মিশরীয়দের
মনেও প্রশ্ন জাগল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, মৃত্যু এবং জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। এভাবে তাঁদের মধ্যেও
জন্ম নেয় ধর্মীয় বিশ্বাস। অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়
দেবদেবতা। সমাজের বিবর্তন আর সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক গভীর।
প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের চিহ্ন রেখে গেছেন পাথরে গায়ে, সমাধি ক্ষেত্রে, গড়েছিলেন দেবতাদের মূর্তি আর মন্দির।
প্রাচীন মিশরে ২০০০ এরও বেশি দেবদেবী ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। স্থান ও কালের পার্থক্যে
দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল ভিন্ন। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মিশরীয় রাজা বা
ফারাও যারা পরবর্তীতে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। দেবতাদের কেউ কেউ ছিলেন
ক্ষতিকর। উল্লেখযোগ্য দেবতারা ছিলেন – রা,
তাহ, ওসিরিস, আইসি্স,
হোরাস, সেথ, হাথর,
আনুবিস, থথ, আটেন,
আমুন, বাস্তেত। রা ছিলেন সূর্যের দেবতা । রা দেবতা আবির্ভূত
হতেন বিভিন্ন রূপে সকালে খেপরি, বিকালে
আটুম কিংবা হোরাক্তি রূপে। রা-এর ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন ন্যায়বিচারের দেবী মাত। রা-এর দিবাকালীন
আকাশভ্রমণ সব সময় নিরাপদ ছিল না। আপেপ নামের এক সাপের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হত। আপেপের
নিঃশ্বাসে মেঘের কালো কুণ্ডলী রা-কে ঘিরে ফেলত। কিন্তু শক্তিমান রা-কে এসব
আটকাতে পারত না। সে সব কিছুকে পরাজিত করে ঠিকই তার পথ অতিক্রম করত। মাঝে মাঝে
ক্ষতিকর দেবতারা
এসে গিলে ফেলত রা-কে। তখন সূর্যগ্রহণ হত। কিন্তু রা ঠিক ঠিক শত্রুর পেটে কেটে বেরিয়ে
আসত। আইসিস, মিশরীয় মাতৃদেবী। উর্বরতার
দেবতা আমুন। ফারাওরা
নিজেদের রা-এর সন্তান বলে দাবি করত।
মায়াদেরও
দেবতাদের কথা আমরা
জানতে পারছি। অর্থাৎ মায়াদেরও দেবতা-ধারণা আছে। হুনাহপু এবং এক্সবালেংখুয় হল
মায়াদের দেবতা। এই যমজ দেবতার কাহিনি মায়া পুরাণের সবচেয়ে
রোমাঞ্চকর অধ্যায়। এই কাহিনি যে কয়টি এপর্যন্ত
জীবিত মায়া পুরাণ টিকে আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এরা সম্পর্কে দুই ভাই। মায়ার নরকের
দেবতা হলেন এক্সিবালবা।
এক্সিবালবা অত্যন্ত বদরাগী এবং নিষ্ঠুর চরিত্রের দেবতা ছিলেন। মায়ারা বিশ্বাস করতেন
এক্সিবালেংখুয়ে এবং হুনাহপু ছিলেন যথাক্রমে পৃথিবীর শাসক এবং আকাশের দেবতা। পরে অবশ্য
দুজনেই চন্দ্রদেব এবং সূর্যদেবে রূপান্তরিত হন। মায়ারা বিশ্বাস করত মায়া-সম্রাট আসলে হয়
এক্সিবালেংখুয়ে, নয় হুনাহপু দেবের পুত্র।
তবে
সনাতনী দেবতারা মানুষের রূপধারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষই দেবতায়
উন্নীত হয়েছে সনাতন ধর্মে। আজও মানুষ দেবতায় উন্নীত হয় – ভগবান রজনীশ, ভগবান চন্দ্রস্বামী, ভগবান সাঁইবাবা, ভগবান
আশারাম, ভগবান সারথীবাবা
ইত্যাদি !!! ভগবান মনু রাজাদেরও দেবতা বা দেবতারূপী বলেছেন। বস্তুত প্রাচীন যুগে
রাজা বা শাসকরাই ছিলেন স্বঘোষিত ভগবান। এঁরা পুজো পান। মনুর বলছেন রাজা কে ? রাজশূন্য এই জগতকে রক্ষার জন্য ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য,
অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র
এবং কুবের – এই দেবতার সারভূত অংশ নিয়ে
পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার
সৃষ্টি হয়েছিল সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন।(অরাজকে হি লোকেঽস্মিন্ সর্বতো
বিদ্রুতে ভয়াৎ।/রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ
প্রভুঃ।।/ইন্দ্রানিলযমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ।/চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা
নির্হৃত্য শাশ্বতীঃ।।/যস্মাদেষাং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো
নৃপঃ।/তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা”।।(মনুসংহিতা, সপ্তম অধ্যায়, শ্লোক
৩-৪-৫) রাজা কী ? মনু বলছেন – (১) তিনি সূর্যের মতো চোখ ও মন সন্তপ্ত
করেন। পৃথিবীতে কেউ তাঁকে মুখোমুখি অবলোকন করতে পারে না। (২) বালক হলেও
রাজাকে মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা। (৩)
অতি নিকটে গেলে আগুন একমাত্র সেটাই দগ্ধ করে, কিন্তু রাজারূপ আগুন বংশ-পশু-সম্পত্তি সহ দগ্ধ করে। (৪) রাজার অনুগ্রহে বিশাল
সম্পত্তি লাভ হয়, যাঁর বীরত্বে জয়লাভ
হয়, যাঁর ক্রোধে মৃত্যু বাস করে,
তিনি প্রকৃতই সর্বতেজোময়। ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রাচীন
গ্রিস থেকে শুরু করে হিন্দু ধর্ম, ইসলাম
এবং খ্রিস্টান ধর্ম, চিনা এবং জাপানি
ধর্মগুরুরা, ইনকা এবং মায়ান
সভ্যতার মানুষগুলি সবাই নিজেদের মতো করে মানুষ এবং বিশ্বসৃষ্টির ব্যাখ্যা
দিয়ে এসেছে। এখনও আফ্রিকা কিংবা আমাজনের জঙ্গলে বিভিন্ন গোত্র পাওয়া যাবে যারা বিভিন্ন গাছপালা
কিংবা চাঁদ ও সূর্যকে
তাদের ঈশ্বর বলে মনে করে এবং তারা তাদের এই বিশ্বাসের জন্যে জীবন দিতেও প্রস্তুত!
ঈশ্বর
আছে কী নেই –- তা একটি জিজ্ঞাসায়
গিয়ে থমকে গেছে।
তিনি আস্তিক হন কিংবা নাস্তিক – জিজ্ঞাসা
করবেন, “ আমি সৃষ্টি হলাম কীভাবে ? বিশ্ব সৃষ্টি হল কীভাবে ? ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হল কীভাবে?” অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন। এই প্রশ্নের
উত্তর পেলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে যাবে ! সনাতন ধর্মে বেদ,
উপনিষদ্, মনুসংহিতা, পুরাণ
ইত্যাদি পবিত্র গ্রন্থগুলিতে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত
বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সনাতন ধর্মের যে এক
ও অদ্বিতীয় সত্তা, তার নাম হলে ব্রহ্ম। ঈশ উপনিষদের
ব্রহ্মের প্রকৃতি হিসাবে বলা হয়েছে -- “ওঁ
পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং
পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।/ পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।” অর্থাৎ -- ওটি (পরব্রহ্ম) পূর্ণ,
এটি (নামরূপে স্থিত ব্রহ্ম) পূর্ণ;
এই সকল সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থ পরিপূর্ণ
ব্রহ্ম থেকে উদগত বা অভিব্যক্ত হয়েছে। আর সেই পূর্ণস্বভাব ব্রহ্ম থেকে পূর্ণত্ব
গ্রহণ করলেও পূর্ণই
অর্থাৎ পরব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকেন। ত্রিবিধ বিঘ্নের (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক। (ঈশ উপনিষদ/শান্তিপাঠ।) উপনিষদে বর্ণিত
ব্রহ্ম অদ্বিতীয়
সত্তা। ইনি সূক্ষ্ম ও স্থূল সকল কিছূরই উত্স। এই উত্স থেকে জগতের বিভিন্ন উপকরণের
সৃষ্টি হয়। এর সমর্থন পাওয়া যায় অন্যান্য সনাতন ধর্মগ্রন্থেও। যেমন মার্কণ্ডেয় পুরাণে
বলছে -- যা অব্যক্ত এবং ঋষিরা যাকে প্রকৃতি বলে থাকেন, যা ক্ষয় বা জীর্ণ হয় না, রূপ রস গন্ধ শব্দ ও স্পর্শহীন, যার আদি অন্ত নেই, যেখান থেকে জগতের উদ্ভব হয়েছে, যা চিরকাল আছে এবং যার বিনাশ নেই, যার স্বরূপ জানা যায় না, সেই ব্রহ্ম সবার আগে বিরাজমান থাকেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে,
সৃষ্টির আদিতে পরমব্রহ্ম বিরাজ করেন।
এবং সেই পরমব্রহ্ম থেকেই জগতের সব কিছু সৃষ্টি হয়।
সৃষ্টি
প্রক্রিয়ার স্তরগুলি সম্পর্কে মার্কেণ্ডয় পুরাণে যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা হল -- সত্ত্ব (প্রকৃতি) রজ (যার প্রভাবে অহংকারসহ
অন্যান্য মন্দগুণের জন্ম হয়) ও তম (অন্ধকার)
এই তিন গুণ তাঁর মধ্যে পরস্পরের অনুকূলে ও অব্যাঘাতে অধিষ্ঠিত আছে। সৃষ্টির সময়ে
তিনি (ব্রহ্ম) এই গুণের সাহায্যে সৃষ্টিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হলে প্রধান তত্ত্ব প্রাদুর্ভূত হয়ে
মহত্তত্ত্বকে (মহৎ নামক তত্ত্ব) আবৃত করে। এই মহত্তত্ত্ব তিনগুণের ভেদে তিন
প্রকার। এর থেকে তিন প্রকার ত্রিবিধ অহংকার সৃষ্টি হয়। এই অহংকারও
মহত্তত্ত্বে আবৃত ও তার প্রভাবে বিকৃত হয়ে শব্দ-তন্মাত্রের সৃষ্টি করে। তা থেকেই
শব্দ লক্ষণ আকাশের জন্ম। অহংকার শব্দমাত্র আকাশকে আবৃত করে এবং তাতেই স্পর্শ-তন্মাত্রের জন্ম।
এতে বলবান বায়ু
প্রাদুর্ভূত হয়। স্পর্শই বায়ুর গুণ। শব্দমাত্র আকাশ যখন স্পর্শমাত্রকে আবৃত করে, তখন বায়ু বিকৃত হয়ে রূপমাত্রের সৃষ্টি
করে। বায়ু থেকে জ্যোতির উদ্ভব, রূপ
ওই জ্যোতির গুণ। স্পর্শমাত্র বায়ু যখন রূপমাত্রকে আবৃত করে, তখন জ্যোতি বিকৃত হয়ে রসমাত্রের সৃষ্টি
করে। তাতেই রসাত্মক জলের উদ্ভব। সেই রসাত্মক জল যখন রূপমাত্রকে আবৃত করে, তখন জল বিকৃত হয়ে গন্ধমাত্রের সৃষ্টি করে। তাতেই
পৃথিবীর জন্ম হয়।
পুরাণের
বিবৃত থেকে বোঝা যায় ব্রহ্মা প্রকৃতিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করে পৃথিবী
সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই বর্ণনা আমাদের কাছে সুষ্পষ্ট বর্ণনার পরিবর্তে এক
দুর্বোধ্য কল্পনাকে
জাগ্রত করে। আবার বিভিন্ন পণ্ডিতরা যখন এর ব্যাখ্যা নিজেদের মতো করে করতে থাকেন,
তখন তা বিভিন্ন অর্থে প্রতীয়মান হতে
থাকে। মহাভারতের আদিপর্বের সৃষ্টিবর্ণন অংশে সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে যে ধারণা পাই তা
কিছুটা আধুনিক
বিজ্ঞানের সমার্থক বলেই বোধ হয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে, আদিতে বস্তুপুঞ্জ একত্রিত হয়ে একটি পিণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। উক্ত
পিণ্ডের বিস্ফোরণের
মধ্য দিয়ে বর্তমান মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। তবে মহাভারতে এর সঙ্গে ঐশ্বরিক সত্তার
মহিমা যুক্ত করার কারণে এই বর্ণনা ভিন্ন মাত্রায় রূপ পরিগ্রহ করেছে।
সৃষ্টিতত্ত্ব
নিয়ে বেদের বিখ্যাত নাসাদীয় সুক্ত এবং হিরণ্যগর্ভ সুক্তের কথা অনেকেই
জানেন। ধর্ম বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী মহলে বহুল আলোচিত এই দুটি সুক্তের আলোকে
সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক -- "নাসাদাসিস নঃ সদাসিত্ তদানীম নাসিদ রজ ন ব্যামাপ্রো
যৎ..."(ঋগবেদ ১০/১২৯/১)। অর্থাৎ শুরুতে কোনো অস্তিত্ব(সৎ) বা অনস্তিত্ব(অসৎ)
ছিল না। সেখানে
ছিল না কোনো বায়ুমন্ডল। "তম অসিৎ তমস... তপসস্তন্মহিনাজায়াতৈকম”(ঋগবেদ ১০/১২৯/৩)।অর্থাৎ চারদিক ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।
সমস্ত জিনিস একত্রে পুঞ্জীভুত ছিল। সেখান থেকে প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি হল। "হিরণ্যগর্ভ
সামাভরতাগ্রে.."(ঋগবেদ ১০/১২১/১)।অর্থাৎ প্রথমেই হিরণ্যগর্ভ সৃষ্টি হল।"আপ
হ য়দ বৃহাতিরিবিশ্বমায়ান গর্ভম..."(ঋগবেদ ১০/১২১/৭)। অর্থাৎ সেই হিরণ্যগর্ভে ছিল
উত্তপ্ত তরল, যাতে ছিল সৃষ্টির সমস্ত
বীজ। "হিরণ্যগর্ভানি অপঃ তে সলিলা..." (শতপথ ব্রাক্ষ্মণ ১১/১/৬/১)। অর্থাৎ
প্রথমে হিরণ্যগর্ভ সৃষ্টিহল। সেখানেছিল উত্তপ্ত গলিত তরল। এটি ছিল মহাশুন্যে ভাসমান। বছরের
পর বছর এই অবস্থায় অতিক্রান্ত হয়।"তারপর যেখানে বিস্ফোরণ ঘটল গলিত পদার্থ থেকে,
বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু
হল" (ঋগবেদ ১০/৭২/২)। "সেই বিস্ফোরিত অংশসমূহ থেকে বিভিন্ন গ্রহ,নক্ষত্র তৈরী হল"(ঋগবেদ ১০/৭২/৩)।
"তার এক জীবনপ্রদ অংশ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হল"(ঋগবেদ ১০/৭২/৪)। "তারপর সৃষ্ট
ক্ষেত্রে সাতধাপে সংকোচন-প্রসারণ সম্পন্ন হল। তারপর সৃষ্টি হল ভারসাম্যের।"(ঋগবেদ ১০/৭২/৮-৯)
মোট
কথা সনাতন ধর্মগ্রন্থগুলিতে সৃষ্টিতত্ত্বের রূপ মোটামুটি যেভাবেই বিবৃত হয়েছে, তার একটি রূপরেখা আঁকার চেষ্টা করলাম।
এইসব বর্ণনা অনুসারে যে সারকথা পাওয়া যায় তা হল- আদিতে ব্রহ্ম নামক পরম সত্তা ছিল। সেই
সত্তা প্রকৃতিকে
একটি বিশাল অণ্ডে রূপান্তরিত করলেন। উক্ত অণ্ড থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বচরাচর
এবং দেবতাসহ অন্যান্য সকল প্রাণী। লক্ষণীয় বিষয় হল -- সৃষ্টির আদিতে যে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি
হয়েছিল, তাকে সমর্থন করা
গেলেও পৃথিবী সৃষ্টির
আগে জলের অস্তিত্বের কথা বলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। যদি
হিন্দুদর্শন আরও সুবিস্তৃত। তারপরেও বলা
যায় গ্রিক পুরাণের সঙ্গে হিন্দুদর্শনের মূল কথা প্রায় একই রকম।
আদি
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে- ক্যায়োস স্বয়ম্ভু হিসাবে বিবেচনা হয়েছে। আর ইউরোনোমে সৃষ্টি
হয়েছিল সেই স্বয়ম্ভু
ক্যায়োস থেকে। কিন্তু ইউরিনোমের ছিলেন সর্বত্র । রূপকতার আড়াল থেকে ইউরোনামকে বের
করে আনলে- সুবিস্তৃত বস্তুরাশির কথাই মনে হয়। সে কারণেই আকাশ ও পৃথিবীকে একত্রিত
অবস্থানে ছিল। ইউরোনাম আকাশকে সাগর থেকে পৃথক করলেন। এই ধারণা বিজ্ঞানের সাথে
মেলে না। কিন্তু ইউরিনোমের নৃত্যকে বস্তুপুঞ্জের অস্থিরতা ধরা যেতে পারে।
সেই অস্থিরতা থেকে বস্তু যখন আন্তঃআর্কষণে কেন্দ্রীভূত হতে থাকলো- তখন ঘূর্ণায়মান গতির
সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তৈরি হয়েছিল বিশালকারে গতিময় কুণ্ডলিত অবয়ব। যাকে হয়তো
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে অফিয়ন নামক একটি বিরাট সাপের কুণ্ডল হিসাবে কল্পনা
করা হয়েছে। উভয়ের
মিলনে যে অণ্ডের সৃষ্টি হয়- তাই ছিল বিগব্যাং-এর পূর্ববর্তী সুপার এটম। গ্রিক পুরাণের
সেই আদি অণ্ড ফেটে গিয়ে মহাকাশ ও এর অন্যান্য উপকরণ (সূর্য, চন্দ্র,
নক্ষত্র ইত্যাদি) তৈরি হয়েছিল।
কোরান
মতে মূলত আল্লাহর
স্বরূপ, আল্লাহর প্রতি
মানুষের আনুগত্য, সহজ ও সরল পথ অনুসরণে মানুষের জীবন-যাপনের
ধারা ইত্যাদি সম্পর্কিত নির্দেশাবলি কোরানের বিষয়। তাত্ক্ষণিকভাবে উক্ত প্রেরিত বাণী ছিল
তত্কালীন আরববাসীদের জন্য। কিন্তু এই বাণী এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল যাতে
করে আগামীদিনের সকল ভূখণ্ডের মানুষও দিক নির্দেশনা পেতে পারে। এই নির্দেশনার
অনুসঙ্গ বা উদাহরণ হিসাবে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সহায়ক তথ্যাবলি। এই তথ্যাবলির ভিতর আছে
পূর্ববর্তী বিভিন্ন নবিদের কার্যকলাপ, প্রাচীন
ইতিহাস, প্রকৃতি, মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাবলি,
মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতিসহ আরও বিবিধ
প্রাসঙ্গিক বিষয়।
বিষয়াবলি এইভাবে উপস্থাপনের কারণে কোরানের অনেক জায়গাতেই একই উদাহরণ বারবার এসেছে। উদাহরণ
প্রয়োগে বা মূল নির্দেশনামাটি কোনো ক্ষেত্রে বিস্তৃতভাবে এসেছে। আবার কোনো-কোনো ক্ষেত্রে
অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে এসেছে। সেই কারণে পুরো কোরান পাঠ না করে এর অংশ বিশেষের
নির্দেশ মেনে কোনো
বিষয়ের মীমাংসা করাটা অত্যন্ত অবিবেচকের কাজ হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বিভিন্ন দেশের তথাকথিত ফতোয়াবাজরা এই
কাজটি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকেন। কোরানে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির ক্ষেত্রেও
তথ্যাবলি পাওয়া যায় সহায়ক উপকরণ হিসাবে। যেহেতু এই সহায়ক বাণীগুলি বিভিন্ন
প্রসঙ্গে বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত আকারে এসেছে, তাই কোনো বিশেষ সুরার বিশেষ আয়াতকে উপস্থাপন করে বিষয়টি বুঝতে
গেলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। যেমন কোরানে মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও পৃথিবী সৃষ্টি প্রসঙ্গে দুই
দিন বা ছয় দিনের কথা বলা হয়েছে। কোরানের সমগ্র পাঠ উপলব্ধি না করলে বিষয়টি অবশ্যই বিভ্রান্তির
সৃষ্টি করতে পারে।
এবার দেখি কোরানের দৃষ্টিতে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে আলোকপাত যায় কি না।
নিশ্চয়ই
তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। (সুরা
আরফ/আয়াত ৫৪) এখান সমগ্র বিশ্বচরাচর ছয় দিনে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এই হিসাবটি
খ্রিস্টধর্মের পবিত্র
ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু এই আয়াতে ছয় দিনের সৃষ্টিকে দুটি ভাগে
ভাগ করেছে। একটি ভাগ নভোমণ্ডল, অর্থাৎ
মহাকাশ ও এর সমস্ত
উপকরণ (গ্যালাক্সি ও মহাকাশীয় অন্যান্য উপকরণ)। দ্বিতীয় ভাগে সৃষ্টি করছেন ভূমণ্ডল,
অর্থাৎ পৃথিবী।
এখানে অধিকাংশ অনুবাদক ‘দিন’(Day ?) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেই কারণে আমি দিনই ব্যবহার করেছি। কিন্তু
প্রকৃতপক্ষে এই “দিন” বলতে কী বোঝানো হয়েছে সেটিও গবেষণার
বিষয় হতে পারে। এখানে পার্থিব দিনের হিসাব গ্রহণ করা যাবে না। কারণ সৃষ্টির আদিতে যখন পৃথিবী,
সূর্য ইত্যাদি তৈরি হয়নি তখন পার্থিব দিনের
বিষয়টি আসতে পারে না। আরবি ‘ইয়াওম’
শব্দের অর্থ দিন। কিন্তু উক্ত আয়াতে
ব্যবহার করা হয়েছে ‘আইয়াম’। উল্লেখ্য,
‘আইয়াম’ হল ‘ইয়াওম’
শব্দের বহুবচন, অর্থাৎ দিবসসমূহ। এখানে আক্ষরিক দিবসসমূহ অর্থ গ্রহণ
না-করে এর অর্থ গ্রহণ করা উচিৎ কাল, পর্যায়,
যুগ ইত্যাদি অর্থে। সে হিসাবে এই আয়াতের
অনুবাদ হওয়া উচিত ....তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় কালে (পর্যায়ে বা যুগে)
সৃষ্টি করেছেন।
কোরানে
বর্ণিত এই
ছয় মহাকালের মধ্যে আল্লাহ কোন্ পর্যায় কী তৈরি করেছেন, তা পাওয়া যায় সুরা হা-মিম সিজদাতে। “বলো, তোমরা কি সে সত্তাকে অস্বীকার করো যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন
দুইদিনে এবং তোমরা কি তার সমকক্ষ স্থির করো ? তিনি তো সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা।” (সুরা হা-মিম সিজদা/ আয়াত ৯) “তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগ অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন,
তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চারদিনের মধ্যে তাতে
তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন, পূর্ণ
হল জিজ্ঞাসুদের জন্য।” (সুরা
হা-মিম সিজদা/ আয়াত ১০) “অতঃপর
তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রপুঞ্জ......” (সুরা হা-মিম সিজদা/ আয়াত ১১) ইত্যাদি।
সুরা আরফের ৫৪ আয়াতে ছয়টি পর্যায়ে
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এখানেই সমগ্র ছয়টি
পর্যায়কে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি হল নভোমণ্ডল সৃষ্টিকাল, অপরটি ভূমণ্ডল সৃষ্টিকাল। এই দুটি
পর্যায়ের প্রথমেই
নভোমণ্ডল তৈরি করার সময়ই পৃথিবী তৈরি হয়ে গেছে। বিশ্বচরাচরের প্রাথমিক বিন্যাসে
আল্লাহ মাত্র দুটি সময়-পর্যায় ব্যয় করেছেন। ফলে ছয়টি পর্যায়ের মধ্যে চারটি পর্যায় অবশিষ্ট
থেকে যায়। এই কারণে সুরা হা-মিম সিজদা ৯ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুইদিনে।
বাকি চারটি পর্যায়ে
আল্লাহ ভূমণ্ডল তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন। ফলে পৃথিবীর উপরিভাগে পাহাড় পর্বত স্থাপন
করছেন। সুরা হা-মিম সিজদা ১০ আয়াতে যেভাবে তার উল্লেখ পাওয়া যায় -- তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগ অটল
পর্বতমালা স্থাপন করেছেন। এর সঙ্গে উক্ত আয়াত থেকেই জানা যায় যে আল্লাহ
খাদ্যের উপযোগী পরিবেশ ও উপকরণ সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ নদী, সাগর, প্রাণধারণের
উপযোগী বায়ুমণ্ডল, গাছপালা
ও অন্যান্য
প্রাণী তৈরির বিষয়টিও এই সময়ে সম্পন্ন হয়েছিল।
কোরান মতে, মহাকাশের পরিবর্তনের সূচনা করলেন আল্লাহ।
আল্লাহ ধুম্রপুঞ্জের দিকে নজর দিলেন। অর্থাৎ ধুম্রপুঞ্জকে বিভিন্ন মহাকাশীয় বিষয়েবস্তুতে
পরিণত করলেন।
সৃষ্টির এই পর্যায়ে যখন আকাশমণ্ডলের দিকে আল্লাহ নজর দিলেন, তখন মহাকাশকে সম্প্রাসরণ ও পৃথিবীকে বিস্তৃত
করেছেন। সুরা
আন-নাজিয়াতে যেভাবে বিয়টিকে যেভাবে বলা হয়েছে -- “তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন না আকাশের, যা তিনি নির্মাণ করেছেন?” (সুরা আন-নাজিয়াত/ আয়াত ২৭) “তিনি একে উচ্চ করেছেন ও সুবিন্যস্ত করেছেন।”
(সুরা আন-নাজিয়াত/ আয়াত ২৮) “তিনি রাত্রিকে করেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং
এর সূর্যালোক প্রকাশ করেছেন।” (সুরা
আন-নাজিয়াত/ আয়াত ২৯) “পৃথিবীকে
এর পরে বিস্তৃত করেছেন।”(সুরা
আন-নাজিয়াত/ আয়াত ২৩)
সৃষ্টিতত্ত্ব
বিষয়ে বাইবেলের ওল্ড টেস্টমেন্টের আদিপুস্তকের অধ্যায় শুরু হয়েছে জগত্সৃষ্টির
বিবরণের মাধ্যমে। আমি যে বাইবেলটি হাতে পেয়েছি, সেটি অত্যন্ত ‘কাষ্ঠংবৎ’
বাংলায় ছাপা হয়েছে। চেষ্টা করব যাতে ‘জলবৎ’ বাংলায় প্রকাশ করা যায়। “আদিতে
ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন।” (১) “পৃথিবী
ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার সমুদ্রের
উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর
অবস্থিতি” (২) “করছিলেন। পরে ঈশ্বর বললেন, দীপ্তি হোক, তাতে দীপ্তি হল।” (৩)
“তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখলেন, এবং ঈশ্বর অন্ধকার থেকে দীপ্তি পৃথক”
(৪) “করলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখলেন। আর
সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হলে প্রথম দিন হল।”(৫) “পরে
ঈশ্বর বললেন,
জলের মধ্যে চাঁদোয়া হোক, এবং জলকে দুই ভাগে” (৬) “পৃথক করুক। ঈশ্বর এইভাবে বিতান করে বিতানের উর্ধ্বস্থিত
জল থেকে চাঁদোয়ায় অধঃস্থিত জল পৃথক করলেন।” (৭) “তাতে
সেরকম হল। পরে ঈশ্বর চাঁদোয়ার নাম আকাশমণ্ডল রাখলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হলে দ্বিতীয় দিন
হল।”(৮) “পরে ঈশ্বর বললেন, আকাশমণ্ডলের নীচস্থ সমস্ত জল একস্থানে
সংগৃহীত হোক ও স্থল সপ্রকাশ হোক, তাতে”
(৯) “সেরকম হল। তখন ঈশ্বর স্থলের নাম ভূমি, ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখলেন; আর ঈশ্বর দেখলেন যে,” (১০) “তা উত্তম। পরে ঈশ্বর বললেন, ভূমি, তৃণ,
বীজোত্পাদক ওষধি ও সবীজ স্ব স্ব জাতি
অনুযায়ী ফলের উত্পাদক ফলবৃক্ষ, ভূমির
উপরে উত্পন্ন করুক;” (১১)
“তাতে সেইরকম হল। ফলত ভূমি, তৃণ, স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বীজোত্পাদক ওষধি এবং স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সবীজ
ফলের উত্পাদক বৃক্ষ,
উত্পন্ন করল; আর ঈশ্বর দেখলেন যে, সে সবই” (১২)
“উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হলে
তৃতীয় দিন হল।” (১৩) “পরে ঈশ্বর বললেন, রাত্রি থেকে দিনকে বিভিন্ন করণার্থে
আকাশমণ্ডলের চাঁদোয়ায় জ্যোতিষ্কগণ হোক; সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর
জন্য এবং দিনের ও” (১৪)
“বছরের জন্য হোক; এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দেওয়ার জন্য দীপ বলে
আকাশ-মণ্ডলের চাঁদোয়া থাকুক; তাতে
সেই” (১৫) “রকম হল। ফলত ঈশ্বর দিনের উপর কর্তৃত্ব
করতে এক মহাজ্যোতিঃ, ও
রাত্রির উপরে
কর্তৃত্ব করতে তদপেক্ষা এক জ্যোতিঃ, এই
দুই বৃহৎ জ্যোতিঃ, এবং নক্ষত্রসমূহ নির্মাণ
করলেন।” (১৬) “আর পৃথিবীতে দীপ্ত দেওয়ার জন্য, এবং দিন ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব” (১৭) “করণার্থে, এবং
দীপ্তি থেকে অন্ধকার বিভিন্ন করণার্থে ঈশ্বর ওই জ্যোতিঃসমূহকে আকাশমণ্ডলের
চাঁদোয়ায় স্থাপন করলেন, এবং
ঈশ্বর দেখলেন যে, সে” (১৮) “সবই উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হলে চতুর্থ দিন হল” (১৯) “পরে ঈশ্বর বললেন, জল
নানা জাতীয় জঙ্গম প্রাণীবর্গে প্রাণীময় হোক, এবং ভূমির উর্ধ্বে আকাশমণ্ডলের চাঁদোয়ায়” (২০) “পক্ষীগণ উড়ুক। তখন ঈশ্বর বৃহৎ তিমিদের, ও যে নানা জাতীয় জঙ্গম প্রাণীবর্গে জল প্রাণীময় আছে,
সে সকলের, এবং নানা জাতীয় পক্ষীর সৃষ্টি করলেন। পরে ঈশ্বর দেখলেন যে,”(২১) ইত্যাদি।
যদি ধরেও নেওয়া যায় যে ভগবান খুব কর্মঠ এবং সাত দিনে উনি বিশ্ব তৈরি করেছেন – তাহলে কেউ বলতে পারেন এই বিশ্ব তৈরি করার আগে পর্যন্ত উনি কি করছিলেন ? “বিশ্ব”
ব্যাপারটা কী? মানে Universe-এর ধারণাটা (concept)
কী, কাকেই-বা “বিশ্ব” বলে চিহ্নিত করছেন ? ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের কত অমিল ! তা ছাড়া উনি যদি বিশ্ব সৃষ্টি বা নির্মাণ করেই থাকেন, তবে সেই নির্মাণকার্যের মাল-মেটিরিয়ালস কোথা থেকে জোগাড় করলেন ? উনি তাহলে এই বিশ্বের বাইরে কোথায় থাকেন, যেখানে ওনার resources
আছে ?
“ঈশ্বর” বলতে কী ভাবতে হবে বা কী ভাবা উচিত ? এই গ্যালাক্সি কি শেষ, নাকি এরপরেও আরও কিছু আছে? Linear Time বা বহমান কালকে কে দিন-ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ডকে ভাগ করলেন ? ভগবান ? এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে গ্যালাক্সি তৈরি করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তাহলে এই বহমান কালকে কে ভাগ করেছিলেন ?
আজ পর্যন্ত কোনো দার্শনিক ভগবান কী বা কে বলেননি বা বলতে পারেননি। কোনো গণিতজ্ঞ ও অঙ্ক কষে ভগবানের প্রমাণ দিতে পারেননি।
বিশ্বখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর “The Grand Design”, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর মাধ্যমে শূন্য থেকে বস্তু তৈরি হতে পারে যার শক্তি হচ্ছে পজেটিভ। সেই পজেটিভ শক্তিকে ব্যলান্স করার জন্যে (শক্তির নিত্যতার সূত্রঃ শক্তির কোনো সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য) আছে মহাকর্ষ বল যেটি স্থান এবং সময়ের একটা বৈশিষ্ট্য মাত্র। মহাকর্ষের নেগেটিভ শক্তি বস্তুর পজেটিভ শক্তিকে ক্যান্সেল করে দিয়ে শক্তির নিত্যতা বজায় রাখে। মহাবিশ্বের এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া স্বতস্ফুর্ত, কোনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ছাড়াই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে। অতএব, শূন্য থেকে ইচ্ছা মতো মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে, কোনো ঈশ্বরের দরকার নাই সে জন্যে! হকিং এর মতে ঈশ্বরকে দিয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি করানো মানে প্রশ্নটাকে এক ডিগ্রী উপরে উঠিয়ে দেওয়া, মহাবিশ্ব কে সৃষ্টি করেছেন সেটি প্রশ্ন না করে এখন প্রশ্ন করা হবে ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন। তবে সাধারণত ফার্স্ট-কজ আরগুমেন্ট নামে একটি যুক্তি – ঈশ্বর সবসময়ই ছিলো এবং থাকবে, তাকে সৃষ্টি করার প্রয়োজন পড়ে না – একটি যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। হকিং বলছেন, ঈশ্বরকে না এনে কিভাবে বিশ্ব সৃষ্টি ব্যাখ্যা করা যায় সেটাই তাদের এই বই এর উদ্দেশ্য।
বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে হকিং এবং মেলাডনো বেশ কয়েকটি অধ্যায় ব্যয় করেছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং কজমোলজির বিভিন্ন বিষয়গুলি বুঝানোর জন্যে। একেবারে শেষ অধ্যায়ে (যেটির নাম বইয়ের নামে – দি গ্র্যান্ড ডিজাইন) একটা ছোট গেইম এর মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছেন কিভাবে কিছু সাধামাটা নিয়ম এবং সূত্র থেকে অনেক জটিল বস্তু তৈরি হতে পারে। এর উদ্দেশ্য ছিলো এটা বুঝানো যে কয়েকটি সাধারণ তত্ত্ব/সূত্র থেকে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে এবং সেখান থেকে মানুষের মতো জটিল জীবের আবির্ভাব হতে পারে যারা এধরণের জটিল প্রশ্ন করতে পারে – আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী?
হকিং বলেছেন শূন্য থেকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে বস্তু তৈরি হবার কথা এবং মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে সেই বস্তুর পজেটিভ শক্তিকে নিউট্রালাইজ করার কথা। এখানে দুটো জিনিস হকিং পরিষ্কার করে বলেননি। ক) শূন্য বলতে কি হকিং একেবারে শূন্য (nothing) বুঝিয়েছেন নাকি কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়াম (বস্তুর অনুপস্থিতি) বুঝিয়েছেন সেটি পরিষ্কার করে বলা হয়নি, খ) সৃষ্টির শুরুতে সময় স্থান এর মতো আচরণ করলেও পরবর্তীতে কিভাবে এবং কেনো সময় “সময়” এর মতো আচরণ শুরু করলো সে ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি বইটিতে। মহাকর্ষ বল ছাড়া মহাবিশ্ব সৃষ্ট হতো না, কিন্তু মহাকর্ষ বল এর সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে সেটা নিয়ে হকিং কিছু বলেননি। শূন্য থেকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের এর মাধ্যমে বস্তুর (শক্তির) সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু সেই বস্তুর মহাকর্ষ বল এর বৈশিষ্ট্য থাকবে অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য থাকবেনা কেনো? বইটি প্রকাশ হওয়ার পর সিএনএন এর ল্যারি কিং স্টিফেন হকিং এর একটি সাক্ষাতকার নেয়। সেখানে তাকে ল্যারি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন – “আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন”? “ঈশ্বর থাকতে পারেন, তবে বিশ্বসৃষ্টি ব্যাখ্যা করার জন্যে আমাদের তাঁকে প্রয়োজন নাই” – এটা ছিলো হকিং এর উত্তর।
এখানে উল্লেখ্য ধর্মীয় মতাদর্শগুলি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছে মাত্র। এই ইঙ্গিতকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিতে হবে, এমন কঠোর নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে। এই নির্দেশ মানতে গিয়ে সত্য রক্ষিত হবে কি না তা বিবেচ্য নয়। যে ক্ষেত্রে ধর্মীয় এই বিশ্বাসের সঙ্গে সত্যানুসন্ধানের ঐক্য হবে, সেখানে ধর্মবাদীরা ধর্মের সত্যনিষ্ঠ শক্তির কথা সগৌরবে প্রচার করেন। কিন্তু যেখানে এই সত্য লঙ্ঘিত হয়, সেখানেই সৃষ্টি হয় সত্যের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের সংঘাত। যেমন, খ্রিস্টান এবং পুরোহিতদের সঙ্গে গ্যালিলিওর মতবাদের সংঘাত। মূলত ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে বিজ্ঞানের আলোকময় পথে। এখন প্রশ্ন হল -- বিজ্ঞান কি সর্বদা অভ্রান্ত ?
না, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে চলে, ত্রুটি সংশোধনের ক্রমধারার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ধর্মীয় বয়ানকে গোড়া থেকে অভ্রান্ত ও চিরন্তন হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। এর কোনো অংশ সংশোধন করতে গেলেই ধর্মের এই চির সত্যের প্রাসাদ ভেঙে পড়ে। তাই বিজ্ঞানীরা যেখানে প্রতিনয়ত নিষ্ঠার সঙ্গে সত্যের কাছে পৌঁছোনোর জন্য নিজেদের সত্যকেই অগ্রাহ্য করে নতুন সত্যকে উপস্থাপন করে। সেখানে ধর্মীয় পুরোহিতরা মিথ্যা জেনেও পুরোনো ধারণাকে নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষা করেন।
প্রাচীনকালে রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক মতবাদ বহুল প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টাইন,
সেন্ট পল, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের লেখনীতে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐশ্বরিক মতবাদের মূল বক্তব্য ছিল – (১) রাষ্ট্র ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির পিছনে মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। (২) রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা রাজার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। সেইজন্য রাজার আদেশ বা নির্দেশ, যা আইনরূপে গণ্য হয়ে থাকে, তা মান্য করা সকল মানুষের একান্ত কর্তব্য। রাজার আইন মান্য না-করার অর্থ হল ঈশ্বরকে অবমাননা করা। (৩) ঈশ্বরের বিধান অনুসারে রাজপদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা যায়। রাজার মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা হবেন। (৪) রাজা যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিনিধি সেইহেতু তিনি কখনোই অন্যায় করতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া তিনি আর কারও কাছে তাঁর কাজের জন্য জবাব দিতে বাধ্য নন। (৫) ঈশ্বরের প্রতিনিধি এই রাজার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ করা যায় না। এই ধারণা বা তত্ত্ব শুধু ভারতবর্ষের হিন্দুধর্মেই নয় – এই তত্ত্ব মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি সব ধর্মেই প্রচার করা হয়েছে। প্রাচীন যুগে কোনো-কোনো রাজাকে ভক্তি-শ্রদ্ধায় পুজো করত,আবার কোনো-কোনো শাসক বা রাজা ভয় দেখিয়ে অত্যাচার-সন্ত্রাস করে পুজো আদায় করত।
শুধু মানুষই নয় – গাছগাছালি,
প্রাণীদের উপরও দেবত্ব আরোপ হয়েছে। পুজোও হয়। আছে লৌকিক বা আঞ্চলিক দেবতা, যাঁদের আখ্যান পুরাণ বা কোনো ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়নি। সনাতন ধর্মে পশু-প্রাণীর পুজো করা নতুন কিছু নয়। তবে দেবতাদের বাহন হিসাবেই পশু-পাখি পূজিত হয়। আবার কোথাও কোথাও সরাসরি প্রাণীকেও পুজো করা হয়। যেমন রাজস্থানের কারনি মাতা মন্দিরে পূজিত হয় ইঁদুর। গণেশ ঠাকুরের বাহন হিসাবে ইঁদুর পূজিত হয় হয়তো। কিন্তু কুকুর, এই প্রাণী আবার কার বাহন বা কার কী ? তবে ছোটোবেলায় ক্যালেন্ডারে ব্রহ্মার ছবিতে কুকুর দেখেছি। তাহলে কি কুকুর ব্রহ্মার বাহন ? ভারতের অঙ্গরাজ্য কর্নাটকের রাজধানী ব্যাঙ্গালোর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে চন্নপত্তন এলাকার রামনগর জেলার এক ছোট্ট গ্রামে কুকুরকেই পুজো করা হয় । সেই গ্রামে কুকুরই দেবতা। আর সেই দেবতাকে পুজো করার জন্য বানানো হয়েছে মন্দিরও। জানা যায়, কুকুর মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু । তাই বিশ্বস্ত এই বন্ধুকে পুজো করে স্থানীয় বাসিন্দারা। সেইসঙ্গে তাদের বিশ্বাস‚ অপদেবতাদের ছায়াকে গ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখে কুকুরদেবতাই। তাই ভক্তিভরে কুকুরের মূর্তির কাছ থেকেই আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন সবাই।
প্রায়ই দেখা যায় আগে যেই দেবতাকে নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলের মানুষেরা পুজো করত, পরবর্তীতে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ ওই একই দেবতার পুজো করছে। আবার কোনো একটি পূজনীয় প্রাণী স্বকীয়তা হারিয়ে বড়ো কোনো দেবদেবীর সঙ্গে মিশে গেছে। আবার কোনো-কোনো পুজো বা উৎসব একেবারেই হারিয়ে গেছে, কোনোটি অন্য কোনো পুজো বা উৎসবের সঙ্গে মিশে নতুন রূপ পেয়েছে। দেখি, আরও কিছু লৌকিক দেবতাদের খোঁজ নেওয়া যাক ---
(১) গ্রামদেবতা : প্রাচীন বাংলার পাড়াগাঁয়ে অ-জনপ্রিয় কয়েকজন দেবদেবী ও অপদেবতা পুজোর জন্য বট, পাকুড় অথবা অন্য কোনো বড়ো আকারের গাছের নিচে ‘থান’ অথবা ‘স্থান’ নামে একটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিল। এই দেবদেবী ও অপদেবতা শুধুমাত্র ওই গ্রাম ও তার আশেপাশের এলাকাতেই পরিচিত ছিলেন। কোনো-কোনো দেবদেবীর ক্ষেত্রে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ভারতবর্ষের সব অঞ্চলে এইসব দেবদেবীগণ একই নামে পরিচিত ছিলেন না। যেমন বর্তমানকালে ‘কালী’ নামে পরিচিত দেবী কোথাও ভৈরবী, কোথাও চণ্ডী, কোথাও বনদুর্গা নামে পরিচিত। শুরুতে কিন্তু কালীও একজন গ্রামদেবী ছিলেন। প্রথম প্রথম গ্রামের ব্রাহ্মণদের লবি ওই দেবদেবীদের স্বীকৃতি দিতে আপত্তি জানালেও পরবর্তীতে তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় এইসব দেবদেবী ও অপদেবতাগণ মূল ধর্মে ঢুকে পড়ে। শীতলা, চণ্ডী, কালী, বনবিবি,
ষষ্ঠী, মনসা, শিব এইরকম কয়েকজন গ্রামদেবদেবী। বাংলাদেশের (ঢাকা) দোহার, নবাবগঞ্জ, ধামরাই সহ কিছু কিছু অঞ্চলে নিশকাইন্দা নামে গ্রাম-অপদেবতার পুজো হয়। আর সুন্দরবন অঞ্চলের দেবী বনবিবির কথা তো সবারই জান। বগুড়া অঞ্চলের সন্ন্যাসীর থান আছে।
(২) ধ্বজাপুজো : ‘ধ্বজা’
অর্থ পতাকা, নিশান। এখানে ‘ধ্বজা’ বলতে প্রাচীন বাঙলায় ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী বা কৌমের প্রতিনিধিত্বকারী ভিন্ন ভিন্ন পশুপাখি ও পৌরাণিক প্রাণী বোঝানো হয়েছে। কৌম ও গোষ্ঠীগুলিতে গরুড়ধ্বজা, মীনধ্বজা, ইন্দ্রধ্বজা, ময়ূরধ্বজা,
কপিধ্বজা, সিংহধ্বজা, হংসধ্বজা, নন্দীধ্বজা,
পেঁচকধ্বজা, মকরধ্বজা ইত্যাদি ধ্বজা পুজো প্রচলিত ছিল। মীন, গরুড়, ময়ূর, সিংহ, হাঁস, পেঁচা সেইসব কোম অথবা গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হত। আর গোষ্ঠী অথবা কৌমের যিনি নেতা তিনি হংসধ্বজ , মীনধ্বজ, পেঁচকধ্বজ, মকরধ্বজ, সিংহধ্বজ ইত্যাদি নামে পরিচিত হতেন। সময়ের পরিবর্তনে ধ্বজা পুজো হারিয়ে গেলেও ‘ধ্বজা’ হারিয়ে যায়নি। বরং মূল স্রোতে মিশে গিয়েছিল বিভিন্ন দেবদেবীর বাহন হিসেবে। যেমন গঙ্গার বাহন মকর, কার্তিকের বাহন ময়ূর, সরস্বতীর বাহন হাঁস, বিষ্ণুর বাহন গরুড়, শিবের বাহন নন্দী, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা ইত্যাদি। আলাদাভাবে আজও ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে ‘থান’-এর সঙ্গে ধ্বজা পুজোও হয়।
(৩) ব্রতোৎসব : প্রাচীন ও বর্তমান বাংলা এবং বিহার, ওডিশা, আসামের একটি বড়ো স্থান অধিকার করে আছে এই ব্রতোৎসব। আর্য-ব্রাহ্মণেরা যাঁদের ‘ব্রাত্য’ বলে গণ্য করতেন, তাদের নিজস্ব সেই উৎসবই ব্রতোৎসব। কেউ কেউ বলেন, ‘ব্রত’ শব্দটির অর্থ আবৃত করা, সীমা টেনে পৃথক করা। ব্রতোৎসবের অন্তর্গত উৎসব বা অনুষ্ঠানগুলি জাদুশক্তির বিশ্বাস প্রচ্ছন্ন, বিশ্বাস করা হয় নির্দিষ্ট কিছু মন্ত্র পড়ে অথবা আঙ্গুল ছুঁইয়ে-ঠেকিয়ে, ব্যক্তির চারপাশে ঘুরে তাকে অপশক্তির প্রভাবমূক্ত রাখা যায়। মূলত ব্রতোৎসব নারীদের অনুষ্ঠান, পুরুষের অংশগ্রহণ তেমন একটা দেখা যায় না। বাংলা মাসভিত্তিক ব্রতগুলি একবার একনজরে দেখে নেব -- বৈশাখ মাস : পুণ্যপুকুরব্রত (বৃষ্টি’র জন্য অদৃশ্য শক্তির পুজো), শিবপুজো (প্রজনন শক্তির পুজো), গোকালব্রত (গৃহপালিত পশুর প্রজনন সংক্রান্ত),
কৃষি সংক্রান্ত বেশ কিছু ব্রত প্রচলিত ছিল য্যামন অশ্বত্থপটব্রত, মধুসংক্রান্তি ব্রত, সন্ধ্যামণি ব্রত, বসুন্ধরা ব্রত ইত্যাদি। জ্যৈষ্ঠ মাস : জয়মঙ্গলের ব্রত (প্রজনন শক্তির পুজো)। ভাদ্র মাস: ভাদুরি ব্রত ও তিলকুজারি ব্রত (কৃষি সংক্রান্ত)। কার্তিক মাস: কুলকুলটি ব্রত, ইতুপুজো ব্রত (প্রজনন শক্তির)। অগ্রহায়ণ মাস: যমপুকুর ব্রত ও তুষতুষলি ব্রত (কৃষিসংক্রান্ত ও গৃহপালিত পশুর প্রজনন শক্তির)। মাঘ মাস: তারণ ব্রত ও মাঘমণ্ডল ব্রত (গৃহপালিত পশুর প্রজনন শক্তির)। ফাল্গুন মাস: ইতুকুমার ব্রত, সসপাতা ব্রত (গৃহপালিত পশুর প্রজনন শক্তির)। চৈত্র মাস: নখছুটের ব্রত । এছাড়াও আরও কয়েকশো ব্রত আছে তিথি-নক্ষত্রভিত্তিক। মঙ্গলকাব্য থেকে উদ্ভুত মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদিও ব্রতোৎসবের অন্তর্গত।
(৪) কামমহোৎসব : প্রাচীন বাঙলার কৃষিসমাজে আর-এক উৎসবের প্রচলন ছিল যেখানে শস্যের ভালো উৎপাদন কামনায় যৌন-উদ্দীপক নাচ ও গানের সঙ্গে মদন ও রতিদেবীর (যৌন-উত্তেজনার দেবতা ‘কাম’ এবং যৌনমিলনের দেবী ‘রতি’) পুজো হয়। সেইসঙ্গে দেওয়া হত নরবলি। কালের পরিবর্তনে এই উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে হোমযজ্ঞ মিলেমিশে নরবলির পরিবর্তে পশুবলির প্রথা শুরু হয় এবং যৌন-উদ্দীপক নাচ ও গানের পাশাপাশি প্রচলিত কিছু ঘৃণার উক্তি, যৌন আবেদনপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি এবং নানান ব্যঞ্জনা যুক্ত হয়। কামমহোৎসব নামক এই উৎসবটি সংঘটিত হত চৈত্র মাসের প্রচণ্ড রৌদ্রে অশোকগাছে নিচে। ফাল্গুনের হোলির সঙ্গে কামমহোৎসব মিলেমিশে যায় এবং আরও কিছুকাল পরে আবীর-কুমকুম খেলা ও রাধা-কৃষ্ণের ঝুলন উৎসবের সঙ্গে মিলেমিশে এই উৎসবটি স্বকীয়তা হারায়। মুসলমান শাসকদের আগমনের ফলে ধর্মীয় কারণে উৎসবটি চিরতরে হারিয়ে যায়। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’, শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’ ও ভবভূতির ‘মালতীমাধব’ নাটকে এই উৎসবের উল্লেখ আছে।
(৫) গাছপুজো : প্রাচীন ভারতের ঋষিরা বলেছেন প্রকৃতির মাঝেই ‘তিনি’ বিদ্যমান। জড় প্রস্তরখণ্ড থেকে শুরু করে গাছপালা-পশুপাখি সবকিছুতেই ‘তিনি’ আছেন। তাদের এ কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে অক্ষম মানুষের দ্বারা ‘ঈশ্বর’ গাছ ও পাথর হয়ে গেছেন । কোনো-কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য গাছপালা ঈশ্বরের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। এখনকার মতো প্রাচীন বাংলায়ও মহিলাদের মধ্যে ভোরে উঠে তুলসী, শেওড়া ও বটগাছ পুজোর প্রচলন ছিল। গ্রামদেবতার সঙ্গে গাছপূজার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একেকটি গ্রামে যে গাছের নিচে আঞ্চলিক দেবতার পূজা হত কোনো-কোনো সময় সেই গাছটিরও পুজো করা হত। কথিত আছে, ভারতের বুদ্ধগয়ায় যেই অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে গৌতমবুদ্ধ বোধিস্বত্ত্ব লাভ করেছিলেন, সেই গাছের পুজো প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে করচগাছের নিচে ‘থান’ তৈরি করে করচগাছেরই পুজো করা হয়। বাংলাদেশের সুন্দরবনে দুর্গাপুজোর তালনবমী তিথিতে অপদেবতার কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে পানের বরজে কলার খোলে পাকা কলা, আতপ চাল, ফুল ইত্যাদি দিয়ে প্রতিদিন নৈবেদ্য দেওয়া হয়। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে আজও বট-অশ্বত্থের বিয়ে দেওয়া হয়। মানুষের বিয়ের মতন সেখানেও খাওয়া দাওয়া হয়, অনুষ্ঠান হয়, তারপর গাছ দুটিকে বেঁধে কোথাও লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই নতুন একটি ‘থান’ তৈরি হয়। বট, অশত্থ, বেল, নিম, তুলসী – এ সবই দেবতার থান হয়, পুজো হয়। বাঁকুড়া জেলার ছাতনার মন্টুমুড়া গ্রামে বিজয়ার দিন গাছেদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন গ্রামবাসীরা। এমন অনেক লৌকিক পুজো আছে যেখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই একসঙ্গে পুজো দেন। মাজারে হিন্দুরা কাপড় না চড়ালে ফুরফুরা শরিফে উৎসব শুরু করা যায় না। কালনার কাঁসারিপাড়ার এক সেবা প্রতিষ্ঠানের পুজোয় মুসলিম মেয়ে ‘কুমারী পুজো’-য় অংশ নেয়।
গাছপুজো কেমন ছিল, এইরকম বর্ননা পাওয়া যায় “সদুক্তিকর্ণামৃত”-এর একটি শ্লোক থেকে --- “তৈস্তৈর্জীরোপহারৈর্গিরি কুহরশিলা সংশ্রয়ার্মচয়িত্বা।/দেবীং কান্তারদূর্গাং রুধিরমুপতরু ক্ষেত্রপালাউ দত্বা।।/তুম্বীবীণা বিনোদ ব্যবহৃত সরকামহ্নি জীর্ণে পুরাণীং।/হালাং মালুরকৌষের্যুবতি সহচরা বর্বরাঃ শীলয়ন্তি।।”
অর্থাৎ বর্বর লোকেরা পশুবলি দিয়ে পাথরের পুজো করে, রক্ত দিয়ে কান্তারদুর্গার পুজো করে, গাছতলায় ক্ষেত্রপালের পুজো করে এবং দিনশেষে তাদের যুবতী সহচরীদের নিয়ে তুম্বীবীণা বাজিয়ে নাচগান করতে করতে বেলের খোলে করে মদ পান করে আনন্দে মত্ত হত।
শুধু গাছই নয়, কিছু কিছু ফল ও শস্যও অন্তর্ভূক্ত ছিল পুজোর। আমাদের নানান আচারানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধান, দুর্বা, কলা, সুপারি, পান, নারকেল ইত্যাদি এখনও পুজোর সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িত। এসব এসেছে প্রাচীন বাঙলার ফল ও শস্যের পুজো থেকে। আখমাড়াই ঘরের দেবতা হিসেবে পুন্ড্রাসুরর পুজো করা হত, এই পুন্ড্রাসুর হল একপ্রকারের আখ। পশ্চিমবঙ্গে এখনও পুন্ড্রাসুরের পুজোর প্রচলন আছে, পরাসুর নামে।
দক্ষিণ রায়, বনদেবী, মারাংবুরু, ভাদু, টুসু, ইতু, মনসা, ওলাউঠা, শীতলা প্রভৃতি লৌকিক দেবতাগণও পেলাম কালে কালে, বিভিন্ন সময়ে। বেদের যুগে অগ্নি, বরুণ তো লৌকিক দেবতাই। এমনকি বেদের যুগের আগেও পশুপতি লৌকিক দেবতা। লক্ষ করুন, এই দেবতারা ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট দেবদেবী নয়, সাধারণের আত্মীয়। সংস্কৃত মন্ত্র নেই, ব্রাহ্মণ-পুরোহিত নেই। এই দেবতারা শান্ত, নরম, সন্তানসম, আদরের। ব্রাহ্মণদের দেবতারা ক্ষতিকর, হিংস্র, ত্রাস সৃষ্টিকারী, অসহিসষ্ণু, কামুক, কামার্ত,
প্রতিহিংসাপরায়ণ, ছিদ্র অন্বেষক -- দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের নামে খুনোখুনি করে। এরা নরকের ভয় দেখায়, স্বর্গের লোভ দেখায়। এ ছাড়া মানুষ যা যা করতে অক্ষম, ঈশ্বরের মধ্যে সেই গুণগুলিই আরোপিত হয়েছে। এর থেকেই স্পষ্ট যে মানুষের দুর্বলতা এবং অসহায়তাই ঈশ্বরের আঁতুরঘর। লক্ষ করুন এইসব প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি সবই উপরের শূন্য থেকে মানে আকাশ থেকেই পতন হয়। অর্থাৎ এইসব অঘটনের ধারণা হল স্রষ্টা, আকাশেই থাকেন এবং অবশ্যই নিরাকার। সে কথা লিপিবদ্ধ হল স্বরচিত ধর্মগ্রন্থগুলিতে, ঈশ্বরের নামে ।
“স্বয়ং ভগবান” হল একটি সংস্কৃত ধর্মতাত্ত্বিক শব্দ। এই শব্দটির মাধ্যমে হিন্দুধর্মে 'ভগবান'রূপী একক সর্বোচ্চ ঈশ্বরের ধারণাটি প্রকাশ করা হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে এই শব্দটির প্রয়োগ সর্বাধিক। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কৃষ্ণকেন্দ্রিক ধর্মতত্ত্বে কৃষ্ণকে “স্বয়ং ভগবান” নামে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা শুধুমাত্র কৃষ্ণকেই “স্বয়ং ভগবান” বলেন। যদিও ভাগবত পুরাণে এর অন্য ব্যবহারও দেখা যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব, নিম্বার্ক সম্প্রদায় ও বল্লভাচার্যের অনুগামীরা কৃষ্ণকে বিষ্ণু ও নারায়ণ এবং তাঁর সকল অবতারের উৎস মনে করেন। এই কারণেই তাঁকে "স্বয়ং ভগবান" বলা হয়। ব্যাসদেব বলছেন, “এই তত্ত্বের জিজ্ঞাসার অর্থ ধর্ম-জিজ্ঞাসা, তত্ত্বজ্ঞ ব্যাক্তিরা অদ্বয় জ্ঞানকেই তত্ত্ব বলে থাকেন। সেই তত্ত্বের অনেক নাম, যেমন – বেদজ্ঞরা তাকে বলে পরাব্রহ্মা, হিরণ্যগর্ভা উপাসকেরা (মহাযোগী) তাকে বলে পরমাত্মা, আর ভগবদ-ভক্তেরা তাকে ভগবান বলে থাকেন, তিনিই একমাত্র পরম সত্য” (শ্রীমভাগবত- ১.২.১১)। “শ্রদ্ধাশালী যে মুনিগণদের বেদান্ত শ্রবণ(বেদান্ত দর্শন উপলগ্ধি),জ্ঞান(আধ্যাত্মিক জ্ঞান),বৈরাগ্যযুক্ত,ভক্তি (ঈশ্বরভক্তি) উৎপন্ন হয়, তারাই স্ব-আত্মা থেকে সেই তত্ত্বর উপলব্ধি করতে পারে” (শ্রীমভাগবত- ১.২.১২)। “যিনি পরম ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী,
জ্ঞান ও বৈরাগ্য গুণযুক্তা তিনিই ভগবান।” এখানে নির্গুণা-পরাব্রহ্মা, হিরণ্যগর্ভা, পরমাত্মা, ভগবান এছাড়া সচ্চিদানন্দ, পরমপুরুষ,
ঈশ্বরের গুণকে মানব কল্যাণের উপর ভিত্তি করে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (বিষ্ণুপুরাণ-৬.৫.৭৯)। সংস্কৃত অভিধানে “ভগবান”-এর “ভগ” শব্দের অর্থ – শ্রী(Fortune),
ঐশ্বর্য(Wealthy),
বীর্য+যশ (Prosperity),
জ্ঞান+বৈরাগ্য (Blessed)। পরাশর মুনি “ভগবান” শব্দটির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন । “ভগ” অর্থ ঐশ্বর্য এবং “বান” অর্থ অধিকারী , যার আছে। ঠিক যেভাবে যার সুন্দর রূপ আছে আমরা তাকে বলি রূপবান, যার ধন আছে ধনবান , ঠিক তদ্রুপ যিনি ভগ অর্থাত্ ঐশ্বর্যের অধিকারী তাকে বলে ভগবান । পরাশর মুনি ভগবান শব্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “ঐশ্বর্য্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ । জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষন্নত্ ভগ ইতিঙ্গনা।।”
-- যার মধ্যে এই ছয়টি গুণ পূর্ণমাত্রায় বর্তমান, তিনি হচ্ছেন ভগবান । সমস্ত ঐশ্বর্য ,সমস্ত বীর্য ,সমস্ত যশ ,সমস্ত শ্রী, সমস্ত জ্ঞান এবং সমস্ত বৈরাগ্য। এই জগতে কেউ বড়ো ধনী হতে পারে, কিন্তু কেউ দাবি করতে পারে না আমি সমস্ত ধনের মালিক । এই জগতে কেউ জ্ঞানী হতে পারে ,কিন্তু সে দাবি করতে পারে না সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী । কিন্তু ভগবান সমস্ত ধন ,সমস্ত জ্ঞান ,সমস্ত সৌন্দর্য ,সমস্ত যশ ,সমস্ত শক্তির অধিকারী , তাই তাকে বলা হয় ভগবান । অনেক পণ্ডিত মনে করেন -- ভগবান শব্দের অর্থ “অশ্লীল”। “ভগবান” শব্দটির স্ত্রীবাচক রূপটি হল "ভগবতী"। তা ছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা, অর্থগত দিক দিয়ে এটি অশ্লীলতার বাহক। ‘ভগবান’ বলতে ঈশ্বরকে বোঝানো হলেও এটি আসলে হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের একটি কুখ্যাত উপাধি। সে তার গুরুপত্নী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করায় গুরুর অভিশাপে তার সর্বাঙ্গে ১০০০ ‘ভগ’ (স্ত্রী যোনি) উৎপন্ন হয় এবং তাতে ইন্দ্রের নাম ‘ভগবান’ (ভগযুক্ত) হয়। ‘ভগবান শব্দটি তাই ইন্দ্রের ব্যভিচারের একটি স্মারকলিপি, নিন্দনীয় বিশেষণ। আবার অনেকে মনে করেন -- ভগ + বান = ভগবান। “ভগ” মানে ভগাঙ্কুর বা যোনি, “বান” মানে শিশ্ন বা লিঙ্গ। ভগ আর বানের ঘর্ষণের ফলে যে প্রাণের সৃষ্টি হয়, তাই-ই ভগবান। অমৃতস্য পুত্রাঃ।
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী ভগবান ও দেবতাদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে | যেমন- দেবতারা হচ্ছেন ভগবানের দ্বারা নিযুক্ত এ জড়জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের নিয়ন্ত্রণ কর্তা | যেভাবে অগ্নি দেবতা অগ্নি নিয়ন্ত্রণ করেন; বরুণদেব জলের নিয়ন্ত্রণ করেন; বায়ু দেবতা বায়ু নিয়ন্ত্রণ করেন ইত্যাদি | শাস্ত্র অনুসারে দেবতারা জীবতত্ত্ব |
যে-কোনো জীব ভগবান থেকে বিশেষ শক্তি প্রাপ্ত হয়ে দেবতাদের আসন গ্রহণ করতে পারেন | কিন্তু ভগবান জীবতত্ত্ব নন, তিনি হচ্ছেন বিষ্ণুতত্ত্ব |
দেবতাদের আধিপত্য এই জড়জগতে সীমাবদ্ধ, কিন্তু ভগবানের আধিপত্য বা ঐশ্বরত্বের প্রভাব জড় ও চিন্ময় জগত সর্বত্র ব্যাপ্ত | দেবতারা মানুষকে একমাত্র ভৌতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করতে পারেন, কিন্তু মুক্তি দিতে পারেন না | ভগবান জীবকে মুক্তি প্রদান করতে পারেন | দেবতারা মায়াধীন, কিন্তু ভগবান হচ্ছেন মায়াধীশ | সৃষ্টি ও প্রলয়কালে দেবতাদেরও প্রভাবিত হতে হয়, কিন্তু ভগবান নিত্য বর্তমান এবং তার ধামও নিত্য বর্তমান | এইভাবে ইন্দ্রলোক, চন্দ্রলোক প্রলয়ের সময়ে সব ধ্বংস প্রাপ্ত হবে | কিন্তু ভগবানের ধাম-বৈকুণ্ঠ, অযোধ্যা, গোলক বৃন্দাবন ইত্যাদি ধ্বংস প্রাপ্ত হবে না | ইন্দ্র, চন্দ্র প্রভৃতি দেবতাগণ প্রকৃতির তিনটি গুণ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন | কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, রাম, নারায়ণ প্রভৃতি গুণাতীত | তাদের কার্যকলাপ প্রকৃতির তিনটি গুণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না |
ভগবানকে কেউ ‘ঈশ্বর’ বলে সম্বোধন করে থাকেন । তাই ‘ঈশ্বর’ শব্দটির অর্থ আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন। শাস্ত্র বা শব্দকোষ অনুসারে ঈশ্বর শব্দের অর্থ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ন্ত্রণ কর্তা অর্থাৎ যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। এই জগতের প্রতিটি জীবের সীমিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে, তাই তারা নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করতে পারে বা দেবতাদেরকে ঈশ্বর বলে গ্রহণ করা যেতে পারে । যেহেতু তারা এই ব্রহ্মাণ্ডের কোনো না-কোনো কার্যের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন । কিন্তু ঈশ্বরকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন । সেই পরমেশ্বরকে জানাই হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য । পরমব্রহ্ম বা পরম ঈশ্বরকে নিয়ন্ত্রন করে থাকেন, তিনিই ভগবান । ভগবান শব্দটি সমাজে যেমন খুশি ব্যবহার হচ্ছে, সেভাবে ব্যবহার করা উচিত নয় । বর্তমান সমাজ যে-কোনো যোগ-সিদ্ধি লাভ করা ব্যক্তির প্রতি এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যা শাস্ত্রবিরোধী ।
“আ হিস্ট্রি অফ গড” গ্রন্থটিতে ঈশ্বর-সন্ধানী ক্যারেন আর্মস্ট্রং লিখেছেন –
“…..আমি ধর্মীয় সংগঠনে যোগ দিই, তরুণ শিক্ষানবিস ‘নান’ হিসাবে ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারি। অ্যাপোলোজেটিক্স, ঐশী গ্রন্থ, ধর্মতত্ত্ব ও গির্জার ইতিহাসে নিজেকে নিযুক্ত করি। মঠের জীবনাচারের ইতিহাস খুঁড়ে বেড়াই এবং আমার নিজস্ব বৃত্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করি, যা আমাদের সম্পূর্ণ কণ্ঠস্থ করতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, এগুলির কোনোটাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভূত হয়নি। সব গুরুত্ব যেন গৌণ বিষয়ের উপর আরোপ করা হয়েছে। ধর্মের বিভিন্ন প্রান্তিক বিষয়াদি মনোযোগ পেয়েছে বেশি। আমি প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেছি, ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে মনের উপর জোর খাটিয়েছি, কিন্তু তিনি আমর নিয়মনীতি ভঙ্গের দর্শক হিসাবে কঠোর প্রভুই রয়ে গেছেন কিংবা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত থেকেছেন। আমি যতই সাধু-সন্ন্যাসীদের পরমানন্দ (rapture) সম্পর্কে জানতে পেরেছি ততই ব্যর্থতার অনুভূতি জেগেছে আমার মনে। …… এরপর দুঃখের সঙ্গে ধর্মীয় জীবন ত্যাগ করি আমি ; ব্যর্থতা ও অপূর্ণতায় ভার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ঈশ্বরে আমার বিশ্বাসও নীরবে বিদায় নিয়েছে বলে মনে হয়েছে।”
তাহলে কি সাধু-সন্ন্যাসীদের দিব্যদৃষ্টি ও পরমানন্দের অনুভূতিও কেবলমাত্র তাদের মানসিক আলোড়নের প্রকাশ ? ঈশ্বর যেন ক্রমবর্ধমান হারে স্থানচ্যুত হয়ে গেছেন বলে মনে হয়েছে, মানবজাতি যাঁকে অতিক্রম করে এসেছে। ক্যারেন আর্মস্ট্রং বলছেন – “মানুষ আসলে আধ্যাত্মিক প্রাণী। প্রকৃতপক্ষেই হোমো সেপিয়েন্সরা আসলে হোমো রিলিজিয়াস বলে তর্ক করার যথেষ্ঠ অবকাশও আছে। নারী ও পুরুষ মোটামুটিভাবে মানুষ হয়ে ওঠার পরপরই দেব ও দেবীর উপাসনা শুরু করেছিল। শিল্পকলার মতোই একই সময়ে তারা ধর্মকে সৃষ্টি করেছে। এটা যে কেবলমাত্র ক্ষমতাশালী শক্তিকে প্রসন্ন করার জন্য ছিল তা নয় ; এইসব আদি বিশ্বাস এই সুন্দর অথচ ভীতি জাগানো জগৎ নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। শরীর যে দুঃখ-কষ্টের তা সত্ত্বেও জীবনের একটা অর্থ অনুসন্ধানে শিল্পের মতো ধর্মও একটি প্রয়াস। অন্য যে-কোনো মানবীয় কর্মকাণ্ডের মতো ধর্মকেও অপব্যবহার করা যায়, আর আমরা যেন সেটাই সবসময় করে এসেছি।”
ঈশ্বর সৃজনশীল কল্পনার সৃষ্টি। ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের ধারণার একটি ইতিহাস আছে, কিন্তু কালের বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে একে ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর কাছে তা বরাবরই পরিবর্তিত অর্থ বহন করেছে। কোনো এক প্রজন্মের এক দল মানুষের সৃষ্ট ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা অন্য এক দল মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে দাঁড়াতে পারে। ‘ঈশ্বর’ শব্দের মাঝে কোনো একক অন্তর্নিহিত অপরিবর্তনীয় ধারণা নেই, বরং শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে যেগুলি আবার পরস্পরবিরোধী। এমনকি একটা অপরটিকে বাতিলও করে। ঈশ্বরের ধারণায় এই পরিবর্তনশীলতা না থাকলে অন্যতম মহান মানবীয় ধারণা হওয়ার জন্য তা টিকে থাকত না। যখনই ঈশ্বর সম্পর্কিত একটি ধারণা অর্থ হারিয়েছে বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীরবে সেটাকে বর্জন করে এক নতুন ধারণাকে সেখানে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। দুর্জ্ঞেয়কে স্বাভাবিক ধারণাগত ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। একেশ্বরবাদীরা এই দুর্জ্ঞেয়কে ‘ঈশ্বর’ আখ্যা দিয়েছে। সেইসঙ্গে চারপাশ জুড়ে কিছু জরুরি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। ইহুদিদের ক্ষেত্রে যেমন ঈশ্বরের পবিত্র নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ। মুসলিমরা যেমন অলৌকিককে দর্শনীয় প্রতিমায় উপস্থাপিত করতে পারবে না। এই বিধানই মনে করিয়ে দেয়, যে সত্তাকে ‘ঈশ্বর’ নামে আখ্যায়িত করি – তা সকল মানবীয় অভিব্যক্তির অতীত।
বস্তুত ঈশ্বরের শুরু হয়েছিল পুরুষদেবতা হিসাবে। একেশ্বরবাদীরা সাধারণত তাঁকে ‘পুরুষবাচক সে’ হিসাবে উল্লেখ করে থাকে।
আসলে কোনো কিছুরই চিরন্তন তাৎপর্য নেই। কোথাও কিছু একটা ভুল আছে, এই বোধ নিয়েই ধর্মের শুরু। প্রাচীন পৌত্তলিকতার যুগে এই বোধ স্বর্গীয় জগৎ আমাদের চেনা জগতের কিংবদন্তীর দিকে টেনে নিয়ে গেছে, যা মানবজাতিকে শক্তি জোগাতে সক্ষম। অদৃশ্য এবং দুর্বোধ্য একজন ঈশ্বরকে কীভাবে জানা সম্ভব ? গ্রিকরা এ ধরনের প্যারাডক্স ভালোবাসত এবং হেসিচ্যাস্টরা ঈশ্বরের সত্তা (Ousia)
এবং তাঁর ‘শক্তি’ (Energeiai) বা জগতে তাঁর ক্রিয়াকর্মের সেই প্রাচীন পার্থক্যে ফিরে যেতে চায়। ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি’ – এই কথাটির বাস্তব কোনো অর্থ নেই। কিন্তু যখন কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মুখে বিশেষ প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হয় তখনই অন্য যে-কোনো বাক্য বা কথার মতো ওই প্রেক্ষাপটে তা অর্থ প্রকাশ করে থাকে।
বাইবেলীয় কাহিনির আলোচনা প্রসঙ্গে হারমান কোহেন যুক্তি দেখিয়েছেন --আমরা যাকে ‘ঈশ্বর’ বলি তা যে কেবল সত্তা স্বয়ং সেই সত্য প্রকাশেরই আদিম অভিব্যক্তি। এটা আমাদের বোধের সাধারণ সত্তাসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা কেবল এই আবশ্যক অস্তিত্বে অংশগ্রহণ করতে পারে। ‘দ্য রিলিজিন অফ রিজন ড্রন ফ্রম দ্য সোর্সেস অফ জুদাইজমেও কোহেন বেশ জোরের সঙ্গে বলেন – ঈশ্বর স্রেফ মানুষের একটা ধারণা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “চতুরঙ্গ”-এ বলেছেন -- "ঈশ্বর যদি থাকেন তবে আমার বুদ্ধি তাঁরই দেওয়া; সেই বুদ্ধি বলিতেছে, যে ঈশ্বর নাই; অতএব ঈশ্বর বলিতেছেন, যে ঈশ্বর নাই…. "
আগেই
বলেছি মুনি-ঋষি-অবতার-পয়গম্বর কেউই ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। তবে দেবতাদের
দেখেছেন নিশ্চয়। প্রাচীন যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো মানুষই ঈশ্বর-ভাবনা এবং ঈশ্বর-ধারণা
নিয়ে কোনোভাবেই ঐক্যমতে পৌঁছোতে পারেনি। তাই প্রাচীন যুগ থেকেই ঈশ্বর-ভাবনা এবং ঈশ্বর-ধারণার
মতানৈক্যকে ভিত্তি
করে নতুন নতুন ধর্মদর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন হিন্দু, ইসলাম, ইহুদি,
খ্রিস্ট, চার্বাক, বৌদ্ধ,
জৈন, শিখ, সিন্তো,
তাও, কনফুশিয়ান, বাহাই
--- এইভাবে প্রায় ৪৩,০০০টি ধর্ম-ভাবনা সৃষ্টি হয়ে গেল ৪৩,০০০ ধরনের ‘ঈশ্বর’, শুধুমাত্র
মতানৈক্যের ফলে। সম্প্রতি David B. Barrett নামে এক গবেষক বিশ্বব্যাপী জরিপ ও অনুসন্ধান চালিয়ে বড়ো ধরনের একটি
ডাটাবেজ তৈরি করেন
এবং “Encyclopedia Britannica” সেটি
প্রকাশ করে। এ ধর্মাবলম্বীরা বলেন তাঁরাই সঠিক ধর্ম, তো ও ধর্ম বলে তাঁদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ।
আমি বলি --- হয় সবার ধর্মই সঠিক, নয়তো
কারোর ধর্মই সঠিক নয়। ধর্ম তো কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী নয় ! তাহলে কেন এতো হানাহানি, খুনোখুনি, কোপাকুপি, কেনই-বা
শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই
! ঈশ্বর কার ? হিন্দুদের, না মুসলিমদের ? তাহলে মানুষের কোনো ঈশ্বর নেই ! এখন প্রশ্ন :
মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ‘ঈশ্বর’,
নাকি ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ‘মানুষ’ ?
“মানুষই
দেবতা গড়ে তাহার কৃপার ‘পরে করে দেবমহিমা নির্ভর”
--- মিথ্যাকে মিথ্যা হিসাবে জেনে বা না-জেনে
এক অদ্ভুত
মানসিক আচ্ছন্নতা ও মোহের ঘোরে আমরা অনেকেই ওই তথাকথিত ‘ঈশ্বর’-কে আঁকড়ে রাখার চেষ্টা
করি। এই আঁকড়ে রাখার মধ্যে কারোর উদ্দেশ্য থাকে মিথ্যা মানসিক সাহস এবং অলীক ভরসার স্থল খোঁজা,
কারোর-বা সরল বিশ্বাসী মানুষদের প্রতারিত করে নিজের
আখের গোছানোর ধান্দা থাকে। ঈশ্বর বিশ্বাসী মাত্রই ধান্দাবাজ এবং প্রতারক নয় --- কিন্তু
ধান্দাবাজ এবং প্রতারক মাত্রই ঈশ্বর বিশ্বাসী, ঈশ্বরের ডাইরেক্ট এজেন্ট।
আসলে
পৃথিবীর সৃষ্ট ভগবানের বোঝা পৃথিবীর ভক্তরাই বয়। ভবানীপ্রসাদ সাহু বলছেন – “ভগবানকে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ
করা অসংখ্য মানুষ ভক্তদের বুঝিয়েছে এবং নিজেরাও হয়তো বিশ্বাস করেছে যে, ভগবান তো যা দেওয়ার আগেই দিয়ে দিয়েছেন।
অর্থাৎ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড,
তার নানা সম্পদ, নানা উদ্ভিদ আর প্রাণী এবং মানুষ,
মানুষের কর্মক্ষম হাত, সক্রিয় মস্তিষ্ক ইত্যাদিসহ। অর্থাৎ
ভগবানের ভাবটা এমনই
যে, আমি তো যা দেওয়ার
দিয়ে দিয়েছি। এবার তোমরা সেগুলির পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে বেঁচেবর্তে
থাকো, করেকর্মে খাও। আমাকে
আর জ্বালিও না।
‘তিনি’ একবার যা দেওয়ার দিয়ে দিয়েছেন, আর নিজের হাতে কিছু দেবেন না --- এসব জেনে বুঝে দেখে শুনেও ঠেকে শেখা
হয়নি। এখনও ঈশ্বর আরাধনা, পূজা-প্রার্থনা
এবং ‘তাঁকে’ সন্তুষ্ট করার জন্য নানা কাজকর্ম বেশ
কিছু করেই চলেছে।
……. সৃষ্টি করেছে নানা
নামের ঈশ্বর, আর নানা ধর্মমতাবলম্বী মানুষের গোষ্ঠী এবং
তাদের মধ্যে অনৈক্য, অবিশ্বাস
এবং খেয়োখেয়ি। হিন্দু-মুসলিম-ইহুদি-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ
--- একই মানুষের মধ্যে কত-না ভাগ এবং তাদের মধ্যে বিদ্বেষ ও হত্যার
ধারাবাহিকতা।”
মানুষ
ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীদের এসব ঝামেলা নেই। ঈশ্বর শুধু মানুষকেই চেনেন
মানুষকেই জানেন --- যা
করেছেন সবই মানুষের জন্যই। দু-চারটে গৃহপালিত পশুপক্ষী ছাড়া ঈশ্বর জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে
বসবাসকারী কোটি কোটি প্রজাতির কোটি কোটি প্রাণীর নাম পর্যন্ত জানেন না। আর সেইসব প্রাণীদের
না-আছে ঐশ্বরিক ধর্ম, না-আছে
ঈশ্বর। কারণ
এরা মানুষ নামক প্রজাতির মতো ধুরন্ধর নয়, বিচক্ষণ নয়। তাদের কল্পনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তথা
মস্তিষ্কের গঠন এত উন্নত নয় যে তারা ‘ঈশ্বর’
আবিষ্কার করবে। বরং মানুষই গোরু বা
শুয়োয়ের মতো ‘সাতে নেই পাঁচে নেই’ প্রাণীদের মেরে মন্দির বা মসজিদের
চাতালে ফেলে দিয়ে দাঙ্গা বাঁধিয়ে মানুষ খুন করে। আল্লা বা ঈশ্বরকে
শিখণ্ডী করে নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব মানুষই স্বেচ্ছায়
কাঁধে তুলে নিয়েছে। ঈশ্বরের ভাবনা যদি মানুষের না আসত তাহলে হত পৃথিবীর
সভ্যজগত ? নিশ্চয় অন্যরকম হত। মন্দির-মসজিদ-গির্জাহীন
পৃথিবীও থাকত। সভ্যতারও পরিবর্তন হত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ঈশ্বর ছাড়া সভ্যতার বিকাশ নিশ্চয়
আটকে থাকত না ! বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩% মানুষ নিজেদের নাস্তিক
বলে পরিচয় দেয় এবং ১১.৯% মানুষ কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জাপানের
৬৪% থেকে ৬৫% নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায়
৪৮% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৬% (ইতালি)
থেকে শুরু করে ৮৫% (সুইডেন) পর্যন্ত। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণভাবে ধর্মহীন বা
পারলৌকিক বিষয়সমূহে অবিশ্বাসী হিসাবে গণ্য করা হয়। এদের প্রগতি কি থেমে গেছে
? এরা কি নিরাশ্রয় ? এরা এবং এদের দেশ কি রসাতলে গেছে ?
গোটা
পৃথিবী জুড়ে সর্বমোট জনসংখ্যা ৭.২৮ (7.28 billion people as of January
2015) বিলিয়ন। এই ৭.২৮ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ২.২ বিলিয়ন (2.2 billion), ইসলাম ধর্মাবলম্বী ১.৮ বিলিয়ন (1.8 billion), ধর্মহীন মানুষ ১.১ বিলিয়ন (1.1
billion), হিন্দু বা সনাতন
ধর্মাবলম্বী ১ বিলিয়ন (1 billion), বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৩৭৬
মিলিয়ন ইত্যাদি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার বিচারে খ্রিস্টান ৩১.৫ %,
ইসলাম ২৩.২ %, হিন্দু ১৫ %, বৌদ্ধ
৭.১ %। বিশ্বের ২১০ কোটি লোক
বলছে “গডই একমাত্র সত্য”। বিশ্বের ১৪০ কোটি লোক বলছে “আল্লাহই একমাত্র সত্য”। বিশ্বের ৯০ কোটি লোক বলছে “ঈশ্বর
বা ভগবানই একমাত্র
সত্য”। বিশ্বের ১১০ কোটি লোক বলছে “কোনো ঈশ্বর-ধারণাই সত্য নয়”। একাধিক ঈশ্বর,
একাধিক ধর্ম এবং একাধিক মতবাদ। কেন,
একাধিক কেন ? এদের সবার দাবি এক সঙ্গে সঠিক হতে পারে না। হয় সকলেই সঠিক,
নয় সকলেই বেঠিক। কে বলে দেবে --- “কে সঠিক কে বেঠিক ?” কেউ বলে দেবে না। কারণ বলে দেওয়ার মতো
কেউ নেই।
স্বয়ং ঈশ্বরও নেই !
বিশিষ্ট
বিজ্ঞানী ডঃ রমেন্দ্রকুমার পোদ্দারের ভাষায় -- বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে প্রাণ, কোনো কিছুই ঈশ্বরেষ সৃষ্টি নয়। …… ঈশ্বর এসব কিছুই সৃষ্টি করেননি, এসব সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টির নিয়মে এবং হঠাৎ একদিনে
সৃষ্টি হয়নি। হয়েছে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। প্রকৃতির রাজ্যে যে রূপান্তর জন্মলগ্ন
থেকে শুরু হয়েছিল, তা সম্পূর্ণই উদ্দেশ্যহীনভাবে আজও
ক্রিয়াশীল। এই পৃথিবীতে যা কিছু দেখছেন -- সমস্ত পদার্থ, গাছপালা, পশুপাখি,
কীটপতঙ্গ, ভাইরাস-ব্যাকটিরিয়া, মানুষ ইত্যাদি সমস্ত কিছু কতকগুলো পরমাণুর সমষ্টি। A
collection of atoms. মানুষের ক্ষেত্রে শুধু Collection
of atoms বললে হয় না, বলতে হয় a highly organized collection of atoms. কারণ প্রকৃতির রাজ্যে হল সর্বোন্নত জীব।
মানুষ এসেছে সবার
শেষে। মানুষের আগমন মাত্র ৩০ লক্ষ বছর আগে। মানুষও একবারে টুপ করে পৃথিবীতে এসে পড়েনি।
এককোষী প্রাণীর থেকে যে রূপান্তর সৃষ্টি হয়েছিল, তারই শেষ পরিণতি মানুষ। এবং সর্বশক্তিমান মানুষ তামাম পৃথিবীর সকল
বস্তুকে বশে আনল,
আর পৃথিবীর সমস্ত স্থাবর-জঙ্গম মানুষের
দ্বারা বশীভূত হল, মানুষের দাসে পরিণত হল। মানুষ
মানুষকেও দাস বানাতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। অবশেষে Man created God in his own
image. তবে সনাতনী ভক্তরা কখনোই মূর্তির পুজো
করেন না,
করেন মূর্তিতে ভগবান বা দেবদেবীর পুজো।
প্রার্থনার মাধ্যমে মূর্তিভাব দূর করে ভগবদভাবে পুজো করে। সনাতনীরা মনে করেন এইভাবে মূর্তিতে
ভগবানের পুজো
করলে সমস্ত স্থান ভগবদভাবে পরিপূর্ণ হয়। ভগবদ পুজোয় ভগবানের উপর ভক্তিভাবের আরম্ভ হতে
থাকে।
আমাদের
গ্যালাক্সির নাম "মিল্কি ওয়ে" বা "আকাশগঙ্গা"। এই
গ্যালাক্সিতে প্রায় ১০০ কোটি নক্ষত্র আছে, সূর্য তার মধ্যে একটি নক্ষত্র। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রায় ১০০ কোটি
গ্যালাক্সি রয়েছে। এই নিয়ে হল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটি
শক্তিতে চালিত
হচ্ছে এবং সেখানে শক্তির অনেক রূপান্তরও ঘটে চলেছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মৌলিক শক্তির কোনো
সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। কিন্তু রূপের পরিবর্তন আছে। যেমন বিগ ব্যাং থেকে শুরু
করে নানা রূপের পরিবর্তন ঘটিয়ে অর্থাৎ শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হতে হতে শেষে
ব্ল্যাক হোল বা
কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। প্রশ্ন হল শক্তি কি তাহলে বিগব্যাং থেকেই শুরু..? না, একদম তা নয়। তার আগেও শক্তি ছিল কিন্তু অন্য রূপে ছিল। শক্তির নিত্যতা সূত্র থেকে আমরা জানি
যে শক্তি অবিনশ্বর, অর্থাৎ
শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধু
এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত করা যায় মাত্র, যেমন আলোকশক্তি থেকে তাপশক্তি, তাপশক্তি থেকে তড়িৎশক্তি, তড়িৎশক্তি থেকে যান্ত্রিকশক্তি, যান্ত্রিকশক্তি থেকে শব্দশক্তি ইত্যাদি।
ভরহীন কোনো পদার্থ কল্পনা করা গেলে সেখানেই শক্তি শূন্য হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে
ভরহীন কোন পদার্থের
অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, যদিও
বিজ্ঞানীদের মতে ফোটন ভরহীন কণা হলেও হতে পারে, তবে
সেটিও বিতর্কিত। যাই হোক, ভরের
সঙ্গে শক্তির এই নিবিড় সম্পর্ক। এবার আসা যাক আস্তিকগণ এবং নাস্তিকগণের কথায়।
আস্তিকগণ বলবেন, এই মৌলিক শক্তিই হল
ঈশ্বর এবং এই শক্তিকেই তাঁরা ভক্তি করেন। নাস্তিকগণ বলবেন
এই শক্তির যখন কোনো সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই
তখন এর কোনো সৃষ্টিকর্তা বা ধ্বংসকর্তা নেই, তাহলে
ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোথায়..? খোঁজ
চলছে। নিরন্তর খোঁজ। হাজার হাজার বছরের খোঁজ। যে ‘ঈশ্বর’ বিষয়ে
বিজ্ঞান কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি, সেই
‘ঈশ্বর’-কে অ-জ্ঞানীরা কেমন যেন চরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সব জেনে গেলেন ! এরা
ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে কীভাবে যেন অবিচল অনড় থাকে। ঈশ্বর আছে কী নেই সেটা প্রশ্ন
নয় – প্রশ্নটা বিশ্বাসের,
লড়াইটা বিশ্বাসের, দাঙ্গাটাও বিশ্বাসের, রক্তবন্যাও বিশ্বাসের, নাস্তিক-হত্যাও বিশ্বাসের, প্রতিমা ভাঙাও বিশ্বাসের। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বলছেন
--- “ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃণ্য চতুরতা,/ মানুষের
পৃথিবীকে শত খণ্ডে
বিভক্ত করেছে/ তারা টিকিয়ে রেখেছে শ্রেণীভেদ ঈশ্বরের নামে।/ ঈশ্বরের নামে তারা অনাচার
করেছে জায়েজ।”
যদি
বলেন, ঈশ্বর বিষয়ে আমার বক্তব্য কী ? আমি বলব -- আমার কাছে বস্তুবাদী ভাবনায় ‘সূর্য’-ই সমগ্র পৃথিবীর প্রাণীদের একমাত্র দেবতা। সূর্যই নিরপেক্ষ, বৈষম্যহীন, সমবণ্টক, শক্তিদাতা।
সূর্যের কাছে ধনী-দরিদ্রের বিভেদ নেই, সূর্যের
কাছে ব্রাহ্মণ-শূদ্রের
বিভেদ নেই, সূর্যের কাছে
শিয়া-সুন্নি-মুসলিম-কাফেরের বিভেদ নেই, সূর্যের
কাছে প্রোটেস্ট্যান্ট-ক্যাথলিকের বিভেদ নেই, সূর্যের কাছে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ বিভেদ নেই। এমন ঈশ্বর সবার।
“নিশ্চর্মণ
ঋভবো গামপিংশত সংবৎসেনা সৃজতা মাতবং পুনঃ।” – অর্থাৎ “হে
ঋভুগণ ! তুমি
গাভীকে চর্ম দ্বারা আচ্ছাদন করিয়াছিলে এবং সেই গাভীকে পুনরায় বৎসের সহিত যোগ করিয়াছিলে।”
ব্যাখ্যা : পৃথিবীর জন্ম বা জীবনসৃষ্টি
সূর্যরশ্মিরই অবদান।
গো শব্দে পৃথিবীকেও বোঝায়। পৃথিবীকে চর্মাচ্ছাদিত করার ক্ষেত্রে সূর্যরশ্মির কর্তৃত্ব
অনস্বীকার্য। তৃণ, উদ্ভিদ ও তরুলতায়
পৃথিবীর আচ্ছাদন গাভীর কঙ্কালে চর্ম-সংযোজন। পৃথিবীতে অন্ধকারের আবরণও তো
সূর্যকিরণেরই সৃষ্টি।
তা সত্ত্বেও কেউ যদি বলেন সূর্য সৃষ্টি করল কে ? সেই স্রষ্টাকে সৃষ্টি করল কে ? কৃষ্ণগহ্বরের বিস্ফোরণ থেকে সূর্য থেকে
সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সির
সৃষ্টি। কৃষ্ণগহ্বর কে সৃষ্টি করল ? ইত্যাদি। আমি বলি, সৃষ্টি আর যেই করুক সে কখনোই মানুষের
নির্মিত-কল্পিত দেবতা-ঈশ্বর-আল্লাহ নন। সেই দেবতা-ঈশ্বর-আল্লাহ কোনো
ধর্মগ্রন্থ লেখেননি। সেই দেবতা-ঈশ্বর-আল্লাহ কোনো ধর্ম এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি
করেননি। সেই দেবতা-হিন্দু
আল্লাহ-কুতুবউদ্দিনকে হত্যা করতে উদ্যত হয় না। সেই আল্লাহ-মুসলিম দেবতা-হিন্দুদের প্রতিমা
ভাঙে না। সেই আস্তিক-আল্লাহ নাস্তিক-আল্লাহর মুণ্ড চাপাতি দিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে দেয় না।
সেই দেবতা-হিন্দু
আল্লাহ-এখলাককে গোমাংস ঘরে রাখার অভিযোগে হত্যা করে না। মানুষের তৈরি এইসব আল্লাহ-দেবতা-গডদের
কোনো ক্ষমতা নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং সমস্ত জড়-প্রাণ যদি সত্যিই কেউ
সৃষ্টি করে থাকেন, সেই স্রষ্টার পক্ষে-বিপক্ষে একটি
কথাও মানুষের উচ্চারণ করার অধিকার নেই। মানুষ সেই স্রষ্টার বিষয়ে কিস্যু জানে না। না
আস্তিকরা জানে, না নাস্তিকরা জানে।
না হিন্দুরা
জানে, না মুসলিমরা জানে।
কেউ জানে না। বেদের ঋষিরা বা পুরাণের রচয়িতারা কেউ কোথাও ঈশ্বর প্রত্যক্ষ
করেছেন বলে দাবি করেননি। শুধু সনাতন ধর্মেই নয়, অন্য কোনো ধর্মের প্রবর্তকরাই সে দাবি করে না। মহাব্রহ্মাণ্ডের কাছে মানুষ একটি অতি
ক্ষুদ্র সরষের দানার মতো অস্তিত্ব। বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড তার জ্ঞানের বিষয় নয়। যে ঈশ্বর নিয়ে
মানুষ খুনোখুনি করে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, মানুষ পুড়িয়ে মারে, মন্দির-মসজিদ গুড়িয়ে দেয় – সেই ‘ঈশ্বর’ মানুষ
তৈরি করেছে
মানুষের জন্যই। যে ঈশ্বর জীবদ্দশায় মানুষকে দু-বেলা দু-মুঠো অন্নের জোগান দিতে পারে না,
সেই ঈশ্বর পরকালে কী দেওয়ার ক্ষমতা রাখে
! রোজা-উপবাস করে
যদি আল্লাহ-ঈশ্বরের বান্দা-দাস হওয়া যেত, তাহলে পৃথিবীর লাখো লাখো মানুষ যারা দিনের পর দিন ভুখা থাকে তারাই
সবার আগে আল্লাহর ‘বান্দা’ বা ঈশ্বরের ‘দাস’ হবেন।
গঙ্গাজলে যদি সব শুদ্ধ হয়ে যেত, তাহলে
প্রতিদিন গঙ্গায় এসে যারা স্নান সারেন তাদের শুদ্ধতা প্রশ্নাতীত হত। ঈশ্বর,
আল্লাহ, গড – এসব
নানাবিধ ধারণা গ্রুপবাজিরই ফল। আসলে মানুষের সভ্যতাই গ্রুপবাজির সভ্যতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাস। যদি ভাববাদী ভাবনায় বলি, তাহলে বলব ভাববাদী ভাবনায় ‘সময়’-ই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো দেবতা। সময় বিমূর্ত, সময় অপ্রত্যক্ষ। সব ধ্বংস আর সৃষ্টির জন্য
সময়ই দায়ী। সূর্য মূর্ত, কিন্তু মূর্তি নয়। পরিশেষে
বলব সূর্য অথবা সময়ের চেয়ে বড়ো দেবতা বা ঈশ্বর দুনিয়াতে আর দ্বিতীয় নেই। এক এবং অদ্বিতীয়। এটা
বিশ্বাস নয়, যুক্তিবিজ্ঞান।
===================================================
তথ্যসূত্র: (১) পৌরাণিক অভিধান --
সুধীরচন্দ্র সরকার, (২)
সনাতন ধর্ম: মত ও মতান্তর -- রণজিৎ কর, (৩) সিন্ধু থেকে হিন্দু -- ড. আর এম দেবনাথ, (৪) ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রাচীন ভারতীয়
প্রেক্ষাপট -- নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, (৫) বাঙালির ইতিহাস --- নীহাররঞ্জন রায়, (৬) বিজ্ঞানের চোখে ভগবান – ভবানীপ্রসাদ সাহু, (৭) মার্কেণ্ডয় পুরাণ -- শ্রীসুবোধকুমার
চক্রবর্তৗ, (৮) A History
of God – ক্যারেন আর্মস্ট্রং (অনুবাদ – শওকত হোসেন), (৯) হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ – হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য। (১০) মূর্তিপূজা কী ও কেন
-- ভবেশ রায় সম্পাদিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন