শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৬

ভারতবর্ষে ইসলাম : প্রবেশ এবং প্রস্থান (প্রথম পর্ব)



[মুখবন্ধ : এই প্রবন্ধটির বিষয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অতএব লেখা চলাকালীন  যথাযথ যুক্তি ছাড়া কারোকে আলটপকা মন্তব্য না-করার অনুরোধ রাখছি। লেখা প্রথম থেকে না-পড়ে মাঝখান থেকে কেউ মন্তব্য করবেন না। যদি কারোর মনে হয় তিনি আমার জানার বাইরে আরও বেশি কিছু জানেন, তাহলে লিখিতভাবে বক্তব্য রেখে আপনি যা জানেন সেটা সবাইকে জানান। সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন কোনোরকম কটুক্তি ডিলিট করে দেওয়া হবে, বারবার একই আচরণ করলে সোজা ‘নোটিশ’। বিতর্ক অনাবশ্যক, আলোচনা চলতেই পারে।এটি একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ, গবেষণা করতে গিয়ে যেসব গ্রন্থাদির সহায়তা নেব, সেগুলি শেষ পর্বে উল্লেখ করা হবে। যেহেতু প্রবন্ধটি ইতিহাস নয়, ইতিহাসের ইতিহাস – সে কারণে আমার জানার সঙ্গে আপনার জানা সবসময় নাও মিলতে পারে।প্রতিটি ধর্মব্যবস্থায় যেমন ভালোর দিক আছে, তেমনি মন্দের দিকও আছে -- আমার লেখায় দুটি দিকই আলোচিত হবে, কোনোরকম ফিল্টার ছাড়াই।]

“কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে/কত মানুষের ধারা/দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে/ সমুদ্রে হল হারা।/হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/হেথায় দ্রাবিড়, চীন--/শক-হুন-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন।/পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,/সেথা হতে সবে আনে উপহার,/দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে,/এই ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে।/……………..এসো হে আর্য, এসো অনার্য,/হিন্দু মুসলমান।/এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,/ এসো এসো খৃস্টান।/এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন/ধরো হাত সবাকার,/এসো হে পতিত করো অপনীত/সব অপমানভার।/মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা/মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,/সবারে-পরশে-পবিত্র-করা/তীর্থনীরে।/ আজি ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে।”

ভারতে ইসলাম তথা মুসলমানদের ইতিহাস নিয়ে লিখতে বসে মহামানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি উল্লেখ না-করে শুরু করতে পারছিলাম না। প্রায় ৭০০ বছরের ইতিহাস তো সোজা কথা নয়। ভারতবর্ষের পরতে পরতে মুসলিমদের সুকীর্তিতে যেমন উজ্জ্বল হয়ে আছে, কুকীর্তিতেও তেমন কালিমালিপ্ত হয়ে আছে।আর্য-অনার্য-হিন্দু-মুসলমান-ইংরাজ-খ্রিস্টান যখন এক দেহে লীন হয়, তখন সেই দেশে একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের ইতিহাস লেখা সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে সেই ধর্মাবলম্বীদের শাসনকাল যদি ৭০০ বছরের হয়। না, ঠিক ইতিহাস নয় হয়তো – ইতিহাসের ইতিহাস।
সেই ইতিহাসের সন্ধান তো করবই, তার আগে জানা প্রয়োজন ইসলাম ধর্মের ইতিহাস। ইসলাম একটি একেশ্বরবাদী এবং আব্রাহামিক ধর্ম । কোরান দ্বারা পরিচালিত --  যা  এমন এক কিতাব যা  হবহু আল্লাহর বাণী এবং ইসলামের প্রধান নবি মোহাম্মদের প্রদত্ত শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনাদর্শও এর ভিত্তি । বলা হয় সুন্নাহ এবং হাদিস নামে লিপিবদ্ধ রয়েছে । ইসলামের অনুসারীরা মোহাম্মদকে শেষ নবি বলে মনে করেন।অনেকের ধারণা যে মোহাম্মদ হলেন এই ধর্মের প্রবর্তক। তবে মুসলিমদের মতে, তিনি এই ধর্মের প্রবর্তক নন। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রসুল বা পয়গম্বর। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে তিনি এই ধর্ম পুনঃপ্রচার করেন। পবিত্র কোরান ইসলাম ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের মুসলমান বা মুসলিম বলা হয়। পবিত্র কোরান আল্লাহর বাণী এবং এটি তার কর্তৃক মোহাম্মদের নিকট প্রেরিত বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন। তাদের বিশ্বাস অনুসারে মোহাম্মদ শেষ নবি। হাদিসে প্রাপ্ত তাঁর নির্দেশিত কাজ ও শিক্ষার ভিত্তিতে কোরানকে ব্যাখ্যা করা হয়। তবে কোনো হাদিসের মর্মার্থ কোরানের বিরুদ্ধে গেলে তা বাতিল বলে গণ্য হয়।

মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসের মূল ভিত্তি এক আল্লাহ, অর্থাৎ একত্ববাদ। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ মানবজাতির জন্য তাঁর বাণী ফেরেস্তা জিব্রাইলের মাধ্যমে রসুল মোহাম্মদের নিকট অবতীর্ণ করেন। কোরানে বর্ণিত ‘খতমে নবুয়জত’-এর ভিত্তিতে মুসলমানরা তাঁকে শেষ বাণীবাহক (রসুল) বলে বিশ্বাস করেন। তারা আরও বিশ্বাস করেন, তাদের পবিত্র গ্রন্থ কোরান নিখুঁত, অবিকৃত ও মানব এবং জিন জাতির উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ আল্লাহর সর্বশেষ বাণী, যা পুনরুত্থান বা কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। তবে মুসলিমদের মধ্যে আহ্মদি নামক একটি সম্প্রদায় মনে করে মোহাম্মদ শেষ নবি নন। বরং যুগের চাহিদা মোতাবেক নবুওয়াতের ধারা অব্যাহত থাকবে। শিয়াদের একটি বিরাট অংশবিশেষ ইসমাইলীয়দের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস যে, ইমাম ইসমাইল আখরি নবি ছিলেন। ইসলামের দৃষ্টিতে ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মাবলম্বীরাই আব্রাহামের শিক্ষার ঐতিহ্য পরম্পরা। উভয় ধর্মাবলম্বীকে কোরানে ‘আহলে কিতাব’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বহুদেবতাবাদীদের থেকে আলাদা করা হয়েছে। পবিত্র কোরানের সুরা আলে ইমরানে আহ্বান করা হয়েছে -- “তুমি (মুহাম্মদ) বলো, হে কিতাবীগণ, এসো সেই কথায় যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে এক। যেন আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারও ইবাদত গ্রহণ না-করি। কোনো কিছুকেই যেন তাঁর শরিক না-করি। এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য হিসাবে গ্রহণ না-করি। যদি তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলো, তোমরা সাক্ষী থাক -- অবশ্যই আমরা মুসলিম।" (৩:৬৪)
এই ধর্ম দুটির গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের উল্লেখ কোরানেও আছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আছে পার্থক্য। ইসলামি বিশ্বাসানুসারে এই দুই ধর্মের অনুসারীগণ তাদের নিকট প্রদত্ত আল্লাহর বাণীর অর্থগত ও নানাবিধ বিকৃতসাধন করেছেন; ইহুদিগণ তৌরাতকে (তোরাহ) ও খ্রিস্টানগণ ইনজিলকে (নতুন বাইবেল)। মুসলমানদের বিশ্বাস ইসলাম ধর্ম আদি এবং অন্ত এবং স্রষ্টার নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম। আল্লাহ শব্দটি ‘আল’ এবং ‘ইলাহ’ যোগে গঠিত। আল অর্থ সুনির্দিষ্ট এবং ইলাহ অর্থ উপাস্য, যার অর্থ সুনির্দিষ্ট উপাস্য। খ্রিস্টানগণ খ্রিস্টধর্মকে ‘একেশ্বরবাদী’ বলে দাবি করলেও মুসলমানগণ খ্রিস্টানদের ‘ত্রিত্ববাদ’ (Trinity) বা এক ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মিলন, এই বিশ্বাসকে বহু-ঈশ্বরবাদী ধারণা বলে অস্বীকার করেন। ইসলামি ধারণায় আল্লাহ সম্পূর্ণ অতুলনীয় ও পৌত্তলিকতার অসমতুল্য, যার কোনোপ্রকার আবয়বিক বর্ণনা অসম্ভব। এধরনের অবয়বহীনতার ধারণা ইহুদি ও কিছু খ্রিস্টান বিশ্বাসেও দেখা যায়। মুসলমানরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে বর্ণনা করেন তাঁর বিভিন্ন গুণবাচক নাম ও গুণাবলির মাধ্যমে।কোরান মুসলমানদের মূল ধর্মগ্রন্থ। তাদের বিশ্বাস পবিত্র এই কোরান স্রষ্টার অবিকৃত, হুবহু অনুসরণ করা বক্তব্য। এর আগে স্রষ্টা প্রত্যেক জাতিকে বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠিয়েছেন, কিন্তু সেগুলিকে বিকৃত করা হয়। কোরানকে বলা হয় ‘আল-কোরান’ বা ‘কোরান শরিফ’।
ইসলাম মতে জিব্রাইল ফেরেশতার মাধ্যমে নবি মোহাম্মদের নিকট ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬ জুলাই, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে স্রষ্টা তাঁর বাণী অবতীর্ণ করেন। বিশ্বাসীরা মনে করেন, এই বাণী তাঁর অন্তঃস্থ ছিল, সংরক্ষণের জন্য তাঁর অনুসারীদের দ্বারা পাথর, পাতা ও চামড়ার ওপর লিখেও রাখা হয়। অধিকাংশ মুসলমান পবিত্র কোরানের যেকোনো পাণ্ডুলিপিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন, স্পর্শ করার পূর্বে ওজু করে নেন। তবে, ওজু ছাড়াও এ কোরান পাঠ করা যায়। কোরান জীর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লে আবর্জনা হিসাবে ফেলে দেওয়া হয় না, বরং কবর দেওয়ার মতো করে মাটির নিচে রেখে দেওয়া হয় বা পরিষ্কার জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।বেশিরভাগ মুসলমানই কোরানের কিছু অংশ এর মূল ভাষা আরবিতে মুখস্থ করে থাকেন, কমপক্ষে যেটুকু আয়াত নামাজ আদায়ের জন্য পড়া হয়। সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থকারীদের ‘হাফিজ’ বলা হয়। মুসলমানরা আরবি কোরানকেই কেবলমাত্র নিখুঁত ও খাঁটি বলে বিশ্বাস করেন। সকল অনুবাদ মানুষের কাজের কারণে এতে ভুলত্রুটি থাকার সম্ভাবনা থেকেই যায়। বিষয়বস্তুর মূল প্রেরণা ও সঠিক উপস্থাপনা অনুবাদকর্মে অনুপস্থিত থাকতে পারে, না-হলে অনুবাদসমূহকে কখনোই আরবি কোরানের সমতুল্য ও সমান নিখুঁত গণ্য করা হয় না। বরং এগুলিকে সর্বোচ্চ ‘অর্থানুবাদ’ হিসাবে অভিহিত করা হয়।
মুসলমানগণ প্রধান দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত -- শিয়া ও সুন্নি। শিয়া মাজহাব মুসলিম মাজহাবগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো মাজহাব নয়।
মুসলিম মাজহাবগুলির মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য আছে। যদিও সেগুলির বেশিরভাগই কালাম শাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং বেশিরভাগ সাধারণ মুসলমানই সেগুলি সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও বহু অভিন্ন বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়, যা এই মাজহাবগুলির ঐক্যের বন্ধন হিসাবে কাজ করতে পারে। এসব অভিন্ন বিষয়ের সংখ্যা বিভেদ সৃষ্টিকারী বিষয়গুলির তুলনায় অনেক বেশি। আক্ষেপ এই যে, মতানৈক্য সৃষ্টিকারীরা যৌথ বা অভিন্ন বিষয়গুলি যেন তুলে না-ধরারই পণ করেছেন।বিভিন্ন মাজহাবের ফিকাহগত বিষয়, যেমন -- বিয়ে, তালাক, হজ, উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভূত মিল আছে। শিয়া ফিকাহতেও উপরোক্ত বিষয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের অপর ৪ মাজহাবের সঙ্গে মিল আছে। মাসলা-মাসায়েলের মতো শাখাগত বিষয়, এমনকি কোনো কোনো বিষয়ের ফরজ হওয়া বা ফরজ না-হওয়া নিয়ে সুন্নিদের মাজহাবগুলির মধ্যেই অনেক মতপার্থক্য দেখা যায়, শিয়া মাজহাবও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোতে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলের সংখ্যাই বেশি। যেমন -- শিয়া ও সুন্নি উভয় মাজহাবই এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহতে বিশ্বাসী। বিশ্বনবি হজরত মোহাম্মদকে শেষ নবি ও রসুল মনে করে। কোরানকেও অবিকৃত মনে করে উভয় মাজহাবই। উভয় মাজহাবই বিশুদ্ধ হাদিসকে মান্য করতে বলে। উভয় মাজহাবই রোজা রাখা, নামাজ কায়েম করা, জাকাত দেওয়া, হজ পালন, অতীতের নবি-রসুলদের স্বীকৃতি দেওয়া, কিয়ামত বা পুনরুত্থানে বিশ্বাস ইত্যাদিকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অংশ মনে করে।

শিয়া ও সুন্নি পার্থক্যের কয়েকটি দিক হল -- শিয়াদের প্রধান ধারা বা ১২ ইমামি শিয়া মুসলমানরা মনে করেন রসুলের পর কে মুসলমানদের নেতা বা খলিফা হবেন তা ‘তানসিসি’ বিষয়। অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে ও রসুলের ব্যাখ্যার মাধ্যমে খলিফা বা ইমাম নির্বাচিত হবেন।অন্যদিকে সুন্নি মুসলমানরা মনে করেন এই পদে কে বসবেন তা বেছে নেয়াম মাধ্যমে নির্ধারণযোগ্য বিষয়। শিয়া মুসলমানরা মনে করেন রসুলের পবিত্র আহলে বাইত থেকেই মুসলমানদের রসুল পরবর্তী ইমাম বা নেতা কিংবা কোরানের ভাষায় ‘উলিল আমর’ মনোনীত হয়েছেন। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলি ও তাঁর বংশে জন্ম নেওয়া আরও ১১ জন ইমাম মুসলমানদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসুলের মনোনীত নেতা। হজরত ইমাম মাহদি এই ১২ জন ইমামের মধ্যে সর্বশেষ ইমাম। শিয়া মুসলমানরা এই ১২ ইমামকে নিষ্পাপ মনে করেন এবং তারা কখনও ভুলও করেন না। কোনো সুস্থ ও বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে বিষপান যেমন অসম্ভব বিষয়, তাঁদের জন্যও পাপ ও ভুল করা অসম্ভব বিষয়। পবিত্র কোরআনে সুরা আহজাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে বিশ্বনবির আহলে বাইত সম্পর্কে বলা হয়েছে – “হে নবির আহলে বাইত। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে।”
সুন্নি মুসলমানরাও শিয়া মুসলমানদের সব ইমামকেই শ্রদ্ধা করেন এবং তাঁদেরকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মুসলমান বলে মনে করেন, তাঁরা সবাই আল্লাহর মনোনীত খলিফা বা ইমাম ছিলেন বলে সুন্নি সম্প্রদায়রা মনে করেন না। সুন্নি মুসলমানরা হজরত আলিকে চতুর্থ খলিফা হিসাবে সম্মান করেন। শিয়াদের দৃষ্টিতে আহলে বাইতের সদস্য বলে বিবেচিত হজরত ফাতিমাকে সুন্নিরাও বেহেশতি নারীদের সর্দার মনে করেন। তাঁর দুই পুত্র হজরত ইমাম হাসান ও হোসাইনকেও বেহেশতি যুবকদের সর্দার মনে করেন সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলিরা। শিয়া ভাইদের ১২ জন ইমামের সবার নামই পবিত্র মদিনার মসজিদুন্নবীর ছাদ-সংলগ্ন বিভিন্ন বিম বা পিলারে এখনও খচিত রয়েছে। সুন্নি ভাইরাও ইমাম মাহদিকে মুসলমানদের শেষ ইমাম মনে করেন।তবে তাঁর জন্মকাল ও আবির্ভাব নিয়ে এ দুই মাজহাবের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমগণ মনে করেন আল্লাহ মুসলমানদের জন্য সবসময়ই নেতা বা ইমামের ব্যবস্থা করেছেন। এখনও ইমাম মাহদি মুসলমানদের নেতা। তবে তিনি জন্মের কিছুকাল পর অদৃশ্য অবস্থায় আছেন এবং শ্রেষ্ঠ ইসলামি আইনবিদ বা ওলিয়ে ফকিহ ইমাম মাহদিষ প্রতিনিধি হিসাবে মুসলমানদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার পিতা ইমাম হাসান আসকারি ছিলেন মুসলমানদের ১১তম ইমাম। উপযুক্ত সময়ে ও পরিবেশে ইমাম মাহদি আবারও আবির্ভূত হবেন এবং হজরত ঈসা হবেন তাঁর সহকারী। ইমাম মাহদি সারা বিশ্বে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। সুন্নি মুসলমানরাও মনে করেন ইমাম মাহদি সারাবিশ্বে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন এবং হজরত ঈসা হবেন তাঁর সহকারী। তবে সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমানদের অনেকেই তাঁর জন্ম এখনও হয়নি বলে মনে করেন না।সুন্নি মাজহাবের অন্যতম প্রধান ইমাম আবু হানিফা ও মালিকি মাজহাবের প্রধান মালিক ইবনে আনাস ছিলেন শিয়া মুসলমানদের ষষ্ঠ ইমাম হজরত জাফর সাদিকের ছাত্র।

প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমদের সম্পর্কে একটা মারাত্মক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে অনেকের মধ্যে। এ ভুল ধারণাটি হল, শিয়ারা হজরত আলিকে মর্যাদার দিক থেকে রসুলের সমতুল্য মনে করে। কিন্তু এ অভিযোগ মোটেই সত্য নয়। শিয়া মুসলমানরা এবং তাঁদের ইমামরাই হজরত মোহাম্মদকে সবদিক থেকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মনে করেন। বস্তুত শিয়া-সুন্নির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সুন্নি মুসলমানরা নবির ওয়ারিশদের ভালোবাসে। হজরত আলিকে ইসলামের জ্ঞানী ব্যক্তি হিসাবে জানে।ইসলামের মুল বিষয়গুলি একই। সামান্য যে বিষয়গুলি নিয়ে মতভেদ আছে, তা অতি সামান্য। তাই শক্তিশালী মুসলিম জাতি গঠনে সামান্য মতভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করে। মাজহাব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। কোন মাজহাব ভালো বা সঠিক তা নিয়ে বিভেদ এ তর্ক ঠিক নয়।অতএব শিয়া সম্প্রদায় মুসলমান সুন্নিদের হত্যা করবে, আর সুন্নিরা শিয়া সম্প্রদায় মুসলমানকে হত্যা করবে এটা তো কোনো মাজহাবই মেনে নেয় না। বস্তুত মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করা হারাম।
সেসময় তো আরবদেশে তথা পৃথিবীতে ইহুদি, খ্রিস্টধর্মের মতো অন্য সুসংগঠিত ধর্মপ্রতিষ্ঠান তো ছিলই। তবে কেন ইসলাম ধর্মের প্রয়োজন হয়ে পড়ল আরববাসীদের ? ‘জাজিরাতুল আরব’ অর্থ হল আরব উপদ্বীপ। ভারতবর্ষের পশ্চিমদিকে আরবসাগরের ওপারে আরব দেশ।আরবের উত্তরে ইরাক জর্ডন ও সিনাই উপদ্বীপ, পূর্বে পারস্য উপসাগর ও আরবসাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর, সুয়েজ খাল ও সিনাই মরুভূমি। ‘আরব’ শব্দটির অর্থই মরুভূমি।কাহতানের পুত্রসন্তান ইয়ারেবের নামানুসারেই এদেশের নাম হয়েছে আরব। নুহের এক পু্ত্রের নাম ছিল সাম। এই সামের নামানুসারে অনেকে আরবকে ‘সিমেটিক’ বলে উল্লেখ করে।
আরবের অধিবাসীদের দুই ভাগে ভাগ করা হত। একদল যারা এক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, কৃষিকার্য ও ব্যাবসাবাণিজ্য করে জীবিকা অর্জন করে তাদের বলা হয় মেদুইন। অপরদল যাদের কোনো স্থায়ী বাসস্থান নেই তাঁবু পেতে জায়গা পরিবর্তন করে জীবনযাপন করে, পশুপালন, লুঠতরাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের যাযাবর বা বেদুইন বলা হয়।এরা যেমন অতিথিপরায়ণ ছিলেন তেমনি সাহসী জাতি ছিলেন । কঠিন প্রাকৃতিক আবহাওয়া তাঁদের উগ্র নিষ্ঠুর করে তোলে।
প্রাচীনকালে আরব ছিল অন্ধকারের যুগ।এই অন্ধকারময় যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞতার যুগও বলে।এই সময় আরববাসী নানারকমের নোংরামি, ভণ্ডামি, অত্যাচার, ব্যাভিচার, হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ-বিগ্রহ করে ব্যস্ত থাকত।এদের কোনো সামাজিক বন্ধন ছিল না।বহুবিবাহ, মদ, জুয়া, দাবা ধনী মানুষের নিত্যসঙ্গী। দাসেদের জীবন ছিল দুর্বিসহ।মেলায়, হাটে দাসী বিক্রি হত পশুর মতো।নারীর ন্যূনতম মর্যাদা ছিল না। কোনো নারীকে স্ত্রী হিসাবে রাখার কয়েকদিন পর ছেঁড়া জুতোর মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত। পুরুষরা সৎ মা, পিসিমা, মাসিমা, ভাগ্নি, দুধ-মা, সহদোরা বোনকেও তাঁরা বিবাহ করত। একজন পুরুষ যেমন একাধিক নারীকে বিয়ে করত, তেমনি একজন নারী একাধিক পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করত। পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, আভিজাত্যের দম্ভ আরব চরিত্রকে কলুষিত করল।
হজরত মোহাম্মদের আবির্ভাবকালে আরবে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। আরববাসীরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। রাত পোহালে গোত্রে গোত্রে লড়াই, ঝগড়া, যুদ্ধ লেগেই থাকত। আইন বলতে কিছু ছিল না। জোর যার মুলুক তার।সামান্য ছাগল-মুরগি নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ লেগে যেত গোত্রে গোত্রে। নিজ গোত্রের ন্যায় অন্যায় কাজের প্রতি ছিল তাদের চরম আনুগত্য, কিন্তু অপরের সঙ্গে ছিল ব্যাপক বৈরিতা। এই সুযোগে বিদেশিরা এসে লুঠ ও ভূখণ্ড দখল করে নিত ।  বিচার বলতে ছিল ‘রক্তের বদলে রক্ত, ‘নখের বদলে নখ’, ‘দাঁতের বদলে দাঁত’, ‘চোখের বদলে চোখ’। বিচারালয়, জেলখানা কিছুই ছিল না সেসময়।(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই: