এতক্ষণ আমরা যে যে বিষয়গুলি আলোচনা করলাম তার সবকটিই লিখিত নয়, লোকের মুখে মুখে শুনে বংশপরম্পরায় প্রচারিত ও মান্য করা
হত। পরে এগুলি লিখিত আকারে সংরক্ষিত করা হয়। সেই লিখিত আকারই ছাপার অক্ষরে আমাদের
কাছে সুলভ হয়েছে আরও পরে। এবার আমি এমন কিছু গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করব যেগুলি প্রায়
গোড়া থেকেই লিখিত রূপ ছিল, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে
ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে আসছে। আসলে প্রাচীন যুগে সব সাহিত্যই হত রাজকাহিনি এবং এই
রাজকাহিনি হৃষ্টপুষ্ট হত ঈশ্বরের উপস্থিতিতে। কারণ যতসব অবাস্তব অলৌকিক কাণ্ড
ঘটিয়ে রাজাকেই সর্বোচ্চে রাখতেন প্রাচীন যুগের কবিরা। এইসব কবিরা রাজার
তত্ত্বাবধানে থেকে রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজার গুণকীর্তন করতেন এবং ঈশ্বরপুষ্ট হয়ে
রাজকাহিনি লিখতেন। সেই কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে যেখানেই অন্যায় অবিচার অবমাননার
প্রয়োজন সেখানেই ঈশ্বরের অনুষঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। ঈশ্বর ছাড়া অবাস্তব কাহিনি
উপস্থাপন করার সুযোগ কোথায় যেমন – রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদভগবদগীতা ইত্যাদি। শাসকের অন্যায় কাজকর্মগুলিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা
করা হত নিজেদের মানদণ্ডে যুক্তি খাড়া করে। বস্তুত আর্য ভার্সেস অনার্যের
ন্যায়-অন্যায়ের কাহিনি। মোগলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু
বহিরাগতই ছিল না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠী এবং
তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও রোলার চালিয়েছিল, চালিয়েছিল ব্যাপক আক্রমণ, হত্যাকাণ্ড। আর
এই আক্রমণই আর্য-অনার্যের যুদ্ধ, সুরাসুরের জমি
দখলের লড়াই। আর্যরা সেইসব দেবদেবতা -- অনার্যরাই দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ষস, অসুর সাব্যস্ত হল। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারত
উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীরা আর্যদের পক্ষেই থেকে গেলেন। অথচ তারা ভুলে যায় একদিন
আর্যদের আক্রমণের ফলেই ধ্বংস হয়ে যায় আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ
সিন্ধুসভ্যতা। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠীকে দাসে পরিণত করার লক্ষ্যে যে
চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, শেষপর্যন্ত এতে সফলও হয় তারা। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই
হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক, দেবতা বা দেবতাতূল্য। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে
ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসাবেই স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা
বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত
সংবিধান হয়ে ওঠল 'মনুসংহিতা’। যেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক
অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যারা এই
ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে বিদ্রোহী করতে থাকল, তারাই অছ্যুৎ, দস্যু, অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। এইসব অস্পৃশ্যদের
যখন খুশি ন্যাংটো করে দেওয়া যায়, ন্যাংটো করে
দৌড় করানোও যায়।
আশির দশকের মাঝামাঝি বছরে রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’ ভারতের দূরদর্শনে ইতিহাস সৃষ্টি
করেছিল। হয়েছিল তুমূল বিতর্ক। বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শকরা অভিযোগ করতে থাকলেন যে
তাঁদের রামায়ণে যা আছে রামানন্দ সাগরের রামায়ণে তা মিলছে না। সেই বিতর্ক মেটাতে
রামানন্দ সাগর টাইটেলে বিস্তারিত জানিয়ে দিলেন কোন্ রামায়ণের কোন্ কাহিনি।