বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান (চতুর্থ/শেষ পর্ব)



গ্রহশান্তির জন্য জ্যোতিষবাবুরা রত্ন-পাথর ছাড়াও গাছের মূল বা শিকড় ও ধাতু বা মেটাল ব্যবহারের নিদান দেন। নাকের বদলে নরুন আর কী ! কী আছে শিকড়-বাকড়ে ? শরীরে শিকড়-বাকড় বাঁধলে দুষ্ট গ্রহরা পালিয়ে যায় ? শিকড়-বাকড়ের দোকানে লোকজন দেখি ভিড় করে থাকে, বিশেষ করে শনি-মঙ্গলবারে। মূল-বিক্রেতারা মূল-ক্রেতাদের একটা কার্যকরী আপ্ত্যবাক্য শুনিয়ে থাকে, তা হল – গাছ কথা বলে। গাছ তো কথা বলেই। কিন্তু জ্যোতিষবাবু, গাছকে কথা বলানোরক্ ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানে গাছদের কথা বলিয়ে গ্রহদের খেদাতে পারবেন না। ওটা চিকিৎসকদের কাজ, চিকিৎসকরাই পারেন। চিকিৎসকরাই পারেন চিকিৎসা পদ্ধতিতে। দেখুন কীভাবে পারে -- জ্যোতিষবাবুদের মতে সূর্য বা রবি গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে বিল্বমূল অর্থাৎ বেলের শিকড় হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন--(১) বেলের শিকড়ের ছাল ৩/৪ গ্রাম মাত্রায় গরম জলে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে ছেঁকে তার সঙ্গে একটু বার্লি বা খইয়ের মণ্ড ও অল্প চিনি মিশিয়ে খাওয়ালে শিশুদের বমি ও অতিসার বন্ধ হয়ে যায়। (২) বেলের মূলের ছালচূর্ণ ৬ থেকে ১২ মাত্রায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হৃদ্দৌর্বল্য দূর হয়। এছাড়া অনিদ্রা ও ঔদাসীন্যভাবও কেটে যায়।(৩) বিল্বমূলের ছাল ১২ থেকে ১৪ গ্রেনের সঙ্গে ৬ গ্রেন জিরে বেটে গাওয়া ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ধাতুতারল্যে বা শুক্রতারল্যে উপকার পাওয়া যায়।জ্যোতিষবাবুরা বলেন রবির প্রকোপে হৃদরোগ, শিরঃপীড়া হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে বিল্বমূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?

জ্যোতিষবাবুদের মতে চন্দ্র বা চাঁদ গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ক্ষীরিকা বা ক্ষীরা বা শশার মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন--(১) সৌন্দর্য পিপাসু নারী-পুরুষেরা শশা ত্বকের যত্নে ব্যবহার করতে পারেন। (২) পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখতে এবং শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে শশার বিকল্প নেই। (৩) জলশূন্যতা দূর করে সারাদিন কাজের ব্যস্ততার কারণে পর্যাপ্ত জল পান করা হয় না অনেকেরই। এই জল ঘাটতি দূর করতে শশার তুলনা হয় না। শশায় ৯০ ভাগ জল থাকায় শরীরের প্রয়োজনীয় জলের অভাব দূর করে শরীর সুস্থ রাখে। (৪) শশা আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বাইরে রোদে ঘুরা-ফেরা করার কারণে সূর্যের তাপে শরীরের চামড়ায় যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা থেকে শশা আমাদেরকে অনেকটাই স্বস্তি দিতে পারে। এজন্য শশা চাক চাক করে কেটে শরীরের রোদে পোড়া অংশে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।(৫) শশার ভিতরের জলীয় অংশ শরীরের অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দিতে সক্ষম। নিয়মিত শশা খেলে কিডনিতে পাথর হওয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়।(৬) সুস্থ থাকার জন্য আমাদের শরীরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন দরকার হয় তার অধিকাংশের অভাব পূরণ করে থাকে শশা। ভিটামিন এ, বি ও সি--যেগুলি শরীরে শক্তি উৎপাদন ও শরীরের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে, তার অধিকাংশই পূরণ করে থাকে শশা।(৭) শশায় রয়েছে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সলিকন। তাই শরীরে এসবের অভাবজনিত সমস্যার মূল সমাধান হলো শশা।(৮) শশায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জল এবং অত্যন্ত কম পরিমাণে ক্যালরি। তাই আমার যারা শরীরের ওজন কমানোর ব্যাপারে সচেতন তাদের জন্য শশা বা ক্ষীরিকার একটি প্রধান উপাদান। আয়ুর্বেদশাস্ত্র তন্নতন্ন করে তালাশ করেও শিকড় বা মূলের সন্ধান পেলাম না।জ্যোতিষবাবুরা বলেন চন্দ্রের প্রকোপে অতি আবেগপ্রবণতা, মানসিক অসুস্থতা, বাত, শ্লেষ্মা হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে ক্ষীরিকা মূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?

জ্যোতিষবাবুদের মতে মঙ্গল গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে অনন্তমূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন – (১) ৩ গ্রাম আন্দাজ অনন্তমূল জলে বেটে দুধের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে সেই দুধ দই পেতে পরের দিন সকালে খেতে হবে। অর্শে ভালো কাজ করে।(২) অনন্তমূল ৩ গ্রাম আন্দাজ জলে বেটে অল্প সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে সরবতের মতো দু-বেলা খেলে একজিমা ও হাঁপানি সেরে যায়।(৩) ৩ গ্রাম আন্দাজ অনন্তমূল বেটে সকালে ও বিকালে দুধ বা জল সহ খেলে অনিয়মিত ঋতুস্রাবে উপকার হয়। (৪) অনন্তমূল বেটে অল্প ঘি মিশিয়ে গায়ে মেখে কিছুক্ষণ বাদে স্নান করে নিলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়।(৫) অনন্তমূলের ক্বাথ সেবনে স্তনে দুধ বাড়ে। (৬) গোরুর দুধে অনন্তমূল বেটে খাওয়ালে পাথুরি রোগে যন্ত্রণার উপশম হয়। জ্যোতিষবাবুরা বলেন মঙ্গল প্রকোপে অর্শ, রক্তপাত, ফোঁড়া, হাম, বসন্ত হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র কিছু কিছু অসুখ সারবে বললেও সেগুলি নির্দিষ্টভাবে তৈরি করে সেবন করতে হবে, বাঁধতে বলেনি। তাহলে অনন্তমূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?
জ্যোতিষবাবুদের মতে রাহু গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে শ্বেতচন্দন মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন – (১) যাদের ঋতুস্রাবে দুর্গন্ধ, পুঁজ বা মজ্জাবৎ স্রাব হতে থাকে, সেক্ষেত্রে চন্দন ঘষা অথবা ওই কাঠের গুঁড়ো গরম জলে ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে নিয়ে দুধে মিশিয়ে খেতে হবে। (২) ঘামাচি নিশ্চিহ্ন করতে শ্বেতচন্দন ঘষার সঙ্গে হলুদবাটা ও অল্প একটু কর্পূর মিশিয়ে অথবা চন্দন ও দারুহরিদ্রা একসঙ্গে ঘষে মাখতে হবে।(৩) হিঞ্চে শাকের রসে শ্বেতচন্দন ঘষা মিশিয়ে খেতে দিলে গুটি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে এবং ভয়াবহতার উপশম হয়।
জ্যোতিষবাবুদের মতে কেতু গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে অশ্বগন্ধা মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন – (১) শ্বেতী রোগে অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ করে দেড় বা দুই গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে দু-বেলা দুধসহ খেতে হবে।(২) অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় নিয়ে গাওয়া ঘি এক চা-চামচ ও মধু আধ চা-চামচ মিশিয়ে সকালের একবার এবং বিকালে দিকে একবার একটু একটু করে চেটে খেলে ক্রনিক বঙ্কাইটিস সারে।
জ্যোতিষবাবুদের মতে বুধ গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে বৃহদ্বারক বা বিদ্যাধারক মূল, বৃহস্পতি গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ব্রহ্মষষ্ঠী মূল এবং  শুক্র গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে রামবাসক মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য রচিত ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ গ্রন্থে এই গাছটি সম্বন্ধে কিচ্ছু পাইনি।যা পাওয়া গেছে তাতে কোথাও বলা নেই মূলগুলি হাতে-পায়ে শনি/মঙ্গলবার বাঁধতে হবে। তা ছাড়া এই বিশেষ নিয়মে কিছু অসুখ-বিসুখ সারে বইকি, গ্রহ তুষ্ট হয় বলে কোথাও কিছু উল্লেখ নেই।নিমের ডাল বা শিকড় হাতে-পায়ে বাঁধলে যদি কারর তেতো স্বাদ অনুভূত হয় তাহলে মানবো শ্বেতচন্দনের মূল হাতে-পায়ে বাঁধলে রাহু তুষ্ট হবে।
জ্যোতিষবাবুরা ধাতু বা মেটাল ব্যবহার করতে বলেন। এইসব ধাতু ফুটপাথে বিক্রি হয়, জ্যোতিষবাবুদের কাছে থাকে না। এইসব ধাতুবিক্রেতারাও আবার অল্পবিস্তর জ্যোতিষী হাতফাতও দেখেন।রবির জন্য তামা বা সোনা ব্যবহার, চন্দ্রের জন্য রূপো, মঙ্গলের জন্য রূপো ইত্যাদি। মানবদেহে বিভিন্ন পরিমাণে ধাতুর উপস্থিতি আছে। ধাতুর কম/বেশি উপস্থিতিতে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়। আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথ, অ্যালাপ্যাথিতে ওষুধ প্রস্তুতিতে ধাতুর প্রয়োগ হয়, ধাতুর ভারসাম্য রক্ষা হয়।মানুষ এবং অন্যন্য প্রাণীরা তাদের আহার্য ফল-মূল-সবজি-মাছ-মাংস-ডিম খাওয়র মাধ্যমে তার শরীরের ধাতুর চাহিদা মেটায়। ফল-মূল-সবজি-মাছ-মাংস-ডিমে নির্দিষ্ট পরিমাণে লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক সালফেট,  দস্তা, সোনা, রূপা থাকে।এইসব ধাতুর অভাবে বা ধাতুর প্রাবল্যে মানুষের নানাবিধ অসুখবিসুখ হয়। সরাসরি কোনো ধাতু খাওয়া যায় না। তাই ওষুধ তৈরি করতে সেইসব ধাতুর প্রবেশ ঘটাতে হয়।ওষুধের স্ট্রিপ বা প্যাকেটে Composition পড়ে দেখুন। আয়ুর্বেদে স্বর্ণভস্ম, রৌপ্যভস্ম প্রয়োগ করা হয় নিশ্চয়। তাই বলে তামা-লোহা-সোনা-রূপা হাতে-পায়ে বাঁধলে অসুখবিসুখ সেরে যাবে ? গ্রহরা সব পালিয়ে যাবে ? তা কোনোদিন হয়? তাহলে দিল্লিতে উনুন জ্বালিয়ে কলকাতায় বসে ভাত রান্না করা যায় বিশ্বাস করতে হবে !
ভেবেছিলাম ধাতুর কথা লেখার পর উপসংহারে চলে যাব। হঠাৎই আমার এক বন্ধু রুদ্রাক্ষের কথা মনে করিয়ে দিলেন। রুদ্রাক্ষও নাকি গ্রহশান্তিতে করিৎকর্মা। দেখা যাক -- আয়ুর্বেদের সংহিতাগ্রন্থে রুদ্রাক্ষ নামের কোনো বস্তুর ব্যবহার, এমনকি নামোল্লেখ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে অন্য নামে এটি ব্যবহৃত হয়েছে কি না সেটা আজও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। রাজনিঘণ্টুনামে এক বৈদ্যক দ্রব্যাভিধানে এই গাছটির গুণাগুণের বর্ণনা দেওয়া আছে -- এটি উষ্ণগুণসম্পন্ন; বাত, কৃমি, শিরোরোগ, ভূতগ্রহ, বিষনাশক এবং রুচিকারক। অসুখবিসুখের ব্যাপারে পরে আসছি। তার আগে দেখে নিই রুদ্রাক্ষের মাহাত্ম্য কতটা ? একমুখী থেকে শুরু করে আটত্রিশমুখী পর্যন্ত রুদ্রাক্ষের সন্ধানও পাওয়া যায়। সহজলভ্য নয় বলে চোদ্দোমুখী থেকে একুশমুখী রুদ্রাক্ষের মূল্যও বেশিগৌরীশঙ্কর, ত্রিযুতি -- রুদ্রাক্ষ জগতে অত্যন্ত সুবিদিত হলেও সাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে। গৌরীশঙ্কর রুদ্রাক্ষ দেখলে মনে হয় দুটি রুদ্রাক্ষ বীজ একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে -- যাকে শিব ও পার্বতীর প্রতীক বলে মনে করা হয়। যাঁরা বৌদ্ধ অনুসারী তাঁদের মধ্যে কলাবতীর শক্ত বীজের সঙ্গে রুদ্রাক্ষের দানা মিশিয়ে সংকর মালা তৈরি করতে দেখা যায় । রুদ্রাক্ষের মধ্যে সবচেয়ে দুর্লভ বোধ হয় সুশ্রী এবং গোলাকার একমুখী রুদ্রাক্ষ, যা আজকাল অতিশয় দুর্লভ। শোনা যায়, টাটা কোম্পানি ৭০ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি একমুখী রুদ্রাক্ষ বংশপরম্পরায় রক্ষা করে আসছে।
জ্যোতিষবাবুদের ব্যাবসায়িক প্রবণতার কারণে প্রচার হয়েছে, রুদ্রাক্ষ যে-কোনো ধর্মের এবং যে-কোনো বয়সের নারী-পুরষই ধারণ করতে পারেগলায়, বাজুতে এবং কবজিতে প্রচার হয়েছে গাছের তলায় পড়ে থাকা রুদ্রাক্ষ ব্যবহার্য নয়, গাছ থেকে চয়ন করতে হবে তবেই কাজে দেবে। রুদ্রাক্ষের লাল কালো হলুদ ধূসর নানা রং এবং এর সঙ্গে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব, পাপস্খালন, দাম্পত্য জীবনে সুখ, ব্যাবসায়িক সাফল্য ইত্যাদি বিষয়গুলিকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যার পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত।
অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া রুদ্রাক্ষ ও ভদ্রাক্ষ নির্ণয় করা কঠিন ব্যপার। বাজারে নকল রুদ্রাক্ষ প্রায় ৯৮ শতাংশ শতাংশ খাঁটি রুদ্রাক্ষ ব্যবহার উপযোগী, তাও অনেক মূল্য। বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাঠের গুড়ার সঙ্গে লোহা, সিসা, গ্যালিলিথ নামক রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণ করে রুদ্রাক্ষ তৈরি করা হয়, যার বড়ো বাজার হচ্ছে নেপাল, বোম্বে ও বাঙ্গালোরে সহ গোটা বিশ্বে । যেহেতু নেপালে রুদ্রাক্ষ বৃক্ষ জন্মে, তাই বিদেশিরা মনে করে থাকেন নেপালেই খাঁটি রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায়। নেপালে ব্যবসায়ীরা ৩/৪ হাজার টাকায় খাঁটি রুদ্রাক্ষের একটি পিসও সরবরাহ করতে পারেন  না অপরদিকে ৮/৯ টাকায় নকল পেয়ে যাবেন ।  আগে নকল জিনিস চেনার চেষ্টা করতে হবে, কারণ নকল না চিনলে নকল সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে আসল চেনা যায় না।  খাঁটি রুদ্রাক্ষের দানাতে ৫০.০৩১% কার্বন, ০.৯৫% নাইট্রোজেন, ১৭.৮৯% হাইড্রোজেন এবং ৩০.৫৩% অক্সিজেন বিদ্যমান। ভালো বা আসল রুদ্রাক্ষ চেনার উপায় বা লক্ষণ -- যে রুদ্রাক্ষ সবদিকে সমান, কোথাও বিকৃত, বাঁকা, উঁচু-নীচু বা ভাঙ্গা-চোরা নেই সেই রুদ্রাক্ষ সব থেকে ভালো। এর কিনারাগুলি বেশ স্পষ্ট থাকবে আর গায়ের কাঁটা কাঁটা দাগগুলি বাইরে বেরিয়ে থাকে। যে রুদ্রাক্ষ জলে ডুবে যায়, দুটো তামার টুকরোর মধ্যে রাখলে ঘুরতে থাকে উজ্জল ও ভারী হয় এমন রুদ্রাক্ষ সবচেয়ে ভাল। একে সর্বোত্তম বলে মানা হয়। এই রুদ্রাক্ষ সবচেয়ে বেশি উপকারী হিসাবে বলা যায়। কবিরাজি মতানুসারে যে ব্যক্তি রুদ্রাক্ষ সঠিক নক্ষত্র, তিথি, সময় অনুযায়ী ধারণ করেন তার কোনো রোগ হতে পারে না। সেকি, পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ যদি সকলেই রূদ্রাক্ষ ধারণ করে বসে থাকে তবে তো সব চিকিৎসকদের চিকিৎসা ছেড়ে আকাশের তারা গুণতে হবে ! বিশ্বাসীদের ধারণা -- রুদ্রাক্ষের ক্ষমতা, ধারণ করার নিয়ম, পুজো মন্ত্র  যা সঠিকভাবে অনুসরণ করলে মানুষের জীবনে শান্তি আসবেই।বাপ রে, এদের তো ধরে দশ-পাঁচটা নোবেল দিয়ে দেওয়া দরকার।
জ্যোতিষবাবুরা বলেন যেমন মুখ, তেমন ফল এটাই মানুষের বিশ্বাস যেমন ধরুন -- (১) সপ্তমুখী রুদ্রাক্ষ: এই শ্রেণির রুদ্রাক্ষের নাম অনন্ত মাতৃকাএ রুদ্রাক্ষ ধারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠা, অর্থ মান, যশ ও প্রতিপত্তি লাভের পথ সুগম হয়ে থাকে। রাশিচক্রে রাহুগ্রহ রবি ও চন্দ্র যুক্ত হয়ে লগ্নে দ্বিতীয়ে, চতুর্থে, পঞ্চমে, ষষ্ঠে, সপ্তমে, অষ্টমে, নবমে, দশমে এবং দ্বাদশে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হয়। ১০৮ বার মন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে রাহু গ্রহের সমস্ত কুফল বিনষ্ট হয় অনেকের বিশ্বাস (২) অষ্টমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষের দুটি নাম বিনায়কবটুকভৈরবশনিগ্রহ ও রাহুর অশুভ প্রভাব খর্ব করে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে হঠাৎ আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দুষ্কৃতকারীদের হাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রাশিচক্রে শনি ও রাহু অশুভ থাকলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক পুরুষের ডান বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বাম বাহুতে ধারণীয়। এ রূপে বিনায়ক মন্ত্র পাঠ করে বা বটুক ভৈরব মন্ত্র এ মন্ত্রে বটুক ভৈরবের পুজো করে এবং পরে জপ করে ও পরে বীজমন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব দূরীভূত হয়। (৩) নবমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষের অন্য নাম মহাকাল ভৈরব ধারণে জীবনে উন্নতির সূচনা যায়, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জয়লাভ করা হয়। দুর্ঘটনা ও হঠাৎ মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। ধারণের পূর্বে মন্ত্র উচ্চারণ করে এ রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন বা প্রাণসঞ্চার করে নিতে হয়। মন্ত্র পাঠের পর উচ্চারণ করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিজনিত কাজকর্মের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রচুর সুফল দান করে এ রুদ্রাক্ষ। রাশিচক্রে বৃহস্পতি গ্রহ মকরে নীচস্থ, মকরস্থানে অবস্থান করলে, বা মারকস্থ হলে এবং ষষ্ঠ, অষ্টম, দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে কিংবা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উপরোক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কার পূর্বক ধারণের পর মন্ত্র জপ করে বৃহস্পতয়েএ বীজমন্ত্র জপের পর পুরুষের দক্ষিণ বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বামবাহুতে ধারণ করলে সকল অশুভ বিনাশ হয়। (৪) দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষ দুর্লভ। এর অন্য নাম মহাবিষ্ণুমর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, সুনাম, খ্যাতি, সন্মান, পার্থিব সমৃদ্ধি, কর্মদক্ষতা এবং ব্যাবসায়িক সাফল্য অর্জনে সহায়ক এ রুদ্রাক্ষ। প্রেতাদি কর্তৃক অনিষ্টকর প্রভাব থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। রাশিচক্রে বুধ গ্রহ নীচস্থ শত্রুযুক্ত ও শত্রুক্ষেত্রগত, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, অষ্টম ও দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে পীড়িত হলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক সংস্কার করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র পাঠ ও জপ করে জপের পর উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ দূরীভূত হয়। (৫) একাদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এটি একটি বিশেষ জাতের রুদ্রাক্ষ। এর অন্য নামমহামৃত্যুঞ্জয়মেয়েদের নানা অসুখের ক্ষেত্রে একান্তভাবেই সুফল প্রদানকারী, আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটলে, আত্মহনন চিন্তা এসে মনকে ও মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠলে এ রুদ্রাক্ষ ধারণে তার উপশম হয়। মন্ত্র উচ্চারণযোগে রুদ্রাক্ষ উজ্জীবিত করে ধারণ করা প্রয়োজন। রাশিচক্রে শুক্র ও মঙ্গল অশুভ থাকলে মন্ত্রে যথাবিধি সংস্কার করে মন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব নাশ হয়। (৬) দ্বাদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এর অন্য নাম অর্ক বা আদিত্য রুদ্রাক্ষ রবি ও রাহুর অশুভ প্রভাবকে প্রশমিত করে। রবি যখন মকরে বা কুম্ভরাশিতে অবস্থিত হয়ে অশুভদশা প্রাপ্ত হয় তখন এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সকল কুফল নষ্ট হয়। ব্যাবসায়িক মন্দা বা অসাফল্য নিবারণ করতে মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষকে উজ্জীবন করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র উচ্চারণ করে ১০৮ বার জপের পর রুদ্রাক্ষটি কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়। (৭) ত্রয়োদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এর অপর নাম কামএর ধারণে সর্বভাবেই কামনীয় বিষয়ের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিপূরণ হয়। চিন্তামণি মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হবে।  অতঃপর মন্ত্র ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত পাপ দূর হয় ও সকল মনোরথ সিদ্ধি হয়। এর ধারণে চন্দ্র ও শুক্রের অশুভ প্রভাব নাশ হয়ে থাকে। (৮) চতুর্দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষ শ্রীকণ্ঠ নামে পরিচিত। এই রুদ্রাক্ষ ইন্দ্রিয় সংযমে সাহায্য করে। পঞ্চমুখ হনুমানমন্ত্র সহযোগে একে উজ্জীবিত করতে হয়। মন্ত্র পাঠ করে বীজমন্ত্র জপ করে ধারণ করলে শুক্রগ্রহের সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়। মন্ত্র ১০৮ বার জপ করে ধারণ করলে বৃহস্পতি ও রবির সমস্ত অশুভ প্রভাব নষ্ট হয়ে থাকে।
রুদ্রাক্ষ মৃগীরোগীদের জন্যেও উৎকৃষ্ট। সংক্রামক রোগ, বিশেষত বসন্তরোগ প্রতিষেধক বলে বহু মানুষ শরীরে ধারণ করে। রাজস্থানের বৈদ্য সম্প্রদায় এই রোগে রুদ্রাক্ষ ঘষে গায়ে লাগাতে দিয়ে থাকেন। শ্লেষ্মার আধিক্যে যেসব রোগ-বিসুখ সৃষ্টি হয়, কোনো কোনো প্রদেশে এটি ঘষে খাওয়ানো হয়। যক্ষারোগের প্রথমাবস্থায় তুলসীমঞ্জরীর সঙ্গে রুদ্রাক্ষ ঘষে খাওয়ালে চমৎকার ফল দেয় শুনেছি। এছাড়া রোগীর নাড়ী ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকলে হৃদযন্ত্র সক্রিয় রাখতে গ্রামবাংলার প্রাচীন বৈদ্যকুলের কোরামিন ছিল, রুদ্রাক্ষ ঘষা ও মধু দিয়ে মকরধ্বজ খাওয়ানো হত।ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রকে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাঁদেরই উত্তরসূরি আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন -- আয়ুর্বেদের মূল সিদ্ধান্ত হল, প্রতি দ্রব্যের মধ্যে চারটি জিনিসের অস্তিত্ব বর্তমান। যেমন -- রস, বীর্য, বিপাক ও প্রভাব। প্রথমোক্ত তিনটির প্রত্যক্ষতা প্রমাণ করা যায়, শেষোক্ত প্রভাব’-টি কিন্তু দ্রব্যগুণাদির সম্পর্কশূন্য নয়। কারণ প্রতিটি দ্রব্যের প্রভাবের ক্ষেত্রটিও বিশেষ গুণান্বিত। অর্থাৎ শ্লেষ্মানাশক দ্রব্যের প্রভাব কখনো বাত-পিত্তকে প্রকুপিত করে হয় না, বিরোধীও হয় না।
এতক্ষণ নিশ্চয় আপনি হাজারো সংশয় নিয়ে ভাবছিলেন – জ্যোতিষ যদি অযৌক্তিকই হবে তবে এত মানুষ যে এতকাল ধরে জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষীদের পিছনে ছুটছে, কেন ? আপনার উত্তর নিশ্চয় এরকম – তারা জ্যোতিষের অভ্রান্ততার প্রমাণ পেয়েছেন বলেই-না জ্যোতিষীদের কাছে যাচ্ছে। শুধু আপনি নন, জ্যোতিষীবাবুদের যুক্তিও এরকমই হয়। এর বেশি কুলায় না যে! বড়ো রকমের ফাঁপড়ে পড়ে গেলে মাসলম্যান তো আছেই। মাসলম্যান অবশ্য সবার নেই। যাঁদের নেই ন্যাজে-গোবরে হন, অথবা ত্যাদোর পাবলিকের ধোলাই খান।আর যাঁদের মাসলম্যান আছে তাঁরা হলেন জ্যোতিষজগতের রাঘববোয়াল।সাংবাদিকদের ক্যামেরার ‘দেখে নেব’ বলে হুমকি দিতে ছাড়েন না। ট্যাবলেট-জ্যোতিষীর এহেন হুমকি নিশ্চয় অনেকেই নিশ্চয় দূরদর্শনে দেখেছেন।
১৯৯৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। কাঁকুড়গাছির শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত তথাকথিত প্রাচ্য-পাশ্চাত্য জ্যোতিষ সম্মেলনে “ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি”-র সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উদ্দেশ্য : উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে খোলামেলা চ্যালেঞ্জের আবেদন। আবেদন : ‘ভবিষ্যদ্বক্তা’ জ্যোতিষীরা পাঁচজন বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুদিন আগাম গণনা করে বলে দিন। আর সেই গণনার ফলগুলি আলাদা আলাদাভাবে খামবন্দি করে একটি নিরপেক্ষ জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখা হবে। ওই পাঁচজন ব্যক্তির মধ্যে যে দিন যিনি মারা যাবেন সেসময় সেই ব্যক্তির নামাঙ্কিত খামটি খুলে দেখা হবে জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী মিলেছে কি না।এই পদ্ধতিতে যদি কমপক্ষে চারজনের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়, তাহলে “ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি” জ্যোতিষীদের হাতে চ্যালেঞ্জের টাকা (ভারতীয় রূপিতে ৫০,০০০ টাকা) তুলে দেবে এবং সমিতির পক্ষ থেকে জ্যোতিষবিরোধী সমস্ত আন্দোলন বন্ধ করে দেবে।
জ্যোতিষ-বিশ্বাসীরা কী ভাবছেন ? জ্যোতিষীবাবুরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন ? না, জ্যোতিষীবাবুরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। উলটে সম্মেলনের কক্ষটির সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া হল, যাতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা ঘরের বাইরে বেরোতে না পারে। এরপর জনাকয়েক মাসলম্যান এসে প্রচণ্ড প্রহার করল। বাধা দিতে গিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক , দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিকরাও লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের শিকার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় এক যুবকও প্রহৃত হন। এক্কেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটেছিল সেদিন। জ্যোতিষীদের ফাঁদে ফেলতে চাইলে জ্যোতিষবাবুরা এভাবেই উত্তর ফেরত দিয়ে থাকে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তাঁর এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। একটি হল -- “গণয়তি গণনে গণকশ্চন্দ্রেন সমাগমং বিশাখায়া। বিবিধ-ভুজঙ্গ-ক্রীড়াসক্তাং গৃহিণীংন জানাতি।।” - গণক আকাশে বিশাখা নক্ষত্রে চন্দ্রের সমাগম গণনা করছে। (ওদিকে) নানান উপপতির সঙ্গে ক্রীড়ায় আসক্ত (নিজের) গৃহিণীকে (অর্থাৎ তার খবর) সে জানে না। অপরটি হল -- “গণিকা গণকৌ সমান ধর্মৌ নিজপঞ্চাঙ্গ-নিদর্শকাবুভৌ।/জনমানস মোহকারিনৌ তৌ বিধিনা বিত্তহরৌ বিনির্মিতৌ।।” গণিকা আর গণক -- দুয়েরই এক ধর্ম। দুজনেই নিজের পঞ্চাঙ্গ দেখায়। দুজনেই লোকের মনকে মোহগ্রস্ত করে। বিধাতা এই বিত্তহরণকারীদের তৈরি করেছেন। পঞ্চাঙ্গ হল দুটি হাত, দুটি পা ও মাথা (গণিকা পক্ষে)। বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ, করণ -- এই পাঁচ (গণক পক্ষে)। গণক লোকের সত্য-মিথ্যা ঠিকুজি তৈরি করার পর যদি ফলে যায় তাহলে নিজের কেরামতি জাহির করে। না ফললে সেটাকে বলে লগ্নদ্রষ্টার ভুল। না মিললে বলে – “জ্যোতিষীরা ভুল করেন, তাঁদের গণনা ভুলও হতে পারে অনেক সময়। নামী ডাক্তারদেরও তো ভুল হয়। অঙ্কের ভালো শিক্ষকরাও অঙ্ক ভুল করে। বানান সংশোধকরাও (Proof Reader) বানান ভুল করেন। প্যাথোলজিস্টরা ভুল রিপোর্ট দেয়। বিশ্বের এক নম্বর ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি ব্রিজও ভেঙে পড়ে। তার মানে কি সেই বিদ্যা বা শাস্ত্রগুলি মিথ্যা ? তা ছাড়া জ্যোতিষ গণনা-পদ্ধতি ভুল না ঠিক সেটা একমাত্র জ্যোতিষীরাই বলতে পারবেন, আপনি নন।” ভণ্ড গণকরা এভাবেই মানুষকে ঠকিয়ে তাদের টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়।
আপাতদৃষ্টিতে জ্যোতিষীবাবুদের যুক্তিগুলি সঠিক মনে হতেই পারে। কিন্তু জ্যোতিষবাবুদের ভুলের সঙ্গে অন্য ভুলগুলির কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে।ডাক্তার অথবা শিক্ষকদের ভুলটা বিমূর্ত নয়, সম্পূর্ণটাই চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণিত। জ্যোতিষবাবুদের ভুলটি বিমূর্ত, প্রমাণ করা যায় না। ভুলটা প্রমাণ করা গেলেও ঠিকটা প্রমাণ করা যায় না। যেমন ধরুন আপনার বর্তমান বয়স ৩০। আপনাকে বলা হল ৪০ বছর বয়সে গিয়ে আপনার বড়ো একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমনকি মৃত্যু হওয়ারও আশঙ্কা আছে। আপনি আর আপনার পরিবার খুব ভয় পেয়ে গেলেন এবং মুক্তির উপায় জানতে চাইলেন। জ্যোতিষবাবু আপনাকে পাঁচ রতির একটা নীলা ব্যবহার করতে বললেন।৪০ বছর বয়সে গিয়ে আপনার কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না, মৃত্যুও হল না। কিংবা ওই সময় আপনি এমনভাবে হোঁচট খেয়ে পড়লেন যে আপনার সামনের দুটো দাঁত ভেঙে গেল। জ্যোতিষীবাবু বলবেন – সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীই উনি করেছিলেন ও বিধানও সঠিক দিয়েছিলেন। পাথর কথা বলে। সেদিন পাথরটি ব্যবহার না করলে মৃত্যু ঠেকানো যেত না।” আপনার ৪০ বছর বয়সে দুর্ঘটনা বা মৃত্যু হত কি না, সেটা আর প্রমাণ করা গেল না। কিন্তু যদি উলটোটা হত, অর্থাৎ ৩৫ বছর বয়সে আপনি কোনো দুরারোগ্য অসুখে মারা গেলেন। তখন কি আপনার পরিবার ভুল বলার জন্য জ্যোতিষবাবুর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবেন ? এরকম ঘটনা আকছার ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের চরম উদাসিনতার জন্য জ্যোতিষবাবুদের এই বুজরুকির ব্যাবসা চালিয়ে যেতে এক্কেবারেই বেগ পেতে হয় ন। জ্যোতিষবাবুরা যখন ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং ভাগ্য বদলানোর কথা বলেন, তা এমনই অস্পষ্ট ও অর্থহীন যে তার ঠিক-ভুল বিচারের কোনো মানেই হয় না।বিজ্ঞানের তত্ত্বকে নির্দিষ্টভাবে ভুল প্রমাণ করা যায়, তাই ভুল বলে প্রমাণিত না-হলে সেটি ‘ঠিক’-এর মর্যাদা পায়। জ্যোতিষবাবুদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই, কাজেই ‘ঠিক’-এর মর্যাদাও প্রাপ্য নয়।
অদ্বৈত আশ্রম থেকে প্রকাশিত “কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, বার্থ সেন্টিনারি এডিশন”- এর অষ্টম খণ্ডে “ম্যান দি মেকার অফ হিজ ডেস্টিনি” প্রবন্ধে লেখা আছে -- I have seen some astrologers who predicted wonderful things ; but I have no reason to believe they predicted them only from the stars, or anything of the sort. In many cases it is simply mind-reading some times wonderful predictions are made, but in many cases it is arrant trash. অর্থাৎ, “আমি কোনো কোনো জ্যোতিষীকে দারুণ দারুণ ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখেছি ; কিন্তু একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা শুধুমাত্র নক্ষত্র বা ওই জাতীয় জিনিস থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করে। অনেকক্ষেত্রেই এ হচ্ছে নিছক মনের কথা আঁচ করার ব্যাপার। কখনো-কখনো চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণী হয়, কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই সেগুলি পুরোপুরি ভূষিমাল।”
যৌবনের প্রারম্ভে আমিও বইপত্র কিনে জ্যোতিষগিরি শুরু করেছিলাম। বইপত্র পড়ে দেখলাম এ বিদ্যা কোনো কাজে আসবে না। শুধু টার্মসগুলি আয়ত্ব করে নিলাম। প্রত্যেক পেশারই একটা নির্দিষ্ট স্টাইল থাকে, এক্ষেত্রেও সেটা আয়ত্ব করলাম। কথায় বলে ভেক না থাকলে ভিখ মেলে না। ভেকও বদলে ফেললাম। মুখে মুখে প্রচার চালাতে লাগলাম, যাকে বলে বিজ্ঞাপন করা। প্রথম প্রথম বিনাপয়সাতেই ভবিষ্যদ্বাণী করে দিতাম। লিখিতভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করতাম। বেশ পসার হল। পারিশ্রমিক নিতে শুরু করলাম। আমি ঠিক বলতে পারি সেটা সবাই বলতে থাকল।পূর্ণ উদ্যোমে কাজে লেগে পড়ার আগে বিবেকের ডাকে থমকে গেলাম। লোক ঠকানোর এ কাজ করাটা কি ঠিক ! আমি তো জানি এসব বলায় কোনো ভিত্তি নেই। পুরোটাই ‘মন পড়া’ ব্যাপার।ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে রোগীকে পড়ে ফেলা। ব্যস, কেল্লা ফতে।আপনিও পারবেন মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে। কোনো জ্যোতিষবিদ্যার পাঠ নিয়ে সাগর-সম্রাট হওয়ার প্রয়োজন নেই। কৌশলটুকু আয়ত্ব করলেই হবে। কীভাবে ?
আমি যেভাবে কিছুদিন জ্যোতিষগিরিতে পসার জমিয়ে জমিয়ে ছিলাম, সেটা তো আপনাদের শেয়ার করবই, এর সঙ্গে যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষেরও কিছু মূল্যবান টিপস দেব। তার আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : এটি একটি মানুষকে প্রতারণা, অর্থাৎ প্রতারক হওয়ার টিপস। প্রতারক হতে চাইলে নিজের দায়িত্বেই হবেন। এ টিপস সচেতন ও যুক্তিনির্ভর ব্যক্তিদের স্বার্থেই নিবেদিত হচ্ছে।
টিপস – ১ : আমি মনে করি জ্যোতিষ ব্যাবসায় শিখরে উঠতে চাইলে জ্ঞানী অবশ্যই হতে হবে। জ্যোতিষ ব্যাবসা অজ্ঞানী বা মূর্খদের জন্য নয়। মনে রাখতে হবে আপনার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েই আপনার প্রতি জাতক-জাতিকাকে আকৃষ্ট করতে হবে। “বিদ্বান সর্বত্র পূজতে”, জ্ঞানেই নারীপুরুষনির্বিশেষে মুগ্ধ হয়। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের কিছু শাখায় জ্ঞান থাকলে উত্তম।ইংরেজি ভাষাটাকে ভালোভাবে আয়ত্ত করা প্রয়োজন। মানুষ ইংরেজি ভাষাকে সমীহ করে। জানতে হবে সংস্কৃত ভাষাও। আমাদের সমাজে এ ভাষাও সমীহ আদায় করে নেয়। জাতক বা জাতিকার সঙ্গে কথা বলার সময় ঠিকঠাক সংস্কৃত বাক্য বা শ্লোক গুঁজে দিতে পারলে কেল্লা ফতে। আপনি দোষেগুণে মানুষ থেকে ঈশ্বর বা ক্রান্তিদর্শীতে  উন্নীত হবেন খুব সহজেই।
টিপস – ২ : ফোর টোয়েন্টিগিরি (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রতারণার দায়ে শাস্তির বিধান) করে এভাবে বাকিজীবন চালিয়ে যেতে পারবেন, এরকম মানসিক জোর ও আত্মবিশ্বাস চাই।
টিপস – ৩ : দূরদর্শী, নির্লজ্জ, দুঃসাহসী, তুখোড় বুদ্ধি, ধূর্ত এবং বিচক্ষণ হতে হবে।
টিপস – ৪ : সাগর, সম্রাট ইত্যাদি সার্টিফিকেট নিয়ে নিন কোনো জ্যোতিষ সংস্থা থেকে। সার্টিফিকেট দেনেওয়ালে সংস্থা ভুড়ি ভুড়ি আছে। নগদ রেস্তো খরচ করে কিনে নিন ডিগ্রি, পদক, পি এইচডি ইত্যাদি।
টিপস – ৫ : স্পেশালিস্ট হিসাবে নিজেকে প্রচার করুন। বিদ্যার জন্য সরস্বতী কবচ, বিয়ের জন্য প্রজাপতি কবচ, ব্যাবসার উন্নতির জন্য বিশ্বকর্মা কবচ ইত্যাদির ব্যবস্থাও রাখুন।
টিপস – ৬ : ৫০০ বছরের কিংবা ২০০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পারিবারিক জ্যোতিষী বলে বিজ্ঞাপন দিন।
টিপস – ৭ : আপনার নামের সঙ্গে শাস্ত্রী, আচার্য, আনন্দ জুড়তে ভুলবেন না।
টিপস – ৮ : আপনার নামে ওজন না থাকলে পালটে ফেলুন।
টিপস – ৯ : আপনার নামের শেষে প্রথম বন্ধনীর ভিতর ‘তন্ত্রসিদ্ধ’, ‘অলৌকিক মাতা’, ‘কামাখ্যাসিদ্ধ’, ‘বাকসিদ্ধ’ ইত্যাদি প্রচারে রাখবেন।
টিপস – ১০ : ভালো কপি রাইটারদের একটা জুতসই বিজ্ঞাপন তৈরি করান।
টিপস – ১১ : কোনো চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। এমন প্রচুর জ্যোতিষের চ্যানেল আছে। স্লট কিনুন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারাই আপনাকে বলে দেবে কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, কত দিতে হবে ইত্যাদি।
টিপস – ১২ : ভেক বদলান। কথায় বলে ভেক না-হলে ভিখ মেলে না।
টিপস – ১৩ : বাড়িতে বড়ো করে পূজো দিন। বাড়িতে মন্দির থাকলে ভালো। আপনি যে দেবতাকে জড়িয়ে জ্যোতিষ ব্যাবসা চালাবেন সেই দেবতার পুজো করবেন বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। খুব ভালো কাজ দেয় কালীপুজো করলে।টিভিতে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করুন আপনার পুজো।
টিপস – ১৪ : বিপদের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয় থানা এবং ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।
টিপস – ১৫ : আপনার ব্যাবসা রমরমিয়ে চললে দু-একটি মাসলম্যান পুষবেন। দুঃসময়ে কাজে দেবে।
টিপস – ১৬ : বাজারে প্রচুর জ্যোতিষবিদ্যার বই পাওয়া যায়। কিনে জ্যোতিষী-ভাষা বা টার্মগুলি রপ্ত করুন। প্রতিটি পেশার নিজস্ব ভাষা আছে, জ্যোতিষেও আছে।
টিপস – ১৭ : আবহাওয়া তথা রাজনীতিতে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে সে বিষয়ে এলেম না থাকলে বিষয়টি এড়িয়ে যওয়াই শ্রেয়। যেমন আগামী লোকসভায় কোন দল সরকার গড়বে ? পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন ? ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হবে কি না? ইত্যাদি।
টিপস – ১৮ : অবশ্যই পাথর বেচুন। পাথরই আপনাকে ধনী করবে। ‘বিফলে মূল্য ফেরত’ বলে দিন। পাবলিক এটা খুব খায়। ঘাবড়াবেন না, মূল্য ফেরত দিতে হয় না। কেউ দাবিও করে না। যদি কেউ মূল্য ফেরত নিতেও আসে, সেটা বুদ্ধি খরচ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনুন। সবাই পারে, আপনিও পারবেন।
টিপস – ১৯ : আপনি যদি আপনার বা অন্য মন্দিরে বসতে পারেন, তাহলে হাত দেখার জন্য কোনো পয়সা নেবেন না।পাশে প্রণামীর বাক্স দেখিয়ে দেবেন। বলবেন -- মায়ের পুজোর জন্য আপনার সাধ্য অনুযায়ী দিলেই হবে।
টিপস – ২০ : বিখ্যাত মানুষদের হাত দেখার সুযোগ পেলে অনুমতি সাপেক্ষে ফোটো তুলে রাখতে ভুলবেন না। ওটা বিজ্ঞাপনে দারুন কাজে দেবে।
টিপস – ২১ : মানুষের কিছু কমন জিজ্ঞাস্য বা জানাবার কৌতূল থাকে, সেগুলিই সে জানতে আগ্রহী। একজন অবিবাহিত মেয়ে এবং একজন অবিবাহিত ছেলে জিজ্ঞাস্য ভিন্ন, একজন বিবাহিত মহিলা এবং একজন বিবাহিত পুরুষের জিজ্ঞাস্য আলাদা। একজন অবিবাহিতের প্রেম বিষয়ক, চাকরি বিষয়ক, বিয়ে বিষয়ক প্রশ্ন থাকে।অপরদিকে একজন বিবাহিতের স্বামী/স্ত্রী বিষয়ক, সন্তান বিষয়ক ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানে আগ্রহী। প্রশ্ন যেমনই হোক, উত্তর দিতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে। হবেই এমন কথা কখনোই বলবেন না, ‘সম্ভাবনা’ উল্লেখ করে বলুন। ‘সম্ভাবনা’ শব্দটির মানে হতেও পারে, না হতে পারে।
টিপস – ২২ : ভয় দেখাতে ভুলবেন না। নাহলে পাথর/কবচ বেচতে পারবেন না।পাথর/কবচই আপনার ভবিষ্যৎ যে !
টিপস – ২৩ : সব বয়সের মেয়েদের ‘মা’ বলে সম্বোধন করে কথা বলুন। অবশ্যই সকলকে ‘তুই’ সম্বোধন করাটা রপ্ত করে নেবেন।
টিপস – ২৪ : মানুষ নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা শুনতে ভালোবাসে। প্রথম দর্শনেই সেই ভালো ভালো কথাগুলি বলুন। যেমন – আপনি খুব দয়ালু, আপনি খুব উদার, আপনি মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন কিন্তু আপনি তেমন ভালোবাসা পান না ইত্যাদি। খুব বেশি বেশি পজিটিভ কথা বলুন। দু-একটা নেগেটিভ কথা বলবেন পেটের জন্য।
টিপস – ২৫ : আপনার ‘মুরগি’-কে যে মোক্ষম বাণীগুলি শোনাতেই হবে।৯৯%ভাগ মিলে যাবে, আপনি অব্যর্থ হয়ে যাবেন। দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে – (১) মানুষ নিজের সম্বন্ধে যে কথাগুলি শুনতে ভালোবাসে এবং (২) প্রতিটি মানুষ সে যে স্তরেই অবস্থান করুক না-কেন কিছু বিষয় আছে যেগুলি সকলের সঙ্গেই মিলে যাবে। যেমন এই পয়েন্টগুলো বলুন -- আপনি স্পষ্টবক্তা, দৃঢ়চেতা। আপনি অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী। স্পষ্টবাদিতার জন্য আপনি অপ্রিয় হন, কিন্তু আপনি আপনার জ্ঞানতৃষ্ণার জন্য অনেকের কাছে শ্রদ্ধাভাজনও হন। সংসারের জন্য আপনি অনেক করেন, কর্মক্ষেত্রেও আপনি অনেক করেন – কিন্তু আপনার মূল্যায়ন কেউ করতে পারে না।জীবনে যত বিপদেই পড়েছেন শেষপর্যন্ত আপনি উদ্ধার পেয়েছেন আপনার কনফিডেন্সের জন্য। আপনি খুব তাড়াতাড়ি মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন। আপনি মানুষকে খুব বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করে কখনো-কখনো ঠকেনও, তবু বিশ্বাস হারান না।আপনি রেগে গেলে সাংঘাতিক হয়ে ওঠেন, কিন্তু রেগে গেলেও আপনার বুদ্ধিভ্রম হয় না। আপনি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে চাইলেও বাঁকা পথ ধরতেও বাধ্য হন। সুশ্রী-সুন্দরী জাতিকা হলে বলুন – আপনার কাছে অনেক পুরুষই প্রেম নিবেদন করতে চায়। আপনি পাত্তা দেন না। আপনার গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা বেশ ভালো। পুরুষরা অবলীলায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে। আপনি চাইলেই যে-কোনো পুরুষকেই দখলে নিতে পারেন, কিন্তু আপনি খুবই ক্যালকুলেটেড। বিভ্রান্ত হন না। ইত্যাদি-- দেখবেন আপনার ‘মুরগি’ কী খুশি। আসলে সাধারণত মানুষ তোষামোদে খুব খুশি হয়। নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা শুনতে কার-না ভালো লাগে ! মানুষ স্বীকৃতি চায়। আবিষ্কার চায়। নিজেকে জানতে চায়। পিঠ চাপড়ানো মানুষের মন্দ লাগে না।
এবার মিলতেও পারে, না-ও মিলতে পারে এমন কিছু বলুন। তবে মেলার সম্ভাবনা বেশি। বলুন – মাঝেমধ্যেই আপনাকে একাকীত্বে পেয়ে বসে। আপনার প্রচুর ভালো বন্ধু আছে, শত্রুও আছে ঘাপটি মেরে। সন্মান আপনি পেয়েছেন, কিন্তু যতটুকু আপনার প্রাপ্য ততটুকু আপনি পান না। গোপন প্রণয় আপনার অজ্ঞাতসারে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। পেট ও অম্বল নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইত্যাদি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করলে জ্যোতিষী হিসাবে সফল হবেনই।
টিপস – ২৬ : কোনো বিবাহিত এসে আপনার কাছে এসে জানতে চাইত পারেন – তার বিয়ে হবে কি না, হলে কবে হবে ? কোনো সরকারি চাকুরে এসে আপনার কে এসে জানতে চাইতে পারে তার চাকরি হব কি না, হলে কবে হবে ? এমন ফাঁপড়ে পড়লে ধূর্ততার সঙ্গে উত্তর দিতে হবে। না-হলে কেলানি একটাও  মাটিতে পড়বে না। অবশ্য তাবড় তাবড় জ্যোতিষীবাবুরা এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন না।
টিপস – ২৭ : সবশেষে সবাইকে একথা বলতে ভুলবেন না – “আপনার হাতখানি খুব সুন্দর। এমন অপূর্ব হাত খুব একটা পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও কোটিতে গুটি। যাকে তাকে এ হাত দেখাবেন না। নষ্ট করে দেবে।”
দেশের রোজকার দৈনিক পত্রিকাগুলোয় দিনের অনেক গুরুত্বপুর্ণ খবর বাদ গেলেও “আপনার দিনটি কেমন যাবে” বা “আপনার রাশিফল” বিভাগটি কখনো বাদ যায় না। আবার কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে সকালের বিশেষ আয়োজন থাকে এই রাশিফল নিয়ে। অথচ এমন অনেক পত্রিকা রয়েছে যাদের বিজ্ঞান নিয়ে সাপ্তাহিক আয়োজনটুকুও নেই। বরঞ্চ বিজ্ঞাপন কম আসে বলে কোনো কোনো পত্রিকা সেই সাপ্তাহিক আয়োজনটুকুও বাদ দিয়ে দেয়।কিন্তু এই বিশেষ বিভাগ চালু রাখতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। কারণ একটাই এদেশে তো এই কু-খাদ্যের ভোক্তার অভাব নেই।হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন তাদের কাছে বিষয়টি নিছক বিনোদনের ।হ্যাঁ, সেটা হতেই পারে।কিন্তু বিষয়টি যদি শুধু বিনোদনের জায়গায় থাকত তাহলে কি জ্যোতিষীদের চেম্বার, পাথরের দোকান বড়ো বড়ো শপিং মলে কি দেখা যেত ? রাস্তার মোড়ে মোড়ে পত্রিকার দোকানগুলিতে কি দেখা যেত মাসিক, বাৎসরিক ভাগ্যলিপির পঞ্জিকা ? আর টিভি চ্যানেলগুলিতেই-বা কি দেখা যেত এদের রমরমা বিজ্ঞাপন ? না, মোটেই দেখা যেত না ।
কোনো কোনো জ্যোতিষীবাবু জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চায়, কোনো কোনো জ্যোতিষবাবু আবার শাস্ত্র বলে প্রমাণ করতে চায়, কাউকে আবার শাস্ত্রও বলতে শুনেছি বিজ্ঞানও বলতে শুনেছি। যাঁরা বিজ্ঞানের তর্কে পর্যুদস্ত হয়, তাঁরা বলেন জ্যোতিষকে শাস্ত্র বলে মেনে নিতে অসুবিধা কোথায় আপনাদের ! যেন শাস্ত্র হলেই অব্যর্থ, দৈব কিছু ! বিজ্ঞানের প্রথম শর্ত হল ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো ‘সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয় ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পর। সেইসব পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ফলাফল সুনির্দিষ্টভাবে নথিভুক্ত ও প্রকাশ করা হয়। যে কেউ তা যাচাই করে দেখে নিতে পারে। বিজ্ঞানে দ্ব্যর্থকতার কোনো জায়গা নেই। পটাশিয়াম সায়ানাইড শরীরে প্রবেশ করালে মৃত্যু অবধারিত। যে এটি করবেন তারই এ ঘটনা ঘটবে। অন্যথা হবে না। এটাই বিজ্ঞান, ফল সবসময় সকলের জন্য একই হবে। নিমপাতা চিবালে তেতো লাগবে সকলের, কারোর মিষ্টি লাগবে না – এটাই বিজ্ঞান। বারবার একই ফল পাওয়ার নামই বিজ্ঞান। যুক্তির কাছে অন্ধবিশ্বাস বা ব্যক্তিবিশ্বাসের কোনো জায়গা নেই, মূল্যও নেই। যুক্তি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পরীক্ষার পথ ধরে, পর্যবেক্ষণের পথ অতিক্রম করতে করতে। জ্যোতির্বিদা বাস্তবিকই জ্যোতির্বিজ্ঞান হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে অবিরাম গতিতে বিশ্লেষিত হয়ে চলল পার্থক্যের ব্যাপকতা। বহু পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নিয়ত গবেষণার মধ্য দিয়ে জ্যোতির্বিদ্যা প্রতিষ্ঠা পেল বিজ্ঞানের অলিন্দে।তৎসহ জ্যোতিষশাস্ত্র অবিজ্ঞান হিসাবে ডাস্টবিনে পরিত্যক্ত হল।
ভারতে দারিদ্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪০%, অতি নিম্নবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সংখ্যাও ৪০%। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষ বাকি শতংশের মধ্যে পড়ে। ৫% উচ্চবিত্ত ধরলে ১৫% মধ্যবিত্ত – এরা বেশ সচ্ছল প্রজাতির। দেখা যায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরাই মূলত জ্যোতিষের সমর্থক। বহু বছর আগে ‘ফলিত জ্যোতিষ’ শিরোনামে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন – “কোনও একটা ঘটনার খবর পাইলে সেই খবরটা কি না এবং  ঘটনাটা প্রকৃত কি না তাহা .........জানিবার অধিকার বিজ্ঞানবিদদের প্রচুর পরিমাণে আছে। এই অনুসন্ধান কার্যই বোধ করি তাঁর প্রধান কার্য। প্রকৃত তথ্য নির্ণয়ের জন্য তাঁহাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়।..... তিনি অতি সহজে অত্যন্ত ভদ্র ও সুশীল ব্যক্তিকেও বলিয়া বসেন, তোমর কথায় আমি বিশ্বাস করিলাম না।...... নিজের উপরেও তাঁর বিশ্বাস অল্প।..... কোথায় কোন্ ইন্দ্রিয় তাঁহাকে প্রতারিত করিয়া ফেলিবে ........ এই ভয়ে তিনি সর্বদা আকুল।.......ফলিত জ্যোতিষে যাঁহারা অবিশ্বাসী তাঁহাদিগের সংশয়ের মূল এই। তাঁহারা যতটুকু প্রমাণ চান ততটুকু পান না। তাহার বদলে বিস্তর কুযুক্তি পান।....... একটা ঘটনার সহিত মিলিলেই দুন্দুভি বাজাইব। আর সহস্র ঘটনার যাহা না মিলিবে তাহা চাপিয়ে যাইব, অথবা গণকঠাকুরের অজ্ঞতার দোহাই দিয়া উড়াইয়া দিব এরূপ ব্যাবসাও প্রশংসনীয় নহে।.......একটা সোজা কথা বলি। ফলিত জ্যোতিষকে যাঁহারা বিজ্ঞানবিদ্যার পদে উন্নীত দেখিতে চাহেন তাঁহারা এইরূপ করুন। প্রথমে তাঁহাদের প্রতিপাদ্য নিয়মটা খুলিয়া বলুন। মানুষের জন্মকালে গ্রহনক্ষত্রের স্থিতি দেখিয়া কোন্ নিয়মে গণনা হইতেছে তাহা স্পষ্ট ভাষায় বলিতে হইবে।..... ধরি মাছ না ছুঁই পানি হইলেও চলিবে না। তাহার পর হাজার খানেক শিশুর জন্মকাল ঘড়ি ধরিয়া দেখিয়া প্রকাশ করিতে হইবে; এবং পূর্বের প্রদত্ত নিয়ম অনুসারে গণনা করিয়া তাহার ফলাফল স্পষ্ট ভষায় নির্দেশ করিতে হইবে।...... পূর্বে প্রচলিত ফলাফলের সহিত প্রত্যক্ষ ফলাফল মিলিয়া গেলেই ঘোর অবিশ্বাসীও ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসে বাধ্য হইবে।হাজারখানা কোষ্ঠীর মধ্যে যদি নয়শো মিলিয়া যায় তবে মনে করিতে হইবে যে ফলিত জ্যোতিষে অবশ্য কিছু আছে। যদি পঞ্চাশখানা মা্র মেলে তবে মনে করিতে হইবে, তেমন কিছু নাই। হাজরের বলে যদি লক্ষটা মিলাইতে পারো, আরও ভালো। সহস্র পরীক্ষাগারে ও মানমন্দিরে বৈজ্ঞানিকেরা যে রীতিতে ফলাফল গণনা ও প্রকাশ করিতেছেন সেই রীতি আশ্রয় করিতে হইবে। কেবল নেপোলিয়নের ও বিদ্যাসাগরের কোষ্ঠী বাহির করিলে অবিশ্বাসীর বিশ্বাস জন্মিবে না। চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার হয়, তবে রামকান্তের জজিয়তি কেন হইবে না, এরূপ যুক্তিও চলিবে না।”
জ্যোতিষী নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমত : “জ্যোতিষে বিশ্বাস সাধারণত দুর্বল মনের লক্ষণ। সুতরাং মনে এরকম দুর্বলতা এলেই আমাদের উচিত সুচিকিৎসক দেখিয়ে ভালোভাবে ওষুধ খাওয়া, ভালো পথ্য খাওয়া। আর বিশ্রাম করা।” বলেছেন – “In many cases it is simply mind-reading some times wonderful predictions are made, but in many cases it is arrant trash.”
এহেন বিষয়কেই ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে রেখে যুবকযুবতীদের স্বনির্ভরতার সন্ধান দিতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে। এরপর কি ডাইনি বিদ্যা, ভূত-প্রেত-জিন চর্চা, ডাকিনী চর্চা, ওঝা-গুণিন বিদ্যা, কালাজাদু, ঝাড়ফুঁক বিদ্যা, তেল-পড়া, জল-পড়া, বাটি চালান, ক্ষুর চালান, বশীকরণ বিদ্যাও সিলেবাসে আনবেন ? অবাক হব না। কারণ আদি যুগ থেকে রাষ্ট্রই এইসব বিষয়ের পৃষ্ঠপোষক।রাষ্ট্রকে নির্বিঘ্নে থাকতে হলে নিয়তী বা অদৃষ্টবাদকে প্রতিপালন করতে হবে। তাই পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই অবিশ্বাসী বা নাস্তিকদের সুরক্ষা দেয় না, আস্তিকদের মদত জোগান। নাস্তিকরা এইসব অবৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর সমালোচনা করলে সবক শেখাতে চান। বলেন – অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কথা নাস্তিকদের বলা উচিত হয়নি। আস্তিকরা নাস্তিকদের উপর হামলা করলে রাষ্ট্র প্রায় নির্লিপ্ত থাকে। এবার ইউজিসির কথা একটু উল্লেখ করা যাক।ইউজিসি (University Grant Commission) বলছেন – জ্যোতিষ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তিন বছরের স্নাতক পাঠক্রম এবং দুই বছরের স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক পাঠক্রম চালু করবেন। আর এই জ্যোতিষচর্চায় নতুন নামকরণ করা হবে জ্যোতির্বিজ্ঞান। অ্যাঁ, হাসবেন না কাঁদবেন ! আরও শুনুন – উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দেওয়া হবে এককালীন ১৪ লক্ষ টাকা। দেওয়া হবে জ্যোতিষবিদ্যার উপযুক্ত সরঞ্জাম কেনার জন্য। ইউজিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেইসব জ্যোতিষ বিভাগে একজন অধ্যাপক, দুইজন লেকচারার, একজন লাইব্রেরিয়ান এবং একজন কম্পিউটার চালক থাকবেন। এর ফলে যদি দেশে কুড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাঠক্রম চালু করা হয় তাহলে এই পাঁচজনের জন্য বাৎসরিক খরচ হবে ১ কোটি টাকা। বুজরুকি জারি রাখার জন্য এত অর্থের অপচয় ! এ সংবাদ শুনে ভারতের অগ্রগণ্য পদার্থবিদ ও ইউজিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক যশপাল ক্ষোভ করে বললেন—“এ খবর শুনে আমি মর্মাহত। এ এক নিদারুণ লজ্জা, এক কলঙ্ক। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি ইউজিসির সভ্যদের মতোই আজ এদেশে মশা-মাছির মতো অজ্ঞানদের অভাব নেই।” বেঙ্গালুরু রামন রিসার্চ সেন্টারের বৈজ্ঞানিকগণও একসুরে বললেন – “পশ্চাদে এগিয়ে চলার এ এক বিরাট পদক্ষেপ। এরপরে ভারতের বৈজ্ঞানিক গবেষণার আর কোনো মূল্যই রইল না।” ইন্ডিয়ান ডেমোক্র্যাটিক টিচার্স ফ্রন্টের বক্তব্য – “এই প্রস্তাব অবান্তর, হাস্যকর এবং ভয়ংকরও।”
আত্মপক্ষসমর্থনে ইউজিসি কী বলছেন বিজ্ঞপ্তি জারি করে, একটু দেখে নেব – (১) বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা শুধু আমাদের জ্ঞানার্জনের শাস্ত্র নয়, বরং এটি এমন এক বিদ্যা যা আমাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে চলার পথ দেখায়। জ্যোতিষবিদ্যা আমাদের জানায় জীবনে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত কেমন করে ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে। (২) বিভিন্ন সময়ে যে ঘটনাগুলি ঘটে তা আমাদের জীবনের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করে। সাহায্য করে প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে আনতে।(৩) এটি এমন এক বৈদিক শাস্ত্র যার থেকে আমরা জানতে পারি কীভাবে কখন আমাদের জীবন হতাশা, দুঃখ, অস্থিরতা আসে। যা আমরা আমরা বুঝতে পারি না সে সম্বন্ধে অবহিত করা। (৪) বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষচর্চা শুধু মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটাবে তা নয় – বৈদিক গণিত, বাস্তুশাস্ত্র, কৃষিবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কেও একটা পরিপূর্ণ ধারণা দেবে।(৫) এই মূল্যবান পাঠক্রম থেকে একদিকে যেমন শিক্ষক ও ছাত্র উপকৃত হবেন – অপরদিকে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ সহ সকল পেশার মানুষজন সুফল লাভ করবে ইত্যাদি। রামো রামো !!!
বাকি রইল এবার বশীকরণবিদ্যার পাঠক্রম, তাবিজ-কবচবিদ্যার পাঠক্রম, ঝাঁড়ফুকবিদ্যার পাঠক্রম, জল-পড়া আর তেল-পড়াবিদ্যার পাঠক্রম, ধর্ষণ-খুনের পাঠক্রম ইত্যাদি। গেরুয়া-সংস্কৃতি নিশ্চয় সেই স্বপ্ন পূর্ণ করবে। নিষ্পাপ প্রতারকরাই রাষ্ট্র চালাবেন, এবার থেকে প্রতারকরাই রাষ্ট্রের নাগরিকরা কী করবেন কী করবেন না ঠিক করে দেবেন ? প্রতারকরা ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেবেন, বলবেন – “আসুন, সাক্ষাৎ ধর্ষণ-খুন করলেও অকাট্য সাক্ষ্যসবুত থাকলেও মামলায় জিতিয়ে দেব।পরস্ত্রীতে আসক্ত ? বিছানায় আনতে পারছেন না কিছুতেই ? পাঁচ মিনিটে অব্যর্থ বশীকরণের মাধ্যমে স্বর্গসুখ অনুভব করুন। আপনার সন্তানকে সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা শচীন তেণ্ডুলকর কিংবা কল্পনা চাওলা কিংবা সানিয়া মির্জা কিংবা সানি লিওনে বানাতে চান ? খাঁটি গ্রহরত্ন ব্যবহার করে অব্যর্থ ফল পান।”
এ পোড়া দেশে আইন আছে প্রচুর। কিন্তু আইন রক্ষা করার কেউ নেই। আইন প্রয়োগ করার কেউ নেই। প্রতারক জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে কি মামলা করা যায় এমন আইন আছে? বুজরুকির বিরুদ্ধে কি ভারতে কোনো আইন নেই ? গোখলে বলেছিলেন – “What Bengal thinks to-day, India think tomorrow.” বেঙ্গল, মানে পশ্চিমবঙ্গ কি এইসব অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে ? দিল্লি হাইকোর্টের এক বেঞ্চ দিল্লি সরকারকে নোটিস পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন – অলৌকিক ক্ষমতা বলে অসুখ বা কোনো সমস্যার সমাধানের প্রলোভন দেখালে তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন, প্রকাশক ও প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে যেন ‘ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ (অবজেকশনাবল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪’ অনুসারে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হবে। (দৈনিক বর্তমান ১ মে, ২০০৩) এই নোটিস জারি করা হয় ২৮ নভেম্বর ২০০১ সালে। বলা হয়েছে – ম্যাজিক বা অলৌকিক ক্ষমতাবলে অসুখ সারানো বা মানসিক কোনো সম্যা সমাধানের প্রলোভন দেখানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসবের বিজ্ঞাপন দেওয়াও বেআইনি। এই আইন চালু আছে ১৯৫৪ সাল থেকেই। এই আইন প্রথমবার ভাঙলে ছয় মাসের জেল ও ১০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। পরবর্তী অপরাধের জন্য এক বছর কারাদণ্ড হতে পারে। এই আইনের ঠ্যালায় যেসব স্বনামধন্য জ্যোতিষীরা দিল্লিতে জ্যোতিষগিরি করতে যেতেন তাঁদের ক্ষমতা হল খতম। দিল্লির তল্পিতল্পা গুটিয়ে জ্যোতিষীবাবুরা কলকাতায় পিছটান দিলেন। যাবে কোথায় ! আইনের হাত অনেক লম্বা। ১৯৯৭ সালের ১৮ জানুয়ারি, ‘The Indian Expressপত্রিকায় যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল তা দেখে তাবড় তাবড় জ্যোতিষী এবং জ্যোতিষবিশ্বাসীদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল, তা হল – “Gang of six impostors arrested। এরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ছয় জ্যোতিষী। অপরাধ অবশ্যই ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রিমেডিস (অবজেকশনাবল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইনের ৪, ৫, ও ৭ ধারা ভঙ্গ। তবু আজও জ্যোতিষচর্চা আর জ্যোতিষবাবুদের লোক ঠকানোর ব্যাবসা বহাল তবিয়তে চলছে।পাশাপাশি চলছে এই বুজরুকি ব্যাবসার অবলুপ্তির আন্দোলন। নিষিদ্ধ হোক প্রতারণা, জ্যোতিষ ব্যবসা। কঠোর থেকে কঠোরতর হোক আইন।
আমার এই লেখা পড়ে কোনো জ্যোতিষবাবু যদি বলেন জ্যোতিষ শাস্ত্র জ্যোতিষ বিজ্ঞান জ্যোতিষ চাঁদ-সূর্যের মতো সত্য, তবে তাঁদের জন্য আমার কাছে সুখবর আছে। রেইকি গ্রান্ডমাস্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষ ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের জন্য ২০ লক্ষ ভারতীয় টাকার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছেন যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ। এই চ্যালেঞ্জ ওনার মৃত্যু পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, যতদিন প্রথম অলৌকিক ক্ষমতাবানের সাক্ষাৎ না হবে। অংশগ্রহণকারীরা কীভাবে তাঁদের সত্যতা প্রমাণ করবেন, তার বিস্তারিত প্রবীরবাবুর কাছেই পাবেন। প্রবীরবাবু আপনার জন্য আপনার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শন করার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। যোগাযোগের ঠিকানা  : প্রবীর ঘোষ, ৭২/৮ দেবীনিবাস রোড, কলকাতা – ৭০০০৭৪।
=======================================
কৃতজ্ঞতা সূত্র : (১) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী – ফলিত জ্যোতিষ (২) বিজ্ঞান বার্তা প্রকাশনী -- জ্যোতিষের জালিয়াতি (৩) অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় -- জ্যোতিষ কি আদৌ বিজ্ঞান ? (৪) রত্নজিজ্ঞাসা – পীযূস দাস (৫) অর্জুন রায় -- জ্যোতিষ সম্পর্কে কয়েকটি অপ্রিয় প্রশ্ন (৬) ডাঃ পার্থসারথী গুপ্ত – বিজ্ঞানের আলোয় জ্যোতিষ (৭) গৌরীপ্রসাদ ঘোষ -- মহাবিশ্বে মহাকাশে (৮) নন্দলাল মাইতি – ইতিহাসে জ্যোতিষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান (৯) অরূপরতন ভট্টাচার্য – প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান (১০) প্রবীর ঘোষ – জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক (১১) প্রবীর ঘোষ – অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)।