গুণ বেশি হবে। বৃহস্পতিসহ আরও তিনটি গ্রহ অর্থাৎ শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনকে একসঙ্গে ‘গ্যাসদানব’ বলা হয়। পৃথিবী থেকে দেখলে বৃহস্পতির আপাত মান পাওয়া যায় ২.৮। এটি পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান তৃতীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। কেবল চাঁদ এবং শুক্র গ্রহের উজ্জ্বলতা এর থেকে বেশি। অবশ্য কক্ষপথের কিছু বিন্দুতে মঙ্গল গ্রহের উজ্জ্বলতা বৃহস্পতির চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই গ্রহটি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষীদের কাছে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রচুর পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসও আবর্তিত হয়েছে বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে। রোমানরা গ্রহটির নাম রেখেছিল পৌরাণিক চরিত্র জুপিটারের নামে। জুপিটার রোমান পুরাণের প্রধান দেবতা। এই নামটি প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয় ভোকেটিভ কাঠামো থেকে এসেছে যার অর্থ ছিল আকাশের পিতা। গ্রহটিকে ঘিরে এবটি দুর্বল গ্রহীয় বলয় এবং শক্তিশালী ম্যাগনেটোস্ফিয়ার রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কমপক্ষে ৬৩টি উপগ্রহ যাদের মধ্যে চারটি উপগ্রহ বৃহৎ আকৃতির। এই চারটিকে গ্যালিলীয় উপগ্রহ বলা হয়।বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের উর্দ্ধাংশের গাঠনিক উপাদানের মধ্যে  পরমাণু সংখ্যার দিক দিয়ে ৯৩% হাইড্রোজেন ও ৭% হিলিয়াম আছে। আর গ্যাস অণুসমূহের ভগ্নাংশের দিক দিয়ে ৮৬% হাইড্রোজেন এবং ১৩% হিলিয়াম। হিলিয়াম পরমাণুর ভর যেহেতু হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চারগুণ সেহেতু বিভিন্ন পরমাণুর ভরের অনুপাত বিবেচনায় আনা হলে শতকরা পরিমাণটি পরিবর্তিত হয়। সে হিসাবে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের গাঠনিক উপাদানের অনুপাতটি দাঁড়ায় ৭৫% হাইড্রোজেন, ২৪% হিলিয়াম এবং বাকি ১% অন্যান্য মৌল। অন্যদিকে অভ্যন্তরভাগ খানিকটা ঘন। এ অংশে রয়েছে ৭১% হাইড্রোজেন, ২৪% হিলিয়াম এবং ৫% অন্যান্য মৌল। বৃহষ্পতির ৬৩টি নামকরণকৃত উপগ্রহ রয়েছে -- (১) মেটিস (২) অ্যাডরাস্টে (৩) অ্যামালথে (৪) থিব (৫) আয়ো (৬) ইউরোপা (৭) গ্যানিমেড (৮) ক্যালিস্টো (৯) থেমিস্টো (১০) লেডা (১১) হিমালিয়া (১২) লিসিথে (১৩) এলারা (১৪) এস/২০০০ জে ১১ (১৫) কার্পো (১৬) এস/২০০৩ জে ১২ (১৭) ইউপোরি (১৮) এস/২০০৩ জে ৩ (১৯) এস/২০০৩ জে ১৮ (২০) থেলজিনো (২১) ইউয়ান্থে (২২) হেলিকে (২৩) ওর্থোসাই (২৪) লোকাস্টে (২৫)  এস/২০০৩ জে ১৬ (২৬) প্র্যাক্সিডাইক (২৭) হার্পালাইক (২৮) মিরিনেমে (২৯) হারমিপ্পে (৩০) থাইয়োনি (৩১) আনাকে (৩২) হার্সে (৩৩) অ্যাল্টনে (৩৪) কেল (৩৫) টাইগেটে (৩৬) এস/২০০৩ জে ১৯ (৩৭) চালডেনে (৩৮) এস/২০০৩ জে ১৫ (৩৯) এস/২০০৩ জে ১০ (৪০) এস/২০০৩ জে ২৩ (৪১) এরিনোমে (৪২) এওয়েডে (৪৩) ক্যালিচোরে (৪৪) ক্যালাইক (৪৫) কারমে বা কার্মে (৪৬) ক্যালিরহো (৪৭) ইউরিডোম (৪৮) প্যাসিথি (৪৯) কোর (৫০) সাইলিন (৫১) ইউকেল্যাড (৫২) এস/২০০৩ জে ১৪ (৫৩) প্যাসিফ্যাই (৫৪) হেজেমোনি (৫৫) আর্কে (৫৬) আইসোনো (৫৭) এস/২০০৩ জে ৯ (৫৮) এস/২০০৩ জে ৫ (৫৯) সিনোপে (৬০) স্পোন্ডে  (৬১) অটোনো (৬২) মেগাক্লাইট (৬৩) এস/২০০৩ জে ২ ।বৃহস্পতিকে বশে রাখার জন্য পীত পোখরাজ (রত্ন Topaj বা Sapphire) বা ইয়োলো টোপাজ (উপরত্ন) সোনা (ধাতু) বা ব্রহ্মষষ্ঠী (মূল) বা তারা (কবজ) ৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।
শুক্র (Venus) : শুক্র গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে সৌরজগতের দ্বিতীয়। এই পার্থিব গ্রহটিকে অনেক সময় পৃথিবীর ‘জমজ বোন গ্রহ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, কারণ পৃথিবী এবং শুক্রের মধ্যে গাঠনিক উপাদান এবং আচার-আচরণে বড়ো রকমের মিল আছে। বাংলায় সকালের আকাশে একে ‘শুকতারা’ এবং সন্ধ্যার আকাশে একে ‘সন্ধ্যাতারা’ বলে ডাকা হয়ে থাকে। শক্রের কোনো উপগ্রহ শুক্রগ্রহে বিশাল পাহাড়, সমতলভূমি ও অনেক আগ্নেয়গিরি আছে। গ্রহটির অন্তঃসংযোগের সময় শুক্র অন্য যে-কোনো গ্রহের তুলনায় পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে, তখন এ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হয় চাঁদ থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের প্রায় ১০০ গুণ। ১৮০০ সালের পর থেকে শুক্র গ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে পৌঁছেছিল ১৮৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। কখন তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল ০.২৬৪১৩৮৫৪ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক = ৩৯,৫৪১,৮২৭ কিলোমিটার। ২১০১ সালের ডিসেম্বর ১৬ তারিখের পূর্ব পর্যন্ত এটিই হবে শুক্র থেকে পৃথিবীর সর্বনিম্ন দূরত্ব। উক্ত তারিখে গ্রহদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব দাঁড়াবে ০.২৬৪৩১৭৩৬ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক = ৩৯,৫৪১,৫৭৮ কিলোমিটার।শুক্রকে বশে রাখার জন্য হিরা (রত্ন Daimond) বা হোয়াইট জারকন (উপরত্ন) রূপো (ধাতু) বা রামবাসক (মূল) বা ভুবনেশ্বরী (কবচ) ৬ মুখী/১৩ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।
শনি (Saturn) : শনি সৌরজগতের ষষ্ঠতম গ্রহ। এটি সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ। সূর্যের দিক থেকে এর অবস্থান ষষ্ঠ। হিন্দু পৌরাণিক দেবতা শনির নামানুসারে এই গ্রহের নামকরণ করা হয়েছে। রোমান দেবতা Saturn নামানুসারে ইংরেজি নামটি গ্রহণ করা হয়েছে। নিরক্ষীয় এলাকায় এর ব্যাস ১২০৮০ কিলোমিটার। সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব ১৪৭,২০,০০,০০০ কিলোমিটার। মেরু অঞ্চলের ব্যাস ১০৯০০০। এর ঘনত্ব জলের ০.৬৮ গুণ। সূর্যপ্রদক্ষিণকাল ২৯.৪৬ পার্থিব বৎসর। এটি নিজ অক্ষের উপর একবার আবর্তিত হতে সময় নেয় ১০ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। এই গ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে পাথুরে উপকরণ। মধ্য ও উপরিভাগের অধিকাংশই হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। এর সঙ্গে আছে জল, মিথেন এবং অ্যামোনিয়া। আর এই গ্রহকে ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত বলয়। শনির উপরিভাগের ৭০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত মেঘরাশির উপর থেকে এই বলয়ের শুরু এবং তা প্রায় ৭৪০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বলয়রাশির ভিতর বিভিন্ন পরিমাপের ফাঁকা জায়গা আছে। এই ফাঁকা স্থানের বিচারে এর বলয়গুলিকে কয়েকটি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ভাগগুলি হলো- ডি, সি, বি, এ, এফ , জি, ই। এর সবচেয়ে বড় ফাঁকা স্থানের নাম ক্যাসিনি বিভাজন, এর বিস্তৃতির পরিমাণ প্রায় ১২০,৬০০ কিলোমিটার। পক্ষান্তরে এ এবং বি বলয়ের মধ্যকার দূরত্ব প্রায় ৪৮০০ কিলোমিটার। বলয়টি এতটাই বিশাল যে, এর ভেতর একশ কোটি পৃথিবী ভরে রাখার মতো জায়গা আছে। বলয়টির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বরফ, ধুলাবালি ইত্যাদি ধরা পড়ে।মূলত শনি গ্রহের রয়েছে ১৫০ টিরও বেশি উপগ্রহ, কিন্তু এর মধ্যে নাম দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৩ টি উপগ্রহের  এবং আকার বিবেচনায় ১৮টি উপগ্রহকে মূল উপগ্রহ ধরা হয় ।(১) প্যান, (২) ড্যাফনিস, (৩) অ্যাটলাস, (৪) প্রমিথিউস, (৫) প্যান্ডোরা বা প্যানডোরা, (৬) এপিমেথিউস, (৭) জ্যানাস, (৮) এগিয়ন, (৯) মাইমাস, (১০) মেথোনে, (১১) এন্থে, (১২) প্যালেন, (১৩) এনসেলাডাস, (১৪) টেথিস, (১৫) টেলেস্টো, (১৬) ক্যালিপ্সো, (১৭) ডাইয়োনে, (১৮) হেলেন, (১৯) পলিডিউসেস, (২০) রিয়া, (২১) টাইটান, (২২) হাইপেরিয়ন, (২৩) আইয়াপেটাস, (২৪) কিভিউক, (২৫) ইজিরাক, (২৬) ফোবে, (২৭) পালিয়াক, (২৮) স্কাথি, (২৯) অ্যালবাইয়োরিক্স, (৩০) এস/২০০৭ এস ২, (৩১) বেভিওন, (৩২) এরিয়াপাস, (৩৩) স্কল, (৩৪) সিয়ারনাক, (৩৫) তার্কেক, (৩৬) এস/২০০৪ এস ১৩, (৩৭) গ্রেয়িপ, (৩৮) হাইরোক্কিন, (৩৯) জার্ন্সাক্সা, (৪০) তারভোস, (৪১) মানডিলফারি, (৪২) এস/২০০৬ এস ১, (৪৩) এস/২০০৪ এস ১৭, (৪৪) বার্গেলমির, (৪৫) নার্ভি, (৪৬) এস/২০০৪ এস ১২, (৪৭) ফারবাউটি, (৪৮) থ্রাইম্র, (৪৯) এজির, (৫০) এস/২০০৭ এস ৩, (৫১) বেস্টলা, (৫২) এস/২০০৪ এস ৭, (৫৩) এস/২০০৬ এস ৩, (৫৪) ফেনরির, (৫৫) সুরতুর, (৫৬) কারি, (৫৭) ইমির, (৫৮) লোগে, (৫৯) ফোর্নজোট।সাধারণ মানুষ শনিগ্রহকে খুব ভয় করে। ভয় করার কারণ পুরাণে ভয়ংকর ভয়ংকর সব শনিকে ঘিরে কাহিনি। শনিকে বশে রাখার জন্য নীলা (রত্ন Blue Supphire) বা এমিথিস্ট (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা শ্বেতবেড়েলা (মূল) বা দক্ষিণাকালী (কবচ) বা ৭ মুখী/১৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।
রাহু (Rahu or Dragon's head) ও কেতু (Ketu or Dragon's tail) : জ্যোতিষীরা অবশ্য ‘রাহুর দশা’ ‘কেতুর দশা’ এসব বলে বটে ! তাতেই মানুষ থরহরি কম্প ! যদিও এখনও পর্যন্ত জ্যোতির্বিদরা রাহু ও কেতুর কোনো অস্তিত্বের কথা বলেননি।তবে এই রাহু-কেতু ব্যাপারটা কী ? আমরা জানি যেমন পৃথিবীর কক্ষতলকে বলা হয় পৃথিবীর কক্ষতল, তেমনই চাঁদের কক্ষপথের তলকে বলা হয় চাঁদের কক্ষতল। এই দুই কক্ষতল পরস্পরের সঙ্গে ৫ ডিগ্রি কোণ করে আছে।যার কারণে চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষতলকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে।এই বিন্দু দুটিকে বলে রাহু ও কেতু, জ্যোতিষীরা একে গ্রহ হিসাবে কল্পনা করেন কেন কে জানে ! হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে রাহু জনৈক দানববিশেষ। বলা হয়েছে দানব বিপ্রচিত্তির ঔরসে ও সিংহিকার গর্ভে এঁর জন্ম হয়উল্লেখ্য, সমুদ্রমন্থন শেষে উত্থিত অমৃত অসুরদের বঞ্চিত করে দেবতারা পান  করেছিলইনি কৌশলে গোপনে অমৃতপান করতে থাকলে চন্দ্র ও সূর্য এঁকে চিনতে পেরে অন্যান্য দেবতাদের জানানএই সময় বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের রাহুর মাথা কেটে দেন। কিছুটা অমৃত পান করায় এই দানব ছিন্নমস্তক হয়ে অমরত্ব লাভ করেনএঁর মস্তকভাগ ‘রাহু’ (Head) ও দেহভাগ ‘কেতু’ (Tail) নামে পরিচিতসেই থেকে রাহু এবং চন্দ্র ও সূর্যের সঙ্গে চিরশত্রুতা শুরু হয়। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই রাহু চন্দ্র ও সূর্যকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হয়। কিছুটা গ্রাস করতে সক্ষম হলেও তার কর্তিত দেহ থেকে চাঁদ বা সূর্য বেরিয়ে আসে। রাহুর এই গ্রাসকালীন সময়ে গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ রাহু যখন সূর্যকে গ্রাস করে তখন সূর্যগ্রহণ হয়। অন্যদিকে রাহু যখন চন্দ্রকে গ্রাস করে তখন চন্দ্রগ্রহণ হয়। জ্যোতিষীরা এই মতই বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করান। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন সৌরজগতে সূর্যকে ঘিরে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী, আবার পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে চন্দ্র। চন্দ্র এবং পৃথিবীর এই আবর্তন চলার সময় কখনো-কখনো পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের মাঝখানে একই সরল রেখায় অবস্থান নেয়। এই সময় পৃথিবীর মানুষেরা চন্দ্রের আলো দেখতে পায় না। অর্থাৎ, পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদ ঢাকা পড়ে যায়। পৃথিবী চাঁদের চেয়ে বড়ো হওয়ায় পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রপৃষ্ঠকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। এই কারণে চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়। যেখানে সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর খুব অল্প জায়গা থেকেই দেখা যায়, সেখানে চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর সর্বত্র থেকেই দেখা যায়। রাহু গোমেদ (রত্ন Gomed) বা গোয়া গোমেদ (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা শ্বেতচন্দন (মূল) বা ছিন্নমস্তা (কবচ) বা ৮ মুখী/১৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) এবং কেতুকে বৈদুর্যমণি (Cats eye) বা সিসা/রূপো (ধাতু) বা অশ্বগন্ধা (মূল) বা ধুমাবতী (কবচ) বা ৯ মুখী/১৬ মুখী (রুদ্রাক্ষ) বশে রাখার জন্য জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।
জ্যোতিষীগণ মনে করেন এইসব গ্রহদের রশ্মিও আছে। তবে এই রশ্মি নাকি দেখা যায় না। দেখা যায় না, কিন্তু আছে – আধ্যাত্মিক বা Spiritual রশ্মি বলে কথা ! দেখা যায় না বটে, কিন্তু জ্যোতিষীরা সেই রশ্মি আবার গুণেও ফেলেছেন। যেমন – রবির ২০টি রশ্মি, মেষের ৮টি, মঙ্গলের ১০টি, বুধের ১০টি, বৃহস্পতির ১২টি, শুক্রের ১৪টি, শনির ১৬টি ইত্যাদি। এমন রশ্মির কথা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন না। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন আলফা, বিটা, গামা, কসমিক ইত্যাদি মহাজাগতিক রশ্মির কথা। আরও আছে জ্যোতিষীদের ব্যাপার-স্যাপার। যেমন গ্রহদের স্বক্ষেত্র বা বাসস্থান বা জন্মভূমিও আছে। যেমন ধরুন – (১) সূর্য বা রবির স্বক্ষেত্র কলিঙ্গ (বর্তমানে ওডিশা), (২) চন্দ্রের যবন দেশ (গ্রিস ?), (৩) মঙ্গলের অবন্তী, (৪) বুধের মগধ (পাটনা ও গয়া), (৫) বৃহস্পতির সিন্ধুদেশে, (৬) শুক্রের ভোজকটকে, (৭) শনির সৌরাষ্ট্রে (বর্তমানে গুজরাট), (৮) রাহুর অম্বর অথবা সিংহল (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) এবং (৯) কেতুর (না, জন্মভূমির খোঁজ পাওয়া যায়নি)।মহাকাশের বেশির ভাগ গ্রহদের জন্মস্থান ভারতেই ? মহাকাশের বাকি অংশে শূন্য কেন ?
জ্যোতিষীয় ব্যাবসার ক্ষেত্রে মূল যে চারটি বিষয় জ্যোতিষীরা মাথায় রাখেন, সেগুলি হল – (১) গ্রহ, (২) নক্ষত্র, (৩) গণ (৪) রাশি এবং (৫) লগ্ন। একটু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব এগুলি কী বস্তু ।জ্যোতিষীদের জন্য খুবই প্রয়োজন জন্মরাশি, জন্মলগ্ন, জন্মনক্ষত্র। এতেই জাকতের আমৃত্যু হালহকিকৎ বলে দেওয়া সম্ভব -- এটা জ্যোতিষীদের দাবি এবং মানুষের প্রশ্নহীন বিশ্বাস।জন্মরাশি, জন্মলগ্ন, জন্মনক্ষত্র – এগুলি কী ? নবজাতকের জন্মক্ষণে চন্দ্র যে রাশিতে থাকে তাকে জন্মরাশি বলে। নবজাতকের জন্মক্ষণে পূর্ব আকাশে যে রাশি দেখা যায় তাকে জন্মলগ্ন বলে। নবজাতকের জন্মক্ষণে চন্দ্রের সবচেয়ে কাছাকাছি উজ্জ্বলতম নক্ষত্রকে জন্মনক্ষত্র বলে।
আগেই উল্লেখ করেছি জ্যোতিষীদের গ্রহের কথা। রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র। শনি, রাহুও গ্রহ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। আবার ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো মায় পৃথিবী গ্রহ নয়। রইল এখন নক্ষত্র -- যে বারটি রাশির কথা আগে বলা হয়েছে, সেগুলি বেষ্টন করে ২৭ টি নক্ষত্র রয়েছে। ৩৬০ ডিগ্রিতে যদি ২৭ টি নক্ষত্র থাকে তবে এক-একটি নক্ষত্রের ব্যপ্তি ১৩ ডিগ্রি ২০ মিনিট করে অর্থাৎ মেষরাশির শুরু থেকে ১৩ ডিগ্রি ২০ মিনিট অন্তর পর পর একটি করে নক্ষত্র রয়েছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে নক্ষত্র হল চন্দ্রপথের ২৭টি ভাগের প্রতিটির নাম। নক্ষত্রগুলির নাম ও সংখ্যা হল -  (১) অশ্বিনী,  (২) ভরণী,  (৩) কৃত্তিকা,  (৪) রোহিণী,  (৫) মৃগশিরা,  (৬) আর্দ্রা,  (৭) পুনর্বসু,  (৮) পুষ্যা,  (৯) অশ্লেষা,  (১০) মঘা,  (১১) পূর্বফাল্গুনী,  (১২) উত্তরফাল্গুনী,  (১৩) হস্তা, (১৪) চিত্রা,  (১৫) স্বাতী,  (১৬) বিশাখা,  (১৭) অনুরাধা,  (১৮) জ্যেষ্ঠা,  (১৯) মূলা,  (২০) পূর্বাষাঢ়া,  (২১) উত্তরাষাঢ়া,  (২২) শ্রবণা, (২৩) ধনিষ্ঠা,   (২৪) শতভিষা, (২৫) পূর্ব্বভাদ্রপদ, (২৬) উত্তরভাদ্রপদ এবং (২৭) রেবতী। এই ২৭টি নক্ষত্রের প্রত্যেকটির একটি করে অধিপতি গ্রহ আছে। এই গ্রহগুলির ক্রম হল - কেতু, শুক্র, রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, রাহু, বৃহস্পতি, শনি ও বুধ। অর্থাৎ অশ্বিনীর অধিপতি গ্রহ কেতু, ভরণী নক্ষত্রের অধিপতি গ্রহ শুক্র, কৃত্তিকার অধিপতি গ্রহ রবি ইত্যাদি।
বিয়ের ব্যাপারে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। পাত্র বা পাত্রীর কী গণ। বস্তুত এই গণ তিন রকমের হয় – (১) দেবগণ, (২) নরগণ, (৩) দেবারিগণ বা রাক্ষসগণ। কী গণ সেটা নির্ভর করবে পাত্র বা পাত্রীর কোষ্ঠীতে চন্দ্র কোন্ নক্ষত্রে আছে তার উপরে। চন্দ্র যে যে নক্ষত্রে থাকলে ঐ তিন গণ হয় সেটা নীচে দেওয়া হল। (১) দেবগণ : অশ্বিনী, মৃগশিরা, পুনর্বসু, পুষ্যা, হস্তা, স্বাতী, অনুরাধা, শ্রবণা ও রেবতী। (২) নরগণ : ভরণী, রোহিণী, আর্দ্রা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তরফাল্গুনী, পূর্ব্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, পূর্বভাদ্রপদ ও উত্তরভাদ্রপদ। (৩) রাক্ষসগণ : কৃত্তিকা, অশ্লেষা, মঘা, চিত্রা, বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, ধনিষ্ঠা ও শতভিষা।
সূর্যের গতিপথকে যেমন ১২ ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগের নাম রাখা হয়েছে রাশি, তেমনই চন্দ্রপথকে ২৭ ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগের নাম রাখা হয়েছে নক্ষত্র। বিভিন্ন দেশে এই চন্দ্রনিবাসসমূহের নাম বিভিন্ন। যেমন গ্রিসে এই ধরনের কোনো চন্দ্রনিবাসের কল্পনাও করা হয়নি। সাধারণত দেখা যায় ২.২৫ নক্ষত্রে এক রাশি হয়। আগেই বলা হয়েছে যে ১২টি রাশি ২৪ ঘণ্টায় ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আসছে। অর্থাৎ একটি রাশি সরে গিয়ে পরের রশিটি উদয় হতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা। এই রাশিগুলি মেষ থেকে শুরু হয় এবং এক-একটি রাশির ব্যাপ্তি ৩০ ডিগ্রি করে। সাধারণত পূর্ব ভারতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে এই রাশিগুলিকে সাজানো হয় মেষ থেকে শুরু করে বামাবর্তে (anti-clockwise) পরপর এগিয়ে যেতে হবে। রাশিগুলি হল -- মেষ (Aries), বৃষ (Taurus), মিথুন (Gemini), কর্কট (Cancer), সিংহ (Leo), কন্যা (Virgo), তুলা (Libra), বৃশ্চিক (Scorpio), ধনু (Sagittarius), মকর (Capricorn), কুম্ভ (Aquarius) মীন (Pisces) এই রাশিগুলির প্রত্যেকটির একটি করে অধিপতি গ্রহ বা lord আছে। যেমন -- মেষ ও বৃশ্চিকের অধিপতি মঙ্গল, বৃষ ও তুলার অধিপতি শুক্র, মিথুন ও কন্যার অধিপতি বুধ, কর্কটের অধিপতি চন্দ্র, সিংহের অধিপতি রবি, ধনু ও মীনের অধিপতি বৃহস্পতি এবং মকর ও কুম্ভের অধিপতি শনি। যেটা দাঁড়াল তা হল মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি - এদের প্রত্যেকটির দুটি রাশির উপর আধিপত্য আছে। কিন্তু চন্দ্র ও রবি কেবল একটি করে রাশিরই অধিপতি।রাহু ও কেতু কোনো রাশির অধিপতি নয়। তবে তাদের বলাবল নির্ণয়ের জন্য কয়েকটি রাশিকে তাদের স্বক্ষেত্র, মূলত্রিকোণ ও তুঙ্গস্থান হিসাবে ধরা হয়।আকৃতি ও গুণ অনুযায়ী রাশিগুলিকে অগ্নি, পৃথ্বী, বায়ু, জল এই চারভাগে ভাগ করা হয়। আবার চর, স্থির ও দ্যাত্মক এই তিন ভাগেও ভাগ করা হয়। মেষ থেকে শুরু করে রাশিগুলিকে অগ্নি, পৃথ্বী, বায়ু, জল অথবা চর, স্থির, দ্যাত্মক হিসাবে পর পর ভাগ করে যেতে হবে। অর্থাৎ মেষ, সিংহ, ধনু হল অগ্নি রাশি ( Fiery Signs ) ; বৃষ, কন্যা, মকর পৃথ্বী রাশি ( Earthly Signs ); মিথুন, তুলা, কুম্ভ বায়ু রাশি (Airy Signs) এবং কর্কট, বৃশ্চিক মীন জল রাশি ( Watery Signs ) অন্য রকম বিভাগে, মেষ, কর্কট, তুলা, মকর চর রাশি (Movable Signs ); বৃষ, সিংহ, বৃশ্চিক, কুম্ভ স্থির রাশি ( Fixed Signs ) এবং মিথুন, কন্যা, ধনু মীন দ্যাত্মক রাশি ( Common Signs) ফলাফল বিচারে জ্যোতিষীরা রাশিগুলির এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে অনেক সময় কাজে লাগায়। রাশিগুলির অন্য একটি শ্রেণীবিভাগ হল পুরুষ রাশি (Masculine Signs ) স্ত্রী রাশি ( Feminine Signs ) বিজোড় সংখ্যার যে রাশিগুলি অর্থাৎ মেষ, মিথুন, সিংহ, তুলা, ধনু, কুম্ভ -- এই ছয়টি পুরুষ রাশি এবং বৃষ, কর্কট, কন্যা, বৃশ্চিক, মকর ও মীন – এই ছয়টি স্ত্রী রাশি।
জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী একজন জাতকের রাশি নির্নয় করা হয় তার জন্মমূহুর্তে সূর্য যে রাশিতে অবস্থান করে । তাদের মতে এই রাশি অনুযায়ী নাকি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। তাহলে ভুলটা কোথায় ! দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকায় রাশিফল বিভাগে প্রথম যে রাশিটি আমরা দেখি সেটি হল মেষ রাশি (২১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল সময়ে জন্মগ্রহণকারীরা এই রাশির জাতক)। বর্তমান শতকে তথা এই সময়ে সূর্য মেষ রাশিতে নয়, মীন রাশিতে অবস্থান করে। এই গোলমাল অবশ্যই অন্য রাশির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই গোলমালের মূল কারণ হল পৃথিবীর ‘অয়নচলন’।বিষুববৃত্ত ও ক্রান্তিবৃত্ত ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে পৃথক এবং এই বৃত্ত দুটি পরস্পরকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে।এই বিন্দু দুটিকে বলা হয় মহাবিষুব এবং জলবিষুব বিন্দু ।আরও সহজ করে যদি বলি, তা হল  ‘খ’ গোলকে এই দুটি বিন্দু হচ্ছে বছরে দু-দিন বিষুববৃত্তের উপর সূর্যের অবস্থান।এই দুই দিন হল ২১ মার্চ (দিন ও রাত্রি সমান) এবং ২৩ সেপ্টেম্বর ।মহাবিষুব বিন্দুকে ক্রান্তিবৃত্তের শূন্য ডিগ্রি বিন্দু বা প্রারম্ভ বিন্দু ধরা হয়।এই কারণেই ২০০০ বছর আগে ২১ মার্চ এই মহাবিষুব বিন্দু হতে পরবর্তী ৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করত বলেই মেষ রাশিকে রাশিচক্রের প্রথম রাশি ধরা হয়।গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রতিবছর এই বিষুব বিন্দুদ্বয় তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে। প্রতি ৭২ বছরে এই বিন্দু দুটির ১ ডিগ্রি করে অগ্রগমন ঘটে এবং বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসতে তাদের লাগবে ঠিক ২৬ হাজার বছর। বিষুব বিন্দুদ্বয়ের এই চলনকেই বলে ‘অয়নচলন’ কেন এমনটি ঘটে ? এর কারণ হল পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের স্বল্প গতির ঘূর্ণন।পৃথিবী যেমন নিজ অক্ষে ঘুরে চলছে, তেমনই এর ঘূর্ণন অক্ষটিও নিজ অবস্থান থেকে নিয়মমতোই সরে যাচ্ছে। এই ঘূর্ণন অক্ষটি প্রতি ২৬ হাজার বছরে একবার পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করে।পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের এই সরণের ফলে ক্রান্তিবৃত্তেরও সরণ ঘটছে এবং এর ফলেই বিষুব বিন্দুদ্বয়ের ‘অয়নচলন’ ঘটছে।ঘূর্ণন অক্ষের সরণের ফলে কিছু চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটে ।যেমন উত্তর আকাশে বর্তমানে যে স্থানে ধ্রুবতারা দেখি ১৩ হাজার বছর পর সেখানে বীণা মণ্ডলের অভিজিৎ নক্ষত্রটিকে দেখা যাবে এবং এরও ১৩ হাজার বছর পর সেখানে পুনরায় ধ্রুবতারাকে দেখা যাবে । তাহলে এখন প্রশ্ন হল অয়নচলনের সঙ্গে রাশিচক্রের রাশির অবস্থান পরিবর্তনের সম্পর্কটা কী ? আজ থেকে ২০০০ বছর আগের কোনো একসময় রাশিচক্র তৈরি হয় তখন সূর্য ২১ মার্চ তারিখে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করত, যা টলেমির ‘টেট্রাবিবলস’ থেকে জানা যায়।টলেমে তাঁর ‘টেট্রাবিবলস’-এ বলেছেন “সূর্য তখন ২১ মার্চ তারিখে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং ২২ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করত”।কিন্তু আজ ২০০০ বছর পর মহাবিষুব বিন্দুর প্রায় ২৭ ডিগ্রি সরণের ফলে সূর্য এখন ২১ মার্চ মীন রাশিতে (নক্ষত্রমণ্ডল) প্রবেশ করে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে এবং ১৪ এপ্রিলে গিয়ে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে । রাশিচক্রের অন্যান্য রাশির ক্ষেত্রে একই অবস্থা এবং রাশিগুলিতে সূর্যের অবস্থানের সময় কালেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন সূর্য কন্যা রাশিতে অবস্থান করে ৪৪ দিন, আবার বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে মাত্র ৭ দিন । জ্যোতিষ মতে জন্মমুহুর্তে সূর্যের অবস্থানই মানুষের রাশি নির্ণয় করে। এই শাস্ত্র (?) মতে ১ আগস্ট জন্মগ্রহণকারী হবে সিংহ রাশির, তবে বর্তমানে এইদিন সূর্য অবস্থান করে কর্কট রাশিতে।জ্যোতিষের সব্বোনাশ এখান থেকেই, অর্থাৎ একই ব্যক্তি একই সঙ্গে আলাদা-আলাদাভাবে দু-ধরনের ভাগ্যর অধিকারী হবেন।  এমনকি কারও জন্ম যদি ২৯ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে হয়, তাহলে তার জন্য বর্তমানে রাশিচক্রের কোনো রাশিই বরাদ্দ নেই। কারণ এইসময় সূর্য সর্পধারী নক্ষত্রমণ্ডলে (Ophiucus) অবস্থান করে। তাই কারও সঙ্গে যদি পত্রিকার রাশিফল বা কোনো জ্যোতিষীর ভবিষৎবাণী কাকতালীয় ভাবে মিলেও যায়, তাহলে তৃপ্তির পাওয়ার কিছু নেই, কারণ আপনি নিজেকে যে রাশির জানেন আদতে আপনি মোটেও সেই রাশির নন।
জ্যোতিষীদের ভাগ্যগননার আর-একটি বড়ো উপাদান হল গ্রহ ও তাদের অবস্থান ।জ্যোতিষ মতে গ্রহ-নক্ষত্রদের সময় ভেদে অবস্থানের উপরেই নাকি অর্থপ্রাপ্তি, ব্যাবসার লাভ-ক্ষতি, মামলা-মোকদ্দমায় হারা-জেতা, সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনা, স্বামীর পরস্ত্রীতে অনাসক্ত হওয়া, বিদেশ গমন, দুরারোগ্য অসুখ নিরাময়, প্রেমে জয়ী হওয়া, না-হওয়া বিয়ে হওয়া, পরীক্ষায় পাশ/ফেল ছাড়াও ইহ জাগতিক সকল কর্মই নির্ভর করে।তাহলে এখন খালি চোখে তাদের দাবিগুলির আসড়তাটা স্পষ্ট হয়।এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রহের সংখ্যা হাজারেরও উপরে। আর সেখানে জ্যোতিষীদের গণনায় আছে শুধুমাত্র প্রাচীন পৃথিবীর আবিষ্কৃত সেই ৫টি গ্রহ।আর ইউরেনাস ও নেপচুনকে তাদের এই গণনায় খুঁজে পাওয়া না গেলেও রাহু কেতু নামে দুটি কাল্পনিক গ্রহকে তাদের গণনায় পাওয়া যায়,  সে তো আগেই বলেছি ।মহাবিশ্বের এত গ্রহের মাঝে জ্যোতিষীরা গ্রহ স্বল্পতায় পরে সূর্যকে একটি গ্রহ হিসেবেই বিবেচনা করে! বাস্তবিক অর্থে গ্রহনক্ষত্রগুলির কোনো শক্তি বা বলের এমন কোনো প্রভাবই নেই, যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।আর পৃথিবীর উপর যদি কোনো বলের প্রভাব থেকে থাকে, তা হল মহাকর্ষীয় বল।তবে গ্রহনক্ষত্রগুলি পৃথিবী থেকে এত দূরে যে তারা পৃথিবীর উপর মহাকর্ষীয় বা অভিকর্ষজনিত যে বল বা শক্তি প্রয়োগ করে তার পরিমাণ অতি নগণ্য ।তাই কারও জন্মমুহূর্তে গ্রহনক্ষত্রের আকর্ষণ বলের ক্রিয়া জন্মগ্রহণকারীর ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছে এমনটি ভাবার কোনো যুক্তি নেই। প্রাচীনকালে মানুষ আকাশের বিভিন্ন অংশের এলোমেলো নক্ষত্রগুলির মাঝে তাদের ঘটমান জীবনের পরিচিত বিষয়ের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজ করত বলেই কোনো নক্ষত্রমণ্ডলকে মেষের মতো আবার কোনো নক্ষত্রমণ্ডলকে কন্যা ইত্যাদি রূপে কল্পনা করেছিল।তাই বর্তমান সময়ে নক্ষত্রমণ্ডলগুলির নাম ও কল্পিত চিত্রগুলি তাদের মতোই রয়ে গিয়েছে।অবশ্য অন্য কিছু খুঁজেও পেতে পারি ।
বাকি রইল লগ্ন। প্রতিটি লগ্নের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জ্যোতিষের বইগুলিতে অনেক বিস্তৃত ভাবে লেখা আছে। কোষ্ঠী বিচারের ক্ষেত্রে জ্যোতিষীরা লগ্ননির্ণয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন।জ্যোতিষীদের মতে বারোটি পরপর পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় এবং ক্রমাগত পশ্চিমগামী হয়ে অবশেষে পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়।আসলে পৃথিবীর আবর্তনের জন্যই এরকম মনে হয়। যেহেতু পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার আবর্তন সম্পূর্ণ করে। সেই কারণেই পূর্বদিকে এক-একটি রাশির স্থায়িত্বকাল ২ ঘণ্টা। সকাল ৬ টায় পূর্বদিকে যদি মেষ রাশি উদয় হয় তবে সেটি ৮ টা পর্যন্ত থাকবে, ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত পূর্বদিকে থাকবে বৃষরাশি, ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত পূর্বদিকে থাকবে মিথুন রাশি – এইভাবে দুই ঘণ্টা অন্তর একটি করে রাশি মিলবে, মোট ১২ রাশি। জ্যোতিষ মতে, বৈশাখ মাস থেকে শুরু করে চৈত্রমাস পর্যন্ত সূর্যোদয় মেষ থেকে শুরু করে মীন রাশিতে হবে। যেটি দাঁড়াল – বৈশাখ মাসে সূর্যোদয়ের সময় পূর্বদিকে থাকবে মেষ রাশি, জ্যৈষ্ঠ মাসে সূর্যোদয়ের সময় পূর্বদিকে বৃষ রাশি থাকবে ইত্যাদি।জাতকের জন্মের সময় যে রাশিটি থাকে, সেটিই হল জাতকের লগ্ন, জন্মলগ্ন।তবে এগুলি যে সবার ক্ষেত্রে নির্ভুল ভাবে মিলবে এমন কোনো কথা নয়। গ্রহের বল ও অবস্থান অনুযায়ী বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হতে পারে বলে জ্যোতিষীরা বলে থাকেন। তাই মিলতেও পারে, আবার নাও মিলতে পারে। কারণ কোনো জাতকের চেহারা বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধু লগ্ন কোন্ রাশিতে তার উপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন গ্রহের বল ও অবস্থানের উপর সেটা অনেকাংশেই নির্ভরশীল বলে জ্যোতিষীরা মনে করেন।বস্তুত এই নক্ষত্র, রাশি, মাসই হল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিষয়-আশয়। আর জ্যোতিষীরা এইসব গ্রহনক্ষত্র দিয়ে ছলনার কাজে লাগান, প্রতারণার কাজে লাগান, বুজরুকির কাজে লাগান। মানুষজনদের মাথা মোড়াতে সুবিধা হয়। বোঝাতে চায় – দেখো, আমরা কেমন বিজ্ঞানের উপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। প্রতারণার অভিযোগে সারদার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হলে জ্যোতিষীদের গ্রেফতার করা হবে না কেন ?(চলবে)

২টি মন্তব্য:

The Civil guy বলেছেন...

অনেক সুন্দর লিখেছেন দাদা

Unknown বলেছেন...

দারুন লেখা..... এই অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হোক. .