সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫

সংস্কৃত সাহিত্য : সনাতন ধর্মের প্রাণভোমরা (প্রথম পর্ব)



ইসলাম ধর্ম যেমন কোরান কেন্দ্রিক, খ্রিস্টধর্ম যেমন বাইবেল কেন্দ্রিক, বৌদ্ধধর্ম যেমন ত্রিপিটক কেন্দ্রিক হিন্দুধর্ম কিন্তু তেমনভাবে বেদ কেন্দ্রিক নয়। যদিও বলা হয় হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। তা সত্ত্বেও বলা যায় হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র বেদাশ্রিত নয়। হিন্দুধর্ম সমৃদ্ধ হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডারের আনুকূল্যে। সেই কারণে হিন্দুধর্ম না-বলে সনাতন ধর্ম বলাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। হিন্দুধর্ম কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থকে ঘিরে গড়ে ওঠেনি।হিন্দুধর্ম একটি সংকলিত ধারণামাত্র, যা কেউ বুঝি, অনেকেই বুঝি না।যে অঞ্চলের মানুষের কাছে যে নির্দেশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে সেটা গ্রহণ করেছে, যার যেটা খারাপ লেগেছে সেটা বর্জন করেছে। সেই কারণে কাশ্মীরের হিন্দুধর্ম আর বাংলার হিন্দুধর্ম এক নয়, গুজরাটের হিন্দুধর্মের সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের হিন্দুধর্মে অনেক অমিল, কেরলের হিন্দধর্ম আরা মহারাষ্ট্রের হিন্দুধর্মের বৈসাদৃশ্য প্রচুর। অনেক হিন্দু গো-মাংস ভক্ষণ করেন, অনেক হিন্দু গো-মাংস ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু গো-মাংস মুখে উচ্চারণ করলেই প্রায়শ্চিত্ত (কারণ গোরুর শরীর জুড়ে সব দেবতার অবস্থান) করেন। অনেক হিন্দু শূকর ভক্ষণ, অনেক হিন্দু শূকর ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু শূকরের নাম উচ্চারণ করলে প্রায়শ্চিত্ত (কারণ শূকর বা বরাহ বিষ্ণুর অবতার) করেনঅনেক হিন্দু কচ্ছপ ভক্ষণ করেন, অনেক হিন্দু কচ্ছপ ভক্ষণ করেন না, অনেক হিন্দু কচ্ছপের নাম উচ্চারণ করলেই প্রায়শ্চিত্ত (কারণ কচ্ছপ বা কূর্ম বিষ্ণুর অবতারকরেন। এত ভিন্নতার কারণ হিন্দুধর্মের কোনো প্রবক্তা নেই, হিন্দুধর্মের কোনো স্রষ্টা নেই, একক প্রচারক নেই। ব্যাপক পরিসরে বলা যায় হিন্দুধর্মের কোনো বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থই নেই। সংকীর্ণ পরিসরে অনেকেই বলতে ভালোবাসেন হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থ বেদ, বৃহত্তর তথা সামগ্রিক পরিসরে যদি ভাবা যায় হিন্দুধর্মের একত্রে ধর্মগ্রন্থগুলি হল ঋগবে, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, মনুসংহিতা, অসংখ্য উপনিষদ, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ সমগ্র, রামায়ণ, মহাভারত  ইত্যাদি।


বস্তুত বিপুল সংস্কৃত ভাণ্ডারের সমস্ত নির্দেশাবলি-গল্প-কাহিনিই সনাতন ধর্মের নিয়ন্ত্রক, এগুলিকে আমি ধর্মসাহিত্য বলতে পছন্দ করি। বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। বেদ থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ বেদই সনাতন ধর্মের প্রধান ও প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ। ঐতিহাসিকরা বৈদিক সাহিত্য কখনও লিখিত রূপের উপর জোর দেয়নি। বেদ মানেই শ্রুতি। তার লিখিত রূপ অনেক পরের সময়ের কথা। ফলে কাশ্মীরে এক রকম, বাংলায় আর-এক, তামিলনাড়ুতে অন্য রকম রামায়ণ-মহাভারত পাওয়া গেলেও বেদ নিয়ে সেই সমস্যা হয়নি। তার লিখিত রূপভেদ নেই, তাই দরকার হয়নি কোনও ক্রিটিকাল এডিশনএই কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে উনিশ শতকে উইলসন তাই অনুবাদ করেন ঋগবেদ। কোনো পাঠান্তর বা পাঠভেদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না তাঁকে। আজও পুনের ভাণ্ডারকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ঋগবেদের সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটি গাছের ছালের উপর ১৪৬৪ সালে লেখা। এটি ইউনেস্কোর মেমরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের বোখাজকই শিলালিপির সঙ্গে ঋগবেদের ইন্দো-ইরানীয় ভাষার মিলের কথাও বলা হয়েছে বারবার। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান রমেশ ভরদ্বাজের মতে, ‘‘বাল গঙ্গাধর তিলক, জার্মান পণ্ডিত ফেলিক্স জ্যাকোবি মনে করতেন, ঋগবেদ খ্রিস্টের জন্মের আট হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল।’’ কিন্তু ঋগবেদকে যিনি বিশ্বের দরবারে প্রথম পরিচিত করেন, সেই ম্যাক্সমুলারও তিলকের মতো এত দূর পিছিয়ে যাননি। তিনি খ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছর আগের কথা ভেবেছিলেন। আর আর্যভাষাটি যে শুধুই ভারতীয় ভাষা নয়, সে কথাও ইতিহাসের দরবারে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। শেল্ডন পোলক পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন, সংস্কৃত নামক কসমোপলিটান ভাষাটি আফগানিস্তান থেকে জাভা সর্বত্র চলত। রোমিলা থাপারও ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে ঋগবেদের মিত্রাবরুণগোছের দেবতার অনেক মিল পেয়েছেন। সংস্কৃত ভাষা সমীহের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা সনাতন ধর্মের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা ব্রাহ্মণের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা মন্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা শাস্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা অভিসম্পাতের ভাষা এবং সংস্কৃত ভাষা আশীর্বাদেরও ভাষা।


সংস্কৃত ভাষা কীভাবে সনাতন ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে আমি তারই ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করব -- বেদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা ঠিক, বেদ ছাড়া ভারতীয় মনের ঐতিহাসিক বিকাশের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে বেদ পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। হাজার হাজার সাহিত্য লেখা হয়েছে, যা ধর্মসাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে অনেক ক্ষেত্রে এবং সেইসব সাহিত্যের উপাদানের বীজ সবই বেদে প্রতীয়মান। ঋগবেদের কাল থেকে বেদাঙ্গ রচনার অন্তিম পর্ব পর্যন্ত যে সুবিশাল সাহিত্য কেবল ভারতীয় সংস্কৃতির নয়, বিশ্বসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা করেছিল বৈদিক সাহিত্য। যাজ্ঞবল্ক্যের মতে প্রত্যক্ষ বা অনুমানাদির সাহায্যে যে জ্ঞান লাভ করা যায় না, সেই অতীন্দ্রিয় জ্ঞান যার দ্বারা লাভ করা যায়, তাইই বেদ।
স্বয়ং বেদ বলেছে -- বেদ স্বয়ং উদ্ভূত। এসম্পর্কে বেদের পুরুষসূক্তে বলা হয়েছেতস্নাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুত ঋচ সামানি জজ্ঞিরে।/ ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত (ঋগ্বেদ, ১০/৯০/) অর্থাৎ, সে সর্ব হোম সম্বলিত যজ্ঞ হতে ঋক ও সামসমূহ উৎপন্ন হল, ছন্দ সকল তথা হতে আবির্ভূত হল, যজু তা হতে জন্মগ্রহণ করল, বেদ স্বয়ং উদ্ভূত- বেদ অপৌরুষেয়।



বেদ হল প্রাচীন ভারতে রচিত একাধিক ধর্মগ্রন্থের একটি সমষ্টি। বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদ সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। বেদকে "অপৌরুষেয়" (মানুষের দ্বারা রচিত নয়) মনে করা হয়।হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, বেদ প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। তাই বেদের অপর নাম "শ্রুতি" (যা শোনা হয়েছে)অন্য ধর্মগ্রন্থগুলিকে বলা হয় "স্মৃতি" ("যা মনে রাখা হয়েছে")। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, বেদ ব্রহ্ম (সর্বোচ্চ উপাস্য ঈশ্বর) কর্তৃক প্রকাশিত। বৈদিক ধর্মগ্রন্থ বা শ্রুতি সংহিতা নামে পরিচিত চারটি প্রধান সংকলনকে কেন্দ্র করে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বেদের প্রতিটি পদ মন্ত্র নামে পরিচিত। কোনো কোনো বৈদিক মন্ত্র আধুনিক কালে প্রার্থনা সভা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়ে থাকে।


ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায় বেদ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা বেদকে তাদের প্রধান ধর্মমত (আস্তিক) হিসাবে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য শাখা, বিশেষত বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম বেদকে তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করে না (নাস্তিক)। অধিকন্তু বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, শিখধর্ম, ও ব্রাহ্মধর্ম, এবং দক্ষিণ ভারতের অনেক অব্রাহ্মণ হিন্দুরা বেদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে না। ইয়েঙ্গার ইত্যাদি কোনো কোনো দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ তামিল দিব্য প্রবন্ধম্‌ বা আলোয়ারদের রচনাকে বেদের সমতুল্য জ্ঞান করেন।


বেদের বিধিসম্মত ভাগ চারটি। বেদের চারটি অংশ মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্‌। মন্ত্রাংশ প্রধানত পদ্যে রচিত, কেবল যজুঃসংহিতার কিছু অংশ গদ্যে রচিত। এটাই বেদের প্রধান অংশ। এতে আছে দেবস্তুতি, প্রার্থনা ইত্যাদি। ঋক্‌ মন্ত্রের দ্বারা যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বান করা হয়, যজুর্মন্ত্রের দ্বারা তাঁদের উদ্দেশে আহুতি প্রদান করা হয় এবং সামমন্ত্রের দ্বারা তাঁদের স্তুতি করা হয়ব্রাহ্মণ মূলত বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা। এটি গদ্যে রচিত এবং প্রধানত কর্মাশ্রয়ী। আরণ্যক কর্ম-জ্ঞান উভয়াশ্রয়ী এবং উপনিষদ্‌ বা বেদান্ত সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানাশ্রয়ী। বেদের বিষয়বস্তু সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে আছে বিভিন্ন দেবদেবী ও যাগযজ্ঞের বর্ণনা এবং জ্ঞানকাণ্ডে আছে ব্রহ্মের কথা। কোন্ দেবতার যজ্ঞ কখন কীভাবে করণীয়, কোন্ দেবতার কাছে কী কাম্য, কোন যজ্ঞের কী ফল ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের আলোচ্য বিষয়। আর ব্রহ্মের স্বরূপ কী, জগতের সৃষ্টি কীভাবে, ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক কী এসব আলোচিত হয়েছে জ্ঞানকাণ্ডে। জ্ঞানকাণ্ডই বেদের সারাংশ। এখানে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এক, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তাঁরই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন দেবতা। জ্ঞানকাণ্ডের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনচিন্তার চরম রূপ উপনিষদের বিকাশ ঘটেছে।


এসব ছাড়া বেদে অনেক সামাজিক বিধিবিধান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদির কথাও আছে। এমনকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথাও আছে। বেদের এই সামাজিক বিধান অনুযায়ী সনাতন হিন্দু সমাজ ও হিন্দুধর্ম রূপ লাভ করেছে। হিন্দুদের বিবাহ, অন্তেষ্টি ক্রিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও বৈদিক রীতিনীতি যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়। ঋগ্বেদ থেকে তৎকালীন নারীশিক্ষা তথা সমাজের একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। অথর্ববেদ থেকে পাওয়া যায় তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যার একটি বিস্তারিত বিবরণ। এসব কারণে বেদকে শুধু ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই নয়, প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও ইতিহাসের একটি দলিল হিসেবেও গণ্য করা হয়।
অনেকের মতে বেদ অপৌরুষেয়। অর্থাৎ ঈশ্বর দ্বারা প্রেরিত। এহেন বেদ যখন ঈশ্বর প্রেরিত, এহেন বেদ যখন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ তবে কেন বেদের উল্লিখিত দেবতারা দেবতাহিসাবে পুজো পায় না ? বেদের দেবতা কারা ? দেবতা কে ? দেবতা কী ? সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদে যে দেবতাদের উল্লেখ আছে, সেগুলি হিন্দুসমাজে বহুল প্রচলিত এবং প্রচারিত দেবদেবীদের (দুর্গা, কালী, মনসা, শিব, বালাজী, গণপতি বাপ্পা ইত্যাদি) মতো নয়। অবশ্য বেদের সূত্রেই ভারতীয় হিন্দু বা সনাতন ধর্মের দেবদেবীদের বিস্তার লাভ করেছেঈশ্বর ধারণাটা বেদেই সর্বপ্রথম খোদিত হয়। আদিবেদ হিসাবে স্বীকৃত ঋগবেদে কতগুলি দেবদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগবেদে দেবতাশব্দ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অল্প কয়েকটি সূক্ত ছাড়া প্রায় ৯০ ভাগ মন্ত্রে দেবতা বিষয়ক ভাবনাই মুখ্য। এই মন্ত্রগুলিকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। (১) স্তুতি এবং (২) প্রার্থনা। স্তুতি বিষয়ক মন্ত্রে দেবতার নাম, রূপ ও কর্মের উল্লেখ করে দেবতার স্তব করা হয়েছে। অপরদিকে প্রার্থনা বিষয়ক মন্ত্রে দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে ধন, আয়ু, শক্তি, পুত্র প্রভৃতি।


যাস্কাচার্য তাঁর নিরুক্তগ্রন্থে দেবএবং দেবতাদুটি শব্দের একই অর্থ করেছেন। তিনি দেবশব্দের তিনটি তিনটি অর্থ এবং চারটি ব্যুৎপত্তি দেখিয়েছেন – (১) দাধাতু থেকে। (২) ণিজন্ত দীপধাতু থেকে।(৩) ণিজন্ত দ্যুৎধাতু থেকে। (৪) দিবশব্দ থেকে। অর্থাৎ দেব বা দেবতা তাঁরাই যাঁরা (ক) ঐশ্বর্য দান করেন এবং আমাদের ঈপ্সিত বস্তুগুলি দান করেন। (খ) তেজোময় বলে যাঁরা পদার্থগুলিকে প্রকাশিত করে। (গ) যাঁরা সাধারণত দ্যুলোকে অবস্থান করেন। বস্তুত শৌনকাচার্যের বৃহদ্দেবতাএবং যাস্কাচার্যের নিরুক্তগ্রন্থের দেবতাকাণ্ডে দেবতাতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে। ঋগবেদের সূক্তগুলিতে ধর্মীয় চিন্তাধারায় অনুসরণ করলে দেবতাতত্ত্বের সম্বন্ধে এক বিবর্তন লক্ষ করা যায়। বহুদেবতাবাদ থেকে অতিদেবতাবাদের মধ্য দিয়ে একদেবতাবাদ বা একেশ্বরবাদে উত্তরণ ঘটেছে বৈদিক দেবতাতত্ত্বেবেদের দেবতাতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি দেবতাই বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি থেকে কল্পিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক রূপেরই প্রতিরূপ।


অনেক ক্ষেত্রে দেবতা হিসাবে বিষয়বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এই অর্থে প্রস্তরখণ্ড, ধনুক, ব্যাঙ ইত্যাদি দেবতা প্রতিপন্ন হয়। বস্তুত ঋকবেদের দেবতা অর্থে বুঝি পৃথিবী বা অন্তরিক্ষ বা দ্যুলোকের এমন সব প্রাকৃতিক বিষয়, যাঁদের মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখে ঋষিরা তাঁদের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। সেই কারণে নানা মুনির নানা মতও আছে। যেমন কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে ইন্দ্র হল ঝড়ের দেবতা। কেউ বলেছেন প্রাচীন সূর্যদেবতা। কারও মতে বরুণ স্বর্গের দেবতা, কেউ বলছেন চন্দ্রদেবতা, কেউ-বা বলেন জলের দেবতা ইত্যাদি। ঋকবেদে কতকগুলি আদিত্যের নাম আছে, রুদ্র ও বসু শব্দ দুটি বহুবচনে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু ১২ জন আদিত্য, ১১ জন রুদ্র, ৮ জন বসু এমন উল্লেখও নেই। ঋকবেদে নীচে উল্লিখিত দেবতাদের নাম পাওয়া যায় – (১) মিত্র, বরুণ, অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড, সূর্য, সবিতা এবং ইন্দ্র । এঁদের ঋকবেদে কোথাও না-কোথাও আদিত্য বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আবার অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড -- এঁদের কোনো প্রাধান্য নেই।(২) মিত্র, সূর্য, বরুণ, সবিতা, ইন্দ্রের খুব প্রাধান্য। এ ছাড়া অগ্নি, বায়ু, মরুৎগণ, বিষ্ণু,পর্জন্য, পূষা, ত্বষ্ঠা, অশ্বিনী ২ জন, সোম -- এরাও প্রাধান্য পেয়েছেন। (৩) বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি ও যমেরও কিছু গৌরব আছে। (৪) কোনো কোনো অংশে ত্রিত, আপ্তা, অধিব্রধ ও অজএকপাদেরও নাম পাওয়া যায় । (৫) বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ, স্কম্ভ, প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্মা -- এই কয়টি নাম দ্বারা সৃষ্টিকর্তাকে বোঝায়। (৬) ক-জন দেবীও আছেন। অদিতি ও ঊষা প্রধানা। (৭) সরস্বতী, ইলা, ভারতী, মহী, হোত্রা, বরুত্রী, ধীষণা, অরণ্যানী, অগ্নায়ী, বরুণানী, অশ্বিনী, রোদসী, রাকা, সিনিবালী, গুঙ্গু, শ্রদ্ধা ও শ্রী -- এঁরা দেবী পদভিষিক্তা। তা ছাড়া পরিচিত সব নদীরাও দেবীর মর্যাদা পেয়েছেন ।


পুরাণে আছে, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় ও তার লীলা প্রকাশের বাসনায় দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছে। পরমেশ্বর মহাবিষ্ণুই লীলার জন্য তিন ভাগে ভাগ হয়েছেন -- ব্রহ্মা , বিষ্ণু এবং মহেশ্বর । বিষ্ণু পুরাণে আছে পরব্রহ্মের প্রথম অংশ ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা রূপে সকল কিছু সৃষ্টি করে তৃতীয় বারে দেবতাদের সৃষ্টি করলেন । দেবতারা জ্যোতিষ্মান, দীপ্তিমন্ত । দেবতাদের প্রধানত স্বর্গবাসী হিসাবেই দেখানো হয়েছে, অবশ্য পৃথিবীতেও তাদের অবস্থান আছে। দেবতারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। মানুষ যা করতে পারে না দেবতারা তা করতে পারেন, অথবা দেবতারা যা করতে পারেন মানুষ তা পারে না এরকম গোছের কিছু একটা। সাধারণভাবে মরুৎ ঝড়ের দেবতা বাদে দেবতাদের সংখ্যা হল তেত্রিশকিন্তু যাস্ক প্রভৃতি নিরুক্তকারদের মতে বৈদিক দেবতা মাত্র তিনজন -- অগ্নি , ইন্দ্র এবং সূর্য। তবে পুরাণে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কথা বলা হয়েছে। বোঝাই যায়, বেদে উল্লেখিত ৩৩ টি দেবতায় কাজ মিটছিল না। পুরাণের যুগে এসে তৎকালীন শাসকদের তত্ত্বাবধানে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ৩৬ টি পুরাণে ৩৩ কোটি দেবতাদের গল্প-কাহিনি বর্ণিত হল, যা উপকথা এবং রূপকথার মতোই মনোরঞ্জন করে। পুরাণের পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তার পরিণতি কী হয় ! বেদের দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্ধ আছে । এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার জন্ম আছে। অনেক বিষয়ে মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মিল দেখা যায়, তাই হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া যায় । সেই কারণে পুরাণের দেবতারা মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য ) গড়ে উঠেছে।


আবার অনেক দেবতা মানুষ থেকেও জন্মেছেনতাই আহার-বিহার, যানবাহন বসন-ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের কাছাকাছি । মহাভারতের ক্ষেত্রেও যে বাস্তবতা কিছু রয়েছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু ঘটনা, চরিত্র ও সময় সম্ভবত ঋগবেদের পরবর্তী কোনো সময়ে। ঋগবেদের অনেক দেবতার নামই এখানে দেখা যায়। তবে কৃষ্ণসহ বেশ কিছু নতুন চরিত্র বা ভগবানের উদ্ভব হয়, যেগুলি আসলে ঋগবেদের কিছু দেবতার ভিন্নরূপ বই কিছু নয়। কুন্তিপুত্র পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই হলেও তাদের জন্ম পাঁচজন অন্য পুরুষের (যাঁদের দেবতা বলা হয়েছে) ঔরসে। যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, ভীম বায়ুর, অর্জুন ইন্দ্রের এবং নকুল ও সহদেব যমজ দেবতা অশ্বীনিকুমারদ্বয়ের পুত্র। সমস্যা হল ধর্ম নামে কোনো দেবতাকে আমরা ঋগবেদে পাই না। বাকিদের অবশ্য পাওয়া যায়এখানে এই ধর্মসম্ভবত বরুণ। ঋগবেদে আমরা দেখতে পাই ধর্মসংস্কারের ফলে ইন্দ্র যখন প্রধান দেবতা হিসেবে প্রাধান্য পেতে শুরু করে তখন বরুণকে হেয় করা হয়। কিন্তু প্রথমদিককার ঋকগুলিতে বরুণ প্রধান দেবতা থেকেই যায়। কারণ সেগুলির পরিবর্তন সম্ভব ছিল না হয়তো। সম্ভবত ধর্মসংস্কারের জন্য প্রাচীন দেবতাকে যেহেতু বরুণরূপে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি, তাই তাকে নতুন নামে নতুন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ধর্মদেবতাকে সকল দেবতার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। ঋগবেদে বরুণের সঙ্গে আরও একজন দেবতাকে আমরা দেখতে পাই -- সে হল মিত্র। ইন্দ্রের পূর্বে বরুণ এবং মিত্র এই দুই দেবতাকে ঋগবেদে বেশ উঁচু স্থান দেওয়া হয়।


সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় দেবতা বিষয়ে লিখেছেন – “আমরা আকাশ ও সূর্য্যদেবতাদিগের কথা বলিয়াছি, এক্ষণে বায়ু-দেবতাদিগের কথা বলিব। বেশী বলিবার প্রয়োজন নাই। বায়ু দেবতা,-প্রথম বায়ু বা বাত, দ্বিতীয় মরুদ্গণ। বায়ুর বিশেষ পরিচয় কিছুই দিবার নাই। সূর্য্যের ন্যায় বায়ু আমাদিগের কাছে নিত্য পরিচিত। ইনি পৌরাণিক দেবতার মধ্যে স্থান পাইয়াছেন। পুরাণেতিহাসে ইন্দ্রাদির ন্যায় ইনি একজন দিক্‌পাল মধ্যে গণ্য। এবং বায়ু বা পবন নাম ধারণ করিয়াছেন। সুতরাং ইঁহাকে প্রচলিত দেবতাদের মধ্যে ধরিতে হয়। মরুদ্গণ সেরূপ নহেন। ইঁহারা এক্ষণে অপ্রচলিত। বায়ু সাধারণ বাতাস, মরুদ্গণ ঝড়। নামটা কোথাও একবচন নাই ; সর্ব্বত্রই বহুবচন। কথিত আছে যে, মরুদ্গণ ত্রিগুণিত ষষ্টিসংখ্যক, একশত আশী। এ দেশে ঝড়ের যে দৌরাত্ম্য, তাহাতে এক লক্ষ আশী হাজার বলিলেও অত্যুক্তি হইত না। ইঁহাদিগকে কখন কখন রুদ্র বলা হইয়া থাকে। রুদ্ ধাতু চীৎকারার্থে রুদ্ ধাতু হইতে রোদন হইয়াছে। রুদ্ ধাতুর পর সেই প্রত্যয় করিয়া রুদ্র শব্দ হইয়াছে। ঝড় বড় শব্দ করে, এই জন্য মরুদ্গণকে রুদ্র বলা হইয়াছে সন্দেহ নাই। কোথাও বা মরুদ্গণকে রুদ্রের সন্ততি বলা হইয়াছে। তার পর অগ্নিদেবতা। অগ্নিও আমাদের নিকট এত সুপরিচিত যে, তাঁহারও কোন পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই। কিছু পরিচয় দেওয়াই হইয়াছে। ঋগ্বেদে আর একটি দেবতা আছেন, তাহাকে কখন বৃহস্পতি কখন ব্রহ্মণস্পতি বলা হইয়া থাকে। কেহ কেহ বলেন, ইনি অগ্নি, কেহ কেহ বলেন, ইনি ব্রহ্মণ্যদেব। সে যাহাই হউক। ব্রহ্মণস্পতির সঙ্গে আমাদের আর বড় সম্বন্ধ নাই। বৃহস্পতি এক্ষণে দেবগুরু অথবা আকাশের একটি তারা। অতএব তাঁহার সম্বন্ধে বড় বিশেষ বলিবার প্রয়োজন নাই। সোমকে এক্ষণে চন্দ্র বলি, কিন্তু ঋগ্বেদে তিনি চন্দ্র নহেন। ঋগ্বেদে তিনি সোমরসের দেবতা। অশ্বীদ্বয় পুরাণেতিহাসে অশ্বিনীকুমার বলিয়া বিখ্যাত। কথিত আছে যে, তাঁহারা সূর্য্যের ঔরসে অশ্বিনীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেনএই জন্য তাঁহাদিগের পৌরাণিক নাম অশ্বিনীকুমার। এমন বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে যে, তাঁহারা শেষরাত্রির দেবতা ; ঊষার পূর্ব্বগামী দেবতা। আর একটি দেবতা ত্বষ্টা। পুরাণেতিহাসে বিশ্বকর্ম্মা যাহা, ঋগ্বেদে ত্বষ্টা তাহাই। অর্থাৎ দেবতাদিগের কারিগর। যমও ঋগ্বেদে আছেন কিন্তু যমও আমাদিগের নিকট বিশেষ পরিচিত। যমদেবতার একটি গূঢ় তাৎপর্য্য আছে, তাহা সময়ান্তরে বুঝাইবার প্রয়োজন হইবে। ত্রিত আপ্ত্য অজ একপাদ প্রভৃতি দুই একটি ক্ষুদ্র দেবতা আছেন, কখন কখন বেদে তাঁহাদিগের নামোল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু তাঁহাদের সম্বন্ধে এমন কিছুই কথা নাই যে, তাঁহাদের কোন পরিচয় দিবার প্রয়োজন করে। বৈদিক দেবীদিগের মধ্যে অদিতি পৃথিবী এবং ঊষা এই তিনেরই কিঞ্চিৎ প্রাধান্য আছে। অদিতি ও পৃথিবীর কিঞ্চিৎ পরিচয় দিয়াছি। ঊষার পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই, কেন না, যাহার ঘুম একটু সকালে ভাঙ্গিয়াছে সেই তাহাকে চিনে। সরস্বতীও একটি বৈদিক দেবী। তিনি কখন নদী কখন বাগ্‌দেবীগঙ্গা-সিন্ধু প্রভৃতি ঋগ্বেদে স্তুত হইয়াছেন। ফলতঃ ক্ষুদ্র বৈদিক দেবীদিগের সবিস্তার বর্ণনে কালহরণ করিয়া পাঠকদিগকে আর কষ্ট দিবার প্রয়োজন নাই। আমরা এইখানে বৈদিক দেবতাদিগের ব্যক্তিগত পরিচয় সমাপ্ত করিলাম। কিন্তু আমরা বৈদিক দেবতাতত্ত্ব সমাপ্ত করিলাম না। আমরা এখন বৈদিক দেবতাতত্ত্বের স্থূল মর্ম্ম বুঝিবার চেষ্টা করিব। তার পর বৈদিক ঈশ্বরতত্ত্বে প্রবৃত্ত হইবার চেষ্টা করি।অনেকে বলেন দেবতাঈশ্বর নয়। দেবতা ঈশ্বর প্রেরিত মানুষ। ঈশ্বর অদ্বিতীয়ম্, দেবতা অনেক। বলা হয় কশ্যপ ও অদিতির পুত্ররাই দেবতা এবং অপরদিকে কশ্যপ ও দিতির পুত্রেরা দৈত্য। অর্থাৎ ভগবান ও শয়তান। অর্থাৎ আর্য ও অনার্য। অর্থাৎ শিষ্ট ও দুষ্ট। এই নিয়ে অনেক জয়-পরাজয়ের গল্পগাছা পুরাণে এসে পেয়েছি।

আক্ষেপের কথা একটাই বেশির ভাগ হিন্দু এই গ্রন্থ পাঠ করা তো দূরের কথা, চোখেও দেখেনি। সাধারণ মানুষদের কথা ছাড়ুন, যাদের বেদ পাঠ না করলে ব্রহ্মজ্ঞানই হয় না, সেই ব্রাহ্মণদের একটা বড়ো অংশই বেদ ছুঁয়েও দেখেন না। তা সত্ত্বেও বেদ ব্যতীত সনাতনী বা হিন্দুদের অস্তিত্ব কোথায় ! হিন্দুত্ববাদের দণ্ডমুণ্ডকর্তা এল কে আডবাণী যখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন অক্সফোর্ডে নীরদবাবুর (নীরদ সি চৌধুরী) বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আত্মঘাতী বাঙালি’-র দুর্মুখ রচনাকার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি ঋগবেদ পড়েছেন ?’’ উত্তর : নাহতাশ নীরদবাবু : ‘‘তা হলে আর হিন্দুধর্ম নিয়ে আপনার সঙ্গে কী কথা বলব ?’’


সংস্কৃত ভাষায় রচিত আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ মনুসংহিতা। যদিও বেদই হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বলে বিবেচিত হয়ে আছে, কিন্তু বেদে ধর্মের ভিত্তিতে জীবনযাপন বা উপাসনা করার পদ্ধতি বিস্তৃতভাবে নির্দেশিত হয়নি । হিন্দুদের ধর্মভিত্তিক আইন ও সামাজিক রীতি নীতি পরিচালিত হয় আর-একটি গ্রন্থ মনুসংহিতাবা মনুস্মৃতির উপর ভিত্তি করে । এই গ্রন্থকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে আইনের সমতুল, ধর্মীয় নির্দেশের আইন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ, আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের বিধিবিধানই মনুসংহিতার উপজীব্য। কথিত আছে, এই গ্রন্থটি প্রথম স্বায়ম্ভূব মনু রচনা করেছিলেন। আদি সংহিতায় এক লক্ষ শ্লোক ছিল, এখন অবশ্য মাত্র ২৬৯৪টা শ্লোক পাওয়া যায়। পুরাণ অনুসারে মনু ব্রহ্মার দেহ থেকে তৈরি হয়েছেন। অর্থাৎ পৃথিবীতে ব্রহ্মার একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন মনু। তবে এই পর্যন্ত চোদ্দোজন মনু ব্রহ্মার ইচ্ছায় জন্ম নিয়েছেন বলে জানা যায় -- এদের সবাই ধর্মশাস্ত্র রচনা করেছেন (অবশ্য প্রাচীন যুগে ধর্মশাস্ত্র বা ধর্মীয় নিদান ছাড়া কিছুই রচনা হত না)। প্রায় চার হাজার যুগে ব্রহ্মার একদিন। চার হাজার বছরে এক কল্প হয়। এইভাবে এক দিনে বা এক কল্পে ১৪ জন মনু জন্মগ্রহণ করেন। এক-এক মনুর অধিকারে থাকা সময়কে মন্বন্তরবলে। এরকম এক মন্বন্তরে সপ্তর্ষিগণ, দেবগণ, ইন্দ্র ও মনু-পুত্ররা জন্মগ্রহণ করেন। দেবতাদের হিসাবে ৮ লক্ষ ৫২ বৎসরে এক মন্বন্তর, আর মানুষের হিসাবে ৩০ কোটি ৬৭ লক্ষ ২০ হাজার বৎসরে এক মন্বন্তর। মন্বন্তর শেষ হলে মনু, দেবতা, সপ্তর্ষিগণ, ইন্দ্র, মনুর পুত্ররা বিলুপ্ত হন। স্বায়ম্ভুব মনু ব্রহ্মার কাছ থেকে স্মৃতিশাস্ত্র পাঠ করা শিখে তা তার শিষ্যদের তা পাঠ করান। পরবর্তীতে ভৃগু নামে একজন মনুর আদেশে এই ধর্মশাস্ত্র ঋষিদের কাছে ব্যাখা করেন -- যা এখন মনুসংহিতানামে পরিচিত। বলা হয় বেদ এর পরে মনুসংহিতা সৃষ্টি হয়েছে। মূলত স্বায়ম্ভুব মনুর বর্ণিত শ্লোকগুলিই বাকি মনুরা (স্বায়ম্ভুব, স্বরোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুস, বৈবস্বত বা সত্যব্রত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবতাসাবর্ণি ও ইন্দ্রসাবর্ণি। মৎস্যপুরাণ মতে ১৪ জন মনুর ভিন্নতর নাম পাওয়া যায়। এই ১৪ জন মনুর নাম হল স্বায়ম্ভূব, স্বরোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত বা সত্যব্রত, সাবর্ণি, রোচ্য, ভৌত্যাঃ, মেরুসাবর্ণি, ঋভু, ঋতুধামা, বিষ্কক্সেন) সম্পাদনা ও টীকা বা ব্যাখ্যা যোগ করেছেন এবং কিছু কিছু আইন ও আচরণ পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন। এখনও মনুসংহিতার আইন ও আচরণবিধি পুরোপুরিভাবে না হলেও অনেকটাই হিন্দু ধর্ম ও সমাজে পালন করা হয়। বর্তমান হিন্দু সমাজে মূর্তি/প্রতিমা পুজো, উপাসনার পদ্ধতি, ব্রতাচারণ, বিবাহের নিয়মাবলি, শ্রাদ্ধবিধি, খাদ্যাখাদ্য বিধি, বর্ণাশ্রম বিধি, সম্পত্তি বণ্টন তথা ধর্মীয় আঙ্গিকে জীবনধারণের সব পদ্ধতিই মনুসংহিতাবা মনুস্মৃতি’-তে যে বারোটি অধ্যায়ে (প্রথম অধ্যায় সৃষ্টিরহস্য-বিজ্ঞান প্রকরণ, দ্বিতীয় অধ্যায় ধর্মানুষ্ঠান প্রকরণ, তৃতীয় অধ্যায় ধর্মসংস্কার প্রকরণ, চতুর্থ অধ্যায় ব্রহ্মচর্য্য-গার্হস্থ্যাশ্রমধর্ম প্রকরণ, পঞ্চম অধ্যায় অশৌচবিধি-বিধান প্রকরণ, ষষ্ঠ অধ্যায় বানপ্রস্থ প্রকরণ, সপ্তম অধ্যায় রাজ্য-নিয়ন্ত্রণ প্রকরণ, অষ্টম অধ্যায় রাষ্ট্রনীতি প্রকরণ, নবম অধ্যায় ব্যবহারিক-ধর্ম প্রকরণ, দশম অধ্যায় সামাজিক-নীতি প্রকরণ, একাদশ অধ্যায় প্রায়শ্চিত্ত-সিদ্ধান্ত প্রকরণ, দ্বাদশ অধ্যায় মোক্ষধর্ম প্রকরণ।) ২৬৮৪ টি শ্লোক বর্ণিত আছে, তার উপর ভিত্তি করে পালিত হয়। তাই বলা হয় সনাতন ধর্মের লিখিত সংবিধান মনুসংহিতামানুষের জীবনের এমন কোনো কিছু নেই, যা এই শাস্ত্রে আলোচিত হয়নি। একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দু জন্ম থেকে মৃত্যুপর্যন্ত কী কী করবে বা কী কী করবে না -- সবই এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। হিন্দুদের জীবনবিধান মনুসংহিতাবা মনুস্মৃতিবেদ হিন্দুদের আদি গ্রন্থ এবং এই গ্রন্থের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেই মনুসংহিতাবা মনুস্মৃতিরচিত হয়েছে । বেদ নয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জীবন মনুসংহিতাতেই লেপটে আছে। জীবনযাপনের নিয়মাবলি বেদে নির্দেশিত না-থাকলেও মনুসংহিতাবা মনুস্মৃতি’-তে পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটেছে । যদিও সনাতন ধর্মের কোনো-কোনো শাখা যেমন মতুয়া সম্প্রদায়, সত্য ধর্ম ইত্যাদি মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির নিয়মকানুন গ্রাহ্য করে না। কিন্তু হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মৌলিক আচরণবিধি পালিত হয় মনুসংহিতার উপর ভিত্তি করে।

মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই মনুসংহিতা ব্রাহ্মণগোষ্ঠীর আধিপত্যের চরমতম প্রকট এই মনুসংহিতাতেই। বারোটি অধ্যায়ে এ গ্রন্থটির পাতায় পাতায় ধর্মীয় বিধানের নাম দিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে অক্ষরে যে শ্লোকগুলি উৎকীর্ণ রয়েছে, অধিকাংশ শ্লোকের ভাবার্থকে যদি মনুষ্য সমাজে পালনীয় নীতি হিসাবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে মানুষের সমাজে কোনো মানবিক বোধ আদৌ রয়েছে বা অবশিষ্ট থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করাটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়। অনেকে মনে করেন, মনুসংহিতা একটি অন্যতম মানবতাবিরোধী ধর্মগ্রন্থ, যা আমাদের এই আধুনিক সমাজেও প্রচলিত। ধর্মগ্রন্থ আবার মানবতাবিরোধী হয় কীভাবে ? বস্তুত মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের সর্বশক্তিমান বানিয়েছে এবং অন্ত্যজ শ্রেণি তথা শূদ্রদের ঘৃণ্য করা হয়েছে। তদুপরি নারীদের পদদলিত করা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। সেই কারণ মনুসংহিতা বারবার সমালোচিত হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বেদের কর্মে ভিত্তিকে বর্ণভেদ মনুসংহিতায় এসে ঘৃণায় পর্যবসিত হল -- (১) সর্বসাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।/মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মান্যকল্পয়ৎ।। (মনুসংহিতা ১ : ৮৭) অর্থাৎ এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজ যুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ এই -- চারটি অঙ্গ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যাবস্থা করে দিলেন। এখানে থেকে বোঝা যাচ্ছে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ আর পাদ থেকে শূদ্র তৈরি হয়েছে অর্থাৎ শূদ্রকে সব থেকে নিচু করে রাখা হয়েছে() অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।/দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ ।। (মনুসংহিতা ১ : ৮৮) অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের জন্য তিনি সৃষ্টি করলেন অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ ইত্যাদি। শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্‌।/ জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।। (মনুসংহিতা ৩ : ১৭) অর্থাৎ সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন (অর্থাৎ সমান জাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়)। ব্যভিচারের দণ্ডের ক্ষেত্রেও বৈষম্যবাদী বর্ণপ্রথা দেখুন --
শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবসন্‌।/অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈর্গুপ্তং সর্বেণ হীয়তে।। (মনুসংহিতা ৮ : ৩৭৪) অর্থাৎ কোনো দ্বিজাতি নারী (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নারী) স্বামীর দ্বারা রক্ষিত হোক বা না-ই হোক, কোনো শূদ্র যদি তার সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় উপগত হয়, তাহলে অরক্ষিতা নারীর সঙ্গে সঙ্গমের শাস্তিস্বরূপ তার সর্বস্বহরণ এবং লিঙ্গচ্ছেদনরূপ দণ্ড হবে, আর যদি স্বামীর দ্বারা রক্ষিতা নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করে, তাহলে ওই শূদ্রের সর্বস্বহরণ এবং মারণদণ্ড হবে। উচ্চবর্ণীয়দের ক্ষেত্রে একই অপরাধের জন্য বিবিধ বিধানের মাধ্যমে মনুশাস্ত্রে বর্ণক্রমানুসারে বিভিন্ন মাত্রার কিছু অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে মাত্র। বৈষম্যের শুরু সৃষ্টির আদিতেই। আজও সেই বৈষম্যের খেসারত গুণতে হচ্ছে হিন্দুদের।

শুধু ব্রাহ্মণ-শূদ্রের বৈষম্য নয়, মনু তার বিধানে মানুষকেও ভাগ করেছেন দু-ভাগে। পুরুষ ও নারী। মনুকে পুরুষকে বসিয়েছেন প্রভুর আসনে এবং নারীকে করেছেন দাসী।তাই আজও পুরুষরা বিয়ে করতে যাওয়ার আগে মাকে বলে যায় মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি। (১) বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈর্বা পরিবর্জিতঃ ।/ উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।।(মনুসংহিতা ৫ : ১৫৪) অর্থাৎ স্বামী দুশ্চরিত্র, কামুক বা গুণহীন হলেও তিনি সাধ্বী স্ত্রী কর্তৃক সর্বদা দেবতার ন্যায় সেব্য। পতির সব দোষই নীরবে সহ্য করবে পত্নী, কিন্তু পত্নীর কোনো দোষ করা যাবে না। পতির পরস্ত্রীতে আসক্ত হওয়াটা কোনো দোষের নয়মনু তার অপর এক বিধানে বলেছেন পতির মৃত্যুর পর পত্নীর পুনরায় বিয়ে করা যাবে না। কিন্তু পত্নীর মৃত্যু হলে দাহ ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া শেষে পুরুষ পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। পুরুষ তার অতিক্রিয়া নিবৃত্ত করার জন্য পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু যে মেয়ের স্বামী বিবাহের রাতে কিংবা বিবাহের দু-তিন মাসের মধ্যে মারা যায়। সেই মেয়েকে সারাজীবন বিধবা সেজে থাকতে হবে। (২) কামন্তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।/ন তু নামাপি গৃহ্ণীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু।। (মনুসংহিতা ৫ : ১৫৭) অর্থাৎ পতির মৃত্যুর পর পত্নী ফলমূলের স্বল্পাহার দ্বারা দেহ ক্ষয় করবে, তবু পর পুরুষের নাম করবে না। (৩) ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি।/পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ।।(মনুসংহিতা ৫ : ১৬৮) অর্থাৎ পত্নীর মৃত্যুর হলে দাহ ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া শেষে পুরুষ আবার বিয়ে করবে। বিয়ে ছাড়া নারীর মুক্তি নাই। কাঙ্খিত স্বর্গ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে নারীদের অবশ্যই বিয়ে করতে হবে। নারীরা চিরকুমারী থাকতে পারবে না। কিন্তু পুরুষেরা চিরকুমার হয়ে থাকতে পারবেন। মনু নারী জাতিকে পুরুষের হাতের প্রাণশূন্য পুতুল ভেবেই হয়তো নীচের বিধানটি প্রবর্তন করেছেন। মনু বিধান দিলেন বন্ধ্যাষ্টমেঽধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা/ একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্ত্বপ্রিয়বাদিনী।।(মনুসংহিতা ৯ : ৮১) অর্থাৎ নিঃসন্তান স্ত্রীকে বিয়ের আট বছর পর ত্যাগ করা যায়, মৃত সন্তানের জন্মদানকারী স্ত্রীকে ত্যাগ করা যায় দশ বছর পরে, যে স্ত্রী শুধুমাত্র কন্যা সন্তান জন্ম দেয় তাকে ত্যাগ করা যায় এগারো বছর পরে, ঝগড়াপরায়ণ স্ত্রীকে ত্যাগ করতে বিলম্ব করা যাবে না। বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।/ ন স্বাতন্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিৎ কার্যং গৃহেষ্বপি।।(মনুসংহিতা ৫ : ১৪৭) অর্থাৎ বালিকা কিংবা যুবতী অথবা প্রাপ্তবয়স্কা নারীরা স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করতে পারবে না। এমনকি নিজের ঘরেও নয়। না না, ভগবান মনু নারীদের শুধুই কোণঠাসা করেছেন তা কিন্তু বলা যায় না। মনু বরঞ্চ মনুসংহিতায় নারীকে রাবড়িকায়দায় নির্দেশ দিয়েছেনরাবড়ি রাবড়ি বানানো হয় নীচে তাপ এবং উপরে বাতাস দিয়ে। মনু নারীকে যেমন দাসী এবং বন্দিনীতে পরিণত করেছেন, তেমনি নারীকে সম্রাজ্ঞী এবং মহীয়সী হিসাবে দেখতেও নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন – “মৈথুন ব্যতিরেকেন” “নগ্নাং স্ত্রিয়ং ন পশ্যেৎঅন্যক্ষেত্রে মনুর মতে নারীর মুখ সর্বদাই শুচি, কখনো কলুষিত হয় না (মনুসংহিতা ৫ : ১৩০)। নারীকে কেউ উপভোগ করলেও নারীর উপর স্বত্ব জন্মায় না, আসল প্রভুর অধিকার বজায় থাকে (মনুসংহিতা ৮ : ১৪৯)। নারীকে ভাগ করে নেওয়া যায় না (মনুসংহিতা ৯ : ২১৯)। সন্তান উৎপাদনের কারণে নারীগণ গৃহের আলো। মহোপকারিণী এবং পুজোর যোগ্য। গৃহে শ্রী (লক্ষ্মী) এবং স্ত্রীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই (মনুসংহিতা ৯ : ২৬)। মনু বলেছেন যেখানে নারীদের পুজো হয়, দেবতারা সেখানে আনন্দ পান (যত্র নার্য্যন্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ)।যেখানে তাঁরা পান না সেখানে সমস্ত ক্রিয়াকর্ম বিফলে যায়। যেখানে নারীরা সুখী, সেখানে পরিবারের সমৃ্দ্ধি থাকে। যেখানে নারীগণ অবহেলিতা, সেখানে সবকিছু ধ্বংস হয়। অতএব যাঁরা সমৃদ্ধি চান তাঁরা যেন নারী পান-ভোজনাদি দিয়ে পুজো করেন (মনুসংহিতা ৩ : ৬০)। মনুসংহিতায় মায়ের স্থান কোথায় দেখুন একজন আচার্য হলেন ১০ জন উপাধ্যায়ের সমান, একজন পিতা হলেন ১০০ জন আচার্যের সমান এবং একজন মাতা হলেন ১০০০ জন পিতার সমান (মনুসংহিতা ২ : ১৪৫)। মনুর চোখে নারী কখনো ভগবান, কখনো শয়তান। কেন এই দ্বিমুখী নারীভাবনা ? তাত্ত্বিক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতে পরবর্তীকালে কোনো নারীদ্বেষী সমাজসংস্কারক এইসব অবমাননাকর শ্লোক রচনা করে মনুসংহিতার মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিয়েছে (মনুর অনুবাদ পূরণ ৩১)। ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র মনে করেন বিপরীত কথা থাকলেই তাকে প্রক্ষিপ্ত বলা উচিত বলে আমি মনে করি না। মনু এক অর্থে ছিলেন সমাজের দর্পণ। সমাজে বহু বিপরীত ব্যাপার দেখা যায়। দর্পণে সেসব বিপরীতভাবেই প্রতিফলিত হয়।মনুর ভূমিকা প্রতিবেদক বা রিপোর্টারের মতো, তাই ভালো ও মন্দ দুই দিকই তিনি তুলে ধরেছেন

একজন ব্রাহ্মণ পূর্বজন্মে পুণ্যবান ছিল বলেই এখন ব্রাহ্মণরূপে জন্মলাভ করেছে এবং একজন অস্পৃশ্য পূর্বজন্মে পাপী জীবনযাপন করেছে বলেই এখন অস্পৃশ্য হয়ে জন্মেছে। অস্পৃশ্যকে নিজের মুক্তির জন্যে অবশ্যই দাসের মতো ব্রাহ্মণের পুজো ও সেবা করতে হবে। যারা হিন্দু বর্ণাশ্রমকে মেনে নিয়েছে তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে স্থান পেয়েছে। পক্ষান্তরে যারা তা মানেনি তাদেরকে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। নারী নরকের দ্বার হয়েছেন। অসাম্যের দেবতা মনুর সংকলিত সংস্কৃত ভাষার মনুসংহিতাই এই বৈষম্য এবং অস্পশ্য-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আজও বহমান, ফল্গুনদীর ধারার মতো, অভিশাপের মতো।

মনুস্মৃতি ও মহাভারত গ্রন্থ দুটিতে কতকগুলি শ্লোকের হুবহু মিল পাওয়া যায়। আবার কোনো-কোনো ক্ষেত্রে সামান্য পরিমার্জন হলেও একইরকম। বস্তুত মনুর গ্রন্থ আদিরূপে আমাদের কাছে পৌঁছোয়নি। বর্তমান মহাভারত বহুদিন যাবৎ বিবর্তনেরই রূপ। সুতরাং মহাভারতের কাছে মনুসংহিতা ঋণী, নাকি মনুসংহিতার কাছে মহাভারত ঋণী এটা নির্ণয় করা বেশ অসম্ভব। এই দুই গ্রন্থে এমন কিছু শ্লোক আছে যেগুলিতে শব্দগত সাদৃশ্য না-থাকলেও ভাবগত সাদৃশ্য বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে সবশেষে বলা যায়, মনুসংহিতা বিভিন্ন আচার্যের হাতে সংস্কৃত হতে হতে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে, যা বলা যায়, ভারতের হিন্দুসমাজের সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে তার একচ্ছত্র, অবিসংবাদিত ও অপ্রতিহত কর্তৃত্ব।

উপনিষদ্‌ সনাতন ধর্মের এক বিশেষ ধরনের ধর্মগ্রন্থের সমষ্টি, যা সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এই গ্রন্থগুলিতে সনাতন ধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি আলোচিত হয়েছে। উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, উপনিষদ্‌গুলিতে সর্বোচ্চ সত্য ব্রহ্মের প্রকৃতি এবং মানুষের মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে। উপনিষদ্‌গুলি মূলত বেদের ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক অংশের শেষ অংশে পাওয়া যায়। এগুলি প্রাচীনকালে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ছিল

বস্তুত ২০০টির বেশি উপনিষদের কথা জানা যায়। এগুলির মধ্যে প্রথম বারোটিই প্রাচীনতম, এগুলিকে মুখ্য উপনিষদ বলে। শ্রীমদভগবদ্গীতা, ব্রহ্মসূত্র এবং মুখ্য উপনিষদ্‌গুলি পরবর্তীকালে সনাতন ধর্মের বেদান্ত দর্শনের বিভিন্ন শাখার জন্ম দিয়েছে। এগুলির মধ্যে দুটি একেশ্বরবাদী শাখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, মুখ্য উপনিষদ্‌গুলি প্রাক্‌বৌদ্ধ যুগ থেকে শুরু করে খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালের বিভিন্ন পর্বে রচিত হয়। অপরদিকে অপ্রধান উপনিষদগুলি মধ্যযুগ ও প্রাক্‌-আধুনিক যুগের রচনা। অবশ্য প্রতিটি উপনিষদের সঠিক রচনাকাল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক লক্ষ করা যায়। রালফ ওয়াল্ডো এমারসন, আর্থার শোপেনহাওয়ার ও হেনরি ডেভিড থোরো সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপনিষদ্‌গুলির গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। ব্রিটিশ কবি মার্টিন সেমোর-স্মিথ উপনিষদ্‌গুলিকে "সর্বকালের ১০০টি সবচেয়ে প্রভাবশালী বই"-এর তালিকাভুক্ত করেছেন। গবেষকেরা উপনিষদের দর্শনের সঙ্গে প্লেটো ও কান্টের দর্শনের মিল খুঁজে পান।

উপনিষদগুলির মধ্যে অন্যতম হল মুক্তিকা উপনিষদ্‌। এই উপনিষদে ১০৮টি উপনিষদের নাম পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, ১০৮ সংখ্যাটিকে সনাতনীরা পবিত্র বলেই মানেন। আধুনিক গবেষকেরা তার মধ্যে ১০, ১১, ১২ বা ১৩টি উপনিষদ্‌কে প্রধান বা মুখ্য উপনিষদ বলেন। তাঁদের মতে, অন্যান্য উপনিষদ্‌গুলি এই মুখ্য উপনিষদ্‌ থেকেই উদ্ভুত। আদি শঙ্কর প্রমুখ বিশিষ্ট দার্শনিক ধর্মগুরুরা যেসব উপনিষদের ভাষ্য রচনা করেছেন, সেগুলিই মুখ্য উপনিষদ্‌। সনাতনীরা সেগুলিকেই শ্রুতিশাস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করেন। মুক্তিকা উপনিষদে যে নবীনতম উপনিষদ্‌গুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলি সম্ভবত দক্ষিণ ভারতে রচিত হয়েছিল। বিষয় অনুযায়ী এগুলিকে বেদান্ত (দার্শনিক), যোগ, সন্ন্যাস (মুক্তিবাদী), বৈষ্ণব (বিষ্ণু বিষয়ক), শৈব (শিব বিষয়ক) ও শাক্ত (দেবী বিষয়ক) এই কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। নতুন উপনিষদ্‌গুলি প্রধানত সম্প্রদায়কেন্দ্রিক। কারণ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রুতিশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নিজেদের মতকে ধর্মসংগত করার প্রবণতা ছিল। উপনিষদ্‌গুলির সঙ্গে সংহিতা বা ব্রাহ্মণ বইগুলির সম্পর্কের নিরিখেও এদের শ্রেণিবিভাগ করা যায়। ঐতরেয়, কৌশিতকি ও তৈত্তিরীয় উপনিষদ্‌ প্রায় সমসাময়িককালে লেখা। তবে কিছু অংশ বৈদিক ও ধ্রুপদি সংস্কৃত যুগের সন্ধিক্ষণের রচনা বলে অনেকে করেন।

মুখ্য উপনিষদ্‌গুলিকে তাদের রচনাকাল অনুযায়ী সাজানো গিয়েছে। প্রাচীন উপনিষদ্‌গুলির মধ্যে বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ দুটি সবচেয়ে প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ। বৃহদারণ্যকই প্রথম লেখা হয়েছে। তবে এর কিছু কিছু অংশ ছান্দোগ্যের পরে রচিত হয়েছে। অনেকে আবার ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, কৌশিকতী, মুণ্ডক, প্রশ্ন ও কঠ উপনিষদে বৌদ্ধ প্রভাব আছে বলে মনে করেন। সেক্ষেত্রে গুলির রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পরে হওয়াই স্বাভাবিক। একইভাবে কেন, মাণ্ডুক্য ও ঈশ উপনিষদ্‌ সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়। এগুলি অবশ্য খ্রিস্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীর রচনা। উপনিষদ্‌গুলিতে রচয়িতার নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে যাজ্ঞবল্ক্য, উদ্দালক প্রমুখের মতো ঋষিদের নাম পাওয়া যায়। কয়েকজন মহিলার নামও আছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গার্গী ও মৈত্রেয়ী। মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্যের স্ত্রী । মুখ্য উপনিষদ্‌গুলি চতুর্বেদের কোনো-না-কোনো শাখার সঙ্গে সংযুক্ত। জানা যায় বেদের বহু শাখা ছিল। অবশ্য তার মধ্যে অল্প ক-টিই আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়। নতুন উপনিষদ্‌গুলির সঙ্গে বৈদিক সাহিত্যের যোগ বিশেষ নেই বললেই চলে। বেদান্তের কোনো অগ্রণী দার্শনিক বা টীকাকার এগুলির উপর কোনো ভাষ্য বা টীকা লেখেননি। মুখ্য উপনিষদ্‌গুলি ভাষার দিক থেকে অনেক আলাদা। নতুন উপনিষদ্‌গুলিতে ভাবের সূক্ষ্মতা কম।

নতুন উপনিষদ্‌গুলি একের পর এক রচিত হয়েছে বলে এই উপনিষদ্‌গুলির কোনো নির্দিষ্ট তালিকা পাওয়া যায় না। কোনো কারণে পুরোনো উপনিষদ্‌গুলি নবীন সম্প্রদায়ের প্রবর্তকদের কাছে গ্রহণযোগ্য না-হলে, তাঁরা তাঁদের মতো করে নতুন উপনিষদ্‌ রচনা করতেন। ফ্রেডেরিক স্ক্র্যাডার ১৯০৮ সালে চারটি নতুন উপনিষদ্‌ আবিষ্কার করেছিলেনবাষ্কল, ছগলেয়, আর্ষেয় ও শৌনক। তিনি এগুলিকে প্রথম গদ্যে রচিত উপনিষদ্‌গুলির সমসাময়িক বলে দাবি করেছিলেন। ছগলেয়, আর্ষেয় ও শৌনক উপনিষদের পুথি খণ্ডিত ও অবহেলিত। তবে এগুলির ফারসি-লাতিন অনুবাদের সাহায্যে এগুলিকে উদ্ধার করা সম্ভব। ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগ পর্যন্ত উপনিষদ্‌ নামধারী বই লেখা হয়েছে প্রচুর। নতুন নতুন উপনিষদ রচনা হয়েই চলেছে, আজও।

শাক্ত উপনিষদ্‌গুলিতে মূলত তান্ত্রিক শাক্তবাদের শ্রীবিদ্যা উপাসনা শাখার দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের মতবাদগত ও ব্যাখ্যাগত পার্থক্য আলোচিত হয়েছেপ্রামাণ্য শাক্ত উপনিষদের সংখ্যাও অনেক। এগুলি রচয়িতার সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। তাই এগুলির ব্যাখ্যা সঠিক কি না, বা তান্ত্রিক ঐতিহ্যে এদের কী স্থান ছিল, দুর্ভাগ্যবশত তা জানা যায় না। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের মতে, প্রায় প্রতিটি উপনিষদ্‌ই বহু বছর ধরে গুপ্ত অবস্থায় সংরক্ষিত হয়। এগুলি শ্লোকের আকারে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। তাই মূল রচনা থেকে বর্তমানে প্রাপ্ত পাঠ কতটা ভিন্ন, তা আর ধরার উপায় নেই।
সনাতনীদের কাছে যে প্রতীকটি পবিত্রতম, সেই নাদব্রহ্মরূপী ওঁউচ্চারণটির প্রথম বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় উপনিষদে। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ” -- মন্ত্রটি উপনিষদে বারবার দেখা যায়। উপনিষদে ভক্তিযোগের পথটির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালের শ্রীমদভগবদ্গীতা ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে অবশ্য এই পথটি ঈশ্বর উপাসনার অন্যতম প্রধান পথ হয়ে উঠেছে

অনেক মনে করেন আদি উপনিষদ্‌গুলির রচনাস্থল উত্তর ভারত। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া হয়, এই অঞ্চলের পশ্চিম সীমায় ছিল সিন্ধুনদ, পূর্বে নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতমালা। কুরু-পাঞ্চাল, কোশল-বিদেহ এবং তার পূর্ব ও দক্ষিণের অঞ্চলগুলি ছিল ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের মূল কেন্দ্র। এইখানেই উপনিষদ্‌গুলি রচিত হয়েছিল বলে অনেক পণ্ডিতগণের দাবি।

সাম্প্রতিককালে প্রতিটি উপনিষদের সঠিক রচনাক্ষেত্র নিয়ে একটি অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। উইটজেল মনে করেন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের রচনাক্ষেত্র বিদেহ। কারণ এখানকার রাজা জনক এই উপনিষদের একজন মুখ্য চরিত্র। তা ছাড়া এই উপনিষদের অন্যতম মুখ্য চরিত্র যাজ্ঞবল্ক্য ছিলেন জনকের রাজপণ্ডিত। কুরু-পাঞ্চাল রাজ্যের কেন্দ্রস্থলের ব্রাহ্মণরা এই অঞ্চলটিকে শ্রেষ্ঠ ধর্মতত্ত্ববিদ ও সাহিত্যিকদের বাসস্থান বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এই অঞ্চলই ছিল উত্তর-বৈদিক যুগের ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের প্রাণকেন্দ্র। বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ের পটভূমি সম্ভবত এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছে যে বিদেহর যাজ্ঞবল্ক্য কুরু-পাঞ্চালের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিকদের তর্কে পরাস্ত করেছিলেন। ছান্দোগ্য উপনিষদের রচনাস্থল সম্ভবত আরও পশ্চিমের কোনো অঞ্চলে। সম্ভবত কুরু-পাঞ্চালের পশ্চিম অঞ্চলে। কুরু-পাঞ্চালের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক উদ্দালক আরুণির সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু তথ্য পাওয়া যায় বৃহদারণ্যকে। অবশ্য ছান্দোগ্যে তিনিই প্রধান। মুখ্য উপনিষদ্‌গুলির সঙ্গে তুলনা করলে, মুক্তিকা উপনিষদে যেসব নতুন উপনিষদের নাম পাওয়া যায়, সেগুলি সম্ভবত দক্ষিণ ভারতে লেখা। আর এগুলি তুলনামূলকভাবে অনেক পরবর্তীকালের।

হিন্দুদর্শনের সবচেয়ে প্রভাবশালী শাখাসম্প্রদায় হল অদ্বৈত বেদান্ত শাখা। যদিও মূলধারার সনাতন ধর্ম তথা পরবর্তীকালের হিন্দুধর্মে এই শাখার প্রভাব ঠিক কতটা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। উপনিষদের আপাতবিরোধী বক্তব্যগুলির ভাষ্যরচনা মাধ্যমে প্রথম অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন গৌড়পাদ। অদ্বৈত বেদান্ত একটি একেশ্বরবাদী মতবাদ। অদ্বৈতবাদ ব্রহ্ম ও আত্মার অভিন্নতার কথা বলে। গৌড়পাদ অদ্বৈতবাদের প্রথম ঐতিহাসিক প্রবক্তা হলেও এই মত বিস্তারলাভ করে আদি শঙ্করের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন গৌড়পাদের জনৈক শিষ্যের শিষ্য। রাধাকৃষ্ণন মনে করেন, শঙ্করের অদ্বৈতবাদ উপনিষদ্ ও ব্রহ্মসূত্রের প্রত্যক্ষ বিকাশের ফলশ্রুতি। তিনি নতুন কিছুই বলেননি। যদিও অন্যান্য গবেষকেরা শঙ্করের রচনা ব্রহ্মসূত্রের বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক খুঁজে পান। তাঁরা বলেন, উপনিষদের অনেক বক্তব্যের সঙ্গে শঙ্করের বক্তব্য মেলে না। গৌড়পাদের জীবদ্দশাতেও ভারতে বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তিনি নিজেও তাঁর মতবাদ ও বৌদ্ধ মতবাদের মধ্যে কিছু কিছু সাদৃশ্যের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তাঁর রচনায় বৌদ্ধধর্মের বহু পারিভাষিক শব্দ গৃহীত হয়েছিল। তিনি বৌদ্ধদের মত ও উপমা ইত্যাদি ব্যবহারও করেছিলেন। উপনিষদকে ভিত্তি করে একাধিক দার্শনিক মতবাদ গড়ে উঠেছে। তবে আদি শঙ্কর-পরবর্তী ভাষ্যকারেরা শঙ্করের মতকে আদর্শ অদ্বৈতবাদী মতবাদ মনে করে সেই মতের অনুসরণ করে এসেছেন।

বেদান্তের অপর প্রধান শাখা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রবর্তন করেন রামানুজ। তিনি একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর মানুষ ছিলেন। আধুনিক গবেষকদের মতে, রামানুজের বেদান্তভাষ্য শঙ্করের ভাষ্যের তুলনায় অনেক বেশি মূলানুগ। তাছাড়া রামানুজের মত হিন্দুদের সাধারণ ধর্মবিশ্বাসের অনেক কাছাকাছি। রামানুজ শঙ্করের মত অস্বীকার করেছিলেন। বেদান্তের এই শাখায় অপর দুটি শাখাকে ভক্তি ও প্রেমের পথে এক করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। এটিকে বলে শ্রী বৈষ্ণবধর্ম। এই মতে, জীব ও ব্রহ্ম দুটি পৃথক সত্ত্বা নয়। বরং ঈশ্বর জীবের অন্তর্নিহিত সত্ত্বা। উপনিষদের দ্বৈতবাদী শাখার প্রবর্তক হলেন মধ্ব। তিনি ১১৩৮ সালে উডিপির কাছে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অনেকে দ্বৈতবাদকে আস্তিক্যবাদী শাখাগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। দ্বৈতবাদে ব্রহ্ম ও আত্মার পৃথক সত্ত্বা স্বীকৃত।

সর্বোপরি উপনিষদের শিক্ষা মানুষকে জীবনবিমুখ করে না, এটি world and life negation-এর কথা বলে না বলে এক পরিপূর্ণ জীবনের কথা, যে জীবন জ্ঞান-কর্ম-ভক্তি-প্রেমের দ্বারা ব্রহ্মের সঙ্গে সবসময়ই যুক্ত থাকা। উপনিষদের শিক্ষাকে এইভাবে জীবনে প্রয়োগ করার কথাই শুনতে পাই রামমোহন রায় থেকে অরবিন্দ ঘোষ পর্যন্ত আধুনিককালের মনীষীদের কণ্ঠে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই গ্রন্থ সনাতন ধর্মাবলম্বী, পরবর্তীতে হিন্দুদের কাছে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে জ্ঞানে-অজ্ঞানে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জীবনচর্যায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। ব্রহ্মজ্ঞান, ঈশ্বরতত্ত্ব, অমৃতত্বলাভ, সৃষ্টিরহস্য, জীবাত্মা-পরমাত্মা, ভূমাতত্ত্ব, ব্রহ্মলোক, গায়ত্রী মন্ত্রের ব্যাখ্যা, প্রাণতত্ত্বের মতো জ্ঞান অর্জন সম্ভব উপনিষদ থেকেই। যম ও নচিকেতার উপাখ্যান, উষস্তি ও চাক্রায়ণের উপাখ্যান, জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ ও রৈক্বের উপাখ্যান, সত্যকাম ও জাবালের উপাখ্যান, ইন্দ্র ও বিরোচন উপাখ্যান, মৈত্রেয়ী ও যাজ্ঞবল্ক্যের আলাপন, জনক ও যাজ্ঞবল্ক্যের সংবাদ, বালাকি ও অজাতশত্রুর সংবাদ সনাতনীদের খুবই অনুপ্রাণিত করে জ্ঞানঋদ্ধ করে। মৈত্রেয়ী ও যাজ্ঞবল্ক্যের আলাপচারিতায় জ্ঞানী মৈত্রেয়ীর সেই সর্বকালের বিখ্যাত উক্তি – “যেন অহম্ ন অমৃতা স্যাম, কিম্ অহম্ তেন কুর্যাম্অর্থাৎ যাহা দ্বারা আমি অমরত্ব লাভ করিতে পারিব না, তাহা দ্বারা কী করিব ?”

পুরাণ হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানমূলক ধর্মগ্রন্থ। পুরাণে সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, রাজন্যবর্গ, যোদ্ধৃবর্গ, ঋষি ও উপদেবতাগণের বংশবৃত্তান্ত এবং হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব, দর্শন ও ভূগোলতত্ত্ব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পুরাণে সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো দেবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং তাতে ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার প্রাবল্যও লক্ষিত হয়। এই গ্রন্থগুলি প্রধানত আখ্যায়িকার আকারে রচিত, যা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
অনেক পণ্ডিতগণের মতে, মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব পুরাণগুলির সংকলক। যদিও পুরাণের সব চাইতে প্রাচীন পাঠগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দী) সমসাময়িক। এর অধিকাংশ উপাদানই ঐতিহাসিক বা অন্যান্য সূত্রাণুযায়ী এই সময়কাল ও তার পরবর্তী শতাব্দীগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরাণগ্রন্থগুলি ভারতের নানা স্থানে রচিত হয়েছিল। পুরাণের সামগ্রিক পাঠে কিছু সাধারণ ধারণা লক্ষিত হয়; কিন্তু একটি পুরাণের উপর অপর আরেকটি পুরাণের প্রভাব অন্বেষণ দুঃসাধ্য। তাই সাধারণভাবে এগুলিকে সমসাময়িক বলেই ধরে নেওয়া হয়। লিখিত পাঠ্যগুলির রচনাতারিখ পুরাণের প্রকৃত রচনাতারিখ নয়। কারণ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে পূর্ববর্তী এক সহস্রাব্দকাল ধরে এই কাহিনিগুলি মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়ে আসে। এবং পরবর্তীকালে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এগুলির আকার ও রূপ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।

কাশীর মহারাজা ডক্টর বিভূতি নারায়ণ সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে অল ইন্ডিয়া কাশীরাজ ট্রাস্ট গঠিত হলে পুরাণ নিয়ে সুসংহত গবেষণার কাজ শুরু হয়। এই সংস্থা থেকে পুরাণের সমালোচনামূলক সংস্করণ এবং পুরাণম্নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে রচিত ছান্দগ্যো উপনিষদে (৭::২) পুরাণের একটি প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ পুরাণকে "পঞ্চম বেদ" নামে অভিহিত করে -- ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদম্এতে প্রাচীন যুগে পুরাণের ধর্মীয় গুরুত্বের কথা জানা যায়। সম্ভবত সেই যুগে পুরাণ মৌখিকভাবে প্রচারিত হত। অথর্ববেদেও (১১::১৪) এই শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
মৎস্যপুরাণ অনুসারে, পুরাণের মূল বিষয় পাঁচটি। এগুলি পঞ্চলক্ষণনামে পরিচিত – (১) সর্গ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকাহিনি।(২) প্রতিসর্গ পরবর্তীকালের (মুখ্যত প্রলয় পরবর্তী) সৃষ্টিকাহিনি। (৩) বংশ দেবতা ও ঋষিদের বংশবৃত্তান্ত।(৪) মন্বন্তর মানবজাতির সৃষ্টি ও প্রথম সৃষ্ট মানবজাতির কাহিনি। মনুর শাসনকালের কথা, এই শাসনকাল ৭১টি দিব্য যুগ বা ৩০৮,৪৪৮,০০০ বছরের সমান।(৫) বংশানুচরিতম্ রাজবংশের ইতিহাস। কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে পঞ্চলক্ষণনামে পরিচিত এই বিশেষ লক্ষণগুলি অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও দৃষ্ট হয়।

পুরাণে বংশবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ রাখার উপরেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বায়ুপুরাণ অনুসারে -- "পুরাকালের দেবতা, ঋষি, গৌরবশালী রাজন্যবর্গের বংশবৃত্তান্ত ও মহামানবদের কিংবদন্তি লিপিবদ্ধ রাখার দায়িত্ব সূতের উপর অর্পিত হয়।" পৌরাণিক বংশবৃত্তান্ত অনুযায়ী মনু বৈবস্বত ভারত যুদ্ধের ৯৫ প্রজন্ম পূর্বে জীবিত ছিলেন।

পারগিটার বলেছেন, ‘মূল পুরাণগুলিবা ‘Original Purana’ সম্ভবত বেদের সর্বশেষ লিখিত রূপের সমসাময়িক। এবং পারগিটার মনে করেন, বায়ুপুরাণে যে যুগগুলি ৪৮০০, ৩৬০০, ২৪০০ ও ১২০০ বছরে বিভক্ত হয়েছে, তার মধ্যে পৌরাণিক কৃত যুগ "সমাপ্তি রাম জমদগ্ন্যের দ্বারা হৈহয়দের ধ্বংসপ্রাপ্তিতে। ত্রেতাযুগের সূত্রপাত রাজা সগরের সময়কালে এবং সমাপ্তি রাম দাশরথি কর্তৃক রাক্ষস ধ্বংসে। দ্বাপর যুগের সূত্রপাত অযোধ্যা-প্রত্যাবর্তনে এবং সমাপ্তি ভারতযুদ্ধে।"
পুরাণ গ্রন্থগুলি এমন এক জটিল উপাদান-সংগ্রহ যাতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী সম্প্রদায়ের উদ্ভবতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। তাই গেভিন ফ্লাড ঐতিহাসিকভাবে লিখিত পুরাণের উদ্ভবের সঙ্গে গুপ্তযুগে নির্দিষ্ট দেবতাকেন্দ্রিক ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভবের ঘটনাকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মনে করেছেন -- যদিও এই গ্রন্থগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এদের একটিতে অপরটির উপাদান প্রায়শই গৃহীত হয়েছে, তবুও বলতে হয়, প্রতিটি গ্রন্থেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে জগতকে দেখা হয়েছে। এগুলিকে প্রচলিত উপকথার এলোপাথাড়ি সংকলন মনে করা উচিত নয়। এগুলি বিশ্বচেতনার অভিপ্রকাশ, সুসংকলিত, বিষয়গতভাবে সুসংবদ্ধ এবং ধর্মীয় তত্ত্বকথা। ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নির্দিষ্ট দর্শনকে তুলে ধরার জন্য এগুলি সংকলন করেছিলেন -- কেবল কেউ বিষ্ণু, কেউ শিব, কেউ-বা দেবী বা অন্য কোনো দেবতার উপর আলোকপাত করেনভারতীয় বিভিন্ন ভাষার অনুবাদে পুরাণগুলি অনূদিত হয়েছে। কথক নামে পরিচিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে কথকতার মাধ্যমে ভক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণের কাহিনিগুলি জনসমাজে প্রচার করে সাধারণ্যে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেন।

কীভাবে যে শনি ভয়াল ভয়ংকর দেবতা হয়ে গেল বুঝতে হবে পুরাণ পাঠ করেই। শনির মতো ভয়ংকর ও দুচ্ছাই দেবতা আর একটিও নেই ! শনি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা যতই ভয়ভীতিমিশ্রিত হোক না-কেন -- মৎস্যপুরাণ কিন্তু শনিকে লোকহিতকর গ্রহের তালিকাতেই ফেলেছে। মৎস্য ও সৌর পুরাণের মতে, শনি বিবস্বান (সূর্য) ও ছায়ার পুত্র। আবার অগ্নি পুরাণের মতে, বিবস্বানের পত্নীর সংজ্ঞার গর্ভে শনির জন্ম। এদিকে মার্কণ্ডেয়, বায়ু, ব্রহ্মাণ্ড, বিষ্ণু ও কূর্ম পুরাণ মতে, শনি বা শনৈশ্চর অষ্টরুদ্রের প্রথম রুদ্রের পুত্র। তাঁর মায়ের নাম সুবর্চলা। স্কন্দপুরাণে শনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শিপ্রা ও ক্ষাতা নদীর সংযোগস্থলে। শনির জন্ম নিয়ে একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনিও আছে। শনি জন্মগ্রহণ করেই ত্রিলোক আক্রমণ করে বসলেন এবং সেই সূত্রে রোহিণীর পথ ভেদ করলেন। সারা ব্রহ্মাণ্ড আতঙ্কে শঙ্কিত হল। ইন্দ্র প্রতিকার চাইতে ব্রহ্মার কাছে ছুটলেন। ব্রহ্মা সূর্যের কাছে গিয়ে শনিকে সংযত করতে বললেন। কিন্তু ততক্ষণে শনির দৃষ্টিপাতে সূর্যেরই পা-দুটি পুড়ে গিয়েছে। তিনি কিছুই করতে পারলেন না। তিনি ব্রহ্মাকেই উলটে শনিকে সংযত করার অনুরোধ করলেন। ব্রহ্মা গেলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণুও নিজে কিছু করতে পারবেন না ভেবে ব্রহ্মাকে নিয়ে চললেন শিবের কাছে। শিব শনিকে ডেকে পাঠালেন। শনি বাধ্য ছেলের মতো মাথাটি নিচু করে এলেন শিবের কাছে। শিব শনিকে অত্যাচার করতে বারণ করলেন। তখন শনি শিবকে তাঁর জন্য খাদ্য, পানীয় ও বাসস্থানের নির্দেশ করতে বললেন। তখন শিবই ঠিক করে দিলেন শনি মেষ ইত্যাদি রাশিতে তিরিশ মাস করে থেকে মানুষের পিছনে লাগবেন এবং এই করেই তাঁর হাড় জুড়াবে। অষ্টম, চতুর্থ, দ্বিতীয়, দ্বাদশ ও জন্মরাশিতে অবস্থান হলে তিনি সর্বদাই বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হবেন। কিন্তু তৃতীয়, ষষ্ঠ বা একাদশ স্থানে এলে তিনি মানুষের ভালো করবেন এবং তখন মানুষও তাঁকে পুজো করবে। পঞ্চম বা নবম স্থানে এলে তিনি উদাসীন থাকবেন। চুক্তি হল অন্যান্য গ্রহদের তুলনায় তিনি বেশি পুজো পাবেন। পৃথিবীতে স্থির গতির জন্য তাঁর নাম হবে স্থাবর। আর রাশিতে মন্দ গতির জন্য তাঁর নাম হবে শনৈশ্চর। তাঁর গায়ের রং হবে হাতি বা মহাদেবের গলার রঙের মতো। তাঁর চোখ থাকবে নিচের দিকে। সন্তুষ্ট হলে তিনি লোককে দেবেন রাজ্য, অসন্তুষ্ট হলে লোকের প্রাণ নেবেন। শনির দৃষ্টি যার দিকেই পড়বে, তিনি দেবতাই হোন, বা দৈত্য, মানব, উপদেবতাই হোন, পুড়ে মরতে হবেই হবে। এই কথা বলে শিব শনিকে মহাকালবনে বাস করতে বললেন

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে, শনি আদৌ কুদৃষ্টি নিয়ে জন্মাননি, বরং স্ত্রীর অভিশাপই তাঁর কুদৃষ্টির কারণ। একদিন যখন শনি ধ্যান করছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী সুন্দর বেশভূষা করে এসে তাঁর কাছে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও ধ্যানরত শনি স্ত্রীর দিকে ফিরেও দেখলেন না। অতৃপ্ত, বিমুখ ও প্রত্যাখ্যাত শনির স্ত্রীর তখন শনিকে অভিশাপ দিলেন, বললেন -- আমার দিকে ফিরেও চাইলে না তুমি ! যাও, অভিশাপ দিলাম। এবার থেকে যার দিকেই দৃষ্টি দেব, সেই-ই ভষ্ম হয়ে যাবে।গণেশের জন্মের পর সকল দেবদেবীর সঙ্গে শনিও গণেশকে দেখতে গেলেন। কিন্তু স্ত্রীর অভিশাপের কথা স্মরণ করে তিনি গণেশের মুখের দিকে চেয়েও দেখলেন না। পার্বতী শনির এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চাইলে শনি অভিশাপের বিষয়টা বলেন। কিন্তু পার্বতী সেকথা বিশ্বাস করলেন না। বারংবার অনুরোধের পর শনি শুধু আড়চোখে একবার গণেশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাতেই গণেশের মুণ্ড দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বোধহয় মামা শনির দৃষ্টি’-তে ভাগ্নে গণেশের মুণ্ড খসে পড়ার গপ্পোটিই শনিকে ঘরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। শনির দশাকাটাতেই জ্যোতিষীদের এত রমরমা ব্যাবসা।


পুরাণগুলিতে এরকম শত শত গল্প আছে, যা রূপকথার চাইতেও বেশি রূপকথা। অপ্রাকৃতিক, অলৌকিক রূপকথার গল্পগুলি একসঙ্গে করে একটা আলাদা বই ছোটোদের মনোরঞ্জনের জন্য করা যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হল রূপকথাগুলি ছোটোদের জন্য নয়, বড়োদের জন্য। কারণ আদিরসাত্মক যৌনগন্ধি গল্পে পুরাণগুলি ম ম করছে।

বর্তমান সময়ে বেদ এবং পুরাণের সম্পর্ক এবং এদের পারস্পরিক সাংঘর্ষিকতার বিষয়টা নিয়ে একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। বেদের সঙ্গে পুরাণগুলি সাংঘর্ষিকতা এবং পুরাণগুলির প্রচলন বৈদিক সভ্যতার পতন ও বৈদিক ধর্মের অবক্ষয়ের মূল কারন। পুরাণ বলতেই আমরা ৩৬টি প্রচলিত পুরাণ (১৮টি মূলপুরাণ এবং ১৮টি উপপুরাণ) বুঝি। কিন্তু আসলে কী ? সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৮টি মূলপুরাণ এবং ১৮টি উপপুরাণ আছে যেগুলো ব্যাসদেব কর্তৃক লিখিত বলে কথিত। পুরাণগুলিকে পঞ্চম বেদের মর্যাদা দেওয়া হয়। এটা বৈদিক যুগে পুরাণগুলির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নির্দেশ করে।

শ্রুতিশাস্ত্রে পুরাণের উল্লেখ আছে -- "রিচা সামানি ছন্দমসি পুরানাম যজুসা সহ উচ্ছিষ্টজ্জানি রে সর্বে দিবি দেবা দিবি স্মৃতহ" (অথর্ববেদ ১১::২৪) এবং ইতিহাসাং চ পুরাণাং চ গাথা চ ইতিহাসস্য চ স বায় পুরাণস্য চ গাথানাম চ নরসংসাম চ প্রিয়ম ধামা ভবতি য ইবম বেদ” (অথর্ববেদ ১৫::১১-১২) । অর্থাৎ ঋক্, সাম, যজু ও অথর্ব ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত, ঠিক তেমন পুরাণ, ইতিহাস, গাথা, কল্প ও সকল দেবসমূহও তাঁর থেকে সৃষ্ট। ছান্দেগ্য উপনিষদে আছে -- "ইতিহাসপুরাণাম পঞ্চম বেদানাহ বেদহ" (ছান্দেগ্য উপনিষদ ৭::::৪)। অর্থাৎ ইতিহাস পুরাণগুলি যেন পঞ্চম বেদরূপ।

পুরাণসমূহ মানবসমাজে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং এগুলি বেদ বুঝতে সহায়ক। বেদদ্রষ্টা এবং উপনিষদ রচয়িতা মুনিগণ (যেমন ছান্দেগ্য উপনিষদ রচয়িত ঋষি উদ্দালক, সনত্কুমার, শাণ্ডিল্য মুনি কর্তৃক) সত্য এবং ত্রেতা যুগে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যসদেব দ্বাপর যুগে জন্মগ্রহণ করেন। "তথা হি মহাভারতে মানবিয়ে চ ইতিহাস পুরানাব হ্যম বেদম সমুপব্রহ্ময়েত বিভেয়ি অল্পশ্রুতদ বেদো মম অয়ম প্রহরীস্যতি ইতি পুরাণাম পুরাণাম ইতি চন্যয়ত্র্য ন চ বেদেন বেদেস্য ব্রহ্মণম সম্ভবতি ন য অপরিপুর্ণস্য কনক বলয়সি অ ত্রপুনা পূর্ণম যুজ্যতে"(মহাভারত আদি পর্ব, ১.২৬৭,২৬৮)

বর্তমানে প্রচলিত পুরাণগুলি মতে ব্যাসদেব মহাভারত লেখার ও বহুকাল পরে পুরাণগুলি রচনা করেন। যদি তাই হয়ে থাকে তবে মহাভারতে পুরাণ শব্দটি এল কী করে ? কেন-না তখন পর্যন্ত তো পুরাণ বলে তো কিছু ছিলই না ! এর মাধ্যমে মহাভারতে উল্লেখিত পুরাণ মহাভারতের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ বর্তমানে প্রচলিত ৩৬টি পুরাণ মহাভারতে উল্লেখিত পুরাণসমূহ নয়। ঐতরেয়, শতপথ, গোপথ ও সাম -- এই চারটি ব্রাহ্মণ গ্রন্থই হল বেদ, উপনিষদ ও মহাভারতে উল্লেখিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুরাণ ! এই চার ব্রাহ্মণ গ্রন্থের অপর নামগুলি হল ইতিহাস, পুরাণ, কল্প, গাথা এবং নরসংশি। যখন ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বিভিন্ন পূর্বাপর ঘটনা বর্ণিত থাকে তখন তার নাম হয় ইতিহাস(যেমন ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যাজ্ঞবল্ক্যসহ বিভিন্ন ঋষির ইতিহাস) ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে যখন সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন তার নাম হয় পুরাণ (শতপথ ব্রাহ্মণের সৃষ্টিতত্ত্ব) যখন বৈদিক শব্দের ব্যাকরণ ও অর্থ এবং তার ব্যুত্পত্তি নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন এদের নাম হয় কল্প । যেহেতু বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সেহেতু আর-এক নাম গাথা। অনেক স্থানে বিভিন্ন কাহিনির মাধ্যমে ভাল-মন্দের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তাই আর-এক নাম নরসংশি।

পুরাণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সায়নাচার্য বলেছেন --"ইদম নৈব কিমছনসিন্নদ রসিতিত্যদিবম। জগতঃ প্রগনবস্থাম উপক্রম্য স্বর্গপ্রতিপদ একম বাক্যথতম পুরানাম"। অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে শুধু সেই এক ও অদ্বিতীয়ই বিরাজমান ছিলেন। সৃষ্টির পর তাঁর সৃষ্টির তত্ত্ব নিয়ে যেগুলি আলোচনা করল সেগুলি হল পুরাণ। মানুষ যাতে দ্বিধায় না ভোগে সেই জন্য বলেছেন -- "ন ব্রহ্ম যজ্ঞ প্রকারণেমন্ত্র ব্রাহ্মণব্যতিরেকে ত ইতিহাস্যেভাগ অম্লয়ন্তে"। অর্থাৎ ব্রহ্ম যজ্ঞে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয় যে ব্রাহ্মণসমূহ থেকে সেগুলো ব্যতিরেক অন্য কোনো গ্রন্থই পুরাণ নয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যে বৈদিক যুগে যজ্ঞের পরে যজমানরা ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি থেকে সৃষ্টিসুক্তগুলি উচ্চারণ করা হয়, যে কারণে এসব গ্রন্থকে পুরাণ বলা হত।

তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ২.৯ শ্লোকে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে -- "যদ ব্রাহ্মণ ইতিহাস পুরাণানি কল্পন গাথা নরসংশি"।অর্থাৎ মন্ত্রের বিষয় ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিই পুরাণ, ইতিহাস, কল্প, গাথা ও নরসংশি নামে পরিচিত। সুতরাং এটা স্পষ্ট হয় যে বেদ, উপনিষদ ও মহাভারতে উল্লেখিত পুরাণ হল ব্রাহ্মণগ্রন্থ এবং প্রচলিত ৩৬টি পুরাণ প্রকৃত পুরাণ নয়। পুরাণগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় যে নানারকম ভুল, অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব কাহিনিতে পরিপূর্ণ, অশ্লীলতায় ভরা এই বিকৃত পুস্তকগুলি মোটেও মহর্ষি ব্যাসদেবের লেখা নয়বরং কিছু ধর্মব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রের ফসল মনে করা যেতেই পারে। সুতরাং সনাতনের ঐক্যের স্বার্থে এবং বৈদিক ধর্মের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এইসব মিথ্যাচারের গ্রন্থ আমাদের বর্জন করা উচিত কি না ভাবা যেতে পারে।

মিথ এবং পুরাণ ঠিক সমার্থবোধক না হলেও ব্যাবহারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যে সাধারণভাবে এই দুটিকে পরস্পরের প্রতিশব্দ বলেই নেওয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় অর্থে যাকে পুরাণ বলা হয়, তার উপকরণগত ব্যাপ্তি মিথের চেয়ে অনেক বেশি। পুরাণের মধ্যে মিথসুলভ উপকরণের পাশাপাশি কিংবদন্তী, ধর্মীয় প্রতীতী ও কিঞ্চিত বাস্তব ইতিহাসের ভগ্নাবশেষ একত্রিত হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য হলেও বলতেই হয় মিথ এবং পুরাণ কোনোটিই ইতিহাস নয়। আসলে পুরাণ কিংবা মিথ হল আদিমকাল থেকে মৌখিকভাবে প্রচলিত কিছু কাহিনি, যা কালক্রমে সমাজে বিবর্তিত রূপে প্রচলিত হয়ে আসছে। বস্তুত মিথের মধ্যে একটি জাতির নিজস্ব ঐতিহ্যের পরিকাঠামোটি নিবিড়ভাবে লীন হয়ে থাকে। উত্তরকালে এই পরিকাঠামোতেই গড়ে ওঠে সাহিত্যের বিভিন্ন বর্গ, যেখানে পুরাণ কিংবা মিথের অন্তর্গত উপাদানগুলিকে উত্তরকালের স্রষ্টারা সংযোজন-বর্জন-পরিমার্জন করে নিজেদের সমসাময়িক জীবনধারার ও ধ্যানধারণার সঙ্গে মানানসই করে নতুন নতুন কাহিনি সৃষ্টি করেন। মিথই কালক্রমে তার বাইরের আবরণটি পালটাতে পালটাতে চলে আসে উত্তরকালে। ফলে যে প্রাচীন ধর্মধারার অনুষঙ্গে মিথ-কাহিনিগুলি গড়ে উঠেছিল অতীতকালে, একালে এসে তার অবলুপ্তি ঘটে যায়।

সনাতনী সমাজজীবনে পুরাণের প্রভাব লক্ষ করা যায়। দেবালয়ে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে, বারব্রতে পুরাণ পাঠ হয়। পুরাণ সমস্ত জাতিকে ধর্মানুষ্ঠানের বিশেষত মহিলাদের ধর্মানুষ্ঠানের অধিকার বর্ণিত করেছে। চিন্ময়ী উপাসনা মৃন্ময়ী মূর্তিতে পুরাণের যুগে আবির্ভূত। পুরাণেই নতুন নতুন দেবদেবীদের রমরমা, দেবদেবীদের রূপকল্পনা, অবতার-ভাবনা, মূর্তি-ভাবনা, অলৌকিক কাণ্ডকারখানার আধার হয়ে উঠল। দেবমন্দির নির্মাণ, দেবতা প্রতিষ্ঠা, সর্বসাধারণের জন্য জলাশয় প্রতিষ্ঠা, বৃক্ষরোপণ, সেবাসদন সবেরই শুরু পুরাণ। বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের দেবী বা দেবতাকে মূল লক্ষ্য করে এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এক-একটি পুরাণ রচনা করেছেন।শুধু ঈশ্বর-মাহাত্ম্যই নয়, সমসাময়িক ঘটনাও নিজেদের সুবিধা মতো লিপিবদ্ধ করা আছে পুরাণে। প্রাচীনকাল থেকে পরীক্ষিতের রাজ্যলাভ, শিশুনাগ, নন্দবংশ, মৌর্যবংশ, অন্ধ্রবংশ, শুঙ্গবংশ, গুপ্তবংশ প্রভৃতি রাজবংশের বর্ণনা, আভীর-গর্দভ-শক-যবন-হূন প্রভৃতি বৈদেশিক জাতির ভারত আক্রমণের বর্ণনা জলে-দুধে মিশে আছে পুরাণগুলিতে।ভারতীয় সনাতনীদের সমাজজীবনে সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্ম, সাহিত্য এবং ইতিহাসের পুরাণগুলির মূল্য অপরিসীম। মিথ, তাই কি মিথোলজি !!! (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই: