জ্যোতিষীবাবুদের
গ্রহ, নক্ষত্র, রাশি, লগ্নের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
(১) ১৮ ডিগ্রির এক টুকরো আকাশে যদি ১২ টি রাশি
থাকে, তাহলে ৩৬০ ডিগ্রি আকাশে ডিগ্রির আকাশে কত লক্ষ রাশি থাকতে পারে ভাবুন। তবে তো
খুব ভয়ানক ব্যাপার, এত লক্ষ লক্ষ রাশির প্রভাব হিসাবে উচিত নয় ? জ্যোতিষীবাবুরা কী
বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(২) জন্মকালে চন্দ্র যে রাশিতে থাকে সেটিই জাতকের
রাশি বলা হয়। শুধু চন্দ্র কেন, সৌরজগতে তো আরও অসংখ্য গ্রহ আছে উপগ্রহ আছে – সেগুলি
বিচার্য নয় কেন ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৩) জাতকের জন্মসময় কোনটি ? এটা বড্ড গোলমেলে ব্যাপার
! কেউ মনে মনে করেন মাতৃজঠরে ভ্রূণের প্রথম দিন, কেউ মনে করেন মাতৃজঠরে থাকাকালীন যেদিন
শরীরে প্রাণসঞ্চার হয়, কেউ মনে করেন যেদিন শিশু মাতৃগর্ভ ত্যাগ বেরিয়ে আসে, আবার কেউ
মনে করেন শিশুর নাড়ি কাটার সময়, কেউ আবার এত ঝামেলায় না-গিয়ে চিকিৎসকের দেওয়া সার্টিফিকেটের
জন্মসময় গ্রাহ্য করে – এক্ষেত্রে আবার সংশয়, চিকিৎসক বা চিকিৎসা-কর্মীরা যে সময় নথিভুক্ত
করেছেন সেটা কতটা অথেনটিক ! যাই হোক, জ্যোতিষীবাবুরা কোন জন্মসময় বিচার করে জাতকের
কোষ্ঠী বিশ্লেষণ করবেন ? ভিন্ন ভিন্ন সময়কে জন্মসময় ধরলে ভিন্ন কোষ্ঠী বিচার হবে না
? হবেই তো। রাশির অবস্থান পালটালে নির্ণয়ও পালটাতে বাধ্য।এক্ষেত্রে অবশ্য জ্যোতিষীবাবুরা
বলেন, লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকাল ব্যতীত লগ্ন-মধ্যবর্তী সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের সন্নিবেশের
এমন কিছু তারতম্য হয় না, ফলে রাশি পালটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ও মা, সে কি কথা !
যদি জমজ সন্তান হয় ? তাদের কোষ্ঠীবিচার তো একই হবে। মানে তারা একই সময়ে পটি করতে যাবে,
একই শিক্ষকের কাছে পড়বে, একইরকম বিদ্বান হবেন, একই ক্লাসে পড়া শেষ করবে, একই জায়গায়
একই চাকরি করবে, একই মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করবে, একই দিনে একই সময়ে একই কারণে মরবে
– তাই-ই হবে, জ্যোতিষ বিজ্ঞান হলে।হয় কী ? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মানোর পরপরই একটি
সন্তান মারা যায়। তাহলে একই লগ্ন, একই গ্রহস্থান, একই রাশিচক্র হওয়া সত্ত্বেও দুইজন
জাতকের আয়ুষ্কাল দুই রকমের হবে কেন ? তাহলে কী পৃথিবীর সকল জমজ জাতকই লগ্ন পরিবর্তনের
সন্ধিকালে জন্ম নেয় ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? অবশ্যই নিরুত্তর থাকেন।
(৪)
পুব আকাশে রাশি উদয় হয়—এই বিষয়টি এক্কেবারেই আপেক্ষিক। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে
স্থানীয় সূর্যোদয়কাল বিভিন্ন হওয়ার ফলে পুবদিকে উদিত রাশিটি ভিন্ন হবে। ফলে একই সময়ে
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো জাতকের লগ্ন বিভিন্ন রকমই হবে, কোষ্ঠীও হবে বিভিন্ন।অতএব
একই সময়ে জন্মানো সত্ত্বেও আলাদা আলাদা জাতকের আলাদা লগ্নফল এবং কোষ্ঠীচক্র হবে না,
তাই তো ? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৫)
জ্যোতিষীদের যে শাস্ত্র, তা ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে মেনে চলে। অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র
করে সূর্য সহ সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্ররা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তত্ত্ব তো অচল তত্ত্ব, আস্তাকুড়ে
তার ঠিকানা। এই ধরনের তত্ত্ব কে. সি. পালের মতো বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে পারেন, যারা
ভাঙা রেকর্ডের মতো এখনও চলেছেন ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’।এই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে
থাকলে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলতে অসুবিধা আছে। ভুল হবে রাশি-গ্রহের অবস্থান। সঠিক হবে
না রাশিচক্র, কোষ্ঠী-ঠিকুজি।এ তত্ত্ব সঠিক হলে গ্রহ-উপগ্রহগুলিতে মহাকাশযান কিংবা কৃত্রিম
উপগ্রহ পাঠানো সম্ভব হত না।ওই তত্ত্ব ভুল, তাই জ্যোতিষ ভুল।জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন
এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন।
(৬) কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীবাবুরা যোটক বিচার করে।
অর্থাৎ পাত্রপাত্রীদের রাজযোটক হলে দাম্পত্যজীবন বড়োই সুখময় হয় !!! যোটক বিচার কাকে
বলে ? এককথায় – “বিবাহের পূর্বে পাত্র এবং পাত্রীর পরস্পরের জন্মরাশ্যাদি থেকে যে শুভাশুভ
বিচার করা হয়, তাকে রাজযোটক বলে”।এই বিচার আট প্রকার, অর্থাৎ আট প্রকারের কূট। ‘কূট’
কথাটির অর্থ জটিল। জ্যোতিষীবাবুরা প্রবল কূট বলে দু-হাতেই আট প্রকারের ‘কূট’ সামাল
দিতে পারেন। এই কূটগুলি হল – বর্ণকূট, বশ্যকূট, তারাকূট, যোনিকূট, গ্রহমৈত্রীকূট, গণমৈত্রীকূট,
রাশিকূট এবং ত্রিনাড়িকূট। এদের আবার ‘গুণ’ আছে। ‘বর্ণকূট’ থেকে ‘ত্রিনাড়িকূট’ পর্যন্ত
গুণ হবে ১,২,৩ ইত্যাদি। মোট নম্বর ৩৬-এর মধ্যে ১৮ নম্বর পেতেই হবে, আর তা না-হলে ডাহা
ফেল।যদি ৩০-এর উপর নম্বর হয় তাহলে লেটার মার্কস হবে। একটু ‘যোনিকূট’ নিয়ে বিশ্লেষণ
করা যাক – যোনি চোদ্দ প্রকার। দুটি করে নক্ষত্র নিয়ে এক-একটি যোনি। অভিজিৎ নক্ষত্রকে
ধরে নক্ষত্রের সংখ্যা ২৮।অবশ্য সবকটি যোনিই ইতর-যোনি, অর্থাৎ ঘোড়াযোনি, মোষযোনি, বাঘযোনি,
সিংহযোনি, হাতিযোনি, কুকুরযোনি, বেড়ালযোনি, ইঁদুরযোনি, বানরযোনি ইত্যাদি। না, মানুষের
জন্য মনুষ্যযোনি নেই। তামাম মনুষ্যকুল ইতর-যোনির অংশ।ছাগল, কুমির, হাঙ্গর, গোরিলা,
গোসাপ, শিম্পাঞ্জি, টিকটিকিদের কি যোনি নেই !
আমার
বিয়ের সময় আমার শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিস পাত্রের কোষ্ঠী দেখাতে হবে। বড়োই
বিপদে পড়ে গেল আমার অভিভাবক। কারণ আমার কোনো কোষ্ঠী-ঠিকুজি ছিল না। অতএব জ্যোতিষে শরণাপন্ন।
জ্যোতিষীকে বলে আমার একটা ‘রাজযোটক’-এ মিল হয়েছে এমন একটা কিছু করিয়ে আনা হল। কেল্লা
ফতে, বিয়ে পাক্কা।আদতে আমার রাশি, লগ্ন, কোষ্ঠী কিছুই নেই – তার আবার রাজযোটক ! আমার
১২ বছরের সংসার দিব্য চলছে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়ো মেয়ের বিয়ে
ছিল রাজযোটক। ভাটপাড়ার জনৈক জ্যোতিষী মেয়ে আর হবু জামাইয়ের কোষ্ঠীবিচার করে সেটাই বলেছিলেন।
রাজযোটকের বিয়ে, তা সত্ত্বেও বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের বড়ো মেয়ে বিধবা
হয়ে যান। এরকম হাজার হাজার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা যায়, যেখানে রাজযোটক হওয়া সত্ত্বেও
বিয়ে অকালে নষ্ট হয়ে গেছে। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকেন। (৭)
একদা, মানে দেড়শো বছর আগে পর্যন্ত জ্যোতিষীবাবুরা বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকলে
বাল্যবিবাহের নিদান দিতেন। তাই ওই সময় প্রায় সকল মেয়েদেরই বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে
কোণে থাকার ফলে বাল্যবিবাহ হত। ১৯৯৯ সালে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন,১৯৯৯’ চালু হওয়ার পর
থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে গেল। বলবান সপ্তমপতি গেল কোথায় ? কেন্দ্রের কোণে আর থাকেন
না ? গেছে।ভুল।জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে ? নিরুত্তর থাকবেন।