শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

সংস্কৃত সাহিত্য : সনাতন ধর্মের প্রাণভোমরা (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)



এতক্ষণ আমরা যে যে বিষয়গুলি আলোচনা করলাম তার সবকটিই লিখিত নয়, লোকের মুখে মুখে শুনে বংশপরম্পরায় প্রচারিত ও মান্য করা হত। পরে এগুলি লিখিত আকারে সংরক্ষিত করা হয়। সেই লিখিত আকারই ছাপার অক্ষরে আমাদের কাছে সুলভ হয়েছে আরও পরে। এবার আমি এমন কিছু গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করব যেগুলি প্রায় গোড়া থেকেই লিখিত রূপ ছিল, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে আসছে। আসলে প্রাচীন যুগে সব সাহিত্যই হত রাজকাহিনি এবং এই রাজকাহিনি হৃষ্টপুষ্ট হত ঈশ্বরের উপস্থিতিতে। কারণ যতসব অবাস্তব অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে রাজাকেই সর্বোচ্চে রাখতেন প্রাচীন যুগের কবিরা। এইসব কবিরা রাজার তত্ত্বাবধানে থেকে রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজার গুণকীর্তন করতেন এবং ঈশ্বরপুষ্ট হয়ে রাজকাহিনি লিখতেন। সেই কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে যেখানেই অন্যায় অবিচার অবমাননার প্রয়োজন সেখানেই ঈশ্বরের অনুষঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। ঈশ্বর ছাড়া অবাস্তব কাহিনি উপস্থাপন করার সুযোগ কোথায় যেমন রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদভগবদগীতা ইত্যাদি। শাসকের অন্যায় কাজকর্মগুলিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হত নিজেদের মানদণ্ডে যুক্তি খাড়া করে। বস্তুত আর্য ভার্সেস অনার্যের ন্যায়-অন্যায়ের কাহিনি। মোগলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিল না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠী এবং তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও রোলার চালিয়েছিল, চালিয়েছিল ব্যাপক আক্রমণ, হত্যাকাণ্ড। আর এই আক্রমণই আর্য-অনার্যের যুদ্ধ, সুরাসুরের জমি দখলের লড়াই। আর্যরা সেইসব দেবদেবতা -- অনার্যরাই দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ষস, অসুর সাব্যস্ত হল। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারত উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীরা আর্যদের পক্ষেই থেকে গেলেন। অথচ তারা ভুলে যায় একদিন আর্যদের আক্রমণের ফলেই ধ্বংস হয়ে যায় আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সিন্ধুসভ্যতা। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীকে দাসে পরিণত করার লক্ষ্যে যে চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, শেষপর্যন্ত এতে সফলও হয় তারা। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক, দেবতা বা দেবতাতূল্য। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসাবেই স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠল 'মনুসংহিতাযেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে বিদ্রোহী করতে থাকল, তারাই অছ্যুৎ, দস্যু, অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। এইসব অস্পৃশ্যদের যখন খুশি ন্যাংটো করে দেওয়া যায়, ন্যাংটো করে দৌড় করানোও যায়।




আশির দশকের মাঝামাঝি বছরে রামানন্দ সাগরের রামায়ণভারতের দূরদর্শনে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। হয়েছিল তুমূল বিতর্ক। বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শকরা অভিযোগ করতে থাকলেন যে তাঁদের রামায়ণে যা আছে রামানন্দ সাগরের রামায়ণে তা মিলছে না। সেই বিতর্ক মেটাতে রামানন্দ সাগর টাইটেলে বিস্তারিত জানিয়ে দিলেন কোন্ রামায়ণের কোন্ কাহিনি।





রামায়ণ একটি মহাকাব্য। মূল রামায়ণটি সংস্কৃত বা দেবনাগরী ভাষায় রচনা করেছেন আদিকবি বাল্মীকি। সংস্কৃত ভাষা সকলের কাছে বোধগম্য না-হওয়ায় ভারতের বিভিন্ন ভাষায় ভাবানূদিত রামায়ণ বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যেমন বাঙালিদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় রামায়ণ কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা ভাষায় ভাবানূদিত শ্রীরাম পাঁচালী’ (খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী), তেমনি গো-বলয়ে হিন্দি ভাষায় ভাবানূদিত তুলসীদাস গোস্বামীর রামচরিতমানস’ (খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দী)। এছাড়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তামিল ভাষায় কম্বন কর্তৃক রচিত রামাবতারম্’ (খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী) ইত্যাদি নানা ভারতীয় ভাষায় লেখা রামায়ণ সেই সেই ভাষাভাষীর রাজ্যে গ্রহণীয় হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের মূল পাঠটি বাল্মীকি রামায়ণনামে পরিচিত। এই গ্রন্থের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, রামায়ণ-উপাখ্যানের পটভূমি ত্রেতাযুগ নামে পরিচিত পৌরাণিক সময়কাল। মূল রামায়ণের একাধিক আঞ্চলিক পাঠান্তর, সংস্করণ ও উপসংস্করণ বিদ্যমান। পুথিবিশারদ রবার্ট পি. গোল্ডম্যান এই সংস্করণগুলিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন -- (ক) উত্তর ভারতীয় ও (খ) দক্ষিণ ভারতীয়।




যাই হোক, বাল্মীকি রামায়ণের প্রথম ও শেষ কাণ্ডদুটি মূল রচয়িতা কর্তৃক রচিত কি না সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। রঘুনাথন মনে করেন, এই দুই কাণ্ডের কয়েকটি প্রক্ষিপ্তাংশ বর্তমানে মূল রামায়ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হলেও, গ্রন্থের অন্যান্য অংশের সঙ্গে এই অংশগুলির শৈলীগত পার্থক্য এবং আখ্যানগত স্ববিরোধ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বাল্মীকির রামায়ণে রামচন্দ্র নামে একটি চরিত্র আছে বটে, কিন্তু সেই রামায়ণের রাম সর্বত্র একইভাবে চিত্রিত নন। এক ভারত বহু সংস্কৃতি। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রাবন্ধিক এ কে রামানুজমের লেখা থ্রি হানড্রেড রামায়নস : ফাইভ এগজাম্পলস অ্যান্ড থ্রি থটস অন ট্রান্সলেশনগ্রন্থে বলেছেন – “ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু বিচিত্র সংস্কৃতির সঙ্গে নানাভাবে রামায়ণের কাহিনি এসেছে, মূল কাহিনির বৃত্তে বৃহত্তর রামচরিত আখ্যাত হয়েছে। একই রামের গল্প মানুষ ফিরে ফিরে লিখেছে, ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বা ভাষ্য তৈরি করেছে। শুধু ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়ের নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গীয় জনজাতির মুখের ভাষা, জীবনযাপন প্রণালী, অন্তরের চিত্রমালা বর্ণিত আছে তাদের রামায়ণ কথায়। এ তাদের আত্মশক্তি জাগরণের এক উপায়ও বটে। বাল্মীকির আগেও রামায়ণ কথা ছিল, পরেও আছে। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বিপুলায়তন এক সাহিত্য সম্পদ।

অতএব বোঝাই যাচ্ছে রামের কাহিনি অনেক প্রাচীনকাল থেকে লোকগাথায়, আখ্যানে, জনমানসে ছিলই। যা সংকলিত করে সুসংঘবদ্ধভাবে প্রথম রূপ দিয়েছিলেন বাল্মীকি। মূল কাহিনির থেকে অনেকটা সরে গিয়ে পরবর্তীকালে সংযোজিত অংশ মিলে মহাকাব্যটির কলেবর বৃদ্ধি লাভ করে। সপ্তকাণ্ড রামায়ণের শেষ কাণ্ড (উত্তরকাণ্ড) বাল্মীকির রচিত নয় বলেই পণ্ডিতরা মনে করেন। সংযোজিত অংশকেই পণ্ডিতরা বলেন প্রক্ষিপ্ত অংশএখানে প্রক্ষিপ্ত মানে, যা বাল্মীকি স্বয়ং লেখেননি, কিন্তু উল্লেখ আছে। কী লেখেননি বাল্মীকি সেটা খোঁজার চেষ্টা করি। বস্তুত সাতটি কাণ্ডে রামায়ণকে আমরা যে রূপে যে আঙ্গিকে যে বর্ণনায় পাই সেটাই রামায়ণের মূল রূপ কি না এবং তা একই কবির রচনা কি না এ বিষয়ে পণ্ডিতদের সন্দেহ আছে। পণ্ডিতরা মনে করেন রামায়ণের আদি ও সপ্তম কাণ্ড পরে সংযোজিত হয়েছে অন্য কারোর দ্বারা। দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ কাণ্ড পর্যন্ত মহাকাব্যটিই প্রাচীন অংশ। আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডের লেখক বা লেখকবৃন্দ উত্তর ভারতের পূর্ব গাঙ্গেয় সমভূমি এবং ষোড়শ মহাজনপদের যুগের কোশল ও মগধ রাজ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেনকারণ উক্ত অংশে এই সকল অঞ্চল সম্পর্কে প্রদত্ত ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক তথ্য এই অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যদিও অরণ্যকাণ্ড থেকে রাক্ষসবধকারী নায়ক ও নানাপ্রকার পৌরাণিক জীবজন্তুর উপস্থিতিতে সহসাই এই উপাখ্যান কল্পকাহিনিমূলক হয়ে পড়েছে। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের ভৌগোলিক তথ্য এখানে অত্যন্ত অস্পষ্ট। লঙ্কাদ্বীপে ভৌগোলিক অবস্থানটিও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই সকল তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ঐতিহাসিক এইচ. ডি. সংকলিয়া খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীকে এই মহাকাব্যের রচনাকাল বলে উল্লেখ করেন। এ. এল. ব্যাসাম অবশ্য এই মত প্রকাশ করেছেন যে রাম সম্ভবত ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম অথবা সপ্তম শতাব্দীর এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতি। দেখা যাক প্রক্ষিপ্তের যুক্তি কী – (১) আদি কাণ্ড ও সপ্তম কাণ্ডে রামচন্দ্র হলেন বিষ্ণুর অবতার। কিন্তু বাকি পাঁচটি কাণ্ডে দেখা যায় যে তিনি একজন আদর্শ, অমিতবিক্রমী মানুষ (যদিও গোটা রামায়ণে রামচন্দ্রের অমিতবিক্রমের কোনো পরিচয়ই আমি পাইনি।বিক্রম যা পেয়েছি তার সবই ঐশ্বরিক সহায়তা, অলৌকিকতা এবং অনৈতিক চতুরতা)।(২) আদি কাণ্ড ও সপ্তম কাণ্ডের রচনাশৈলী ও ভাষা অন্য বাকি পাঁচটি কাণ্ডের তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের।(৩) আদি কাণ্ডে যেসব কথা বলা হয়েছে অপর পাঁচটি কাণ্ডের মধ্যে কোথাও তার সমর্থন বা উল্লেখ তো নেই-ই, উপরন্তু তার বিরোধিতা বা বৈপরীত্য দেখা যায়। (৪) যুদ্ধকাণ্ডের শেষে রামায়ণ পাঠের ফলের উল্লেখ আছে। এটাই প্রাচীন মূল গ্রন্থের সমাপ্তি বাক্য বলেই মনে হয়।(৫) উত্তরকাণ্ডের বিস্তৃত পরিসরে রাম-সীতার প্রসঙ্গ এসেছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। অবশিষ্ট অংশ নানা অলৌকিক আখ্যানের সমাবেশে পূর্ণ। (৬) আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড বাল্মীকিকে রামচন্দ্রের সমসাময়িক কবিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল রামায়ণে বাল্মীকি কিন্তু পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব। (৭) রামায়ণের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ কাণ্ডগুলির নামকরণ করা হয়েছে বিষয়বস্তু অনুসারে। যেমন অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড প্রভৃতি। কিন্তু প্রথম ও সপ্তম কাণ্ডের নাম আদিএবং উত্তরকাণ্ড বিষয়বস্তু অনুসারে হয়নি। (৮) প্রথম এবং সপ্তম কাণ্ডে বাল্মীকি নিজেই মহাকাব্যটির একটি চরিত্র।কিন্তু মাঝের বাকি পাঁচটি কাণ্ডে চরিত্র তো ননই, এমনকি কোথাও তাঁর নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই।এরকম আরও অসংলগ্ন এবং অসামঞ্জস্য বিষয় পরিলক্ষিত হয়। মূল রামায়ণেই এই অবস্থা, পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণ ভাবানূদিত হয়ে প্রচুর নতুন নতুন উপাখ্যান সংযোজিত হয়েছে।




মহাকবি বাল্মীকি অমরকাব্য রামায়ণতাঁর হৃদয়ের অপূর্ব মাধুরী দিয়ে রচনা করেছিলেন। তমসা নদীর তীরে এক ব্যাধের শরাঘাতে নিহত ক্রৌঞ্চের বিরহে ক্রৌঞ্চবধূর করুণ ক্রন্দন বাল্মীকির হৃদয়কে বিদীর্ণ করে। তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে তীব্র অভিশাপবাণী – “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শ্বাশতী সমাঃ।/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।সেযুগে ব্রাহ্মণদের অধিকার ছিল অযাচিতভাবে অন্ত্যজদের ক্ষতিসাধন করার, অভিশাপ দেওয়ার। যাই হোক, বাল্মীকির সেই শোক অবশেষে শ্লোকে পরিণত হল। রচিত হল অনুষ্টুপ ছন্দে সুদীর্ঘ কাব্য, ‘রামায়ণরামের কথা নিয়ে যে শুধু বাল্মীকিই কাব্য করেছেন তা নয়। সংস্কৃত ভাষায় আরও বেশ কিছু কবি কাব্য রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত অন্য রামায়ণগুলি হল – ‘আধ্যাত্ম রামায়ণ’, ‘আনন্দ রামায়ণ’, ‘ভুশণ্ডি রামায়ণইত্যাদি। আধ্যাত্ম রামায়ণের মূল কথক মহাদেব বা শিব। অপরদিকে বাল্মীকির রামায়ণের কথক নারদ। বাল্মীকির রামায়ণের বঙ্গীয় পাঠ এবং পূর্ব-ভারতে প্রচলিত রামকাহিনির সমন্বয়ে আনন্দ রামায়ণ -- এই রামায়ণে নয়টি কাণ্ড, সাতটি নয়। ভুশণ্ডি রামায়ণের মূল কথন বাল্মীকি রচিত রামায়ণেরই অনুরূপ (তবে কাহিনিবিন্যাস, পরিকাঠামো, লোকগাথা ভিন্ন চরিত্রের)।বাল্মীকি তাঁর কাব্যে তাঁর দস্যুজীবনের কাহিনি বলেননি। কিন্তু বাঙালিদের কাছে রত্নাকর দস্যুর পাপের ভাগ নেওয়ারগল্পটি খুবই জনপ্রিয়। কারণ এই মনোরঞ্জক গল্পটি কৃত্তিবাস ওঝাই সংযোজন করেছেন তাঁর বাংলা রামায়ণে।এমনকি বাংলার বাঙালিরা প্রতি বছর শরৎকালে যে দুর্গোৎসবে মেতে ওঠেন তা কৃত্তিবাসের রামায়ণ অনুসারেই শরৎকালীন অকালবোধন। বাল্মীকির রামায়ণে এ ঘটনার উল্লেখ নেই। তাহলে কি এ ঘটনা কৃত্তিবাস ওঝার মস্তিষ্কপ্রসূত ? উত্তর এককথায় হ্যাঁবলা যায় না।কারণ এ কাহিনির বীজ আছে ভাগবত পুরাণকালিকাপুরাণ”-এ। কৃত্তিবাসী রামায়ণের দুর্গোৎসব বিবরণের সঙ্গে পৌরাণিক দুর্গোৎসব বর্ণনা ঠিক হুবহু মেলে না। যেসব পুরাণমতে আজ বাংলায় দুর্গাপুজো হয়, তার একটি হল কালিকাপুরাণ। এই পুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপুজোর বর্ণনা পাই। কেন অকালবোধন ? শরৎকাল সূর্যের দক্ষিণায়ণ, দেবতাদের রাত। এই সময় দেবতারা ঘুমোন। শরৎকাল পরে দক্ষিণায়ণের সময়এই সময় দেবতাকে পুজো করতে হলে তাকে জাগরিত করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটিই হল বোধন। বৃহদ্ধর্মপুরাণে চণ্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম ও রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুণ্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।মহাবিপদ কেটে গেল অষ্টমীতে, তাই অষ্টমী হল মহাষ্টমী। রাবণ বধ করে মহাসম্পদ সীতাকে লাভ করলেন রাম, তাই নবমী হল মহানবমী এবং দশমীতে বিজয়ার বিজয়োৎসব। যুদ্ধজয়ের আনন্দ। সিঁদুরখেলা আর আলিঙ্গন।




এরকম প্রচুর ভিন্ন ভিন্ন গল্প পাওয়া যায় বিভিন্ন রামায়ণে। আবার বৌদ্ধদের রামের কাহিনি দশরথ-জাতক’-এ রাম ও সীতা একে-অপরের ভাইবোন (এই রামকথায় কোনো মুনিঋষি নেই, দণ্ডকারণ্য নেই, বানরগোষ্ঠী নেই, রাবণ নেই, সীতাহরণও নেই)। কৃষিনির্ভর মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ভাইবোনের বিয়ে স্বাভাবিকই ছিল। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই ! আবার থাইল্যান্ডের রামায়ণের সঙ্গে কৃত্তিবাসী রামায়ণ এক নয়। ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণের সঙ্গে তুলসীদাসের রামায়ণে প্রচুর গরমিল। তামিল ভাষায় রচিত কম্বন রামায়ণের সঙ্গে খোটানের রামায়ণেও অনেক অমিল। কন্নড় ভাষায় রচিত রামায়ণে যোগীর তুক করা আমের শাঁস খেয়ে রাবণ প্রেগন্যান্ট হন। কি আর করা ! রাবণ তো আর মহিলা নন যে নির্দিষ্ট পথে সন্তান প্রসব করবে ! অতএব হাঁচির সঙ্গে সন্তান বেরিয়ে আসে বাইরে, এই সন্তানই হলেন সীতা। আদিবাসী সমাজের কোনো-কোন অঞ্চলে রাবণ নায়ক রচিত হয়েছে রাবণগাথাও। অসমিয়া ভাষায় মাধব-কণ্ডলীর রামায়ণ’-এর মতো এরকম ৩০০ টি রামায়ণের সন্ধান পাওয়া যায়।




সেইদিনকার অবতার রামচন্দ্র আধুনিক ভারতের ত্রাতা রামচন্দ্র। ধর্মকে প্রাচীন নায়কদের রাজনীতিতেব্যবহার করা এদেশে বহু প্রাচীন। হিন্দুধর্মের জাতীয়বাদ ধারণা, মুসলমানদের স্বতন্ত্র থাকার প্রেরণা এমন ভাবেই জাঁকিয়ে বসে আসে ভারতীয় রাজনীতিতে। রামচন্দ্রকে রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে আসেন স্বয়ং গান্ধিজি। ১৯৯০ সালে রামের জন্মভূমি উদ্ধারের তোড়জোড় শুরু হয়। ১৯৯২ সালে বাবর-ই-মসজিদ ভেঙে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে রামমন্দির গড়ার বাসনা প্রকটিত হল। ঘৃণিত হল, নিন্দিত হল আজও সারা ভারতে কালা দিবসহিসাবে পালিত হয় ৬ ডিসেম্বর।




রামচন্দ্রকে নিয়ে যত উদ্দীপনা বস্তুত গো-বলয়ে। গো-বলয়ের রাম এসেছেন রামচরিতমানস’-এর হাত ধরে, রামায়ণকার তুলসীদাস গোস্বামী। ১৫৭০ সালে রচিত হয়েছে তুলসীদাসের রামায়ণ। সেখানে কোথাও অযোধ্যার রামমন্দিরের উল্লেখ নেই।তা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্ররোচণায় হিন্দুধর্মকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাই শ্লোগান শুনতে পাই : গর্ব সে কহো হাম হিন্দু হ্যায়,কসম রাম কি খাতে হ্যায়, মন্দির ওহি বনায়েঙ্গেঅতএব ভারত হবে একটি হিন্দু রাষ্ট্র, জিশু কিংবা মোহম্মদের মতো রাম হবেন অবতার, রামায়ণ হবে ধর্মগ্রন্থ এবং একমাত্র তীর্থস্থান অযোধ্যা।







শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন রচিত রামায়ণী কথা’-র ভূমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন – “শতাব্দীর পর শতাব্দী যাইতেছে কিন্তু রামায়ণ-মহাভারতের স্রোত ভারতবর্ষে আর লেশমাত্র শুষ্ক হইতেছে না। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তাহা পঠিত হইতেছে, মুদির দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত সর্বত্রই তাহার সমান সমাদর। ধন্য সেই কবিযুগলকে, কালের মহাপ্রান্তরের মধ্যে যাঁহাদের নাম হারাইয়া গেছে, কিন্তু যাঁহাদের বাণী বহুকোটি নরনারীরর দ্বারে দ্বারে আজিও অজস্রধারায় শক্তি ও শান্তি বহন করিতেছে, শত শত প্রাচীন শতাব্দীর পলিমৃত্তিকা অহরহ আনয়ন করিয়া ভারতবর্ষের চিত্তভূমিকে আজিও উর্বরা করিয়া রাখিতেছে। এমন অবস্থায় রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে-- রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্ম্যের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান। এই কারণে, রামায়ণ-মহাভারতের যে সমালোচনা তাহা অন্য কাব্যসমালোচনার আদর্শ হইতে স্বতন্ত্র। রামের চরিত্র উচ্চ কি নীচ, লক্ষ্ণণের চরিত্র আমার ভালো লাগে কি মন্দ লাগে, এই আলোচনাই যথেষ্ট নহে। স্তব্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে, সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কিরূপভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আমি যতবড়ো সমালোচকই হই-না কেন, একটি সমগ্র প্রাচীন দেশের ইতিহাস-প্রবাহিত সমস্ত কালের বিচারের নিকট যদি আমার শির নত না হয় তবে সেই ঔদ্ধত্য লজ্জারই বিষয়। রামায়ণে ভারতবর্ষ কী বলিতেছে, রামায়ণে ভারতবর্ষ কোন্‌ আদর্শকে মহৎ বলিয়া স্বীকার করিয়াছে, ইহাই বর্তমান ক্ষেত্রে আমাদের সবিনয়ে বিচার করিবার বিষয়। বীররসপ্রধান কাব্যকেই এপিক বলে এইরূপ সাধারণের ধারণা, তাহার কারণ যে দেশে যে কালে বীররসের গৌরব প্রাধান্য পাইয়াছে সে দেশে সে কালে স্বভাবতই এপিক বীররসপ্রধান হইয়া পড়িয়াছে। রামায়ণেও যুদ্ধব্যাপার যথেষ্ট আছে, রামের বাহুবলও সামান্য নহে, কিন্তু তথাপি রামায়ণে যে রস সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে তাহা বীররস নহে। তাহাতে বাহুবলের গৌরব ঘোষিত হয় নাই, যুদ্ধঘটনাই তাহার মুখ্য বর্ণনার বিষয় নহে। ……….রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতাপুত্রে, ভ্রাতায় ভ্রাতায়, স্বামীস্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে প্রীতি-ভক্তির সম্বন্ধ রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। দেশজয়, শত্রুবিনাশ, দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচণ্ড আঘাত-সংঘাত, এই-সমস্ত ব্যাপারই সাধারণত মহাকাব্যের মধ্যে আন্দোলন ও উদ্দীপনার সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু রামায়ণের মহিমা রাম-রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই; সে যুদ্ধঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্যপ্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষমাত্র। পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতিপত্মীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছে। এইরূপ ব্যক্তিবিশেষের প্রধানত ঘরের সম্পর্কগুলি কোনো দেশের মহাকাব্যে এমনভাবে বর্ণনীয় বিষয় বলিয়া গণ্য হয় নাই। ……….রাম যে একই কালে আমাদের কাছে দেবতা এবং মানুষ, রামায়ণ যে একই কালে আমাদের কাছে ভক্তি এবং প্রীতি পাইয়াছে, ইহা কখনোই সম্ভব হইত না যদি এই মহাগ্রন্থের কবিত্ব ভারতবর্ষের পক্ষে কেবল সুদূর কল্পলোকেরই সামগ্রী হইত, যদি তাহা আমাদের সংসারসীমার মধ্যেও ধরা না দিত।




মহাভারত গ্রন্থে রামোপাখ্যাননামে রামায়ণের একটি সারাংশ সংযোজিত হয়েছে; যুধিষ্ঠিরের নিকট কথিত এই উপাখ্যানে রামের চরিত্রে কোনো দেবত্ব আরোপ করা হয়নি। রামায়ণের নায়ক রাম হিন্দুধর্মে একজন অন্যতম প্রধান দেবতা বিবেচিত হন। রামায়ণ মহাকাব্যটিও কেবলমাত্র একটি মহৎ সাহিত্যিক নিদর্শনই নয়, বরং হিন্দুধর্মের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী, রামায়ণ পাঠ অথবা শ্রবণে পাঠক বা শ্রোতা পাপমুক্ত হন। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, বিষ্ণু জগতের সকল জীবকে ধর্মের পথসন্ধান দিতে রাম রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।




রামায়ণএবং মহাভারত’ -- সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্য। অন্যতম মহাভারত, বিষয়বৈচিত্র্যের বিচারে। এই মহাকাব্যটিও রামায়ণের মতোই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ হিসাবে সমীহ আদায় করেছে। তদুপরি ইতিহাসের উপাদানের আকর গ্রন্থ হিসাবেও ঐতিহাসিকদের কাছে আজও মূল্যবান। মহর্ষি বেদব্যাস কথিত মহাভারতের কাহিনি রচনা করতে সম্ভবত তিন বছর লেগেছিল। এর দ্বারা অনুমান করা যেতে পারে, ওই সময় লিখন পদ্ধতি প্রচলিত না-থাকায় সে যুগের বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্যগুলিকে মুনিঋষিরা গুরুশিষ্য পরম্পরা অনুসারে মৌখিক রূপে স্মরণ করে রাখতেন।




প্রথমে (৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ব্যাসদেব ১০০টি পর্ব ও এক লাখ শ্লোক সমন্বিত 'জয়' গ্রন্থ রচনা করেন (এই গ্রন্থটিই পরবর্তীকালে মহাভারতনামে পরিচিত হয়)। পরে ব্যাস প্রচারিত ওই কাহিনিটিকে তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের মহাযজ্ঞে জনমেজয় সহ সৌতি অন্যান্য মুনিদের শোনান। এই সময় গ্রন্থটির নাম হয় 'ভারত'এরপর তৃতীয়বার (২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বৈশম্পায়ন কথিত ভারত কাহিনিটিকে সৌতি ১৮টি খণ্ডে বিভক্ত করেন ও নৈমিষারণ্যে স্থিত শৌনক ও অন্যান্য মুনিদের গল্পের আকারে শোনান। সৌতির এই গল্পটিই বর্তমানে 'মহাভারত' নামে সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হয়। এরও পরে (১২০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ) লিখন পদ্ধতির উন্নতি হলে সৌতি প্রচারিত এই প্রসিদ্ধ মহাভারতের কাহিনি পাণ্ডুলিপি বা পুথিতে ব্রাহ্মী (ব্রাহ্মীলিপি পরিবার) কিংবা সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়। অপরদিকে ম্যাকডোনেল, ওয়েবার এবং অধ্যাপক ভিন্টারনিৎস গবেষণা করে তিনটি স্তর নির্ণয় করেছে। সেগুলি হল – (১) প্রথম স্তর বা সৌত রচনারচনাকাল আনুমানিক ৭০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব। (২) দ্বিতীয় স্তর বা ব্রাহ্মণ্য রচনা। রচনাকাল আনুমানিক ৫০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্ব। এবং (৩) তৃতীয় স্তর বা শ্রমণগণের রচনা। এরপরও নানা ঋষিমুনি ও পণ্ডিতরা নিজস্ব শৈলী প্রয়োগ করে মহাভারতের মূল কাহিনির সঙ্গে আরও অসংখ্য কাহিনি প্রক্ষিপ্তভাবে সংযোজন করেন।



ঐতিহাসিক প্রমাণ যা পাওয়া যায় তা হল, মহাভারতে গুপ্ত কিংবা মৌর্য সাম্রাজ্য (১০০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব) অথবা জৈন বা বৌদ্ধধর্মের (৭০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্ব) কোনো উল্লেখ নেই। তা ছাড়া শতপথ ব্রাহ্মণ (১১০০ খ্রিস্টপূর্ব) ও ছান্দোগ্য উপনিষদে (১০০০ খ্রিস্টপূর্ব) মহাভারতের কিছু প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। অর্থাৎ মহাভারত ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অনেক আগেই লেখা হয়েছিল। পাণিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ীতে (৬০০ থেকে ৪০০ খ্রিস্টপূর্ব) মহাভারতের কাহিনি ও কৃষ্ণার্জুনের কিছু প্রসঙ্গ রয়েছে। অতএব বলা যায়, মহাভারত যে পাণিনির যুগের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রথম শতাব্দীতে ইউনানের রাজদূত Dio Chrysostom-এর বর্ণনায় জানা যায়, তৎকালীন দক্ষিণ এশীয় লোকেদের কাছে এক লক্ষ শ্লোক যুক্ত একটি মহাগ্রন্থ ছিল, অর্থাৎ সেই সময়ও মহাভারতে এক লক্ষ শ্লোকই ছিল। সংস্কৃতের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন একটি পাণ্ডুলিপিতে (প্রথম শতাব্দী) মহাভারতের আঠেরোটি পর্বের একটি অনুক্রমণিকা পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝাই যায়, সেইকালে আঠেরো পর্ব যুক্ত মহাভারতের কাহিনিই প্রচলিত ছিল, যদিও ব্যাসদেব ১০০টি পর্ব যুক্ত আদি মহাভারত রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে আঠেরোটি পর্বে এসে থেমে যায়। বর্তমানে যে সংস্কৃত ভাষার মহাভারতটি দেখতে পাই তা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে থিতু হয়েছে। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা প্রায় এক হাজার বছরে মহাভারত গ্রন্থটি পূর্ণতা পায়।



মহাভারতের মূল উপজীব্য বিষয় হল কৌরব-পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ। আর এই গৃহবিবাদকে কেন্দ্র করে যে যার স্বার্থ চরিতার্থ করতেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আয়োজন। সেইসঙ্গে এই গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে দর্শন ও ভক্তির উপাদান। আর আছে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী প্রাণখুলে আদিরসাত্মক কাহিনির বর্ণনা। আছে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চার পুরুষার্থের বিশ্লেষণ। মহাভারতের অন্তর্গত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা ও উপাখ্যানগুলি হল শ্রীমদভগবদ্গীতা, দময়ন্তীর উপাখ্যান, রামায়ণের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠান্তর ইত্যাদি। শ্রীমদভগবদ্গীতা ছাড়া (এ বিষয়ে সুযোগ পেলে পরে আলোচনা করব) এগুলিকে মহাভারত রচয়িতার নিজস্ব সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।



মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব। অনেক গবেষক এই মহাকাব্যের ঐতিহাসিক বিকাশ ও রচনাকালীন স্তরগুলি নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধুনা প্রাপ্ত পাঠটির প্রাচীনতম অংশটি মোটামুটি ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ রচিত হয়। মহাভারতের মূলপাঠটি তার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে গুপ্তযুগের প্রথমাংশে (খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী)। মহাভারত কথাটির অর্থ হল ভরত বংশের মহান উপাখ্যান। গ্রন্থেই উল্লিখিত হয়েছে যে ভারত নামে ২৪,০০০ শ্লোকবিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্রতর আখ্যান থেকে মহাভারত মহাকাব্যের কাহিনিটি বিস্তার লাভ করে। মহাভারতে এক লক্ষ শ্লোক ও দীর্ঘ গদ্যাংশ রয়েছে। এই মহাকাব্যের শব্দসংখ্যা প্রায় আঠারো লক্ষ। মহাভারত মহাকাব্যটির আয়তন ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যদ্বয়ের সম্মিলিত আয়তনের দশগুণ এবং রামায়ণের চারগুণ। কথিত আছে ব্যাসদেব প্রথমে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের জয় সূচক উপাখ্যানযুক্ত ১০০০০০ শ্লোক সমন্বিত আদ্য জয়গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বশেষে তিনি ষাট লক্ষ শ্লোক সমন্বিত অপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যে গ্রন্থের ৩০ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, ১৫ লক্ষ শ্লোক পিতৃলোকে, ১৪ লক্ষ রক্ষোযক্ষ লোকে স্থান পেয়েছে এবং অবশিষ্ট মাত্র ১ লক্ষ শ্লোক এই মনুষ্যলোকে মহাভারতনামে সমাদৃত হয়েছে। মহাভারত রচনা সম্পূর্ণ হলে ব্যাসদেব এই কাব্য তাঁর পুত্র শুকদেবকে দিয়ে অধ্যয়ন করান, পরে শিষ্য পরম্পরায় গ্রন্থটি বৈশম্পায়ন, পৈল, জৈমিনি, অসিত-দেবল প্রভৃতি ঋষি দ্বারা পঠিত হয়। শুকদেব এই গ্রন্থটির কাহিনি গন্ধর্ব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে, দেবর্ষি নারদ দেবতাদের মধ্যে ও অসিত-দেবল পিতৃদের মধ্যে প্রচারিত করেন। বৈশম্পায়ন এই কাহিনীটি প্রথম মনুষ্যদের মধ্যে 'ভারত' নামে প্রচার করেন। অর্জুনের প্রপৌত্র মহারাজ জন্মেজয়ের মহাযজ্ঞে ঋষি বৈশম্পায়ন ঐ কাহিনী জন্মেজয় সহ সৌতি এবং উপস্থিত মুনি-ঋষিদের শোনান।



রাজা পরীক্ষিৎ তক্ষক নাগের দংশনে মারা গেলে ক্রোধের বশে পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয় বিশ্বের সমস্ত সাপেদের ধ্বংস করার পণ নিয়ে সর্পযজ্ঞের আয়োজন করেন। কিন্তু তক্ষকের অনুরোধে আস্তিক মুনি এই যজ্ঞ ভণ্ডুল করে দেন। জনমেজয়ের অনুতাপ হয় এবং পাপ খণ্ডন করতে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। কিন্তু কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ করা অনর্থের কারণ মনে করে দেবরাজ ইন্দ্র ছল করে এই যজ্ঞও নষ্ট করেন এবং জনমেজয়ের উপর ব্রাহ্মণহত্যার পাপ আরোপিত হয়।। এই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি ব্যাসদেবের পরামর্শ মতো ঋষি বৈশম্পায়নের কাছ থেকে পবিত্র মহাভারতের কাহিনি শ্রবণ করে পাপমুক্ত হন। পরে ঐ যজ্ঞে উপস্থিত গল্পকথক উগ্রশ্রবা সৌতি কাহিনিটি শুনে তা নৈমিষারণ্যে যজ্ঞরত শৌনক ও অন্যান্য মুনিদের শোনান। এইভাবে মনুষ্যসমাজে মহাভারতের কাহিনি প্রচারিত হয় বলে প্রচলিত।



মহাভারতের বিশালতা তথা দার্শনিক গূঢ়তা কেবল ভারতের পৌরাণিক আখ্যানই নয়, বরং এটিকে সমগ্র সনাতন ধর্ম এবং বৈদিক দর্শন ও সাহিত্যের সারসংক্ষেপ বলা যেতে পারে। 'মহাভারত' নামটির উৎপত্তি প্রসঙ্গে একটি আখ্যান প্রচলিত যে, দেবতারা তুলাযন্ত্রের একদিকে চারটি বেদ রাখেন ও অন্যদিকে বৈশম্পায়ন প্রচারিত ভারত গ্রন্থটি রাখলে দেখা যায় ভারত গ্রন্থটির ভার চারটি বেদের চেয়েও অনেক বেশি। সেকারণে ভারত গ্রন্থের বিশালতা দেখে দেবগণ ও ঋষিগণ এর নামকরণ করলেন 'মহাভারত'আবার একে 'পঞ্চম বেদ'ও বলা হয়। জগতের তাবৎ শ্রেষ্ঠ বস্তুর সঙ্গে একে তুলনা করে বলা হয়েছে: "মহত্ত্বাদ্ ভারতবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে।"



তবে অনেক বিবর্তনের মাধ্যমে মহাভারতের বিভিন্ন অংশ নানাভাবে পরিবর্তিত হয়। তার উপর মূল সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় মহাভারতের প্রচুর অমিল দেখা যায়।কাশীরাম দাস ভাবানুবাদ করেন বাংলা মহাভারত। ইংরেজি ভাষায় মহাভারত প্রথম অনুবাদ করেন কিশোরীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় । পণ্ডিত রামনারায়ণদত্ত শাস্ত্রী পাণ্ডে রাম হিন্দি ভাষায় মহাভারতের ভাবানুবাদ করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় ফয়জি ও অব্দ্ অল-কাদির বদাউনি ফারসি ভাষায় মহাভারত অনুবাদ করেন, যার নামকরণ করা হয় রজম্নামেহ্তামিল ভাষায় মহাভারতের অনুবাদ করেছেন মানালুর রঙ্গচরিয়ার। মহাভারতের তামিল সংস্করণটি তেরুক্কুট্টু বা কাত্তৈক্কুট্টু নামে মঞ্চে অভিনীত হয়, এতে প্রধানত দ্রৌপদীর চরিত্রের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ভারতে মহাভারতের তিনটি পৃথক সংস্করণ পাওয়া যায় উত্তর ভারতীয়, দক্ষিণ ভারতীয় ও মালাবারী। মালাবারী মহাভারত আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পরিপূর্ণতা লাভ করে। বাকি দুটি সম্ভবত আরও কিছুকাল পরে পরিপূর্ণ হয়ে আধুনিক রূপ লাভ করেছে।



ইন্দোনেশিয়ায় একাদশ শতকে জাভার রাজা ধর্মবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ককবিন ভারতযুদ্ধনামে মহাভারতের একটি সংস্করণ পুষ্টি লাভ করে, যেটি পরে বর্তমান হিন্দুপ্রধান বালীদ্বীপে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এর থেকে উদ্ভুত নৃত্যনাটক ওয়ায়াঙ্গ ওয়ঙ জাভা সংস্কৃতি ও সাহিত্যকেও পুষ্ট করেছে। এই সংস্করণটিতে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী ছিলেন না। তাঁর বিবাহ শুধু যুধিষ্ঠিরের সাথেই হয়। শিখণ্ডীকে অর্জুনের স্ত্রী হিসাবে বর্ণিত হয়েছে, যিনি যুদ্ধে পুরুষদেহ না ধারণ করেই এক স্ত্রীযোদ্ধা হিসাবে অংশগ্রহণ করেন। এখানে গান্ধারীকে মহীয়সী নারী হিসেবে না-দেখিয়ে এক খলচরিত্র হিসাবে দেখানো হয়েছে। সেমর, পেত্রুক, গরেঙ্গ্ নামে কিছু চরিত্র সংযোজিত হয়েছে, যা মূল সংস্কৃত মহাভারতে নেই। রবীন্দ্রনাথেরও মতে, মহাভারত কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, মহাভারত একটি ঐতিহাসিক কাব্যসাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কৃষ্ণচরিত্রপ্রবন্ধে লিখেছিলেন, “মহাভারতে যে নানা লোকের রচনা আছে তাহা স্বীকার্য, কিন্তু তাহাদিগকে পৃথক করিয়া তাহাদের রচনাকাল ও তাহাদের আপেক্ষিক সত্যাসত্য নির্ণয় যে কেমন করিয়া সাধিত হইতে পারে তাহা এখনো আবিষ্কৃত হয় নাই।



তদুপরি মহাভারত কোনো একটি গ্রন্থ নয়, মহাভারত শুধুমাত্র মহাকাব্যই নয় মহাভারত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পবিত্র ধর্মগ্রন্থও। তবে এক্ষেত্রেও সংস্কৃত ভাষায় রচিত ব্যাসদেবের মহাভারতম্নয়, যেমন বাংলায় কাশীরাম দাসের মহাভারতই বেশি চর্চিত। বাঙালি হৃদয় জুড়ে আছে কাশীরামে মহাভারত। যে হোক সে হোক যুদ্ধ করিলাম পণ।/

বিনা যুদ্ধ রাজ্য নাহি দিব কদাচন।।”, “চর্ব্ব চূষ্য লেহ্য পেয় কর বহুতর।/রস গন্ধ আগি যত জন-মনোহর।।” – এসব এখন প্রবাদ হয়ে গেছে। মূল সংস্কৃত ভাষার মহাভারতে কী আছে তা পণ্ডিতমাত্রই জানেন। পণ্ডিতমাত্রই জানেন সংস্কৃত মহাভারত সকলের জন্য নয়। কারণ এতে পরতে পরতে আদিরসাত্মক কাহিনিতে ভরপুর হয়ে আছে। শরীরী সম্পর্কের এমন নিখুঁত বর্ণনা খুব গ্রন্থেই আছে। শামিম আহমেদের মহাভারতে যৌনতা’, পৃথ্বীরাজ সেনের মহাভারতে প্রেম ও যৌনতা’, মাহবুব লীলেনের অভাজনের মহাভারত’, সুবোধ ঘোষের ভারতপ্রেমকথাপড়ে দেখতে পারেন।



সংস্কৃত না হোক, ভারতীয় অন্যান্য ভাষায় রচিত মহাভারত পাঠ অথবা শ্রবণ করেই সনাতনীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মহাভারতের দর্শন, মহাভারতের ভক্তি, মহাভারতের শ্রদ্ধা মিশে আছে। তা সত্ত্বেও মহাভারতকে ঘিরে হাজারো প্রশ্ন এবং তার উত্তর খোঁজার গবেষণা অব্যাহত। সনাতনীদের কাছে আজও মহাভারত ভারতের জীবনবেদ ও ভারতাত্মার মর্মবাণী। লক্ষ শ্লোকাত্মক বিশাল মহাকাব্য মহাভারতভারতবর্ষের ধর্মীয়, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে, চিন্তায় ও মননে, জ্ঞানে ও কর্মে, শিক্ষা ও সাহিত্যে অপরিসীম গুরুত্ব রাখে।



সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে আরও একটি গ্রন্থ অতীব মূল্যবান হল শ্রীমদ্ভগবদগীতা”, চালু পরিচয় গীতাহিন্দুধর্মের অন্যান্য গ্রন্থের মতই গীতাও প্রথমে সাধারণ হিন্দুদের হাতে ছিল না। ১৭৮৫ সালে গীতার সর্ব প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন চার্লস উইলকিন্স । ১৮২৩ সালে জার্মান পণ্ডিত শ্লেগেল লাতিন ভাষায়, ১৮২৫ সালে ইউজেন বুর্নক ফরাসি ভাষায় ১৮৫৭ সালে ডোমোট্রিয়ার গ্রিক ভাষায় ১৮৬৯ সালে এফ লরিনসার জার্মান ভাষায়, ১৮৮৫ সালে এডউইন আর্নলড ইংরেজি ভাষায় এবং ১৯২৭ সালে নভিকভের নামক এক রাশিয়ান ভদ্রলোক এটির রুশ অনুবাদ করেন, যার ভূমিকা লেখেন ওয়ারেন হেস্টিং। স্বামী বিবেকান্দ এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন-- ব্রাহ্মণরাই টাকার বিনিময়ে গীতাকে ম্লেচ্ছদের হাতে তুলে দিয়েছিল।



শ্রীমদ্ভগবদগীতা বা গীতা একটি ৭০০ বা ৭৪৫ শ্লোকের হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। বিগত তিন হাজার বছরে সংস্কৃত ভাষাগুলিতে যত বই রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি প্রভাবশালী সম্ভবত শ্রীমদ্ভগবদগীতা, যদিও এটি মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি ছোট্ট গ্রন্থাংশ। গীতায় উল্লিখিত নিষ্কাম কর্মের সেবা ছিল গান্ধীর অনুপ্রেরণা। তিনি লিখেছেন – “যখন সংশয় আমাকে তাড়া করে ফেরে, যখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে হতাশা, আমি দিগন্তে আশার কোনো আলো দেখতে পাই না, তখন আমি ভগবদ্গীতার দিকে মুখ ফেরাই। এমন একটি শ্লোক পেয়ে যাই, যা আমাকে শান্তি দেয়। তখন ঘনায়মান দুঃখের মধ্যেও আমার মুখে হাসি ফোটে। আমার জীবন বাহ্যিক ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ। আমার জীবনে যদি তাদের কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য প্রভাব না থাকে, তার জন্য আমি ভগবদ্গীতা র শিক্ষার প্রতি কৃতজ্ঞ।ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভগবদ্গীতা প্রসঙ্গে বলেছেন -- ভগবদগীতা মানব অস্তিত্বের আধ্যাত্মিক ভিত্তিটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। জীবনের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্মের জন্য কর্মের ডাক দেওয়া হয়েছে গীতায়। সেই সঙ্গেই আধ্যাত্মিক প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের বৃহত্তর উদ্দেশ্যটির দিকেও দৃষ্টি রাখা হয়েছে।আমেরিকান পদার্থবিদ ও ম্যানহ্যাটন প্রজেক্টের পরিচালক জে. রবার্ট ওপেনহিমার ১৯৩৩ সালে সংস্কৃত শিখে গীতার মূল সংস্কৃতে পাঠ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই বইটিকে জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলির একটি বলে উল্লেখ করেন।



বাংলার ভূতপূর্ব গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসের মতে গীতাতত্ত্বই ভারতীয় চিন্তার পূর্ণ পরিণতি ও সূক্ষ্ম নির্যাস। মোগল সম্রাট শাজাহানের পুত্র দারাশিকো লিখেছেন-- "গীতা স্বর্গীয় আনন্দের অফুরন্ত উৎস। সর্বোচ্চ সত্যলাভের সুগম পথ গীতায় প্রদর্শিত। গীতায় পরমপুরুষের কথা বিবৃত ও ব্রহ্মবিদ্যা ব্যাখ্যাত। গীতা ইহলোক ও পরলোকের সুগভীর ও শ্রেষ্ঠ রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটন করেন।" ইংরেজ মনীষী ডক্টর এল.ডি.বার্নেট বলেন -- "লক্ষ লক্ষ লোক গীতা পড়েছেন বা শুনেছেন । সকলেই এটি পাঠে বা শ্রবণে বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বরলাভের দুর্গম পথে এটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহচর । জীবনের প্রত্যেক কর্মকে অনাসক্তির আগুনে শুদ্ধ করে উপাসনায় পরিণত করার যে অপূর্ব কৌশল গীতা শিক্ষা দেয়, তা মানবের কর্মজীবনের অনন্য অবলম্বন।" ১৬০ বছর আগে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস চার্লস উইলকিন্স কৃত গীতার ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় লিখেছেন - "গীতার প্রাচীনত্ব এবং যে পুজো তা বহু শতাব্দী ধরে মনুষ্যজাতির এক বৃহৎ অংশের কাছ থেকে পেয়ে আসছে তার দ্বারা গীতা সাহিত্যজগতে এক অভূতপূর্ব বিস্ময় উৎপাদন করেছে। এটির সাহিত্যিক গুণাবলি জগতে অননুকরণীয়। গীতাপাঠে শুধু ইংরেজগণ কেন, সমগ্র বিশ্ববাসী উপকৃত হবেন। গীতাধর্মের অনুশীলনে মাননজীবন শান্তিধামে পরিণত হবে।বছর দুয়েক আগে একটি পত্রিকায় একটি মজার খবর বেরোয়, যার শিরোনাম ছিল – “এ বার ডান দিক থেকে বাম দিকে গীতা পড়ুনএস টি বেঙ্কট অপালাচারী উর্দুতে অনুবাদ করেছেন ভগবদ্গীতা-- নাম দিয়েছেন নাগমে ইলাহি’, মানে ভগবানের সংগীত।



ভগবদ্গীতা উপনিষদ শ্রেণীর গ্রন্থ। দ্বাপর যুগে কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে সংঘটিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুন প্রতিপক্ষে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনদের দেখে স্নেহমমতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং যুদ্ধ না-করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন সারথি শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বীরের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অন্যায়-অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করা এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য অর্জুনকে যে উপদেশ দেন, তাই শ্রীমদভগবদ্গীতা, সংক্ষেপে ভগবদ্গীতা বা শুধু গীতা নামে পরিচিত। ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত আঠারোটি অধ্যায় (২৫ থেকে ৪২) নিয়ে গীতার কলেবর রচিত। এখানে ৭০০ শ্লোক আছে বলে এজন্য গীতাকে সপ্তশতীও বলা হয়। গীতার প্রবক্তা শ্রীকৃষ্ণ, আর শ্রোতা অর্জুন।

ভগবদ্গীতার রচনাকাল সম্বন্ধে অনেক রকম মতামত রয়েছে। ঐতিহাসিকেরা এই গ্রন্থের রচনাকাল হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত যে-কোনো সময়ের মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করেছেন। এ ছাড়াও কারও কারও মতে এটাও ধরা হয়ে থাকে ভগবদ্গীতা আদি শঙ্করাচার্য দ্বারা সর্বপ্রথম মহাভারত থেকে সংকলীত হয়ে আলাদা গ্রন্থ হিসেবে মর্যদা পায়। অধ্যাপক জীনীন ফাউলারের মতে এই গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী বলে মনে করলেও, গীতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কাশীনাথ উপাধ্যায় মহাভারত, ব্রহ্ম সূত্র ও অন্যান্য গ্রন্থ পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, গীতা খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। অনেকে মনে করেন ভীষ্মপর্বের ২৫ অধ্যায় থেকে ৪২ অধ্যায় পর্যন্ত অংশ ব্যাসদেবের রচিত নয়, এটি পরবর্তী কোনো একটি সময়ে প্রক্ষিপ্তভাবে বাইরে থেকে ঢোকানো হয়েছে।দেখা গেছে মূল মহাভারতের সঙ্গে ভীষ্মপর্বের ২৫ অধ্যায় থেকে ৪২ অধ্যায়ের রচনাশৈলী বেশ পৃথক। ভিন্ন কোনো একজনের লেখা। তা ছাড়া যুদ্ধ শুরুর সময় দীর্ঘ সময় নষ্ট করে অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের ৭০০ শ্লোক শোনানোটা হাস্যকর। এ যেন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে চাকুরিপ্রার্থীর কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনা। আধুনিক পণ্ডিতগণ বাইবেলের মতো গীতারও উচ্চতর বা ঐতিহাসিক সমালোচনা (higher or historical criticism) করেছেন । জার্মান পণ্ডিত গার্বে সর্বপ্রথম গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা ও গবেষণা শুরু করেন । ইনিই প্রথম জার্মান ভাষায় গীতার অনুবাদও প্রচার করেছেন । উক্ত সমালোচনার স্থলে টালবয়েজ হুইলার, ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ পণ্ডিতগণ বলেন যে, গীতা একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ এবং মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত। গার্বের শিষ্য জার্মান সংস্কৃতজ্ঞ ডাঃ রুডল্‌ফ অটো গীতার উচ্চতর সমালোচনা করে জার্মান ভাষায় যে বৃহৎ গ্রন্থ লিখিয়াছেন তাহার নাম 'The Original Gita'; বইখানি ইংরেজি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে । অটো সাহেবের মতে, গীতায় কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ-বিষয়ক আখ্যায়িকা অংশটি মহাভারতের প্রকৃত অংশ। এই আখ্যায়িকা অংশ ১২৮টি শ্লোকের অনধিক, কিন্তু তিনি বলেন - ভক্তি, যোগ, জ্ঞান, কর্ম প্রভৃতি-সম্বন্ধীয় গীতার উপদেশগুলির পৃথক পৃথক গ্রন্থ এবং শ্রীকৃষ্ণের বাণীরূপে প্রচলিত করার উদ্দেশ্যেই মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুতরাং এইগুলি প্রক্ষিপ্ত। গীতাকে ঐতিহাসিকরা আদি মহাভারতের অন্তর্গত বলেই মনে করেন না। তাঁদের মতে, মূল মহাভারতের কাহিনি প্রচলিত হওয়ার কয়েকশো বছর পরে বৌদ্ধধর্মের মোকাবিলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বার্থে গীতাকে মহাভারতের কাহিনির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, অর্থাৎ গীতা মহাভারতের একটি প্রক্ষিপ্ত অংশ।



মহাভারতের সঙ্গে গীতার সম্পর্ক নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন-- যাহা আমরা ভাগবতগীতা বলে পাঠ করি তাহা কৃষ্ণ প্রণীত নহে; উহা ব্যাস প্রণীত বলিয়া খ্যাত বৈয়াসিকী সংহিতানামে পরিচিত । ইহার প্রণেতা ব্যাসই হোক আর যেই হোক তিনি কৃষ্ণের মুখের কথাগুলো নোট করিয়া রাখিয়া এই গ্রন্থ সংকলন করেন নাই।বঙ্কিমের এমন মতামতের কারণ একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দু-পক্ষের যুদ্ধকে থামিয়ে, রণসজ্জায় সজ্জিত সৈন্যদের মাঝে দীর্ঘ ১৮ অধ্যায়ের যোগধর্ম শোনা সম্ভবপর নয়। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য হল --কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে থামিয়ে রেখে সমস্ত গীতা আবৃত্তি করা সাহিত্যের আদর্শ হিসাবে অপরাধ।

অপরপক্ষে, কিন্তু বালগঙ্গাধর তিলক এবং ডাঃ সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণন এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন, সমগ্র গীতাই মহাভারতের প্রকৃত অংশ । কারণ -- (১) গীতা ও মহাভারতের অন্যান্য অংশের মধ্যে ভাষার নিকট সাদৃশ্য আছে এবং (২) মহাভারতের অন্যান্য পর্বে গীতার উল্লেখ আছে । ভীষ্মপর্বের ২৫ থেকে ৪২ অধ্যায়ই ভগবদ্‌গীতা। শান্তি ও অশ্বমেধ পর্বে এবং অন্যান্য বহু স্থলে ব্যাসদেব ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত ভগবদ্‌গীতার সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। এ থেকে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে, গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ, প্রক্ষিপ্ত নয়। অটো সাহেবের পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি ।



মধ্যযুগে শঙ্কর, রামানুজ দুজনেই গীতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের বর্গে ফেলেছেন, স্মৃতি মানে পুরাণের চেয়ে ওপরে, কিন্তু শ্রুতির (বেদ) নিচে। গীতা নয়, বেদই শীর্ষে। বেঁচে থাকলে শঙ্কর বা রামানুজ কেউই গীতাকে জাতীয় গ্রন্থবলতেন না সেটা সঠিক। গীতার গুরুত্ব অন্যত্র। স্মৃতি কিন্তু শ্রুতিতুল্য। গীতার বাণী ধর্মদর্শনের বিচারে অত্যন্ত উচ্চমার্গের। কিন্তু গীতার পূর্বসূরি বেদ-উপনিষদের দর্শনতত্ত্ব ভারতের আধ্যাত্মিক ভাবনা ও জীবনচর্যার মূল প্রেরণা। গীতা মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত অংশ। আসলে গীতা এক দর্শন। দর্শন কোনো গ্রন্থে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। দর্শন মহাজাগতিক চেতনা বিশেষ। এই দর্শনকে কোনও গ্রন্থে বেঁধে একে ব্যবহার করতে চাইছে ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থ।



গীতা একাধারে ধর্ম, দর্শন ও কাব্যগ্রন্থ। ভারতীয় দর্শনের অন্যতম ভিত্তি ভগবদ্গীতা। এতে বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থে বর্ণিত দার্শনিক তত্ত্বের সার সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়া ধর্মতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, গার্হস্থ্যনীতি ইত্যাদি সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে। তাই একে সকল ধর্মগ্রন্থের সারগ্রন্থও বলা হয়। কর্ম-জ্ঞান-ভক্তি-যোগ প্রভৃতি অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ যাতে অভীষ্ট ঈশ্বর বা মুক্তি লাভ করতে পারে তার দিকনির্দেশনা রয়েছে এই গীতা গ্রন্থে।

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।



গীতায় ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যোদ্ধার কর্তব্য এবং আত্মার অবিনাশিতা ধর্ম সম্পর্কে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছেন তার দ্বারা বিশ শতকে ভারতীয় বিপ্লবী ও স্বাধীনতাকামীরা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই একখানা করে গীতা থাকত। গীতাপাঠে তাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গে শক্তি সঞ্চয় করতেন। মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মুক্ত করতে আত্মবিসর্জনে উদ্বুদ্ধ হতেন। গীতার শিক্ষা হচ্ছে ধর্মে উদারতা, কর্মে নিষ্কামতা, জ্ঞানে ব্রহ্মভাব ও সর্বভূতে ভগবদ্ভাব, যোগে বা ধ্যানে ভগবানে চিত্তসংযোগ, ভক্তিতে ভগবদশরণাগতি, নীতিতে সাম্যদৃষ্টি, উপাসনায় ভগবদকর্ম, জীবসেবা ও স্বধর্ম পালন এবং সাধনায় ত্যাগানুশীলন। গীতা হিন্দুদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিত্য গীতাপাঠ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গীতাপাঠ ও ব্রাহ্মণকে গীতাদান হিন্দুসমাজে পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হয়।



এই হল প্রধান আধার গ্রন্থ, যেসব গ্রন্থগুলি প্রত্যক্ষভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে যথার্থই প্রাণভোমরা। এছাড়া পরোক্ষভাবেও বেশকিছু সংস্কৃত ভাষায় লেখা গ্রন্থ সনাতনীদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে। গ্রন্থগুলি হল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’; বাৎসায়ণের কামশাস্ত্রম্’; পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী’; পতঞ্জলির মহাভাষ্য’; অমরসিংহের অমরকোষবা নামলিঙ্গানুশাসন; ভোজরাজের সমরাঙ্গনসূত্রধার’; বিশ্বকর্মার বাস্তুশাস্ত্রম্’; পরাশরের পরাশরসংহিতা’; বশিষ্ঠের ধনুর্বেদসংহিতা’; চরকের চরকসংহিতা’; সুশ্রুতের সুশ্রুতসংহিতা’; কালিদাসের রঘুবংশম্’, ‘কুমারসম্ভবম্’, ‘মেঘদূতম্’, ‘ঋতুসংহারম্’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’, ‘বিক্রমোর্বশীয়ম্’, ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’; ভাসের প্রতিমানাটকম্প্রভৃতি।



আপনারা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন আমার এ রচনায় বেশিরভাগ জায়গায় সনাতন ধর্মবলে উল্লেখ করেছি, হিন্দুধর্ম নয়। তার মূল কারণ উল্লেখিত গ্রন্থগুলি যখন পাওয়া গিয়েছিল বা রচিত হয়েছিল সে সময় হিন্দুধর্মতো অনেক দূরের কথা, ‘হিন্দুশব্দটিই আবিষ্কার হয়নি। ভারতে মুসলিমদের আবির্ভাবের পূর্বে এ উপমহাদেশের সাহিত্যে হিন্দুশব্দটির প্রচলন ছিল না। অষ্টম শতকের প্রারম্ভে মুসলিম আরবেরা সিন্ধুতে আগমন করেন এবং এর নামকরণ করেন হিন্দতারা এখানকার জনগণকে হিন্দীবলে আখ্যায়িত করেন। ক্রমে হিন্দশব্দটি ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত সমগ্র উপমহাদেশই হিন্দনামে পরিচিত হয়ে উঠে। এখন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদেরকে হিন্দুবলে পরিচয় দেয়। হিন্দুশব্দটি উৎসারিত হয়েছে সংস্কৃত সিন্ধুশব্দটি থেকে। সিন্ধু ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক নদীর নাম। ঋগবেদে সিন্ধু নদের স্তুতি করা হয়েছে। পরবর্তীকালের আরবি সাহিত্যেও আল-হিন্দশব্দটির মাধ্যমে সিন্ধুনদ অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতের নামের সমার্থক শব্দ হিসাবে হিন্দুস্তানবা হিন্দুস্থানশব্দটির উৎপত্তি হয়। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ হিন্দুদের দেশপ্রথমদিকে হিন্দুশব্দটি ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অধিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কেবলমাত্র চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্যভাগবত ইত্যাদি কয়েকটি ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থে যবন বা ম্লেচ্ছদের থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পৃথক করার জন্য শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় বণিক ও ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসগুলির অনুগামীদের একত্রে হিন্দুনামে অভিহিত করে। ধীরে ধীরে এই শব্দটি আব্রাহামীয় ধর্মসমূহ অথবা অবৈদিক ধর্মবিশ্বাসগুলির (যেমন জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও শিখধর্ম) অনুগামী নন এবং সনাতন ধর্ম নামক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন সকল ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। ইংরেজি ভাষাতে ভারতের স্থানীয় ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি বোঝাতে Hinduism বা হিন্দুধর্মকথাটি চালু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ঊনবিংশ শতকে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদীগণ হিন্দু-ইজমশব্দটির প্রয়োগ শুরু করার পর থেকেই হিন্দুধর্ম একটি বিশ্বধর্ম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

কোনো-কোনো ঐতিহাসিকগণ মনে করেন -- হিন্দু শব্দটি এসেছে পারসিক থেকে এসেছে, যার অর্থঅন্ধকারবহু বছর আগে এশিয়া মহাদেশে যেসব অমুসলিম এশিয়া মহাদেশে বসবাস করত তাদেরকে হিন্দু বলা হত কিন্তু তাদের ধর্মের কোনো নামকরণ ছিল না এর কারণ তারা হাজার হাজার জাত, গোত্র এবং উপগোত্রে ভাগ ছিল। প্রত্যেকেরই নিজস্ব সৃষ্টিকর্তা, ধর্মবিশ্বাস, উৎসব, ধর্মপন্থা ইত্যাদি বিরাজমান ছিল। ব্রিটিশরা দেশ দখল করার পর এত জাতি বিভক্ত দেশটির লোকদের সুনিদ্দিষ্ট ধর্ম নাম দেওয়ার জন্য ১৮৩০ সালে সর্বপ্রথমহিন্দুধর্মশব্দটি ব্যবহার করে। যাতে সব গোত্রকে একটি ধর্মবিশ্বাসে বর্ণনা করা সম্ভব হয়। হিন্দুধর্মশব্দটি কী যুক্তিকতায় নামকরণ করা হল তা আজও পর্যন্ত কোনো পণ্ডিতগণের পক্ষে সঠিকভাবে বর্ননা করা সম্ভব হয়নি যার কারণে তারা উভয় সংকটে পড়েন কখনও বলেন সনাতন ধর্ম, আবার কখনও বলেন বেদিক ধর্ম। বেশিরভাগ ধর্মীয় শিক্ষা পরস্পর বিরুদ্ধ।



সনাতন ধর্ম বলতে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মপদ্ধতিকে বোঝায় না। এটি হচ্ছে পরম শ্বাশত জীব সকলের নিত্য ধর্ম। আগেই বলা হয়েছে(গীতা যথাযথ সংস্করণের মুখবন্ধ দ্রষ্টব্য), সনাতন ধর্ম হচ্ছে জীবের নিত্য ধর্ম। শ্রীপাদ রামানুজাচার্য সনাতন শব্দটির ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “যার কোন শুরু নেই এবং শেষ নেইতাই যখন আমরা সনাতন ধমের কথা বলি, শ্রীপাদ রামানুজাচার্যের নির্দেশানুসারে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই ধর্মের আদি নেই এবং অন্ত নেই। বর্তমান জগতে (এ পার্থিব বা জড় জগতে) ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, সনাতন ধর্ম ঠিক তা নয়। ধর্ম বলতে সাধারণত কোন বিশ্বাসকে বোঝায় এবং এ বিশ্বাসের পরিবর্তন হতে পারে। কোন বিশেষ পন্থার প্রতি কারও বিশ্বাস থাকতে পারে এবং সে এ বিশ্বাসের পরিবর্তন করে অন্য কিছু গ্রহণ করতেও পারে। কিন্তু সনাতন ধর্ম বলতে সেই সব কার্যকলাপকে বোঝায়, যা পরিবর্তন হতে পারে না। যেমন, জল থেকে তার তরলতা কখনই বাদ দেওয়া যায় না। আগুন থেকে যেমন তাপ ও আলোককে বাদ দেওয়া যায় না, তেমনই সনাতন জীবের সনাতন বৃত্তি জীবের থেকে আলাদা করা যায় নাজীবের সং্গে তার সনাতন ধর্ম ওতপ্রোতবাবে জড়িয়ে আছে। সূতরাং যখন আমরা ধর্মের কথা বলি, তখন শ্রীপাদ রামানুজাচার্যের প্রামাণ্য ভাষ্য মেনে নিতে হবে যে, এর কোন আদি-অন্ত নেই। যার কোন আদি নেই, অন্ত নেই, সে ধর্ম কখনই সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। এ ধর্ম সমস্ত জীবের ধর্ম, তাই তাকে কখনই কোন সীমার মধ্যে সীমিত রাখা যায় না। একে কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে বদ্ধ রাখাও চলে না। কিন্তু তবুও কিছু সাম্প্রদায়িক লোক মনে করে যে, ‘সনাতন ধর্মওএকটি সাম্প্রদায়িক ধর্ম। কিন্তু এটি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্কীর্ণতা ও বিকৃত বুদ্ধিজাত অন্ধতার প্রকাশ। আমরা যখন আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে সনাতন ধর্মের যথার্থতা বিশ্লেষণ করি, তখন দেখি যে এ ধর্ম পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ধর্ম-শুধু তাই নয়, এ ধর্ম সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জীবের ধর্ম।সনাতন ধর্ম সনাতন জীবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থেকে চিরকালই বর্তমান। জীব সম্বন্ধেও বলা হয়েছে যে, সে জন্ম-মৃত্যুর অতীত। ভগবদ্গীতাতে বলা হয়েছে যে, জীবের জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। সে শাশ্বত ও অবিনশ্বর এবং তার দেহের মৃত্যু হলেও তার কখনই মৃত্যু হয় না। সনাতন ধর্ম বলতে যে ধর্ম বোঝায়, তা আমাদের বুঝতে হবে ধর্ম কথাটির সংস্কৃত অর্থের মাধ্যমে। ধর্ম বলতে বোঝায় যা অপরিহার্য অঙ্গরূপে কোন কিছুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে।



হিন্দুধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম, তবে হিন্দুনামটি আধুনিকালের দেওয়া। আগেই বলেছি এর প্রাচীন নাম হল সনাতন ধর্মআবার এই ধর্ম বৈদিক ধর্মনামেও পরিচিত। এই ধর্ম বেদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এ ধর্মত্ত্বের মূল কথা হল ঈশ্বরের অস্তিত্বেই সকল কিছুর অস্তিত্ব এবং সকল কিছুর মূলেই স্বয়ং ঈশ্বর। ভারতীয় দর্শনের ছয়টি আদি মতবাদ ছাড়াও চার্বাকের অবিমিশ্র নিরীশ্বরবাদ, আচার্য রামানুজের দ্বৈতবাদ, আচার্য শংকরের সর্বেশ্বরবাদ, রাজা রামমোহন রায়ের একেশ্বরবাদ এবং বহুদেববাদও সনাতন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। এভাবে সনাতন ধর্ম হল কতকগুলো পরস্পরবিরোধী ধর্মীয় মতবাদ ও দর্শনের সমষ্টি। হিন্দুবাদহচ্ছে কঠোর বর্ণাশ্রমভিত্তিক একটি সমাজ-ব্যবস্থা, যাতে মানুষের মর্যাদা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সুবিচারের কোনো স্বীকৃতি নেই। এই সমাজ-কাঠামোর দার্শনিক ভিত্তি হল জন্মান্তরবাদ। সার্বিক সহিষ্ণুতা থেকে মতবৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও হিন্দুধর্মের রক্ষণশীল উদারতা ধ্রুপদী পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় এই ধর্মের সংজ্ঞা নিরুপণের প্রধান বাধাস্বরূপ। সনাতন ধর্ম মূলত একটি ব্যাবহারিক ধর্মচেতনা। একাধিক প্রথা, সংস্কার ও আদর্শ এতে সন্নিবেশিত। তাই অনেকের মতে এই ধর্মের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা বেশ অসুবিধাজনক। সেই কারণে রিলিজিয়নবা ধর্ম অপেক্ষা রিলিজিয়াস ট্র্যাডিশনবা ধর্মসংস্কার হিসাবেই একে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংজ্ঞায়িত করা হয়। হিন্দুধর্মকে মনে করা হয় বিশ্বের জটিলতম ধর্মবিশ্বাসগুলির অন্যতম। এই জটিলতা ব্যতিরেকেও হিন্দুধর্ম যে শুধুমাত্র একটি সংখ্যাগতভাবে সুবৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্মচেতনা তাই নয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রচলিত এই ধর্মবিশ্বাস পৃথিবীর অধুনা বর্তমান ধর্মগুলির মধ্যে প্রাচীনতমও বটে। পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্ম কি এবং কিভাবে তা আরও প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত তারই বিচারে হিন্দুধর্মকে যাচাই করা হয়। ধর্মবিশ্বাস’ (‘ফেইথ’) শব্দটি ধর্ম’ (‘রিলিজিয়ন’) অর্থে প্রয়োগের ফলে এই বিষয়ে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো পণ্ডিত এবং অনেক হিন্দু দেশীয় সনাতন ধর্ম’-এর সংজ্ঞাটির পক্ষপাতী। এই সংস্কৃত শব্দবন্ধটির অর্থ চিরন্তন ধর্ম (বিধি)বা চিরন্তন পন্থা। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতে --- হিন্দুধর্ম কোনো ধর্ম নয়, এটি এক জীবনধারা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হিন্দুধর্মের একটি অসাধারণ সংজ্ঞা দিয়েছেশীর্ষ আদালত বলেছে, হিন্দুধর্ম কোনো ধর্ম নয়, এটি একটি জীবনধারাসুপ্রিম কোর্টের এই মত তিনিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন বলে জানান মোদিপ্রধানমন্ত্রী বলেন, হিন্দুধর্ম এক বিজ্ঞানসম্মত জীবনধারার মধ্য দিয়ে বন্যজীবন সহ গোটা পরিবেশ-প্রকৃতির স্বার্থ রক্ষা করে চলেএতে জীবনের ছোটো ছোটো সমস্যাগুলি থেকে বেরনোর রাস্তা পাওয়া যায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি

বস্তুত অনেকেই মনে করেসনাতন ধর্ম’- হচ্ছেহিন্দুধর্ম! মূর্তি বা প্রতিমা পুজোয় বিশ্বাসী ! আবার অনেকেই সনাতন ধর্মকেহিন্দুধর্মবলে আখ্যায়িত করে ! যা এক্কেবারে একটি ভুল ধারণাসনাতন ধর্মের ভিত্তি বৈদিক শাস্ত্রের কোথাওহিন্দু শব্দটির উল্লেখ নেইনেই এইজন্য যে, তা আধুনিককালে মানে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয়েছে অথবা কালক্রমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সনাতন ধর্মকে হিন্দুধর্মেপরিণত করা হয়েছে ! হিন্দু একটি নির্দিষ্ট জাতি হিন্দুধর্ম বলতে বোঝায় হিন্দু জাতির ধর্ম ! বৈদিক শাস্ত্রের কোথাও কোনো জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা সমাজের ধর্ম হিসাবে সনাতন ধর্মকে অভিহিত করা হয়নিঅভিহিত করা হয়েছে মানব জাতির বা জৈব ধর্ম বা জীবের ধর্ম হিসাবে
হিন্দুধর্ম কি গ্রহণ করা যায় ? গ্রহণ করা গেলে গ্রহণের পদ্ধতি কী ? আমি তো এতদিন জানতাম, হিন্দুধর্ম গ্রহণ করার ধর্মীয় কোনো পদ্ধতি নেই। কিন্তু কৃষ্ণকথানামে একটি হিন্দুত্ববাদী ওয়েব সাইট বলছে --- যেহেতু একসময় পুরো পৃথিবীতে হিন্দুধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মই ছিল না তাই সেসময়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার প্রথাও ছিল না, কেন-না সেসময় ভিন্ন ধর্ম বলতে কিছু ছিল নাকিন্তু সময়ের পরিবর্তনে শুধু ভিন্ন ধর্মের উদ্ভবই ঘটেনি, এমনকি হিন্দুধর্মকে সংহার করতে বহু ধর্মেরই উদ্ভব ঘটেছে আর এদের দ্বারা হিন্দুরা বিপথে চালিতও কম হয়নি মহামানবরা যেমন সমাজ সংস্কারের জন্য কাজ করেন তেমনই সময়ের প্রয়োজনে কিছু পদ্ধতিও সম্প্রদায় সমাজের জন্য নির্দেশ করেনখ্রিস্টীয় চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দীর দিকে তেমনই একজন ঋষির আবির্ভাব ঘটেযদিও ১২০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আনুষ্ঠানিক ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক বিস্তার শুরু হয়, কিন্তু মূল কাজটি শুরু হয়েছিল বেশ পূর্বেআর ভিন্ন ধর্মে চলে যাওয়া হিন্দুদের নিজ ধর্মে ফিরিয়ে আনতে এবং ভিন্ন ধর্মের মানুষকে হিন্দুধর্ম গ্রহণের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেন এই মহান ঋষি দেবলতাঁর রচিত দেবল স্মৃতিহিন্দুধর্ম গ্রহণের পূর্ণাঙ্গ বিধান দেওয়া আছে ভারতীয় আর্য সমাজ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে কনভার্ট হওয়া হিন্দুদের নিজ ধর্মে ফিরিয়ে আনা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুধর্ম গ্রহণেরশুদ্ধি যজ্ঞনামক আনুষ্ঠানিকতাটি মূলত এই দেবল স্মৃতির অনুসরণ চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দীর দিকে ঋষি দেবলের ডাকে সমসাময়িক ভারতে ঋষিদের নিয়ে সিন্ধু তীরবর্তী (বর্তমান পাকিস্তান অংশে) এক সম্মেলন হয়এই সম্মেলনে ঋষি দেবল অন্যান্য ঋষিগণ হিন্দুদের রক্ষা হিন্দুধর্ম প্রসারের লক্ষ্যে কিছু সিদ্ধন্তে উপনীত হনএই সিদ্ধন্তের ফলাফল হচ্ছে দেবল স্মৃতিনামক গ্রন্থ ভারতের দেরাদুন আর্য সমাজের গ্রন্থাগারে আজও দেবল স্মৃতিসংরক্ষিত আছে এছাড়াও বেদের সেই বিখ্যাত মন্ত্রও আমাদের নির্দেশ করে যে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করা যায় – “হে মনুষ্যগণ তোমরা ঈশ্বরের মহিমাকে বৃদ্ধি করো, সমগ্র বিশ্বকে আর্যধর্মে দীক্ষিত করো (ঋগ্বেদ, /৬৩/)
হিন্দুধর্ম একটি সার্বজনীন বিশ্বকোশ এবং এটি কোনো সাম্প্রদায়িক অনুশাসন নয়, এটি হচ্ছে আমাদের জীবনের অবলম্বন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে এই ধর্মের আলোকে উদ্ভাসিত তার সঙ্গীত অনুপ্রাণিত হিন্দুধর্মের প্রথম সিদ্ধান্ত হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বহিন্দুধর্মের গণ্ডির মধ্যে কখনোই নিরীশ্বরবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনিধর্মমতের অবাধ স্বধীনতা হিন্দুধর্মেও সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য “Weber, Hunter, Wilson, Davies, Hopkins, Schlogel, Max Muller প্রমুখ ঋষিগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, শুধু আধ্যাত্মবিদ্যা নয়, জাগতিক জ্ঞানের যে-কোনো শাখার উৎপত্তিস্থল এই ভারতবর্ষ এবং হিন্দুরাই পাশ্চাত্য সভ্যতা শিক্ষার আদি শুরু অঙ্ক, জ্যামিতি, বীজগণিত, এমনকি অন্তরকলন, জ্যোতির্বিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, স্থান কালের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিভাজনের যে তথ্য ঋষিরা বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে আবিষ্কার করেছিলেন এবং যা হৃদয়ঙ্গম করতে পাশ্চাত্য ধুরন্ধরদের এত যুগ লেগেছে, তারই সহায়তায় হিন্দুগণ বিবর্তনবাদ উদ্ঘাটিত করে
 
‘‘হিন্দুধর্ম কোনও প্রমাণিত ধর্ম নয় কারণ কে এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, কখন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে কোনও তথ্য নেইবিচারের কোন মানদণ্ড নেই, তাই একজন হিন্দু ধর্ম পালন না করেও ভালো হিন্দু বলে পরিচয় দিতে পারে’’ [Richard F. Nyrof, Area Handbook for India, (Washington: 1975), p. 163.] S.V. Kelkar বলেন, ‘‘হিন্দুদের একই মতবাদের কোনও ধর্মগ্রন্থ নেইধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে দেবতাদের কোনও যোগসাজস নেই, যা হিন্দু ধর্মীয় জীবনকে একই ধর্মমতের ছায়াতলে আনতে পারেনিধর্মীয় পণ্ডিতগণকে একই শিক্ষায় আকর্ষণ করতে পারেনি’’ [Theertha, p.177.]  (সমাপ্ত)
 
============================================================
তথ্যসূত্র : (১) রামায়ণ-মহাভারত : কাল, ইতিহাস, সিদ্ধান্ত -- লেখক বাসুদেব পোদ্দার, (২) The Ram Myth – Romilla Thapar, (৩) রামায়ণ সংখ্যা, কোরক, ১৪০৫। (৪) রামায়ণ ও মহাভারত : নব সমীক্ষা শ্রীমনোনীত সেন।(৫) বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা সুকুমারী ভট্টাচার্য।(৬) রামায়ণ ও মহাভারত : আনুপাতিক জনপ্রিয়তা সুকুমারী ভট্টাচার্য। (৭) মহাভারতে যৌনতা -- শামিম আহমেদ। (৮) মহাভারতে প্রেম ও যৌনতা -- পৃথ্বীরাজ সেন । (৯) অভাজনের মহাভারত -- মাহবুব লীলেন। (১০) ভারতপ্রেমকথা -- সুবোধ ঘোষ। (১১) ভারতবর্ষের ইতিহাস(প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগ) গোপালচন্দ্র সিনহা। (১২) কৃষ্ণচরিত্র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। (১৩) হিন্দুধর্ম কী মহাত্মা গান্ধী। (১৪) হিন্দুধর্মের সারতত্ত্ব ডঃ দুর্গাদাস বসু।(১৫) প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য সুকুমারী ভট্টাচার্য, (১৬) হিন্দু জাতীয়তাবাদ : একটি ইতিবৃত্ত ডঃ শ্যামাপ্রসাদ বসু।

1 টি মন্তব্য:

সব্যসাচী সরকার বলেছেন...

দাদা, অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা...!