সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫

দেবতার তত্ত্বতালাশ (প্রথম পর্ব)



ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ সৃষ্টিকর্তাকে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই একই পংক্তিতে ফেলে ভেবে থাকেন। মুসলিমগণ তাদের ঈশ্বরকে 'আল্লাহ' এবং খ্রিস্টানগণ 'গড' বলে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কাছে ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা, ঠাকুর সবই এক। সবই কিন্তু এক নয়। দেবতা বা ঠাকুরের মধ্যে ঈশ্বর বা ভগবানের বিস্তর তফাত। কখনোই এক নয়। ঈশ্বর বা ভগবান নিরাকার, দেবতা বা ঠাকুর সাকার। ঈশ্বর বা ভগবান বিমূর্ত। দেবতা বা ঠাকুর মূর্তিমান। হিন্দু, গ্রিক, মিশরীয় এবং রোমানদের ছাড়া আর কোনো ধর্মেই দেবতা বা ঠাকুর নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদেরও ঈশ্বর বা ভগবান আছে। ভাষাভেদে ভিন্ন নামে। আল্লাহ, গড -- সব ঈশ্বরেরই প্রতিশব্দ। ঈশ্বর হল জাগতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থানকারী কোনো অস্তিত্ব | অনেকের মতে, এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক আছে মনে করা হয় --- যাকে গড, ঈশ্বর সহ বিভিন্ন ভাষা ও সংষ্কৃতিতে বিভিন্ন নাম এবং উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়। এই অস্তিত্বে বিশ্বাসীগণ ঈশ্বরের বা উপাসনা করেন। তাদেরকে আস্তিক বলা হয়| আর অনেকে ধারণাকে অস্বীকার করেন| এদেরকে বলা হয় নাস্তিক| আস্তিক সমাজে, ঈশ্বরের ধারণা ধর্ম ও ভাষা ভেদে ভিন্ন। ভাষাভেদে একে ইংরেজি ভাষায় গড, আরবি ভাষায় ইলাহ এবং বাংলা ও সংষ্কৃত ভাষায় ঈশ্বর ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। একজন সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারণাকে বলা হয় একেশ্বরবাদ| ভগবান এবং দেবতার মধ্যে পার্থক্য কী ? এককথায় হিন্দুরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভগবান নামে ডাকেন, তবে তারা বিশ্বাস করে ভগবান সরাসরি নিজে সবকিছু করেন না। তিনি একই সঙ্গে, একই সময়ে, নানান রূপে একাধিক কাজ সম্পন্ন করেন। ভিন্ন ভিন্ন কাজ করার সময় তার যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রকাশিত হয় সেটাকেই হিন্দুরা বলে দেবতা। যেমন ভাবা হয় ভগবান বিশ্বকর্মাদেবতা নাম নিয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। হিন্দুরা বিশ্বকর্মাকে দেবতা মনে করেন। একইভাবে বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ইত্যাদি। অপৌরুষেয় গ্রন্থগুলিতে বলা হয়েছে --- দেবতারা ঈশ্বরনন, দেবতারা ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ মানুষ!
গ্রিকদেবী অ্যাফ্রোদিতি
ঈশ্বর হলেন সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর কোনো শুরুও নেই এবং তাঁর কোনো শেষও নেই। আস্তিকগণ মনে করেন কোনো মানুষই কখনো ঈশ্বরকে দেখেনি। বামাক্ষ্যপা, রামপ্রসাদ, মোহম্মদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ, জিশু, ইব্রাহিম কেউ নয়। ঈশ্বরের ধারণা দিয়েছেন মাত্র। কারণ তিনি হলেন আত্মিক ব্যক্তি। আর এর অর্থ হল -- পৃথিবীতে বসবাসরত মাংসিক প্রাণী থেকে তাঁর জীবন আরও উন্নত প্রকৃতির। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে তা যেমন প্রমাণ করা যায় না, আবার তিনি যে নাই তাও প্রমাণ করা যায় না। বাইবেল বলে, বিশ্বাসেই এই সত্য আমাদের অবশ্য মেনে নিতে হবে যে, ঈশ্বর সত্যিই আছেন --বিশ্বাস ছাড়া ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা অসম্ভব, কারণ ঈশ্বরের কাছে যে যায়, তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ঈশ্বর আছেন এবং যারা তাঁর ইচ্ছামত চলে তারা তাঁর হাত থেকে তাদের পাওনা পায়” (ইব্রীয় ১১:৬)। যদি ঈশ্বর চান তাহলে খুব সহজে তিনি তো উপস্থিত হয়ে সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দিতে পারেন যে, তিনি আছেন। কিন্তু যদি তিনি তা করেন, তাহলে বিশ্বাসের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। সেইজন্য জিশু থোমাকে বলেছিলেন -- থোমা, তুমি কি আমাকে দেখেছ বলে বিশ্বাস করছ ? যারা না দেখে বিশ্বাস করে তারা ধন্য” (জোহন ২০:২৯)। তবে, তার মানে এই নয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। বাইবেল বর্ণনা করেছে --মহাকাশ ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করছে, আর আকাশ তুলে ধরছে তাঁর হাতের কাজ। দিনের পর দিন তাদের ভিতর থেকে বাণী বেরিয়ে আসে, আর রাতের পর রাত তারা ঘোষণা করে জ্ঞান। কিন্তু তাতে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভাষা নেই, তাদের স্বরও কানে শোনা যায় না। তবু তাদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে জগতের শেষ সীমা পর্যন্ত।”(গীতসংহিতা ১৯:১-৪)।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রথম যুক্তি : ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা দিয়েই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। ঈশ্বর সম্বন্ধে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে --তিনি এমন এক সত্ত্বা, তাঁর চেয়ে মহত্তর আর কিছু ভাবা যায় না।এভাবেও যুক্তি দেওয়া হয়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকার চেয়ে বরং তাঁর অস্তিত্ব থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো। তার মানে ধারণা করার মতো সবচেয়ে বড়ো সত্ত্বার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকে, তাহলে ঈশ্বর সম্পর্কে সবচেয়ে বড়ো কোনো ধারণা করা যায় না। করা না-গেলে ঈশ্বর সম্পর্কে এই সংজ্ঞার গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি : উদ্দেশ্যবাদ। উদ্দেশ্যবাদ এভাবে বর্ণনা করে, যেহেতু এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এক আশ্চর্য উপায়ে সাজানো, সেহেতু একজন ঐশী পরিকল্পনাকারী অবশ্যই আছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যদি পৃথিবী কোনো কারণে সূর্যের কাছে আসে বা সূর্য থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে পৃথিবী এখনকার মতন প্রাণীর অস্তিত্ব ধরে রাখতে সমর্থ হবে না। আমাদের বায়ূমন্ডলের কোনো উপাদান যদি সামান্য পরিমাণে এদিক-সেদিক হয়ে যায়, তাহলে এই পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রাণীই বেঁচে থাকবে না।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে তৃতীয় যুক্তি : সৃষ্টিতত্ত্ব। কোনো কিছু ঘটলে তার কারণ অবশ্যই থাকে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এবং যা কিছু সৃষ্টি, তা অবশ্যই কোনো ঘটনার ফল। অবশ্যই এমন কিছু কারণ ঘটেছে, যার ফলে সবকিছুর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। চুড়ান্তভাবে কারণ ছাড়া অবশ্যই এমন কিছু আছে -- যার কারণে সবকিছুই অস্তিত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। আর এই কারণ ছাড়াইকারণ হচ্ছে ঈশ্বর। ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে চতুর্থ যুক্তি : সমগ্র ইতিহাস জুড়ে প্রত্যেকটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিছু নিয়ম আছে। প্রত্যেকের রয়েছে ভালো-মন্দের জ্ঞান। খুন করা, মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা এবং অনৈতিক কাজ করা -- প্রায় সর্বজনীনভাবে বর্জন করা হয়েছে। যদি একজন পবিত্র ঈশ্বর না থাকেন, তাহলে এইরকম ভালো ও মন্দ বোঝার জ্ঞান কোথা থেকে এলো ?
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে পঞ্চম যুক্তি : যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, তারা প্রাকৃতিক বিবর্তনের মতবাদকে খুব জোরালোভাবে ধরে রাখে, যা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে তাদের জন্য বিকল্প পথ। ঈশ্বর আছেন এবং সকলেই জানে তিনি আছেন। তবে খুব সত্যি এটাই, যখন কেউ আক্রমণাত্মকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে প্রমাণ করতে চায়, তা আসলে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে একটা যুক্তি।
ভারতীয় দার্শনিক ভাষ্যমতে, মানুষ হল প্রকৃতি বা প্রকৃতির অংশ। এটাই প্রমাণ যে মানুষ প্রকৃতির ভিন্ন কোনো জিনিস নয়। মানুষ অন্যান্য সৃষ্টিগুলির মতোই। শুধুমাত্র মানুষের বৈশিষ্ট্যমূলক ও অপূর্ব চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মস্তিষ্ক আছে। মানব শরীর হল একটি সরল রূপান্তর খাদ্য থেকে শারীরিক অংশে। খাদ্য হচ্ছে জড় বা মৃত পদার্থ এবং মানুষের শরীরও জড় পদার্থ। আমাদেও ভিতরকার ঈশ্বরের উপস্থিতি এই জড় দেহকে জীবন্ত দেহে পরিণত। এরকম একটা সংবাদ দেখেছিলাম ইয়াহু ডট কমের প্রথম পৃষ্ঠায় (৭ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮)। বিজ্ঞানীরা জীবন সৃষ্টি করেছেন কিছু পদার্থ থেকে। এটার মধ্য দিয়ে মনোথিজম, প্যানথিজম বা পলিথিজম তত্ত্বের পরাজয় হয়েছে। এটি একটি দুঃখজনক সে তত্ত্বেও যেখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ একটি জীবন সৃষ্টি করেছে এবং প্রমাণ করেছে সে ঈশ্বরের চেয়ে ভিন্ন নয়। জড় ও চেতন হল প্রকৃতির দুটি ভাগ। জড় চেতন হতে পারে এবং চেতনও জড় হতে পারে। সুতরাং খাদ্য শরীরের অংশে পরিণত হয় এবং চেতনে রূপান্তর ঘটে। জীবন্ত মানুষ জড়ে পরিণত হয় মৃত্যুর পর। সুতরাং দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত ও জীবন্তেও মধ্যে কোনো তফাত নেই। শুধুমাত্র জ্ঞানের অনুপস্থিতিরই পার্থক্য। তারা পারস্পরিক রূপান্তরে সক্ষম। খাদ্য অবস্থায় জ্ঞান নিষ্ক্রিয় থাকে। শরীরী অবস্থায় জ্ঞান সক্রিয় থাকে। জ্ঞানই ঈশ্বর, অর্থাৎ ব্রহ্ম।
আস্তিকগণ বলেন, এই ঈশ্বর নাকি মানুষের (শুধু মানুষ ! অন্য সব হাজার হাজার প্রাণীদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক নন ঈশ্বর। কারণ তাদের ঈশ্বরও নেই ধর্মও নেই আরাধনাও নেই) ভাগ্যসমগ্র তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে যোগ করেন মানুষ যা করে তা উনার ইচ্ছাতেই করে। যখন বলা হয় মানুষ যেহেতু ঈশ্বর ইচ্ছাতেই সব করে, তাহলে খারাপ কাজের দায়-দায়িত্বও ঈশ্বরের। পাপকর্মের জন্য পরকালে শাস্তি প্রদান ব্যাপারটা খুবই অযৌক্তিক। তারা তখন পালটি খেয়ে বলেন -- এইসব আসলে রূপকার্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ভাগ্য গলায় ঝুলানো বলতে বোঝানো হয়েছে মানুষকে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। মানুষ নিজেই তার ভাগ্যনিয়ন্তা। সেকি ! ঈশ্বরের ইচ্ছায় কাজকর্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন ঈশ্বর মানুষকে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার দিলেও ফলাফল তিনি আগে থেকেই জানেন, যেভাবেই ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করুক না কেন ফলাফল তো পরম নিয়ন্ত্রকের ইচ্ছাতেই হচ্ছে। তাহলে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়ার উদ্দেশ্য কী ? ফলাফল যদি নির্ধারিতই থাকে তাহলে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে কী হবে ? এর উত্তরে কেউ কেউ বলেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীন, তাকে ভালো-খারাপ কাজের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। মানুষ তার জ্ঞানের দ্বারা কৃতকর্মের ফল লাভ করবে। এই দাবি আগের সব কথার সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক। মানুষ স্বাধীন হলে কেবল ভাগ্যতত্ত্বই বাতিল হয়ে যায় না সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের সবজান্তা, ভবিষ্যতদ্রষ্টা, সর্ব নিয়ন্ত্রক ইত্যাদি বিশেষণও বাতিল হয়ে যাবে। আদম-ইভের ভুলও ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছে। তা নাহলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও ধ্বংস হবে না। আদম-ইভ স্বাধীন ইচ্ছায় চললে যে ঈশ্বরের এই বিশাল প্ল্যান-পরিকল্পনা মিথ্যা হয়ে যেত। তাহলে বলা যায় তিনি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন ঠিকই, তবে ফলাফল তার জানা। জানা যায় ঈশ্বর এই মানুষ সহ হাজার হাজার প্রাণী, জড়, অজড় সৃষ্টি করেছেন। তাও আবার শুধু পৃথিবী নামক একটি গ্রহে। এখন পর্যন্ত যত সংখ্যক গ্রহ-উপগ্রহের অস্তিত্বের কথা জানা গেছে, কোথাও ঈশ্বরের সৃষ্টির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ঈশ্বর আরও একটি সৃষ্টির কলোনি করুক না পৃথিবীকে বাদ দিয়ে। পৃথিবীতে আর সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। এবার যা করার মানুষই করুক।
যেমন হিন্দুদের দেবতাদের বৈদিক দেবতা, পৌরাণিক দেবতাদের দেবকল্পনার উৎস বিশাল-বিপুল বৈদিক সাহিত্য। বেদ থেকে বেদোত্তর পুরাণ, পুরাণ থেকে পুরাণোত্তর যুগে তাঁদের রূপান্তর হয়েছে মাত্র। যেসব দেবতার প্রাধান্য বৈদিক যুগে ছিল, পুরাণের যুগে তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন, অথবা এক্কেবারে গৌণ বা নামেমাত্র পর্যবসিত হয়েছে। বৈদিকযুগে দেবতার মূর্তি ছিল না, ছিল না মূর্তিপুজোর রীতি। তবে পরবর্তী সময়ে এসে পুরাণ ও তন্ত্রে দেবতাদের সুস্পষ্ট মূর্তির বিবরণ পাওয়া যায়। বৈদিকযুগে একমাত্র অগ্নিই উপাস্য ছিল। অগ্নিই ছিল ঈশ্বরের মুখ এবং দূত। প্রজ্বলিত যজ্ঞের মধ্যে হবি (ঘৃত, পিষ্টক, পায়েস, পশুর বপা বা মেদ, মাংস প্রভৃতি সহযোগে)অর্পণ করে তুষ্ট করা হত।   এই যজ্ঞের অধিষ্ঠাতা যজ্ঞেশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বর। যজ্ঞেশ্বরকে তৃপ্ত করার জন্যই পার্থিব যজ্ঞের অনুষ্ঠান।

পুরাণ এবং তন্ত্রে যতই বহু দেবদেবীর উপাসনাই থাকুক না-কেন  সনাতন ধর্মে এক দেবতার উপাসকের সঙ্গে অন্য দেবতার উপাসকের বিরোধ নেই। সনাতন ধর্মে ঈশ্বর-কল্পনায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, মূর্তি-কল্পনার নিষেধাজ্ঞা নেই। কল্পনার ডানা মেলার অধিকার আছে। অপরদিকে ইসলাম ধর্মে মূর্তি-কল্পনা এবং মূর্তিপুজো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তদুপরি বলা হয়েছে মূর্তিপূজকরা শয়তানইসলামিদের মন্দির-দর্শনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সনাতনীদের মসজিদ-গির্জা অথবা অন্য কোনো ধর্মস্থান দর্শনে কোনো ফতোয়া নেই। খ্রিস্টানরা মূর্তিপূজক না-হলেও মুর্তিপূজকদের শয়তানবলে না। যদিও খ্রিস্টধর্মে জিশুর মূর্তি-কল্পনা আছে, মূর্তির সামনে প্রার্থনাও আছে। নিরাকার এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ধারণা করা সাধারণ মানুষের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। তাই নিরাকার ব্রহ্মকে সাকার রূপে কল্পনা করে মানুষ তৃপ্তি পায়। অন্য ধর্মাবলম্বীরা মূর্তিপূজকদের ঘৃণা করে তৃপ্তি পায়।

দেবতাদের কেন্দ্র করে যুগে যুগে গড়ে উঠেছে কত উপাখ্যান, কত কাহিনি। প্রচুর উপাখ্যান-আখ্যান আজগুবিই। তবে আজগুবি বা বানোয়াট হলেও তাতে আছে গভীর সত্য, সত্যের ব্যঞ্জনা। যদিও প্রায় সবকটি আখ্যান উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রচিত হয়েছে, সোজা কথায় যা হয়েছে শোষণের হাতিয়ার। চমকিয়ে লুটে খাওয়ার ফন্দি। স্বর্গ-নরকের সুখ-যন্ত্রণার আখ্যান তো খুবই জনপ্রিয়কিছু পণ্ডিত চিরকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার অভিলাষে ভুলভাল ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে থাকেন। প্রতিবাদ করলে ধর্মীয়ানুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে এই অজুহাতে হামলে পড়ে প্রতিবাদীর ঘাড়ের উপরএর ফলে চার্বাকদের ভ্যানিশ করা গেল, বৌদ্ধদের খেদিয়ে দেওয়া গেল ! বলা অমরত্ব মানে হাজার হাজার বছর নশ্বর দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা নয়, বলা হল না মূর্তি গড়ে পুজোর রীতি চিরন্তন নয়, বলা হল না অমৃতের অধিকারী দেবকুলের আয়ুষ্কালও অনন্ত নয়, বলা হয়নি ঈশ্বর আর দেবতা সমতুল নয়। বলা হয়নি দেবতা যে কেউ হতে পারে ঈশ্বর নয়। বলা হয়নি যত দেবতা তত পুজো, যত পুজো ততই কর্মসংস্থান যত রীতি ততই নিশ্চিত রোজগার সম্বৎসর দুধে-ঘিয়ে বিন্দাস।

কাল্পনিক কাহিনি শুনিয়ে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মের ঋষিরাই উচ্ছৃঙ্খল মানুষকে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করেননি, অন্য ধর্মেও আমরা এরকম বনোয়াট কাহিনি পাই যা মানুষকে সুপথে চালিত করার কাজে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কোরান এবং নিউ টেস্টামেন্টে উল্লিখিত পৃথিবীর প্রথম সেই আদম ও হাওয়া বা ইভের কাহিনি দেখব। আদম-হাওয়ার যৌনমিলনে হাওয়া গর্ভধারণ করলেন। যখন তা বোঝাস্বরূপ হল তখন তারা উভয়েই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে আমাদের প্রতিপালক! যদি তুমি আমাদেরকে একটি সুস্থ সন্তান দান করো, তবে আমরা নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভক্ত হব এক নির্দিষ্ট সময়ে হাওয়া এক জোড়া সন্তান প্রসব করলেন। দু-দুটি সন্তান লাভ করে তারা আনন্দে আত্মহারা। উভয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন হাবিল ও কাবিল ছিল আদম হাওয়ার প্রথম জোড়া সন্তান। পরবর্তিতে হাওয়া এক জোড়া কন্যাসন্তান প্রসব করেন। এরপরে তাদের একটি পুত্র সন্তানও হয়। তার নাম রাখা হয় শীষ। অত:পর তাদের অন্যান্য সন্তানেরা জন্মলাভ করেন। 
হাবিল ও কাবিলদুই ভাইয়ের মধ্যে কাবিল ছিল অহংকারী ও দুষ্ট। অন্যদিকে হাবিল ছিল দয়ালু ও ভক্তিমান। কাবিল কৃষিকাজ করত আর হাবিল চরাত মেষ। স্বভাবতই আদম ও হাওয়ার কাছে হাবিল প্রিয় ছিল।  হাবিল ও কাবিল যখন বিবাহের উপযুক্ত হল, তখন আদম জৈষ্ঠ্য হাবিলের সঙ্গে জৈষ্ঠ্য কন্যার এবং কনিষ্ঠ কাবিলের সঙ্গে কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু কাবিল তা মেনে নিতে রাজি হল না। কেন-না আদমের কন্যাদ্বয়ের মধ্যে জৈষ্ঠ্যটি ছিল কনিষ্ঠটির তুলনায় সুন্দরী, আকর্ষণীয়া। আর এ নিয়েই দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হল। আদম সিদ্ধান্ত শোনালেন,বললেন – “তোমরা উভয়ে কোরবানি দাও যার কোরবানি আল্লাহ স্বীকার করবেন, সেই প্রথমে তার স্ত্রী বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবে বললেন, “তোমরা তোমাদের কোরবানির দান উঁচু স্থানে নিয়ে রাখোউপর থেকে আগুন এসে যার দান পুড়িয়ে দেবে তার কোরবানি আল্লাহ গ্রহণ করেছেন বলে ধরা হবে
আল্লাহর উপর হাবিলের ভক্তি ও আস্থা ছিল প্রবল। সে ভাবল, খোদাকে যা দেব তা হবে সর্বোৎকৃষ্ট। সুতরাং সে তার মেষপাল থেকে সবচেয়ে সুন্দর একটি মেষ কোরবানি করে তা পাহাড়ের উপর রাখল। আর কাবিল ভাবল, ভাল শস্য নষ্ট করে লাভ কী, আল্লাহর তো কোনো কিছুরই অভাব নেই সুতরাং সে তার শস্য থেকে নিকৃষ্ট কিছু শস্য নিয়ে তা পাহাড়ের উপর রাখল।  এরপর সকলে অপেক্ষা করতে থাকল। হঠাৎ উপর থেকে আগুন নেমে এসে হাবিলের কোরবানির মাংস পোড়াতে লাগল। অর্থাৎ আল্লাহ হাবিলের কোরবানি গ্রহণ করেছেন। পৃথিবীর প্রথম কোরবানি।
হাবিলের কোরবানি কবুল হয়েছে  দেখে কাবিল মনে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ল। কোনো একদিন হাবিল তার মেষপাল চরাতে নিয়ে যাচ্ছে চারণভূমিতে। এসময় কাবিল তাকে দেখতে পেল। সে তার ক্ষেতে কাজ করছিল। হাবিলকে দেখতে পেয়েই কাবিলের মনে ঈর্ষা নতুন করে জেগে উঠল। কাবিল বলল, “আল্লাহ তোমার কোরবানি কবুল করেছেন কিন্তু আমারটা নয়হাবিল বলল, “আল্লাহ কেবলমাত্র সংযমীদের কোরবানিই কবুল করেনকাবিল বলল, “ভবিষ্যতে তোমার বংশধরেরা আমার বংশদরদের বলবেআল্লাহ তোমাদের পিতার কোরবানি স্বীকার করেননি আমি তা হতে দিতে পারি না। সুতরাং আমি তোমাকে খুন করব, করবই। হাবিল বলল, “তুমি আমাকে খুন করার জন্যে উদ্যত হলেও তোমাকে খুন করার জন্যে আমি উদ্যত হব না আমি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালককে ভয় করি। আমি চাই তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বইবে ও বাস করবে আগুনে। আর এটাই জালিমদের কর্মফল কাবিল একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে  হাবিলকে লক্ষ্য করে  ছুঁড়ে মারল। পাথরটি হাবিলের মাথায় পড়লে হাবিল লুটিয়ে পড়ল এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল  পৃথিবীর প্রথম খুন।
ইতিমধ্যে কাবিলের মন থেকে জিঘাংসা লুপ্ত হয়েছিল। সে তার ভাইয়ের মরদেহ কাঁধে তুলে নিল এবং ওই মৃতদেহ লুকানোর চেষ্টায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। একসময় লাশের শিরাগুলি সংকুচিত হয়ে  শক্ত হয়ে গেল পরিশ্রান্ত হয়ে সে একস্থানে বিশ্রামের জন্যে থামল এবং লাশটি নামিয়ে রেখে নিজের অবস্থা ও অবস্থানের কথা ভাবতে লাগল। তখন আল্লাহ চাইলেন তার এই বিশ্বাসী বান্দার মৃতদেহের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হোক। সুতরাং তিন এক কাককে পাঠিয়ে দিলেন লাশ কীভাবে গোপন করা যায় সেটা কাবিলকে তা দেখানোর উদ্দেশ্যে অপর একটি কাকের সঙ্গে মারামারি করে তাকে হত্যা করল। তারপর মৃত কাকের পাশে পায়ের নখর দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটি গর্ত তৈরি করল। এরপর মৃত কাকটিকে ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে ওই গর্তে ফেলার পর পুনরায় নখের সাহায্যে মৃত কাকটিকে মাটি চাপা দিয়ে দিল।  এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে কাবিল খুব লজ্জিত হল। ধিক্কার দিল নিজেকে। তারপর সে অনুতপ্ত হল। কাকের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে কাবিল  মাটি খুঁড়ে তার ভাইয়ের লাশ কবর দিয়ে দিল। পৃথিবীর প্রথম কবর 
বানোয়াট গল্প। রূপক। অলৌকিক -- কিন্তু গভীর, গভীর সত্য। শিক্ষণীয়। পথের পাথেয়।

সনাতন দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নেই, বরং একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। সনাতন ধর্মমতে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ, অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন। তার কোনো স্রষ্টা নেই, তিনি নিজের স্রষ্টা। ঈশ্বরের নির্দিষ্ট কোনো রূপ নেই, তই তিনি অরূপ। তিনি যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারেন। তাই প্রশ্নঈশ্বর আর দেবতা বা দেবদেবী এক ? না, এক নয়। ঈশ্বর এক, কিন্তু দেবতা বা দেবদেবী অনেক। দেবদেবীগণ কিন্তু একেবারেই ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণ, অর্থাৎ জগতের সব গুণের আধার তিনি। ঈশ্বর আবার সগুণও, কারণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর চাইলে যেকোনো গুণের অধিকারী হতে পারে। বলা হয় দেবতা বা দেবদেবীগণ ঈশ্বরের এই সগুণের প্রকাশ। অর্থাৎ ঈশ্বরের এক একটি গুণের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বরের শক্তির সগুণ রূপ দুর্গা, কালী, পার্বতী, সরস্বতী, লক্ষ্মী, যম ইত্যাদি। বলা হয়েছে ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন তখন ব্রহ্মা (ব্রহ্ম নয়), যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু, যখন প্রলয় ঘটান তখন শিব। বলা হয় দেবতাগণ এই পরম ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপ। অতএব সনাতনীরা বহু দেবোপাসক হতে পারে, কিন্তু বহু ঈশ্বরবাদী নয়।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ দেব-দেবতাদের বিষয়ে কী বলছে একবার দেখা যাতে পারে। ঋগবেদ থেকে আমরা ৩৩ কোটি দেবতার কথা জানতে পারি। সংস্কৃতে কোটিশব্দের সংখ্যাবাচক অর্থ ছাড়াও আরও অনেক অর্থ আছে। সংস্কৃতে কোটিশব্দের অর্থ হল অন্ত, চরম, অসংখ্য, অসীম, কল্পনা (বিশাল ধারণা)। অন্য অর্থ হল কোনো উপযুক্ত শব্দ বা রূপক বেছে নেওয়া । যদি শব্দটি ক্রিয়া হিসাবে ব্যবহৃত হয় তাহলে এ শব্দের উত্তম অর্থ হয় ধারণা বা রূপক। সনাতনী মহাসাধক ঋষিরা কখনোই ৩৩কোটি দেব-দেবতা বলে তারা ৩৩ কোটি দেবতার অস্তিত্ব বোঝাতে চাননি। প্রাচীন ভারতীয় সাধারণেরা এটাকে একটি সংখ্যা হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। কোটিশব্দটি প্রায় অর্থহীন অর্থাৎ কল্পনা বা ধারণা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হল ৩৩। এখন প্রশ্ন হল প্রাচীন লোকেরা কীভাবে এ তেত্রিশে (৩৩) পৌঁছোলো তা আগে বুঝতে হবে যে -- (১) ৩৩ কোটি দেবতা আছে, (২) এখানে ৩৩ দেবতার ধারণা বা কল্পনা আছে, (৩) এখানে কোনো বাহ্য দর্শনীয় কোনো দেবতা নেই। উপরের তিনটি বাক্যই একই অর্থ বহন করে। জড় ও চেতন উপাদান সমন্বয়ে পাওয়া গেল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা ৩৩। এই ৩৩ এসেছে এক নির্গুণ, নিরাকার ব্রহ্ম থেকে। ৩৩ একটি ধারণা, তাই বলা হয়েছে ৩৩ কোটি। এই তেত্রিশের (৩৩) মধ্যে চেতন উপাদান হল ৮। যা ভারতবর্ষে অষ্টধা প্রকৃতি নামে খুবই পরিচিত। বাকি ২৫ টি জড় ও চেতনের সমন্বয়। এটাই হল তেত্রিশের (৩৩) রহস্য। দেখা যাক উপাদানগুলি কী --- পঞ্চ কষা + পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় + পঞ্চ কর্মোন্দ্রিয় + পঞ্চ প্রান + পঞ্চ বিশ্ব = মোট ২৫ । এই ২৫ টি তৈরি হয়েছে জড় প্রকৃতি থেকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৮টি চেতন সত্ত্বা বা অষ্টধা প্রকৃতি। আগের ২৫ টি এসেছে ৫টি আন্তঃকর্মক উপাদান নিয়ে। পঞ্চকৃত পঞ্চ মহার ভূত + ৩ অন্তঃকরণ (১. আত্মজ্ঞান ২. মন ৩. স্বতন্ত্র বুদ্ধিদীপ্ততা) এসব মিলিয়ে হয় ৩৩। এই ৩৩ হল মানব এবং এ বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা ও শাসক।
এবার সরাসরি ঋগবেদের পাতা উলটে দেখে নেব। ঋগ্বেদে আছে দেবতা তেত্রিশটি। এই তেত্রিশই কবি, ভক্তদের গল্প গল্পে তেত্রিশ কোটি হয়ে গেছে। সেই তেত্রিশটি দেবতা শতপথ ব্রাহ্মণে (এটিও বেদ) তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়েছেন, যেমন -- (১) আদিত্য, (২) রুদ্র এবং (৩) বসু। মহাভারতেও এই তিন শ্রেণির দেবতার যেমন নাম দেওয়া আছে। ঋগবেদের সঙ্গে এর কিছু মিলে না। এর মধ্যে কোনো-কোনো দেবতার নামও ঋগবেদে পাওয়া যায় না। ঋগবেদে এমন অনেক দেবতার নাম পাওয়া যায়, যা এই তালিকায় নেই। ঋগবেদে কতকগুলি আদিত্যের নাম আছে বটে এবং তা রুদ্র ও বসু শব্দদ্বয় বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র এবং অষ্ট বসু -- এমন কথা নেই। ঋগবেদে নিম্নলিখিত দেবতাগণের নাম পাওয়া যায়। যেমন -- (১) মিত্র, বরুণ, অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড, সূর্য, সবিতা ও ইন্দ্র। এদেরকে ঋগবেদের কোনো-না-কোনো স্থানে আদিত্যবলা হয়েছে। অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড এদের কোনো প্রাধান্য নেই। (২) আর কয়েকটি, অর্থাৎ মিত্র, সূর্য, বরুণ, সবিতা ও ইন্দ্রের খুব প্রাধান্য। তা ছাড়া --- অগ্নি, বায়ু, মরুদ্গণ, বিষ্ণু, পর্জন্য, পূষা, ত্বষ্টা অশ্বীদ্বয়, সোম দেবতারাও ঋগবেদ সংহিতায় বড়ো প্রবল। (৩) বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি ও যমেরও কিছু গৌরব আছে। (৪) ত্রিত, আপ্ত্য, অধিব্রধ্ন ও অজ একপদের নাম স্থানে স্থানে পাওয়া যায়। (৫) এই ক-টি নামে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর বোঝায় -- বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ, স্কম্ভ, প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্ম। (৬) তা ছাড়া কয়েকটি দেবী আছেন। দুইটি দেবী বড় প্রধানা --- অদিতি ও ঊষা। (৭) সরস্বতী, ইলা, ভারতী, মহি, হোত্রা, বরুত্রী, ধীষণা, অরণ্যানী, অগ্নায়ী, বরুণানী, অশ্বিনী, রোদসী, রাকা, সিনিবালী গুঙ্গূ, শ্রদ্ধা ও শ্রী, এই কয় দেবীও আছেন। তদ্ভিন্ন পরিচিতা সকল নদীগণও স্তুত হইয়াছেন। আদিত্যশব্দে এখন সচরাচর সূর্য বোঝায়। দ্বাদশ আদিত্য বললে অনেকেই বারোটি সূর্য বোঝেন। অনেক পণ্ডিত আবার এই ব্যাখ্যা করেন যে, দ্বাদশ আদিত্য অর্থে বারোটি মাস বুঝতে হবে। অপরদিকে, আদিত্য সকল দেবতাদিগের সাধারণ নাম, এরূপ প্রয়োগও আছে। অমরকোষ”-দেব’-এর প্রতিশব্দ মধ্যে আদিতেয়শব্দটি ধরা হয়েছে। আদিতেয়, আদিত্য, একই। দ্বাদশ আদিত্য, একাদশটি রুদ্র এবং আটটি বসু। আদিত্য, রুদ্র, এবং বসু বিশেষ একটি দেবতার নাম নয়, দেবতার শ্রেণি বা জাতিবাচক মাত্র। বেদের উল্লেখযোগ্য দেবতারা হলেন --- অগ্নি, বরুণ, মিত্র, মরুৎগণ, বৃহস্পতি, পুষন, রুদ্র এবং বিষ্ণু। বর্তমানে অবশ্য একমাত্র বিষ্ণু ব্যতীত কেউই ভারতবর্ষে পূজিত হন না। বিষ্ণু অবশ্য টিকে আছেন অবতার তত্ত্বের মাধ্যমে। বিষ্ণুর দশাবতারের সঙ্গে সবাই পরিচিত।
দেবতা হচ্ছে সত্ত্বা”, যা আমাদের জন্য উপকারী। কিন্তু বেদে কোথাও এটা উল্লেখ নেই যে আমাদেরকে এইসব সত্ত্বাকে (মূর্তি গড়ে বা না-গড়ে) পুজো করতে হবে। ঈশ্বরকেও একজন দেবতা অথবা একাধিক দেবতা বলা হয় এবং সেজন্যই বোধহয়মহাদেবতাবলা হয় । তাই শুধু মাত্র তাকেই উপাসনা করতে হবে। বেদে ৩৩ কোটি দেবতার উল্লেখ করেনি, কিন্তু ৩৩ ধরনের দেবতার উল্লেখ আছে। সংস্কৃততেদেবতাঅর্থ হচ্ছে ধরন বা প্রকার। বিষয়টি শতপথ ব্রাহ্মণে খুবই পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এইসব ৩৩ জন দেবতার প্রভু হচ্ছেনমহাদেবতাঅথবা ঈশ্বর”, যাকে শতপথ ব্রাহ্মণ (১৪ কাণ্ড অনুযায়ী) শুধুমাত্র তাকেই উপাসনা করতে হবে, অন্য কাউকে নয়। বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থের আলোকে এই কথাটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে এইসব সত্ত্বাগুলি যাদের আমরা দেবতাবলি, তারা কেহই ঈশ্বরনয় এবং উপাসনার যোগ্যও নয়। ঈশ্বর বহু গুণাবলির অধিকারী। শুধুমাত্র মুর্খ মানুষেরাই মনে করে ঈশ্বরের এই ভিন্ন ভিন্ন গুণ এক-একটি ঈশ্বর। বেদে কয়েকটি মন্ত্র আছে, যেখানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে যে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এবং তার কোনো সহকারী, দূত, নবি, অবতার অথবা অধীনস্থ কোনো কর্মচারী নেই, যার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব। বেদ কী বলছে, নিজের চোখেই পর্যবেক্ষণ করা যাক --
এই সমস্ত বিশ্ব শুধু মাত্র একজন ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টি ও পরিচালিত হচ্ছে। কখনোই অন্যায় কোরো না অথবা অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনের ইচ্ছা কোরো না” (যজুর্বেদ ৪০/১)ঈশ্বর সর্বত্রই বিদ্যমান এবং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে পরিচালিত করেন। পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই জয় ও শ্বাশত, কারণ প্রদানকারী। প্রতিটি আত্মা অবশ্যই তাঁকেই সন্ধান করবে যেমন করে একটি শিশু তারা বাবাকে খোঁজে। শুধুমাত্র তিনি আমাদেরকে খাদ্য ও স্বর্গীয় সুখ প্রদান করেন” (ঋগবেদ ১০/৪৮/১)। ঈশ্বর সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করেন। তিনি অপরাজেয় এবং মৃত্যুহীনওতিনি এই জগত সৃষ্টিকারী। সকল আত্মার উচিত পরম সুখ সন্ধান করা জ্ঞান অন্বেষণ ও কর্মের মধ্য দিয়ে। তারা কখনোই ঈশ্বরের বন্ধুত্ব থেকে নিজেকে পরিহার করবে না” (ঋগবেদ ১০/৪৮/৫) ।ঈশ্বরই সত্যের সন্ধানীদের সত্য জ্ঞান দিয়ে থাকেন। তিনিই শুধু জ্ঞানের প্রর্বতক এবং ধার্মিক ব্যাক্তিদের পরম সুখ লাভের জন্য পবিত্র কর্ম করতে উৎসাহী করেন। তিনিই একমাত্র জগতের সৃষ্টিকারী এবং এর পরিচালক। ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা কোরো না” (ঋগবেদ ১০/৪৯/১) ।সমগ্র বিশ্বে শুধু একজনই হর্তাকর্তা রয়েছেন। শুধুমাত্র তিনিই পৃথিবী, আকাশ, এবং অন্যান্য দৈবসত্ত্বাকে ধারণ করেন। তিনি নিজেই পরম সুখী! তিনিই শুধুমাত্র তিনিই আমাদের দ্বারা উপাসিত হবেন” (যজুর্বেদ ১৩/৪) ।তিনি না দুই, না তিন, না চার, না পাঁচ, না ছয়, এমনকি না সাত, না আট, না নয়, না দশ। তিনি একজন এবং শুধুই একজন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ ঈশ্বর নন। সকল দেবতাগণ তার মাঝেই থাকেন এবং তার দ্বারাই পরিচালিত হন। তাই তিনি ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য নেই” (অথর্ববেদ ১৩/৪/১৬-২১) । শুধুমাত্র ঈশ্বরই হলেন শ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র উপাস্য। তিনিই সমস্ত জ্ঞানের ও কার্যাবলির উৎস” (অথর্ববেদ ১০/৭/৩৮) ।বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত স্থানেই তিনি বর্তমান। কোনো স্থানই তাঁকে আড়াল করতে পারে না। তিনি নিজেই নিজের কাজ করেন এবং তাঁর কাজ করার জন্য তাঁর কোনো সহায়কের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। যে আত্মা অনুধাবন করতে পারে যে শুধুমাত্র ঈশ্বরই তাকে জয় করতে পারে এবং উপভোগ করতে পারে শর্তহীন অসীম আনন্দ” (যজুর্বেদ ৩২/১১) ।
বৈদিক দেবতাদের মধ্যে আমরা আকাশদেবতাকে পেয়েছি। (আকাশ : আকাশ হল ভূপৃষ্ঠ থেকে দেখতে পাওয়া বায়ুমণ্ডল বা মহাশূন্যের অংশবিশেষ। দিনের বেলায় সূর্যের আলোর বিক্ষেপণের ফলে আকাশ নীল দেখায়, আর একই কারণে সকাল ও সন্ধ্যায় এর রং হয় লাল। রাতের আকাশ কালো। আকাশ কোনো নির্দিষ্ট বস্তু নির্দেশ করে না। কিন্তু বলা হয় আকাশে মেঘ, পাখি ইত্যাদি ঘুরে বেড়ায়। মাথার উপরের শুন্য অংশটাকেও কখনো-কখনো আকাশ বলা হয়। আবার কখনো কোটি মাইল দূরের অংশকেও আকাশ বলা হয়ে থাকে। তারা কিংবা গ্রহদেরকেও আকাশে ধরা হয়ে থাকে। আসলে মাথার উপরের ফাঁকা জায়গা থেকে শুরু করে মহাশুন্য পর্যন্ত সবটাকেই আকাশ ধরা হয়।) এবং সূর্যদেবতার কথা জানি। (সূর্য : সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রের খুব কাছে অবস্থিত তারাটির নাম। প্রায় আদর্শ গোলক আকৃতির এই তারা প্রধানত প্লাজমা তথা আয়নিত পদার্থ দিয়ে গঠিত যার মধ্যে জড়িয়ে আছে চৌম্বক ক্ষেত্র। এর ব্যাস প্রায় ১৩ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার যা পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ, ভর প্রায় ×১০৩০ কিলোগ্রাম তথা পৃথিবীর ভরের ৩ লক্ষ ৩০ হাজার গুণ। এই ভর সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগ। সূর্যের প্রধান গাঠনিক উপাদান হাইড্রোজেন, আসলে মোট ভরের তিন চতুর্থাংশই হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেনের পরেই সবচেয়ে প্রাচুর্যময় মৌল হিলিয়াম। হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌল সূর্যের মাত্র ১.৬৯% ভরের জন্য দায়ী, তারপরও এদের সম্মিলিত ভর পৃথিবীর ভরের ৫,৬২৮ গুণ। এই ভারী মৌলগুলির মধ্যে আছে অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন, লোহা ইত্যাদি।)
জানি বায়ুদেবতার কথা। (বায়ু : বায়ু পৃথিবীর চারদিক বেষ্টনকারী গ্যাসীয় আবরণ যা পৃথিবীর অভিকর্ষের টানে পৃথিবী সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর জীবজগৎকে ক্ষতিকর বিকিরণ এবং মহাজাগতিক ধ্বংসাত্মক রশ্মি থেকে রক্ষা করে। নানাবিধ গ্যাসের মিশ্রণে বায়ু গঠিত, যার মধ্যে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ সর্বাধিক। ফুসফুস মারফত বায়ুর অক্সিজেন গ্রহন করেই প্রাণীকুল জীবনধারণ করে।) প্রথম বায়ু বা বাত, দ্বিতীয় মরুদ্গণ। বায়ুও পৌরাণিক দেবতার মধ্যে স্থান পেয়েছেন। পুরাণেতিহাসে ইন্দ্র ইত্যাদির মতো ইনি একজন দিক্‌পাল গণ্য। বায়ু আবার পবন নাম ধারণ করেছেন। ইনি প্রচলিত দেবতাদের মধ্যে একজন বটে। বায়ু বাতাস হলে মরুদগণ ঝড়। নামটা কোথাও একবচন নাই, সর্বত্রই বহুবচন লক্ষ করা গেছে। এদেরকে কখনো-কখনো রুদ্রও বলা হয়ে থাকে। রুদ্ ধাতু চীৎকারার্থে রুদ্ ধাতু হইতে রোদন হয়েছে। ঝড়ের যেহেতু সশব্দে আগমন হয়, সেইজন্যই হয়তো মরুদ্গণকে রুদ্র বলা হয়েছে।
আছেন অগ্নিদেবতাও। (অগ্নি :আগুন দ্রুত প্রজ্জ্বলনশীল পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়াবিশেষ। এর মাধ্যমে উত্তাপ, আলোসহ বহুবিধ রাসায়নিক উৎপাদিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ধীরগতিতে অম্লজাত প্রক্রিয়ায় সংগঠিত মরিচা পড়া বা পরিপাকতন্ত্রের বিক্রিয়ায় সৃষ্ট আগুন এ সংজ্ঞায় ধর্তব্য নয়। আগুন খুবই গরম প্রকৃতির। এটি কখনো স্পর্শ করা যায় না। এর সংস্পর্শে যা আসে তার সবই পুড়ে যায়। মানুষের চামড়া এর স্পর্শে ফোসকা পড়ে কিংবা পুড়ে যায়। আগুন জ্বালানোর জন্য তিনটি উপাদানের প্রয়োজন পড়ে --- অক্সিজেন, জ্বালানী এবং তাপ। জ্বালানী হিসেবে কাঠ, কয়লা, তৈল এবং অন্যান্য দাহ্য পদার্থ পরিবেশের সর্বত্র রয়েছে। একবার আগুন জ্বলতে শুরু করলে পরবর্তীতে এটি নিজেই তাপ উৎপাদনে সক্ষম। কখনো-কখনো এটি নিজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে জ্বলতে শুরু করে।)। অগ্নি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈদিক দেবতা। অগ্নি আগুনের দেবতা এবং যজ্ঞের গ্রহীতা। অগ্নিকে দেবতাদের বার্তাবহ মনে করা হয়। তাই হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, যজ্ঞকালে অগ্নির উদ্দেশ্যে আহুতি প্রদান করলে সেই আহুতি দেবতাদের কাছে পৌঁছে যায়। অগ্নি চিরতরুণ, কারণ আগুন প্রতিদিন নতুন করে জ্বালা হয় এবং তিনি অমর।
ঋগবেদে উল্লিখিতআর-একটি দেবতা হলেন বৃহস্পতি বা ব্রহ্মণস্পতি। কেউ কেউ বলেন ইনিই অগ্নি, কেউ বলেন ব্রহ্মণ্যদেব। ইনি বর্তমানে দেবগুরু অথবা সৌরজগতের সবচেয়ে বড়ো গ্রহ বৃহস্পতি বা জুপিটার হিসাবে পরিচিত। ঋগবেদের আর-একজন দেবতা সোমদেব। সোমদেবতাই বর্তমানে চন্দ্র, ঋগবেদে ইনিই সোমরসের দেবতা। অশ্বীদ্বয় বা অশ্বিনীকুমার শেষরাত্রির দেবতা, ঊষার পূর্বগামী দেবতা। ঋগবেদে যিনি ত্বষ্টা তিনিই বিশ্বকর্মা হিসাবে পূজিত হন। ইনি দেবতাদিগের ইঞ্জিনিয়ার বা স্থাপত্যশিল্পী। বিশ্বকর্মা রচিত গ্রন্থখানির নাম বাস্তুশাস্ত্রম্ অনেকেই অভিশাপ দেন --- তোকে যমে ধরে না ?” কিংবা তুই তো যমেরও অরুচি হ্যাঁ, ঋগবেদে যমও আছেন। বৈদিক দেবীদিগের মধ্যে অদিতি, পৃথিবী এবং ঊষা --- এই তিনজনের গুরুত্ব আছে। সরস্বতীও একটি বৈদিক দেবী। তিনি কখনো নদী, কখনো বাগ্‌দেবী।
তাহলে দেখা যাচ্ছে বৈদিক দেবতারা মূলত প্রাকৃতিক এবং নুষ্যোচিতআগুন (বেদে তিন ধরনের তাপ উৎপাদনকারী আগুনের কথা জানা যায় সূর্যের আগুন, বজ্রপাতের আগুন এবং দাবানল বা চকমকি ঠোকা আগুন। তবে বেদের ঋষিদের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ব্যাপারটা জানা না-থাকায় সে বিষয়ে উল্লেখ নেই। কারণ ভারতবর্ষ অগ্ন্যুৎপাতপ্রবণ অঞ্চল নয়। তাই অগ্ন্যুৎপাত বা আগ্নেয়গিরির দেবতা পাই না।), বৃষ্টি, প্লাবন, ঝড়, বিদ্যুৎ, বজ্রপাত, মৃত্যুর মতো অনিবার্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকেই এদের যজ্ঞাদিপূর্বক উপাসনা। বানিয়ে বলছি না। বেদ থেকেই জেনে নিন
আ তেন যাতং মনসো জবীয়সা যথং যং বামৃভবশ্চক্রুরশ্বিনা।
যস্য যোগে দুহিতা জায়তে দিব উভে অহনী সুদিনে বিবস্বতঃ।।” (ঋকবেদ -- ১০ : ৩৯ : ১২)
অর্থাৎ অশ্বিদ্বয়, ঋভু নামক দেবতারা যে রথ প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন, যে রথের উদয় হইলে আকাশের কন্যা ঊষা আবির্ভূত হবেন এবং সূর্য হইতে অতি সুন্দর দিন ও রাত্রি জন্মগ্রহণ করে, মন অপেক্ষাও সমধিক সেই রথে আরোহণপূর্বক তোমরা আগমন করো।” ‘ঋভু মানে সূর্য বা সূর্যকিরণ-- “আদিত্যবশ্মযোঽপি ঋভব উচ্যন্তে।বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় এ বিবরণ এক বিন্দুও অলৌকিক নয়, প্রাকৃতিক। বিমূর্ত নয়, দর্শনযোগ্য। বৈদিক ঋষিরা মনে করতেন, এই যে বর্ষণধারা, এরও একটা দেবতা আছে। এই বর্ষণ বা বৃষ্টির দেবতার নাম বেন। এই দেবতার উল্লেখ ঋগবেদের দশম মণ্ডলে ১২৩ সূক্তে আছে। ইনি অন্তরিক্ষে অবস্থান করেন এবং বৃষ্টিদান করেন। বৃষ্টিদানই তার একমাত্র কর্ম-কর্তব্য। অয়ং বেনশ্চোদয়ৎ পৃশ্নিগর্ভা জ্যোতির্জবায়ু রজসোবিমানে।/ইমমপাং সংগমে সূর্যস্য শিশুং ন বিপ্রা মতিভী রিহংতি।। অর্থাৎ জ্যোতির্বেষ্টিত এই বেন দেবতা উৎপত্তিস্থান অন্তরিক্ষে অবস্থিত থাকিয়া আদিত্যগর্ভভূত উদকরাশি প্রেরণ করেন। বৃষ্টিরূপ জলরাশির এবংএবং সূর্যের সঙ্গমস্থান অন্তরিক্ষে অবস্থিত শিশুর ন্যায় এই বেন দেবতাকে মেধাবী স্তোতৃগণ নানাবিধ স্তুতির দ্বারা অর্চিত করেন।এই আলোকময় বৃষ্টিদাতা দেবতাই আসলে সূর্য। বেদের ঋষিরা বলছেন ইনিই বৃষ্টিদাতা ইন্দ্র, পর্জন্য, বরুণ প্রভৃতি। সমুদ্রাদূমিমুদয়র্তি বেনো নভোজাঃ পৃষ্ঠং হর্ষতস্য দর্শি।/ঋতস্য সানাবিধ বিষ্টপি ভ্রাট্ সমানং যোনিমভ্যনূষত ব্রাঃ।।”(ঋগবেদ ১০ : ১২৩ : ) অথবা ভানুঃ শুক্রেন শোচিষা চকানস্তৃতীয়ে চক্রে বজসি প্রিয়াণি।” (ঋগবেদ ১০ : ১২৩ : ) অর্থাৎ তিনি শুভ্রবর্ণ আলোকের দ্বারা দীপ্যমান হবেন। দীপ্যমান হইয়া তিনি তৃতীয় লোকে অর্থাৎ আকাশের উপরিভাগ উপরিভাগ হইতে সর্বলোক-বাঞ্ছিত জলের সৃষ্টি করেন।
অবশ্য ঋগবেদে বেন দেবতার স্বরূপ সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা নেই। এই বেনই আবার পুরাণে এক অত্যাচারী রাজার নাম। ঋষির অভিশাপে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁর মন্থন করে পৃথুর জন্ম হয়। পৃথু থেকেই নাম হয় পৃথিবী।
বহুদেবতাবাদ থেকে অতিদেবতাবাদের মধ্য দিয়ে একদেবতাবাদ বা একেশ্বরবাদে উত্তরণ ঘটেছে বৈদিক দেবতাতত্ত্বে। বেদের দেবতাতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি দেবতাই বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি থেকে কল্পিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক রূপেরই প্রতিরূপ। অনেক ক্ষেত্রে দেবতা হিসাবে বিষয়বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এই অর্থে প্রস্তরখণ্ড, ধনুক, ব্যাঙ ইত্যাদি দেবতা প্রতিপন্ন হয়। বস্তুত ঋকবেদের দেবতা অর্থে বুঝি পৃথিবী বা অন্তরিক্ষ বা দ্যুলোকের এমন সব প্রাকৃতিক বিষয়, যাঁদের মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখে ঋষিরা তাঁদের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। এইসব বৈদিক যুগের প্রাকৃতিক দেবতাদের টপকে পৌরাণিক যুগে এসে গেল দুর্গা, কালী, গণেশ, কার্তিক, শনি, কৃষ্ণ ইত্যাদি মানুষরূপি দেবতারা। পুরাণে আছে, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় ও তার লীলা প্রকাশের বাসনায় দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছেএই দেবতারা সাকার। এঁরা জ্যোতিষ্মান, দীপ্তিমন্তদেবতাদের প্রধানত স্বর্গবাসী হিসাবেই দেখানো হয়েছে, অবশ্য পৃথিবীতেও তাদের অবস্থান আছে। দেবতারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। মানুষ যা করতে পারে না দেবতারা তা করতে পারেন, অথবা দেবতারা যা করতে পারেন মানুষ তা পারে না এরকম গোছের কিছু একটা। তবে সূর্য, সবিতা ও বিষ্ণু মনে হয় যেন একই দেবতা। আসলে সূর্যই একমাত্র দেবতা। শুধু হিন্দুদের দেবতা নয়, সমগ্র পৃথিবীর দেবতা। সূর্যই একমাত্র সব ধর্মাবলম্বীদের দেবতা। আমরা সকলে সূর্যদেবরই সন্তান। অমৃতস্য পুত্রাঃ। বৈদিক কবিরা সূর্যের গতিকেই এইভাবে বিষ্ণুর পদক্ষেপ বা ত্রিপাদগমন বলে কল্পনা করেছেন। এই ত্রিপাদ অর্থে সম্ভবত সূর্যের উদয়গিরিতে আরোহণ অর্থাৎ সূর্যের উদয়, মধ্য আকাশে স্থিতি অর্থাৎ মধ্যাহ্নপ্রখরতা এবং অস্তাচলে অস্তগমন। যদিও অন্যরা অনুমান করেন কবিরা এইভাবে সূর্যের ত্রিলোক-ভ্রমন কল্পনা করেছিলেন। পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণ, মহাভারত ও পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর এই ত্রিপাদ-ভ্রমণ সংক্রান্ত প্রাচীন কল্পনা নানা আখ্যায়িকা ও অনুষ্ঠানের সংযুক্ত হয়ে পল্লবিত ও জটিল রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু বিষ্ণু যে সূর্যেরই সমস্থানীয় দেবতা কিংবা ঋতুর নিয়ামক দেবতা সূর্যই, তা ঋগ্বেদের এই তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত থেকে অনুমিত হয় – “চতুর্ভিঃ সাকং নবতিং চ নামভিশ্চক্রং ন বৃত্তং ব্যতীরবীবিপৎ।/ বৃহচ্ছরীরো বিমিমান ঋক্কভিষুর্বাকুমারঃ প্রত্যেত্যাহবম্।।” (ঋগ্বেদ-১/১৫৫/৬)। ইরানের আবেস্তা আর উত্তর ভারতের বেদে বিভিন্ন ঈশ্বর(God)-এর সমাহার। আগেই বলেছি মিত্র ও বরুণ দুই ধর্মগ্রন্থেই আছেন । ইন্দো-ইরানীয় তাঁদের নানাবিধ God-এর মধ্যে দুই রকম God-কে আলাদা করে নিয়েছেন । একদল “Deava”, যার অর্থ স্বর্গীয় আর-এক দল “Asura”, যাদের বৈশিষ্ট্য অতিলৌকিক বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা । উত্তর ভারতের বেদে এদের প্রতিরূপ হল দেবএবং অসুরউত্তর ভারতে দেবপুজো পান এবং তাঁদের গুণকীর্তন হয় । তদুপরি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার বিধ্বংসী পরিণামের জন্য তাঁদের চোখে অসুরক্রমে ক্রমে দৈত্যবা দানব”-এ পরিণত হল । ইরানে কিন্ত বিবর্তনের পথটা অন্যরকমভাবেই হয়েছে । সেখানে অসুর পূজিত হন । আর “Deava”-রা পরিণত হন দৈত্য-দানব”-এ । জরাথুস্ট্র বা “Zoroaster” ছিলেন “Mazda” বা জ্ঞাননামে এক “Ahura”-র পূজারী । “Ahura” হল সেই “Asura” বা অসুর। সংস্কৃত ভাষায় “Ahura Mazda” হল জ্ঞানাসুর । বিভিন্ন Ahura-র মধ্যে “Ahura Mazda”-কেই সর্বোত্তম মনে করা হত । দরায়ুস বা Darius এবং তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে এই “Ahura” ছিলেন উপাস্য। প্রাচীন ইরানের আর্যদের কাছে অসুর হল পূজ্য । আর দেব হল দৈত্য-দানব। আর ভারতের আর্যদের কাছে দেব হল পূজ্য আর অসুর হল দানব । তাই দেব-অসুরের শব্দ বিভ্রান্তি এড়িয়ে শুভ আর অশুভের দ্বন্দ্বের কল্পনা করাই সবচেয়ে সুবিধাজনক । আর এই সুবিধাজনক ক্লেশহীন ধারণাই সনাতনীদের যুগ যুগ ধরে আনন্দে রেখেছে।
দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্ধ আছে । এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার জন্ম আছে। অনেক বিষয়ে মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মিল দেখা যায়, তাই হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া যায় । সেই কারণে পুরাণের দেবতারা মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য ) গড়ে উঠেছে। আবার অনেক দেবতা মানুষ থেকেও জন্মেছেন । তাই আহার-বিহার, যানবাহন বসন-ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের কাছাকাছি । তবে কৃষ্ণসহ বেশ কিছু নতুন চরিত্র বা ভগবানের উদ্ভব হয়, যেগুলি আসলে ঋগবেদের কিছু দেবতার ভিন্নরূপ বই কিছু নয়। কুন্তিপুত্র পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই হলেও তাদের জন্ম পাঁচজন অন্য পুরুষের (যাঁদের দেবতা বলা হয়েছে) ঔরসে। যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, ভীম বায়ুর, অর্জুন ইন্দ্রের এবং নকুল ও সহদেব যমজ দেবতা অশ্বীনিকুমারদ্বয়ের পুত্রসমস্যা হল ধর্ম নামে কোনো দেবতাকে আমরা ঋগবেদে পাই না। বাকিদের অবশ্য পাওয়া যায়। এখানে এই ধর্মসম্ভবত বরুণ। ঋগবেদে আমরা দেখতে পাই ধর্মসংস্কারের ফলে ইন্দ্র যখন প্রধান দেবতা হিসেবে প্রাধান্য পেতে শুরু করে তখন বরুণকে হেয় করা হয়। কিন্তু প্রথমদিককার ঋকগুলিতে বরুণ প্রধান দেবতা থেকেই যায়। কারণ সেগুলির পরিবর্তন সম্ভব ছিল না হয়তো। সম্ভবত ধর্মসংস্কারের জন্য প্রাচীন দেবতাকে যেহেতু বরুণরূপে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি, তাই তাকে নতুন নামে নতুন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ধর্মদেবতাকে সকল দেবতার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। ঋগবেদে বরুণের সঙ্গে আরও একজন দেবতাকে আমরা দেখতে পাই -- সে হল মিত্র। ইন্দ্রের পূর্বে বরুণ এবং মিত্র এই দুই দেবতাকে ঋগবেদে বেশ উঁচু স্থান দেওয়া হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণের অবস্থান নিরপেক্ষ মনে হলেও মোটেই তা নিরপেক্ষ ছিল নাসে পাণ্ডবদের মিত্রহিসাবেই অবস্থান নিয়েছিলেন। নিজের পক্ষকে জয় এনে দিতে ন্যায়ের নামে যা যা নোংরামিকরা যায়, তার সব তিনিই সম্পাদন করেছেন। ভালো মানুষের ভেক ধরে আর লম্বা লম্বা ডায়লগ মেরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাকে প্রহসনে পরিণত করেছেন কৃষ্ণ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কৃষ্ণ অনার্যের প্রতিনিধি ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে মনে করেন কৃষ্ণ মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়নও হতে পারেন। বেদব্যাসের অপর নামই তো কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।
শ্রীমদভগবদগীতা বলছে --- যেঽপ্যন্যদেবতাভক্তাঃ যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।/ তেঽপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যাবিধিপূর্ব্বকং ||” (গীতা। ৯।২৩।) অর্থাৎ ঈশ্বর ভিন্ন অন্য দেবতা নাই। যে অন্য দেবতাকে ভজনা করে সে অবিধিপূর্বক ঈশ্বরকেই ভজনা করে। প্রাচীন ইতিহাস থেকে আমরা দুই ধরনের দেবতাদের পাই – (১) আর্য দেবতা এবং (২) অনার্য দেবতা। লম্বা তালিকা দেওয়াই যায়কিন্তু দেব না। কলেবর না বাড়িয়ে দুটি উদাহরণ দেব।
আর্য দেবতা হলেন ইন্দ্র বা সহস্রলোচন। ইনি মূলত দেবতাদের রাজা, স্বর্গের রাজা। এঁর সহস্র চোখ ছিল। কথিত আছে সুন্দ-উপসুন্দ নামক অসুরদ্বয়কে হত্যা করার জন্য বিশ্বকর্মা তিলোত্তমা নামক একটি অপরূপ নারী সৃষ্টি করেছিলেন। তিলোত্তমাকে দেখার জন্য ইন্দ্রের সহস্র চোখের সৃষ্টি হয়েছিলআবার মহাভারতের মতে- গৌতম মুনির অনুপস্থিতে ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধরে তাঁর স্ত্রী অহল্যাকে ধর্ষণ করেন। এই কারণে মুনির অভিশাপে এঁর শরীরে সহস্র যোনিচিহ্ন প্রকাশ পায়। পরে ইন্দ্রের অনুনয় বিনয়ে গৌতম তাঁর ওই চিহ্নগুলিকে চোখে পরিণত করেছিলেন। আবার রামায়ণের মতে- গৌতমের অভিশাপে অণ্ডদ্বয় খসে পড়েছিল। পরে অশ্বিনীকুমারদ্বয় মেষের অণ্ড কেটে সেখানে সংযোজিত করে দেন।ইনি অনার্য বা অসুরদের চির শত্রু ছিলেন।দুর্দমনীয় যোদ্ধারূপেই তিনি পরিকল্পিত। অগ্নি ও এবং পুষা তাঁর ভাই। মরুৎগণ তাঁর সহায়। মহাভারতের মতে ইনি কুন্তীর গর্ভে অর্জুনকে জন্ম দেন পরবর্তী সময়ে ইনি অর্জুনের জন্য অন্যায়ভাবে কর্ণের কবচ ও কুণ্ডল সংগ্রহ করেছিলেন। ইনি কামদেবসহ স্বর্গবেশ্যাদের নিয়োগ করতেন। কৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের বিরোধ দেখা দিলে, কৃষ্ণের চেষ্টায় ব্রজবাসীরা ইন্দ্রের উপাসনা বন্ধ করে। সেই থেকেই বোধ হয় হিন্দুসমাজে ইন্দ্রের পুজো নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
অনার্য দেবতা হল শিব বা মহাদেব বা মহেশ্বর বা পশুপতি। অনার্য দ্রাবিড়রা ছিল মিস্টিক। দেবদেবীর কল্পনাতে তারা সূক্ষ্ম ধর্মবোধের পরিচয় দিয়েছে। দ্রাবিড়দের প্রধান দেবতা ছিলেন শিব। অর্থাৎ শিব হলেন অন্যতম অনার্য দ্রাবিড় দেবতা। যে কারণে সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে শিবের সর্ম্পক আছে। মোহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত একটি সিলমোহরে ত্রিমুখ, দ্বিশৃঙ্গ, যোগাসনে উপবিষ্ট ও পশুবেষ্টিত যে মূর্তিটি অঙ্কিত দেখা যায় সেটিকে পৌরাণিক শিব পশুপতির আদিরূপ হিসাবে অনুমান করা হয়। তবে বেদে অনার্য শিবের কোনো উল্লেখ নেই, থাকার কথাও নয়। কেউ কেউ অবশ্য বৈদিক দেবতা রুদ্রকে শিবের সঙ্গে তুলনা করেন। পরবর্তীতে অবশ্য শিব আর্য দেবমণ্ডলীতে পাক্কা জায়গা করে নেয়। তবে সেটি যে সহজে হয়নি, সেটা অনুমেয় । দোর্দণ্ডপ্রতাপ অনার্যদের রাজা শিবের সঙ্গে আর্যরা এঁটে উঠতে পারেননি। অতএব মেনে নেওয়া। আর্যরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পথ বেছে নিলেন চতুর এবং বিচক্ষণ আর্যদেবতারা অপ্রতিরোধ্য অনার্যদেবতা শিবকে দিয়েই বেশিরভাগ অসুর তথা অনার্যদের হত্যা করার কাজ সম্পন্ন করে নিয়েছিলেন। অনুমোদনের সিলমোহর ! দীর্ঘকালীন আর্য-অনার্য ধর্মীয় মতার্দশের প্রবল ঘাতপ্রতিঘাতের পরই এমন আপাত-সহাবস্থান সম্ভব হয়েছে।
তা ছাড়া আর্য-দ্রাবিড় মিশ্র সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। যেমন ওই সময় ভারতবর্ষের অধিবাসীদের মন থেকে অধিকাংশ বৈদিক দেবতারা অপসৃত হন। তার বদলে ভারতবর্ষের সমাজে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে নিয়েত্রিমূর্তিধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। এবং মহেশ্বরই হলেন অনার্য দেবতা শিব। যিনি পরবর্তীকালে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতার আসন লাভ করেন। বিভিন্ন পুরাণে ও শাস্ত্রে যেসব গুণাবলি শিবের উপর আরোপিত হয়েছে, তা অন্য কোনো দেবতার উপর আরোপিত হয়নি।ত্রিমূর্তিকল্পনায় শিবকে অহেতুক প্রলয়ের দেবতা বলা হয়েছে। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণু (বিষ্ণুঁ = ঈশ্বর, বিষ্ণু = দেবতা) জগৎ পালন করেন এবং মহেশ্বর প্রলয়ের দেবতা। প্রলয়ের তমোগুণে রুদ্রমূর্তিতে বিশ্বসংসার হরণ করেন বলে ইনি হরঅবশ্য অনেকেই শিবের এই অভিধা মেনে নেননি। আর্যরা অনার্য-দ্রাবিড় জাতির প্রধানতম দেবতা শিবকে গ্রহন করতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিল। অনার্য-দ্রাবিড় জাতি বৈদিক দেবতা বিষ্ণুকে গ্রহন করেনি। গ্রহণ করেছিল বিষ্ণুর অবতার রাম, কৃষ্ণকেই। অবশ্য অন্য অবতার মৎস্য, কূর্ম , বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, বুদ্ধ এবং কল্কিরা তেমন কলকে পায়নি।
সর্বোপরি, সর্বভারতীয় দেবতা হিসেবে শিবের প্রতিষ্ঠা মূলত আর্যদের উপর অনার্যদের বিশাল এক বিজয়। মাথায় জটাজুট, তার মানে জটা ধরা চুল, হাতে ত্রিশূল, পরনে পশুচামড়ার পোশাক, কপালে তৃতীয় নয়ন, কন্ঠ নীল । একদা আদিসমুদ্রের উপরিতলে বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল; শিব সেই বিষ পান করে নীলকন্ঠ হয়েছেন। এই রূপকথাটি পুরাণে কারা প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন ? আর্যরা না দ্রাবিড়? প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই । কেবল ইতিহাসের ধূসর লগ্নে উত্থিত অনার্য দেবতা শিব আজও ভারতবর্ষজুড়ে রয়েছেন স্বমহিমায়। পৌরাণিক যুগে শিব তাঁর পরিবারসহ হিন্দু মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন। শিব পরিণত হন পরিপূর্ণ দেবতায় । পার্বতী, উমা, গঙ্গা, দুর্গা ও কালী -- এঁরা শিবের স্ত্রীরূপে কল্পিত হন। সেই সঙ্গে শিবের দুই পুত্র -- গণেশ এবং কার্তিক। কন্যাদের মধ্যে মনসা ও লক্ষ্মী। সরস্বতী নয়
ঈশ্বর কোথায় থাকেন? সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ মনে করেন -- ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। সেইজন্যে তিনি সকল স্থানেই বিদ্যমান। ঈশ্বর আকাশে কোনো বিশেষ জায়গায় অথবা কোনো বিশেষ সিংহাসনের মতো কোনো নির্ধারিত তথা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতেন তাহলে তিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সমস্ত কিছুর পরিচালক, সৃষ্টিকারী ও ধ্বংসকারী হতে পারতেন না। তিনি যেখানে বর্তমান নেই, সেখানে তিনি তাঁর কোনো ক্ষমতায় প্রয়োগ করতে পারবেন না। যেখানে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সেখানে কোনো কারণই নেই যে তিনি ভয়ে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোনো এক ক্ষুদ্র সীমিত জায়গায় আত্মোগোপন করে থাকবেন। যদি তিনি তা করে থাকেন, তাহলে তাকে সর্বশক্তিমানবলা যাবে না। অতএব সমস্ত সৃষ্টি ঈশ্বরের মাঝেই। কারণ ঈশ্বর এই সমস্ত বস্তুসমূহের বাইরে, কিন্তু এই সমস্ত বস্তুসমূহ ঈশ্বরের বাইরে নয়সুতরাং পৃথিবীর সমস্ত কিছুতে ঈশ্বর পরিব্যাপ্ত।
বেদ এবং সাধারণ বুদ্ধি অনুসারে তিনি অবশ্যই নিরাকার। যদি কোনো আকার থাকত তাহলে সর্বব্যাপী হতে পারতেন না। কারণ আকার বলতে আমরা বুঝায় একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ অবয়ব। এবং সেই জন্য তার যদি কোনো আকার থাকে তাহলে সে তার সীমার বাইরে যেতে পারবেন না। যদি ঈশ্বর অশিষ্ট সাধারণ নগণ্য হতেন, তাহলে তার আকার দেখা যেত। কারণ কোনো বস্তু যা অন্য আর-একটি বস্তু যার আলোকতরঙ্গ প্রতিফলিত হতে পারে, তার চেয়ে সুক্ষ্মতর তাহলে আমরা তা খালি চোখে দেখতে পাই না। ঈশ্বর হচ্ছেন সবচেয়ে সূক্ষ্মতম, ফাঁকহীন এবং সর্বত্র একরূপ । সেজন্য তার কোনো আকার হতে পারে না। যদি ঈশ্বরের আকার থাকে তাহলে কেউ তার আকার সৃষ্টি করেছে। এটা একে বারেই অসম্ভব। ঈশ্বর নিজেই নিজের আকার তৈরি করেছেন, তাহলে এর অর্থ হচ্ছে তিনি আগে নিরাকার ছিলেন। ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার উভয়ই বললে ব্যাপারটা পরস্পরবিরোধী হয়ে যায়। তিনি সর্বত্র একরূপে বিরাজ করেন, তাহলে তিনি কীভাবে মানবদেহধারী ঈশ্বর ও পৃথিবীর বাকি অংশের মাঝে আলাদা করব ? বস্তুত বেদে ঈশ্বরের সাকার রূপ ধারণ করার কোনো ধারণা নেই। অধিকন্তু সেখানে এমন কিছুর উল্লেখ নেই যে ঈশ্বর আকারহীন হয়ে কিছু করতে পারবে না, তাই তাকে অবশ্যই আকার ধারণ করতে হবে।
রামায়ণের রাম-সীতা-হনুমান, মহাভারতের কৃষ্ণ ইত্যাদির মতো কাউকে ঐশ্বরিক মানবরূপ বলে গণ্য করা হয়। আসলে তারা ঐশ্বরিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এইসব কালজয়ী চরিত্রগুলি ছিলেন মনের বিশুদ্ধতা ও উপাস্য ঈশ্বরের সংক্ষিপ্তসার মাত্র সেজন্য সাধারণ মানুষ তাঁদেরকে ঈশ্বর জ্ঞান করে। কিন্তু বেদ ঈশ্বর ছাড়া অন্য কাউকে উপাসনাকে নিষিদ্ধ করেছে। এইরূপে এইসব চরিত্রগুলিকে যা সাধারণ মানুষ ঈশ্বর মনে করে তাদের পুজো করার বদলে তাদের অনুকরণ করে আমরা তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারিমাত্র।
যদি ঈশ্বর আকার ধারণ করবে এবং সেই সকলই আকারের পুজোর মাধ্যমে মুক্তিলাভ হবে তাহলে অবশ্যই বেদে এই বিষয়ে বর্ণনা থাকতকিন্তু বেদে এইরকম কোনো ইঙ্গিতই দেওয়া নেই।
বস্তুত পুরাণ থেকে আমরা প্রচুর দেবতার কাহিনি পাই। বিভিন্ন অলৌকিক কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে এই দেবদেবীদের প্রকাশ। এত দেবদেবতার প্রাবল্য একমাত্র সনাতন ধর্মেই দেখা মেলে। তবে গ্রিস ও রোমেও দেবদেবতাদের আধিক্য দেখা যায়। দেখা যায় দেবদেবীদের নিয়ে মূর্তিকল্পনা। যদিও প্রচলিত মূর্তিপুজো বেদ কখনো সমর্থন করেনি, বরং বিরোধিতা করেছে – “আজ্ঞা যজন্তি বিশ্বেশং পাষাণাদিষু সর্বদা” – অর্থাৎ ভগবান মূর্তিতে নন। ভগবান সর্বভূতে। সুতরাং সর্বভূতের ভজনাই ঈশ্বরের উপাসনা। সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঅর্থাৎ যে সর্ব ভূতে অবস্থিত নারায়ণকে উপেক্ষা করে মূর্তিতে নারায়ণের অর্চনা করে, সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয়। কিন্তু সনাতনী তথা হিন্দুগণ এই নির্দেশ বা সতর্কবাণী অনুসরণ করেনি। আচার্য রামানুজ শঙ্করের অদ্বৈতবাদে (নিরাকারবাদ) বিশ্বাসী হয়েও মূর্তিপুজো করতেন। মূর্তিপুজো দ্বৈতবাদের কথা। পরবর্তীকালে তিনি বিশিষ্টা দ্বৈতবাদ মত প্রচার করেন। হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি প্রধানত মানুষের আদলে নির্মিত। পশুর আদলে বা আংশিক পশুর আদলেও (যেমন, হনুমান, নৃসিংহ, গণেশ) দেবতার মূর্তি নির্মিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ এই জাতীয় মূর্তিতেই দেবতাদের পূজা করা হলেও, হিন্দুধর্মে শিবলিঙ্গ ও শালগ্রাম শিলার মতো নিরাকার প্রতীকেও দেবতার পূজা প্রচলিত রয়েছে। দেবতার নররূপ হিন্দুদের ধ্যানের বিশেষ সহায়ক হয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বলেছেন, “দেহধারী মানুষের পক্ষে সাকার ঈশ্বরের তুলনায় নিরাকার ঈশ্বরে মনঃসংযোগ করা অধিক কষ্টকর।ভক্তিবাদী সম্প্রদায়গুলিতে মূর্তিপূজা ঈশ্বরোপাসনার একটি বিশেষ অঙ্গ। ভক্তিবাদীরা মূর্তিপুজো বা মূর্তিসেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের মধুর সম্পর্ককে সুদৃঢ় রাখার কথা বলেন। যদিও আর্য সমাজ ও ব্রাহ্মসমাজের মতো সম্প্রদায়গুলি মূর্তিপুজোকে পৌত্তলিকতা আখ্যা দিয়ে তা বর্জন করে থাকে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, মানুষ তাওহিদের আকিদা নিয়েই পৃথিবীতে আগমন করেছে এবং এক আল্লাহরই আরাধনা করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে মানবসমাজে খোদার পয়গমবাহক নবির অনুপস্থিতিতে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে শয়তানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে মানুষ মূর্তিপুজো ও সৃষ্টির পুজো শুরু করে। আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন জীবন কাটিয়ে যখন কোনো সাধক পুরুষের ইন্তেকাল হয়েছে, তখন তাঁকে স্মরণ করতে, তার মাধ্যমে ইবাদতে প্রেরণালাভের উদ্দেশ্যে প্রথম তাঁর প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছে মানুষ। কালক্রমে সে প্রতিকৃতিরই পুজো করতে শুরু করেছে। এভাবেই মূর্তিপুজোর সূচনা। আবার প্রকৃতির কোনো জিনিসের মধ্যে আল্লাহর শক্তি ও উপস্থিতি জ্ঞান করে বিভিন্ন জড় ও জন্তুর পুজো করতে শুরু করেছে। পবিত্র কোরানের ভাষায় – “তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করছে। তারা (কওমের নেতৃস্থানীয়রা) বলেছে, তোমরা কিছুতেই ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসরকে বর্জন কোরো না” (সুরা নুহ, আয়াত ২২-২৩)। উপরোক্ত পাঁচটি নাম হল পাঁচটি মূর্তির। শয়তানের প্ররোচনায় পরবর্তী বংশধররা ভাস্কর্যের পুজো করতে শুরু করে। এবং বংশানুক্রমে রসুলের যুগ পর্যন্ত তাঁদের পুজো চলতে থাকে। বুখারির এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, কবিলাকে কালব 'ওয়াদ'-এর, হুজায়েল 'সুওয়া'-এর, মুরাদ ও গুতাইয়া গোত্র 'ইয়াগুস'-এর, হামদান গোত্র 'ইয়াউক'-এর এবং হিমরার গোত্র 'নাসর'-এর পুজো করত। বনি ইসরাইলের কাছে প্রেরিত নবিদের একজন ছিলেন হজরত ইলইয়াস। তাঁর সময় বনি ইসরাইল 'বাআল' নামক মূর্তির পুজো করত। রাসুলুল্লাহর আগমনকালে জাহেলি আরব মূর্তিপুজোর আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। কথিত আছে, খোদার ঘর কাবায় ৩৬৪টি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। কৌলীন্য রক্ষায় প্রতিটি গোত্র ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীর পুজো করত। পারিবারিকভাবেও ঘরে ঘরে দেবদেবীর মূর্তি সংরক্ষণ করা হত বিশেষ কল্যাণ লাভের আশায়। পবিত্র কোরানে এ রকম কিছু দেবদেবীর আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্যুর পর লোকেরা প্রথমে মৃত ব্যক্তির কবর, অতঃপর তাঁর মূর্তি বানিয়ে পুজো করত। ইবনে জারিরের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মক্কা ও তায়েফের মাঝখানে অবস্থিত একটি গাছকে মানুষ পুজো করতে শুরু করে এবং আল্লাহর সিফাতি নাম আজিজকে বিকৃত করে তাঁর নামকরণ করে উয্যাআর 'মানাত' ছিল আওস, খাজরাজ ও তাদের মিত্রদের দেবতা। অবশেষে অষ্টম হিজরির ১৭ রমজান মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল নিজে কাবাঘরের আশপাশে ও ছাদের উপর স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি, ভাগ্য গণনার তীর, মানুষের ছবি, কবুতরের প্রতিকৃতিসহ যাবতীয় শিরক ও পৌত্তলিকতার চিহ্ন অপসারণ করেন। ৩৬০ টি দেবতার মধ্যে লাত, মানত, ওজ্জা ও হোবল ছিল প্রধান। এছাড়া গাছ, পাহাড়, পাথর, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র ও আগুনের পুজো করত। তারা বিশ্বাস করত দেবতার অশুভ দৃষ্টির জন্য ভূমিকম্প, ঝড়, বিপদ-আপদ হয়। প্রতিটি গোত্রের আলাদা আলাদা দেবতা ছিল। এদের মধ্যে হানিফরাই এক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখত। এহেন অবস্থার আমূল বদলে দেন কোরায়েস বংশীয় হজরত মোহাম্মদ। বলা হয় আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হজরত মোহাম্মদ প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। বললেন, “তোমরা পুতুল পুজো কোরো না, এক আল্লাহর উপাসনা করোএ সময় হজরত মোহম্মদ ও তার অনুগামীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করত বিরোধীরা। তাদের যাতায়াতের পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হত, নামাজরত অবস্থায় গলায় ফাঁস দিয়ে দিত, উটের নাড়িভুঁড়ি গায়ে ফেলে দিত। মোনাজাত করার করার সময় হাতে পশুর মলমূত্র ঢেলে দিত, উপহাস করত। এত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পৌত্তলিকতাকে নির্বিষ করে অবশেষে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়। মোহম্মদ জিলহজে মাসের ১০ তারিখে হজরত আলি সর্বশক্তিমান আল্লাহর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। ঘোষণার তারিখ থেকে অবকাশকাল চার মাস অতিক্রান্ত হলে রবিউস সানির ১০ তারিখ থেকে মক্কা নগরীসহ জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপ থেকে মূর্তিপুজো চিরতরে খতম হয়ে যায়।
শুধুমাত্র ইসলামীরা তথা আরব দেশগুলি থেকে মূর্তিপুজো নিষিদ্ধ হয়েছিল, তা নয়। ইহুদি, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরাও মূর্তিপুজো করে না। আগেই বলেছি গ্রিক ও রোমানদের দেবদেবীদেরও মূর্তিরূপে পাওয়া যায়। মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টানদের দেবদেবীদের কোনো আখ্যান কল্পিত হয়নি। গ্রিকরাই নাকি ভারতে সভ্যতা বলতে যা বোঝায় তার সূত্রপাত করেছিল। গ্রিকরা ভারতের কথা জেনেছে এশিয়া মাইনরের সূত্রেজেনেছে পারসিক সাম্রাজ্যের সূত্রে। এক সময় বৃষ্টি, ফসল, খাদ্যের জন্য মানুষকে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে হত। স্বর্গের দেবতাদের কখন কৃপা হয়, তারা কখন করুণা করে কিছু সাহায্য দেবে তার অপেক্ষায় তাদের থাকতে হত।
গ্রিকদেবতা জিউস (বলকান এলাকার মানুষেরা আবহাওয়ার দেবতা হিসাবে জিউসের পুজো করত। জিউস মূলত আকাশের দেবতা ও সে সুত্রে বৃষ্টিপাতের দেবতাও। সুতরাং ধারণা করা হয় জিউস বজ্রপাত ও আলো ও নিয়ন্ত্রণ করত।), অলিম্পাসের দেবতা জিউসের আদেশে তৈরি করা হয় ''প্যান্ডোরা'' নামের এক নারীকে (গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী তাকে পৃথিবীর প্রথম নারী বলা হয়ে থাকে), হেলেন হচ্ছে জিউসের কন্যা । মিথের বর্ণনামতে তার মাতার নাম লেডা । কোনো কোনো বর্ণনায় তার মায়ের নাম প্রতিশোধের দেবী নেমেসিস । প্রমিথিউস (মানুষকে আর সব প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠতর করার জন্য তাদের সোজা হয়ে হাঁটতে শেখালেন এবং অন্যান্য জীব থেকে মানুষকে মহত্তর বলে ঘোষনা দিলেন। তিনি নিজে স্বর্গে যান এবং মানুষের জন্য সূর্যের কাছ থেকে মশাল জ্বালিয়ে আনেন এবং মানুষকে আগুন উপহার দেন। প্রমিথিউসরা ছিলেন তিন ভাই। তার এক ভাইয়ের নাম এটলাস। মানবতার মুক্তির জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে প্রমিথিউস)আফ্রোদিতে গ্রিক সীমানা ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এক দেবী। হোমারের মতে আফ্রোদিতে হল জিউসের মেয়ে। আফ্রোদিতে বিয়ে করেন দেবতা হেফেস্টাসকে। রোমানদের কাছে তিনি ভেনাস নামে জনপ্রিয়। গ্রিক পুরাণের আর-এক বিখ্যাত দেবতা অ্যাপোলো। অ্যাপোলো হল জিউসের পুত্র। অ্যাপোলো গ্রিক পুরাণে আমার দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য চরিত্র। বহু নারী আর দেবীর সাথে তার প্রণয় ছিল। গ্রিকেরা মনে করত বহুদূর পশ্চিমে, যেখানে আকাশ মাটিতে গিয়ে মিশেছে এবং শক্তিশালী মহাবীর অ্যাটলাস (এই মহাবীরের নামানুসারে আটলান্টিক মহাসাগরের নামকরণ করা হয়েছে) পৃথিবীর উপর অর্ধবৃত্তকার ছাদস্বরূপ বিশাল মহাকাশ নিজের কাঁধের উপর ধরে রেখেছে, সেখানে সমুদ্রোপকূলের এক উদ্যানে স্বর্ণ আপেল ফলে। হারকিউলিস ঐ স্বর্ণ আপেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।দীর্ঘপথ অতিক্রম করে সে অবশেষে সেখানে পৌঁছেছিল। এথিনা যুদ্ধ আর শিল্পকলার দেবী ছিল। জিউসের প্রথম স্ত্রী মেটিসের গর্ভে জন্ম হয় এথিনার।নিক্স’ (ফিনিক্স নয়) নামের একটা পাখি -- তিনি একটা সোনালি রঙের ডিমে তা দিচ্ছিল। একসময় ডিম ফোটার সময় হয়ে গেল, ডিম ফুটে বের হল এক দেবতা -- ইরস। ইরস হলেন প্রেমের দেবতা। নরকের দেবতা হেইডিস।
রোমান মিথলজি আর গ্রিক মিথলজির মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে হারকিউলিসের কথা ধরা যায়। এ নামটি রোমান। কিন্তু মূল ধারণাটা গ্রিকদের কাছ থেকে ধরা করা। গ্রিক বীর হেরাকলসের কাহিনি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে রোমানরা নিজেদের মতো করে এ কাহিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিল তাদের পুরাণে। বিভিন্ন বিষয়ে গ্রিক আর রোমানদের মধ্যে মিল থাকার ব্যাপারটি পরিচিত ‘Graeco-Roman Culture’ হিসাবে। এ ধরনের মিলের মধ্যে বাদ যায় নি রোমান মিথলজির সবচেয়ে বড়ো দেবতা জুপিটারও। তাকে গ্রিক দেবতা জিউসের সমতুল্য ধরা হয়।

কোন মন্তব্য নেই: